ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬০

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬০
মিথুবুড়ি

“আপনি আবারো আমার বিশ্বাসে আঘাত করলেন?”
‘রিচার্ড নিশ্চুপ। নিটল, স্তব্ধ, অবিচল নীরবতায় জবান বন্দ করে রেখেছে সেই কখন থেকে। হাতদুটো শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করা। রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে এলিজাবেথের দিকে। ধৈর্যচ্যুত হয়ে কটাক্ষ মিশ্রিত গলায় চেঁচাল এলিজাবেথ,

“মেয়েদের ইজ্জত এতোটাই সস্তা আপনার কাছে? উত্তর দিন মি.কায়নাত।”
‘রিচার্ড নির্জীব। পাশেই সোফার উপর অবহেলায় পড়ে থাকা ল্যাপটপ হতে ক্লান্তিহীন শব্দের ধারা বইছে। সেখানে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে রিচার্ড আর এক অজ্ঞাত ব্যক্তির ফোনকলের কথোপকথন। যেখানে রিচার্ড লোকটাকে ডিরেকশন দিচ্ছে, কিভাবে এলিজাবেথকে হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান থেকে অপহরণ করে তাদের গোপন আস্তানায় নিয়ে আঁটকে রাখবে। থরথর করে কাঁপছে এলিজাবেথের ঠৌঁট। ভগ্নহৃদয়ে উতালপাতাল ঢেউ আঁচড়ে পড়ছে নিরন্তর। কার্নিশ জমেছে কালো মেঘের ঘনঘটা। থেমে, থেমে ঝরঝরিয়ে নামছে বৃষ্টি। বুকের গভীর থেকে ক্ষতের আতর্নাদ চিৎকার দিয়ে বেরোয়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনি আসলে কখনো আমাকে ভালোবাসেননি।”
‘তৎক্ষনাৎ রিচার্ডের তীব্র আপত্তি। রাশভারি মুখটা তুলে দাঁত খিঁচে বলল,
“আমি যা করেছি, তোমাকে তার থেকে দূরে নেওয়ার জন্য করেছি।”
“সেদিন যদি সে-ই লোকটা ঠিক সময় না আসত,কি হতো ভেবে দেখেছেন একবার?”
‘রিচার্ড নত দৃষ্টি নিবিষ্ট করে জলদগম্ভীর গলায় প্রত্যুত্তর করে,”কিছুই হতো না।”
‘কণ্ঠনালী বেয়ে তাচ্ছিল্যের ঝলক উঠে এলো ঠোঁটে। এলিজাবেথ দু’হাত তালি দিয়ে শব্দ করে হেসে উঠল আরও তীব্রতায়। কটাক্ষের সেই হাসিতে কেঁপে উঠল ওর পাতলা শরীর। হঠাৎই কণ্ঠ ভরে গেল বিষাদে। ঘৃণায় জর্জরিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল এলিজাবেথ,
“হতো। অবশ্যই হতো। আমি সেদিন ধর্ষিত হতে যাচ্ছিলাম। আবারও ঠিক যেমনটা পূর্বে আপনি আমার সঙ্গে করেছিলেন।”
‘রিচার্ডের চোখেমুখে বিদুৎচমকানোর মতো হিংস্রতা। তালুতে আঙুল পিষে ক্রোধ সংবরণ করার চেষ্টা করল সে। কণ্ঠে অদ্ভুত দৃঢ়তা,
“তোমার ভালোর জন্যই ছিল আমার সকল পদক্ষেপ।”

“আই ওয়াজ বিটেন বাই দ্যাট মাদা’রফা’কার। লোকটা আমাকে ছুঁয়েছিল, এখানে, ওখানে। অশোভন ভাষায় কথা বলে কাছে আসতে চেয়েছিল। তারপরও আপনি বলবেন–আপনি আমাকে সে-ই লোকটার থেকে দূর করার জন্য—সে-ই লোকটা, যে-ই লোকটা হাজার বার সুযোগ পেয়েও কখনো ছুঁয়ে দেখেনি আমাকে—সে-ই লোকটার থেকে দূরে নেওয়ার জন্য এমন নোংরা খেলা সাজিয়েছিলেন?”
‘থেমে, কথার শেষে আরেকটু সংযোজন করল এলিজাবেথ,
“নিজের স্ত্রীকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন, সেটার জন্যও এতো বাজে খেলা খেলতে হলো? একটু নত হলে কি এমন হতো?”

”রিচার্ড কায়নাত কখনো নত হয় না কারোর কাছে। হোক সে আমার স্ত্রী।”
‘আড়ষ্ট মেয়েটার ঠৌঁট কেঁপে ওঠে বারবার। বুকের গভীর থেকে উঠে আসে ভাঙাচোরা কান্না। ঠৌঁট কামড়ে কান্না আটকানো বৃথা চেষ্টা করল মেয়েটা। যদিও সে তাতে ব্যর্থ বরাবরের মতোই। নিভে আসা কণ্ঠে ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে আওড়ালো সে,
“কেন? কেন বারবার আমাকে আমার বিশ্বাসের কাছে হার মানতে হয়? যখন সবচেয়ে বেশি স্বামীর ছায়া খুঁজি পাশে, তখন কেন সে থাকে না? কী লুকোচ্ছে সে আমার কাছ থেকে? স্ত্রী হয়ে জানার এখতিয়ার কি আমার নেই?”
“না।”

‘এই স্বর ম্লান হওয়ার আগেই ধারালো ছুরির শীতল ফলা চিরে গেল মাংসপেশী। কালচে ঠোঁটের ফাঁক গলে গাঢ় খয়েরি র”‘ক্ত ছিটকে এসে বিদীর্ণ করল এলিজাবেথের কোমল ত্বক। রিচার্ড পেটে হাত চেপে কুঁচকে পড়ল এলিজাবেথের সামনে হাঁটু ভেঙে। আঙুলের ফাঁক গলে ফিনকি দিয়ে ঝরতে থাকল র”ক্ত। নিস্পৃহ চোখে রিচার্ড চেয়ে থাকে এলিজাবেথের দিকে। এলিজাবেথ র”‘ক্তমাখা ছুরিটা হাতে নিয়ে রিচার্ডের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসল। রিচার্ড
“What’s the big deal about kneeling? See, I’m doing it too.”
‘ফিচলে হাসল তার আত্মঘাতীকে পুড়তে দেখে তার যন্ত্রণায়।রিচার্ড র”ক্তমাখা ঠৌঁট কামড়ে যন্ত্রণা গিলে নিলো।
“বাহ! এতো পদন্নোতি? স্বামীর পেটে ছুরি চালাতেও শিখে গিয়েছ।”
‘এলিজাবেথ বাকরূদ্ধ। যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ ভঙ্গুরতা লোকানোর। ওদিকে ফ্লোরে র”ক্তে”র রক্তিমা নদীর স্রোত প্রবাহমান অজস্রধারায় হাঁটু বেয়ে গড়িয়ে পড়া র”ক্তে। র”ক্তে’র পিচ্ছিল গন্ধে গুমোট পরিবেশ যেনো শোকে গেয়ে উঠল৷ আবারো হাসল রিচার্ড, তবে এবার উপহাসের হাসি।
“এখন বুঝি আর ভালোবাসো না আমাকে?”

