মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩৮ (২)
মুসতারিন মুসাররাত
পরীক্ষা শেষ। ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। চারপাশে মৌমাছির ঝাঁকের মতো শব্দ, হালকা গুঞ্জন হচ্ছে। প্রত্যাশারা তিনজন আগপিছ করে সিঁড়ি ভেঙে নামছে। প্রত্যাশা বিরক্ত গলায় বলল,
-” যেখানে নিজের জন্ম সালই মনে থাকে না, সেখানে এসেছে রবীন্দ্রনাথের জন্ম সাল কবে। কাজী নজরুল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রোকেয়া, সুফিয়া সবকটা জন্ম সাল ঠোঁটস্থ করেছিলাম। তবুও কেমন গুলিয়ে গেল। শেষে অনেকক্ষণ ভেবে মাথায় চাপ দিয়ে মনে করলাম, রবী ঠাকুর এদের চেয়ে বয়সে বড়। তাই সঠিক উত্তরটা দিতে পারলাম।”
থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে ওপরে তাকিয়ে ডাকল প্রত্যাশা,
-” অ্যাই হ্যাপির বাচ্চা এই টিকটা কী হবে? কী দিয়েছিস তুই?”
হ্যাপি ভ্রুকুটি করে বলল,
-” কোনটা?”
-” ওইযে উদ্দীপকে দেয়া ছিল, আলু, পটল সবজির মতো দরকষাকষি হচ্ছে বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে। অপশনে তো___”
হ্যাপি গলায় প্রশ্ন ঝুলিয়ে বলল,
-” তুই কোনটা দিয়েছিস?”
-” আরে কনফিউজড ছিলাম। একবার মনে হলো কল্যাণী, আবার মনে হলো আহ্লাদী। তাই দুটোর ঘরেই বৃত্ত ভরাট করেছি।”
হ্যাপি কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” দু’টো বৃত্ত ভরাট করেছিস?”
-” কী করব! যেহেতু শিওর না, তবে এই দুজনের একজন সেটা তো শিওর। তাই একটা টিকে দু’টো বৃত্ত ভরাট করেছি। আল্লাহ রহম করো, কম্পিউটার যেন সঠিকটাই নেয়। নম্বর যেনো কা*টা না যায়।”
উপরের দিকে মুখ তুলে দোয়া করার মতো করে প্রত্যাশা। হ্যাপি বলল,
-” ওটা আহ্লাদী হবে।”
প্রত্যাশা কিছুটা রাগি স্বরে বলল,
-” তুই শিওর ছিলি তাহলে জিজ্ঞাসা করার পরেও বললি না কেনো? সেলফিশ একটা। দোয়া করি তোর কপালে যেনো আহ্লাদীর বর জগুর মতো একজন জোটে।”
হ্যাপি তড়িঘড়ি বলল,
-” আরে তুই যখন জিজ্ঞাসা করিস আমি তখন তোর মতোই কনফিউজড ছিলাম। পরে কিছুটা শিওর হই।”
কোয়েল ফোড়ন কাটল,
-” মিথ্যে বললে তোর কপালে জগুই জুটবে।”
হ্যাপি পাল্টা বলল,
-” আর আমি সত্যি বললে, তোর কপালে মির জাফরের পুত্র মিরন জুটবে। আর তোর___”
প্রত্যাশাকে উদ্দেশ্য করে যখন শেষের কথাটা বলতে নেয় হ্যাপি। ঠিক তক্ষুনি প্রত্যাশা বলে তড়িঘড়ি,
-” এই এই আমার কপালে নতুন করে আর কাউকে জুটার দরকার নাই। আমার বর আছে ভাই।”
