ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৪

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৪
সাইয়্যারা খান

দীর্ঘ কয়েকটা দিন অসুস্থ থেকে মিশান এখন পুরোপুরি সুস্থ। আজ রোদের হলিডে। সকাল সকাল মিশিকে নিজের বুলি শিক্ষা দিচ্ছে মিশান। আজ ঘুরতে যাবে বাইরে। রোদ’কে বলেছিলো কিন্তু রোদ সোজা না করে বলেছে, মিশান নাকি এখনও সুস্থ না। মিশান জানে টিম বড় করতে হবে। আজ ঘুরতে যাওয়ার পিছনে বড় একটা কারণ ও আছে।

আজ ওর মা-বাবা’র বিয়ের ছয় মাস পূর্ণ হবে। বিয়েতে তো মিশান ছিলো না। এখন এটা সেলিব্রেট করতে চায় ও। আরিয়ান, রাদদের ও বলেছে। সে অনুযায়ী তারাও প্লান করেছে অথচ এতসবের কিছুই জানে না রোদ আদ্রিয়ান। টেবিলে মিশিকে খায়িয়ে আদ্রিয়ান’কে খাবার বেড়ে দিচ্ছে রোদ। মিশি বাবার খাওয়া হতেই বাবার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘেঁষে চুমু খেল। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— মা এত আদর করছে যে আজ?
— বাবাই।
আদুরে গলায় ডাকলো মিশি। আদ্রিয়ান মেয়ে’কে চুমু’তে ভরিয়ে তুললো। বুকে নিয়ে নিজেও আদুরে গলায় বললো,
— জ্বি মা।
মিশি বাবার বুকে আঁকিবুঁকির করতে করতে আবার দাঁড়ি নাড়াচাড়া করলো। এই অভ্যাস পেয়েছে ও রোদ থেকে। আদ্রিয়ান আবারও বললো,

— বলো মা। কি হয়েছে?
— বাবাই ঘুরতে যাব।
আদ্রিয়ান রোদের দিকে তাকালো। রোদ তখন খাচ্ছে। আবার মিশির দিকে তাকিয়ে বললো,
— মা কাল যাই? আজ তো বাবাই অফিসে যাব। একটু কাজ আছে।
গাল ফুলালো মিশি। আদ্রিয়ান অসহায় চোখে তাকালো অভিমানে টাইটুম্বুর মেয়ের দিকে। কিছু একটা ভেবে মিশির গালে চুমু খেয়ে বললো,

— আচ্ছা মা নিয়ে যাব। রাতেই যাব আজকে। এখন বাবাই অফিস যাই?
— পমিস করো আসবে?
— প্রমিজ মা।
খুশি হলো মিশি। কোল থেকে নামাতেই দৌড়ে মিশানের কাছে এসে বললো,
— ভাই যাব আমরা।

মিশান এদিক ওদিক তাকিয়ে হাসলো। রোদ খাওয়া হতেই কফি হাতে রুমে ছুটলো। আদ্রিয়ান শার্ট গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোদের পড়ার টেবিলের সামনে। বইয়ের ভাজে পাতলা একটা বই দেখা যাচ্ছে। আকর্ষন বোধে আদ্রিয়ান হাত বাড়িয়ে নিতেই চক্ষু কপালে। বইয়ের নাম, “হাউ টু মেক ইউরসেলফ এটরাকটিভ ফর হাবি”। এই মেয়ে কিসব পড়া শুরু করেছে? আদ্রিয়ানের হাসি পাচ্ছে পেট ফেটে।

যেখানে ও রোজ রোজ নিজের সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে যাতে রোদের সাথে এমন কিছু না করে যাতে পরবর্তীতে পস্তাতে হয় সেখানে এই মেয়ে ওকে সিডিউস করার জন্য এসব বই পড়ে? অথচ রোদ জানেই না আদ্রিয়ান কতটা আগ্রহী রোদকে পেতে। একদম কাছে করে পেতে।নিজের করে পেতে। ওর ও পুরো সত্তা বারবার চায় রোদে নিজেকে মাখামাখি করতে। অতি আদরে আদরে পাগল হয়ে যেতে। ভালোবেসে বেসে উন্মাদ হতে। এসবের কিছুই করছে না আদ্রিয়ান। শুধু মাত্র যাতে রোদের লেখাপড়ায় ক্ষতি না হয়। এসবে জড়িয়ে যদি পড়ে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে? এই বয়সটা আবেগের। রোদ নাহয় বুঝতে চাইছে না তাই বলে আদ্রিয়ান কিভাবে অবুঝ হয়ে যাবে?