‘দু’হাতের কুয়াশাভরা আদলায় এলিজাবেথ চেপে ধরল রিচার্ডের রক্ষ পুরুষালি দাঁড়ি বিহীন চোয়াল। বৃদ্ধাঙ্গুলে তুলে নিল এক ফোঁটা উষ্ণ র”ক্ত। এক টুকরো উষ্ণ স্পর্শে পাষণ্ড লোকটার বুক ধাঁধিয়ে গেল শীতলতায়। বুক হিম হয়ে আসে। আজ ভঙ্গুর মেয়েটার ভাঙা কণ্ঠে অদ্ভুত রকমের দৃঢ়তা। রক্তাক্ত স্বামীর সমুদ্র নীল চোখে আলোছায়া মেশানো চোখের স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্ষীণ আওয়াজে আওড়ালো,
“আমি ভালোবাসি আপনাকে। এখনো ঠিক আগের মতোই ভালোবাসি। কিন্তু আমরা এক হতে পারব না কারণ আপনার কাছ থেকে কষ্ট পেতে, পেতে আমি ক্লান্ত; কান্না করতে করতে আমি ক্লান্ত। আপনি সবসময় আমার মন ভেঙে দিয়েছেন—লাগাতার, বারবার। আমি এভাবে বাঁচতে পারব না। কষ্টের পরিবর্তে এবার আমি নিজেকে বেছে নিলাম। আই’ম ডান মি.কায়নাত।”

‘অজানা উদ্বেগ চেপে বসল রিচার্ডের ভিতর৷ হারানোর অন্তগর্ত ভয়ে,ভয়াল অনুভূতিতে বেজে উঠল শরীরের শিরা-উপশিরা। তবুও লোকটা তার শক্ত খোলস থেকে বের হলো না। অধর কোণে দীপ্তি দিল চিরচেনা সেই বাঁকা হাসি। নিখিল কৃষ্ণ চোখে সন্নিকটের অবিনাশী চাহনিতে নিস্প্রভ দ্বিধাহীন নজরে চেয়ে ধরাশায়ী কণ্ঠে বলল,
“তবে এখনো হাত তেমন পাকাপোক্ত হয়নি। এটুকুতে কেউ মরে না। মারতে গেলে তীক্ষ্ণ ফলা আরো গভীরে প্রবেশ করাতে হয়। সেজন্য বুকে ছুরি চালানো অতিব জরুরি।”
‘শক্ত ঢোক গিলল এলিজাবেথ। পরপর কয়েকবার ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে চোখের কোণ বেয়ে নামা অনাহুত জলের রেখা মুছে নিল আঙুলের পেছনে। অভিন্ন, শীতল স্বরে বলল,

“আজ ছুরি চালিয়েছি। ভবিষ্যতে অস্ত্র চালাবো। যদি আবার আপনি জাল বিছানো শিকারি হয়ে ধরা দেন আমাকে, তখন সরাসরি বুকে চালাবো। দেবেন তো বুক উজাড় করে? খুব বেশি কিছু কি চেয়ে ফেলেছি?”
‘রিচার্ডের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এলো। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শরীর নিস্তেজ হতে থাকে তবুও মুখাবয়বে তার ছিটেফোঁটা ক্লান্তি নেই, বরং চোখেমুখে এক উদ্দাম, বেপরোয়া উল্লাস। ক্ষতস্থান থেকে হাত তুলে এলিজাবেথের হাত চেপে ধরল রিচার্ড। রক্তাক্ত আঙুলের কঠিন স্পর্শে কেঁপে উঠল দুজনেই। পেটের ক্ষত থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। রিচার্ড আরেকটু কুঁকড়ে গেল তবুও মুখাবয়বে নির্ভয়ের দীপ্তি অটুট। মানুষটার কণ্ঠস্বর হঠাৎই কোমল হয়ে এল। অপরিচিত সেই কোমলতায় ভেসে উঠে নির্দ্বিধায় গেয়ে উঠল রিচার্ড,

“যা চাওয়ার চেয়ে নে
যা পাওয়ার নিয়ে নে
যা হওয়ার হয়ে নে আজকে………
এদিন বেসামাল তোর স্বস্থি নাজেহাল
দেখে কষ্ট হলো কাল ঝরটাকে….
“ও তাইতো প্রেমের লিখেছি
আর তাতে তোর নাম লিখেছি
মাঝ রাতে বদনাম হলো মন, যেইনা
চোখের ইচ্ছা হলো,,,,
তোর পাড়াতেই থাকতে গেলো,
ডাক নামে তোর ডাকতে গেলো মন,
কি করি এমন অসুখের
জমেছে মরন এ বুকে……
“লাস্ট হাগ?”

‘অনুমতির অপেক্ষা করল না এলিজাবেথ। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রিচার্ড’কে—দু’হাতে গলা পেঁচিয়ে। রক্তে ভিজে গেল ওর শাড়ি। তবে অবকাশ দিল না রিচার্ডকে ধরার। কান্না করতে করতে বেরিয়ে গেল ম্যানশন থেকে। ঠৌঁটে কোণে বার বার ধ্বনিত হতে থাকে,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি মানে, কখনো ‘ভালোবাসি’ না বললেও ভালোবাসি! সারাজীবন ভালোবাসবো।”
‘রিচার্ড পেটে হাত চেপে ধীরে উঠে দাঁড়াল। রক্তপাত খানিকটা কমেছে কিন্তু শরীর নিস্তেজ প্রাণশক্তি যেন ধীরে ধীরে নিভে আসছে। ডগমগ পায়ে এগিয়ে গিয়ে মেইন ফটকের সামনে স্থির হলো রিচার্ড। এলিজাবেথ তখনও ম্যানশনের ভেতর, গেটের দিকে অগ্রসর। রিচার্ডকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে গার্ডরা মুহূর্তেই বন্দুক তাক করল তার দিকে। তৎক্ষণাৎ রিচার্ড গর্জে উঠল। কণ্ঠে আহত সিংহের দহন,
“উমহু ডোন্ট।”
‘গার্ডরা স্তব্ধ। শোচনীয় বিস্ময়ে বন্দুক নামিয়ে নতজানু হয়ে পড়ল। তাদের দৃষ্টিও নত হলো। রিচার্ডের দেহে আগেই ছিল অসংখ্য ক্ষত; এখনের এই অতিরিক্ত রক্তপাত আর সইল না। চারপাশের দৃশ্য ক্রমে ঝাপসা, কালো হয়ে আসতে লাগল। হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে ধপ করে লুটিয়ে পড়ল রিচার্ড। গার্ডরা ছুটে এলো তার দিকে। ঘোলা দৃষ্টিতে রিচার্ড শেষবার দেখল এলিজাবেথ গেট পেরিয়ে গেল,একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না। সহসা চোখ বুজে এল রিচার্ডের।

‘এটা সেই কল রেকর্ডিং—যেটা সেদিন রিচার্ড শুনেছিল। যা শুনতেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল ঘাম গড়িয়ে পড়েছিল। জেমস যা বারবার পাঠাতে চেয়েছিল এলিজাবেথের কাছে। বহু ব্যর্থতার পর অবশেষে সফল হয় জেমস। কত চাতুরী, কত গভীর খোঁজের পর শেষমেশ রেকর্ডটা খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিল জেমস। সেদিন, যেদিন এলিজাবেথকে গ্র্যান্ড সুলতানা থেকে অপহরণ করা হয় পুরোটাই ছিল রিচার্ডের সাজানো নাটক। উদ্দেশ্য একটাই তাকবীরের কাছ থেকে এলিজাবেথকে সরিয়ে দেওয়া। কারণ রিচার্ড আগে থেকেই জেনে গিয়েছিল তাকবীর এলিজাবেথ’কে লুকিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করছে। তাই খেলার প্রথম চালটা দেয় রিচার্ডই, যাতে তাকবীর বাধ্য হয় এলিজাবেথকে দ্রুত দূরে সরিয়ে দিতে।

‘রিচার্ড চাইলেই তার ক্ষমতা দেখিয়ে এলিজাবেথকে কাছে আনতে পারত, কিংবা দূরে সরিয়ে রাখতে পারত। কিন্তু রিচার্ড ইচ্ছে করেই তা করেনি। সে চেয়েছিল দূরে রেখে প্রতিকূলতার ভেতর ফেলে এলিজাবেথকে আরো শক্ত করতে। এমনভাবে যেন এলিজাবেথ যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। সেদিন রিচার্ডের ভাড়া করা লোকেরাই প্রথমে এলিজাবেথকে অপহরণ করেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর একটা ফোনকলের মাধ্যমে তারা বিক্রি হয়ে যায় তাকবীরের শত্রুদের হাতে। তাদের আদেশেই তারা চেষ্টা করেছিল এলিজাবেথকে লাঞ্ছিত করতে। এই সবকিছুর তথ্য, এই কল রেকর্ডিং জেমস সংগ্রহ করে পাঠিয়েছে এলিজাবেথের কাছে। শুধুমাত্র একটাই উদ্দেশ্য: রিচার্ডকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। কারণ এখন জেমস খুব ভালো করেই জানে রিচার্ডের একমাত্র দুর্বলতা এলিজাবেথ। আর শত্রুরা জানে আঘাত করতে হয় ঠিক দুর্বলতার কেন্দ্রে।

“হা, ফিনিস অল অফ দ্যাম।”
‘কঠোর গলায় বলে ফোন কাটল রিচার্ড। ইতোমধ্যে জেমস দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আপাতত রিচার্ডের বন্দিশালায় জেমসের সমস্ত লোক। ইতালিতে জেমসের যত সম্পদ, যত স্মৃতি সবকিছুকে আগুনের ভস্ম করে দিয়েছে রিচার্ড। প্রতিশোধস্পৃহায় ছটফট করছে সে। চাইলে জেমসের দুর্বলতা লাড়াকেই বেছে নিতে পারত, তবে করেনি। লাড়া আবারো ফিরে গিয়েছে ইউএসএ-তে।
‘রিচার্ড ফোন রেখে ধীরে টান দিয়ে সোজা হয়ে বসতেই পেটের সেলাইয়ের চারপাশে খিঁচ ধরে তীক্ষ্ণ ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। মুখ কুঁচকে যায় যন্ত্রণায়। পেটে চারটে সেলাই লেগেছে। ক্ষত তেমন গভীর নয়। বউ বেশ মায়া করেই কোপ বসিয়েছিল। ভিয়েতনামের মিশন থেকে ফেরার পর রিচার্ডের শরীর এমনিতেই ছিল দূর্বল, তারপর আবার নতুন করে ক্ষত, তাই ডাক্তার কড়া নিষেধ দিয়েছেন কয়েকদিনের বিছানা বিশ্রাম ছাড়া উপায় নেই। রিচার্ড থাকতে চায়নি একরাতও, কিন্তু ন্যাসো লুকাসের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়েছে।

‘লুকাস কালকেই ফিরেছে রাশিয়া থেকে। রিচার্ডের খবর শুনেই এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হাসপাতাল ছুটে এসেছে। সারা রাত ছিল এখানে। নিজের শরীরও ক্ষত-বিক্ষত। কপালে সেলাইয়ের রেখা, উপরে কোনো ব্যান্ডেজ নেই কালো মুখশ্রীতে আরও ভয়াল ছাপ পড়েছে। এলিজাবেথ ম্যানশন ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই ন্যাসো সঙ্গে সঙ্গে ওকে আনতে গিয়েছিল। এলিজাবেথ আর ফেরেনি। জানায় সে আর ফিরবে না। উপায় না দেখে ইবরাত ওকে নিয়ে এক হোটেলে রাত কাটিয়েছে। এলিজাবেথও সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে সকাল হলেই চাচার বাড়ি চলে যাবে। ইবরাত এলিজাবেথের সঙ্গে এটা জানার পর রিচার্ড আর পাগলামি করেনি হাসপাতাল ছাড়ার। এলিজাবেথ আর ইবরাত হোটেলে থাকলেও, ন্যাসো আর লুকাস এক মুহূর্তের জন্যও সরে যায়নি রিচার্ডের পাশ থেকে। অথচ দুজনেই ক্লান্ত, অবসন্ন। লুকাসের নিজেরই চিকিৎসা প্রয়োজন ছিল। শেষ রাতে রিচার্ডের কঠিন ধমক খেয়ে সে নিজের শরীরের ক্ষতগুলো জোড়াতালি দিয়েছে। আবার সকল হতেই গেঁথে গিয়েছে তাদের বসের কেবিনে। রিচার্ড এদের উপর বিরক্ত হতে চেয়েও পারে না৷

‘লুকাস বসে বসে কমলার খোসা ছাড়িয়ে কমলা খাচ্ছিল,পাশেই ন্যাসো ফোনে কিছু একটা করছিল। হঠাৎই চোখাচোখি হলো দুজনের। চোখেচোখে বাক্য আদানপ্রদান করল তারা। এতো বড় কেবিনের নিরবতা লুকাস’কে অস্থির করে তুলে। হাঁসফাঁস করতে থাকে সে। শব্দ করে গলা খাঁকারি দিয়ে কেবিনের নিস্তব্ধতা ভাঙল লুকাস। পরপর আমতাআমতা করে রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বস এখন কেমন বোধ হচ্ছে?”
‘দেখতে সুন্দরী এবং ভদ্র গোছের অবাধ্য তকমা নিয়ে ঘোরা বউকে কাল থেকে দেখতে পারছে না বলে রিচার্ডের মেজাজ ছিল এমনিতেই চটে। এমতাবস্থায় লুকাসের ঠেস মারা কথা চটানো মেজাজ সঙ্গে সঙ্গে তিরিক্ষি মেজাজে পরিণত হলো। কটাক্ষ মিশ্রিত গলা ঝাঁঝিয়ে উঠল রিচার্ড,
“খুব গর্ভবোধ হচ্ছে। গর্ভে পেট ফুলে যাচ্ছে আমার। না জানি কখন অতি গর্ভে গর্ভবতী হয়ে যায়।”
‘ন্যাসো পানি খাচ্ছিল। রিচার্ডের কথা কর্নকূহরে পৌছানো মাত্র পানি তার তালু ছুঁলো। কাশতে কাশতে মাথায় হাতের তালু চাপড়াতে থাকল ন্যাসো। লুকাস সেন্টি খেয়ে তাকিয়ে থাকে রিচার্ডের দিকে। তবে সে তো চুপ থাকার মানুষ নয়। তার বৈশিষ্ট্যের সাথে নিরবতা কোনো এঙ্গেল থেকেই মানাসই না। কুটিল হাসল লুকাস। দু-হাতে মুখ চেপে লাজুক হেসে বলল,

“ছিঃ বস! প্রযুক্তি এখনো এতোটাও উন্নত হয়নি।”
‘রিচার্ড রক্তিম চোখে লুকাসের দিকে তাকাল। বিরক্তে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“তোমার মুখ বন্ধ করার জন্য নিজের হাতে মেশিন বানাবো আমি।”
‘তব্দা খেয়ে যায় লুকাস। তড়িঘড়ি করে মুখে হাত চেপে ধরে লাগাম টানল। ন্যাসো ঠৌঁট কামড়ে হাসল। লুকাসের ঠৌঁট নিশপিশ করতে থাকে। ঠৌঁটের আগায় জড়ো হয়েছে অজস্র বাগধারা। সে মিনমিনিয়ে বলল,
“বস আমার বোধহয় মুখের রুচি বেড়েছে।”
‘রিচার্ড গা ঝাড়া জবাবে বলল,”কবে কম ছিল?”
‘লুকাস এবার লাফিয়ে উঠল,
“আরে তেমনটা না বস! মনে হয় এখন আমার ভিটামিন অফ ডায়াবেটিস আর নারী নাশক ক্যালসিয়াম-এর ডোজ একটু বেশি হয়ে গেছে। বুঝলেন না? এই মিশনে যাকে দেখেছি তাকেই লাগছে ওহ মা গো! রাশিয়ান মেয়েরা তো আসলেই এক্সট্রা স্ট্রং৷ এবার বুঝলাম আপনি ম্যাডামের পেছনে এতো কেন হাওয়ার মতো দৌড়া,,,,,
‘বাক্য সমাপ্ত করার আগেই ন্যাসোর কনুইয়ের গুঁতো পড়ল লুকাসের বাহুতে। লুকাস কপাল কুঁচকে ন্যাসোর দিকে তাকাতেই সে চোখ দিয়ে সর্তক করল তাকে। তৎক্ষনাৎ জিভ কাটল লুকাস। পরপরই বাক্য সংশোধনে বিলম্বনা করল না।

“স্যরি বস আন্টি।”
‘রিচার্ড তার অগ্নি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল, কর্কশ শ্বাস ফেলল। লুকাস মিইয়ে গিয়ে থমথমে গলায় বলল,
“বস আমি বিয়ে করতে চাই।”
“কর, কে আঁটকিয়েছে? মেয়ে পছন্দ কর। ন্যাসো তুলে এনে দিবে।”
‘বিষন্ন অনুভূতির মিলনে চুপসে গেল লুকাসের মন। তবুও কণ্ঠে দৃঢ়তার প্রবল ঢেউ, নেই কোনোপ্রকার জড়তা। দৃঢ়হৃদয়ে সে বলল,
“অন্য কোনো মেয়েকে না বস। আমার সুইটিকেই লাগবে। আমাকে দেশে যেতে দিন।”
‘রিচার্ড গম্ভীর ভঙ্গিতে ম্যাগাজিনের পাতা পাল্টাতে, পাল্টাতে রাশভারি আওয়াজে বলল,
“তাহলে আরো ওয়েট করতে হবে। অনেক কাজ এখনো বাকি। আমার সাথে থাকতে হলে দেশে যাওয়ার চিন্তাভাবনা বাদ দাও। এখানেই কাউকে দেখে সংসার শুরু কর।”

‘অন্য কারোর সাথে সংসার’ শব্দ মস্তিষ্কে পাক খেতে লুকাসের অনুভূত হলো সে ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আটকে গিয়েছে। গোটা পৃথিবী ঘূর্ণন গতিতে ঘুরছে তার চারপাশে। পরক্ষণেই সুইটির সেই আলোছায়া মেশানো চোখ,অবিনাশী চাহনি, ঘন কালো কেশরাশি, ঠৌঁটের কোণের সেই নির্মল হাসি চোখের সামনে প্রতিফলিত হতেই হৃদয় উথলে ওঠে উষ্ণ ভালোবাসার ঢেউে। অন্তরের বয়ে যায় প্রশান্তির নরম স্রোত। লুকাস এক টুকরো নিখাদ হাসি দিয়ে বলল,
“না বস, আমি একজনাতে আসক্ত। হোক তার গায়ের রং কালো, তাতে কি এসে যায়। মনে ঘন্টা তো সেই কালো মেয়েটার জন্যই বাজে। বিয়ে করলে আমি সেই কালো মেয়েটাকেই করব।”
‘রিচার্ড ম্যাগাজিন রেখে শিরশিরে অনুভূতিতে ফিরে তাকাল লুকাসের দিকে। অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করল লুকাসের কথায়। ওষ্ঠপুটে উঁকি দিল দূর্লভ হাসির এক ঝলকানি। তবে তা বরাবরের মতোই দেখা দিল না দন্তপাটে। কিন্তু তার এড়ালো না ন্যাসো তেরছা নজরের সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ হতে। ন্যাসো বক্র হেসে জিজ্ঞেস করল,

“বউয়ের হাতে জখম হয়েও চোখেমুখে এতো উৎফুল্লতা?”
‘রিচার্ড সোজা হয়ে বসল৷ স্মিত হেসে ন্যাসোর দিকে চেয়ে অবিলম্বে আওড়ায়,
“বউয়ের হাত জখম হয়ে যদি তার চোখে আমার ব্যাথার অশ্রু দেখা যায়, তাহলে প্রতিটি মুহুর্তে, প্রতিটি সেকেন্ডে জখম হতে চাই আমি।”
‘লুকাস ন্যাসো একে-অপরের দিকে তেরছাভাবে দৃষ্টি আদান-প্রদান করল। লুকাস সুচারু দৃষ্টিতে তাকাল রিচার্ডেরউতপ্ত খরখরে মরুভূমির পানে। ভণিতাহীন বলল,
“এই রিচার্ড কায়নাত-ই কি সে-ই রিচার্ড কায়নাত?”
“সে-ই?”
“সে-ই রিচার্ড কায়নাত–যে ছিল দুর্বার নারীবিদ্বেষী, ঘেন্না করত মেয়েদের। আজ সে-ই রিচার্ড কায়নাত এভাবে ভেঙেচুরে যাচ্ছে একটা সাধারণ মেয়ের কাছে?”
‘রিচার্ড চমৎকার হাসি দিল। কণ্ঠে অনভ্যস্ত কোমলতা,
“সে-ই রিচার্ড কায়নাত যে, এই সাধারণের মধ্যে অসাধারণ মেয়ের প্রেমে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে তার শক্ত খোসল থেকে।”

‘ন্যাসো অবাক না হয়ে পারল না। দুজনেই শোচনীয় বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে রিচার্ডের দিকে। নিজেকে ধাতস্থ করে ন্যাসো সবেগে অবিলম্বে আওড়াল,”একটুও রাগ হয় না ম্যামের প্রতি?
“উমহু একটুও না। প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেয় না। আমার জীবন যাদের জন্য ধ্বংস হয়েছে, তাদের কাউকে যেমন আমি ছাড় দেয়নি, তেমনি আমিও ছাড় পাচ্ছি না। কম তো কষ্ট দেয়নি।”
“গ্যাংস্টার বসের কণ্ঠে অনুশোচনার রেশ?”
“কারণ যদি হয় সে, তাহলে হবে হয়তো।”
“এতো ভালোবাসেন ম্যাম কে?”
‘এক চিলতে সূক্ষ্ম হাসির রেখা মিলল রিচার্ডের অধর কোণে। সে তার অধর কোণে তা বজায় রেখে কণ্ঠ নিভৃত কোমল স্বরে বলল,