ফ্রেন্ডরা ভুল বুঝে সেলফিশ বলায় হ্যাপির মুখ ভার হয়ে এলো। ওদের ভুল ভাঙাতে হ্যাপি বলল,
-” অ্যাই তোরা ভুল বুঝিস না। আমি সত্যিই বলছি, প্রথমে আমিও কনফিউজড ছিলাম। এইযে তোর চুল ছুঁয়ে বলছি। একদম সত্যি __”
এই বলে কোয়েলের চুল স্পর্শ করতে নেয় হ্যাপি। তক্ষুনি কোয়েল একলাফে একহাত দূরে সরে হইহই করে উঠল,
-” অ্যাই বোন থামথাম বিশ্বাস করেছি। তবুও আমার চুল ছুঁয়ে কিছু বলিস না। এমনিতেই চুল উঠে দিনদিন টাকলা হয়ে যাচ্ছি।”
ওরা দু’জন হো হো করে হেসে উঠল। কোয়েল চোখ রাঙিয়ে বলল,
-” আমি হাসির মতো কী বললাম যে তোরা দু’জন হাসছিস? মজার কিছু বলেছি নাকি? আমি তো দুঃখের কথাই বললাম। চুল পড়া একটা মেয়ের জন্য কতটা প্যাথেটিক, যার পড়ে সেই শুধু জানে, হুহ।”
কোয়েলের কপালে আঙুল দিয়ে মৃদু টোকা দিয়ে বলল প্রত্যাশা,
-” টাকলা কথাটা শুনে হাসি পেল।”
হ্যাপি বলল,
-” বাই দ্য ওয়ে, এই কোয়েল একটা জিনিস খেয়াল করেছিস প্রত্যাশার চুল কিন্তু আগের থেকে বেশি সিল্কি আর ঘন হয়েছে। অ্যাই প্রত্যাশা তোর চুলের সৌন্দর্যের গোপন রহস্য কী? বল জলদি?”
-” ধূর, চুলে তেলই দিই না ঠিকমত। যা আম্মু জোর করে দেয়। শুধু শ্যাম্পুটা একটু ঘনঘন করি, ব্যস!”
কোয়েল জিজ্ঞেস করল,
-” কী শ্যাম্পু দিস?”
প্রত্যাশা ফাজলামোর সুরে বলল,
-” প্যান পড়া টিন। এবার তোরাই বুঝে নে।”
কোয়েল বুঝল না, হ্যাপি ঝটপট বলল,
-” প্যান্টিন?”
প্রত্যাশা হেসে মাথা ঝাকাল। শুধাল,
-” তুই?”
হ্যাপিও মজার ছলে বলল,
-” আমি সূর্যের ঝলক। আর মিরজাফরের পুত্র বধূ আপনি?”
ওমন সম্বোধনে কোয়েল চোখ পাকিয়ে তাকাল। পরপর জবাবে বলল,
-” তোদের মতো করেই উত্তর দিই; আমি ঘুঘু ইউস করি।”
কথা বলতে বলতে ওরা প্রায় গেইট অবধি চলে এসেছে। ওরা গল্পে এতটাই বিভোর যে আশপাশে লক্ষ্য নেই। কোয়েল আকস্মিক প্রত্যাশাকে পরখ করে বলল,
-” এই হ্যাপি, শুধু চুলের শাইনই না রে, প্রত্যাশাই আগের থেকে বেশি ঝকঝকে হয়েছে। মুখে একরকম টকটকে জ্যোতি। দেখেছিস? শুনেছি বিয়ের পর নাকি বরের আদরে মেয়েরা ঝলমল করতে থাকে। প্রত্যাশাও মনে হয় সেই ঝলমল দশায় আছে এখন।”
হ্যাপি তাল মিলিয়ে ঝটপট বলল,
-” হ্যাঁ, হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছিস।”
কোয়েল ভাঁজ করা ঠোঁটে দুষ্টু হাসি নিয়ে বলল,
-” এখন তো সত্যিই মনে হচ্ছে বরের ছোঁয়াতে ফর্সা হওয়ার ক্রীমও হার মানবে। বর একবার কোলে তুলেছে আর আমাদের প্রত্যাশা বলিউড লুক পেয়ে গেছে। অসম্পূর্ণ বাসর সম্পূর্ণ হলে না জানি….”
প্রত্যাশা লজ্জায় হাঁসফাঁস করে উঠল। চোখ বড় করে কোয়েলের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি থামিয়ে দিল,
-” অ’স’ভ্য মহিলা। থা”প্প”ড় খাবি একটা।”
কথাটা বলতে বলতেই স্বল্প দূরত্বে থাকা রাস্তার পাশে দাঁড়ানো নীরবের দিকে চোখ পড়ে প্রত্যাশার। বিস্ময়ে থ বনে যায়। সাথে সাথে প্রত্যাশা জিভ কে”টে আওড়ায়— এইরে এএসপি সাহেবর কানে এসকল কথা যায়নি তো আবার? কোয়েলের যে ফা’টা বাঁশের মতো গলা।
নীরব এক আঙুলে কপাল চুলকে মনেমনে ফিসফিস করল— এই জন্যই বলে, মেয়েমানুষের পেট কথার সেফ তো নয়, ওটা যেন ফাটা বাঁশের কভারবিহীন মাইক। বর কোলে তুলেছে এই তথ্যও বান্ধবীদের কাছে প্রচার করতে হয়? আর বান্ধবীও পারলে সেটা মাইক নিয়ে বলে। ও গড! এমন বউ নিয়ে মা”রা”ত্মক টেনশনে আছি। আজ বান্ধবীদের কাছে ‘কোলে তোলা’ রিলিজ হয়েছে। ভবিষ্যতে ‘বাসর-স্পেশাল’ এপিসোড রিলিজ হবে না, আল্লাহ মালুম।
নীরবের ভাবনায় ছেদ পড়ল প্রত্যাশার কথায়। প্রত্যাশা এগিয়ে এসে মিহি স্বরে বলল,
-” আপনি?”
নীরব মুখাবয়ব এমন করল যেনো তার কানে কিছুই ঢোকেনি। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” চলো। যেতে যেতে বলছি।”
প্রত্যাশা বিড়বিড় করে— যাক কোয়েলের কথা উনি শোনেনি বোধহয়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল প্রত্যাশা। বান্ধবীরা এঁটে ধরেছিল, গল্পে গল্পে ওই একটু বলে ফেলেছিল মাত্র।
পাশের এক কফিশপে এসে বসল ওরা। শীতল ফেনা উঠা কোল্ডকফির ক্যাপে স্ট্র বসিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করল নীরব,
-” পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
প্রত্যাশা একটা স্ট্র তুলে নাড়াতে নাড়াতে নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো হয়েছে। আপনি হঠাৎ এখন আসলেন যে?”
-” সকালে ঠিক সময় মতো আসতে পারিনি। ভাবলাম দুপুরের কিছু সময় তোমাকে দেয়া উচিত। যাতে করে হলেও সকালের কথা রাখতে না পারাটা একটু হলেও পুষিয়ে দিব।”
প্রত্যাশা মৃদু হেসে বলল,
-” ওহ্। আব্বুর আসার কথা ছিলো। যদিও আমি বারণ করেছিলাম। একাই যাব।”
-” আমি আংকেলকে ফোন করে বলেছিলাম তোমাকে ড্রপ করে দিবো।”
-” আপনি জানেন সকালে আপনার উপর কতটা রাগ হয়েছিল? আপনি না আসলে আমি কথাই বলতাম না আর, হুঁ।”
-” স্যরি!”
-” ওকে ওকে। এখন তো ঘু”ষ দিয়ে রাগ, অভিমান গলিয়ে দিচ্ছেন।”
-” ভুল বললে ঘু*ষ নয়, পেয়ার দিয়ে গোস্বা ভাঙানোর চেষ্টা মাত্র।”
প্রত্যাশা ঠোঁট ভেঙিয়ে বলল,
-” ঢং।”
দু’দিন পরেই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছে প্রীতি। একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে আজ দু’দিন সঙ্গ দিচ্ছে ছোট্ট ইচ্ছে। যদিও এই একাকী থাকা সে নিজেই বেছে নিয়েছে। ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে কী বুঝে আল্লাহ জানে! মা যে অসুস্থ সারাটাক্ষণ মায়ের কাছ ঘেঁষে আছে। প্রীতি এপাশ থেকে ওপাশ হলেও ছোট্ট ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” মাম্মা তোমার কিছু লাগবে? তুমি পানি খাবে মাম্মা?”
ইশশ্! আদুরে ঠোঁট, মুখ নাড়িয়ে কথাগুলো যখন বলে না; প্রীতির বরফের মতো কঠিন, শক্ত মনটাও গলে আসে। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চার মায়ের প্রতি টান ভালোবাসা দেখে প্রীতি ক্ষণেক্ষণে স্তব্ধ হচ্ছে। অবাক হচ্ছে এই আদুরে বাচ্চাটাকে সে পেটে ধরেছিল। সাথে লজ্জিত হচ্ছে, এই প্রাণটা পৃথিবীর আলো বাতাস দেখুক, তা সে কস্মিনকালেও চায়নি। একটা সময় তো অ্যাবরশন করার জন্যেও উঠেপড়ে লেগেছিল। শুধু মায়ের কথায় সেটা পারেনি।
অবসাদের ধোঁয়াটে চাদরে মোড়ানো প্রীতির হৃদয়টা। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় আরও ঘোলাটে ঠেকছে। শরীর যতটা না অসুস্থ, তার চেয়ে ঢের বেশি ক্লান্ত, বিষণ্ণ মনটা। অন্তঃপুর যেন ঘন কুয়াশায় ঢাকা একটা মরুভূমি, নিঃসঙ্গ, নিঃস্ব। বেডের হেডে হেলান দিয়ে ফোন স্ক্রল করছিল প্রীতি। গলাটা শুকিয়ে আসে। বেডটেবিলে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিতে যাবে ঠিক তক্ষুনি কোল ঘেঁষে বসে থাকা ইচ্ছে বলল,
-” মাম্মা আমি দিই?”
না চাইতেও প্রীতির ঠোঁটে হাসি ফুটল। বলল,
-” আমি পারব।”
ইচ্ছে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
-” তোমার হাতে ব্যথা নেই? ডক্টর ইঞ্জিন দিলো।”
প্রীতির ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো। মাথা নেড়ে বলল,
-” না ব্যথা নেই। মেডিসিন নিচ্ছি যে এখন একদম ঠিক আছি।”
-” ওহ্।”
প্রীতি পানি খেয়ে মাথাটা এলিয়ে চোখ বুজে নিল। ইচ্ছে আবদার করল,
-” মাম্মা তোমার ফোনটা নিই? কার্টুন দেখব?”
-” ওকে নাও।”
কার্টুন দেখতে দেখতে ইচ্ছে বলল,
-” মাম্মা পাপার সাথে কথা বলি?”
প্রীতি চোখ বুজেই দৃঢ় গলায় বলল,
-” নাহ, বলবে না।”
-” উল্প বলি?”
সেদিনের নীরবের করা অপমান, প্রতিটা কথা আজও বুকে সূচ ফোটানোর মতো বেঁধে— তোমাকে থা”প্প”ড় মা”রতেও আমার ঘে”ন্না হয়।….হাত নোং/রা করা।
যতটা না চড়ে আঘাত পেয়েছিল তার থেকে হাজার গুণ বেশি আহত হয়েছিল কটা কথায়। প্রীতি গর্জে উঠল,
-” ইচ্ছে…এএএএ।”
ইচ্ছের ছোট্ট শরীর কেঁপে উঠল। থরথরিয়ে কাঁপছে বাচ্চা মেয়েটা। প্রীতি বসে মেয়ের দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
-” বললাম না, তোমার কানে ভালো কথা গেল না?”
ইচ্ছে ফুঁপিয়ে উঠল,
-” স-স্যয়ি মাম্মা।”
ইচ্ছের ভীতু মুখটা দেখে মায়া হলো। আজকাল প্রীতির মনটাও নিজের সাথে বেঈমানি করছে। এইযে মেয়ের প্রতি তার কোনোকালেই টান ছিলো না বললেই চলে। মেয়েকে কাজের লোকের উপর ছেড়ে দিয়ে রেখেছিল। তবে হঠাৎ কী হলো, কে জানে? হাসপাতালে পাশে কেউ নেই, ছোট্ট মেয়েকে পেল। ভাইয়া ডিউটিতে ব্যস্ত। তবে দায়িত্ব সে পালন করেনি তা না। আর মা? চাইলে কী একটিবারের জন্যও যেতে পারত না? ছোট্ট মেয়ে কান্না করে মা’কে ছাড়া সে বাসায় যাবে না। হাসপাতালের ছোট বেডে পাশে শুতে চায়। বাচ্চাকে কোলের পাশে নিয়ে শুতে যে একটা শান্তি অনুভব হয়। সেটা প্রীতি জানত না। জানবে কী করে? কখনো তো সেভাবে স্নেহভরা চোখে মেয়ের দিকে তাকায়ইনি। তবে মৃ*ত্যু*র দোরগোড়া থেকে ফিরে এই পৃথিবীতে আপন বলতে একজনকেই আবিষ্কার করল। তার পেটের মেয়ে। যেখানে কোনো স্বার্থ ছিলো না। শুধুই ছিলো আত্মিক টান।
ইচ্ছের মাথা বুকে টেনে নিল প্রীতি। ইচ্ছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। প্রীতির কী হলো নিজেও জানে না। নিজের ইগো ধরে রাখতে, নাকি নিজের ভেতর সুক্ষ্ম পরিবর্তন থেকে বলে উঠল,
-” ইচ্ছে আমি নিজে তোমার পাপার কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো। আর তুমি প্রমিস করো আমায়, আমি যা বলব তাই শুনবে। আমি যাদের সাথে মিশতে বলব তুমি তাদের সাথেই মিশবে। যাদের সাথে কথা বলতে বারণ করব, তুমি বলবে না কথা তাদের সাথে। কথা দাও শুনবে?”
ইচ্ছে ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক প্রত্যুত্তর দেয়।
পরেরদিন…
প্রীতি একজন নার্সের সাথে কথা বলছে। ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখছে। প্রীতি কণ্ঠে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,
-” *** নম্বর কেবিনের নীবিড় মাহবুবের সাথে দেখা করতে চাই।”
-” স্যরি, ম্যাম সম্ভব নয়।”
-” যেকোন ভাবেই হোক আমি দেখা করতে চাই। জাস্ট ফাইভ মিনিটসের জন্য হলেও। ব্যবস্থা করুন।”
প্রীতির কণ্ঠে সুক্ষ্ম আদেশ মেশানো। নার্সটি বলল,
-” ডক্টর খান আর পেশেন্টের গার্ডিয়ান যিনি ওনাকে এখানে এডমিট করেছেন তাদের থেকে বারণ আছে। ওনাদের পারমিশন ছাড়া কাউকে এলাউ করা হবে না। আপনি ফোন করে পারমিশন নিয়ে নিন।”
প্রীতি একটা নম্বর বের করে বলল,
-” আমি একটা নম্বর দিচ্ছি, আপনি একটু কষ্ট করে কল করে বলুন; ইচ্ছে দেখা করতে আসছে।”
নার্স নম্বর তুলতে তুলতে বলল,
-” পেশেন্টের কী হোন আপনি?”
প্রীতি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
-” আমি….আমি পেশেন্টের… পেশেন্টের ওয়াইফ।”
কল রিসিভ হতেই সালাম দিয়ে নার্স বলল,
-” পেশেন্ট নীবিড় মাহবুবের ওয়াইফ আর বাচ্চা দেখা করতে এসেছেন। স্যার কী করব?”
নীরব থম মে*রে ভাবতে থাকে। পরমূহুর্তে বলল,
-” দেখা করতে দিন।”
নার্স সাথে সাথেই আছে। প্রীতি বেডের থেকে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে। ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল,
-” মাম্মা ভালো লাগছে না। বাসায় চলো।”
বেডে নিস্তেজ শরীরটা লম্বালম্বি ভাবে পড়ে আছে। ঠোঁট দুটো নিঃশ্বাসের জন্য থেকে থেকে নড়ছে। প্রীতি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে তুমি ভুল জানো, এটা তোমার পাপা।”
ইচ্ছে কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করল,
-” পাপা?”
-” হ্যাঁ, এটা তোমার পাপা। তোমার পাপা অসুস্থ।”
ইচ্ছে বেডের দিকে তাকাল। চুল এলোমেলো, দাঁড়ি গোঁফ বড় বড়। ইচ্ছের কেমন ভয়-ভয় লাগল। ও দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,
-” মাম্মা মিথ্যে বলছো, আমার পাপা সুন্দর। আমার পাপা ইত্ত কিউত।”
প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইচ্ছে কিছুতেই মানল না। প্রীতি জানালার পাশ ঘেঁষে এগিয়ে মা’কে ফোন করল। বলল,
-” মা, তুমি নীবিড়ের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। ওকে বিদেশে পাঠানোর জন্য যা করা দরকার তুমি তাই করবে।”
ওপাশ থেকে খানিকক্ষণ ভেবে ঠাণ্ডা মাথায় বলল,
-” তুমি ভেবে বলছো? নাহ মানে নীরব ওর ফ্যামেলি রাজি হবে? তুমি আগে নীরবের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে নাও। তারপর না হয়।”
প্রীতির মাথার ভেতর রাগ চিড়বিড় করে উঠল। ক্ষিপ্র হয়ে বলল,
-” নীরবের সাথে কথা বলব না জন্য তোমাকে বলছি। আমি জানি না, তুমি কীভাবে নীরব বা ওর ফ্যামেলিকে ম্যানেজ করবে। তবে আমি চাই নীবিড় সুস্থ হয়ে উঠুক।”
-” প্রীতি আমি জানি তুমি রেগে আছো। আরেকটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে নিলে হয় না।”
-” প্লীজ মা আমার এই কথাটা অনন্ত শোনো। তোমার কোনো কথাই তো আজ পর্যন্ত ফেলিনি আমি। আমার এই একটা কথা রাখবে এতটুকু আশারাখি।”
-” আচ্ছা। তুমি বাসায় আসো।”
-” মা, আমার লাইফ হেল হলেও আমি আমার মেয়ের লাইফটা ন*ষ্ট করতে চাইছি না। মা, আমার মেয়ে অন্যের দায়িত্বে থাকুক আমি চাই না। যে কী না আমায় ঘৃ/ণা করে। তুমি জানো আমার দূর্বলতা শুধু একটা জায়গায়। এই দূর্বলতাটুকু না থাকলে প্রীতি ওর দিকে থুতুও ফেলতে ঘুরত না। প্রীতির রাগ-জিদ সম্পর্কে ওর আজও ধারণা হয়নি।”
প্রীতির গলা ধরে এল। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,
-” নীবিড় সুস্থ হলে, একহাতে ওর মেয়েকে দিবো। আরেক হাতে ডিভোর্স লেটার। যেটা আমি আগেই চেয়েছিলাম। শুধু তোমার কথা রাখতে পারিনি সেটা। তারপর আমি চিরদিনের জন্য বিডি ছাড়ব।”
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। প্রীতি ইচ্ছেকে বলল— চলো। আবার কিছু ভেবে বেডের দিকে একপল চাইল। ডান হাতটা নীবিড়ের কপালের উপর এলোমেলো পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে বাড়াল। আবার পরমুহূর্তেই এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল প্রীতি। পিছু ঘুরে না তাকিয়ে গটগট পা ফেলে বেরিয়ে যায়।
এক সপ্তাহ খানেক পর…
শুক্রবারের পড়ন্ত বিকেল। ছুটির দিনের অলস বিকেলে বাসায় বোর হচ্ছিল নীরব। প্রত্যাশার সাথে কয়েকদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই। ভাবে বিকেলটা ওখান থেকে ঘুরে আসা হোক। শ্বশুরবাড়িতে আসতে ছেলেদের আজন্মের একটা লজ্জাবোধ কাজ করে। তাই সময় সুযোগ থাকলেও খুব একটা আসা হয় না। প্রত্যাশার রুমের বেডে হাত দু’টো বিছানায় ঠেস দিয়ে গা-টা পিছুনে হালকা এলিয়ে বসে নীরব। প্রত্যাশা নাস্তা রুমেই আনল। পাশের টেবিলে নামাতে নামাতে বলল,
-” নাস্তা করুন।”
নীরব নিরুত্তর রইল। প্রত্যাশা ফের বলতেই নীরব বলল,
-” কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।”
-” অল্প করে খান।”
-” পরে খাব।”
প্রত্যাশা বিছানার মাথার কাছ বরাবর বসল। আকস্মিক বলে উঠল,
-” একটা কথা জিজ্ঞাসা করব করব করে করা হয়নি। আচ্ছা, নীরব আপনি কী করে জানতেন ওই ওই উনি..?”
