মনের উঠোন জুড়ে পর্ব ২৩

মনের উঠোন জুড়ে পর্ব ২৩
নূন মাহবুব

-“শিক্ষার রুমে এসে যেন সাহিত্যের পা থমকে যায়। সাহিত্যের হাতে থাকা শপিং ব্যাগ নিচে পড়ে যায়। লাল কাচের চুড়ি গুলো ভেঙ্গে এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। সাহিত্য ধপ করে নিচে বসে করে। পরক্ষণেই সে শিক্ষার রুমে চোখ বুলিয়ে দেখলো , রুমের সব জিনিসপত্র ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে।হয়তো এইখানে হাতাহাতি মা’রা’মা’রি হয়েছে।

শিক্ষার কাপড় চোপড়, ব‌ইখাতা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে।বালিশ ছিঁড়ে তুলা বেরিয়ে সমস্ত রুমে একাকার হয়ে গিয়েছে। এমনকি শিক্ষার পছন্দের ফুলদানি টাও ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে।যাতে র’ক্ত লেগে রয়েছে। র’ক্ত মাখা ফুলদানি দেখে সাহিত্যের কলিজা মোচড় দিয়ে ওঠে। সাহিত্যের বুঝতে বাকি থাকে এখানে ঠিক কি ঘটেছে? তৎক্ষণাৎ সাহিত্যের কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার মানে বাড়ির লোকেরা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘুমায় নি তাদের কে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শিক্ষা কে কিডন্যাপ করার জন্য। সাহিত্য আর এক মূহুর্ত দেরি না করে আবৃত্তির রুমে চলে আসে। কিন্তু এইখানে এসে ও আরেক দফা চমকে ওঠে সাহিত্যে। তার কলিজার টুকরা বোন অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।মুখ কেমন যেন নীল হয়ে গিয়েছে। শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।

সাহিত্য নির্জন কে কল করে সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বলে একে একে প্রত্যেকের রুমে গিয়ে দেখে সবার একি অবস্থা।তার মানে কেউ সবাইকে ক্লোরোফর্ম বা হেলোথেন নাকে শুকিয়েছে ।যার কারণে সবার এই অবস্থা। কিন্তু এই কাজ টা করলো কে? আমাদের বাড়িতে বাইরের লোক বলতে শুধু সাথী রয়েছে।তার মানে কি সাথী এই কাজ করেছে? কিন্তু সাথী তো নিজেই অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তাহলে নিশ্চয় বাইরের কেউ এই কাজ টা করেছে।

কিন্তু সেই লোকটা কে হতে পারে? সাহিত্যের ভাবনার মাঝে নির্জন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে আসে। সাহিত্য নিজের পরিবারের সদস্যদের এই অবস্থায় দেখে এতোটা ঘাবড়ে গেছিলো যে শিক্ষার কথা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে‌।সে শিক্ষার চিন্তা বাদ দিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছুটে চললো হসপিটালের উদ্দেশ্য।”

-” এসব কি বলছেন উক্টর?”
-” আমি বলছি না সাহিত্য। ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে। এদের সবাইকে হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ পানিতে মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছে।আর এই ঔষধের মাত্রা এতোটায় তীব্র ছিলো যে এদের কে ঠিক সময়ে হসপিটালে নিয়ে না আসলে কোনো একটা অঘটন ঘটে যেতে পারতো।”

-” এটা সাধারণ ঘুমের ঔষধ। আমার জানা মতে খুব বেশি হলে অনেকক্ষন ধরে ঘুমিয়ে থাকবে।”
-“দেখো সাহিত্য আমরা সাধারণ ঘুমের ঔষধ খাই প্রশান্তিদায়ক ঘুমের জন্য, দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিংবা মাংস পেশী শিথিল করার জন্য। কিন্তু এসব ঔষধ অতিরিক্ত খেলে শ্বাস প্রশ্বাস শ্লথ হয়ে আসে, র’ক্ত চাপ হঠাৎ করে কমে যায়, মুখমণ্ডল নীল হয়ে আসে,পেশি থলথলে হয়ে থাকে, শরীরের ত্বক ঠাণ্ডা ও চটচটে হয়। রোগী অচেতন হয়ে পড়ে।

এমনকি শ্বাস ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যু ও ঘটতে পারে। আমি তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম সাহিত্য। তোমাদের ডাইনিং টেবিলের উপর যে জগ রাখা আছে ঐ জগে রাখা পানিতে এই ঔষধ পাওয়া গিয়েছে।আর একটা কথা শিক্ষার রুমে ফুলদানি তে যে র’ক্ত লেগে হয়েছে সেটা শিক্ষার র’ক্ত নয়।”

