মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১০

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১০
ফাবিয়াহ্ মমো

মিথ্যে বলেনি। মিথ্যে লাগেনি। মিথ্যে ছিলো না কিছুই। দুহাতে গলাটা জড়িয়ে কোলে বসলো মেহনূর। প্রাণচঞ্চল্যকর কিশোরীর ন্যায় মায়া-মায়া চোখে তাকালো। অন্ধকার থাকা সত্ত্বেও শান্ত-ধীর মুখটা দেখতে পেলো। ওই মুখে কোনো ক্রোধ নেই, গাম্ভীর্যের আভাস নেই, কাঠিন্যের ছাপ নেই। শ্রাবণের শান্ত বৃষ্টির মতো ঠান্ডা, সন্ধ্যার ডুবো-ডুবো সূর্যের মতো নিস্তেজ, পূর্ণিমার রাত্রির মতো নিরব। একটু আগে অস্থির-উৎকণ্ঠায় বিহ্বল ছিলো মাহতিম।

সাগরে ডুবন্ত ব্যক্তি যখন সামান্য খড়কুঁটো পেয়ে বাঁচতে চায়, একটুখানি আশা পেয়ে যেমনরূপে অস্থির হয়, মাহতিমও যেন ওইরূপে ব্যকুল হয়ে মেহনূরকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে। পুষ্পকূটতুল্য নরম অধরযুগলে নিজের ওষ্ঠাধর গুঁজে দেয়। শুষ্ক মাটি যেমন একটুখানি পানি পেয়ে সবটুকু আর্দ্রতা টেনে নেয়, তেমনি মাহতিম আকুলভাবে ঠোঁটদুটোকে ছিন্নভিন্ন করে শুষে নিলো। পূর্বের তুলনায় সবটুকু আদুরে ছোঁয়া বহুগুনে বাড়িয়ে দিলো। যে উৎকণ্ঠিত অবস্থা কোনোদিন প্রকাশ করেনি, যেই চিত্রটা মেহনূরের কাছে খুলে ধরেনি, আজ প্রাণপণে তা মেলে দিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

যেই দুটো বছর দিশেহারা পথিকের মতো নিজেকে নিঃসঙ্গ লাগতো, আজ বহুদিন পর সঙ্গিনীর বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখলো। এক কাল্পনিক স্বপ্নের মতো লাগলেও স্বপ্নচারিনীর কাছে সপে নিজেকে হালকা লাগছিলো। প্রায় বহুক্ষণ পর হৃদয়ের প্রাণদায়িনীকে ছেড়ে দিলো মাহতিম। অন্ধকারে তার শান্ত চোখদুটো কেবল কাতরের ভাষায় তাকিয়ে রইলো। সে জানে না, কি বলে প্রিয়তমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাবে। তাকে ছাড়া কতটা নাজেহাল, কতটা দুঃখ-পীড়ায় জর্জরিত ছিলো, সেকথা বলতে পারেনি মাহতিম। চুপ করে বসে রইলো, তাকিয়ে রইলো, শেষে মেহনূরের দেহ থেকে দু’হাত নামিয়ে নিলো। সে ভাবতেও পারেনি মেহনূর তার কোলের মধ্যেই চলে আসবে। অম্লানবদনে তাকিয়ে-তাকিয়ে চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করবে। মেহনূর চোখে-চোখ মিলিয়ে নরম সুরে বললো,

– হয়তো শাড়ি পুড়িয়ে দিতাম। কিন্তু স্মৃতিচিহ্ন পুড়ানো সম্ভব? আমার মধ্যে যেই দাগকাটা স্মৃতি আপনি গেঁড়ে দিয়েছেন, সেগুলো কি ভুলতে পারবো? আপনাকে জড়িয়ে আমার সবকিছু কেটেছে, আমি কি মুছতে পারবো? যদি পারতাম, যদি আমার ক্ষমতা বেড়ে যেতো, তাহলে নিষ্ঠুরভাবে সব পুড়িয়ে দিতাম। আপনাকে ছাড়ার পর সব জিনিস ছাই করে ফেলতাম। আমি পারিনি। আপনাকে দুঃখ দিলে আমার গায়েই লাগে। আপনাকে জড়িয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। সেখানে বিষ দিলে আমার গলাই জ্বলে। কেন আপনি এতো মায়া বাড়িয়ে দিলেন? কেন আপনার প্রতি দূর্বলতা শিখালেন? আমার মধ্যে ভালোবাসার সর্বনাশী বুননটা কেন গেঁথে দিলেন বলুন?

মেহনূর একটু থামলো। মূলত থামিয়ে দিলো মাহতিম। মেহনূরের হাতদুটো ঘাড়ের পেছন থেকে আলগা করতেই রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বেজে উঠলো। বাইরে বৃষ্টি না থাকলেও বাতাসের হুল্লোড় চলছে। কানে সেই শব্দ স্পষ্ট পাওয়া যাচ্ছে। অকস্মাৎ বুকের ধুকপুকনি বেড়ে গেলো মেহনূরের। মাহতিম কি করতে চাইছে? হাতদুটো সরিয়ে দিলো কেন? কেন সে চুপ করে আছে? মেহনূর একটু নিজের মনে প্রশ্ন কষে চললো। মাহতিমের নিশ্চুপ অবস্থা বড্ড এলোমেলো করে দিলো। মেহনূর ঢোক গিলে যেই প্রশ্ন করবে, ঠোঁট খুলে যেই বলতে নিবে, ঠিক তখনই মাহতিম আস্তে করে মেহনূরের বাহুদুটো ধরলো। বাহু ছুঁয়ে-ছুঁয়ে কোমরের দুপাশ ধরে শীতল কন্ঠে বললো,

– ডান কাধের চুলগুলো সরাও।
এমন আদেশ শুনে ভ্যাবাচ্যাকা হয় মেহনূর। কারণটা না বুঝলেও চুপচাপ মানলো। বাঁ-হাতটা উলটো করে ডানকাধের কাছ থেকে চুল সরালো। গোছা-গোছা চুলগুলো বাঁ-কাধে টেনে আনলো। মেহনূর প্রশ্ন বাড়িয়ে কিছু বলতে নিলো,
– আপনি কি —

ওমনেই চোখের কপাট বন্ধ করলো মেহনূর। কোমরের দুপাশ থেকে শক্ত বেড়িবাঁধ তাকে প্যাঁচিয়ে ধরলো। বুক ফুলিয়ে শ্বাসবায়ুটা উচ্চ তরঙ্গে আঁটকে গেলো ওর। হিম করা অনূভুতিতে সিক্ত হলো মেহনূর। রিনিঝিনি হাতদুটো বিছানার চাদর খামচে ধরলো। ক্লিভ শেভের খোঁচা-খোঁচা গালটা মেহনূরের গলায় ছুঁয়ে দিচ্ছে। মানুষটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলতেই নিবিড় কন্ঠে বললো,

– মেহনূর,
ডাক শুনে আমতা-আমতা করে উত্তর দিলো মেহনূর,
– জ-জ-জ্বী,
সাড়া পেয়ে মুচকি হাসলো মাহতিম। মেহনূরের কাধের হাড্ডিতে ঠোঁট রাখলো সে। আলতো করে ছুঁয়ে দিতেই ঘোরলাগা কন্ঠে বললো,

– আমি যা বলবো, আমার সাথে-সাথে বলবে। একটুও এদিক-ওদিক যেন না হয়। যদি দেরি হয়, খুব অত্যাচা —
তাড়াতাড়ি কথাটা ছিনিয়ে নিলো মেহনূর। বেচইন কন্ঠে বললো,
– না, না; দেরি না। আপনি বলুন, আপনি বলুন।
সারা পিঠময় হাত বুলাচ্ছে মাহতিম। কোমরে একটা হাত তখনও রাখা। মেহনূরকে জব্দ করতে গলার ছোট্ট তিলতুল্য জায়গায় চুমু বসিয়ে দিলো। ধীরকন্ঠে সুক্ষ্ম দম্ভ নিয়ে বললো,

– আমি মেহনূর আফরিন…
মাহতিমের ফ্যাসাদে কাতর মেহনূর হালকা গলায় বললো,
– আমি মেহনূর আফ-আফরিন…
– আমার স্বামী মাহতিম আনসারীর…
– আমার স্বা-স্বামী মাহতিম আনসা-সারীর…
– সকল কথা মানিয়া চলিবো।
– সকল কথা মানিয়া চলিবো।

– তাহাকে ছাড়িয়া কখনো কোনোদিন যাওয়ার চিন্তাভাবনা আনিবো না।
– তা-তাহাকে ছাছা-ড়িয়া কখনো কোনোদিন যাওয়ার চিন্তাভাবনা আনিবো না।
– যদি এই ধরনের পরিকল্পনা করি,
– যদি এই ধরনের চিন্তা করি,
– একটা লাগাবো! ভুল বলা নিষেধ। বলো, যদি এই ধরনের পরিকল্পনা করি,
মেহনূর দম আঁটকানো সুরে বললো,

– যয-দি এই ধরনের পরিকল্পনা করি,
মাহতিম আশ্বস্ত হয়ে বললো,
– তাহলে আমার স্বামী যা শাস্তি দিবেন, তাই আমি মানিয়া চলিবো।
চোখ কুঁচকে ঠেলে-ঠেলে বললো মেহনূর,
– তাহলে আমার স্বামী যা শা-শাস্তি দিবেন, তাই আমি মানিয়া চলি-চলি-চলিবো।
শেষের কথাটা বলে চোখ খিঁচালো মেহনূর। গলায় প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে চোয়াল শক্ত করলো। চাদর থেকে হাত সরিয়ে গলার কাছে মাথাটা দু’হাতে ধরলো। মানুষটার চুলের অরণ্যে আঙ্গুল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে অনুরোধের সুরে বললো,

– এবার যে ব্যথা পাচ্ছি। মাফটা মন্ঞ্জুর করলে হয় না?
সভ্য ব্যক্তির মতো ছেড়ে দিলো মাহতিম। কোল থেকে নামিয়ে দিলো মেহনূরকে। বিছানা থেকে দু’পা ফেলে দাঁড়িয়ে পরতেই প্রসন্ন সুরে বললো,
– অনেক কিছু করার ইচ্ছে ছিলো। কিছু করলাম না। সামনে তোমার বোর্ড এক্সাম। স্পেশাল ডোজটা আপাতত তোলা থাক। জানালাটা খুলে দাও। আমি মোমবাতি জ্বালাচ্ছি।

গলায় হাত বুলাতে-বুলাতে জানালা খুললো মেহনূর। একঝাঁক বৃষ্টি মিশেল হাওয়া ওর চোখে-মুখে ছুঁয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিলো মেহনূর। কি তরতাজা ঠান্ডা হাওয়া! একরত্নি ধূলো নেই, গন্ধ নেই, প্রাণবন্ত সজীব হাওয়া। চোখ খুলে বিছানার বালিশ সাজালো মেহনূর। টেবিলের উপর সাদা লকলকে মোমটা জ্বালালো মাহতিম। ম্যাচ বাক্সটা টেবিলে রাখতেই বিছানার দিকে তাকালো। পূর্ণদৃষ্টিতে দুটো নেত্রযুগল এক হয়ে আছে। একজনের ঠোঁটে মুচকি হাসির ছোঁয়া, অপরজনের ঠোঁটে বাঁকা হাসির টুকরো। মেহনূরের দিকে ভ্রুঁ নাচিয়ে মাহতিম জিজ্ঞেস করলো ,

– কি দেখছো?
অকপটে বললো মেহনূর,
– আপনাকে।
মৃদ্যু হাসলো মাহতিম। বিছানার দিকে পা ঘুরালো। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে এগুতে-এগুতে বললো,
– আমাকে দেখার কিছু নেই। তোমাদের ভাষায় আমি একজন ‘ রসকসহীন ‘ মানুষ। যার মধ্যে শুধু ভোঁতা অনুভূতি আছে। সেখানে খুঁজাখুঁজি করলে কিছু মৃত স্মৃতি পাবে। মেবি আর কিছুই না।
বিছানায় শুয়ে পরেছে মেহনূর। খাটের বাঁ-দিকে মাহতিমের জন্য জায়গা ছেড়েছে। কাছাকাছি আসতেই বিছানায় হাঁটু ফেলে উঠে পরলো মাহতিম। খালি জায়গায় শোয়ার জন্য গা ছাড়বে, তখনই মেহনূর ব্যস্ত গলায় বলে উঠলো,

– ওখানে ঘুমোচ্ছেন কেন?
মাহতিম আশ্চর্য হয়ে শোয়া থামিয়ে ফেললো। কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে বললো,
– কোথায় ঘুমাবো? তুমি কি নিচে শুতে বলছো?
‘ না ‘ করলো মেহনূর। এক প্রস্থ মিষ্টি হাসি দিলো। মাহতিমকে বক্ষস্থলে রাখার জন্য, তাঁকে কাছে আসার জন্য, তাঁকে আবদ্ধ করার জন্য দু’হাত মেলে দিলো। শূন্য দুটি হাতে আঙুল নাড়িয়ে আসতে ইশারা করলো। মাথাটা একবার উঁচু-নিচু করে শেষ আহবানটা জানিয়ে দিলো। আকুল মাখানো প্রীতিপূর্ণ আবদারে ঝাঁপিয়ে পরলো মাহতিম। একমাত্র শয্যাসঙ্গিনীর বুকে মাথা রেখে দিলো। চোখের পাতা দৃঢ়ভাবে বন্ধ করতেই অজানা কারণে চোখ ভিজে এলো। হাতের পাঁচ আঙ্গুলে পিঠের ব্লাউজটা মুঠো করলো সে। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে আর্দ্র গলায় বললো,

– আমাকে ছেড়ে যেও না মেহনূর। তোমাকে খুব ভালোবাসি। একটু আগে চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছিলো। এমন ব্যথা পাচ্ছিলাম, আমার কলিজাটা বুঝি দু’টুকরো হয়ে ছিঁড়ে গেছে।
মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরলো মেহনূর। চুলের ফাঁকে-ফাঁকে আঙ্গুল ঢুকিয়ে গভীরভাবে চুমু খেলো। পিঠে হাত বুলাতে-বুলাতে বললো,
– ছেঁড়া কাপড় পুড়িয়েছি গো। ওটা কিচ্ছু ছিলো না। আপনার কিছুই আমি পুড়াইনি। শুধু ঝাঁজালো গন্ধ আনার পর দুটো শুকনো মরিচ পুড়িয়েছিলাম। আর কথা না। আর কিচ্ছু বলবেন না। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। চোখদুটোকে ঠান্ডা করুন। বুকে একটু ঘুম দিন। আর কথা বলবেন না। ঘুমিয়ে পড়ুন। ধীরে-ধীরে ঘুমিয়ে পড়ুন।

বৃষ্টিস্নাত সকাল। শেষ রাত্রিরে বৃষ্টি হয়েছে। বড়-বড় কচুপাতায় শিশির জমেছে। রৌদ্রের আলোতে মুক্তোর মতো জ্বলছে। ভোরের আলোটা বাড়তে-বাড়তে সকাল হয়ে গেছে। চারিদিকের নিরবতা ভেঙ্গে পাখির কলরব উঠলো। বাতাসে-বাতাসে এক পশলা হাওয়া মর্মর শব্দ করছে। গেরস্থ বাড়ির উঠোনে হাস-মুরগী ছেড়েছে। ধীরে-ধীরে প্রাতঃকাজ সেরে গ্রামবাসীরা জাগছে। দূর-দূরান্তে চাপকল চাপার ধ্বনি। কলপাড়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মুখ ধুচ্ছে কেউ। কেউ আবার বাঁহাতের তেলোয় কয়লা নিয়ে সন্তর্পণে দাঁত ঘষছে। গরুর হাম্বা-হাম্বা ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো মেহনূরের।

গোয়ালের কালো গরুটা প্রাতঃকালে খুব ডাকে। একটা মোরগের চেয়ে বেশি ডাক ছাড়ে। দু’চোখের পাতা খুলে হাই তুললো মেহনূর। ঘুমের রেশ নিয়ে শরীর টানা দিতেই হঠাৎ বুকের কাছটায় খেয়াল হলো। ওমনেই তড়িঘড়ি করে থেমে গেলো। ভাগ্যিস ঘুমটা গভীর। নাহলে ঠিকই জেগে যেতো। বুকের মধ্যে ছোট্ট অবুঝ বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে আছে মাহতিম। কেউ যেনো একরাশ স্নিগ্ধতা ঘুমন্ত মুখে লাগিয়ে দিয়েছে। জানালা দিয়ে লম্বালম্বি এক টুকরো রোদ মুখের উপর পরেছে। মেহনূর সেটাকে আড়াল করার জন্য ডানহাতে বাধা দিলো। মুখ ঝুঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে সকালের স্পর্শটা কপালে বসিয়ে দিলো। চোখ খুলে হাসি-হাসি মুখে বললো,

– আপনার কপাল থেকে সব চিন্তা দূর হয়ে যাক।
জানালা দিয়ে ক্ষণিকের জন্য ঠান্ডা হাওয়া ঢুকলো। ঘুমন্ত মুখের কপালে কয়েকটা চুল উড়ে এসে থামলো। মেহনূর ডানহাতের তর্জনীতে চুল সরাতেই হঠাৎ কানে অদ্ভুত কিছু ঠেকলো। ব্যাপারটায় গুরুত্ব দেওয়ার জন্য তর্জনীটা থামালো মেহনূর। কয়েক সেকেন্ড শুধু কান খাড়া রাখলো। নিচ থেকে একটা হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। গলাটা বোধহয় বড়মার। বড়মা সাতসকালে কখনো চেঁচায় না।

এ বাড়ির একটা নিয়ম আছে। সকাল-সকাল বাড়ির মহিলাদের কন্ঠ উচ্চস্বরে উঠলে সেদিনটা নাকি ভালো যায় না। যদিও এটা কুসংস্কার। কিন্তু ব্যাপারটা মেহনূরের দাদী মেনে চলতো। মেহনূর উঠবে-কি-উঠবেনা এমন একটা দোটানায় পরলো। একদিকে ক্লান্ত মাহতিমের ঘুম, অন্যদিকে বড়মার উচ্চস্বর। মেহনূরের কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগলো। বড়মা কিছুতেই অপ্রতিভ আচরণ করে না। বিনা কারণে তো কখনোই না। আজ সকাল-সকাল নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।

নিচে একবার যাওয়া দরকার। কিন্তু কিভাবে যাবে? মাহতিমকে সরালেই ঘুম ভেঙ্গে যাবে। এখন উপায় কি? নিচ থেকে শব্দ আরো বেড়েছে। এবার বড়মার সাথে শেফালির কন্ঠও যুক্ত হয়েছে। হৈচৈয়ের মাত্রাটা অতিমাত্রায় ঠেকেছে। রুমের দরজাটা বেশ দূরে। সেই সঙ্গে দরজাটা কাঠের হবার ফলে শব্দ কম। মেহনূর গা থেকে হাত সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ঘুমন্ত মাহতিম ঘুমন্ত বাঘের মতো ধরেছে। থাবার মধ্যে শিকারি ধরার মতো শক্ত। মেহনূর হাল ছেড়ে ব্যর্থতার নিঃশ্বাস ফেললো। ঘুমন্ত মুখে তাকিয়ে উপায়হীন সুরে বললো,

– আমাকে এভাবে ধরেছেন কেন? আমি কি পালিয়ে যাব? নিচে কতক্ষণ ধরে হাউকাউ করছে, অথচ আপনাকে উঠাতে —
হঠাৎ বাকি কথার মাঝখানে চমকে উঠলো মেহনূর। আপনাআপনি ওর কথায় দাড়ি বসে গেলো। নিচ থেকে হুঙ্কারের গলা ঝরছে। দফায়-দফায় গলা উঁচাচ্ছে বড়মা! মেহনূর অপ্রস্তুত ভয় নিয়ে অবাক হলো। মাহতিমের ঘুমও ইতিমধ্যে ভেঙ্গে গেলো। মেহনূরকে একবার জিজ্ঞেস করলো মাহতিম,
– নিচে কিছু হয়েছে? গলাটা বড়মার না? উনি কেন চেঁচাচ্ছে?

মেহনূর অবুঝ ভঙ্গিতে মাহতিমের দিকে তাকালো। ‘ না ‘ সূচকে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– আমিও তো জানি না। আপনি ঘুমাচ্ছেন দেখে উঠতে পারিনি। বড়মা অনেকক্ষণ ধরে হৈচৈ করছেন।
মাহতিম একলাফে বিছানা থেকে উঠলো। তাড়াতাড়ি গায়ে টিশার্ট গলাতেই বললো,
– তুমি আস্ত একটা বো:কা। নিচে গণ্ডগোল হয়েছে তুমি আমাকে তুলবে না? বো:কার মতো আমার ঘুম দেখার মানে আছে? আল্লাহ্-ই জানেন নিচে কি হয়েছে! তুমি চটপট নামো। আমি আগে দেখে আসি।
মাহতিম তাড়াহুড়ো করে দরজার কাছে গেলো। জং ধরা ছিটকিনিটা জোর খাটিয়ে খুলতেই আরেকদফা চিৎকার শুনলো! চকিত হলো মাহতিম। এবারের কন্ঠটা শেফালির! মাহতিম ছিটকিনিতে হাত রেখে মাথা পিছু ঘুরালো। সোজাসুজি মেহনূরের দিকে তাকালে একসাথে দুজন অবাকের কন্ঠে বললো,

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯ শেষ অংশ

– মেজো মা!
শেফালি আলাদা তেজে ঔদ্ধত্যের সুরে বললো,
– আমি তোরে ত্যা:ইজ্য ভাইব্বা ফালাইছি। তু:ই আমার চক্ষের সা:মনেরতে দূর হ! আমারে তুই বা:ন্দি পাইছোস? যখন মন চায় আইবি? যখন মন চায় আবদার করবি? এতোই সুজা লাগে?

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১১