মন দিতে চাই পর্ব ১০

মন দিতে চাই পর্ব ১০
লেখনীতে সুপ্রিয়া চক্রবর্তী

সুবর্ণা আপি মুক্তো আর আমাকে ভেতরে যেতে বলল। আমি সুবর্ণা আপির মুখ থেকেই প্রথম জানতে পারলাম যে সুদর্শন পুরুষের নাম মুক্তো। যেমন দেখতে সুন্দর তেমন তার নামও অনেক সুন্দর। এমন সময় আমার মাথাতে একটি প্রশ্ন এলো। সবারই তো এক একটা নাম আছে। তাহলে আমার কি কোন নাম নেই?

আমি খুব করে চেষ্টা করলাম মনে করার কিন্তু ব্যর্থ হলাম। হাজার চেষ্টা করেও নিজের নাম মনে করতে পারলাম না।
সুবর্ণা আপির বাড়ির ভেতরে যেতেই সে আমাদের বসতে দিল। তার ব্যবহার অনেক ভালো। সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহারও বোধহয় খুব সুন্দর হয়। সুবর্ণা আপি আমাদের চা-নাস্তা দিল। আমার নতুন যায়গায় কিছু খেতে লজ্জা করছিল। তখন সুদর্শন পুরুষ মানে মুক্তো বলল, লজ্জা না করে খেয়ে নিন। এখন থেকে তো আপনাকে এখানেই থাকতে হবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এতবার একই কথা শুনে আমার মন মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। মুক্তো কি জানেন না আমার মনের কথা? আমি যে তার সাথে থাকতে চাই। একরাশ অভিমান সাথে নিয়েই আমি চায়ে বিস্কিট ডুবিয়ে খেতে লাগলাম। চা এর মধ্যে চিনি নেই বললেই চলে। একটু মুখে দিতেই আমার বমি এসে গেল। বিস্কিটটাও কেমন নোনতা। সুবর্ণা আপি তো ডাক্তার। ডাক্তাররা বুঝি এমন খাবারই খায়। তাই আমি আর এই নিয়ে বেশি কিছু ভাবলাম না।

মুক্তো সুবর্ণা আপির সাথে হেসে হেসে কথা বললেন। আমি বুঝতে পারলাম তাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা অনেক গভীর। কথার ছলে সুবর্ণা আপি মুক্তোকে বলল, তা তুই আর কতদিন এভাবে দেশে বসে থাকবি? সেই কবে যে পরিবারের সাথে লন্ডনে গেলি তারপর তো আর ফিরলি না। এখন একটা মেয়ের জন্য দেশে পড়ে আছিস!
ও কোন সামান্য মেয়ে নয়। আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে ঐ মেয়ে। ওকে খুঁজে বের না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। আমি দেখতে চাই ও এখন কেমন আছে, কোথায় আছে।

কিভাবে খুঁজবি তুই মেয়েটাকে? নাম ছাড়া তো আর কিছুই জানিস না। ওর মামার বাড়িতে খোঁজ করেছিস?
না করিনি। আমি ঐ ঘটনার পর আর সিলেটে ফিরিনি। বিদেশে ছিলাম কয়েকদিন। তারপর মাথায় জেদ চেপে বসল দেশে ফিরব। তাই চলে এলাম। ঢাকায় আসতেই এই মেয়েটার সাথে এক্সিডেন্ট হলো। এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় আর খোঁজ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে ভাবছি এখন খোঁজ নেবো।
জানিস আমার না মাঝে মাঝে খুব হিংসা হয় আবার করুণাও হয় ঝিনুক নামের মেয়েটার উপর। একটা মেয়ে তোর মতো এতো ভালো একটা ছেলেকে রিজেক্ট করল। আর তুইও না দেখে তার প্রেমে পড়ে গেলি। আচ্ছা সত্যি করে বল তো মেয়েটাকে কি তুই সত্যি দেখিস নি?

ড্যাড ওকে দেখে পছন্দ করেছিল। আমি ওকে দেখিনি। তুই তো জানিস আমি বিয়ে নিয়ে একটা থ্রিলে ছিলাম। ছোট বেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল একেবারে বিয়ের দিন নিজের বউকে দেখব। তাই আজ অব্দি মেয়েটার ছবি দেখিনি।
ছবি না দেখে ওকে খুঁজে চলেছিস? আদৌ কি খুঁজে পাবি?
জানি না। মম ড্যাডের সাথে তো এখন রাগ করে যোগাযোগ বন্ধ করেছি। কারণ বিদেশে ফিরে তারা আবার নতুন করে আমার বিয়ে ঠিক করেছিল। যেটা আমি চাই নি। এত ঘটনা ঘটেছে আমার সাথে যে কাউকে কিছু না বলে দেশে চলে আসি। এখানে আমাদের বিজনেসের হয়ে কাজ করছি। মম ড্যাড আমার খোঁজ নেয়না। আমিও তাদের সাথে যোগাযোগ করছি না।

এভাবে বসে থাকলে কি ঝিনুককে পাওয়া যাবে?
গড নোস। এখন তিনিই একমাত্র ভরসা। আমি আর এসব নিয়ে ভাবতে চাই না। আমার মানসিক শান্তির প্রয়োজন।
তাদের কথোপকথন এতক্ষণ ধরে মনযোগ দিয়ে শুনলাম আমি। ঝিনুক নামের মেয়েটার কথা শুনে খুব হিংসা হলো আমার। বুঝলাম ঝিনুক নামের মেয়েটাকে হয়তো মুক্ত ভালোবাসে। আমার সুদর্শন পুরুষের মনে অন্য কেউ রাজ করবে সেটা আমি কিভাবে মেনে নেই?
আমি তো ওনার মনের অধিকারী হতে চাই। সুবর্ণা আপি এবার আমার দিকে খেয়াল করে বললেন, এই মেয়েটার নাম কি?

এতক্ষণে আমার দিকে নজর পড়ল মুক্তোর। মুক্তো বলল, সত্যি তো আমি এটা ভেবে দেখিনি। এই মেয়েটার নাম কি হতে পারে? ওর তো কিছু মনেই নেই।
সুবর্ণা আপি বলল, ওকে বরং তুই একটা নাম দে। সেই নামেই নাহয় ওকে ডাকব আমরা।
আমি ওর কি নাম দেব? ওকে দেখে আমার একটা নামই মনে পড়ে দিশা। কারণ ওর জীবনের কোন দিশা নেই। তাহলে আজ থেকে ওকে এই নামেই ডাকব।
দিশা হুম অনেক সুন্দর নাম। ওর সাথে মানিয়েও ছে।

আমাকে রেখে চলে গেছে মুক্তো। আমার মনটা ভাড়ি খারাপ হয়ে গেল। সুবর্ণা আপি আমার কক্ষে আসল। আমাকে বলল, এই মেয়ে তাড়াতাড়ি খেতে চলে আয়। খেয়ে বাড়ির সব কাজ করবি কিন্তু। তোকে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না।
সুবর্ণা আপির ব্যবহার খুব খারাপ লাগল আমার। মুক্তোর সামনে তো ভালো ব্যবহার করল। আর সে যেতেই কিরকম ব্যবহার শুরু করল। আমি যেহেতু এখানে আশ্রিতা হিসেবে আছি তাই তার কথা শুনতে বাধ্য। মন খারাপ নিয়েই খেতে বসলাম।

আমার সামনে সুবর্ণা আপি পোলাও, মুরগীর মাংস সহ কত সুন্দর সুন্দর খাবার খেলো। আর আমাকে খেতে দিয়েছে ভাত আর ডাল। আমি শুকনো মুখ নিয়ে তাই খেলাম।
সুবর্ণা আপি নাকি অনাথ ছিল। মামা-মামির অত্যাচারে মানুষ হয়েছে। তাহলে সে এমন কেন? তার তো কষ্ট বোঝা উচিৎ। আমি যতদূর বুঝলাম তার নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের কারণে সে এমন হয়েছে। এমন অনেক মানুষ আছে পৃথিবীতে যাদের সাথে ঘটা অন্যায়ের কারণে তারা সাইকো হয়ে যায়। নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের জন্য নির্দোষ মানুষদের উপর শোধ তোলে। এভাবে তারা ভাবে তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের শোধ তুলছে। এটা একটি ভয়ানক মানসিক ব্যাধি।

যাইহোক খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আমাকে সব কিছু পরিস্কার করতে হলো৷ সুবর্ণা আপি আমাকে দিয়ে বাড়ির প্রায় সকল কাজই করিয়ে নিলেন। আমার খারাপ লাগলেও নিজেকে বোঝালাম এখন আমার নিজের জন্য হলেও এসব করতে হবে।
সুবর্ণা আপি একটু পরেই হাসপাতালে চলে গেল। আমি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সুবর্ণা আপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই এমন কিছু আমার চোখে পড়ল যা আমার পুরো ধারণা বদলে দিল। আমি বুঝতে পারলাম সুবর্ণা আপি কেন এমন ব্যবহার করল আমার সাথে।

আমি সুবর্ণা আপির ডাইরি ঘেটে দেখলাম। সেখানে সে তার নিজের সাথে হওয়া সকল অন্যায়ের কথা লিখেছে। তার মামা-মামি তার উপর অকথ্য অত্যাচার চালাতো। এগুলো পড়ে আমার স্মৃতিতেও আফসা আফসা কিছু ভেসে ওঠে। তাহলে আমার সাথেও এমন কিছু হয়েছিল? আমি মনে করার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। তবে এতটুকু আমি বুঝতে পেরেছি যে সুবর্ণা আপি স্বাভাবিক নয়।

মন দিতে চাই পর্ব ৯

আমার উপর অত্যাচার করে তার নিজের প্রতি হওয়া অত্যাচারের শোধ তুলছেন তিনি। আমি ভাবলাম এখানে থাকা আমার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই যে করেই হোক এখান থেকে চলে যেতে হবে। এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল। আমি গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম মুক্তো এসেছে। আমি কোন কিছু না ভেবে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। এক এক করে তাকে সব ঘটনা বললাম। সব শুনে মুক্তো বলল, আপনাকে এখানে থাকতে হবে না। আমি আপনাকে নিজের সাথে নিয়ে যাবো।

মন দিতে চাই পর্ব ১১