মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১১

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১১
ফাবিয়াহ্ মমো

প্রচণ্ড শোরগোল হচ্ছে। কোনোক্রমেই সেটা থামছে না। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে এখন। হৈচৈ যেন কমছে না। দ্রুত দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে গেলো মাহতিম। লম্বা বারান্দা পেরুতেই নিচের দিকে তাকালো। চোখে বিষ্ময় নিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো। মনে-মনে উচ্চারণ করলো, ‘ এটা এখানে কেন? এই বদমাইশ কি করতে এসেছে? ‘। নিচ থেকে চোখ সরিয়ে সিঁড়ি ধরলো মাহতিম। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে নিচে নামলো সে। যতটুকু বুঝতে পারলো শেফালি এখন চটে আছে। চোখে-মুখে রাগীভাব। দাঁত কিড়মিড় করছে। আগত ছেলেটার গায়ে কালো স্যূট-প্যান্ট, ডানহাতে একটা ব্রিফকেস। বেশভূষায় বিদেশি-বিদেশি ছাপ থাকলেও চোখে একটা কটা ভাব আছে। সুজলা তিরিক্ষি মেজাজে কিছু বলার জন্য অগ্রসর হবেন, তখনই ছেলেটা বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,

– আমি আপনাদের চেহারা দেখতে আসিনাই। আই নিড্ মানি। আমার টাকা লাগবো। পাঁচ লাখ টাকা দেন, নাইলে আমিও এখান থেকে যাইতেছি না। দাদার টাকা-পয়সা ক্যামনে গিলেন আমিও দেখবো।
কথা শুনে গর্জে উঠলো শেফালি। রাগ সামলাতে না-পেরে উঠোন পরিষ্কারের ঝাঁটাটা হাতে নিলো। এক চোট মারতে নিলে শেফালির রণমূর্তি দেখে তাড়াতাড়ি চোখমুখ খিঁচে পিছিয়ে গেলো সিফাত। পরিস্থিতিটা দ্রুত সামলানোর জন্য শেফালির ডানহাতটা ধরলো মাহতিম, একচান্সে ঝাঁটাটা নিজের হাতে নিয়ে শেফালিকে আঁটকে দিলো। শেফালি আরো ক্ষেপে গিয়ে চেঁচাতে লাগলো। সিফাতের দিকে যতো প্রাণপণে এগুতে চাইলো, ততবার পেছন থেকে দু’হাতে আঁটকাতে থাকলো মাহতিম। অনবরত সে বলতে লাগলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– থামুন মেজো মা। মাথা ঠান্ডা করুন। প্লিজ আমাকে ব্যাপারটা দেখতে দিন। এই বদমাইশের সামনে সিন-ক্রিয়েট করার প্রয়োজন নেই।
অপরদিকে শেফালি বাঘিনীর মতো হামলা করার বাসনায় উচ্চকন্ঠে বললো,
– মাহতিম থামাইও না বাবা, থামাইও না। আমারে আইজকা ছাইড়া দেও। এই কুত্তার বাচ্চারে আগে শিক্কা দিয়া লই! এই জানোয়ার আমারে কতো বড় পিত্তি দেখায় দেখছো? ওয় আমার সামনে ভাবীরে কিরম চোখ রাঙানি দেয়! শয়তান, চা:মার! ওই জানোয়ার! তুই আমারে পেটে ধরছোস? আমারে পালছোস তুই? পালনের যহন বয়স আইলো, তুই টেহা চাইতে আইছোস! তোরে তো ঝাঁটি দিয়া বাইড়ায়া-বাইড়ায়া খেদান দরকার। ছাড়ো মাহতিম, আমারে ছাইড়া দেও। এই কুলাঙ্গারের বাচ্চারে সোজা করুম। ওরে আমি ছাড়ুম না।

অনেক কষ্টে শেফালিকে থামালো মাহতিম। শান্ত করে একসাইডে দাঁড়াতে বললো। সুজলার দিকে তাকালো মাহতিম। সম্পূর্ণ ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– বড়মা আপনি কি একে রাখতে চান?
ডানহাতের তর্জনী তুলে সিফাতের দিকে ইশারা করলো মাহতিম। উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো সুজলার দিকে। একমাত্র সুজলার কথায় সবকিছু স্থির করবে। সুজলা দুই মিনিটের মতো নিরব থেকে গম্ভীর গলায় বললেন,
– আমি একে চিনি না। মেজো বউও একে চায় না। বাড়িটা আপদমুক্ত করো মাহতিম। আমার কোনো আপত্তি নেই। নাস্তা বানানোর সময় হয়েছে। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।

একটু-একটু করে বাঁকা হাসিটা ফুটে উঠলো ঠোঁটে। ঠিক এমন উত্তরটাই মাহতিম চেয়েছে। সুজলার কাছ থেকে যোগ্য জবাব পেয়ে মাথাটা সামনে ঘুরালো সে। সরাসরি তাকালো সিফাতের দিকে। তর্জনী নামাতে-নামাতে বাঁকা হাসিটা মিলিয়ে দিলো। একদম হাসিহীন ঠোঁটে পাষাণের মতো তাকালো। সিফাত যতই ভয় পাক, হাবভাবে বুঝতে দিলো না। কিন্তু বেচারা সিফাত পরের র্কীতি সম্বন্ধে অবগত না। মাহতিম ওর দিকে একপা-একপা করে এগুতেই কাট-কাট সুরে বললো,

– দ্যা ইউনাইটেড আরব আমিরাত। সেখান থেকে ইউনাইটেড স্টেটস। নিউইয়র্কের মতো বড়লোকি জায়গায় জুয়াখেলা শুরু। ক্যাসিনোতে লাখ-লাখ টাকা হার। গাম্বলিং করতে-করতে সব অর্থ শেষ। দেশে ফেরার টাকা ছিলো না। এক আমেরিকান নারীকে প্রেমের জালে ফাঁসানো। কিছু টাকা উদ্ধার। তারপর —
সিফাতের মুখ ভয়াবহ কালো। গলাটা একদম শুকিয়ে গেছে। ভীতিপ্রবণ অবস্থা সারা মুখে ছড়িয়ে আছে। মাহতিম একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। ঠোঁট গোল করে ছোট্ট একটা শিষ বাজাতে-বাজাতে ডানহাতে প্লেনের উড়ার ইঙ্গিত দিলো। ভ্রুঁদুটো দু’বার নাচিয়ে সিফাতের উদ্দেশ্যে বললো,

– তারপর বিদেশ-টু-বিডি। তাই না মিস্টার স্টিফেন?
বিদ্যূৎপৃষ্টের মতো চমকে গেলো সিফাত। চোখদুটো গোল-গোল করে আস্তে করে ঢোক গিললো। এই লোকটা কে? কিভাবে এতোকিছু জেনেছে? চুটিয়ে ঘামছে সিফাত। প্যান্টের লেফট্ পকেট থেকে রুমাল বের করতেই ভীতিপ্রদ কন্ঠে বললো,
– হু আর ইউ?

একগাল হাসি দিলো মাহতিম। গলা খাঁকাড়ি দিয়ে হাতদুটো প্যান্টের পকেটে গুঁজলো। মাথাটা বামে ফিরিয়ে চোখদুটো ঠিক দোতলার দিকে রাখলো। ওরকম চাহনি দেখে সিফাত খানিকটা ঘাবড়ে গেলো। অন্যদিকে তাকালো কেন? সেও মাহতিমের দৃষ্টি লক্ষ করে দোতলার দিকে চাইলো। কপালের বাঁদিকটা রুমালে মুছছিলো সে, তৎক্ষণাৎ কিছু দেখতে পেয়ে বাঁ-হাতটা থেমে গেছে। ভূত দেখার মতো ঠোঁট ফাঁক করলো সিফাত।

উজবুকের মতো একবার দোতলার দিকে তাকালো, আরেকবার তাকালো মাহতিমের দিকে। দোতলায় তখন মেহনূর দাঁড়িয়ে আছে। সেই ছোট্ট-শৈশব-বাচ্চামো চিত্র আর নেই। বদলে গেছে মেহনূর। যৌবনে পদার্পণ করা টগবগে যুবতী এখন। যেন সদ্য ফোঁটা ফুলের মতো মায়াবী। চোখের চাহনি, মুখের শ্রী, দেহের গড়ন সব মিলিয়ে সুরসুন্দরী। সিফাতের অবাক চাহনি দেখে মেহনূর অস্বস্তি বোধ করলো। এক দৌঁড়ে বারান্দা পেরিয়ে রুমে ঢুকে পরলো। সিফাত চোখ নামিয়ে মাহতিমের দিকে চাইলো। মনটা প্রচুর খচখচ করছে। অনেক কিছু জানার জন্য অস্থির লাগছে। মাহতিম ওর প্রশ্নাতুর অবস্থাটা বুঝতে পেরে বলিষ্ঠ কন্ঠে বললো,

– মোল্লাবাড়ির ছোট নাতজামাই। মাহতিম আনসারী। পেশায় বাংলাদেশ নেভির সদস্য। বয়সে আপনার চেয়ে সিনিয়র আছি। সম্পর্কের দিক থেকে কিছুটা ছোট। এতোসব তথ্য কিভাবে জোগাড় করলাম, নিশ্চয়ই সেটা ব্যাখ্যা দিতে হবে না।
সিফাত নিজেকে সামলে নিলো। কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হবে। একটুও বাজে আচরণ করা যাবে না। নেভালের লোকজন ভালো না। এদের মেজাজ খুব চড়া থাকে। কখন কি করে বসে, কিচ্ছু বলা যায় না। একটু আগে যেই লোকটা হাসতে-হাসতে কথা বললো, এখন তার মুখের অবস্থা অবর্ণনীয়। একেবারে চেন্ঞ্জ অবস্থা। সিফাত খুব মাপযোগ করে জিজ্ঞেস করলো,

– আপনি কিভাবে জানলেন? আমার পেছনে লোক লাগিয়েছেন? আমিতো আপনাকে চিনি না। আপনি কি করে আমার পরিচয় পেলেন?
মাহতিম কোনো জবাব দিলো না। দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। এই বদমাইশের সাথে কথা বলতে অসহ্যবোধ হচ্ছে। এর চেহারা দেখলে তরুণের কথা মনে পড়ছে। এই বদমাইশটা ওই শয়তানকে বন্ধু পাতিয়েছিলো। মাহতিম কোনো ভণিতা না-করে মোদ্দাকথায় ফিরলো,

– আপনি কি মাল নিবেন, না বিদায় হবেন?
কথাটা ধরতে পারলো না সিফাত। ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকতেই বোকা গলায় বললো,
– জ্বী?
কিছুক্ষণ নিরব থাকলো মাহতিম। পকেটে এখনো হাতদুটো গোঁজা। সিফাতের দিকে তাকিয়ে থাকতেই দ্বিতীয়বার শুধালো। কিছুটা গাম্ভীর্যের সাথে প্রতিটা শব্দ থেমে-থেমে বললো,
– আপনি কি মাল নিবেন, নাকি বিদায় হবেন?

‘ মাল ‘ শব্দটা শুনে সিফাত টাকার কথা ভাবলো। মাহতিম বোধহয় টাকার ব্যাপারটা অন্যভাবে বোঝাচ্ছে। একপ্রকার মুগ্ধ হলো সিফাত। এরকম বোনজামাই পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। কি সুন্দর করে মালের কথাটা তুললো। সিফাত মিষ্টিমধুর হাসিতে সায় জানিয়ে বললো,
– আমি মাল নেবো ভাইজান। তখন তো পাঁচ চেয়েছি। এখন আপনাকে দেখে দশ বলতে চাচ্ছি। এক কাজ করুন, আপনি খুশি হয়ে দশই দিন। জিনিপত্রের যা দাম। বুঝেনই তো সমস্যা?

মাহতিমও তাল মিলিয়ে হাসলো। সিফাতের কথায় হাস্যমুখে সায় দিলো। পকেট থেকে ডানহাত বের করে কপালের ডানদিকটা চুলকাতে লাগলো। সিফাত বেজায় খুশি। পুরো দশ লাখ টাকা দিচ্ছে! খুশিতে গদগদ হয়ে যেই ‘ হিহি ‘ টাইপ হাসি দিবে, প্রচণ্ড শব্দে বাঁ-গালে চড় পরলো। গালের চামড়াটা বুঝি ধাঁইধাঁই করে জ্বলছে। কানটা তব্দা লেগে ‘ ভোঁ ‘ জাতীয় শব্দ হচ্ছে। কঠিন এক চড় খেয়ে মাথা ঝাঁকানি দিলো সিফাত। চোখে এখন ঝাপসা দেখছে। দোতলা থেকে সম্পূর্ণ দৃশ্য দেখছে দু’বোন। সাবা রোষের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাজটার প্রতি সম্মান জানিয়ে দাঁত চিবিয়ে বললো,

– একদম ঠিক আছে। খুশি হয়েছি। মাহতিম ভাইয়া আরো মারো। আরো মারো। পিটিয়ে এটাকে বিদায় করো। জোচ্চোরটা যেনো জীবনেও না-আসে।
পাশেই অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে সুরাইয়া। সিফাতের করুণ দশা দেখে কিছুতেই ভালো লাগছে না। যত কিছু হোক, ওর তো ভাই। ওকে তো একসময় দেখে-দেখে রেখেছে। কোনোদিন অন্যায় করেনি ওর সাথে। ছোটবেলার কথাগুলো ভাবলে আজও খারাপ লাগে। সিফাতকে ‘ দাদা ‘ ডাকতো সে।

সেই দাদা কতবছর পর ফিরেছে। কিন্তু দাদা আজ এমন কেন? সেই দাদাটা কোথায় হারিয়ে গেলো? যেই দাদাটা সুরাইয়ার জন্য চকলেট এনে দিতো, মাথার তুলি কিনে আনতো, মায়ের খুব ভক্ত ছিলো, সে আজ কোথায়? কেন সিফাত দাদা কুসঙ্গে ফাঁসলো? ওই তরুণের মতো নেশাখোরকে কেন পছন্দ করলো? পুরোনো কথা ভাবতে গিয়ে চোখদুটো ভিজে এলো। খুব সাবধানে আঁচল টেনে চোখ মুছে নিলো। সাবা আড়চোখে ব্যাপারটা লক্ষ করে সুরাইয়ার দিকে তাকালো। নিচু সুরে বললো,

– তোর খুব খারাপ লাগছে, না?
সুরাইয়া চোখ মুছা থামিয়ে সাবার দিকে তাকালো। ঠোঁটে অপ্রস্তুত হাসি টেনে এড়ানোর জন্য বললো,
– রাত জেগে পড়তে-পড়তে চোখটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বুবু। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। খুব পানি পরে।
সাজানো মিথ্যা শুনে মিচকি হাসলো সাবা। বাঁদিকে কনুই গুঁতা মেরে ফাজলামি করে বললো,
– এইতো আর ক’টা দিন। তারপর তুইও মেহনূরের মতো আকাম করবি। সারা রাত জাগবি। জামাই পালবি। ব্যাপারটা ঠিক আছেনা সুরাইয়া?
লজ্জায় অবাক হলো সুরাইয়া। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

– কি খারাপ! তুমি দিনদিন খুব দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো বুবু। এটা কিন্তু ঠিক না। আমি কিন্তু বড়মার কাছে বিচার দেবো।
সুরাইয়ার রাগ দেখে পাত্তাই দিলো না সাবা। উলটো মুখ ভেংচিয়ে বললো,
– যা যা বল গা। তোকে আমি ভয় পাই নাকি? তুই একদিক দিয়ে আম্মার কাছে যাবি, আমিও তোর ফেল্টুস খাতা মেজোমার হাতে গুঁজে দেব।

সুরাইয়া কিছু বলার সুযোগ পেলো না। আর কথা এগুলো না। পরিবেশটা ইতিমধ্যে গরম হয়ে গেছে। দু’বোনের দৃষ্টি নিচের দিকে থেমেছে। সিফাতের অবস্থা দেখে সুরাইয়া খপ করে সাবার হাত ধরলো ধরলো। ভয়কাতুরে দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে থাকলো। সিফাতের মুখ বরাবর চরম একটা ঘুষি পরেছে। সেই ঘুষিতেই নাকের ছিদ্রপথে টলটল করে রক্ত বেরুচ্ছে। এটুকুতে থামেনি মাহতিম। আরেকচোট আঘাত কান বরাবর মারলো। ওই দৃশ্য দেখে চোখ খিঁচালো ওরা। দ্রুত সুরাইয়ার হাত ধরে রুমে ঢুকলো সাবা। ওই নৃশংস মারগুলো দেখার মতো না।

সকালটা বিশ্রীভাবে শুরু হলো। শুরু হলো একের-পর-এক ঘটনা। যেই ঘটনা সবকিছু বিগড়ে দিলো। কেউ বুঝতে পারেনি, ধরতে পারেনি এমন কিছু হবে। এক অদৃশ্য ঝড় দামামা বাজিয়ে আছড়ে পরবে। সিফাতের আগমন নিয়ে ক্ষুণ্ণ ছিলো সবাই। তাকে বিদায় করার পর স্বস্তি পায় তারা। মাহতিমের বেধড়ক পিটানো নিয়ে কোনো আপত্তি ছিলো না। সকালের নাস্তা খেতে টেবিলে বসে সবাই। গতকাল দুপুরে এসেছে মাহতিম। হুট করেই এসেছে। মেহনূর যখন অনুষ্ঠান ছেড়ে বাড়ি চলে আসে, তখনই সুজলা আসল ঘটনা বুঝতে পারে। রান্নার আয়োজন শুরু করতেই কালো জীপটা হাজির হয়। মাহতিম যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থা নিয়ে বাড়িতে ঢুকে, তখনই সুজলার চাপাচাপিতে পুরো ঘটনা বলে ফেলে।

সবকিছু শোনার পর ছেড়ে দেয় সুজলা। হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে মাহতিম। ঠিক তখনই জানতে পারে মেহনূর খায়নি। আসার পরপরই দরজা সেঁটে ঘুমিয়েছে। কারোর সাথে দেখা করেনি। মাহতিম সবটা শোনার পর সুজলার কাছে অনুরোধ করে। ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপারটা মিটাতে চায় সে। তবে, রাতের ঘটনা স্রেফ সাবা-সুরাইয়া জানে। পোড়া গন্ধের ইতিহাস তারাও চুপিচুপি দেখেছে। মেহনূর যখন মরিচের জন্য রান্নাঘরে যায়, তখনই তারা মরিচ আনার কাহিনি দেখতে পায়। মেহনূর নাক-মুখ চেপে মরিচ পুড়িয়ে দরজার পাশে রাখে। সেই দরজার নিচ দিয়ে মাহতিমের কাছে পৌঁছে।

কাঠের দরজা ঠেলে মেহনূর ঢুকে। চোরের মতো পা ফেলে বিছানার দিকে তাকায়। সর্বপ্রথম বুকের উঠা-নামাটা দেখে। কবে জানি বুকটা স্থির হয়ে যাবে। শরীর হবে ঠান্ডা। যেই মাতৃস্পর্শের কাছে সতেরটা জীবন কাটালো, সেটা ছুঁতে গেলে ঠান্ডা অনুভব হবে। এমন একটা অনুভূতি কি করে সহ্য হবে? জীবন্ত মানুষটা হুট করে চলে যাবে। কান্নার আবেগটুকু খুব দামালভাবে আঁটকায়। মায়ের সামনে কাঁদা যাবে না।

একটুও কাঁদা যাবে না। যেই শারীরিক যন্ত্রণায় দিনের-পর-দিন ভুগছে, তার নরম মনটাতে কষ্ট দেওয়া ঠিক না। মেহনূর নিচের ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে ধাতস্থ হয়। পা টিপে-টিপে মায়ের কাছে যায়। শিউরের কাছে বসে ঘুমন্ত মায়ের রোগা কপালে হাত রাখে। একটু-একটু করে চোখের পল্লব মেলে মাহমুদা। কয়েক মিনিট চেষ্টা পর স্পষ্ট দেখতে পায়। মেয়েকে শাড়ি বেশে দেখে খুশি হয়। ফ্যাকাশে ঠোঁট একটুখানি হাসে। ওই হাসিটুকু মেহনূরের বুকটায় তীরের মতো বিঁধে। ‘ মা আর থাকবে না ‘ এমন একটা সুর বাজে। মেহনূর খুব আলতো করে কপালে হাত বুলায়। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে,

– তুমি হাসছো কেন আম্মা? আমাকে খুব বাজে দেখাচ্ছে?
মেহনূর কথাটা ইচ্ছা করে বলে। মায়ের মুখ থেকে মূল্যবান প্রশংসাটা দু’কানে শুনতে চায়। মাহমুদা মলিন কন্ঠে দম ছেড়ে-ছেড়ে বলে,
– তোকে খুব সুন্দর লাগে রে মা। আল্লাহ্ পাক তোকে সব সৌন্দর্য দিয়ে আমার গর্ভে পাঠিয়েছেন। আমি ধন্য রে মা। এবার একটু শান্তিতে যেতে পারবো।
সাথে-সাথে সুন্দর আকাশে মেঘের বাজ পরলো। খুব কষ্ট করে ভেতরটা সামলালো মেহনূর। কোনোভাবেই মা’কে বুঝতে দিলো না। ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বললো,
– তুমি আমাকে তাড়াতে চাচ্ছো তাইনা? চাচ্ছো যে আমি এখান থেকে বিদায় হই। এ বাড়ি থেকে চলে যাই। তুমি এটাই চাচ্ছো না বলো?

পাণ্ডুর মুখে হাসে মাহমুদা। মেয়ের কথা শুনে খুব হাসতে মন চাইছে। শরীরে সেই বলটুকু শূন্য। বারবার শ্বাসনালিতে দম ফুরিয়ে আসছে। খুব খারাপ লাগছে। তবুও মাহমুদা সবকিছুর অগোচর করলো। মেয়ের সান্নিধ্য পেয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
– তোর ঘরে প্রথম সন্তান যেন একটা মেয়েই হোক। মাহতিমের জীবনে আরেক মায়ের আদর আসুক। আমিতো মা থাকবো না। তোর মেয়েটাকে মায়ের মতোই ভালোবাসিস।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১০

আমার শেষ সময়ে যেভাবে পাশে থাকলি, তোর মেয়েটাও দেখিস কতো আপন করে নেয়। কোনোদিন মাহতিমের সাথে দূর্ব্যবহার করবি না। যতো ঝগড়াঝাঁটি হোক, যতো কাটাকাটি হোক, কোনোদিন আলাদা থাকবি না। এখনকার যুগ বিষাক্ত যুগ রে মা। এই যুগের তালে-তালে নিজেরে শেষ করিস না। মনোমালিন্য হলে মাহতিমকে সময় দিবি। খবরদার স্বামীর মুখে-মুখে তর্ক করবি না। এইসব শয়তানের প্ররোচনা। তোর দাদী সবসময় তিন বউকে বুঝ্ দিতো। আমি জীবনেও তোর দাদা-দাদীকে আলাদা থাকতে দেখিনি। কথাগুলো মনে রাখিস মেহনূর। আজীবন তো চুপচাপ থাকলি। এখন একটু কথা বলা শিখিস।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১২