নীরব কিছুটা রুক্ষ স্বরে বলল,
-” কী ওই উনি উনি করছো? স্পষ্ট করে বলো।”
প্রত্যাশা জড়তা নিয়ে বলল,
-” না মানে বলতে চাচ্ছি।”
নীরব কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
-” সার্থক তোমাকে পছন্দ করে সেটা?”
প্রত্যাশা ওড়নার কোণা আঙুলে পেচাতে পেচাতে মাথা নাড়ল। নীরব গম্ভীর স্বরে বলল,
-” প্রীতির মাধ্যমে জেনেছিলাম। বাট তখন ওরা জানত না তুমি আমার বউ।”
-” ওহ্। উনারা যা করেছেন, প্রীতি মানে প্রীতি আপু উনার ভাইকে হেল্প করেছেন। এটাও অন্যায়। দু’জনেই সমান দোষী। তবুও মাঝেমাঝে মনে পড়লে আমার গা কাঁ”টা দিয়ে উঠে। দাবাং মা/র্কা পাঁচটা চ’ড় মে*রেছেন আপনার শ্রদ্ধেয় ভাবীর গালে। যার নাম নিয়ে একদিন একটু ব্যঙ্গ করেছিলাম বলে কতগুলো জ্ঞানের কথা শুনালেন।”
প্রত্যাশা যে একটু ঠেস দিয়ে বলল তা নীরব ঠিক বুঝতে পারল। নীরব বলল,
-” সে অন্যায় করেছে। আমি যেটা করেছি, ওটা তো তার অন্যায়ের সামান্য প্রতিবাদ। আসলে উচিত ছিল কঠোর শাস্তি দেওয়া।”
-” ওনার মা বৃদ্ধা মহিলা হাতজোড় করে রিকুয়েসট করলো। আর ক্ষমা তো মহৎ গুণ। দিলাম না হয় ওদের দুই ভাইবোনকে মাফ-সাফ করে।”
-” তোমার কথা ভেবে বাড়তি কোনো অ্যাকশন নেইনি। যতই হোক ওরা তো আবার তোমার আপনজন।”
প্রত্যাশা ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল,
-” আমার আপনজন মানে? ওনারা তো আপনারই রিলেটিভ।”
নীরব টিশার্টের গলা ফাঁক করে ফুঁ দিল। গরম লাগার ভঙি করে কথা ঘুরিয়ে বলল,
-” আমার রিলেটিভ হলেও দেখেছো কখনো সৌজন্যমূলক আচরণ করতে? অথচ তুমি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েও ওদের সাথে আড্ডা দিতে বসো।”
প্রত্যাশার মুখটা তেতো হয়ে এল। চিড়বিড়িয়ে রাগ উঠল। কিছুক্ষণ থম মে*রে থেকে বলে উঠল,
-” আমার না পার্সোনালি পু”লিশ-টুলিশ পছন্দ নয়।”
নীরব ভ্রু গুটিয়ে চেয়ে বলল,
-” কেনো?”
-” আমার এক বান্ধবীর বাবা পুলিশ। সে পরিবারকে না জানিয়ে সিরাজগঞ্জে ওনার পোস্টিং ছিলো। সেখানে আরেকটা বিয়ে করে সংসার পাতে। প্রতিবেশী এক আন্টির হ্যান্ডবেন্ডেরও প্রায় সেইম সেইম কেস। অনেক পুলিশকে দেখেছি দুই বিয়ে করতে।”
-” আমাকেও কী তোমার ওমন মনেহয় নাকি?”
-” না তা মনে হয় না। তবে পুরুষ মানুষকে নিয়ে বিশ্বাস নেই।”
-” এটা বাদ দিয়ে অন্য কোনো কারন থাকলে বলতে পারো। এখানে আমি লেটার মার্ক নিয়ে পাশ করে যাব, নো ডাউট।”
প্রত্যাশা জিভের আগায় ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বলল,
-” একটা বিষয় দেখবেন সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশ নিয়ে পজেটিভের থেকে নেগেটিভ মনোভাবই বেশি। আর এইযে দেখুন না, বাংলা সিনেমায় মা*রামা*রি, ফা*টাফাটি র*ক্তার*ক্তি, লা*শ পড়ার পর শেষ দৃশ্যে এসে পু*লিশ হাজির হয়। যখন সবশেষ তখন আসে দায়িত্ব পালন করতে। আমার কাছে আপনাকেও তেমনই ঠেকছে। সবকিছু শেষে এসে আপনি সত্য উদঘাটন করেন। শুধু মাত্র আমার ক্ষেত্রেই দেখলাম ডিরেক্ট অ্যাকশন নিলেন। সেটাও আবার যাচাই-বাছাই না করে ভুল বুঝে। নিরীহ, অবলা আমিটাকে পেয়েছিলেন, সব রাগ একসাথে ঝাড়লেন।”
নীরব অপমানিত বোধ করল। কিছু বলার খেই হারিয়ে ফেলল। কিছুপল চুপচাপ থেকে মৃদুস্বরে বলল,
-” বলেছি তো ওই মুহূর্তে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। মাইন্ড আউট হয়ে যায়, আমার বউয়ের গলায় আমার হাত দিয়ে পড়িয়ে দেয়া চেইন আমার শ”ত্রুর টিশার্টের বোতামে আটকায়। সে আবার যত্ন সহকারে ছাড়াচ্ছে। নিজের বউকে অন্যের সাথে এতটা ক্লোজড দেখলে কোনো পুরুষেরই মাথা ঠিক থাকবে না। হ্যাঁ, মানছি বেশি রুঢ় আচরণ করে ফেলেছি। স্যরি!”
ছোট করে শ্বাস ফেলে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল নীরব,
-” আচ্ছা, এসব টপিক বাদ দাও। এখন বিয়ের প্রোগ্রাম নিয়ে তোমার প্লান বলো। বিয়েতে কী পড়বে, শাড়ি না লেহেঙ্গা?”
কথাটা বলতে বলতে নীরব বিছানায় শুয়ে মাথাটা রাখে প্রত্যাশার কোলের উপর। প্রত্যাশা মৃদু কেঁপে উঠল। বলল ছোট করে,
-” শাড়ি।”
-” ওকে। কী রঙের?”
-” ভাবিনি। ইউটিউব থেকে দেখে নিবো।”
-” আচ্ছা।”
প্রত্যাশা বলল,
-” নাস্তা করে নিন। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।”
-” ঘুমাব।”
-” এখন? আরেকটু পরে আজান পড়বে তো। ছয়টা দশ বাজে অলরেডি।”
প্রত্যাশার কোমড় দুই হাতে জড়িয়ে পেটে মুখ গুঁজে বলল নীরব,
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩৮
-” আজানের আগে ডেকে দিবে। এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট একটাও শব্দ করবে না, না তো নড়াচড়া।”
-” আ’জ’ব কথা আমি নাকি স্ট্যাচু হয়ে এভাবে বসে থাকব। এখন এই অবেলায় আপনার ঘুম পাচ্ছে। রাতে কী করেছিলেন? না ঘুমিয়ে মশা তাড়িয়েছিলেন নাকি?”