মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২১

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২১
মুসতারিন মুসাররাত

কয়েক জোড়া প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি স্থির নীরবের দিকে। প্রত্যাশা ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। বুক ভেঙে যাচ্ছে ওর বোবা কান্নায়। চোখের সামনে ইচ্ছের ওভাবে নীরবকে সম্বোধন করতে দেখা, যেন শিরায় শিরায় বি’ষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। রাগ-ক্ষোভ ঘৃ’ণার পারদ সীমাহীন বাড়ছে। মুক্ত দানার মতো অশ্রুবিন্দু অঝোরে গাল গড়িয়ে পড়তে লাগল। হাতের উল্টোপাশে সিক্ত গাল মুছে তড়াক উঠে দাঁড়াল ও। সহসাই ভেজা গলায় উঁচু স্বরে প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল,
-” আপনাকে তো সবাই বিশ্বাস করে, একজন আদর্শবান মানুষ বলে জানে। আমিও তাদের ব্যতিক্রম ছিলাম না। আপনার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিলো, সম্মান করতাম। তাহলে এমনটা কেনো করলেন? বলুন, প্লিজ বলুন আমাকে? এত বড় একটা সত্য লুকিয়ে রেখে কেন বিয়ে করলেন আমাকে?”
দুপুরে ফোনে প্রত্যাশার কথা, এখনকার কথা, তারপর ইচ্ছে। তীক্ষ্ম বুদ্ধি সম্পন্ন নীরবের বুঝতে বাকি রইল না। বলল শান্ত কণ্ঠে,

-” তোমার উচিত ছিলো এ ব্যাপারে আমার সাথে আগে কথা বলা। তাহলে অন্তত এরকম সিনক্রিয়েট হয় ন___”
প্রত্যাশা কথা কেড়ে নিল। কণ্ঠ কাপল তবুও চেঁচিয়ে উঠল,
-” আপনার মনে হচ্ছে আমি সিনক্রিয়েট করছি। আপনার মতো একটা চিটারের সাথে কথা বলার ইচ্ছে আমার ছিলো না। তবে সবাইকে জানানো জরুরী। তাই… অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনার মুখোমুখি হতে হলো।”
নীহারিকা, নীলা কিছুই ঠাওর করতে পারছে না। তবে প্রত্যাশার এভাবে কথা বলায় নীহারিকার বদনে রাগ-ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটাকে বে’য়াদব তকমা দিতে মন চাইছে। প্রত্যাশা গলায় আটকানো কান্না গিলে এক নাগাড়ে বলতে থাকে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি খুব ভালো অভিনয় করতে পারেন।”
এক সেকেন্ড থেমে গলার চেইনটা শক্ত করে ধরে বলল,
-” নিশ্চয় এটা আমার জন্য ছিলো না। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আমি দেখে ফেলায়, আপনি নাটক করে আমার গলায় দিলেন। যখন থেকে আপনার আর প্রীতির ছবি দেখেছি, তখন থেকে এটাকে আমার ফাঁসের দড়ি মনে হচ্ছে। দম আঁটকে আসছে। আপনার প্রতি তীব্র ঘৃ’ণা হচ্ছে এএসপি সাহেব।‌”
একটানে চেইনটা গলা থেকে খুলে ফেলে প্রত্যাশা। বল প্রয়োগ করায় ছিঁড়ে যায়। পরপর শেষের কথাটা বলতে বলতে ছুঁ’ড়ে ফেলে। নীরবের ঠিক পায়ের সামনে ফ্লোরে পড়ে। নীরবের কপালের রগ টনটন করে উঠল। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ধ’ম’ক দিয়ে বলল,

-” থামবে তুমি….আমাকে বলতে দাও। আমার কথা আগে ফিনিশ করতে দাও। তারপর যত খুশি চাইল্ডিশ বিহেভিয়ার করবে।”
নীলার চোখ ছানাবড়া। একহাতে চোখ ডলল। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে। নীহারিকা বিরক্তির শ্বাস ফেললেন। ধ’ম’কে ইচ্ছে কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠল প্রত্যাশা নিজেও। ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে নীরব নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। প্রত্যাশা ফুপাতে ফুপাতে বলল,
-” আপনি ধ’ম’কিয়ে আমাকে থামাতে চাইছেন?”
এরমধ্যে মাহবুব সাহেব উপস্থিত হন। নীহারিকা অতীষ্ঠ চাহনিতে প্রত্যাশার দিকে চেয়ে বললেন,
-” আরে তুমি থামতো। আর নীরব কাহিনী কী বল? কী সমস্যা হয়েছে তোদের? প্রত্যাশা কী বলছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আর এই বাচ্চাটা কে?”
-” ইচ্ছে নীবিড় আর প্রীতির মেয়ে।”