রোদ রুমে ডুকেই কফিটা আদ্রিয়ানের হাতে দিয়ে খোলা শার্টের বাটন গুলো লাগাতে লাগাতে বললো,
— মিশিকে ঘুম পারিয়ে দিব নে। মিশান পুরোপুরি সুস্থ হোক তারপর ঘুরে আসব নে।
আদ্রিয়ান একহাতে কফির মগে চুমুক বসিয়ে বললো,
— থাক না। এত মর্জি করছে। আজই যাব। মিটিং হতেই এসে পরব।
–আচ্ছা।
রোদ কোট টা পেছন দিকে ধরতেই আদ্রিয়ান তা পরে রোদের কপালে সময় নিয়ে চুমু খেলো। রোদ আহ্লাদী হয়ে গলা জড়িয়ে ধরতেই আদ্রিয়ান দুষ্ট হেসে বললো,

— মিস করবে বুঝি?
— উহু। আমার বাচ্চারা আছে না। আপনাকে কেন মিস করব? আপনি কি আমাকে আদর করেন? পঁচা জামাই।
আদ্রিয়ানের মুখটা মলিন হয়ে এলো। ও তো খুব করে চায় রোদকে ভালোবাসা দিতে। আদর দিতে। কিভাবে বুঝাবে এই পাগলকে? আদ্রিয়ানের ওমন ভোতা করে রাখা মুখে পা উঁচু করে চুমু খেল রোদ। ছেড়ে দিয়ে বললো,
–লেট হচ্ছে না?

আদ্রিয়ান রোদের কোমড়’টা চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো,
— যেতে মন চাইছে না তো সোনা।
মুখ ভেঙালো রোদ। আদ্রিয়ান হেসে ওকে নিয়েই নিচে নামলো। ছেলে মেয়ে থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো। রোদ যতক্ষণ আদ্রিয়ান’কে দেখা যায় ততক্ষণই দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। লিফ্ট আসতেই আদ্রিয়ান চলে গেল। দরজা লাগাবে ঠিক সেসময় রোহানের দেখা পেলো। বেচারা রোদকে দেখেই তারাহুরোয় চলে যেতে নিলো। ঐ দিন রোদের ঝারি খাওয়ার পর থেকে আর রোদের সামনে আসে নি রোহান। ওকে যেতে দেখেই মিশান পেছন থেকে ডেকে উঠলো,

— রোহান ভাইয়া?
রেহান থামতেই রোদ ভ্রু কুচকে তাকালো। মিশানের ডাকে ভেতরে ডুকলো রোহান। রোদের আবার এতসব পছন্দ না। যেখানে এই রোহান আদ্রিয়ানকে ভাই ডাকে সেখানে মিশান আবার রোহানকে ভাই ডাকে৷ মানে সম্পর্কের কঁথা পুড়ি অবস্থা। মিনমিন করতে করতে রোদ কিচেনে ডুকলো কফি আনতে। এক কাপ কফি তো দেয়াই যায়। ছেলেটা বিদায় হলে বাঁচে রোদ। যেই পসেসিভ ওর জামাই। রোদের পাশে কোন ছেলেকে সহ্য করে না ও। ইদানীং রোহানের সাথে সক্ষ্যতার রহস্য ওর অজানা।

জারবা ইয়াজকে কল করছে কিন্তু ইয়াজ রিসিভ করছে না। জারবা ঘড়িতে সময়টা পরখ করে নিলো বারকয়েক। আজ এই টাইমে তো ওনার ডিউটি নেই তাহলে কল করে ধরছে না?বোকাসোকা জারবা’র মুখে আধার নেমে আসলো। মুহূর্তেই ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেল। নাকের পাটা ফুলে চোখে স্থান পেল পানির ফোয়ারা। ঝাপসা চোখে ডায়াল লিস্টে ছোট ভাবী লিখা নামে কল দিলো। রিসিভ হতেই নাক টেনে টেনে একগাদা বিচার দিলো ইয়াজের নামে। ইয়াজ নাকি কল ধরছে না। রোদ জারবার কান্না থামাতে সান্ত্বনা স্বরে বললো,

