মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯
ফাবিয়াহ্ মমো

চোখেমুখে হিং:স্র প্রতাপ। চোখের কোটর শক্ত। পলকহীন চোখদুটো স্ক্রিনের দিকে নিবদ্ধ। নিকোটিন ফুঁকা ঠোঁটদুটো ফাঁক হয়ে আছে। মোহিত দৃষ্টিতে অবাক ভঙ্গিতে বুক ফুলিয়ে যাচ্ছে। মনে বাজছে সুর, কানে চলছে তাল, ঠোঁটে আসছে সাড়া। এমন রমনীর মূর্তি যেনো কল্পনায় ভাবা চিত্র। যার সৌন্দর্যের কাছে চোখ পরলে রবীন্দ্র সংগীত বাজে, হৃদয়কুঠিতে উচাটন করে, কোথাও যেনো মৃদ্যু-মৃদ্যু ধাক্কার অনুভব হয়। ল্যাপটপের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ভদ্রলোক,

– এটাই আনসারীর বউ? মেয়েটা মেহনূর আফরিন?
ভাইয়ের কথামতো স্ক্রিনে তাকালো রজনী। সম্মতি জানিয়ে মৃদ্যুস্বরে বললো,
– জ্বী ভাইজান। মেয়েটা মাহতিমের বউ। আপনাকে দেখানোর অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু, আপনিতো কাজের ব্যস্ততায় দেখলেন না। এটাকে কিছু করুন ভাইজান। এই কেস যদি আপনি হ্যান্ডেল করেন, তাহলে আমি চিন্তামুক্ত থাকতাম।
রাত দশটা। জায়গাটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নরম সোফায় পাশাপাশি বসে আছে দুজন। রজনী নিজের পার্সনাল ল্যাপটপ এনে বড়ভাইকে পুরো ঘটনা খুলে বললো। সেই রহস্যময় ট্যুর, সেই কক্সবাজারের সমুদ্রতীর, সেই বালুর কাছে সকলের হাসি-হাসি মুখের ছবি, মাহদির শেষ স্মৃতি, মেহনূরের গোটা পরিচয়, সব একনিমেষে বিবৃতি করলো সে। মেহনূরকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতেই কোমরে চোখ পরলো ভদ্রলোকের। সেখানে খুবই কর্তৃত্বের সাথে হাত রেখেছে মাহতিম আনসারী। সদাসর্বদা যার মুখ গম্ভীর হয়ে থাকতো, একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব দেহসৌষ্ঠব্যে ফুটে উঠতো, এই ছবিতে সেই মুখটা হাসি দিয়ে আছে। একটা সরস ভাবের প্রাণপূর্ণ চাহনি ঠিক নব্য-প্রেমের আশ্বাস দিচ্ছে। আবার মেহনূরের দিকে দৃষ্টি রেখে থুতনি চুলকে বললো,

– মেয়েটার নাম সুন্দর। দেখতেও গেঁয়ো লাগে না। টার্গেট কি একটাই? নাকি উদ্দেশ্য অন্য কিছু আছে?
খুবই রোষের সাথে নিশ্বাস ফেললো রজনী। একের-পর-এক ব্যর্থ প্রচেষ্টার ঘটনা উল্লেখ করে বললো,
– উদ্দেশ্য একটাই ভাইজান। ওকে মে::রে ফেলা। যদি অনাকে বিয়ে করতো, তাহলে কোনো টেনশনই ছিলো না। আনসারী খুব ভোগাচ্ছে ভাইজান। আমি বাজেভাবে হেরে গিয়েছি। ব্যর্থ হতে-হতে আমার ধৈর্য্য এখন তলায় জমে গেছে। আর পারা যায় না। যতবার ধরার জন্য ফাঁদ পেতেছি, আনসারী ততবারই আমাকে তছনছ করে দিয়েছে। দুটো বছর আমাকে যন্ত্রণা দিয়েছে ভাইজান। না পেরেছি বলতে, না পেরেছি ধরতে। যতবার ওকে য:ন্ত্রণার মুখে ফেলতে চাইতাম, কোনো-না-কোনো বাধা আসতোই। আমি সহ্য করতে পারছি না।

