মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৫

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৫
ফাবিয়াহ্ মমো

পিস্তল তাক করা। যেকোনো মূহুর্তে গুলি চালাবে। সামনেও গাড়ি, পেছনেও গাড়ি। রাস্তা পুরোপুরি ব্লক করা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বইছে। আকাশ বিদীর্ণ হয়ে ফর্সা আলো ফুটতেই ভূমি কেঁপে উঠল। প্রচণ্ড জোরে বজ্রপাত হলো। নোমান চোখ খিঁচে ফেললেও মাহতিম পুরোপুরি শান্ত। ক্ষুরধার দৃষ্টিটা সামনে বজায় রেখে নোমানের উদ্দেশ্যে বললো,
– রুফ-টপ লাইটটা বন্ধ করো।

নোমান ভীরু চোখে লুকিং মিররে তাকালো। বসের চোখদুটো ঘোর বিপদে এখনো স্থির দেখাচ্ছে। একটুও চন্ঞ্চল হয়নি। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির লেপন দেখে একটু ভরসা পেলো নোমান। বাঁ-হাত দিয়ে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় তর্জনী চাপতেই গাড়ির ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেলো। আর দেখতে পেলো না লুকিং-মিরর। চাপা উদ্বেগ ও উত্তেজনার ভেতর বুক ধ্বক-ধ্বক করছে। গলা শুকিয়ে তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো অবস্থা। তখনই চোখের সামনের একটা দৃশ্য উদয় হলো। গাড়িতে বসা লোকগুলো টার্গেট ঠিক করছে, গুলি চালাতে কয়েক সেকেন্ড মাত্র বাকি! অবস্থা গুরুতর দেখে চোখ বড় করলো নোমান। ঠোঁট ফাঁক করে মুখ হা করতেই পেছন থেকে আজ্ঞা সুর ভেসে এলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– তাড়াতাড়ি গদি উঠাও নোমান! এ্যাকশনে নামো, কুইক!
কঠিন আজ্ঞাটা শুনতে-না-শুনতেই সিটবেল্ট খুললো নোমান। উত্তেজনার চোটে হাত নড়তে চাইছে না। নোমান আতঙ্কের সাথে পাশের সীটে চাইলো। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে একটান মেরে শক্ত গদিটা উঠালো। সেখানে দুটো রিভলবার! চোখ ঝলসানো আনন্দে চমকে উঠলো নোমান! বস্ এতো সুন্দর কাজ করেছে? গদির নিচে অস্ত্র! খুশির প্রথম রেশটা কাটিয়ে না উঠতেই চটাস করে কাঁচ ভেঙ্গে উঠলো! সটান মেরে ঝুঁকে পরলো নোমান। সামনের গাড়ি থেকে সমানে গুলি চালাচ্ছে! কোনো থামাথামি নেই! মাথা নোয়ানোর ফলে একটা গুলিও টার্গেট মতো লাগছেনা! বৃষ্টির সাথে-সাথে টুংটাং গুলির শব্দ হচ্ছে! পেছন থেকে মাহতিম রাগে-ক্ষোভে ফুঁসতে-ফুঁসতে দাঁত চিবিয়ে বললো,

– একটা চ:ড় লাগাবো বে:কুব! বসে-বসে গু:লি খেতে চাচ্ছো? তাড়াতাড়ি রিভলবারটা উঠাও!
বিপদাপন্ন পরিস্থিতিতে ভুল করেছে নোমান। রিভলবারটা না-তুলে উলটো ঝুঁকে রয়েছে সে। যেই পযর্ন্ত রিভলবারটা হাতে না-আসবে, সেই পযর্ন্ত বিপদ! চটজলদি একটা রিভলবার তুললো নোমান, জীবনের সবচেয়ে বড় রিস্কটা চাক্ষুষ করে একনাগাড়ে গুলি চালালো। পরপর এক রাউন্ড গুলি চালাতেই সামনের গাড়িটা থামলো। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছে নোমান। বুক উঠানামা করা অবস্থায় রিভলবারটা দুহাতে ধরে আছে। নোমান কয়েক মিনিটের জন্য সামনের গাড়িকে থামিয়ে দিয়েছে। সেই সুযোগে গাড়িটা জানালা বন্ধ করে কিছুটা পিছিয়ে গেলো। নোমান দৃশ্যটা দেখতে-দেখতেই রিভলবার নামিয়ে হাঁপানির সুরে বললো,

– স্যার, স্যার ওরা পিছাচ্ছে। ওরা পিছিয়ে যাচ্ছে। এখন কি করবো স্যার? রাস্তা এখনো ব্লক! ওরা আমাদের ছাড়েনি। বেরুনোর উপায় পাচ্ছি না। বৃষ্টির জন্য নেটওয়ার্ক নেই। রেসকিউ টিমকে ডাকতে পারবো না। সামনে-পিছনে দুটো গাড়িতে মোটামুটি দশ-বারো জন। ওদের সবার কাছে অস্ত্র! এই মূহুর্তে —

মাহতিমের তীক্ষ্মদৃষ্টি বিপদ্দশার সূত্র মেলাতে ব্যস্ত। দু’কানে নোমানের সমস্ত কথা শুনলেও মাথা খাটাচ্ছে অন্যদিকে। তার বিচক্ষণ দৃষ্টি বলছে, এটাই মোক্ষম সুযোগ, আর দেরি নয়। মাহতিম চট করে মাথা ঘুরিয়ে ডানদিকে তাকালো। সেদিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘুমন্ত মেহনূরের মাথাটা বুক থেকে তুললো। উষ্ণ দেহটা কোলের উপর বসিয়ে গায়ের সাথে মিশাতেই ছোট বাচ্চা যেমন কোলে বসে মাথাটা কাধে রাখে, গলা ও ঘাড়ের মধ্যখানটায় মুখ লুকোয়, দু’খানি হাত জড়োসড়ো করে গলা পেঁচিয়ে ধরে, মেহনূরও জ্বরের ঘোরে শীতের কাঁপুনি নিয়ে মাহতিমকে জড়িয়ে ধরলো। মাহতিমের বাঁকাধের কাছে ছোট্ট মুখটা গুঁজে দিলো। দাঁত লাগা শীতে ঠকঠক করছে মেহনূর। বাইরের বৃষ্টি যেন রন্ধ্রে-রন্ধ্রে শীত জাগিয়ে দিচ্ছে। একটুখানি উষ্ণতার জন্য ছটফট করছে। অস্থির-চন্ঞ্চল পাখির মতো সাদা পান্ঞ্জাবীর কলারটা দুমড়ে-মুচড়ে দুহাতের মুঠোয় খাবলে ধরলো। ঠকঠকানো শীতে দাঁত কিড়মিড় করতেই মাহতিম ওর গরম কানটায় মুখ ঠেকিয়ে বললো,
– শীত করছে?

কথা বলতে পারলো না মেহনূর। দাঁতে ঠকঠক করতেই মাথাটা দূর্বলভাবে উপর-নিচ দুলালো। উত্তর পেয়ে পায়ের নিচটায় হাত দিলো মাহতিম। সেখানে থাকা ট্রাভেল ব্যাগে পানির বোতল, শুকনো খাবার, পাতলা কম্বল ও শুকনো টাওয়েল থেকে স্রেফ কম্বলটা টান মারলো। কম্বলটা বের করে সম্পূর্ণ ভাঁজ খুলে দুপাশে টান-টান করলো। কম্বলটা পুরোপুরি মেলতেই দুহাতে মেহনূরকে ঢেকে দিলো। আবারও কানের কাছে ঠোঁট ঠেকিয়ে নির্মল সুরে বললো,

– শুধু দশ মিনিট হ্যাঁ? শুধু দশটা মিনিট একটু কষ্ট করো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। আমি কাজটা শেষ করে নেই। নড়াচড়া কোরো না। আমার লক্ষ্মী বউয়ের মতো শান্ত থাকো। গুলির আওয়াজ চলবে ঠিকআছে? ভয় পেও না। কোনো ভয় নেই। এইযে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়েছি না? কোথায় লুকিয়ে আছো জানোতো? চুপ করে লুকাও।
মেহনূর মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। কম্বলের ওম ও মাহতিমের উষ্ণতা পেয়ে গুটিয়ে গেলো সে। আরো দৃঢ়ভাবে মাহতিমের ঘাড়টা জড়িয়ে ধরলো। মেহনূরকে আশ্বস্ত করে বুকভর্তি দম নিলো মাহতিম। চড়া দৃষ্টি এবার সামনের দিকে। পান্ঞ্জাবীর স্লিভদুটো গুটাতে-গুটাতে তেজালো কন্ঠে বললো,

– গিভ্ মি দ্যা রিভলবার। থ্রো ইট।
সামনের গাড়ি থেকে চোখ সরালো নোমান। বসের হুকুম পেয়ে অন্য রিভলবারটা হাতে নিলো। এখনো টান-টান উত্তেজনা চলছে। বস কি করতে চাইছে নোমান জানে না। রিভলবার যেহেতু চাইছে, তার মানে প্রস্তুত থাকা দরকার। নোমান কথামতো রিভলবারটা পিছনের দিকে ছুঁড়লো। হাতটা শূন্যে উঁচাতেই ক্যাচ্ করলো মাহতিম। ডানহাতে লোডেড রিভলবারটা নিতেই তর্জনী আঙ্গুলে বাই-বাই ঘুরিয়ে তিন আঙ্গুলে কবজা করলো। সেফটি-লক খুলতে-খুলতে সুস্থির গলায় বললো,

– গাড়ি স্টার্ট দাও। একবার সামনে, একবার পিছনে, একদম ডানদিকে মোড়। থাউজেন্ড সিসি। স্পিড সম্বন্ধে জানো।
নোমানের চোখদুটো ডানে-বামে ঘুরছে। অস্থিরভাবে কিছু একটা চটজলদি ভাবছে। চট করে মস্তিষ্কের চাকাটা ঘুরলো যেন! টনক নড়ার মতো ক্ষিপ্র গতিতে বললো,
– জ্বী স্যার, নো টেনশন। স্টার্ট দিচ্ছি। আপনি শুরু করুন।

জুনিয়রের পূর্বজ্ঞান দেখে গর্বসূচকে হাসলো মাহতিম। রিভলবারটা প্রস্তুত। নোমান সমস্ত আতঙ্ক চুরচুর করে আত্মকর্মে লিপ্ত। স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি স্টার্ট দিতেই বৃষ্টির উল্লাসধ্বনির মধ্যে ইন্ঞ্চিন গোঙিয়ে উঠলো! তৎক্ষণাৎ কালক্ষেপণ না-করে বাকি দুটো গাড়িও হুঙ্কার দিয়ে ফেললো। নোমান কানে শুনতে পেলো বসের আগাম খেলা। মনে-মনে কাউন্টিং শুরু করলো সে। থেমে-থেমে ‘ এক…দুই…তিন ‘ বলতে-না-বলতেই ফুল স্পিডে গাড়ি চালালো নোমান। পেছন থেকে মাহতিম একচোখ বন্ধ করে টার্গেট মতো শ্যূট করছে। আকাশ যেন ভারী হয়ে আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো।

দিনের আলো চারিদিকে ফুটতেই নোমান সামনের দিকে গাড়ি টানলো, লাগালো এক ধাক্কা! বিদ্যুপৃষ্ট হয়ে গর্জে উঠলো আকাশ। তবুও থামেনি নোমান। আবার স্টিয়ারিং ধরে প্রচণ্ড জোরে পিছিয়ে ঠেললো গাড়ি, ফের লাগালো ধাক্কা! পরপর দুই দফা ধাক্কার চোটে খেঁই হারালো গাড়িদুটো। অবস্থা খারাপ, সামনের কাঁচ ভেঙে শেষ। আকাশ যেন প্রকৃতির হিংস্রতা ও মনুষ্যলীলার কীর্তি দেখে গর্জন-তর্জন করছে।

সুযোগে দ্বিতীয় দফায় কোপ ফেললো নোমান। ডানদিকের পরিত্যক্ত জমিতে গাড়ি ছুটালো সে। আকাশের বেড়াজাল ফেটে শুভ্র আলোটা পরিষ্কার হয়ে ফুটছে। সেই কয়েক সেকেন্ডের আলোতে জমির শেষটা দেখলো মাহতিম। রাস্তা বেরিয়ে গেছে! কাঁচা জমিতে বেশ দক্ষতার সাথে গাড়ি হাঁকালো নোমান! বিরাট জক্কি পোহিয়ে শেষমেশ পাকা রাস্তায় উঠলো। পেছন থেকে ওই দুটো গাড়ি আসছে কিনা সাইড মিররে দেখলো। বহুদূর থেকে হেডলাইটের উৎস আলো আসছে। এখনো পিছু ছাড়েনি ওরা। নোমান ব্যাপারটা দেখার পর শান্ত-স্বাভাবিক রইলো।

হুড়হুড় করে আশি-চুরাশি-নব্বই ছুঁয়ে স্পিডের কাটা বাড়াতে লাগলো। গোঁ গোঁ শব্দে জনশূন্য হাইওয়েতে গাড়ি ছুটছে। ঠিক আধ ঘন্টার মধ্যেই কয়েক গজ দূরে কালো গাড়িটা ছুটে আসলো। মাথা পিছু ঘুরিয়ে গাড়িটার অস্তিত্ব দেখলো মাহতিম। বাঁহাতে মেহনূরের পিঠটা একদম বেষ্টন করে ফেললো। ডানহাতের রিভলবারটা কাঁচহীন জানালা বরাবর উঠালো। নিশানা মাফিক তাক করতেই ট্রিগারে আঙ্গুল চাপলো সে। সাথে-সাথে চলন্ত গাড়ির টায়ারটা ভয়ংকর শব্দে ব্লাস্ট হলো। মূহুর্ত্তের ভেতর গগনাঙ্গন চিঁড়ে বজ্রঘাত হলো। গাড়িটা ডানকাত হয়ে হেলে গেছে। পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে চাকাগুলো গোল-গোল ঘুরছে। রিভলবারটা নামিয়ে হাতটা সরিয়ে ফেললো মাহতিম। কাজ শেষ।

অস্থিরচিত্তে পায়চারি করছে রজনী। তার হাতে কালো কভারের ফোন। অপেক্ষা করছে কলের জন্য। গুরুত্বপূর্ণ কলটা আসেনি। কখন আসে কে জানে। এখনো কেন আসলো না? এতো দেরি হওয়ার না। তাহলে কি কিছু হয়েছে? একবার নিজ থেকে ফোন দেবে? কিন্তু কল দেওয়াও তো বিপদ। ওরা বলেছে, কাজ শেষ হলে নিজেরাই প্রাইভেট নাম্বার থেকে জানিয়ে দেবে। কিন্তু এখনো তো কল এলো না। মুখ তুলে দেয়ালঘড়িতে তাকালো। রাত সাড়ে এগারো। আকাশটা চমকাচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টি নেই। বোধহয় অন্য কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। কল দেওয়ার কথা এগারোটার দিকে। এখন দেখি আধ ঘন্টা লেট। তাহলে কি সত্যি-সত্যিই বিপদ হলো? রজনী এবার না-পারতে ভাইকে ফোন দিলো। আনসারী নিবাসে কেউ নেই। শুধু বিশ্বস্ত চাকর সিরাজ আছে। বুড়োটা যক্ষের মতো পুরো বাড়িটা পাহারা দিচ্ছে। কয়েক টোন যেতেই কলটা রিসিভ হলো। অপরপ্রান্ত থেকে মাতাল সুরে বললো,

– রজু,
রজনী ভ্রুঁ কুঁচকে পায়চারি থামালো। বিস্ময়কর চাহনি নিয়ে ঢোক গিললো সে। আবার মুখ তুলে ঘড়ির দিকে তাকালো। ফোনের ওপাশ থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। একটা নারীকন্ঠের চাপা আর্তস্বর শুনতে পেলো রজনী। এরপরই সেটা যেনো চেপে ধরলো কেউ। কন্ঠের জায়গায় গোঙানি শুনছে সে। দু’চোখে বিমূঢ় ভাব প্রকাশ করে রজনী ভয়ে ডুবলো। বড় ভাইয়ের এই নিকৃষ্ট স্বভাবের জন্য না জানি সব ভষ্ম হয়। এসব নিয়ে ইদানিং ভয় পায় রজনী। সেদিন সেই ছবিটা দেখানোর পর থেকে ভাই যেনো আগ্রাসী হয়ে গেছে। ছবিতে বারবার আঙ্গুল রেখে বলেছে,

– একে আগে আমার কাছে পাঠাবি। কয়েক দিন আমার কাছে থাকবে। কোনো বাড়াবাড়ি করবি না। আমি সময়মতো তোর কাছে পাঠিয়ে দেবো। রজু, একটা উত্তর দে। খাঁটি উত্তর দিবি। এমন টগবগ আগুন রেখে আনসারী কিভাবে থাকে? চোখ পরলেই মাথা নষ্ট। আমার মাথাটা ঝিঁঝি করছে। তুই এক কাজ তো, বরফ কুচি ছেড়ে একগ্লাস পানি নিয়ে আয়। ছবিটা দেখে শান্তি পাচ্ছি না। একে বাস্তবে লাগবে।