নীহারিকা যেন একটা বড়সড় ধা’ক্কা খেলেন। বিস্ময়ে তাকালেন ইচ্ছের দিকে। ছোট্ট মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে গেছে, চেঁচামেচিতে আরও বেশি অস্থির। এক হাতে নীরবের শার্ট আঁকড়ে ধরেছে। আর অন্য হাতটি শক্ত করে চেপে আছে নীরবের হাতের মুঠোর ভেতর। নীহারিকা চোখমুখ শক্ত করে শুধালেন,
-” নীরব তুই ওদের সাথে যোগাযোগ রাখতিস?”
নীরব নির্বিকারভাবে ছোট করে জবাব দিল,
-” হ্যাঁ।”
প্রত্যাশা গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
-” নীবিড়…কে?”
মাহবুব সাহেব মুখ খুললেন,
-” আমার ছেলে। নীবিড় আর নীরব জমজ।”

প্রত্যাশা যেন জোরসে ঝটকা খেল। ভিতু চোখে নীরবের দিকে তাকাল। নীরবের ফরসা মুখে অমাবস্যা নেমে আছে। প্রত্যাশা আলগোছে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। জড়তা নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
-” উনি কোথায়? আর….আর উনার কথা জানিই বা না কেনো? কখনো বলা হয়নি…”
নীহারিকা থমথমে মুখে বললেন,
-” বড়লোক শাশুড়ি আর বউয়ের আঁচলের তলায় থাকে। সেখানে থেকে উচ্ছন্নে গিয়েছে____।”
নীরব জোরালো শ্বাস ফেলল। নীহারিকাকে থামিয়ে দেয়,
-” মা…. প্লীজ থামবে।”
নীহারিকা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন,

-” কেনো ভুল কিছু বলেছি আমি? কবেই তো ওর টাকাওয়ালা শাশুড়ির কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। দেখলি না, তোদের বাবার অসুস্থতার সময় একটিবারও দেখতে আসলো না। নিভান ব্লাড লাগবে বলে ফোন দিলো। বউকে দিয়ে ফোন ধরাল। বউ বলল, ওরা ট্যুরে গেছে আসা সম্ভব নয়। পরও তো পরের অসুস্থতার কথা শুনে দেখতে আসে। কিন্তু ও….ফিরেও এদিকে মুখ করল না।‌”
কথার মাঝে প্রত্যাশা প্রশ্ন করে উঠল,
-” ইচ্ছে আপনাকে পাপা ডাকে কেনো?”
নীরবের মসৃণ কপালে খাঁজ পড়ল। মেয়েটা এখনো সেই এক জায়গায় আঁটকে আছে। নীরব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই প্রত্যাশা মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,
-” না মানে ও বলেছিল, নুপুর পাপা দিয়েছে। তারপর এখনো আপনাকে ডাকল…আপনি কিছুই বললেন না।”
পুরো পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার আগে বউকে সামলাতে হবে। না হলে রণক্ষেত্রও হতে পারে। নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে শর্টকাটে বলল,

-” নীবিড় অসুস্থ। হসপিটালে আছে। নীবিড়ের অনুপস্থিতিতে ইচ্ছে মানসিক রোগে ভোগে। আমি যখন ফার্স্ট ওদের সাথে দেখা করতে যাই, ইচ্ছে আমাকে ওর পাপা ভেবেছিল। শুধরে দিলেও ও অবুঝ থাকে।_____”
পরপর সাইকিয়াট্রিস্টের বলা কথাগুলোও বলে নীরব। প্রত্যাশাও অল্প কথায় ভুল বোঝার কথাটা বলে। মাহবুব সাহেব নরম স্বরে বললেন,
-” প্রত্যাশা মা তোমার উচিত ছিলো প্রথমেই নীরবের সাথে কথা বলা। তোমার সন্দেহ হওয়া ভুল নয়। তবে বলব, নীরবের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলে এতটুকুও ভুল বোঝাবুঝি হয় না। যাক তবুও অল্পের উপর দি___”
নীহারিকা বেগম গম্ভীর মুখে বললেন,
-” ও যা করেছে ঠিকই করেছে। সবারই জানা উচিত ছিলো। আর এসব সন্দেহ যে কতটা ভয়ংকর, কতটা কষ্ট দেয় তা আমি জানি।”
শেষের কথাগুলো মনেমনে বললেন। তারপর নীরবের দিকে অসন্তুষ্ট চাহনিতে চেয়ে বললেন,
-” এই বাড়িতে আমার কথার বিরুদ্ধে প্রথমে নীবিড় গিয়েছে। তারপর তুইও দেখিয়ে দিলি; আগা নৌকা যেদিকে যায় পিছের নৌকাও সেদিকেই যায়। আমি কী পইপই করে বলেছিলাম না? ওই ফ্যামেলি থেকে দূরে থাকতে। আমার কথার অবাধ্য হয়ে তুই ওদের সাথে ঠিক যোগাযোগ রেখেছিস।”
নীরব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-” মা আমি আজও বুঝি না। তোমার একচুয়েলি প্রীতিকে নিয়ে সমস্যাটা কী ছিলো? শুরুতেই তুমি যদি ওদের বিয়েটা মেনে নিতে, তাহলে আজ এমন দিন আসতো না।”
-” ওই মেয়েকে বিয়ে করতে বারণ করেছিলাম। শোনেনি আমার নিষেধ, বারণ। সেদিন যদি বারণ শুনতো, তাহলে আমার সন্তান আজ আমার কাছেই থাকতো। আমার জোড়া সন্তান, আলাদা হতো না।”
নীরব কিছু বলবে, তার আগেই মাহবুব সাহেব ইশারায় নীরবকে থামতে বললেন। ইচ্ছে এত কথাবার্তার মাঝে ভ’য়ে চুপসে ছিল। প্রত্যাশা সন্তর্পণে ইচ্ছের হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিল। নীরব আড়চোখে দেখল। প্রত্যাশা ভেতরে ভেতরে ভ’য়ে আছে। নীরবের দিকে তাকানো সাহসে কুলাচ্ছে না।
নীলাশা ভাবছে–ইয়া আল্লাহ! শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের আরেক পুত্রকে ত্যাজ করে রেখেছেন। এত কাহিনী। আমিও তো কিছু জানি না। আর বিয়েই হয়েছে সবে পাঁচ মাস। তারমধ্যে আগে তো পড়াশোনার অজুহাতে ও বাড়িই বেশি থেকেছি।

এত কথাবার্তার মাঝে এতক্ষণে নীরবের খেয়াল হলো। আর খেয়াল হলো বলেই ফোনটা পকেট থেকে বের করতে করতে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল থমথমে স্বরে,
-” নিশ্চয় ইচ্ছেকে না জানিয়ে এনেছো। ওর মাম্মা বা বাসার লোকজন জানে তুমি ইচ্ছেকে এনেছো?”
প্রত্যাশা ফাঁকা ঢোক গিলল। জিভের ডগা দিয়ে নিম্নোষ্ঠ ভিজিয়ে মাথাটা দু’দিকে না বোধক নাড়ল। বলল মিহি স্বরে,
-” নাহ। ওকে দেখভাল করা মেয়েটা জানে শুধু।”
নীরব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে প্রীতির নম্বরে কল দিল। রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে জবাব এলো,
-” বলো”
-” ইচ্ছে আমার কাছে আছে। আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ওকে দিয়ে আসবো।”
-” তার আর দরকার পড়বে না। আমি রাস্তায় আছি। দু মিনিটের মধ্যেই আসছি।”
নীরবও আর দ্বিরুক্তি করল না। খট করে কল কা’ট’ল। প্রত্যাশার গা ঘেঁষে ইচ্ছে। প্রত্যাশা হাঁসফাঁস করতে থাকল। নীরবের দৃষ্টি স্বাভাবিক ঠেকছে না। ঝ’ড়ে’র আগে পরিবেশ যেমন থমথমে থাকে, ঠিক তেমন নীরবের মুখাবয়ব। প্রত্যাশা দোয়া-দরুদ পড়ছে। যেন নীরব বেশি রাখঢাক না করে। একা পেলে কী করবে আল্লাহ মালুম! এইভেবে প্রত্যাশার হাত-পা জমে আসছে।

এরমধ্যে শর্মিলা আর আনিশা বাসায় এসে সবটা শোনে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ইচ্ছেকে দেখতে থাকে। গাল ছুঁয়ে আদরও করেন। মাহবুব সাহেব এগিয়ে এলেন ইচ্ছের কাছে। ইচ্ছের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে ডাকলেন,
-” আমার ছোট আপু, কেমন আছো তুমি?”
নীহারিকা ডায়নিংয়ে গেলেন। এদিকে আগ্রহ নেই তাই দেখাতে গুছানো টেবিল ফের গুছাতে থাকলেন। আর আড়চোখে চাইলেন এদিকে। নীরব একহাত পকেটে গুঁজে অন্যহাত কপালে স্লাইড করে অপেক্ষায় আছে। প্রীতিকে নিয়ে মা যেনো আবার সিক্রিয়েট না করে বসে। এই নিয়ে চিন্তায় আছে। প্রত্যাশার কোমড় জড়িয়ে ছিলো ইচ্ছে। মাথায় আদুরে স্পর্শ পেয়ে গোল্লা গোল্লা চোখ করে তাকায়। প্রশ্ন করল,

-” তুমি?”
মাহবুব সাহেব একগাল হেসে বললেন,
-” আমি তোমার দাদুভাই।”
-” তুমি বুঝি পাপার পাপা?”
মাহবুব সাহেবের চোখ ভিজে ওঠে। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
-” হ্যাঁ।”
সদর দরজাটা হালকা টানা ছিলো। সার্থক একহাতে ধাক্কা দিয়ে ইশারা করতেই প্রীতি ভেতরে পা রাখল। ক’পা দিতেই সোজাসুজি ড্রয়িংরুমে ইচ্ছেকে দেখতে পেল। উচ্চ স্বরে ডাকল,
-” ইচ্ছে।”
ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চোখেমুখে হাসি ফুটল,
-” মাম্মা!”
ইচ্ছে দৌড়ে গেল। প্রীতির সামনে দাঁড়িয়ে মুখে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে ফের ডাকল,
-” মাম্মা।”
উপস্থিত সবার নজর এদিকে পড়ল। ইচ্ছেকে দেখভাল করা মনা প্রত্যাশার দিকে তর্জনী তাক করে বলল,
-” ম্যাডাম…স্যার ওই মেয়ে। ওই যে ওই মেয়ে। ওই মেয়ে জোর করে ইচ্ছে সোনামণি রে নিয়া আইছে। আমি মানা করছি। শোনেনি। আমাকে পুলিশের ভয়-ডর দেখায়ছে। পুলিশের চৌদ্দ শিকে ভরার কথাও বলেছে, হ্যাঁ। বিশ্বাস না হলে জিগান। জিগান উনারে।”

প্রত্যাশা জড়সড় হয়ে দাড়াল। দৃষ্টি নুইয়ে ফেলল। শেষের কথাশুনে নীরবের মেজাজ চটল। বউ ভবিষ্যতে আর কত কী করে আল্লাহ জানে! ডা’কাতি করতে গিয়েও উল্টো পুলিশের ভ’য় দেখিয়ে করে আনতে পারে। এই মেয়েকে নিয়ে তা অসম্ভব নয়। প্রীতি এগিয়ে আসলো। তীক্ষ্ণ নার্ভ সম্পন্ন প্রীতি চিনে ফেলে প্রত্যাশাকে। ছবির এই সেই মেয়ে। প্রীতি এগিয়ে গেল। রাগি স্বরে বলল,
-” তোমার সাহস হয় কী করে আমার মেয়েকে এভাবে আনার? তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। ভাগ্যিস নীরবের বউ বলে এবারের মত বেঁচে গেলে। নইলে আমার অজান্তে আমার মেয়েকে চু’রি করে আনার অপরাধে তোমার নামে থানায় ডায়েরি করতে দু সেকেন্ড সময় নিতাম না।”
প্রীতি তেড়ে প্রত্যাশার কাছাকাছি যেতে নেয়। পিছুন থেকে ওর হাতে টান পড়ল। সার্থক ওর হাত টেনে ধরেছে। চোখ দিয়ে ইশারা করল। ফিসফিসিয়ে বলল,

