মনের আড়ালে পর্ব ৫ || লেখনীতে Alisha Rahman Fiza

মনের আড়ালে পর্ব ৫
লেখনীতে Alisha Rahman Fiza

সকালবেলা
আমার ঘুম ভাঙ্গে মোবাইলের রিংটনের আওয়াজে আমি ঘুম ঘুম চোখে বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা নিয়ে রিসিভ করেই কানে দিয়ে বলি,
~ভাই রে ভাই ঘুমাইতেও দিবেন না আপনারা এতো হিংসা করেন কেন আমার ঘুম নিয়া?
এতটুকু বলে থেমে গেলাম তখনই অপরপাশ থেকে বলে উঠলো,
~আপনার ঘুমকে হিংসা করে আমার কোনো লাভ নেই।আমি জাস্ট এটা বলার জন্য ফোন দিয়েছি যে আপনার বোকার মতো কাজের জন্য রুপসার অনেক পেট ব্যাথা করছে।
মিস্টার রক্তিমের কথা শুনে আমি সাথে সাথে বসে পরলাম রুপসার কথা শুনে তো বুকটা মোচর দিয়ে উঠলো।আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

~রুপসা এখন ঠিক আছে নাকি ব্যাথাটা এখনও আছে।
মিস্টার রক্তিম বললেন,
~এখন একটু কম রাত ৩টা থেকে পেট ব্যাথা শুরু হয়েছে রুপসা আপনাকে অনেকবার ফোন করতে বলেছে রাত বলে আমি ফোন করিনি কিন্তু এখনও কিছুতেই আপনাকে ছাড়া মেডিসিন নিবে না।
আমি বললাম,
~আমি এখনই আসছি।
মিস্টার রক্তিম বললেন,
~তার কোনো প্রয়োজন নেই আপনি ওর সাথে কথা বললেই হবে আর আপনার টাইম মতো আপনি চলে এসেন।
আমি বললাম,
~ঠিক আছে।
রুপসার ফোন নিয়ে বলতে শুরু করলো,

~ম্যাম,আমার পেট ব্যাথা করছে সেই রাত থেকে তুমি ফুচকা খেতে মানা করছিলে তবুও খেয়েছি তাই হয়তো এমন হয়েছে।
আমি বললাম,
~না সোনা বাচ্চা এমন ভাবে বলে না তুমি মেডিসিন নিয়ে নেও আমি একটুপরই চলে আসবো।
রুপসা বললো,
~আচ্ছা।
রুপসার সাথে কথা বলে আমি ফোন রেখে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রুমের বাহিরে চলে আসলাম তারপর মায়ের সাথে রান্নার কাজে হাত লাগালাম।কিন্তু আমার মনটা রুপসার কাছেই রয়ে গেছে না জানি মেয়েটা কী করছে?মা আমাকে অন্যমনষ্ক দেখে বললো,
~কী হয়েছে?
আমি বললাম,
~রুপসার পেটে ব্যাথা।
মা আতংকিত হয়ে বললো,
~কী বলিস এখন কেমন আছে?
আমি বললাম,
~এখন একটু কম।
মা বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

~টেনশন নিস না ঠিক হয়ে যাবে।
আমি বললাম,
~মা কী বলছো?মেয়েটার পেটে ব্যাথা না জানি কেমন করছে আমি এখনই রওনা দিবো।
মা আমার কথা শুনে হালকা হেসে বললো,
~দেখেছিস মাতৃত্বের টান কতোটা যখন তোদের কিছু হয় তখন আমি কেমন করি।এখন তুই রুপসার জন্য ঠিক তেমনই করছিস।
আমি মায়ের কথায় তার দিকে তাকালাম মা আবার বললো,
~আমি অনেক খুশি মা তোর জন্য কারণ সেই মনমরা অধরাকে দেখতে আমার একটুও ভালো লাগতোনা।ওই ছোট পরীটার জন্য আমার পরীটা আবারও খিলখিল করে হাসতে শিখেছে।
মায়ের কথা শুনে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো মা আমার জন্য কতোটা কষ্ট সহ্য করেছে কোনো মা তার সন্তানকে এতোটা কষ্টে দেখতে পারে না।তবুও মা শক্ত থেকেছে আমার জন্য আমি মাকে বললাম,
~এখন থেকে নো কষ্ট রুপসাকে আর তোমাদের নিয়ে হ্যাপি হ্যাপি থাকবো।
মা আমার গালে হাত রেখে বললো,
~আল্লাহ যেনো সব সুখ তোর আঁচলে দিয়ে দেয়।

তাড়াতাড়ি নাস্তা করে বের হয়ে পরলাম রুপসার বাসায় যাওয়ার জন্য আমার সাথে আজ অরুনাও আছে।অরুনা রুপসাকে দেখে তার ভার্সিটি চলে যাবে অরুনা আমাকে টেনশনে দেখে বললো,
~আপু তুমি টেনশন করো না রুপসা ঠিক আছে।
আমি বললাম,
~কী যে বলিস এতটুকু মেয়েটার অবস্থা কী হয়েছে আল্লাহ জানে।
কিছুক্ষণ পর আমরা পৌছে গেলাম তাদের বাসায় আমি এক প্রকার দৌড়ে বাসার ভিতরে ঢুকে পরলাম আমার পিছন পিছন অরুনাও চলে আসলো।আমি হলরুমে ঢুকে দেখলাম মিস্টার রক্তিম আর তার মামা বসে কোনো অফিসিয়াল কাজ করছে।আমাকে দেখে মামা বললেন,
~অধরা,রুপসা এখন ঠিক আছে তুমি গিয়ে দেখা করতে পারো।
আমি রুপসার রুমে যেতে নিবো তখনই মিস্টার রক্তিম বললেন,

~অধরা,রুপসার ব্যাপারে কোনো উদাসীনতা আমি সহ্য করবো না।আজ যা হয়েছে তা আর কোনোদিন যাতে না হয়।
অরুনা আমার হাত শক্ত করে ধরে বললো,
~দেখেন ভাইয়া, আপু তো ইচ্ছা করে কিছু করেনি।
মিস্টার রক্তিম বললেন,
~তোমার বোন ইচ্ছা করে কিছু করেনি আমি জানি। আমি জাস্ট তাকে আরেকটু সচেতন হতে বলেছি।
বলেই সে গটগট করে বাসার বাহিরে চলে গেলেন মামা আমাদের সামনে এসে বললেন,
~তোমরা রক্তিমের কথায় কষ্ট পেওনা।
আমি বললাম,
~নাহ উনি নিজের মেয়ের জন্য চিন্তিত। অরুনা ভিতরে চল রুপসা অপেক্ষা করছে
আমি আর অরুনা রুপসার রুমে চলে গেলাম রুপসা বিছানায় বসে বসে টিভি দেখছে।আমি রুপসাকে ডেকে উঠলাম,

~রুপসা,তুমি ঠিক আছো?
রুপসা আমার দিকে তাকিয়ে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
~আমি ঠিক আছি।
আমি ওর পাশে বসে পরলাম রুপসা আমার কোলে মাথা রেখে অরুনার দিকে তাকিয়ে বললো,
~ম্যাম এই মেয়েটি কে?
অরুনা হেসে বললো,
~আমি তোমার ম্যামের বোন।
রুপসা বললো,
~তাহলে তোমাকে আমি কী বলে ডাকবো?
অরুনা হেসে বললো,
~তাই তো তুমি আমায় কী বলে ডাকবে?
রুপসা কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো
~আমি তোমাকে অরুনা আন্টি ডাকি।
অরুনা বললো,
~ঠিক আছে।

রুপসা অরুনার সাথে অনেকক্ষন আড্ডা মারলো আমি রুপসাকে এরই মাঝে খাবার খাইয়ে দিলাম।অরুনা চলে গেলো তার ভার্সিটি আমারও স্কুল যেতে হবে কিন্তু রুপসাকে রেখে কীভাবে যাবো তাই ভাবছি?রুপসার চুল গুলো বেঁধে দিয়ে ভাবলাম আজ আর স্কুল যাবো না এটা ভেবেই যেইনা মোবাইল নিয়ে প্রিন্সিপালকে ফোন করতে যাবো তখনই মিস্টার রক্তিম রুমে ডুকে বললেন,
~আপনি স্কুলে যান আমি রুপসার সাথে আছি আজ অফিস যাবো না।
আমি বললাম,
~কিন্তু রুপসা আমাকে ছাড়া থাকবে না।
মিস্টার রক্তিম বললেন,
~রুপসাকে handle করতে পারবো।
আমি আর কিছু না বলে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে রুপসাকে bye বলে বের হয়ে পরলাম স্কুলের জন্য।

