মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৪

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৪
ফাবিয়াহ্ মমো

বড্ড গোলমেলে ব্যাপার। দুটো বাইক ধাওয়া করছে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক না। এর মধ্যে আবহাওয়া খারাপ। মৃদ্যু বাতাসের ঝাপটা চলছে। চর্তুদিকে অন্ধকার। ওদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। সেটা হেলমেটে ঢাকা। লেফট-মিররে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে মাহতিম। তার চোখ স্থির। মাথাটা ঠান্ডা। এই মূহুর্তে অস্থির হলে চলবে না। তাকে ঠান্ডা মাথায় আগাতে হবে। ওরা কেন ধাওয়া করছে সেটা বুঝতে হবে। মাহতিম লেফট-মিররে দৃষ্টি রাখা অবস্থায় নোমানের উদ্দেশ্যে বললো,

– দুটো বাইক ফলো করছে। খবরদার গাড়ি থামাবে না। আমি না-বলা পযর্ন্ত এ্যাকশনে যাবে না।
চকিতে ভিড়মি খেলো নোমান। এতোক্ষন খুব শান্ত মনে গাড়ি চালাচ্ছিলো। পেছনে কে, বা কারা আসছে সেদিকে খেয়াল করেনি সে। স্টিয়ারিং ধরা অবস্থায় রাইট-মিররে তাকালো। বসের দৃষ্টিশক্তি আসলেই লা-জওয়াব! পেছন থেকে আসলেই দুটো বাইক ফলো করছে। বস্ কি চমৎকার ধরে ফেলেছে। অথচ, এই কাজটা তার করা উচিত ছিলো। কেননা ড্রাইভটা এখন তার আন্ডারে। নোমান তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে গাড়ির লুকিং মিররে তাকালো। পেছনে বসা মাহতিমের উদ্দেশ্যে অবাক কন্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– এই চামার দুটো কারা? আমাদের কেন ফলো করছে? আপনি যে ব্যাক করছেন, এই খবর তো কেউ জানে না।
মাহতিম চট করে লুকিং মিররে তাকালো। নোমানের দিকে চোখাচোখি দৃষ্টি হেনে গম্ভীর গলায় বললো,
– আমি এদের চিনি না। যেহেতু চিনি না, তাই এলার্ট থাকো। আমি না-বলা পযর্ন্ত পাকনামো করতে যাবে না। গাড়িতে আমি একা নই।

শেষ কথাটা কার জন্য ছিলো বুঝতে পেরেছে নোমান। কথা হলো, এই লোকদুটো কারা? এভাবে রাতের আঁধারে ধাওয়া করাটা স্বাভাবিক না। মাহতিম একমিনিটের জন্য হাতদুটোর মাঝে তাকালো। মায়াভরা শুকনো মুখটা ঘুমে ঢুলে আছে। কি নির্ভার সেই মুখ, কি নিষ্পাপ সেই অবয়ব। নবজাত কিশলয়ের মতো ঠোঁটদুটো জ্বরের ঘোরে কাঁপছে। ওই ঠোঁটদুটোকে নিজের ওষ্ঠাধরে ছোঁয়ার জন্য ব্যকুল ছিলো মাহতিম। জ্বরের তপ্ত ছোঁয়াটুকু নিজের ঠোঁটে নেওয়ার জন্য বড্ড আকুলিবিকুল ছিলো। কিন্তু, গাড়িতে নোমান আছে।

সে শুধু স্বামীরূপে নয়, কারোর বস্ হিসেবেও আছে। যদিও নোমান পেছনের দিকে তাকায়নি। তার স্বভাবে এটা একটা মার্জিত দিক। মানুষের প্রাইভেসি ব্যাপারটা নোমান বুঝে। গাড়িটা এখন মেইন-রোড ধরেছে। ঝড়ো-হাওয়ার জন্য মানুষ কম। যানবাহন তেমন একটা নেই। দু-একটা ট্রাক হুটহাট পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। তাও অন্যদিকে খেয়াল নেই। জানালা দিয়ে ধূলোমিশ্রিত বাতাস ঢুকছে। তবুও, সেটা বন্ধ করেনি। স্পিড এখন সত্তরে সীমাবদ্ধ। সেটা বাড়ানোর জন্য তাগিদ আসেনি। নোমান খুব দক্ষভাবে ড্রাইভ করছে।

এমন ভাবেই করছে, যেন পেছনের বাইকাররা না-বুঝুক। মাহতিম সন্তপর্ণে হিসাব কষে যাচ্ছে। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর হঠাৎ বাইকদুটো পিছিয়ে গেলো। আয়নায় তাদের দৃশ্যটা আস্তে-আস্তে মিলিয়ে গেলো। নোমানও ড্রাইভিং করা অবস্থায় ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছে। ওরা পেছনে আর ফলো করছে না। তাহলে কি ভয় পেলো? ওমন করে পিছালো কেন? নোমান হাসি দিয়ে যেই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়বে, ঠিক তখনই লোমহর্ষক কাণ্ডটা ঘটলো। সামনে থেকে মুখোমুখি অবস্থায় একটা কালো গাড়ি আসতেই চেঁচিয়ে উঠলো মাহতিম,

– নোমান থামো!
তৎক্ষণাৎ গাড়িটা থামালো নোমান। ভয়ংকর একটা সংঘর্ষ হবার আগেই ব্রেক কষলো সে। স্টিয়ারিং ধরে নোমান হাঁপাচ্ছে। চোখদুটো বিস্ফোরিত হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে থেকে আগত গাড়িটা হিংস্রভাবে দাঁড়ানো। আরেকটু হলেই ভয়াবহ দূর্ঘটনা হতো। এরকম অবস্থা এই প্রথম হলো। মাহতিমের অধীনে অনেক বছর হলো কাজ করছে। কিন্তু আজকের মতো অবস্থা কখনো হয়নি। আগত গাড়িটা কালো। অন্ধকারে সামনের দুটো হেডলাইট জ্বলছে। মাহতিম ডান হাত বাড়িয়ে পুরো ব্যালেন্স সামলে নিয়েছে। যদি ডানহাতে সামনের সীটটা না-ধরতো, তাহলে তাল সামলাতে গিয়ে কপালে বারি খেতো। নোমান স্টিয়ারিং থেকে ডানহাত তুলে ঘার্মাক্ত কপালটা মুছলো। ঢোক গিলে শঙ্কিত গলায় বললো,

– আরেকটু হলে গাড়িটা উলটে যেতো স্যার। এই হারামজাদারা প্ল্যান করে এসেছে। আমাদের কাছে সিকিউরিটি নেই। আমার পিস্তলটা জীপে ফেলে এসেছি। এখন কি করবো স্যার? গাড়ি থেকেও নামা যাবে না।
বাঁহাতটা শক্ত করলো মাহতিম। সাথে-সাথে মেহনূরের গরম মুখটা বুকে গুঁজে গেলো। তপ্ত নিশ্বাসটা পাণ্ঞ্জাবী ভেদ করে চামড়ায় লাগছে। মাহতিম সোজাসুজি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই মুখোমুখি গাড়িটা হিংস্র চোখে দেখছে। ইচ্ছে করছে গাড়িটাকে এখুনি গুড়িয়ে দিতে। নোমান কোনো উত্তর না-পেয়ে আবার বলতে নিলো,

– স্যার,
দাঁতে-দাঁত পিষে থামালো মাহতিম,
– চুপ! কথা না।
কথার অবর্ণনীয় তেজে চমকে উঠলো নোমান। বস্ চটে গেছে। আর কথা বাড়ায়নি। বস্ যেহেতু শান্ত হয়ে আছে, তাহলে চুপ থাকা দরকার। মাহতিম একবার ডানে, আরেকবার বামে তাকালো। দুদিকে কেউ নেই। মাথাটা পিছু ফিরিয়ে দেখলো পেছনেও খালি। বুঝতে আর বাকি রইলো না, পেছন-পেছন বাইকদুটো সটকে গেছে। ওরা গুপ্তচর ছিলো। মাহতিম পুরো নকশাটা আঁচ করতে পারলো। একদম খাপে-খাপে মিলিয়ে ফেললো। মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই ওই গাড়িটার পাশে আরেকটা গাড়ি আসলো। নোমান উত্তেজনার চোটে বিস্মিত হয়ে বললো,

– ওরা আমাদের ঘিরে ধরছে স্যার! এক্ষুনি না পালালে ফেঁসে যাবো।
বলতে দেরি, সামনে থেকে ভোঁ-ভোঁ জাতীয় হুঙ্কার শুরু হলো। গাড়িদুটো ইন্ঞ্জিন চালু দিয়েছে। মাহতিম আর দেরি না-করে উচ্চকন্ঠে বলে ফেললো,
– গাড়ি ব্যাকে নাও কুইক! দেরি কোরো না নোমান!
নোমান একটুও দেরি করলো না। বাধ্য কর্মকর্তার মতো মনিবের কথা শুনলো। একটু পিছিয়ে নিতেই একচান্সে গাড়িটা ঘুরিয়ে ফেললো। প্রচণ্ড স্পিডে ওই দুটো গাড়ি আসছে। নোমান চোখে-মুখে বীভৎস রাগ ফুটিয়ে দাঁত কটমট করলো। খিঁচানো মেজাজে গজগজ করে বললো,

– চামারের বাচ্চারা খেলা শুরু করেছে। একটু আগে এক্সিডেন্ট হতে-গিয়ে-হলো না। এখন ধাওয়া করছে! এমন কেন করছে স্যার? আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না।
নোমানের উৎকন্ঠা দেখে কিছুই বললো না। মাহতিমের টেনশন শুধু মেহনূরকে নিয়ে। ওকে এই অবস্থায় আনা ভুল হয়েছে। যদি জানতো এমন কিছু হবে, তাহলে সে থেকেই যেতো। দুদিন কাটিয়ে ফিরে আসতো। কিন্তু উপায় নেই। ওই বাড়িতে থাকা যায় না। চর্তুদিকে শোকের ছায়া। মাহতিম গভীর করে এক দম নিলো। ঠোঁটদুটো গোল করে নিশ্বাসটুকু ছাড়লো। তুমুল স্পিডে গাড়ি চলছে। আশির গতিসীমা ছুঁয়ে ফেলেছে। বাইরে ঝপ করে বৃষ্টি শুরু হলো। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট ঢুকছে। মাহতিম দ্রুত জানালার কাঁচ উঠাতে থাকলে নোমান তখন বললো,

– স্যার, ওরা ফলো করছে কেন?
মাহতিম ডানদিকের জানালাটা লাগালো। তুখোড় বৃষ্টি পরছে। আকাশটা পৈশাচিক সুরে ডাকছে। মেঘে-মেঘে গর্জে উঠছে খুব। রাতের চাদর চিঁড়ে দিনের আলো ফুটলো। সাথে-সাথে ঠাস করে মেদিনী কাঁপিয়ে বজ্রপাত হলো। শব্দের তীব্রতা কান ফাটানোর মতো। প্রচণ্ড ভয়ে শিউরে উঠলো মেহনূর। জ্বরতপ্ত দুহাতে পান্ঞ্জাবীটা খামচে ধরতেই উষ্ণক্রোড়ে আগলে নিলো মাহতিম। ওর মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে নোমানের জবাব দিলো,
– ওরা ফলো করছে না নোমান। ওরা খু:ন করতে চাইছে।

বুকটা কেঁপে উঠলো! ঢোক গিললো নোমান। হঠাৎ মনে পড়লো একজনের কথা। চোখের সামনে মনের ক্যানভাসে একটি মুখ ভাসলো। সেই মুখটা নিষ্পাপ না, ভয়ংকর। কতটা ভয়ংকর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই দুটো বছর যে চিত্র ধারণ করেছে, সেটা ওই ব্যক্তির জন্য। তার বসের জীবনে এই ব্যক্তি অভিশাপের মতো। ক্ষমতার জোরে ওই ব্যক্তি আজ প্রচুর অপকর্ম করছে। কিন্তু, এমনভাবে কাজ সারছে, সেখানে কোনো প্রমাণ নেই। একদম হাত ঝাড়া দিয়ে খালাশ।

এদিকে পুলিশ থেকে শুরু করে সবাই তার কথা শোনে। তার ইশারায় উঠে-বসে। যদি একটুখানি এদিক-ওদিক কেউ করে, তাহলে পরিচয়ের পাশে ‘ মরহুম ‘ লেগে যায়। খু:নের কথাটা মনে পরতেই চিন্তা কাটলো ওর। ভাবনার দুয়ার থেকে বাস্তবে ফিরলো। বস্ যে কিজন্য টেনশন করছে, এবার বুঝতে পারলো সে। মাহতিম পকেট থেকে ফোন বের করলেও নেটওয়ার্ক নেই। কাউকে কল দেওয়া যাচ্ছে না। নোমান হর্ণ বাজাতে-বাজাতে গাড়ি ছুটাচ্ছে। স্পিডের কাটা আশির উপরে। বৃষ্টির তেজ কমে গেছে। এখনো গাড়িদুটো হায়েনার মতো আসছে। পুরো রোডে তিনটে গাড়ি দাপাতে-দাপাতে যাচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে অদ্ভুত ও জোরালো শব্দ হলো! মাথা পিছু ঘুরালো মাহতিম! পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখে গলা উঁচিয়ে বললো,

– হেড ডাউন নোমান!
একনিমিষের ভেতর মাথা ঝুঁকালো ওরা। বিকট শব্দ করে পেছনের সিটে চূর্ণবিচূর্ণ হলো! পুরো কাঁচ চুরমার হয়ে লাস্টের গদিতে পরলো। পেছন থেকে গুলি চালাচ্ছে! ভাগ্যিস, নোমান আজ মাইক্রোটা এনেছিলো। মাহতিমের টয়েটো গাড়িটা আনেনি। নাহলে কাঁচের টুকরোগুলো বিঁধে যেতো ঠিকই। আবার মাথা উঠালো ওরা। খালিহাতে কিচ্ছু করা যাচ্ছে না। পালটা এ্যাকশনটা না-নিলে ওরা পিছু ছাড়বে না। মাহতিম কিছু করার পূর্বেই অভাবনীয় অবস্থা হলো।

দ্বিতীয়বারের মতো ব্রেক কষলো নোমান। এবারের ব্রেকটা আগের মতো আকস্মিক ছিলো না। দূর থেকে কিছু দেখতে পেয়ে ব্রেক কষেছে। সামনে থেকে আরো এক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা চিনতে পেরে নোমানের দম বন্ধ হয়ে আসলো। পুরো মুখে অকল্পনীয় ভয় এঁকে গেছে। অজান্তেই নোমান স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে ফেললো। সামনে আগত গাড়িটা জানালা দিয়ে পিস্তল ধরে আছে। একটু নড়চড় করলেই গুলি চালিয়ে দিবে। অথচ, তাদের হাতে কিচ্ছু নেই! পিস্তলটা পযর্ন্ত সঙ্গে রাখেনি। নোমান রোবটের মতো স্থিরচোখে বললো,

– স্যা-স্যা-স্যা..
নোমানের তোতলানো কথাটা বুঝতে পারলো মাহতিম। ‘ স্যার, আমাদের হাতে পিস্তল নেই। এ্যাকশন কিভাবে নিবো? ‘। দুই মিনিটের মতো স্থির রইলো মাহতিম। বুকের স্পন্দন অতিমাত্রায় বেশি। ক্রোড়ে আবদ্ধ মানুষটার প্রতি ভয় অনুভব করছে। নিজের প্রতি ধিক্কার, প্রচণ্ড আক্ষেপ, অসম্ভব ঘেন্না হচ্ছে! ভয়ের কাছে ঝুঁকে যাচ্ছে মাহতিম। আজ যদি একা হতো! হায়, যদি একা হতো!

কে জানতো পিঠ-পেছনে এমন মানুষ আসবে। কে বুঝতো এভাবেও চক্রান্ত হতে পারে। নোমান নিঃস্ব-রিক্ত-শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে তাদের গাড়ি থেকে হেডলাইটের আলোটা অন-অফ হচ্ছে। মাহতিম এমনভাবে হেরে যেতে চায় না। পরিস্থিতির কাছে নত স্বীকার করবে না। কোনো চেষ্টা ছাড়া পরাজয় কাম্য না। নিজের বিচক্ষণ সত্তা ক্ষুণ্ণ হবে, মোটেও চায় না মাহতিম। আজ আবারও সুস্থির মাথাটা ঘাঁটতে লাগলো।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৩

চোখের সামনে বিপদ, পেছনে মৃ:ত্যু। এমন স্থিতিতে ভাবতে লাগলো সে। ভাবতে-ভাবতেই হঠাৎ কিছু একটা মনে পরলো তার। অন্ধকার ফুঁড়ে আশার আলো দেখতে পেলে যেমন স্বর্গসুখ হয়, ঠিক তেমনি একটা সুখকর অনুভূতি হলো। ক্ষুরধার দৃষ্টিতে বাঁকা হাসলো মাহতিম। খেলাটা তবে শুরু হোক।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৫