-” প্রীতি কুল….কুল। হাইপার হোস না।”
প্রীতির মেজাজ চটল। অন্যর বউয়ের প্রতি ভাইয়ের আলগা দরদ দেখে পিত্তি জ্বলে উঠে ওর। নীহারিকা এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
-” তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমারই সামনে আমার বাড়ির ছোট বউকে মামলা দেওয়ার হুমকি দাও। ভ’য় দেখাচ্ছো?”
প্রীতি দুই হাত বুকে ভাঁজ করল,
-” না ভ’য় নয়, সতর্ক করছি।”
নীরব বলল,

-” প্রত্যাশা বলছিলো ও মনার কাছে এড্রেস দিয়ে এসেছে। তুমি এত হাইপার না হয়ে, ইচ্ছেকে নিয়ে টেনশন না করে আমাকে একবার কল দিলেই শিওর হওয়া যেতো। শুধু শুধুই বাড়তি টেনশন নিয়ে বিপি বাড়াতে হতো না।”
যাক শাশুড়ি, বর ওর পক্ষে কথা বলায় একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল প্রত্যাশা। তবুও নিজের ভুলের জন্য প্রত্যাশা বলল,
-” স্যরি! আমার এভাবে ইচ্ছেকে আনা ঠিক হয়নি। আমি এক্সট্রিমলি স্যরি।”
নীলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রীতিকে দেখছে। গায়ে কলাপাতা রঙের থ্রি পিস, ওড়নাটা কাঁধের একপাশ দিয়ে সামনে রাখা। চুলগুলো কাঁধের থেকে একটু নিচে। হালকা সোনালী রং করা। নীলার মুখ ভার হয়ে এল–ভেবেছিলাম এ বাড়ির একমাত্র সুন্দরী বউ আমিই। প্রত্যাশার থেকে পড়াশোনায় ভালো, গায়ের রং উজ্জ্বল। এখন তো দেখছি এ ওভার স্মার্ট আর একদম বলিউডের নায়িকার মতো দেখতে। ধূর, ভাল্লাগে না!
শর্মিলা কোমল স্বরে বলল,
-” বসো তোমরা।”
প্রীতি উত্তরে রুক্ষ স্বরে বলল,

-” এখানে বসতে আসিনি। আমার মেয়েকে নিতে এসেছি।”
নীহারিকা কণ্ঠনালীতে আসা শব্দগুলো গিলে নিলেন। ইচ্ছের হাত ধরে প্রীতি বলল,
-” ইচ্ছে চলো।”
ইচ্ছে হাত ছাড়িয়ে বলল,
-” মাম্মা দাঁড়াও, সবাইকে বাই বলি।”
মাহবুব সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে বলল,
-” বুড়া দাদু বাই।”
মাহবুব সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-” আবার এসো দিদিভাই।”
পরপর নীহারিকার সামনে দাঁড়িয়ে ঝলমলে হেসে বলল,
-” তুমি আমায় খাইয়ে দিয়িছো। তুমি খুব খুউব মিষ্টি।”
এত আদুরে ভঙ্গিতে বলল। নীহারিকার শক্ত মনটাও কেমন কেমন করে উঠল। ছলছল চোখে মায়াময় মুখটায় চেয়ে রইলেন। প্রীতি এগিয়ে ইচ্ছের হাত ধরে টান দিয়ে- “চলো” বলে পা চালাল। ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। বলল চেঁচিয়ে,

-” পাপা, আমি থাকব।”
ইচ্ছের অপর হাতটা সার্থক ধরল। দু’জনের মাঝে ইচ্ছে। ও মাথাটা এদিকে করে একভাবে চেয়ে রইল। নীহারিকা তিতিবিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
-” দেখেছো তোমরা, ওই মেয়েটার হয়ে আমাকে বোঝাও। আজ সরাসরি দেখলে তো। এখানে শ্বশুর-শাশুড়ি বড়রা আছে কাউকে সম্মান দেওয়ার প্রয়োজন বোধটুকু করল না। কেমন দাপট নিয়ে আসলো, আবার বেরিয়ে গেল।”
মাহবুব সাহেব রুমে চলে গেলেন। শর্মিলা একটু আগেই বাইরে থেকে এসেছেন। ফ্রেশ হওয়া জরুরী। বেশি কথা না বলে বলেন,

-” আপা বাদ দাও না। তবে আমাদের নীবিড়ের মেয়েটা কিন্তু ভারী মিষ্টি। একদম নীবিড়ের মতোই দেখতে।”
নীহারিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। শর্মিলাও নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। ঠিক এমন সময় নীরব সামনাসামনি দাঁড়াল প্রত্যাশার। সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকাতেই, প্রত্যাশার হাত-পা ভয়ে বরফের মতো জমে গেল। নীরব টু শব্দটি না করে প্রত্যাশার হাত ধরে এক প্রকার টেনে রুমে আনল। পরপর হাতটা ছেড়ে শব্দ করে দরজা লাগাল। দরজার ধাড়াম শব্দে প্রত্যাশা কেঁপে উঠল। নীরব নব ঘুরিয়ে দরজা লক করে দেয়। প্রত্যাশা শুকনো ঢোক গিলতে থাকে।
নীরব ওর দিকে এগোল। প্রত্যাশা ভয়ে ভয়ে দু’পা পেছাতেই ওর পিঠ দেয়ালে ঠেকল। প্রত্যাশার বুক ধড়ফড় করছে। ভাবল–ইয়া আল্লাহ! মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবলের হাবভাব তো কিছুই বুঝতে পারছি না। নিশ্চয় এখন রোমান্স করার জন্য দরজা লকড করেনি! আর নাতো চুমু খেতে কাছে আসছে।
এতটুকু ভেবেই আপনাআপনি ওর হাত দু’টো হাওয়াই মিঠাই এর মতো তুলতুলে গালে চলে গেল। মনেমনে ভাবে–ইয়া মাবুদ রক্ষে করো। দুইগালে ঠাডিয়ে চড় না পড়ে।
নীরব ওর চোখে চোখ রেখে দারাজ স্বরে প্রশ্ন করল,

-” দুপুরে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিছু হয়েছে কী না! তখন বলোনি কেনো?”
প্রত্যাশা উত্তর দিতে পারল না। নীরব ফের বলল,
-” তখন যদি আমাকে বলতে তাহলে এতটা ঝামেলা হয় না।”
প্রত্যাশা সাহস সঞ্চয় করে বলল,
-” বাররে, আমার কী দোষ! আমি কী জানতাম নাকি আপনার টুইনস আছে! আমার জায়গায় আমি ঠিক আছি, হু।”
এইবলে প্রত্যাশা ডান দিকে দু’পা এগিয়ে গেল। দুইহাত বুকে ভাঁজ করে উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়াল। নীরব ওর বাহু ধরে একটানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল।
-” এত কিছু ঘটানোর পরেও বলছো তুমি ঠিক আছো?”

-” হুম। কারনটা আপনি আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে পারতেন। এটা একটা সেনসিটিভ ইস্যু। মেয়েদের কাছে স্বামীর বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। আর একটা মেয়ের কাছে বিষয়টা কতটা প্যাথেটিক তা কেবল তারাই জানে। পৃথিবীতে সবকিছু ভাগাভাগি করা গেলেও স্বামীর ভাগ মেয়েরা মানতে পারে না। আপনি জানেন ছবিটা দেখার সাথে সাথে আমার মাথায় আ’গু’ন ধরে গিয়েছিল।”
নীরব গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে বলল,
-” থ্যাংক গড! রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা কিছু করোনি। থানায় গিয়ে মামলা দিয়ে বসোনি সেটাই তো বেশি দেখছি।”
প্রত্যাশা বিজ্ঞের মতন মুখ করে বলল,
-” হু।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২০

পরপর ঠোঁট কা’মড়ে হালকা হেসে আচমকা নীরবের শার্টের কলার চেপে ধরল। মুখটা টেনে নিজের দিকে নামাল। নীরব চমকে গিয়ে কিছুটা হতবাক। নীরবের মুখটা প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকে। প্রত্যাশা এক আঙুল দিয়ে নীরবের গলা ছুঁয়ে হালকা করে টান দেওয়ার মতো করল। চোখেমুখে কপট রাগ মিশিয়ে বলল,
-” ভাগ্য ভালো যে আপনার গলায় ছু’রি চালাইনি।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২২