“কি জানি! ভালোবাসার সংজ্ঞা আমার জানা নেই। কেমন হয়, কেন হয়, কখন হয়, ভালোবাসলে কি হয়—কিছুই জানা নেই আমার ৷ তবে এখানে না অনেক কিছুই হয়।”
‘রিচার্ড বুকের বা পাশে হাতের পিঠ দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলল। বিস্ময়কর লাগলেও ওরা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে রিচার্ডের চওড়া তামুকে। ঝলমলে হাসি তাদের ঠৌঁটেও দীপ্তি দিচ্ছে।
“তোমাদের ম্যামের সঙ্গ অক্সিজেনের মতো অনুভব করছি। তোমার ম্যাম’কে নিয়ে আসো ন্যাসো।”
‘বসের গম্ভীর গলার কড়া আদেশ মাথা পেতে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল ন্যাসো।

‘নিশ্ছল আকাশের কালো মেঘের আনাগোনা। আকাশের করুণ অবস্থা দেখে অনুধাবন করা যাচ্ছে বৃষ্টি আসার সম্ভবনা দারুন। ন্যাসো গিয়েছে বেশ অনেকক্ষণই হয়েছে। এরিমধ্য ঘটেছে আরেক কান্ড। গ্যাংস্টার বস রিচার্ড কায়নাতের অবাধ্য নারী তাকে ডির্ভোস লেটার পাঠিয়েছে। রিচার্ড পরপর কয়েকবার ফোঁস নিশ্বাস ফেলল ডিভোর্স লেটারের দিকে তাকিয়ে। পরপর টেবিলের উপর রেখে সন্তপর্ণে কলম তুলে নিল। লুকাসের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। তাকে চুড়ান্ত পর্যায়ের নিয়ে অবাক করে দিয়ে রিচার্ড ডির্ভোস লেটারে কলম ঘুরালো রিচার্ড। ঠিক তখনই ন্যাসো প্রবেশ করে কেবিনে, রক্তাক্ত শরীরে। পদযুগলের শব্দে কলম রেখে সামনে তাকাতেই রিচার্ডের শরীরের রক্ত চলাচল তীব্র হয়ে উঠে। অন্তরে আঁধার নামে তৎক্ষনাৎ। ন্যাসোর পিটানো শরীরে লেপ্টে থাকা ধ্বংসের প্রলেপ অমোঘ বিধ্বংসীর সাইরেন বাজাতে থাকল চারিপাশ। অযাচিত কারণে কাঁপন রিচার্ডের কণ্ঠস্বরে,

“ন্যাসো, তোমার শরীরে রক্ত কেন? রেড, রে-রেড, আমার রেড কোথায়?”
‘ন্যাসোর চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। সে টিস্যু দিয়ে গায়ের রক্ত পরিষ্কার করছিল। রিচার্ডের এহেন কম্পিত কণ্ঠে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে রিচার্ডের দিকে তাকাতেই ধাক্কা খেল সে। বুঝতে পারল না চোখ দু’টোতে কিসের এতো আকুলতা। ন্যাসো পাশে তাকাতেই লুকাস চোখ টিপল। সঙ্গে সঙ্গে ন্যাসোর ঠৌঁটের কোণ ধরে শয়তানি হাসি খেলে গেল। তৎক্ষনাৎ সে নত দৃষ্টি নিবিষ্ট করে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“বস ম্যামের এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
‘শব্দগুলো যেনো ভারী সীসার গুলি হয়ে এসে বিঁধল রিচার্ডের বুকের ঠিক মধ্যিখানে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। অদৃশ্য এক ঝড়ের ধাক্কায় দু’পা পিছিয়ে গেল রিচার্ড। বুকের গভীরে জমে থাকা রক্ত হিম হয়ে গেল এক নিমিষে। জিভ শুকিয়ে এল। ঢোক গিলে ফাটল ঠোঁটের কোণা। পরক্ষণেই বিস্ফোরণ। রিচার্ড ঝাঁপিয়ে পড়ল ন্যাসোর দিকে। আঁকড়ে ধরল ন্যাসোর কলার৷ চোখজোড়া রক্তাভ। গর্জে উঠে রিচার্ড
“কুত্তার বাচ্চা! জবানে লাগাম টান! তোর হাতে তুলে দিয়েছিলাম আমার রেড’কে। কোথায় আমার স্ত্রী? কোথায় আমার এলি জান?”

‘দীর্ঘদেহী ন্যাসো থরথর করে কাঁপতে লাগল রিচার্ডের সামনে। গলা বেয়ে নেমে এল আতঙ্ক। লুকাস ভয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে। ন্যাসো গিলল শুকনো ঢোক। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,”স্য… স্যরি বস।”
‘কিন্তু ততক্ষণে রিচার্ডের সমস্ত জ্ঞানবোধ দগ্ধ হয়ে ছাই। চোখ দুটো যেন শূন্যতার গভীরে তলিয়ে ডুবে গেছে। উন্মত্ত বাঘের মতো রিচার্ড ঠেলে ফেলে দিল ন্যাসো’কে। কেবিনের চারপাশের দুনিয়া ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে থাকে সে।সোফা ছুঁড়ে ফেলছে, গ্লাস চূর্ণ করছে, বইপত্র ছিঁড়ছে, ঘরভরা তাণ্ডব। নিঃশ্বাস ভারী আর দগ্ধ। রিচার্ডের গর্জন আর ভাঙাচোরার শব্দ বাইরে থেকে ছুটে এলো ডাক্তাররা। রিচার্ডের এই রূপ সকলের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। ন্যাসো সকলকে পাঠিয়ে দেয় দ্রুত। রিচার্ড ছুটে বেরিয়ে যেতে চা খালি গায়েই। তপ্ত দেহ, তপ্ত নিঃশ্বাস ছুটে যেতে চায় তার অবাধ্য নারীর কাছে। ওরা গিয়ে জাপ্টে ধরল রিচার্ড’কে। লুকাস আর ন্যাসো মিলেও আটকাতে পারছে না রিচার্ড’কে। রিচার্ডের শরীরজুড়ে কেবল একটাই ক্ষুধা এলি জান’কে ছুঁয়ে দেখা। বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো আর্তনাদ,
“আমার রেড’কে এনে দাও তোমরা। কুত্তার বাচ্চারা এক্ষুনি এনে দে আমার রেড কে! আমি আমার এলি জানের মুখ দেখতে চাই রাইট নাউ! আমার ওয়াইফের কিছু হলে সবকটা-কে জবাই করব আমি।”

‘ওরা কেউই ছাড়ে না রিচার্ডকে। কারও কথার ফাঁকও রাখছে না রিচার্ড। শুধুমাত্র ওর কণ্ঠটাই পাথর চিরে বেরোনো আগুনের মতো চেঁচিয়ে যাচ্ছে। লুকাস দু’হাতে জাপটে ধরেছে রিচার্ডের পেট। ন্যাসো তড়িঘড়ি করে কাঁপা হাতে ফোন টেনে নেয়। করিডোরের বাতাসও এখন রিচার্ডের দমফেলা নিঃশ্বাসে ভারী। নিজেকে ছাড়াতে না পেরে রিচার্ড দেয়ালে একের পর এক ঘুষি মারতে শুরু করে। দেয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে উজ্জ্বল রক্তের ধারা কাঁচের মতো চকচকে। সমুদ্র-নীল চোখের কোণায় ফেটে বেরোয় লাল রক্তবিন্দু। কয়েকটা মুহূর্তেই এই হৃদয়হীন শক্ত মানবের ফর্সা মুখশ্রী মরে যাওয়া জ্যোৎস্নার মতো ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করে প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার আগামতাড়নায়। ঘুষির আঘাতে দেয়ালের ভিত নড়ে ওঠে আর রিচার্ড ফাটতে ফাটতে শুধু একটা কথাই বলে যায় বারবার,
“আমার রেড’কে এনে দাও তোমরা, নাহয়—আমার জানাজার ব্যবস্থা কর। আমার করব খুঁড়ো তোমরা। আমি আমার এলি জানের কাছে যাবো।”

‘রিচার্ড বিধ্বস্ত, ভাঙা এক খণ্ডের মতো নিচে বসে পড়ল। তিরতির করে কাঁপছে হাত। ন্যাসো আর লুকাস অপরাধীর চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক তখনই কানে ভেসে এল মেয়েলি স্বর,
“কি হয়েছে এসব?”
‘এলিজাবেথ একবার তাকাল রিচার্ডের দিকে, তারপর চোখ ফেরাল ভিতরের দিকে। সাজানো-গোছানো কেবিনটা যেনো মুহূর্তেই যুদ্ধক্ষেত্র। সব ছিন্নভিন্ন, অগোছালো। আবারও রিচার্ডের দিকে ফিরে তাকাল এলিজাবেথ। চোখ দু’টো ঘুমে আচ্ছন্ন৷ সকালে মাত্র ঘুমিয়েছিল। এর মধ্যেই ন্যাসো হাজির। যদিও এলিজাবেথ আসতে চায়নি; ন্যাসোর জোরাজুরিতে বের হতে হয়। পথেই একটা ছোট্ট বাচ্চা পড়ে গিয়েছিল তাদের গাড়ির সামনে। আহত শিশুটিকে হাসপাতালে আনার সময় রক্ত লেগেছিল ন্যাসোর গায়ে। এলিজাবেথ নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল বাচ্চাটার অভিভাবকের জন্য, তাই আসতে দেরি হয়েছিল।

‘এলিজাবেথকে দেখামাত্রই রিচার্ডের চোখে যেনো প্রাণ ফিরে এল। দাঁড়ানোর শক্তি না থাকলেও হাঁটু ঠেলে এগিয়ে এলিজাবেথের কোমর দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। চমকে উঠল এলিজাবেথ। অনুভব করল শক্ত-পোক্ত দেহটা দু’বার দপদপ করে কেঁপে উঠল। শিশুর মতো মাথা গুঁজে রিচার্ড তার পেটে ফিসফিস করে বলল,
“আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
‘এলিজাবেথ বিস্ময়ে ফিসফিস করল, “ভয়? কিসের ভয়?”
‘এলিজাবেথ ওদের দিকে তাকাতেই দু’জনেই মাথা নিচু করল। সে ধীর ভঙ্গিতে এসে বসে পড়ল রিচার্ডের সামনে। দু’হাতের আজলায় তুলে ধরল রিচার্ডের শক্ত চিবুকটা।
“কি হয়েছে আপনার?”
‘রিচার্ডের গলা একদম ভাঙা,”আমি খুব ভয় পেয়েছি।”
‘শক্তপোক্ত মানুষটার এই ভঙ্গুরতা অস্থির করে তুলল এলিজাবেথকে। চোখের দৃষ্টি ছুড়ে দিল অপরাধীর মতো মাথা নত করা দু’জনের দিকে। কড়া গলায় বলল,
“আপনারা ওনাকে কি বলেছেন? সত্যি করে বলুন।”

“আমি দেখছি ওদের।”রিচার্ড তেড়ে যেতে চাইলে এলিজাবেথ ওকে টেনে এনে বেডে বসাল। কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। এলিজাবেথ ওদের সামনে গিয়ে দু’হাত বুকে বেঁধে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় ফের জিজ্ঞেস করল,
“কি বলেছেন আপনারা ওনাকে, যে উনি এত অস্থির?”
“আমি বল—” রিচার্ড চেঁচিয়ে কিছু বলার আগেই এলিজাবেথ বিরক্ত ধমকে বলল,
“আমি চুপ করতে বলেছি আপনাকে।”
“ওকে!”রিচার্ড বিলম্ব না করে চুপ করে মাথা নিচু করে রাখে। তবু রাগে গিজগিজ করছে, নিঃশ্বাস হাঁপানির মতো দ্রুত। লুকাস আর ন্যাসো নাক-মুখ কুঁচকে তাকাল রিচার্ডের দিকে। সবটা শোনার পর এলিজাবেথ একবার গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকাল রিচার্ডের দিকে। তারপর গভীর তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ওদের বের করে দিয়ে দরজা আঁটকে গিয়ে দাঁড়াল রিচার্ডের পাশে। দৃষ্টিকোণ হলো টেবিলে রাখা ডির্ভোস পেপার। নিশ্বাস আটঁকে পেপার’টা হাতে তুলে নিল এলিজাবেথ। রিচার্ডের সাইনের জায়গাটাই ঈগল দৃষ্টি পড়তেই ভরকে গেল। এলিজাবেথের স্বাক্ষরের পাশে রিচার্ডের স্বাক্ষরের
জায়গায় গুটগুট করে লেখা,”ফা’ক অফ৷” আঁটকে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে এলিজাবেথ ফের তাকাল রিচার্ডের দিকে।
‘মানুষটার হাত থেকে টুপটাপ রক্ত ঝরছে অথচ তার ভ্রুক্ষেপের লেশমাত্র নেই। দেহ জুড়ে এখনও রাগের আগুন ফুটছে। এলিজাবেথ ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চারপাশ এলোমেলো, নিস্তব্ধতা ভারী। গভীর ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে শাড়ির আঁচল ছিঁড়তে ছিঁড়তে এলিজাবেথ কঠিন কণ্ঠে বলল,

“এতো হৃদয়হীন কেন আপনি?”
‘রিচার্ড নতদৃষ্টি রেখেই গলা শক্ত করল। কথাগুলোও আজ বুকের গভীর থেকে উঠে এল,
“হৃদয়হীন তারা বলে, যারা আমাকে ভালোবাসতে দেখেনি। বিশ্বাস কর এলিজান এখানে আমারও একটা হৃদয় আছে। যেটা কেবল তোর জন্যই বীট করে।”
‘থেমে,
“তুই শুধু বিশ্বস্ততা দিয়ে যা, আমি আগলে রাখতে জানি।”
‘এলিজাবেথ রিচার্ডের হাত টেনে ধরল। ছেঁড়া আঁচলটা তুলে সযত্নে রক্তাক্ত হাতটা পেঁচিয়ে দিতে দিতে ধীর কণ্ঠে বলল,
“যদি বিশ্বাস ভাঙি?”
‘রিচার্ড মাথা তুলে তাকাল এলিজাবেথের নরম চিবুকে। ঠোঁটের কোণে এক টুকরো বাঁকা হাসি ফুটিয়ে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তাহলে আমার কবর খোদায়ের আগে তোর কবর খোঁড়া হবে। তোকে তিন হাত মাটির নিচে চাপা দিয়ে তারপর নিজের কবর নিজ হাতে খুঁড়ব আমি।”
‘এলিজাবেথের হাত থেমে গেল। দৃষ্টি স্থির, নিঃস্পন্দ। চোখে চোখ রেখে বলল,
“একসাথে মরতে পারবেন না?”
‘রিচার্ডের চোখে ঝলক খেলল। মৃদু হাসল। হেসে বলল,

“একসাথে মরলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোকে আগলে রাখব কেমন করে? আর, আমি ছাড়া কে-ই বা আছে তোর ? মৃত্যুর পর তোর লাশের ভারি খাঁটিয়া তো আমাকেই কাঁধে তুলতে হবে। সেটার ভাগও আমি কাউকেই দিতে রাজি নয়।”
‘হঠাৎই এলিজাবেথের কার্নিশদ্বয় নোনাজলে সিক্ত হল। নিঃশব্দে আলতো হাত রাখল রিচার্ডের পেটের ব্যান্ডেজে। গলা নরম রেখে বলল,
“আপনি তো এমন না হলেও পারতেন। আপনি রিচার্ড কায়নাত না হয়ে রিদ হতেন৷ শুধুই আমার হতেন। তাহলে আমাদেরও একটা সংসার হতো। আমাদের সন্তান আজ আমাদের মাঝেই থাকত। আমি মা হতাম, আদর্শ বউ হতাম। তবে আপনার হিংস্রতা সব কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে আমার মাতৃত্ব,আমাকে করেছে খুনি। আপনি চাইলেই পারতেন ফিরে আসতে৷ আমাদের হতে পারতেন। কিন্তু আপনি হননি। দেননি আমাদের সুখে থাকতে। আপনি খুব স্বার্থপর মি.কায়নাত। আপনি স্বামী হিসেবে জঘন্য, বাবা হিসেবে নৃশংস।”

‘রিচার্ড জবাব দিল না। ইচ্ছেই করল না। এসব প্রশ্নের উত্তর তার আসে না। ভিতরটা চেপে ধরা কোন অদৃশ্য হাত আটকে রাখে। অথচ মনে মনে বলতে ইচ্ছে করছিল,
“আমার নিদ্রাহীন রাতগুলো জানে, কতোটা যন্ত্রণা বয়ে আজ আমি এখানে দাঁড়িয়েছি। ভাঙনের পর আমার হৃদয়টা চূর্ণ হয়ে হিংস্রতার আঁধারে হারিয়ে গেছে।”
‘সে কথা মনেই চেপে রাখল। মুখের রেখায় তাচ্ছিল্যের ছায়া টেনে ঠোঁটে ঠান্ডা হাসি টেনে বলল,
“স্বামীকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে আবার তার জন্য লাল শাড়িও পরে আসো? বাহ ওয়াইফি, বাহ। আই’ম ইমপ্রেসড।”
‘এলিজাবেথ ঠান্ডা হাসি ছড়িয়ে রিচার্ডের উপর ঝুঁকল। গলায় রাশভারি স্বর নামাল,
“যেদিন আপনাকে মারব, আমি সেদিন সাদা শাড়ি পরব। আপনার মৃত্যুর পরও কথা রাখব আমি। যখন বিধ্বস্ত হয়ে আপনার নিথর দেহের পাশে পড়ে থাকব,তখন কেউ যেন আমায় উলঙ্গ করে সাদা শাড়ি পরাতে না পারে, তাই আগেই আমি প্রস্তুত থাকব। কাউকে স্পর্শ করতে দেবো না নিজের শরীর। আপনি নামক বিষাক্ত মরীচিকা থেকে মুক্ত হয়েও আমি সেদিন হবো এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভাগিনী। সুখের তাগিদেই পরব সাদা শাড়ি। সেই শাড়ির আড়ালে গাঁথব সম্পর্কের শোকগাথা। আপনার বুকে প্রথম আঘাতের পর ছিটকে আসা রক্ত যখন আমার সাদা শাড়িকে রাঙিয়ে দেবে,

সেই দাগই হবে আমার চিরসঙ্গী। আমি কখনও সেই দাগ মুছব না। বিশ্বাস করুন, কখনো না। আপনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে যখন ছটফট করবেন, কাঁপবেন, আমি তখন আমার অসার দেহ ঢাকব সেই সাদা শাড়িতে আপনার মৃত্যুকণ্ঠের করুণ নিশ্বাস যখন চারপাশে ধ্বনিত হবে,আমি সাদা শাড়ির আঁচল তুলে কানে চেপে ধরব। আপনার রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে মুখ দেখে আমি হাউমাউ করে কাঁদব না। সাদা শাড়ির আঁচল চেপে ধরব ঠোঁটের মাঝে। তবুও বিশ্বাসঘাতকের জন্য এক ফোঁটা জল ফেলব না। আমি ছিঁড়ে আনব আপনার হৃদপিণ্ড—খুঁজব সেখানে আমার নামের একফোঁটা ভালোবাসা। যদি না পাই, তবে নিজ হাতে আপনাকে টুকরো টুকরো করব। আর যদি পেয়ে যাই,শেষ নিঃশ্বাস নেব আপনার বুকে মাথা রেখে। আমি এলিজাবেথ কথা দিলাম।”

‘বুকটা হিমশীতল হয়ে এল রিচার্ডের। তবুও সে তা প্রকাশ করল না। এখন আবেগ দেখানো মানেই পরাজয়। আবেগকে প্রশ্রয় দিতে নেই। মানুষ দূর্বল ভেবে বসে। আর দূর্বলতা মানেই ধ্বংসের নিমন্ত্রণ। যেমন করে একদিন তার বাবা আবেগ দেখিয়ে পেয়েছিল প্রতারণার ছুরিকাঘাত। চোখের পলকে বদলে গেল রিচার্ডের রং। মুহূর্তেই ফিরল পুরোনো খোলসে। হঠাৎই দৃপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে কোলে তুলে নিল এলিজাবেথকে। ঠান্ডা গলায় বলল,
“সে-সব পরে দেখা যাবে। এখন প্রেম করব।”
‘অপ্রস্তুত হয়ে চমকে উঠল এলিজাবেথ। দু’হাতে রিচার্ডের বুক খামচে ধরল। চোখ রাঙিয়ে বলল,
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়?”
“ইট’স আ মিটিং ইন মাই বেড, বেবি।”
‘ভেতরে কোথাও শিহরণ খেলে গেল এলিজাবেথের। হৃদয়ের গভীরে আতঙ্কের ঢেউ উঠল। রিচার্ড ওকে বেডে শুইয়ে দিয়ে ঝুকল উপরে।

“স্বামীর পেটে ছুরি চালিয়ে আবার তারজন্য নিশুতি রাত পার করে দাও করিডরে দাঁড়িয়ে। স্বামীর সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম হচ্ছে?”
‘থতমত খেয়ে যায় এলিজাবেথ,”মা-মানে? কি যা-তা বলছেন আপনি।”
‘রিচার্ড শীর্ণ হাতে ধরল এলিজাবেথের পাখির পাখনা মতো কোমল, নরম হাত। ছুঁইয়ে দিল তার গালের কাটা দাগটাই। সন্তপর্ণে বলল,
“এই হাতে এখানে ছুঁয়েছিলে নাহ আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে?”
‘এলিজাবেথের মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে,”এ্যাৎ! আপনি কি করে জানলেন?”
‘ঠৌঁট কামড়ে হাসল রিচার্ড,”তোমার শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ আমার খুব চেনা, তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ যে আমার বড্ড প্রিয়।”
“কোনো অভিযোগ নেই আমার প্রতি?”
‘রিচার্ড সর্বনাশা চুমু খেল এলিজাবেথের নাকের ডগায়। শান্ত-মধুর মুখশ্রীতে ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আমার দুঃখ পরিমাণ তোমার সুখ হোক।”
“এসব বলে আপনি আর আমাকে দূর্বল করতে পারবেন না।
আমার মনে আপনার জন্য আর কোনো জায়গা নেই।”
‘রিচার্ড ঠৌঁট কামড়ে হাসল। অতঃপর কটাক্ষ মিশ্রিত গলায় হিসহিসিয়ে বলল,

“তোর দিলের উইলে
স্ট্যাম্প মেরে লিখে দিবো যে,
আমি তোর,,,,,
আমি তোর পে,,,,,
‘বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় এলিজাবেথ। অবধারিত হিংস্রতা আর দগ্ধ ক্রোধের যে আগুন এতক্ষণ তপ্ত করছিল অন্তর তা ধীরে ধীরে গলে গিয়ে মিশে যাচ্ছে বৃক্ষপটের শান্ত নীরবতায়। সমস্ত অস্থিরতা, সমস্ত যন্ত্রণা নিমেষে থিতিয়ে আসে। রিচার্ড হঠাৎই মুখ ডুবিয়ে দেয় এলিজাবেথের নরম গ্রীবায়। শিহরিত হয় সে এলিজাবেথ। দেহ ছটফটিয়ে ওঠে। তবু রিচার্ড তাকে অবকাশ দেয় না পালানোর। সে কবে পেরেছিলই বা এই বেপরোয়া পুরুষটার বিরুদ্ধে লড়তে? অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে রিচার্ডের প্রত্যেকটি স্পর্শ, প্রত্যেকটি আকুলতা। এলিজাবেথ ক্লান্ত স্বরে ফিসফিসায়,

“মি. কায়নাত এটা হাসপাতাল। এতো গভীরে যাচ্ছেন কেন আপনি৷ প্লিজ লিভ মি৷”
‘রিচার্ডের চোখে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে দুর্নিবার আকর্ষণ। চাপা গলায় তীব্র ছলনায় সে ফিসফিসায়,”কি করব বলো? ইউ আর ফাকিং গর্জিয়াস রেড। তোমার তাপ আমার ইস্পাতের শাসনেও চিড় ধরায়। প্লিজ একটু এডজাস্ট করে নাও”
“আপনি কিন্তু আজ জোরাজোরি করলে শুধু দেহ পাবেন, মন পাবেন না।
‘মনের সন্ধান কাল থেকে করব।”
‘রিচার্ডের ঠোঁট আবার এগোয় এলিজাবেথের রক্তিম ওষ্ঠের দিকে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই থেমে যায় রিচার্ড। সে লাগামহীন তবে ব্যক্তিত্বহীন নয়। হঠাৎ রিচার্ডের চোখে খেলে যায় এক অচেনা ঘন রহস্যের ছায়া। ঝুঁকে আসে এলিজাবেথের কানের কাছে। পুরুষালি গম্ভীর স্বরে বলল,
“লেটস মেক সাম হবি ওয়াটার।”
“কী…?

‘কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে না উঠতেই রিচার্ড হঠাৎ ঝাঁকিয়ে ধরল এলিজাবেথের হাত। এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত, তারপরই ছিঁড়ে আসা আর্ত চিৎকার। পায়ের নিচে শিরশিরে স্রোত বইয়ে সমস্ত দেহটা ঘুলিয়ে ওঠে। ছিটকে সরে গিয়ে একটানে হাত ছাড়াতে তীব্র হেঁচকা টানে বেল্টে ঘষা লেগে চামড়া ছিলে যায়। যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে এলিজাবেথ দৌড়ে বেরিয়ে যায় হাসপাতাল থেকে। রাস্তার পাশে একটি কল দেখতে পেয়ে উন্মাদের মতো ছুটে যায় সেখানে। বুকের গভীর থেকে উঠে আসে বমির ঢেউ। কলের জলে বারবার ধুতে থাকে হাত। শরীর শিউরে ওঠে বারবার। ভাবতেই গা গুলিয়ে আসে এলিজাবেথের।

“লোকা তোমার শরীরের অবস্থা এতো বাজে কেন?”
‘লুকাস সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ ছুঁড়ে ফেলে নতুনটা জ্বালাল। নিকোটিনের ধোঁয়া ধীরে উড়িয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,”রাশিয়ার মতো দেশের মেয়রকে মারতে গেলে শরীরটা তো ছিন্নভিন্ন হবেই।”
‘ভাবুক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ন্যাসো। “হুম। বসের জীবনও ওইদিন দারুণ রিস্কে ছিল। থ্যাঙ্ক গড, গুলিটা বুক চিরে বেরিয়ে গিয়েছিল।”
“রিস্ক হবে না? সে ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় ক্যাসিনোর লিডার ছিল, শালা।”
‘ন্যাসো চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল, “তোমার কি মনে হয় ওয়েবসাইটটা বন্ধ হয়েছে?”
‘লুকাস ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি টেনে নিল,”মূল না থাকলে গাছ বড় হয় কিভাবে? বস তো শেকড়টাই তুলে দিয়েছে। ওয়েবসাইটটা এমনিতেই অকেজো হয়ে যাবে।”

‘স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ন্যাসো। “বন্ধ হলেই ভালো। নাহলে বস নিজের হাতে পুড়িয়ে ছাই করে দিত সব।”
‘মাথা নাড়িয়ে চাপা হাসল লুকাস। ঠিক তখনই চোখে পড়ল এলিজাবেথ দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল থেকে। তারা হাসপাতালের পাশের ছায়াঘেরা কোণায় সরে দাঁড়াল। গেটের দিকে তাকাতেই দেখল রিচার্ড শার্টের হাতা গুটিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসছে। তাদের নজর পড়তেই রিচার্ডও এগিয়ে এলো। ঠিক সেই মুহূর্তে বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল চারপাশ। তিনজনই চমকে উঠে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আতঙ্ক আর ধুলার আবরণ নেমে এলো পরিবেশে। জনতা দিশাহারা হয়ে ছুটছে। একসময়কার সাজানো হাসপাতাল মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে রূপ নিয়েছে। দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। রিচার্ড বিদ্যুৎগতিতে উঠে চারপাশ খুঁজতে থাকে। না, এলিজাবেথ নেই। এলিজাবেথ আগেই চলে গেছে। হঠাৎই রিচার্ডের দৃষ্টি আটকে গেল হাসপাতালের পেছন দিক থেকে এক সন্দেহজনক লোক কালো ব্যাগ হাতে দৌড়ে আসছে। ন্যাসো আর লুকাসের শাণিত চোখও সেই লোকটার উপর। তিনজনের দৃষ্টি মিলতেই রিচার্ড ঘাড় বাঁকিয়ে ইশারা করল।

‘লোকটার রক্তাক্ত হাত রিচার্ডের বুটের নিচে থেঁতলানো। জিন্সের প্যান্টে সরু ছিদ্র বেয়ে হাঁটু থেকে ঝরঝর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তার আর্তনাদে ফাঁকা জায়গাটা থরথর করে কেঁপে উঠছে। লুকাস ঠাণ্ডা মাথায় আরেকটা গুলি চালাল অপর হাঁটুতে। এবার ফেটে পড়ল কান্না লোকটা৷ গলায় অসহ্য কষ্ট।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫৯ (৩)

“বলছি… বলছি।”
‘রিচার্ড ধীরে বুটের চাপ বাড়াল থেঁতলানো হাতে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”বল কে পাঠিয়েছে তোকে?”
‘গলা থেকে অস্পষ্ট, কর্কশ গোঙানির শব্দ তুলে দম নিতে নিতে ছিন্নস্বরে বলল লোকটা,”তথ্য মন্ত্রী নাসির মোড়ল।”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬০ (২)