মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯ শেষ অংশ

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯ শেষ অংশ
ফাবিয়াহ্ মমো

অপেক্ষা করছে মাহতিম। নির্ভীক মনটা বেসামাল। অবিচল চিন্তায় উতলা। বাইরের অবস্থা যতই শান্ত দেখাক, সে শান্ত নেই। মনটা অসংখ্য চিন্তায় ডুবে আছে। বারবার চোখদুটো দরজার দিকে যাচ্ছে। কখন অন্ধকার দরজা ঠেলে আকাঙ্ক্ষী শিখাটা জ্বলবে। কখন পদশব্দের মৃদ্যু-মৃদ্যু আওয়াজে বুকটা ভারী হবে। কখন অপেক্ষা কাটিয়ে আসবে মেহনূর।

শাড়ি জড়িয়ে লজ্জাবতীর ন্যায় হাজির হবে। ওর ছোট্ট মুখটা অনেকক্ষণ ধরে কখন আদর করবে। লজ্জা রাঙ্গা মুখটা বুকে টেনে নিবে। আর কতো অপেক্ষা? ধৈর্য্য যে কুলোচ্ছে না। সময়ের কাটা ঘুরতে-ঘুরতে পন্ঞ্চাশ মিনিট চলে গেছে, এখনো তো আসলো না। সে কি আসবে না? অপেক্ষায় কাতর চোখদুটো বন্ধ করলো মাহতিম। শেষ ধৈর্য্যটা রাখার জন্য মনে-মনে বললো, ও আসবে, হাল ছাড়িস না। বিছানায় শুয়ে আছে মাহতিম। চোখের উপর হাত ফেলে সময় গুণছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেহনূর যেনো আসুক মনে-প্রাণে চাচ্ছে। এবার এলে কোথাও যেতে দিবে না। একদম সিন্দুকের মতো রেখে দিবে। একটু করে আদর দিবে, একটুখানি রাগ দেখাবে। শাষনের বেলায় কড়া হবে, দিনশেষে কাছেই রাখবে। অনেক সহ্য করেছে মেয়েটা। এবার একটু কাছে রাখা দরকার। সুগভীর ছায়াতলে ভীষণভাবে যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। আদরে-সোহাগে সবটুকু উজাড় করে ভালোবাসা দরকার। রুমটা অন্ধকার। আলো জ্বালায়নি মাহতিম। একমাত্র আলোটা দরজা দিয়ে ঢুকুক। সবটুকু অন্ধকার পরিষ্কার করে দিক। অপেক্ষার যন্ত্রণা নিপাত যাক। মাহতিম ব্যকুল হয়ে আপনমনে বললো,

– একবার আসো বউ। শাড়িটা পুড়িয়ে দিও না।
চোখ থেকে হাত সরালো মাহতিম। আবার দরজার দিকে চাইলো। খোলা দরজায় কেউ নেই। কোনো পদশব্দ নেই। অধীর নেত্রে তাকিয়ে রইলো মাহতিম। অসহায়ের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যদি মেহনূর না আসে, যদি শাড়িটা পুড়িয়ে দেয়, তাহলে আজকের পর আর আসবে না। চিরদিনের জন্য মোল্লাবাড়িকে ছেড়ে দিবে। এমনভাবে সরে যাবে, যেনো কখনো ছিলো না সে। কষ্ট হবে, দুঃখ লাগবে, মনটা খুব ভেঙ্গে যাবে, তবুও মেয়েটা খুশি থাকুক। এটুকু যন্ত্রণা যদি মেহনূরকে স্বস্তি দেয়, তবে আক্ষেপ নেই। কিন্তু আফসোস, ওই মনের মধ্যে আর কাউকে জায়গা দিতে পারবে না।

সেটা কোনোদিন সম্ভব না। ওই সম্মানীয় স্থানটা স্রেফ ভালোবাসার চিহ্ন। এটা অকাট্য দলিল, অমূল্য প্রমাণ, একমাত্র সাক্ষ্য যে, সেও পাগলের মতো ভালোবেসেছিলো। নিঃস্ব, শূন্য, ভঙ্গুর মনটা কারো কাছে আমানতের মতো রেখেছিলো। তবে দোষ এটুকুই, আমানত তুলে দেওয়ার পর খোঁজ নেয়নি। দিনের-পর-দিন নিখোঁজ থাকার সংবাদে তার উপর গাদ জমেছে। বুঝতেও পারেনি, ভাবতেও পারেনি, গাদের পাতলা প্রলেপটা একটু-একটু করে মোটা হচ্ছে। আজ সেই প্রলেপটা শক্ত দেয়ালে পরিণত।

সেটা উঠানোর পন্থা, সারানোর টোটকা তারও জানা নেই। দীর্ঘসময় এমন চিন্তা নিয়ে ডুবে থাকতেই নাকে জোরালো গন্ধ পেলো। একবার-দুইবার শান্তভাবে দম নিলো। চট করে চোখ খুললো মাহতিম। ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসলো। তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় শক্তি পুরোপুরি সজাগ! পোড়া গন্ধটা সত্যি-সত্যিই পাচ্ছে। অন্ধকারে আরো একবার নিজেকে স্থির রাখলো। এটা কি ভ্রম, নাকি সত্য, সেটা বুঝার জন্য শান্ত রইলো। যতবার বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে, ততবার পোড়া গন্ধটা নাসাপথে ঢুকছে।

ক্রমাগত জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতেই একলাফে বিছানা থেকে নামলো। না, মেহনূর করবে না। নিশ্চয়ই গন্ধটা বাইরে থেকে আসছে। নিজের মিথ্যা অনুমানকে সাঙ্গ করে জানালা খুললো মাহতিম। ইতিমধ্যে মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেছে। অস্থিরভাবে ডানে-বামে চোখ ঘুরালো মাহতিম। নির্ঘাত খড়কুটো পুড়াচ্ছে। কিন্তু না, কোথাও কোনো খড়কুটো নেই। বাইরে কোনো আগুন নেই। মাহতিম একবুক হতাশা নিয়ে জানালা থেকে সরে এলো। হতভম্বের মতো পা চালিয়ে বিছানার কাছে আসলো। অন্ধকারে অসতর্কভাবে হাঁটার জন্য পায়ে উষ্টাঘাত খেলো। প্রচণ্ড ব্যথায় চোখটা কুঁঁচকে যেতো, কিন্তু মাহতিম পাত্তাই দিলো না। ধপ্ করে বিছানায় বসে পরলো, অথচ পায়ের প্রতি খেয়াল রইলো না।

সুজলার নির্দেশে কেউ ঘর থেকে বেরোয়নি। সবাই যার-যার খাবার নিয়ে নিজেদের ঘরে ঢুকেছে। ইতিমধ্যে সাবা ও সুরাইয়া বাদে সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। সুজলা ইচ্ছে করে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে গেছেন। তিনি সবকিছু সময়ের হালে ছেড়ে দিয়েছেন। যদি সবকিছু স্বাভাবিক হয়, তাতে দুজনের মঙ্গল। যদি মেহনূর অটল থাকে, তবে মাহতিম কি করবে, তিনি জানেন না। কিন্তু মন গলানোর মতো অদ্ভুত আকর্ষণ মাহতিমের আছে।

অন্তত, একটা গুণের কারণে দশটা মানুষকে বাজাতে পারে। ওর যুক্তি, ওর কথা, ওর দূরদর্শি চিন্তাভাবনা বেশ আশ্চর্যজনক! কথাবার্তায় নিশ্চয়ই চুম্বকের মতো একটা ব্যাপার আছে। নাহলে মানুষ ওর কথা শুনতে বাধ্য হয় কেন? প্রতিটি কথা বেশ মাপযোগ করে বলে। সেখানে বাড়তি কথার রেশ থাকে না। বাক্যের-পর-বাক্য যেনো সততার সাথে ফুটে উঠে। মিথ্যের ছোঁয়া থাকে না। এবারও সুজলা সব কথা শুনেছেন। মাহতিমের প্রতিটি কথা বর্ণনার সাথে শুনেছেন। একটি ঘটনা শোনার পর আশ্চর্য না-হয়ে পারেননি।

যে দু’বছর দেশের বাইরে ছিলো, ওসময় দেশে নির্বাচনী হাওয়া গেছে। দেশের পরিস্থিতি কি ছিলো, বলার মতো না। ওমন বীভৎস পরিবেশে সবকিছু সামাল দেওয়াটা সোজা কথা না। তাঁরও মনে রজনীর মতো প্রশ্ন বুনেছে। এভাবে বাজির উপর বাজি খেলাটা সহজ কর্ম না। তাও রাজনীতিতে চাল ফেলাটা সাংঘাতিক কিছু। মাহতিম যেখানে প:লি:টি:ক্স করে না, সেখানে প:লিটি:ক্সে:র হম্বিতম্বি বুঝলো কি করে? এটা কি আশ্চর্যের ব্যাপার না?

মৃত্যুর কাছে পরাজিত সৈন্য যেমন নিরুত্তাপ ভাবে তাকায়, চক্ষু ধীরে-ধীরে মুদিয়ে ফেলে, দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ক্ষীণ শ্বাসটুকু ছাড়ে, তেমনি সশব্দে দম ছাড়লো মাহতিম। নিজের সমস্ত অনুভূতি আবদ্ধ করার জন্য নিচের ঠোঁটে দাঁত চাপলো। সুদীর্ঘ শ্বাসটা নিতেই অতিকষ্টে ঢোক গিললো। খুব চেষ্টায় ছিলো চোখদুটো শুষ্ক থাকুক। থাকলো না। ভেতরের যন্ত্রণাগুলো কোনোভাবেই ক্ষান্ত দিলো না। বহুদিন পর গভীর-শান্ত চোখদুটো ভিজে এলো। চক্ষুপল্লব বেয়ে নিভৃতে দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরলো। বদ্ধ চোখের পাতায় তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুল চাপলো মাহতিম। পকেট থেকে ফোন বের করলো। দ্রুত অবসাদগ্রস্ত অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কল বসালো সে। কয়েকটা টিউন যেতেই রিসিভ হলো কলটা। ওপাশ থেকে স্বাভাবিক কন্ঠে সাড়া দিয়ে বললো,

– হ্যালো,
নির‍্যুত্তর রইলো মাহতিম। কোনো কথাই বলতে পারলো না। অনেক চেষ্টা করলো, একটা শব্দও বেরুলো না। ওপাশের ব্যক্তি এবার ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো। বিচলিত হয়ে বললো,
– তুই কি চুপ থাকবি?
তিরতির আঙ্গুল ভিজে যাচ্ছে। গাল বেয়ে নিঃশব্দে ফোয়ারা ঝরছে। নাক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিতেই মাথা ঝুঁকালো মাহতিম। নিচের ঠোঁট ছেড়ে ঢোক গিললো। চোখ থেকে আঙ্গুল সরিয়ে ধাতস্থ গলায় বললো,
– কেমন আছিস?

কন্ঠটা স্বাভাবিক লাগছে না। নির্ঘাত কিছু হয়েছে। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে টিভি দেখছে সৌভিক। তৎক্ষণাৎ সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরলো। মনে-মনে শঙ্কা নিয়ে চিন্তিত গলায় বললো,
– কিচ্ছু লুকাবি না মাহতিম। সব খুলে বল্। তোর কন্ঠ আমার কাছে সুবিধার লাগছে না।
কন্ঠরোধ হয়ে এলো মাহতিমের। আর একটা শব্দও বলতে পারলোনা। খুব চেষ্টায় কান্নার উচ্ছাসটুকু ঢেকে রাখলো। সৌভিককে কিছুই বুঝতে দিলো না। কি বলবে সৌভিককে? কি বলার জন্য ফোন দিয়েছে? মাহতিম কোনো কথাই বললো না। কলের ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন সৌভিক আবার জিজ্ঞেস করলো,

– দোস্ত বল না। এতো বছর যোগাযোগ করিসনি সব মাফ। তোর কি হয়েছে বল্। আমার কাছে তো কিচ্ছু লুকাস না। অন্তত সেই বিশ্বাসে বলে ফ্যাল। তুই কাঁদছিস কেন শা::লা? তুই অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজে কাঁদবি কেন? ফোন দিয়েছিস চুপ থাকার জন্যে? তুই একবারও যোগাযোগ করিসনি। উলটো নাম্বার বন্ধ করে বসেছিলি। তোর মতো আস্ত শ:য়:তা:ন হয়?
বন্ধুতুল্য সৌভিকের কথা শুনে ঢোক গিললো মাহতিম। অনেকটা সময় নিয়ে স্থির হলো সে। হাতের উলটোপিঠে চোখ ডলে আর্দ্র গলায় বললো,

– আমার ফোনকল ট্র‍্যাক হতো। তোদের সাথে যা কথা বলতাম, সব শুনতে পেতো। যোগাযোগ বন্ধ ছাড়া উপায় পাইনি সৌভিক। যেই মাধ্যমেই কথা বলি না কেন, সব রেকর্ড হয়ে পৌঁছে যেতো। এর মধ্যে আমার বাইরে যাওয়াটা জরুরী হয়। কি কারণে দেশের বাইরে যাই, তুইতো জানিস। ওই অবস্থায় কিভাবে ওকে ছেড়ে যাই বল্? ফ্যামিলি এ্যালাউ করলে ওকে রেখে যেতাম? আমিতো ট্রিপ যাইনি। কিভাবে ওকে নিতাম? ও আমার কথা বুঝলোই না। একটা জিদ ধরেই আছে। সেদিন কেন মাহদির জন্য ওকে দায়ী করেছি। সৌভিক তুই-ই বল, দায়ী যদি করতাম, ওকে কি বাঁচিয়ে রাখতাম? মে;রে ফেলতাম না?

ভারী নিশ্বাস ছাড়লো সৌভিক। কন্ঠ খাটো করে বললো,
– তোর সংসারের কেরোসিন দিয়ে আমার জীবনে বাতি ধরিয়ে দিলি। এখন তুইযে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিস সেই হুঁশ আছে? তোর সামান্য কাণ্ডে এদিকে শানাজ পযর্ন্ত তোর নাম শুনতে চায় না। ওর তো বোন হয়। তার উপর তোকেও খুব মান্য করতো। আমি কতবার তোর কাছে কারণ জিজ্ঞেস করেছি, উলটো তুই আমাকে ব:কাব;কি করে দ:মিয়ে দিতি। ওর মনে আঘাত লেগেছে মাহতিম। ওর বদ্ধমূল ধারণা এটাই, তুই সেদিন ভুলবশত সত্য কথা উগলেছিস। ও এটা ভাবেনি, তুই অসতর্ক হয়ে ভুল কথা বলেছিস। এজন্যই বড়রা বলে, কথা আর থুথু একবার ফেললে মুখে তোলা যায় না। মানুষেরও ভুল হয়। তুই আছিস কোথায়? তোর কল তো বিডির টাইম শো করছে।

পোড়া গন্ধটা আরো বেড়েছে। রুমের ভেতরটা ধোঁয়াটে। প্রচণ্ড চোখ জ্বালা করছে। নাক নিয়ে নিশ্বাস নিতেই খুক-খুক করে কাশলো মাহতিম। ধোঁয়া সরানোর জন্য ডানহাত নাড়তেই কাশতে-কাশতে বললো,
– আমি দেশে একটু কাজে —

গলা বিষিয়ে উঠলো কাশিতে। প্রচণ্ড ধোঁয়া নাক দিয়ে ঢুকে কন্ঠনালিতে সমস্যা করছে। স্বাভাবিক কথা তো দূরে থাক, নিশ্বাসই নিতে পারছেনা। হঠাৎ কয়েক মিনিটের মধ্যে কি হলো? মাথা উঠিয়ে দেখলো পুরো রুম ধোঁয়ায় ভরা। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। সব ধোঁয়ায় মিলে যাচ্ছে। কাশতে-কাশতে ফোনটা কান থেকে নামালো মাহতিম। কলের ওপাশ থেকে চিন্তার সুরে সৌভিক চেঁচামেচি করছে। প্রতিটি কাশির শব্দ সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। সে চিৎকার দিয়ে ডাকলো,
– মাহতিম! দোস্ত তুই কাশছিস কেন? হ্যালো!

মাহতিম কাশির চোটে নির‍্যুত্তর রইলো। মুখের কাছে ডানহাত মুঠো করে কাশতে-কাশতে কল কাটলো। দ্রুত বাঁহাতে ধোঁয়া সরিয়ে রুমের দরজা খুললো সে। বুঝতেই পারছেনা এতো ধোঁয়া কোত্থেকে এসেছে। চোখে অসহন জ্বালা নিয়ে ডানে-বাঁয়ে চোখ ঘুরালো। না, কিছু দেখা যাচ্ছে না। কাশতে-কাশতে গলাটা বাজেভাবে ঝাঁজাচ্ছে। এটা স্বাভাবিক গন্ধ না। এটা ঝাঁজালো টাইপের গন্ধ। যেটা নাক দিয়ে ঢুকলে নিশ্বাসে জ্বালা ধরে, গলার কাছে খুশখুশে ভাব হয়, চোখ দিয়ে পানি পরে। তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে কোনোমতে নিচে নামলো মাহতিম। আঙিনায় সব ঠান্ডা। কেউ নেই। গন্ধ-টন্ধ কিচ্ছু নেই।
অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে সিঁড়িতে উঠলো মাহতিম।

সে জানে, সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। তবুও গন্ধটা কেউ পায়নি। না-পাওয়ার অবশ্য কারণ থাকতে পারে। কিন্তু, মরিচ পোড়ার ঝাঁজালো গন্ধ কেউ পেলো না? এটা কি স্বাভাবিক ঘটনা? নাতো, এটা স্বাভাবিক ঘটনা না। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলো। এই সাইডের দোতলায় কেউ থাকে না। বর্তমানে সে একা। মোম জ্বালায়নি বলে বারান্দাটা অন্ধকার। বলতে গেলে পুরো জায়গাটাই আলোহীন। বাইরে বৃষ্টি নেই। সেটা ক্ষণিকের জন্য থেমেছে। রুমের ভেতর থেকে সকল ধোঁয়া দরজা দিয়ে বেরিয়েছে। ভেতর-বাড়িতে খোলা আঙিনা থাকার জন্য গন্ধটা বুঝি ছড়ায়নি।

নাহলে ঠিকই সবার ঘরে-ঘরে ঢুকতো। ফ্ল্যাশ জ্বালানো মোবাইলটা রুমের কাছাকাছি এসে বন্ধ করলো। কলপাড় থেকে মুখ ধুয়েছে মাহতিম। চোখের জ্বালাটা কমে এলেও গলা খুশখুশ করছে। কাশিটা থেমে-থেমে হচ্ছে। ভেতরে ঢুকে দরজা লাগালো মাহতিম। আর খুলে রাখার প্রয়োজন নেই। যার জন্য নৈঃশব্দের মূহুর্তগুলো কাটিয়েছে, সে আর মুখ ফিরেও চাইবে না। অন্ধকার রুম, একাকী মূহুর্ত, কেউ নেই পাশে। এমন একটা নিঝুম রাতে পুরোনো স্মৃতি ঘাটলো। কাল তো চলেই যাবে, আজ না-হয় শেষ স্মৃতিটুকু থেকে যাক। খোলা জানালার কাছে আসলো মাহতিম। কাশতে-কাশতেই গলা ঠিক করলো। কয়েকবার খাকাড়ি দিয়ে জোরে শ্বাস ছাড়লো। আকাশে তাকিয়ে মলিন চাহনিতে হাসলো মাহতিম। সুর ধরে একটুখানি গাওয়ার ইচ্ছা রাখলো,

অভিমান পিছু নাও,
তাকে পিছু ফেরাও।
তার কানে না যায় পিছু ডাক আমার,
মুখ বুজেই তাকে ডাকছি আবার।
দুচোখ বন্ধ করে থেমে গেলো মাহতিম। কোথাও যেনো লেগেছে। আবার পুরোনো ঘাঁয়ে আঁচড় পরেছে। আর কখনো গান গাইবে না। যেই গলা দিয়ে তীব্র সুর বেরোয়, সেখান দিয়ে রেওয়াজ গলা মানায় না। আজই এই গানের ব্যাপারটা জলাঞ্জলি দেবে। শোয়ার জন্য বিছানায় কাছে আসলো মাহতিম। জানালা থেকে সরার পর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোনোমতে হাতড়ে-হাতড়ে টেবিলে ফোন রাখলো। বিছানায় উঠে দু’হাতে টিশার্ট খুলে ফেললো। আন্দাজে বালিশের কাছে টিশার্ট রাখতেই হঠাৎ কেউ অন্ধকার চিঁড়ে বললো,

– কলেজে যখন আপনার পরিচয় দিয়েছিলাম। সবাই আপনার পেশা শুনে আপনাকে ‘ ঘ্যা:ড়া, ব:দরা:গী, র:সক:সহীন ‘ বলেছিলো। আমি ওদের কথায় তর্ক করিনি। রেসোর্টের সন্ধ্যায় আপনার ঠোঁটে যেই গান শুনেছিলাম, আপনাকে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছাটুকু সেদিনই অনুভব করি।
আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে মাহতিম। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই তার গায়ে হাত রাখলো। চমক উঠলো মাহতিম। কিছু বলার আগেই একজোড়া কোমল বাহুপাশ তাকে বেষ্টন করে ধরলো। তার উন্মুক্ত বুকের কাছে ছোট্ট দেহটা লুকিয়ে পরলো। খুব শক্ত করে আশ্লেষের ডোরে বেঁধে ফেললো। মাহতিমের মুখের কাছে নিজের মুখ এনে বললো,

– জড়িয়ে ধরবেন না?
এক টুকরো হাসি দিলো মাহতিম। চোখটা অন্ধকার সয়ে গেছে। দুটো কালো চক্ষু মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে। আবদারী মুখটা খুব কাছে, খুব নিকটে, খুব সন্নিকটে। মাহতিম পাগলের মতো ওই মুখে চুমু খেলো। দু’হাতে ছোট্ট মুখটা ধরে গালে-কপালে আদর করলো। জোরে-জোরে উত্থাল নিশ্বাস নিতেই মুখ নামালো মাহতিম। সুনিবিড় অন্ধকার প্রাসাদে একমাত্র মানুষটা বহুদিন পর আলো জ্বালালো।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯ 

যেমন যত্নের সাথে সেই প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষে আলো জ্বালানো হয়, তেমনি আবেশীচিত্তে ওষ্ঠাধরে চুমু বসালো মাহতিম। দমবন্ধ করে তার ভালোবাসাটুকু অধরযুগলে জাহির করলো। ঠিক কতক্ষণ, কতখানি, কতটুকু সময় পেরুলো মেহনূরের জানে নেই। মাহতিমের চোখ এখনো বন্ধ। পিঠে বুলানো হাতটা সরিয়ে ফেললো মেহনূর। শাড়ির লম্বা আঁচলটুকু টেনে খুব সন্তপর্ণে মাহতিমের ঠান্ডা পিঠটা ঢেকে দিলো।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১০