রজনীর কথাটা শোনার পর ভ্রুঁ কুঁচকালো সে। বোনের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি ছুঁড়ে গম্ভীর গলায় বললো,
– কি ধরনের বাঁধা? এমপির সম্মান পেয়েছো রজু। পুরো তোমাকে পার্টি নমঃ নমঃ করে। সেখানে ব্যর্থ হচ্ছো কেন? সমস্যাটা কোথায়?
দাঁত শক্ত করে চোখ বুজলো রজনী। ব্যর্থতার আগুন, অপ্রকাশ্য জ্বালাটা খুব কষ্টে গলাধঃকরণ করলো। পুনরায় চোখ খুলে সংযত গলায় আসল ঘটনা বললো,

– আমাকে বারবার গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কি হচ্ছে সেটা আমি জানি না ভাইজান। মেহনূরের উপর লোক ফিট করেছিলাম। প্রোফেশনাল গ্যাংয়ের সাতজন সদস্য মহিমপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলো। পরিকল্পনা মোতাবেক ওরাও আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, পৌঁছে গেছে। এরপর যেটা হলো, সেটা আমি ভাবতেও পারিনি ভাইজান। যাদের হায়ার করেছিলাম, তাদের লা::শ তো দূরে থাক, সাতটা জী:ব:ন্ত মানুষের অস্তিত্বই মুছে গেছে।

তদন্তের জন্য চার সদস্যের টিম পাঠাই, ওরাও কোনো সুরাহা করতে পারেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ওই মোল্লাবাড়িতে কোনো পুরুষমানুষ থাকে না। ওদের ফোনকল পযর্ন্ত চেক করে দেখেছি। কোনোভাবেই আনসারীর সাথে সম্পৃক্ততা পাইনি। ও দেশের বাইরে গিয়ে ওই বাড়িতে খোঁজ নিতো না। মেহনূরের সাথে সম্পর্ক বলতে গেলে নষ্ট ছিলো। মেহনূরও নিজ থেকে যোগাযোগ করতো না। এর মধ্যে লোক পাঠালে কেউ ফেরত আসতো না।

আমি নোমান ইকবালের উপরও কড়া নজর রেখেছি। ওরও কোনো সন্দেহজনক ব্যাপার ধরা পরেনি। মাহতিম দেশের বাইরে যে কাজে গিয়েছিলো, ও সেকাজেই ব্যস্ত ছিলো। তাহলে আমার এখানে প্রশ্ন হলো, মেহনূরের উপর কিছু হচ্ছে না কেনো? যদি মাহতিম ওকে না বাঁচায়, তাহলে ওকে বাঁ:চাচ্ছে কে? কে ওর প্রতি সহায় হচ্ছে? কে আমার চালগুলো ভেঙ্গে দিচ্ছে ভাইজান? আপনিই বলুন কেন এমনটা হচ্ছে?

ঘরে মোমের আলো। কাঠের দরজাটা বন্ধ। বাইরে বৃষ্টি কমেছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে মিষ্টি গন্ধ ছেড়েছে। কালো চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে আছে মাহতিম। সম্পূর্ণ ভর মেহনূরের উপর ছেড়ে মুখের দিকে ঝুঁকে আছে। ডানগালটা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে একটুখানি হাসলো সে। বাঁহাতে গলার ওড়নাটা মুঠোয় ধরলো মাহতিম। মেহনূর চোখ নিচু করে চুপচাপ কীর্তিটা দেখতে লাগলো। খুব সন্তর্পণে ওড়নাটা টেনে-টেনে গলামুক্ত করলো।

শয্যাশায়িনী মেহনূর নিরবে-নিভৃতে সমস্ত কিছু অবলোকন করতেই নির্ভীক মানুষটা বাঁ-কাধের মাঝে ডুবে গেলো। হৃদয়ের আলিঙ্গনটুকু পূর্ণ করার জন্য থুতনিটা রাখলো মেহনূরের কাধের হাড্ডিতে, গালটা মিলিয়ে দিলো কানের সাথে। পিঠের নিচে দুই হাত গলিয়ে মেহনূরকে বুকের সাথে চেপে ধরলো। এ যেনো আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে ধরা শক্ত বাহুবন্ধন। শক্ত বাহুবন্ধনের সুংকুচিত চাপে নিশ্বাসটা আঁটকে এলো মেহনূরের। তবুও কোনোমতে নাক ফুলিয়ে শ্বাসটুকু ছাড়লো সে। বাঁ-কাধের কাছে লুকানো মুখটা ফিসফিস করে বললো,

– যদি বলি যোগাযোগ বন্ধ রাখার পেছনে কারণ আছে, তাহলে কি তুমি বিশ্বাস করবে?
সিলিংয়ের দিকে তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি রাখলো মেহনূর। বিদ্যুৎহীন ফ্যানটা স্থির। রুমে পর্যাপ্ত আলো নেই।সম্পূর্ণ কথাটা শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
– কি কারণ?
প্রশ্নটা করার সাথে-সাথে দম আঁটকালো মেহনূর। বাহুবন্ধনের সুদৃঢ় চাপে শক্ত রইলো সে। প্রাণচঞ্চল করা অনুভূতিতে জীর্ণ থাকতেই কানে প্রখর সান্নিধ্যের সাথে চুমু খেলো। কিছুক্ষণের ভেতর বাহুজোড়া শিথিল করে মুখ তুললো মাহতিম। চোখে চোখ রেখে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

– তোমার কি মনেহয় আমি বোকা? ওইরকম সামান্য ঘটনার জন্য কেউ যোগাযোগ বন্ধ করবে? আমি বিনা কারণে কাজটা করিনি। তুমি যেই গাড়িতে যাওয়ার জন্য চড়েছিলে, ওই গাড়িই আমি তছনছ করে দিতাম, তবুও তোমাকে যেতে দিতাম না মেহনূর। দরকার পরলে তোমার হাত-পা বেঁধেই হোক, আমার বাড়ি থেকে একপা-ও নড়তে দিতাম না। এ নিয়ে মামলা-টামলা খেলে খেতাম, ভয় নেই। আমার বউ ভুল বুঝে চলে যাচ্ছে, এটা আমি মেনে নেবো? আমার ইচ্ছা ছাড়া, আমার অনুমতি ছাড়া সামান্য ঘটনার রেশ ধরে তুমি চলে যাবে, আর আমিও বসে-বসে তামাশা দেখবো, এটা বাংলা নাটক না মেহনূর। যদি তোমার ক্ষ:তির আশঙ্কা না থাকতো, আমি মহিমপুর আসাটাই ব্যর্থ করে ছাড়তাম।

কথার ভঙ্গিতে ক্ষুদ্ধ অবস্থা ফুটে উঠেছে মাহতিমের। বাক্যের-পর-বাক্য যেনো চাপা ক্ষোভের প্রকাশ। ইচ্ছাবিরুদ্ধ কাজটা যেন ঘাতের মতো বাজিয়েছে, সেটা চোখের দৃষ্টি, মুখের ভঙ্গি সবকিছুতে দৃশ্যমান। মেহনূর চুপ থাকার পরিকল্পনায় ছিলো, কিন্তু মনের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্নের ঘূর্ণিপাকে চুপ থাকতে পারলো না। সোজা কাট-কাট ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো সে,
– আপনি কিছুই খুলে বলছেন না। সব জায়গায় ‘ কিন্তু ‘ লাগিয়ে কথা শেষ করছেন। আমি জানতে চাই, কেন আপনি আমার সাথে যোগাযোগ রাখলেন না। আপনার এমন কঠিন পদক্ষেপের পেছনে শক্ত কারণ কি ছিলো। কেন আপনি আমার সাথে এমন আচরণ করলেন। যেখানে আপনার বিভিন্ন ক্ষমতার কথা শুনি, সেখানে ওই ক্ষমতা কেন ব্যবহার করলেন না। আপনার এসব কাজের পেছনে বারবার কেন আমাকে ঠেলে দিলেন?

প্রশ্নবাণে নির‍্যুত্তর রইলো মাহতিম। নয়নমন একীভূত করে ম্লা:ন ঠোঁটে হাসলো। বুক ভারী নিশ্বাসটা আস্তে করে ছেড়ে নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,
– মা গেলে তো মা আসে না, বউ ঠিকই আসে। কিন্তু, আমার ক্ষেত্রে, বউ গেলে তো তুমি আসবে না। উলটো আমার ভালোবাসাই চলে যাবে।

ঘটনার শুরওয়াত সেই রাতের দিকে। বাড়িটা তখন সৌভিকের বিয়েতে পূর্ণ। সবখানে রমারমা আনন্দ। মেহনূর রুমে নেই। কাজের জন্য নিচে ছিলো। খুব স্বাভাবিকভাবে রাত দশটার দিকে কল আসে। মাহতিম সেটা রিসিভও করে। কিন্তু সে জানতো না, ওই একটি কলই সবকিছু বিগড়াতে প্রস্তুত। পাক্কা কয়েক মিনিট স্তব্ধ ছিলো মাহতিম। নিজের উপরই বিশ্বাস হচ্ছিলো না, সত্যিই ডাক এসেছে। ডাইরেক্ট গর্ভঃমেন্ট থেকে সুপারিশ নিয়ে অফিশিয়াল লেটার পৌঁছেছে। এতো তাড়াতাড়ি এই সুযোগ আসলো কেন? কেন আসলো? মনে-প্রাণে শুধু দেরির জন্য আবদার করতো।

অন্তত মেহনূরের জন্য সবকিছু বন্দোবস্ত করে তারপর যেতে চাইতো। এই মূহুর্তে কিভাবে কি দেখবে? সৌভিকের বিয়ে, মায়ের চিকিৎসা, মেহনূরের নিরাপত্তা, এসব কি সম্ভব? রাগের চোটে ঠোঁট কুঁচকে ফোন ছুঁড়ে মারলো। ভাগ্য পরিহাসে ক্ষুদ্ধ হয়ে ফুঁসতে থাকলো মাহতিম। তখন সে জানতো না, দরজার বাইরে আরো দুজন ব্যক্তি চুপচাপ সব দেখছে। সেই দুজন ব্যক্তি আর কেউ না, তৌফ ও ফারিন ছিলো। এই ঘটনা মুখ ফুটে কাউকে বলেনি মাহতিম। যদিও তৌফ-ফারিন ভুলবশত রাগের তেজটা দেখেছে, তবে আসল ঘটনা জানতে পারেনি কেউই।

বিদেশি ইম্পোর্ট বোতলটা বের করলো ভদ্রলোক। গ্লাসের কাছে বোতল কাত করে ঢকঢক করে পানীয় ঢাললো। চ্যাপ্টা বোতলটা বন্ধ করে আদেশের সুরে বললো,
– গ্লাসটা নাও রজু। মেজাজটা ঠান্ডা করো। আমি গরম মেজাজের কথাবার্তা সহ্য করি না।
কাঁচের টেবিলে বিয়ারপূর্ণ গ্লাসের দিকে নজর দিলো রজনী। বড়ভাইয়ের আদেশটা মান্য করে ডানহাত বাড়িয়ে দিলো। গ্লাস তুলে ঠোঁটের কাছে নিতেই তপ্ত গলায় বললো,

– আমার কথাগুলো শোনার পর কি মনেহচ্ছে ভাইজান? ঘাপলা কি আছে না?
খুবই গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো ভদ্রলোক,
– আছে। না থাকলে হেরে যেতে না। তোমাকে গুল খাইয়েছে রজু। তুমি এখনো ছেলেটাকে শক্তভাবে নিলে না। ওর দূরদর্শি চিন্তাভাবনা ধরতে পেরেছো? তুমি পারোনি। ও দেশ থেকে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সব পাকাপোক্ত করে গিয়েছে। তোমার ফাঁদে তোমাকেই ডুবিয়ে গেছে রজু। ও মেহনূর আফরিনের সাথে সম্পর্ক ন:ষ্ট করেনি। শুধু একটা ধা:প্পাবা:জি করেছে!

চুমুক দিতে গিয়ে চকিত হলো রজনী। পানীয়টা গলা আঁটকে গেলে খুক-খুক করে কেশে উঠলো। চোখ কুঁচকে কাশতে-কাশতে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– আপনি কিভাবে নিশ্চিত ভাইজান? আমি নিজে দেখেছি সবকিছু নষ্ট। মাহতিম যে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখেনি, এটাও ওর কললিস্ট বলে দিচ্ছে।
সরু চোখে তাকালো ভদ্রলোক। বাঁ ভ্রুঁ-টা উপরে তুলে বিজ্ঞের মতো বললো,

– মানুষের মাথাটা একশো কম্পিউটারের সমান। বাকিটা বুঝা উচিত রজু। আনসারীর মাথাটা খুবই শার্প। ওর চিন্তাগুলো কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকে। ও এখানে বসেই বলে দিতে পারবে, ঠিক কত পা এগুলে ওই দরজা পযর্ন্ত যাওয়া সম্ভব। ওর পর্যবেক্ষণ শক্তি নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ওর অনুমানের সত্যতা বহুবার প্রমাণ পেয়েছি। আমি নিশ্চিত, ও নিজের পিঠ-পেছনে এমন কাউকে রেখে গিয়েছে, যেকিনা সবকিছু আড়ালে-আড়ালে দেখে রাখতো। খুব মাথা খাটিয়েছে রজু। স্বাভাবিক ভাবে দেখলে কেউই বুঝতে পারবে না।

প্রশ্ন উদ্রেক চাহনিতে তাকিয়ে আছে রজনী। ভাইয়ের কথার মর্মটা বুঝতে পারেনি। আড়ালে-আড়ালে দেখতো মানে? মাহতিমের পরিচিত বলতে যারা আছে, তারা কেউই মাহতিমের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করতো না। এমনকি খাস বন্ধু সৌভিকের সাথেও মেহনূরকে নিয়ে তর্ক হয়েছে। তার ফলাফল হিসেবে দুই বন্ধুর মধ্যে যোগাযোগ নেই। মাহতিমকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করবে ওমন পুরুষ কোথায়? বাইরে থেকে কে মাহতিমকে সাহায্য করছে? যেহেতু সাহায্য করছে, তারমানে ওই ব্যক্তি নিজেও পাওয়ারফুল। নাহলে মাহতিমের সাথে কানেক্ট হবার চান্স শূন্য বটে। এখানে ঘটনার তদুপরি সত্য তাহলে কি? কি দাঁড়াচ্ছে সবকিছুর পেছনে? ভাইজান কিভাবে মাহতিমের চালবাজি বুঝছে?

বিছানায় উঠে বসলো মাহতিম। পা-দুটো ফ্লোরে রেখে বাঁয়ে মুখ ফেরালো। এখনো বিছানায় শুয়ে আছে মেহনূর। পাশের টেবিল থেকে মোমের আলোটা মুখের উপর পরেছে। আরো নরম, আরো স্নিগ্ধ লাগছে। মাহতিম মৃদ্যু হেসে ওর দিকে বাঁহাত বাড়িয়ে দিলো। ‘ না ‘ সূচকে মাথা নেড়ে আবদার সুরে বললো,
– তোমাকে এই পোশাকে দেখতে চাই না। হাতটা ধরে উঠো,

হাতের দিকে একনজর তাকালো মেহনূর। আপনমনে কিছু একটা চিন্তা করে ওই হাতে হাত রাখলো। শক্ত হাতে ভর দিয়ে শয্যা থেকে উঠলো। মেহনূর যখন বিছানা থেকে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, তখন হাত ছেড়ে আলমারির পাশে হাঁটু গুটালো মাহতিম। লাগেজ খুলে ভাঁজকৃত শার্টের তলায় হাত ঢুকালো সে। দূর থেকে বসে-বসে দেখে যাচ্ছে মেহনূর। এই লাগেজটা কখন এই ঘরে এনেছে, সেটা সম্পর্কে জানে না। মেহনূর যখন চায়ের জন্য নিচে নামে, সম্ভবত তখনই লাগেজটা রেখে গেছে। নিজের শার্টের নিচ থেকে প্যাকেট বের করলো মাহতিম।

মৃদ্যু-মৃদ্যু আলোয় দেখা যাচ্ছে, ওটা একটা সুতির শাড়ি। রঙটা হালকা আকাশী। প্যাকেটটা খুলে ফেলে সামনে আসলো মাহতিম। দুহাতে শাড়ি নিয়ে ইতস্তত চোখে তাকালো। যদি বলে ‘ আমি এটা পরবো না ‘? যদি এই প্রকাশ্যভঙ্গির ছোট্ট ভালোবাসাটা ফিরিয়ে দেয়? যদি শাড়ির ভাঁজটা না খুলে? ফিরিয়ে দিলেও মেহনূরের দোষ নেই। সত্যিই কোনো দোষ নেই। কিন্তু, মন তো ভেঙ্গে যাবে। মুখে দ্বিধা, চোখে সংশয়, ঠোঁট নড়াচড়া করছে, কিন্তু বলতে পারছেনা কিছুই। মেহনূর মুখ তুলে নিরীক্ষা চালিয়ে শান্তসুরে বললো,

– আপনাকে একটা শেষ প্রশ্ন করবো। যদি যথাযথ উত্তর দেন, তো পুরোনো রূপে আপনার সামনে ফিরবো। যদি আপনার কথায় একটুও মিথ্যে পাই, তাহলে আজকের পর জীবনেও আমাকে খুঁজে পাবেন না।
চোয়াল শক্ত করলো মাহতিম। নাক ফুলিয়ে অদম্য নিশ্বাস ছেড়ে প্রত্যয়ের সুরে বললো,
– বলো,
কঠিন প্রশ্নটা করার জন্য প্রস্তুতি নিলো মেহনূর। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে,
– আপনার কি মনেহয় মাহদি আমার জন্য চলে গেছে?

শাড়িটা নিচে নামালো মাহতিম। মেহনূরের দিকে একনিষ্ঠ চাহনিতে অটল থেকে দাম্ভিকতার সুরে বললো,
– জটিল প্রশ্নের জন্য বানোয়াট উত্তর দেবো না। সত্যই সই। আমার ভাইয়ের জন্য যদি তুমি দায়ী থাকতে আমাকে এই রূপে দেখতে পেতে না। তোমার যে কি অবস্থা করতাম, সেটা আপাতত বলতে চাই না। তুমি আমার কি হও, না-হও; সব বাদ! আজন্মের জন্য ধি:ক্কা:র জানিয়ে তোমাকে টু:ক:রো করে ফেলতাম।

আজ তুমি আমাকে এখানে দেখছো, তোমার সামনে আমি কাঙালের মতো দাঁড়িয়ে আছি, এইভাবে কক্ষনো দেখতে না মেহনূর। তোমার কাছে তোমার মাহতিমের মতো আচরণ করি, যার আচরণ দেখে তুমি অভ্যস্ত আছো। আমার ওই ডে:ড-হ্যা:ল রূপ তোমাকে কোনোদিন দেখাইনি। আগামীতেও দেখাবো না। এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই সোজা গাড়িতে উঠেছি, কোনোদিক তাকাইনি। তেরোটা ঘন্টা একটানা ড্রাইভ করেছি, কোথাও থামিনি, কোথাও ঘুমাইনি, শুধু চালিয়েই গিয়েছি, চালিয়েই গিয়েছি, এসব পাগলামি কার জন্য করেছি? তোমার জন্য।

আমার বউ এখানে পরে আছে, একমাত্র সেই চিন্তা ঘুরঘুর করতো। আমি কোনো খু:নি:র প্রতি মায়া-দয়া দেখাতে আসিনি। আমার যেই অধিকার আমি দু’বছর আগে যেতে দিয়েছি, সেই অধিকার আমার কাছে ফিরিয়ে নিতে এসেছি। আমার সম্পদে কারো হস্তক্ষেপ পরতে দেইনি। কোনো চেয়ারম্যান কুলা:ঙ্গারকে ভ:দ্রভাবে ছা:ড়িনি। কোনো জামিল নামের হা:রা:মিকে মা:ফও করিনি। তুমি দুই বছর আগেও আমার বউ ছিলে, এখনো আমার বউই আছো। তোমাকে দূরে রেখেছি, কোনো বিচ্ছেদ করিনি। তুমি আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেখানে ছেদ করলে আমার অর্ধেক সত্ত্বাই হারিয়ে যাবে। এমন বোকামো তো জীবনেও করবো না।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৮

কথা শেষ করে বিছানায় শাড়ি ফেললো মাহতিম। মুখ ফিরিয়ে পা ঘুরিয়ে দরজার দিকে চললো। ছিটকিনিটা যেভাবে লাগিয়েছিলো, সেটা এখন চট করে নামিয়ে দিলো। দরজার দুই দ্বার ধরে খুলে ফেলতেই মুখটা বাঁকাধের কাছে আনলো। সংযত বাক্যে ঠান্ডাভঙ্গিতে বললো,
– যদি আমার কথা বিশ্বাস হয়, ওটা পরে এসো। সারারাত রুমের দরজা খোলা রাখবো। যদি মিথ্যার আভাস পাও, তবে মোমের আগুনে জ্বা:লিয়ে দিও। আর আসা লাগবে না। তোমার শাড়ি পোড়া গন্ধেই আমি বুঝে যাব, তুমি কি চাচ্ছো।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯ শেষ অংশ