ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২
সাইয়্যারা খান

প্রাইভেট গাড়ীতে বরাবরই বমি পায় রোদের এরমধ্যে সকাল থেকে তেমন কিছু খেতেও পারে নি। ভারী পোশাকে প্রচন্ড অসস্তিও লাগতে লাগলো। আদ্রিয়ান বুঝতে পারলো রোদের অবস্থা। থুতনিতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে রোদের যা আদ্রিয়ান বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে দিলো। রোদের অবস্থা ও তেমন একটা সুবিধার না।আদ্রিয়ান আস্তে করে ডাকলো,

— রোদ?
— হু।
— বেশি খারাপ লাগছে?
— হুম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কথাটা কেমন কান্না মিশ্রিত গলায় বললো। আদ্রিয়ান ই বা কি করবে? এত রাতে গাড়ী থেকে নামাটাও সেফ মনে হচ্ছে না। আদ্রিয়ান আলতো হাতে রোদকে নিজের বুকে ঠেস দিয়ে কাত করলো। রোদ একহাতে আদ্রিয়ানের বাহু ধরে হাসফাস করতে লাগলো। আদ্রিয়ান একটা একটা করে পিন ছুটাতে লাগলো রোদের হিজাব থেকে। পিন সরিয়ে হিজাব খুলতেই রোদের একটু সস্তি লাগলো। গলা, ঘাড় ঘামে ভিজে চপচপা হয়ে আছে। আদ্রিয়ান পান্জাবীর পকেট থেকে রুমাল বের করে গলা মুছিয়ে দিলো। রোদের এখন অসস্তিতে কান্না আসছে। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। আদ্রিয়ান ওকে ধরে কিছু বলার আগেই রোদ কান্না করে দিয়ে বললো,

— গাড়ী থামান।
হঠাৎ এমন হওয়ায় ভরকে গেল আদ্রিয়ান। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললো। রোদ মুখে হাত চেপে বসে আছে। আদ্রিয়ান ডোর খুলতেই রোদ কোন মতে নেমে গেল। নামতেই পাশের একটা গাছ ধরে গলগলিয়ে বমি করে দিলো। বমির সাথে একাধারে কেঁদেও যাচ্ছে। আদ্রিয়ান অপর পাশের ডোর খুলে তারাতাড়ি বেরিয়ে পেছন থেকে রোদকে ধরলো। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেই আরেক বার বমি করতে চাইলো রোদ কিন্তু পেটে কিছু না থাকায় এই বার শুধু পানি বের হলো যার ফলে গলা সহ নাক,কান জ্বলে উঠলো।

রোদ দুই হাতে কান চেপে ধরে নিচে বসে পরতে নিলো। বসার আগেই আদ্রিয়ান কোনমতে ধরে ফেললো। ড্রাইভার ততক্ষণে গাড়ী থেকে বড় বড় দুইটা পানির বোতল বের করে নিয়ে এসেছে। খুলে আদ্রিয়ানের হাতে দিতেই আদ্রিয়ান হাতে পানি নিয়ে রোদের মুখের সামনে ধরলো। রোদ বার কয়েক কুলি করলো। আদ্রিয়ান রোদের মাথাটা একটু নিচু করে পানি ঢেলে দিলো। রুমাল ভিজিয়ে গলা, ঘাড় মুছে দিলো। এখন রোদের একটু শান্তি লাগলো। আদ্রিয়ানের চিন্তায় চিন্তায় ঘাম ছুটে গিয়েছে। ততক্ষণে জামাইয়ের গাড়ি থামতে দেখে বাকি সব গাড়িও থেমে গেল। বেরিয়ে এলো আরিয়ান আর ওর বাবা। আদ্রিয়ান ওদের যেতে বলে একহাতে রোদকে জড়িয়ে ধরে গাড়ীতে উঠে বসলো। রোদ অসহায় চোখ করে তাকালো। আদ্রিয়ান ওকে ভরসা দিয়ে বললো,

— আর বেশি পথ বাকি নেই। একটু সহ্য করো।
রোদ গা এলিয়ে দিলে সিটে। আদ্রিয়ান রোদের আঁচলটা উঠিয়ে কাঁধে দিয়ে দিলো। এতে যদি একটু শান্তি পায় মেয়েটা। প্রায় ১৫ মিনিট পরই ওরা পৌঁছে গেল আদ্রিয়ানের বাসায়। রোড ফ্রী থাকায় তেমন সমস্যা হয় নি কিন্তু ততক্ষণে রোদ আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে।

গাড়ীতেই কেঁদে যাচ্ছিলো মেয়েটা। আদ্রিয়ানের অসহায় হয়ে ওকে ধরে রাখা ছাড়া কিছুই করতে পারছিলো না। গাড়ী থামতেই রোদকে আগে বের করলো আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ানের মা, সাবা তারাতাড়ি বাসায় ডুকে বরণ ডালা হাতে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে গেল। জারবা এসে আদ্রিয়ানের সাথে রোদকে ধরলো। আদ্রিয়ান রোদের শাড়ীর আঁচল দিয়েই ঘোমটা টেনে দিয়ে দরজার সামনে গেল। আদ্রিয়ানের মা অশ্রু চোখে তাকালো। আল্লাহ যেন এই বার তার ছোট ছেলেটাকে সুখ দেয়। বরণ করার সময়ই সবাই খেয়াল করলো ডুলতে থাকা রোদকে যাকে আদ্রিয়ান একহাতে জড়িয়ে আছে। ভিতরে ডুকতেই আদ্রিয়ানের বাহু বন্ধনেই ঙ্গান হারালো রোদ। বিচলিত হলো আদ্রিয়ান সহ সবাই। আরিয়ান ওকে বললো,

— ওকে নিয়ে রুমে চল। আমি দেখছি। আর জারবা এক গ্লাস দুধ নিয়ে আয়।
আদ্রিয়ান কোলো তুলে নিলো রোদকে। নিজের রুমে ডুকে ফুল দিয়ে সজ্জিত বিছানায় শুয়িয়ে দিলো রোদকে। আঁচলটা একটু সরে গিয়ে দৃশ্যমান হলো রোদের ধপদপে সাদা পেটের কিছু অংশ। আদ্রিয়ান দৃষ্টি সরিয়ে তা ঠিক করে দিলো। আরিয়ান ওর প্রেশার চেক করলো। যা ভেবেছিলো তাই। প্রেশার লো। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— প্রেশার লো ওর। মনে হয় টেনশনে কিছু খায় নি। জারবা দুধ আনলে খায়িয়ে দিয়ে খাবার খাওয়াতে হবে। দূর্বলতা থেকে অঙ্গান হ’য়েছে।

বাকি সবাইকে রুম থেকে যেতে বলে রুম খালি করতে বললো। একে একে সবাই চলে গেল। আদ্রিয়ান তাকিয়ে রইলো রোদের দিকে। কিভাবে এই ছোট্ট মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেললো ও? আদও সামনে কি হবে তা জানা নেই আদ্রিয়ানের? এতদিন মনে হতো সব মেয়েরা এক কিন্তু এই রোদকে দেখার পর থেকে ধারণায় পরিবর্তন এসেছে আদ্রিয়ানের। আস্তে করে রোদের পাশে বসে এক হাতে গালে আলত চাপড় দিয়ে ডাকলো,

— রোদ? এই রোদ? উঠো।
পিটপিট করে তাকালো রোদ। বুঝার চেষ্টা করলো নিজের অবস্থান। হঠাৎ আদ্রিয়ানকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। আদ্রিয়ান নিজেও ছিটকে সরে গেল। রোদ কিছু না বুঝে বসে রইলো। আদ্রিয়ান নিজেকে ধাতস্থ করে আবারও এগিয়ে এসে ওকে ধরে বললো,

— কি হয়েছে রোদ? ভয় পেয়েছো?
রোদ মিনমিন করে বললো,
— ভুলে গিয়েছিলাম।
— কি?
— বিয়ে।
একটু হাসলো আদ্রিয়ান। রোদের হাত টেনে ধরে বললো,
— আসো চেঞ্জ করবা।
রোদ উঠতে নিলেই শাড়ীর পিন ছুটে লেগে গেল কোমড়ের দিকে। “উফ” করে আওয়াজ করে আবারও বসে পরলো। আদ্রিয়ান ওকে ধরে তারাতাড়ি বললো,

— কি হয়েছে?
রোদ অল্প স্বরে কেঁদে বললো,
— সেফটিপিন বিঁধে গিয়েছে।

আদ্রিয়ান তারাতাড়ি রোদের হাত সরালো কোমড়ের দিক থেকে। লাল র*ক্ত বের হ’য়েছে একটু। আঙ্গুল ছুঁয়িয়ে মুছে দিলো। অল্প সল্প কেঁপে উঠলো রোদ। আদ্রিয়ান হাত সরিয়ে সেফটিপিনটা ছুটিয়ে দিলো। এমন সময় জারবা এলো হাতে দুধ নিয়ে৷ নক করতেই আদ্রিয়ান ভেতরে আসতে বললো। জারবা দুধ টেবিলে রেখে চলে গেল। আদ্রিয়ান দরজা ভিরিয়ে রোদের সামনে দাঁড়ালো। রোদ তখন হাতের চুড়ি খুলতে ব্যাস্ত। বিরক্ত লাগছে ওর এসবে। আদ্রিয়ান নিজেও রোদের গলার হার আর খোঁপার কাটা খুলতে লাগলো। সব কিছু ড্রেসিং টেবিলে রেখে আলমারি থেকে রোদের একটা টিশার্ট,প্যান্ট আর টাওায়াল নিয়ে ওয়াসরুমে রেখে এলো। হাতে কয়েকটা ওয়েট টিস্যু নিয়ে রোদের চেহারা ভালো করে মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,

— কি দরকার ছিলো এসব আটা ময়দা মাখার? এখন শুধু শুধু কষ্ট হচ্ছে তোমার।
রোদ নিচু স্বরে বললো,
— আটা ময়দা না মেকাপ করা বলে এটাকে।
— হু হু জানা আছে আমার। এখন যাও। আর শুনো চুল ভিজিও না। ঠান্ডা লেগে যাবে।

রোদ সম্মতি দিয়ে ওয়াসরুমে ডুকলো। আদ্রিয়ান তারাতাড়ি পাঞ্জাবি খুলে একটা টাউজার পরে নিলো। নিচে যেয়ে গোসল করে ঝটপট রুমে এলো। রোদ এখনও বের হয় নি ভাবতেই ভ্রু কুচকে গেল। এই মেয়ে এতক্ষণ কি করছে ভিতরে ভেবে নক করলো আদ্রিয়ান। ওমনি রোদ দরজা খুলে বের হলো। পরণে ঢোলা টিশার্ট আর ঢোলা প্যান্ট, মাথা টাওয়াল প্যাঁচানো। গলার দিকে এখনও ভেজা। হঠাৎ বের হয়ে আদ্রিয়ানকে দেখেই চমকে তাকালো সাথে সাথেই নজর নামিয়ে নিলো। সুঠাম দেহের আদ্রিয়ানের আকর্ষণীয় বুক ভর্তি লোমগুলো ভিজা ভিজা, চুল গুলো ও সামান্য ভেজা। রোদ একটু ইতস্তত করলো। আদ্রিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— কি হয়েছে?
— কিছু পরুন।
— কি পরব?
— টিশার্ট নেই আপনার?
আদ্রিয়ান নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। টাওয়াল রেখে টিশার্ট পরে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— না করেছিলাম তবুও কেন চুল ভেজালে?
— আসলে অস্থির লাগছিলো। তাই একবারে গোসল করে নিলাম।
আদ্রিয়ান কিছু বলার আগেই ওর মা নক করলো। আদ্রিয়ান খুলতেই উনি খাবার নিয়ে ডুকলেন। রোদকে দেখেই মিষ্টি করে হেসে বললেন,

— কি রে মা এখন ঠিক আছিস?
— জ্বি। দুঃখীত আমার জন্য ঝামেলা হলো।
— আরে কিসের ঝামেলা বোকা? খেয়ে নিবি এখন আয়।
— আন্টি প্লিজ এখন খাব না।
আদ্রিয়ান ধমকে উঠলো,
— খাবে না মানে কি? এখনই খাবে।
আদ্রিয়ানের মা বিরক্ত হয়ে বললেন,
— ধমকাচ্ছিস কেন? রোদ মা আমার ভালো। খাবি এখন।

রোদ অসহায় মুখ করে রইলো। আদ্রিয়ানের মা ওকে বসিয়ে দুই লোকমা খাওয়াতেই রোদ পানি খেয়ে বললো,
— আর না বমি পাচ্ছে আমার।
আদ্রিয়ান চোখ গরম করে তাকাতেই রোদ জোরপূর্বক আরো দুই লোকমা খেল। আদ্রিয়ান দরজা লাগিয়ে রোদের পেছনে গিয়ে টাওয়াল খুলতেই রোদ চমকিয়ে গেল। আদ্রিয়ান চুল মুছতে মুছতে বললো,
— রিল্যাক্স। চুল মুছছি।
চুল মুছে টাওয়াল ওয়াসরুমে রেখে রোদের মুখের সামনে দুধের গ্লাস ধরতেই কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

— দেখুন আমি এটা কিছুতেই খাব না।
— তুমি খাবে তোমার ঘাড়েও খাবে।
বলেই রোদকে চেপে ধরে সবটুকু খায়িয়ে দিলো। রোদ থম ধরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। আদ্রিয়ান কিছু বলার আগেই রোদ ওয়াসরুমে ডুকে একদম দুধ সহ ভাত সবটুকু বমি করে ফেলে দম নিলো। আদ্রিয়ান পেছন থেকে ওর চুল গুলো গুছিয়ে ধরে মুখে পানি দিয়ে কুলি করিয়ে মুখ ধুয়ে দিলো। রোদ আদ্রিয়ানের বুকেই ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বমি করে শান্তি লাগছে এখন ওর। আদ্রিয়ান ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে ওকে ধরে কাউচে বসিয়ে দিলো। হাত দিয়ে বিছানায় ছিটানো গোলাপের পাপড়ি গুলো সরিয়ে দিলো। না করা সত্ত্বেও আরিয়ান, সাবা আর জারবা মিলে সাজিয়েছে এই বাসর। এক সময় কত স্বপ্ন ছিল এই বাসর নিয়ে কিন্তু এখন সবই ধোঁয়াসা।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রোদকে নিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। কাউচেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো রোদ। আদ্রিয়ান হাসলো একটু। এই টুকু পিচ্চি রোদ কি না ওর বউ। লাইট অফ করে পাশে শুয়ে পরলো আদ্রিয়ান। আবার উঠে টেনে বুকে নিলো রোদকে। মাথায় চুমু খেল। আজ কয়েক বছর পর শান্তিতে ঘুমাবে আদ্রিয়ান।

সকাল ৯ টার দিকে দরজায় নক হতেই আদ্রিয়ান জেগে উঠলো। সাধারণত এত সময় ঘুমায় না আদ্রিয়ান কিন্তু কাল রাতে দেড়ীতে ঘুমানোতে এমন হলো। মুখের উপর চুল দেখতেই তা সরিয়ে দিলো।
পাশে তাকাতেই দেখলো এলোমেলো রোদকে। অল্প হাসলো আদ্রিয়ান। হঠাৎ নজর গেল টিশার্ট উঠে গিয়ে দৃশ্যমান পেটে। চেয়েও নজর সরাতে পারলো না আদ্রিয়ান। কেন সরাবে ও? বিয়ে করা বউ ওর রোদ তবুও কেমন ঘোর লাগা নজরে তাকিয়ে রইলো। আবারও দরজায় আওয়াজ হতেই হাতের উপর থেকে রোদের মাথাটা বালিশে দিয়ে টিশার্ট ঠিক করে দিলো। দরজা খুলতেই দেখতে মিশি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কান্না করছে। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো আদ্রিয়ান। কপালে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— আমার মা কাঁদে কেন?
মিশি বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো ছোট ছোট হাত দিয়ে। আদ্রিয়ান বিচলিত কন্ঠে বললো,
— কি হয়েছে মা? কেউ কি কিছু বলেছে আমার মাকে?
— আমি তো কাল ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। মাম্মা তো আনতে পারলাম না। বাবাই মাম্মা যাব।
আদ্রিয়ান চুমু খেল মেয়ের কপালে। আদর কন্ঠে বললো,

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ১

— আমার মা ঘুমিয়েছে তো কি হয়েছে? বাবাই এনেছি তো মাম্মা।
বলে মিশিকে নিয়ে বিছানার উপর দিতেই খুশিতে মাম্মা বলে ঘুমন্ত রোদের বুকে ঝাপিয়ে পরলো।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