আমার সব কাজ শেষ করে বের হয়ে পরলাম স্কুল থেকে রিক্সায় উঠতে যাবো তখনই আমাকে কেউ পিছন থেকে ডেকে উঠলো,
~অধরা।
আমি পিছন ঘুরে দেখি আহনাফের মা তাকে দেখে একটু অবাক হলাম। তারপর নিজেকে সামলে বললাম,
~আপনি এখানে?
আহনাফের মা বললেন,
~তোমার চেহারা দেখার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না।আমি এসেছি এটা জানতে যে তুমি কী আবার বিয়ে করার প্ল্যানিং করছো নাকি?
আমি তার প্রশ্ন শুনে হতবাক আমি বললাম,
~কীসব বলছেন আপনি?
আহনাফের মা বললেন,
~ন্যাকামি হচ্ছে প্রতিদিন একটা ছেলের বাসায় আসা যাওয়া করছো আমি কী বুঝিনা এগুলি।
আমি এবার রেগে গিয়ে বললাম,

~আপনার মুখে এসব সোভা পায় না আপনি গুরুজন হয়ে এসব বলতে লজ্জা করছে না।
আহনাফের মা বললেন,
~এই মেয়ে এতো কথা বুঝিনা আমার ছেলে তোমাকে বিয়ের সময় যে গহনা দিয়েছে তা আমায় ফেরত দিয়ে দিবে আমাকে ব্যাংক থেকে জানিয়েছে গহনা গুলো আহনাফ তোমাকে দিয়েছে।
তার কথা শুনে ঘৃণাটা আরো বেড়ে গেলো একটা নেকলেস আর এক জোড়া কানের দুল নিতে চলে এসেছে সে। আমি কঠিনস্বরে বললাম,
~১০ লাখ টাকা নিয়েও আপনার পেট ভরে নি এখন এগুলো নিতে এসেছেন ঠিক আছে আমি পাঠিয়ে দিবো।
তার সাথে কথা বলে লাভ নেই সে লোভী মানুষ তার থেকে যত দূরে থাকা যায় তত ভালো।
আমি পিছন ফিরে আসতে নিবো সে আবার বলে উঠলো,

~এবারও শুনেছি বড়লোক ধরেছো তা কত টাকা দিয়েছে তোমায়?
আমি পিছন ফিরে তাকালাম আহনাফের মায়ের মুখে বাঁকা হাসি আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,
~আপনি কী আদৌ আহনাফের আপন মা কারণ আপনার আর তার ভিতরে অনেক পার্থক্য।
আর কিছু না বলে রিক্সায় উঠে বসলাম পিছন ফিরে একবারও তাকাইনি এই স্বার্থপর মানুষটি কখনো কারো হতে পারে না।
রুপসাদের বাসায় পৌছে আমি হলরুমে প্রবেশ করতেই দেখি বাবা আর মেয়ে খেলায় মসগুল আমি পা টিপে টিপে রুপসার পিছনে দাড়িয়ে ওর চোখ দুটো ধরতেই রুপসা চটজলদি বলে উঠলো,
~ম্যাম এসে পরেছে।
আমি ওর চোখ ছেড়ে দিয়ে বললাম,
~ওরে আমার পাকনি বুড়ি চিনলে কী করে?
রুপসা আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,

~এভাবেই।
আমি বললাম,
~আমার সোনা বাচ্চা টা কী খাবার খেয়েছে?
রুপসা বললাম,
~তোমার সাথে খাবো।
আমি বললাম,
~ওকে আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি।
মিস্টার রক্তিম বললেন,
~আমার একটু কাজ আছে তা ফিনিস করে আসছি।
আমি রুপসাকে ছেড়ে রুমে চলে আসলাম হাত-মুখ ধুয়ে রুপসাকে খাবার খাওয়াতে শুরু করলাম।এরইমধ্যে মিস্টার রক্তিম চলে এসেছেন হয়তো শাওয়ার নিয়ে এসেছে তাই তার চুল ভেজা। আমি তার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার রুপসার দিকে খেয়াল করলাম।রুপসা তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
~পাপা,তুমি চুল কেনো মুছো নি?
মিস্টার রক্তিম একবার আমার দিকে তাকিয়ে তারপর রুপসাকে বললেন,
~অনেক ক্ষুধা লেগেছে তাই চুল না মুছেই চলে এসেছি।
সরি পরী
রুপসা বললো,
~দাড়াও আমি আসছি।
বলেই রুপসা চেয়ার থেকে নেমে রুমে চলে গেলো আমি মিস্টার রক্তিমের দিকে তাকালাম সে ইশারায় জানতে চাইলো রুপসা কী করতে চাচ্ছে?আমিও ইশারা করে বললাম জানিনা।

একটু পর রুপসা হাজির হয় হাতে টাওয়াল নিয়ে নিজ হাতে রুপসা তার বাবার চুল মুছে দিলো।আমি মুচকি হাসলাম বাবার জন্য মেয়ের ভালোবাসা দেখে
দুপুরের খাবারের পর সব গুছিয়ে আমি রুপসাকে ঔষধ খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দিলাম।তারপর রুম থেকে বের হয়ে নিচে নামতে যাবো তখন দেখি মিস্টার রক্তিম তার রুমের বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট ফুকঁছে। আমি ধীর পায়ে তার রুমে ডুকে তার বারান্দায় গিয়ে তার পিছে দাড়িয়ে পরলাম আর বললাম,
~রুপসা কী জানে তার পাপা সিগারেট ফুঁকছে?
আমার কথা শুনে মিস্টার রক্তিম পিছনে না ফিরেই উত্তর দেয়,
~নিজের একাকিত্ব টাকে ভুলতে এই ধোঁয়ার সাহায্য নিয়ে থাকি।এখন তো রুপসাও আপনার সাথে ব্যস্ত।
আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম তার পাশে দাড়িয়ে রেলিং গুলো ধরে বললাম,
~তাহলে কী আমিও সিগারেটের ধোঁয়া ফুঁকবো?
মিস্টার রক্তিম আমার প্রশ্ন শুনে ভ্রুকুচকালেন আমি বললাম,

~আমিও তো একা আমার জীবনে একজন মানুষের অভাব রয়েছে তাহলে কী আমিও শুরু করে দিবো?
মিস্টার রক্তিম আমার কথা শুনে হালকা হেসে সিগারেট টা ফেলে দিয়ে বললেন,
~নাহ আপনি সিগারেট খেতে যেয়ে আবার ঘরে আগুন লাগিয়ে ফেললাম আপনার কাজ কোনো টাই পারফেক্ট হয় না।
আমি বললাম,
~কী আমার কাজ পারফেক্ট হয় না?
মিস্টার রক্তিম একটু ভেবে বললেন,
~ফুচকা খেতে পারেন পুরো পারফেক্ট ভাবে।
তার কথা শুনে আমি লজ্জা পেলাম মিস্টার রক্তিম বললেন,
~অধরা,আমি আহনাফের ব্যাপারে সবটাই জানি।
জানেন তো যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবেন সেই আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে।এটাই বাস্তবতা
আমি বললাম,

মনের আড়ালে পর্ব ৪

~তা তো ঠিক বলেছেন আর জানেন এই দুনিয়ায় সবারই একজন ভালোবাসার মানুষ থাকে পার্থক্য শুধু এতটুকু কেউ কেউ তার ভালোবাসাকে কাছে পেয়ে আগলে রাখে।আর কেউ কেউ সেই ভালোবাসা পেয়েও হারিয়ে ফেলে
মিস্টার রক্তিম বললেন,
~রাহির সাথে বিয়ে হওয়ার পর আমার জীবনটাই অনেক সুন্দর হয়ে গিয়েছিল।তারপর রুপসা আসাতে তো সেই সুন্দর জীবন আরো সুন্দর হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু সেই সুখ আমার কাছে ধরে রাখতে পারলাম না চলে গেলো রাহি আমাকে ছেড়ে।
এ কথা গুলো বলতে রক্তিমের চোখ পানিতে টলমল করছে সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। অধরা তো চোখের পানি ফেলছে।
তখনই রক্তিম চোখ মুছে বললো,

~অধরা,আপনি তো খাবার খাননি প্লিজ খেয়ে নিন।
বলেই এক প্রকার লুকিয়েই সেখান থেকে চলে যান অধরা এখনও সেই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,
~ভালোবাসার মানুষ গুলো কেন হাত ছেড়ে সেই অজানা পথে চলে যায়?এই প্রশ্নের জবাবটা কী আদৌ কেউ দিতে পারবে?

মনের আড়ালে পর্ব ৬