— জারবা বোন কাঁদে না। আমি ঐ ইয়াজ্জাকে টাইট দিচ্ছি।
জারবা নাক টেনে “আচ্ছা” বলে ফোন রাখলো। ঠিক পাক্কা দশ মিনিট পরই ইয়াজের নামটা জ্বলে উঠলো জারবার মুঠোফোনে। অভিমানী জারবা ধরবে না ফোন কিন্তু দুই বার রিং হতেই তিনবার শব্দ করার সাধ্য হলো না জারবা রিসিভ করে চুপ করে আছে। ইয়াজ ক্লান্ত কন্ঠে ডাকলো,

— কথা বলো জারবা। অনেক টায়ার্ড লাগছে। কথা বলার শক্তি নেই। রোদ কান ঝালাফালা করে দিয়েছে।
কান্নারত গলায় বলে উঠলো জারবা,
— কল করছি কখন থেকে? ধরেন না কেন?
— একজন ডক্টরের ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট।
— তাতে আপনার কি?
— আহ।কথা শেষ করতে দাও।
জারবা নীরব রইলো। ইয়াজ বলে উঠলো,

–আজ ডেলিভারি তাই ডক্টর চলে গিয়েছে ওনার প্রকসি হিসেবে আজ আমি ডিউটি করলাম। বুঝলে আমার বোকা বউ?
— আমি বউ না?
— তাতে কি? করব তারাতাড়ি।
— আজ রাতে আসবেন না?
— আসব জান। শুনো ঐ দিনের গোলাপি ড্রেসটা পরবে। ঠিক আছে?
— আচ্ছা।
ইয়াজ কল কাটলো। এই বোকা প্রেমিকা নিয়ে কোথায় যাবে ও? নুন থেকে চুন খসলেই রোদকে দিয়ে ধমকাধমকি খাওয়ায়। হুমকি ধামকি দেয়।

জাইফার শরীর এখন কিছুটা সুস্থ। রাদ অফিস থেকে আজ তারাতাড়ি ফিরেছে। হাতে এতো এতো ফলমূল যা মূলত ওর বাবা রাস্তা থেকে ধরিয়ে দিয়েছে। বাসায় ডুকেই জোরে ডাক দিলো,
— আম্মু?
রাদের মা কিচেন থেকে দৌড়ে এসে বললেন,
— কি হয়েছে? হাতে এতো কি সব?

— আব্বু ধরিয়ে দিলো জাইফার জন্য। কেমন লাগে বলো? এগুলো নিয়ে হেটে এলাম গলি থেকে।
রাদের মা এসে ছেলের থেকে ধরলেন। রাদ ধাম করে সোফায় শুয়ে পরলো। ওর মা এসে মাথার কাছে বসতেই রাদ মাথাটা মায়ের কোলে তুলে দিলো। রাদের মা ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

— কি হয়েছে আব্বু? এত ক্লান্ত কেন?
— এমনিই।
— এত চিন্তা কিসের? জাইফা ঠিক আছে। অতিরিক্ত টেনশনে দিনদিন কি অবস্থা করছিস নিজের?
— জাইফা রুমে?
— হ্যাঁ। দিশা এসে ফল খাওয়ালো মাত্র। এখন দেখে এলাম মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে।

রাদ চুপ রইলো। ইদানীং ভীষণ ভাবে ভাবায় ওকে সব কিছু। ওর না চাইতেও বারবার মনে হয় দিশার মন ভাঙার শাস্তি সরুপ ওর জাইফা আর বাচ্চাটার কিছু যদি হয়? যদিও এতে রাদের কোন দোষ নেই তবুও অযাচিত সব চিন্তা ভাবনা গুলো জেঁকে ধরে ওকে। পা বাড়িয়ে রুমে ডুকতেই দেখলো জাইফার হাস্যোজ্জ্বল মুখ খানা। প্রশান্তি বয়ে গেলো রাদের সর্বাঙ্গে। কত সুন্দর হেসে হেসে দিশার সাথে কথা বলছে।

প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে যেন জাইফার সৌন্দর্য বেড়েছে কয়েকগুণ। আনমনে ভাবতে ভাবতেই রাদের চোখ ভিজে উঠলো। বাবা হওয়া মোটেও সহজ কিছু না। একজন মা যদি সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে তাহলে বাবা করে মস্তিষ্কের মাঝে। শুধু মাত্র সন্তান না। স্ত্রী এবং সন্তান উভয়ের চিন্তা বহন করে একজন বাবা অথচ বাইরে থেকে বুঝা দায়। কঠিন বাবাটার ভেতর কতটা নরম আর অসহায় থাকে তা হয়তো কেউ ই দেখে না।
নিজেকে সামলে নিলো রাদ। ভেতরে ডুকে বললো,

— জায়ু আজ বাইরে যাব তো। দিশা যাবি না?
দিশা অন্য দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো,
— জ্বি ভাইয়া যাব।
কথাটা বলে জাইফা থেকে বিদায় নিয়ে হুরমুর করে চলে গেল দিশা। রাদের সামনে পরতে চায় নাও নেহাতই আজ ভাগ্যক্রমে দেখা হলো।

সন্ধ্যা থেকেই মিশি’কে আটকে রাখা যাচ্ছে না। রোদের সাথে ঘুরঘুর করছে আর বুলি ফুটাচ্ছে,
— মাম্মা বাবাইকে ফোন দাও। বাবাই পমিস করেছে তো। ভাই,আমি,তুমি, বাবাই বেড়াতে যাব তো।
রোদ কত বুঝানোর চেষ্টা করলো। লাভ হলো না। মিশানের মুখ জুড়ে তখন চোরা হাসি৷ মা তো আর জানে না এটা মিশানের প্ল্যান। হঠাৎ রোদের চোখ ওদিকে পরতেই চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো রোদ। মিশান হঠাৎ তাকাতেই থতমত খেয়ে হাবলা মার্কা হাসি দিয়ে বললো,

— মা ক্ষুধা লেগেছে।
রোদ মিশানের সামনে এসে হালকা করে কান মুচড়ে দিয়ে বললো,
— এতক্ষণ ধরে এই পাজিটাকে আপনি উস্কানি দিচ্ছিলেন তাই না আব্বাজান?
মিশান একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
— আমি ঠিক আছি তো। প্লিজ না করো না।
রোদ মিশানের চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বললো,
— কি খাবে বলো।
— চা আর বাখরখানি।
রোদ হেসে কিচেনে পা বাড়ালো। রোদ থেকেই এই অভ্যাস পেয়েছে মিশান। প্রায় সময় বিকেলে এটা খাওয়া হয় ওদের।

আদ্রিয়ান আসতেই তাড়া দিলো রেডী হতে। রোদ আলমারি খুলে একটা একটা ড্রেস হাতে নিতেই আদ্রিয়ান পেছন থেকে ভেজা শরীর নিয়ে এসে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আলমারি থেকে একটা ব্যাগ বের করতে লাগলো। সদ্য সাওয়ার নেয়া ভেজা ভেজা আধখোলা আদ্রিয়ান রোদের ভীষণ ভালো লাগলো। মন চাইলো ভেজা লোমশ বুকে নিজের হাতের স্পর্শ দিতে। যেই ভাবা ওই কাজ করতে রোদ হাত বাড়ানোর আগেই আদ্রিয়ান সরে গেল। ধাতস্থ হলো রোদ। আদ্রিয়ান প্যাকেট’টা রোদকে দিয়ে বললো,

— এটা পড়বে আজকে।
শাড়ী দেখে ভীষণ ভাবে চমকালো রোদ। প্রশ্নাত্মক কন্ঠে বললো,
— শাড়ী কোথায় পেলেন?
— মলে।
–আরে..
— কোন আরে মারে না। যাবতীয় সব পড়ো। শাড়ী না হয় আমি পড়িয়ে দিব।
কথাটা বলেই চোখ মারলো আদ্রিয়ান। রোদ মুখ কুচকে বললো,

— কোন দরকার নেই। আমিই পারি।
— তুমি শাড়ী পরতে পারো?
অবাক কন্ঠ আদ্রিয়ানের। রোদ আদ্রিয়ান’কে ঠেলতে ঠেলতে,
— যান তো আপনি। আমি শাড়ী পরে নি তারপর আসবেন।

আদ্রিয়ান বের হবে না কিছুতেই। ওর কথা ও নিজে শাড়ী পড়িয়ে দিবে অগত্যা রোদ ওয়াসরুম থেকে সব পড়ে বের হলো। আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো পরপর চোখ নামিয়ে রোদকে টেনে নিজের কাছে নিলো। শাড়ী পড়ানোর নাম করে এই আদ্রিয়ান এদিকে ওদিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে রোদকে জ্বালাতে লাগলো। রোদ কতক্ষণ মোচড়া মোচড়ি করে থামাতে চাইলেও পারলো না। না পেরে এই বার ছোঁ মেরে শাড়ী নিজে নিয়ে কটমট করে বললো,

— একদম কাছে আসবেন না। আমি কাছে আসলেই দূর ছাই করে আর নিজে যখন তখন…
আদ্রিয়ান রোদকে থামিয়ে দিলো। খোলা কমোড়ে দুষ্ট হাতের বিচরণ ঘটতেই রোদের শরীর অবশ হয়ে এলো। আদ্রিয়ান নিজেও অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে। দুই হাতে রোদের গোলগাল মুখটা ধরে বেশ সময় নিয়ে আদর করলো গাল ভর্তি। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে রোদ। আদ্রিয়ানও যেন ভুলে যাচ্ছে। হাতে রাখা শাড়ীটা ফেলে রোদকে উঁচু করে ধরতেই দরজায় নক হলো। আদ্রিয়ান যেন হুসে ফিরলো। রোদ তখনও আদ্রিয়ানের সাথে মিশে। দরজায় নক হওয়ার আওয়াজ যেন ওর কান অব্দি পৌঁছাতে পারে নি। আদ্রিয়ান রোদকে নামিয়ে জড়িয়ে নিলো বুকে। দরজায় আবারও নক হতেই আদ্রিয়ান বললো,

— কে?
— বাবাই?
— মা আমি আসছি। ভাইয়ের কাছে যাও।
আদ্রিয়ান রোদকে ছাড়তেই রোদ আঁকড়ে ধরলো। আদ্রিয়ানের চোখে নিজের চোখ রাখলো। চোখে চোখে আবেদন করলো রোদ। বৈধ পবিত্র আবদার। আদ্রিয়ানের চোখ তখন অসহায়ের ন্যায়। রোদকে বুঝানোর চেষ্টা করতেই রোদ শক্ত করে ধরে বললো,

— প্লিজ।
আদ্রিয়ান দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। এদিক ওদিক নজর ঘুরালো। পলক ঝাপটালো কয়েকবার। রোদের নজরে নজর মেলাতে পারছে না ও। এই চোখ যে এখন আদ্রিয়ানকে চাইছে। সানিধ্য চাইছে ওর। আদ্রিয়ান রোদের মাথায় এক হাত রেখে আদর করে দিতেই রোদের চোখ দিয়ে টুপ করে দুই তিন ফোটা পানি পরলো। এই মাথায় আদর কিসের তা বুঝতে দেড়ী হয় নি রোদের। এই আদরের মানে আদ্রিয়ান এখন রোদকে ছাড়তে বলছে। শেষ বারের মতো রোদ আদ্রিয়ানের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইলো কিন্তু প্রত্যাখ্যানই পেলো। অতি কষ্টে, দুঃখে, রাগে রোদের মাথাটা ফেটে যাচ্ছে যেন। তবুও সব ভুলে নিজেকে বেহায়া উপাধি দিয়ে আদ্রিয়ানের চোখে চোখ দিয়ে বললো,

— আমি আপনাকে চাইছি। আমার স্ত্রী হওয়ার অধিকার দিন।
আদ্রিয়ানের মনে হচ্ছে ওর হৃদপিণ্ডে কেউ খামচে ধরেছে। আকুলতা ভরা দৃষ্টিতে কিছু বুঝাতে চাইলো রোদকে কিন্তু রোদ বুঝার চেষ্টা করলো না। রোদ জানে আদ্রিয়ান কিছুই দিবে না। ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দিলো রোদ তখনই যেন আদ্রিয়ানের বুকে হাতুড়ি পেটা অনুবাদ হলো। মন চাইলো রোদকে ধরে বুকে ভরে রাখতে। রোদ কেন ছেড়ে দিলো? রোদ দূরে সরে দাঁড়ালো। মুখে অনুভূতিহীন ভাবে বললো,

— যান। আমি রেডি হয়ে আসছি।
— রোদ শুনো…
— বললাম তো আসছি রেডি হয়ে।
আদ্রিয়ান বুঝানোর জন্য কয়েকপা এগিয়ে এলো রোদের দিকে। রোদের চোখ মুখের অবস্থা দেখে ওর ভেতরটা হু হু করে উঠছে। এই মেয়ে কেন বুঝার চেষ্টা করছে না? আদ্রিয়ান ওকে ধরতে গেলেই রোদ ঝামটা মে’রে বললো,
— এই এতো ধরাধরি কিসের হ্যাঁ? একদম ধরবেন না। কোন দিন কাছে আসতে চাইবেন শুধু ঐদিন দেখাবো আপনাকে আমি কি? দূরে থাকবেন আমার থেকে।

কথাগুলো বলেই রোদ ফ্লোর থেকে শাড়ী তুলে নিলো। আয়নার সামনে এসে নিজেই পরতে লাগলো। ফুঁপানোর শব্দ কানে আসছে আদ্রিয়ানের কিন্তু কিছু করার নেই। এখন ধরতে গেলেই রোদ ক্ষেপে যাবে। আস্তে করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল আদ্রিয়ান। রোদ এবার কেঁদে উঠলো। কি হয় রোদকে আদর করলে? রোদ কি দেখতে এতটাই খারাপ? আদ্রিয়ান কি তাহলে মাইশাকে ভুলতে পারে নি? না চাইতেও এই চিন্তাই রোদের মাথায় ডুকলো। শাড়ী পড়ে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে হিজাব বেঁধে নিলো। মনের বিষাদ গুলো কৃত্রিম আবরনে ঢেকে দিলো রোদ। হাতে ফোনটা নিয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখলো আদ্রিয়ান, মিশান আর মিশি পুরো রেডি। রোদ আদ্রিয়ানকে উপেক্ষা করে মিশানের হাত ধরে বললো,

— চলো।
মিশি ছিলো আদ্রিয়ানের কোলে। চারজন একসাথে বের হলো। গাড়িতেও পিনপতন নীরবতা। মাঝে মধ্যে শুধু মিশির টুকটাক কথা শুনা যাচ্ছে। মিশান পেছনে ঘুরে বললো,
— মা?
— হুম বলো।
–তোমার মন খারাপ? কথা বলো।
রোদ হাসার চেষ্টা করলো। বাচ্চাদের কি দোষ? মিশান আর মিশির সাথে কথা বলতেই আদ্রিয়ান সস্তি পেলো একটু নাহলে এতক্ষণ বুকে চাপা কষ্ট হচ্ছিলো। ওর রোদটার তো কোন দোষ নেই। পরিস্থিতি ই সব যেন ঘাটিয়ে দিচ্ছে।

গাড়িটা রুফ টপের সামনে থামতেই চারজন একসাথে বের হলো। রোদ, আদ্রিয়ানের জন্য কি অপেক্ষা করছে তা ওরা জানে না। বাইশ তলায় লিফ্টটা থামতেই হঠাৎ করে জোরে আওয়াজ হলো। রোদ আর আদ্রিয়ানের পরিবারের সব ভাই-বোনেরা আছে এখানে। বড় ব্যানারে শোভা পাচ্ছে ইংরেজিতে লিখা, “হ্যাপি সিক্স মান্থ অব এনিভারসিরি”। আদ্রিয়ানের ও হঠাৎ মনে পরলো আজ ওদের বিয়ের ছয় মাস পূর্ণ হলো। সময়গুলো কখন কীভাবে গেলো কেউ টেরও পেলো না। বেশ বড় করেই একটা টেবিল বসানো।

রোদের সব মন খারাপ নিমিষেই ভালো হয়ে গেল। রাদ আর রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। কেক আনতেই রোদ খুশি হয়ে আদ্রিয়ানের হাত চেপে ধরলো। আদ্রিয়ানের বুকে যেন এক পশলা শান্তি নেমে এলো। ও তো ভেবেছিলো আগামী এক মাস ছুঁতেও দিবে না রোদ। যাক কিছুক্ষণের জন্য হলেও তো ভুলেছে। কেক কেটে বেশ ফটোসেশান করে খেতে বসলো সবাই একসাথে। রাতুল আর দিশাও আছে এখানে। দুই জন দুই দিকে। কেউ কারো সাথে কোন বাক্য বিনিময় করল না। শুধু না চাইতেও দৃষ্টি বিনিময় হলো কয়েকবার।

খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই গল্পে মেতে উঠলো। মিশি আর আলিফ এতক্ষণ এখানে খেললেও এখন দু’জনই ঘুম। রাত হ’য়েছে অনেক। মিশি রাদের কোলেই ঘুমোচ্ছে। রাত বেশি হচ্ছে দেখে রাদ যাওয়ার তাড়া দিলো। ওরা বিদায় নিলো সবাই। আরিয়ান, রাদ,জারবা আর ইয়াজ শুধু এখানে আদ্রিয়ানদের সাথে। মিশান আর মিশিকে নিয়ে যাবে রাদ। রোদ ভ্রু কুচকে বললো,

— আজব ওরা কেন যাবে?
— কাল দিয়ে যাব নে।
— কি দরকার? মিশি ঘুম থেকে উঠে না দেখলেই কাঁদবে।

আদ্রিয়ান রোদকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে মিশান৷ আর মিশিকে রাদ নিয়ে গেলো। আদ্রিয়ান এতে তেমন বাঁধা দেয় নি। রোদ এতেই অবাক। আদ্রিয়ান কেন কিছু বললো না? রোদ আদ্রিয়ান গাড়িতে। কেউ কোন কথা বলছে না। আদ্রিয়ান ভাবছে আরিয়ানের কথা। তখন আরিয়ান সাইডে নিয়ে ওকে কিছু বলেছে। যেখানে সবাই এসব স্বাভাবিক নিচ্ছে সেখানে আদ্রিয়ানই আটকে আছে। মন আর মস্তিষ্কের মাঝে যুদ্ধ করতে লাগলো আদ্রিয়ান। বাসায় সামনে আসতেই রোদ নেমে আগে গেলো পেছনে আদ্রিয়ান। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দু’জনই ভেতরে ডুকলো। রোদ রুমের দিকে হাটা দিতেই আদ্রিয়ান দরজা লক করে আটকে দিয়ে রোদের হাত টেনে ধরলো। রোদ ক্লান্ত স্বরে বললো,

–ছাড়ুন। চেঞ্জ করব।
আদ্রিয়ান কিছু না কোলে তুলে নিলো রোদকে। হকচকিয়ে গিয়ে রোদ বলে উঠলো,
— আরে আজব কি করছেন? নামান আমাকে।
আদ্রিয়ান নামালো না। সোজা রুমের দিকে হাটা দিলো। রুমের দরজা ধাক্কা দিতেই তা খুলে গেলো। সারা রুম ফুলের সুবাসে মৌ মৌ করছে। এত ঘ্রাণের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে উপস্থিত সকল পুষ্প। ধীমি আলোর বিচরণে অল্প উজ্জ্বলতায় ঘেরা রুমটা ফুল ভর্তি। পুরোটা সাজানো। এ যেন কারো বাসর সাজানো হ’য়েছে। রোদ অবাক হয়ে বললো,

— এসব কেন?
আদ্রিয়ান ওর কানে ফিসফিস করে বললো,
— পুষ্পহীন মধুরাত কিভাবে হবে সোনা?
আশ্চর্য হলো রোদ। কোল থেকে নামার জন্য তোরজোর করলো কিন্তু লাভ হলো না। আদ্রিয়ান শক্ত করে ধরে রাখলো নিজের সাথে। ফুলে সজ্জিত বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসলো। দুই হাতে রোদকে আগলে নিয়ে দু’জনের ওষ্ঠাধর মিলিত করে দিলো। বেশ সময় নিয়ে নিজেকে বেসামাল করে তুললো আদ্রিয়ান। গলায় মুখ ডুবাতেই রোদ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। আদ্রিয়ান অবাক কন্ঠে বললো,

— রোদ!
— কি রোদ? হ্যাঁ কি রোদ? যখন মন চাইবে ছুঁয়ে দিবেন তা তো হবে না। আমার অনুভূতির মূল্য নেই আপনার কাছে। আমি কাছে আসলেই দূর করে দেন কেন? আমি মেয়ে হয়ে আগ বাড়িয়ে আসি বলেই দাম নেই? আমার ইচ্ছা আকাঙ্খার দাম নেই?
কথাগুলো আওড়াতে গিয়ে অঝোরে কেঁদে উঠলো রোদ। আদ্রিয়ান ব্যাস্ত হয়ে এসে বুকে চেপে ধরলো রোদকে। মাথায় চুমু খেয়ে বললো,

— সোনাপাখি আমার। আমি চিন্তায় ছিলাম। বুঝ একবার। এই যে মাফ চাইছি।
— না না আপনি ভালোবাসেন না আমাকে। ছাড়ুন আমাকে।
আদ্রিয়ান রোদের কপালে চুমু খেয়ে খেয়ে গালেও দিলো। হাতের তালুতেও ঠোঁটের ছোঁয়া দিলো। এতে কাজ হলো বটে। কান্না থেমে থেমে আসছে।প্রিয় নারীর কান্না থামাতে জানে আদ্রিয়ান।

আস্তে আস্তে হিজাবটা খুলে টুকটাক পরিহিত অরনামেন্টস গুলোও খুলে। বারান্দার দরজাটা লাগিয়ে এসির টেমপারেচার কমিয়ে নিজের পরিহিত শার্টটা খুলে ফেললো। রোদের দিকে এগিয়ে এলো নেশালো চোখে। সেই চোখে আজ যেন রোদ নিজের ধ্বংস দেখতে পেলো। বেশিক্ষণ দৃষ্টি টিকিয়ে রাখতে পারলো না রোদ। চোখ নামিয়ে নিলো। বুকে ধ্রীম ধ্রীম শব্দ হচ্ছে। এতদিন যেই স্বর্গসুখে ভাসতে চেয়েছে রোদ আজ সেই সুখে ভাসাতে আসছে আদ্রিয়ান। রোদের ভয়ে শরীর কেঁপে উঠলো।
আদ্রিয়ান উন্মুক্ত বক্ষে এগিয়ে এলো। রোদের হাতে চুমু খেয়ে আরজি জানালো,

— মে আই মাই লাভ?
রোদ উসখুস করতে লাগলো। চঞ্চল হলো শ্বাস প্রশ্বাস। দিকবিদিকশুন্য হলো যেন। আদ্রিয়ান ততক্ষণে নিজের তৈরি অদৃশ্য দেয়াল ভেঙে ফেলেছে। ভুলে গেল সব চিন্তা ভাবনা। নিজের পৌরুষচিত্তের সবটুকু উজার করে দিলো প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীকে। প্রসস্থ, চওড়া বুকে ঠাই পেলো রোদ। ভালোবাসায় আজ যেন পিষে ফেলবে রোদকে আদ্রিয়ান।

আদ্রিয়ানের সম্পূর্ণ ধ্যান ভালোবাসাকে ভালোবাসতে। নিজেকে মাখিয়ে নিতে রোদের উষ্ণতায়। দুই মানব মানবী আজ এতদিনে ব্যাস্ত হলো নিজেদের মধ্যে ভালোবাসা আদান প্রদান করতে। আদ্রিয়ান যেন উন্মাদ হয়ে উঠলো। সেই উন্মাদের উন্মাদনায় পগলপ্রায় রোদ। সারা কক্ষে যেন সুবাস ছড়িয়ে পরলো ভালোবাসার। দুই জন মত্ত হলো দুজনে। মধুময় সময় অতিবাহিত করলো দুজন। রোদ নিজেকে সমর্পণ করলো আদ্রিয়ানের কাছে। আদ্রিয়ান ও অদৃশ্য খাঁচায় বন্দী করে নিলো ভালোবাসাকে। নিজেও ধরা দিলো কারো রোদের ছোট্ট হাতের মুঠোয়। প্রেম নিবেদন ঘটলো অবিরত।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৩

সকল চিন্তা, বাঁধা ভুলে গেল দুজন। আদ্রিয়ান আজ রোদকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিলো। রোদও যেন নিজেকে বিলীন করে দিলো ভালোবাসার পুরুষের কাছে। সারা ঘরে ছন্দ ছড়িয়ে পরলো ভালোবাসার। পূর্ণ হলো আজ রোদ আদ্রিয়ান যেমন আজ পূর্ণ আকাশের চাঁদটা। ভরা চাঁদটার মতোই পূর্ণ আজ রোদ। ভরা চাঁদ যেমন ডুবে যায় ঠিক তেমন ভাবে রোদ ডুবে যাচ্ছে তার প্রিয় জনের বুকে।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৫