-” তাহলে কার?”
-” পিজ্জা ডেলিভারি বয় এর।”
-” হোয়াট ? এর মধ্যে আবার পিজ্জা ডেলিভারি বয় আসলো কোথা থেকে?”
-” হয়তো তোমাদের বাড়ি থেকে কেউ পিজ্জা অর্ডার দিয়েছিলো।আর এই অজানা লোকটা পিজ্জা ডেলিভারি বয় সেজে তোমাদের বাড়িতে আসে , সুযোগ বুঝে ভেতরে প্রবেশ করে এবং পানিতে ঔষধ মিশিয়ে দেয় ব্যাস।”
-” কিন্তু উক্টর আপনি কিভাবে বুঝলেন ফুলদানি তে লেগে থাকা র’ক্ত টা এই ডেলিভারি বয় এর।”

-” শাফ‌ওয়ান মাহমুদ সাহিত্যে কে বললো, তোমাদের টেবিলের উপর পাঁচ টা গ্লাস রাখা ছিলো।যার চার টার মধ্যে এই ঔষধ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু পঞ্চম গ্লাসে এই ঔষধ টা পাওয়া যায় নি। কারণ পঞ্চম গ্লাসে পানি খেয়েছিলো ঐ ডেলিভারি বয়। যার লালা ঐ গ্লাসে লেগে ছিলো।আর ঐ ফুলদানি তে লেগে থাকা র’ক্তে’র
ডিএন‌এ আর এই গ্লাসে লেগে থাকা লালার ডিএনএ ম্যাচ করছে।”

-” ওহ্! তার মানে অজানা লোকটা পিজ্জা ডেলিভারি বয় সেজে আমাদের বাড়িতে ঢোকে। কিন্তু আর বের হয় না।পানিতে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে থাকে। এরপর সবাই যখন পিজ্জা খেয়ে পানি খায় ,তখনি তাদের ঘুম পায়।আর যে যার মতো ঘুমোতে চলে যায়।আর সেই সুযোগে লোকটা শিক্ষার রুমে যায়। রুমের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়েছে , মা’রা’মা’রি হয়েছে ।কিন্তু কেউ কিছু টের পায় নি। কিন্তু ডক্টর শিক্ষা একজন মার্শাল আর্টিস্ট।ওর নিজের আত্মরক্ষা ও খুব ভালো করে করতে পারে। শিক্ষা বাচ্চু বিল্লার মতো একজন ভ’য়ং’ক’র লোক সহ আরো চার পাঁচ টা গুন্ডার সাথে একা লড়ছে। শিক্ষা কে কাবু করা এতো সহজ নয়। তবু ও শিক্ষা কিডন্যাপ হলো কিভাবে ?”

-” হয়তো শিক্ষা কে অজ্ঞান হ‌ওয়ার কোনো ইনজেকশন বা ক্লোরোফার্ম বা স্প্রে দেওয়া হয়েছিলো।”
-” হতে পারে ডক্টর। এখন আমাদের এই দুই টা লোককে খুঁজে বের করতে হবে।এই ডেলিভারি বয় আর কামরুল নামের লোকটা। তাহলেই আমরা পর্দার আড়ালে কে রয়েছে সেটা জানতে পারবো?এই দুই জন লোক আমাদের আসল খু’নি অব্দি পৌঁছে দিবে। এখন শুধু মাত্র সবার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করতে হবে। এদের জ্ঞান ফিরলে জানতে পারবো এই ডেলিভারি বয় কে ছিলো? সাহিত্য আর শাফ‌ওয়ান মাহমুদ নিজেদের মধ্যে কথা বলছে এমন সময় উক্টর এসে বললো, রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। আপনারা গিয়ে কথা বলতে পারে। সাহিত্য একে একে সবার সাথে দেখা করে আবৃত্তির কাছে এসে বললো, কেমন লাগছে এখন?”

-” ভালো ভাইয়া।”
-” এসব হলো কিভাবে?”
-” আসলে ভাইয়া আমার খুব পিজ্জা খেতে ইচ্ছে করছিলো। অবশ্য শিক্ষা বলেছিলো ও নিজে পিজ্জা বানিয়ে দিবো। কিন্তু মাছ ভাঁজতে গিয়ে গরম তেল এসে শিক্ষার হাতে লেগে ফোস্কা পড়ে যায়।যার জন্য আমি শিক্ষা কে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে পিজ্জা অর্ডার করি। কিছুক্ষণ পরে পিজ্জা নিয়ে ডেলিভারি বয় আসে। আমি পিজ্জা নেওয়ার পর সে আমার কাছে পানি খেতে চায়। আমি তাকে ভেতরে আসতে বলি।

লোকটা ভেতরে এসে সোফায় বসে। আমি যখন লোকটা কে পানি দেই তখন লোকটা বলে ,এই পিজ্জার জন্য আরো পঞ্চাশ টাকা বেশি দিতে হবে।তার কথা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম বটে।কারণ আমি টাকা আগেই পেমেন্ট করে দিয়েছিলাম। তবু ও লোকটা বারবার বলছিলো যার জন্য আমি রুমে যাই টাকা আনতে।আর আশ্চর্যজনক ভাবে আমি টাকা নিয়ে এসে তাকে আর পাই নি। ব্যাপার টা আমার কাছে খটকা লাগলেও আমি পাত্তা দেই নি।

আমি পিজ্জা খেতে যাবো তখন মনে হলো একা একা খাওয়ার ব্যাপার টা কেমন দৃষ্টিকটু লাগে।তাই মম আর সাথী কে ডেকে নিয়ে আসি। শিক্ষা পিজ্জা পছন্দ করে না।তাই শিক্ষা কে ডাকি নি। আমি মম , সাথী পিজ্জা খাচ্ছিলাম তখন পাপা আসে।পাপা এসে আমাদের সাথে যোগ দেয়। তারপর পিজ্জা খাওয়ার শেষ হলে পানি খাওয়ার পর যেন দুচোখের পাতা এক হয়ে আসে।আমি ঘুমোতে চলে যাই।আর চোখ খুলে দেখি হসপিটালের বেডে রয়েছি।”

-” তোদের সবাইকে ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছিলো।”
-” আর শিক্ষা? শিক্ষা কোথায়? শিক্ষা কে দেখছি না যে?”
-” মূলত শিক্ষার জন্য তোদের এই অবস্থা। তোদের কে অচেতন করে শিক্ষা কে কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছে।”
-” তোমাদের জন্য এসব হয়েছে। নিজেরা খু’নি ধরার জন্য মেয়েটা কে তোমাদের কাজে ব্যবহার করছো।না জানি মেয়েটা কোথায় আছে ? কেমন আছে?”

-” এতোদিন এক বাড়িতে এক‌ই ছাদের নিচে থেকে ও তুই শিক্ষা কে চিনতে পারিস নি আবৃত্তি। আমি হলফ করে বলতে পারি ওর কিছু হবে না। এখন তুই এটা বল যে ঐ পিজ্জা ডেলিভারি বয় কে ছিলো?”
-” এমন ভাবে বলছো যেন সে আমার বয়ফ্রেন্ড ছিলো। আমি কিভাবে বলবো সে কে ছিলো?”
-” শিক্ষার সাথে থাকতে থাকতে তুই ও শিক্ষার মতো ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলতে শিখে গেছিস। এজন্যই প্রবাদে বলে ” সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস ,অসৎ সঙ্গে স’র্ব’না’শ। আমার দরকার নেই তোর কোনো হেল্প এর।আমি আশেপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে লোকটা কে ঠিক চিনে নিতে পারবো।”

-” জ্বি না।পারবে না।কারণ লোকটা মাস্ক পরে এসেছিলো। শুধু যখন পানি খাচ্ছিলো তখন মাস্ক খুলেছিলো।”
-” তার মানে তুই লোকটার মুখ দেখেছিলি?”
-” হ্যাঁ দেখেছিলাম।”

-” তুই তো খুব ভালো স্কেচ করতে পারিস। ঐ লোকটার একটা স্কেচ করে দিতে পারবি?”
-” কে যেনো বলেছিলো আমার থেকে কারো কোনো হেল্প এর প্রয়োজন নেই।”
-“ইশ্ না জানি শিক্ষা মেয়েটার কি অবস্থা হচ্ছে? অন্ততপক্ষে ঐ লোকটার একটা স্কেচ হলেও আমরা শিক্ষা অব্দি পৌঁছাতে পারতাম। আমার জন্য না হোক তোর ভাবী কে খুঁজে পাবার জন্য হলে ও দে।”

মনের উঠোন জুড়ে পর্ব ২২

-” ঠিক আছে ঠিক আছে।এতো ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার প্রয়োজন নেই।আমি এক্ষুনি দিচ্ছি।”
-” প্রায় ত্রিশ মিনিট পরে আবৃত্তি বললো,স্কেচ রেডি ভাইয়া।এই দেখো সেই পিজ্জা ডেলিভারি বয়।”
-” সাহিত্য স্কেচ দেখে অবাক হয়ে বললো, ওহ্ আচ্ছা এই সেই লোক তাহলে?”

মনের উঠোন জুড়ে পর্ব ২৪