ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৫

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৫
তাজরীন ফাতিহা

ঢাকা শহরে জ্যাম চরম অসহ্যকর একটা মুহূর্ত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় গাড়িগুলো একটার পর একটা সারিবদ্ধ কিংবা পাশাপাশি যেভাবে মিশে থাকে এতে যেকোনো সুস্থ মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। গরমের তীব্রতায় ঘেমে নেয়ে একাকার মারওয়ান। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। এই মুহূর্তে তার অবস্থান সিএনজিতে। জ্যামে আটকে বসে আছে তারা। মেজাজের পারদ উচ্চ সীমায় পৌঁছেছে তার। মাথাটা ঠান্ডা করতে একটা সিগারেট ধরালো সে। সিএনজি চালক একটু পর পর সামনের গ্লাসে দৃষ্টি দিচ্ছে। জিভ বের করে চাটছে। আয়নাটা নিশাত বরাবর। ব্যাপারটা মারওয়ান সিগারেটে লম্বা টান দিতে দিতে বেশ ভালোভাবেই অবলোকন করল। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে চাইল। নিশাত ঘুমন্ত নাহওয়ানকে কোলে নিয়ে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। মারওয়ান নিশাতের হাতে চাপ দিল। নিশাত চোখ খুলে মারওয়ানের দিকে চাইল। মারওয়ান নাহওয়ানকে কোলে তুলে ইশারায় তার সিটে বসতে বলল। দুজনে জায়গা অদল বদল করল। সিএনজি চালক নিজের ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে যখন আবারও আয়নায় নজর দিল তখন ঝটকা খেল। আয়নায় মারওয়ানকে মুখে সিগারেট ধরা অবস্থায় তার দিকে কৌতুকপূর্ণ ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে নিজের ফোনে নজর দিতেই পিছন থেকে মারওয়ান বলল,

“ভাই কি বিবাহিত?”
সিএনজি চালক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। মারওয়ান এবার আয়েশ করে বসে বলল,
“ওহ আচ্ছা। এইযে গাড়িগুলো একজায়গায় স্থির হয়ে আছে এবং এর পচাৎদেশ হতে যে কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে এগুলোর থেকে কোন কোন গ্যাস নির্গত হচ্ছে জানেন?”
প্রশ্নটায় সিএনজি চালক কিছুটা চিন্তিত হলো। নিশাত মারওয়ানের এমন উদ্ভট আলাপে বিরক্ত হলো। হঠাৎ করে এই লোকের কি হলো? আজগুবি প্রশ্ন করছে তাও আবার ড্রাইভারকে। অন্যান্য দিন তো মুখ দিয়ে কথাই বের হয়না আজকে আলগা কথা বলছে কেন কে জানে? হাসপাতালে থেকে এসে কি মাথা আউলিয়ে গেছে? সিএনজি চালক আমতা আমতা করে বলল,
“ভাই হুনছি বিভিন্ন ঘ্যাস বাহির হয় তয় কি ঘ্যাস ওইডা কইতে পারুম না।”
মারওয়ান মাথা নাড়িয়ে বলল,
“কোনো ব্যাপার না, আমি বলে দিচ্ছি। কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, হাইড্রো কার্বন, পার্টিকুলার ম্যাটার ইত্যাদি ইত্যাদি বিষাক্ত গ্যাস ধোঁয়ার সাথে বের হয়।”
সিএনজি চালক মাথা নাড়িয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ভাই আমি মূর্খু মানুষ। এতগুলা ঘ্যাসের নাম জাইনা আমার কাজ কী? কতোলা কঠিন কঠিন ব্যাবাক নাম।”
“অবশ্যই দরকার আছে। মনে করুন ঠাস করে মরে গেলেন। সবাই জিজ্ঞেস করবে, আহা বেচারা কেমনে মরল। কত ভালো মানুষ ছিল, আচমকা মরে যাওয়ার কারণ কী? তখন তো ডেথ সার্টিফিকেটে এসব লিখতে হবে।”
সিএনজি চালক ভয় পেয়ে গেল তা তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠল।
“ভাইসাব, এগ্লা কেমুন কথা?”
“এসবই সত্য কথা। এখন আমার কি ইচ্ছে করছে জানেন?”
“কি ইচ্ছা করছে?”
“এখন আমার ইচ্ছে করছে গাড়ির পিছন দিয়ে যে বিষাক্ত কালো বাষ্প বেরিয়ে আসছে সেই সাইলেন্সার পাইপের মুখে আপনার মুখ স্কচ টেপ দিয়ে আটকে সোজা আজারাইলের কাছে ছেড়ে আসি।”
মারওয়ান এতক্ষণ রসাত্মক কণ্ঠে কথা বললেও এবার তার কণ্ঠ বেশ উঁচু এবং চড়া মনে হলো। সিএনজি চালক আঁতকে উঠে বলল,

“এসব কেমুন কথা কন ভাইসাব? একটা মাইনষের মৃত্যু চাওন কিন্তু ইসলামে জায়েজ নাই।”
“ওরে বাপরে, এ দেখি মাওলানা সুফি দরবেশ ওরফে পীর সাহেব! নজর এদিক ওদিক দেয়ার সময় ইসলাম কই থাকে? এমন থাবড়া মারব ঘুরতে ঘুরতে সোজা কবরে চলে যাবি। বাসায় বউ রেখে অন্য নারীর দিকে তাকিয়ে আবার হাদীস শোনায়। মানে না ধর্মের কিছু অথচ নিজের দরকারে ধর্ম এনে নিজেকে জাস্টিফাইড করার চেষ্টা করে। শ্লা হারামী।”
মারওয়ানের কঠিন দৃষ্টি এবং রূঢ় ব্যবহারের কারণ মুহূর্তেই উদঘাটন করতে পারল চালকটি। প্রথমে মিনমিন করলেও পরে গলা বড় করে বলল,
“আপনেরা নাইমা যান। আপনেগো আমি নিয়া যাইতে পারুম না।”
মারওয়ান নিজের বুক পকেট থেকে কলম বের করে লোকটার পিছনে গুতা দিয়ে বলল,
“তুই যাবি, তোর ঘাড়ও যাবে। সোজা যেখানে বলেছি সেখানে যাবি নয়তো গুলি করে একদম পিঠ ঝাঁঝরা করে দেব।”
সিএনজি চালক ভীত গলায় বলল,

“মূর্খু হইবার পারি তয় বলদ না। আমি দেখছি ওইডা কলম। আমারে ভয় দেখাইলে হইব না।”
“কে বলছে এটা কলম? এটা ডিজিটাল গুলি। দেব নাকি ঢুকিয়ে?”
“আইচ্ছা ওইডা সরান। আমি যাইতাছি। আর তুই তুকারি করেন কেন? ড্রাইভার দেইখা কি আমি মানুষ না?”
মারওয়ান পকেটে কলম ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,
“তুই ব্যাটা আসলেই অমানুষ। সময় থাকতে নজর ঠিক কর, নয়ত তোর ভবিষ্যতে মাইর খাইয়া মরণ ছাড়া আর গতি নাই।”

সিএনজি চালক আর কথা না বলে জ্যাম ছুটতেই গাড়ি হাঁকিয়ে গন্তব্যে ছুটলো। মনে মনে বেশ ভীত হয়েছে সে। নিশাত এতক্ষণ পর কাহিনী বুঝল। আজ আর কোনো প্রতিবাদ করল না। ঠাণ্ডা চোখে মারওয়ানের পানে চেয়ে রইল। অতীত শেষ হতেই কোনো পাল্টা উত্তর না দিয়ে ছেলেকে নিয়ে সোজা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছে লোকটা। নিশাতের চোখে এক ধরনের মায়া। কোলে ঘুমন্ত নাহওয়ান। ছেলেকে জড়িয়ে রেখে নিজের ছন্নছাড়া স্বামীর দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টে। ইশ এই লোকটা জীবনে কত কঠিন সময় পার করে এসেছে। তখন তার জীবনে নিশাতের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। পাশে বসা পুরুষটির পেশা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং উচ্চ পর্যায়ের ছিল। এতদিন নিশাত জানত একটা আটকুড়ো, ছন্নছাড়া, নিরাসক্ত পুরুষের সংসার করে সে। অথচ অথচ… নিশাত আর ভাবতে পারল না।
মারওয়ানের এদিকে একদম ধ্যান জ্ঞান নেই। সে বাইরে তাকিয়ে এক মনে বিড়ি টেনে যাচ্ছে। সিগারেট শেষ করে যখন দেখল গাড়ি আবার জ্যামে পড়েছে তখন মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে গেল,

“বা**লের জ্যাম।
মনে হচ্ছে, শরীরে লাভা ফুটছে মারওয়ানের। এহেন কথায় নিশাত চোখ কুঁচকে মারওয়ানের দিকে চাইল। এতক্ষণ লোকটার জন্য কষ্ট ও দুঃখ পেলেও হুট করে সব যেন কর্পূরের মতো উড়ে গেল এই কাণ্ডে। এই আটকা পরিবেশে সিগারেট খেয়ে মুখ খারাপ করছে কোন আক্কেলে বেক্কল লোকটা? সে চুপচাপ বসে রইল।
ঘন্টাখানেক পর গন্তব্যে পৌঁছুতেই মারওয়ান আগে আগে সিএনজি থেকে নেমে গেল। তারপর নিশাতের কোল থেকে নাহওয়ানকে নিতেই নিশাত বোরকা সামলে বাইরে পা রাখা মাত্রই মারওয়ান ছেলেকে নিশাতের কোলে দিল। মারওয়ান ভাড়া বের করতে করতে বলল,

“এই তোর নাম কীরে?”
“জে নাসির।”
নাম শুনে মুহূর্তের মধ্যে মারওয়ানের চোখ চিলিক দিয়ে উঠল। সে অদূরে দাঁড়ানো নিশাতের দিকে চাইল। সিএনজিতে ভর দিয়ে বলল,
“নাসিরের বাচ্চা, তুই তোর মেয়েকে টাঙ্কি মারছিলি?”
চালকটি হতভম্ব হয়ে গেল। কথার আগা মাথা কিছুই না বুঝে বলল,
“ভাইসাব আমার তো কুনু মাইয়া নাই।”
মারওয়ান হাত নাড়িয়ে বলল,
“ঐ দূরে দাঁড়ানো নারীটি কে জানিস?”
চালক হালকা ঢোঁক গিলে বলল,
“জে আপনের বইন।”
“কিহ!! কোন দিক দিয়ে তোর বোন মনে হলো?”

মারওয়ানের শক্ত কণ্ঠ। চালকটি নিশাতের দিকে একবার চেয়ে মারওয়ানের দিকে নজর ঘুরিয়ে বলল,
“দেখতে ছোট খাটো তাই ভাবলাম বয়স বেশি হইব না। আপনেরে তো তার চাইতে বেশি লাম্বা আর বয়সের লাগে তাই মনে ওইল আরকি।”
মারওয়ান দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“থাবড়া মেরে চাপা ঘুরিয়ে দেব হারামী। মশকরা করিস আমার সাথে, ফাজিল। এক টাকাও পাবি না, ভাগ এখান থেকে।”
সিএনজি চালক দাঁত কপাটি বের করে বলল,
“জে ভাইসাব এট্টু মজা করছিলাম। ওইডা আপনের বউ আমি বুজ্জিলাম। আপনেরে এট্টু রাগাইতে চাইছিলাম আরকি।”

“খুব ভালো করেছিস। আমি রেগেছি এবার তোর ভাড়া বাতিল।”
“ভাই, ভাইসাব এমুন করেন ক্যা? আপনে আমারে কত কথা হুনাইতাছেন আমি কিছু কইছি? এট্টু মজাই তো করছি। এল্লিগা এই গরীবের পেটে লাথি মারণ ঠিক হইব, আপনেই কন?”
“তুই খুব ভালো অভিনয় পারিস, বুঝলি নাস্সু?”
চালকটি নাজুক হেঁসে বলল,
“সবই আপনের দোয়া, ভাইসাব।”
মারওয়ান চোখ রাঙিয়ে বলল,
“চুপ কর, তোরে দোয়া দিলাম কবে? দেখাই তো আজকে প্রথম হলো। শোন, টাকা দিতে পারি তবে এক শর্তে?”
“কী শর্তু ভাইসাব?”

“যাকে টাঙ্কি মারতে চেয়েছিলি তার পায়ের সামনে হাত জোড় করে বসে বলবি, মা আমাকে মাফ করে দিন। এখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিজের নজর হেফাজত করব। আসলে নাসির নামের সবার চরিত্রে একটু আধটু দোষ থাকে। আমি নাসির, আপনি আমার মা।”
“এ্যাহ, আমি পারুম না।”
“তাহলে আমিও টাকা দিতে পারব না।”
বলেই মারওয়ান সামনে হাঁটা ধরল। সিএনজি চালক নিজের পাঁচশ টাকা চলে চলে যেতে দেখে হুড়মুড় করে নেমে আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নিশাতের পায়ের সামনে বসে হাত জোর করে মারওয়ানের শেখানো কথাগুলো বলল। নিশাত ভ্যাবাচেকা খেয়ে ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কি ঘটল, কেন ঘটল কিছুই তার বোধগম্য হলো না।
সিএনজি ভাড়া চারশ দিতেই চালক লোকটি গাঁইগুঁই করে অসন্তোষ প্রকাশ করতে চাইল তবে মারওয়ানের রুষ্ট চোখে চেয়ে দ্রুত টাকা নিয়ে পগারপার হয়ে গেল। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। এখানে থাকলে দেখা যাবে আবারও কোনো পানিশমেন্ট দিয়ে বসল। সাংঘাতিক লোক! আমি নাসির, আপনি আমার মা; কি সাংঘাতিক কথা!

মারওয়ান গোসল করে বের হতেই দেখল নিশাত চুল ছেড়ে জামাকাপড় হাতে নিয়ে খাটের উপরে বসে আছে। বেচারি আগে গোসল করতে যেতে চেয়েছিল মারওয়ান তাকে ঠেলে ধাক্কিয়ে আগে ঢুকে পড়েছে। এত গরমে এক মিনিটও বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ঘাম শরীরে চিটচিট করছিল। তাকে দেখেও নিশাত কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না। নাহওয়ানকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। মারওয়ান একটু অবাকই হলো। নিশাত অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ বেজায় শান্ত। তার সাথে একটুও কথা কাটাকাটি করছে না। বিষয়টা চিন্তার। অতীত শুনে তার প্রতি করুণা হচ্ছে নাকি? হাহ, হতেও পারে। যত্তসব বা*লছাল!
ছেলের গায়ে বেবি সোপ ডলে দুই মগ পানি দিয়ে নিশাত বাথরুম থেকে বের করে দিল। বাচ্চাটা পানি দেখলে অতিরিক্ত হাতায়। নাহওয়ান পানি ভর্তি শরীর নিয়ে বাবার দিকে পিটপিট করে চেয়ে ফিচফিচ করে হাসল। সারা জার্নিপথ ঘুমিয়েছে সে। মারওয়ান গোসলে থাকতে ঘুম থেকে জেগেছে সে। তাই বাবাকে এতক্ষণ কাছে পায়নি। মারওয়ানকে দেখতেই হাত বাড়িয়ে ডাকল,

“বাবা বাবা, গুচুল কচ্চি।”
মারওয়ান গামছা নিয়ে এসে ছেলেকে এক হাতে পেঁচিয়ে মুছে দিতে দিতে বলল,
“এই পান্ডা তুই এতক্ষণ ঘুমিয়েছিস কেন? সারাক্ষণ শুধু ঘুম আর ঘুম।”
নাহওয়ান মাথা দিয়ে বাবার মুখে বারি মেরে বলল,
“গুম আল গুম। গুম নাই।”
ছেলেকে ভালোভাবে মুছিয়ে দিয়ে মারওয়ান গামছা দিয়ে ছোট্ট শরীরটা প্যাঁচিয়ে রাখল। নাহওয়ান প্যাঁচানো গামছা সরাতে সরাতে নিজের ছোট মাথাটা বের করে বাবার দিকে চাইতেই মারওয়ান বলে উঠল,
“টুকি।”
নাহওয়ান উত্তেজিত হয়ে ফিচফিচ করে হেঁসে দ্রুত গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে বলতে লাগল,

“টুকি টুকি।”
“চুপ কর পুকি।”
নাহওয়ান নিজের পাছায় হাত রেখে বলল,
“পুক্কি নাই।”
মারওয়ান ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“তোরে বললাম পুকি তুই বলিস পুক্কি। তোর শরম নাই? বাপের সামনে যেখানে সেখানে হাত দেস?”
নাহওয়ান দাঁত বের করে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
“পুক্কি নাই, চলম নাই, চুমু পুপার চুমু নাই। চুমু পুপার উসুক কচ্চে।”
ছেলের কথায় মারওয়ান গম্ভীর হয়ে গেল। চুপচাপ গেঞ্জি, প্যান্ট পরিয়ে সারা শরীরে পাউডার মাখিয়ে দিল। নিশাত ভেজা চুলে গামছা পেঁচিয়ে বালতি ভর্তি ধোঁয়া জামাকাপড় নিয়ে বের হলো। নাহওয়ান মাকে দেখতেই লাফ দিয়ে উঠে বলল,
“মা মা।”

নিশাত ছেলের দিকে এক নজর তাকিয়ে হাসল। মারওয়ানকে আশেপাশে দেখল না। মাথায় কাপড় দিয়ে বারান্দায় গেল কাপড় চোপড় মেলতে। গিয়ে দেখল মারওয়ান একনাগারে সিগারেটে সুখটান দিতে ব্যস্ত। সে বেশ অবাক হলো। আজকে লোকটার হলো কী? ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছে। অতীতের ক্ষতগুলো লোকটার মনে আবারও তাজা হয়েছে বোধহয়। এসব করে নিজের যে ক্ষতি করছে একবারও বুঝতে পারছে না। সিগারেট টেনে কি আর সুখ কেনা যায়?
নিশাত মারওয়ানের ভেজা শার্ট ঝেড়ে রশিতে মেলে দিল। শার্ট ঝাড়ার ফলে মারওয়ানের গালে শার্টের পানি এসে লাগল। নিশাতকে দেখে বলল,
“সামনে মানুষ দেখতে পারছ না?”
নিশাত জামা মেলতে মেলতে বলল,
“কোথায়?”
মারওয়ান ঘুরে নিশাতের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কোথায় মানে? আমাকে চোখে পড়ে না?”
নিশাত দায়সারা কণ্ঠে বলল,

“ও আপনাকে খেয়াল করিনি।”
কপাল ভাঁজ করে মারওয়ান সরু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“তুমি এতবড় একটা মানুষ খেয়াল করোনি?”
“করেছি তবে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।”
“কেন?”
“কারণ আপনি কোনো মহৎ কার্য সম্পাদন করছেন না যে আপনাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।”
বলে নিশাত টুলের উপর দাঁড়িয়ে উঁচু দড়িতে বাকি জামা গুলো মেলতে লাগল। মারওয়ান কিড়মিড় করে বলল,
“টুল ছাড়া দড়িতে কাপড় মেলতে পারেনা সে এসেছে গুরুত্ব অগুরুত্ব শেখাতে। লিলিপুট কোথাকার।”
“এত উঁচুতে দড়ি আপনি বেঁধেছেন। তাহলে আমিও বলি আপনাকে কারেন্টের খাম্বা?”
মারওয়ান ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,

“হিংসা হয়?”
“খুব।”
“তা তো হবেই। ছোট হয়েও বড় সাইজের স্বামী পেয়েছ হিংসা না হয়ে উপায় আছে?”
নিশাত প্রত্যুত্তর না করে সব কাপড় মেলে দিয়ে টুল থেকে নেমে মারওয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে ধীর গলায় বলল,
“আমার কিংবা নাহওয়ানের আপনাকে খুব দরকার। হাতের মরণব্যাধি জিনিসটা খেয়ে নিজের আয়ু কমাবেন না। আপনার কিসের এত দুঃখ? আমাকে মন খুলে বলবেন, দুজনে একসঙ্গে দুঃখ ভাগাভাগি করব। কারো জন্য নিজের জীবনকে কেন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন? বন্ধু আপনার সঙ্গে ছলনা, প্রতারণা করেছে দেখে আমাদের কষ্ট দেয়ার কোনো অধিকার আপনার নেই। দিনশেষে আমাদের আপনি ছাড়া কেউ নেই, এটা অন্তত মাথায় রাখবেন। আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ; স্বামী সন্তান নিয়ে অনেক বছর বাঁচার সাধ আমারও আছে।”
বলেই খালি বালতি নিয়ে বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল। মারওয়ান শক্ত হয়ে নিশাতের গমনপথে অনিমেষ চেয়ে রইল। নিজের চুল খামচে ধরে বারান্দার দেয়ালে শক্ত ঘুষি বসিয়ে দিল।

বিরাট হলরুমে ইহাব চোখ বুজে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। পাশেই ইমতিয়াজ ভুঁইয়া, উমায়ের ভুঁইয়া ও উজান ভুঁইয়া বসা। উমায়ের ভুঁইয়া কাঠিন্য গলায় বললেন,
“এক্সিডেন্ট কীভাবে করলে? তুমি গাড়ি চালাও কিভাবে?”
ইহাব কোনো জবাব দিল না। উমায়ের ভুঁইয়া আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমাদের মা, ছেলে সবার একটা না একটা সমস্যা লেগেই আছে। তোমার বউটা আসার পর থেকে বিপদ তোমাদের পিছুই ছাড়ছে না। মেয়েটা একটা কুফা।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া উদাসীন গলায় বললেন,
“ওসব কথা রাখুন। নসিবে লেখা ছিল তাই হয়েছে, অন্যের মেয়েকে কুফা বলে কি লাভ? কথায় আছে না, যদি থাকে নসিবে আপনা আপনি আসিবে।”
উমায়ের ভুঁইয়া এবার রাগান্বিত গলায় বললেন,

“উর্মিটার শরীরের উন্নতি হচ্ছে না, ভাগ্নেটা এদিকে হাত, পা ভেঙে বসে আছে। ওই মেয়েটা আসার পর থেকেই তো যত সমস্যা। আমি আগেই আপত্তি তুলেছিলাম স্ট্যাটাসের সাথে মিলিয়ে ছেলেকে বিয়ে করাতে। আমাদেরকে না জানিয়ে চুপিচুপি ছেলের বিয়ে দিয়েছেন এখন আপনাদেরটা আপনারাই বুঝুন। ভালোর জন্য বলি কানে তোলেন না, উচিত কথার দাম নেই।”
ইহাব কোনরকমে বলল,
“মামু তুমি প্লিজ এরমধ্যে মানহাকে টেনো না। মা ওর প্রতি তোমার মাথাটা একেবারে বিষিয়ে দিয়েছে। তুমি আর মা ওকে সহ্য করতে পারোনা কেন মামু? মায়ের নাহয় অসুস্থ কিন্তু তুমি তো সুস্থ। একজন মানুষ কখনোই কুফা হতে পারেনা। এগুলো মারাত্মক কুসংস্কার। তুমি এত হাই সোসাইটিতে থেকেও এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করো? কাউকে অশুভ, কুফা, অপয়া মনে করা মারাত্মক গুনাহ। যদি মনে মনে এই ধারণা করো, তার হাতে ভালো খারাপের শক্তি আছে তাহলে সেটা শিরকের শামিল হবে। এটা আল্লাহর ক্ষমতার সাথে শরীক করার মতো। ভালো, মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। কোনো মানুষ কুফা, অপয়া, অশুভ হতে পারেনা। আমরা তো আল্লাহর সৃষ্টি মাত্র।”

উমায়ের ভুঁইয়া শক্ত হয়ে ইহাবের কথা শ্রবণ করে বলল,
“ভালোই তো ধর্ম কর্মের জ্ঞান হয়েছে। মেয়েটা চমৎকারভাবেই তোমার মাথা খেয়েছে দেখছি।”
ইহাব বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ধর্মের জ্ঞান হলে যদি মাথা খাওয়া হয় তাহলে এমন মাথা হাজারবার খেলেও সেটা আমার জন্য পূর্ণের মামু।”
বলে ইহাব খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উপরে চলে গেল। দুজন সার্ভেন্ট তাকে উপরে নিয়ে যেতে সাহায্য করল। উমায়ের ভুঁইয়া দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
“মা, ছেলে দুজনে বিছানায় পড়েছে ওই মেয়েকে তো একদিনও দেখিনি সেবা যত্ন করতে। সারাক্ষণ ঘোমটার তলে থাকে। একদিন ঠিকই বুঝবি তোর মা কিংবা আমি কেন এই কথা বলেছিলাম। যত্তসব ন্যাকামি!”
উজান ভুঁইয়া এবার মুখ খুললেন,
“আহ ভাইজান, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? ওদের বিষয় ওদেরকেই নাহয় বুঝতে দেন। আমরা হলাম তৃতীয় পক্ষ আমাদের এত কথা বলা মোটেও সাজে না।”
উমায়ের ভুঁইয়া চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“বেশি পণ্ডিতি করবি না। চুল এমনি এমনি বাতাসে পাকেনি আমার। তোদের থেকে যথেষ্ট অভিজ্ঞ আমি।”
উজান ভুঁইয়া মিনমিন করে বললেন,
“হ্যাঁ বয়স হয়েছে চুল তার কালো থাকবে এখনো। অভিজ্ঞতায় কচু পেকেছে, বয়সে যে পেকেছে তা বলেনা।”

নিশুতি রাত। নিশাতের ঘুম ভেঙে গেল। সে হাতড়ে নাহওয়ানকে দেখল। তারপর অপরপাশ খালি দেখে উঠে বসল। খোঁপা করে বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গেল। অদূরে ল্যাম্পপোস্টের আলো বারান্দায় পড়ে চারপাশ হালকা আলোকিত দেখাচ্ছে। মারওয়ানের চোখে ঘুম নেই। সে এক দৃষ্টিতে বাইরের গাঢ় অন্ধকারে তাকিয়ে আছে। হয়তোবা কিছু ভাবছে। নিশাত পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ঘুমাবেন না?”
মারওয়ান বাস্তবে ফিরে বলল,
“ঘুম আসছে না।”
“কেন?”
মারওয়ান সামনে তাকিয়েই বলল,
“এমনিতেই।”
নিশাতও আর কিছু না বলে বাইরে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর নিজ থেকেই বলল,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“করো।”
“আপনি কি এই কাজ ছেড়ে নির্ভেজাল নতুন কোনো কাজ করবেন?
মারওয়ান ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন বলো তো?”
নিশাত নিজের মাথা মারওয়ানের বুকে আলতো করে ঠেকিয়ে বলল,

“সত্যি বলতে আপনার পেশা সম্পর্কে আগে অবগত হলে আপনাকে কোনোদিনও বিয়ে করতাম না। আইন পেশাটায় ছোটবেলা থেকে আমার তীব্র অরুচি। এই পেশা ও পেশার মানুষ দুটোই আমার অপছন্দের। তাদেরকে ভয় লাগে আমার। এদের জীবন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এরা দেশকে প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে বউ, বাচ্চার কথা ভুলে যায়। ফলে অল্প বয়সে বিধবার তকমা গায়ে লাগিয়ে আমাদের মতো হাজার হাজার নারীদের ঘুরতে হয়। আমার কথা নাই ভাবলেন অন্তত নাহওয়ানের কথা ভেবে হলেও কোনো ঝুঁকিতে ঝড়াবেন না, প্লিজ।”
মারওয়ান খেয়াল করল, তার বুক ভিজে গেছে। ধীর কণ্ঠে বলল,
“ঝুঁকির কাজে তো ঝুঁকিতে জড়াতেই হবে। এমনিতেও আমি তোমার যোগ্য নই। তুমি আমার থেকেও অনেক বেটার ডিজার্ভ করো ফৌজিয়া নিশাত।”

নিশাত বুক থেকে মাথা তুলে ভেজা চোখে মারওয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার তো বেটার কাউকে চাইনা। আমার একটা মারওয়ান আজাদ হলেই চলবে।”
মারওয়ান শান্ত চোখে নিশাতের অশ্রু ভরা নেত্রে নিজের নেত্র স্থাপন করে বলল,
“সে তো ভালো নয়, তার সাথে তুমি কখনো সুখী হতে পারবে না।”
“কে বলেছে?”
“সবাই তো বলে।”
নিশাত দুহাতে গেঞ্জি মুঠ করে ধরে চওড়া বুকটায় মাথা ঠেকিয়ে বলল,
“তারা কি কখনো এই বুকে মাথা পেতেছে? এখানের মতো শান্তি সমগ্র পৃথিবী খুঁজে তারা আমায় এনে দিতে পারবে? আমার সুখ, শান্তি শুধু এই বক্ষপটে।”
মারওয়ান অদূরে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

“আমি তোমার যোগ্য নই নিশাত। তোমাকে কষ্ট ছাড়া আমি কিছুই দিতে পারিনি ভবিষ্যতে পারব কিনা তাও জানি না। তুমি তোমার মতোই চমৎকার একজনকে ডিজার্ভ করো।”
নিশাত বুক থেকে মাথা তুলে মারওয়ানের বুকে ধাক্কা মেরে শক্ত গলায় বলল,
“সেই চমৎকার একজনকে আপনার এই বুক চিরে দিয়ে যাবেন তাহলেই তাকে সাদরে গ্রহণ করব।”
মারওয়ান দূরে নজর রেখেই বলল,
“দোয়া করব সেই বুক যেন এই বুকের থেকেও বেশি দীর্ঘ ও শান্তিপূর্ণ হয়।”
নিশাত মারওয়ানের বুকে কিল বসিয়ে বলতে লাগল,
“খারাপ লোক, আমি গোটা আপনিটাকেও চাই। এর থেকে শান্তিপূর্ণ বুক আমার চাইনা। এই বুকে অনন্তকাল ঠাঁই পেতে চাই। আপনাকে কোথায় পাব তাই বলুন?”
কথা শেষ করে নিশাত মারওয়ানের বুকে কামড় বসিয়ে দিল। মারওয়ান চোখ বুজে সহ্য করল। মিনমিন করে বলল,

“তুমি এমন একজনকে চাও যে তোমায় কখনো সুখী করতে পারেনি। আমাকে চাইবার মতো কোনো কাজ তো আমি করিনি। তবুও এতটা চাও কেন আমায়? আমাকে চাইবার তো কথা ছিল না ফৌজিয়া নিশাত।”
ঠিক সেসময় নিস্তব্ধ এই রজনীতে অদূর হতে ভেসে এল মনুষ্য কণ্ঠের বিরহী কিছু চরণ,

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৪

“ওহে কি করিলে বলো পাইব তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে-
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব না,
এত প্রেম আমি কোথা পাব না,
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে।
ও আমার সাধ্য কিবা তোমারে,
দয়া না করিলে কে পারে-
তুমি আপনি না এলে,
কে পারে হৃদয়ে রাখিতে-
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাইনা।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here