বাঁহাতের ঘড়িতে একপলক তাকালো মাহতিম। দুটো বেজে বিশ। বৃষ্টি আর কমেনি। রিস্কের জন্য আস্তে চালাচ্ছে নোমান। আর কিছু পথ বাকি। গাড়ির ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। মেহনূরের জ্বর কমেনি। লম্বা চুলটা ডানহাতে পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে খোপা পাকালো মাহতিম। ওর পিপাসায় কাতর ঠোঁটের কাছে বোতল কাত করলো। ঢকঢক করে পানি খেলো মেহনূর। অবশিষ্ট পানিতে ছোট্ট রুমালটা ভিজিয়ে নিলো মাহতিম। চিপড়ে বাড়তি পানিটা ফেলে জ্বরতপ্ত মুখটা মুছিয়ে দিলো। আস্তে করে হাতদুটো কম্বলের নিচে ঢুকালো। ডানহাতে ভেজা রুমাল, বাঁহাতে ধরলো গরম দেহটার ঘাড়।

খোলা পিঠের আবরুতে রুমাল রাখলো মাহতিম। নিঃশব্দে সারা পিঠময় জুড়ে ছুঁয়ে দিতে লাগলো। পুড়ে যাওয়া আস্তরণে যখন ঠান্ডা কিছু চাপা হয়, যখন জায়গাটা ব্যথানাশ হয়ে মনে-প্রাণে অদ্ভুত শান্তি জোগায়, ঠিক তেমনি আরামবোধে পরিপূর্ণ হলো মেহনূর। পিঠ জুড়ে শীতল স্পর্শের চালনায় সর্বাঙ্গে সুখকর অনুভূতিটা ছড়িয়ে পরলো। পাণ্ঞ্জাবীর কলার ছেড়ে ডানহাতটা নামালো সে। মাহতিমের শক্ত বুকটার বাঁদিকে দূর্বল হাতটা রাখলো। হাতের তালুর নিচে মাংসল পিন্ডটা কাঁপছে। অবিরাম স্পন্দনগুলো খুব টের পাচ্ছে মেহনূর। লম্বা-লম্বা আঙ্গুলে মৃদ্যুভাবে ছুঁয়ে দিতেই মাহতিম মুচকি হাসি দিলো। কন্ঠ খাটো করে স্বচ্ছ গলায় বললো,

– ইশারাটা বুঝতে পেরেছি ম্যাডাম। ধৈর্য্য ধরতে হবে। চাইলেও এই মূহুর্তে কিছু করা সম্ভব না। গাড়িতে আছি তো। বাসায় যাই, তারপর কেসটা দেখছি।
ইঙ্গিতটা কিসের ছিলো, বুঝতে পেরেছে মেহনূর। ঠোঁট-কাটা মানুষটার কথা শুনে এমন মূহুর্তেও হাসি পাচ্ছে। মেহনূর ফিক করে হাসতেই হঠাৎ চোখের পর্দায় রুগ্ন মুখটা ভেসে উঠলো। ফ্যাকাশে মুখ, শুস্ক ঠোঁট, বলশূন্য হাত, কঙ্কালসার দেহটা আর নেই। মনে পড়তেই বুকটা এঁফোড়-ওফোঁড় করে যেন ছিঁড়েই গেলো। মাহতিমের প্রশ্বস্ত কাধটায় কপাল ঠেকিয়ে কেঁদে উঠলো মেহনূর।

ঝরঝর করে বাইরের বৃষ্টির মতো তারও নয়নদুটিতে ঘোর বর্ষা নামলো। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো সে। সাদা পান্ঞ্জাবীর কাধটা চোখের শোকাহত অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে। ড্রাইভে থাকা নোমান নিরবমূর্তির মতো শুনছে। শরীরটা কি অসুস্থ! এই জ্বরের জন্য স্যারই এখন টেনশন করছে। নোমান যদি জানতো, একটা শোকাচ্ছন্ন মানুষকে কি করে সুস্থ করা যায়, তাহলে বলতে একটুও কার্পণ্য করতো না। কেনো জানি ম্যাডামের আর্তনাদটা খুব দুঃখ দিচ্ছে। কাছের কেউ হারালে এতো যন্ত্রণা হয়? এতো কঠিন যন্ত্রণা? নোমান নিজের পরিবার নিয়ে খুব চিন্তায় পরলো। সে তো তাদের জন্যই এতো দূরে-দূরে থাকছে। যদি বাড়ি থেকে এমন একটা ভয়াবহ সংবাদ চলে আসে? নোমান দ্রুত মাথা ঝাড়া দিয়ে চিন্তাটা উপড়ে ফেললো। নিচের ঠোঁটটায় জিভ ছুঁয়ে বললো,

– স্যার, সামনে একটা আর্মি ক্যাম্প আছে। যদি বলেন, তাহলে ওখানে ম্যাডামের জন্য —
সিরিয়াস কথার মাঝে বাধ সাধলো মাহতিম। কোনো ভণিতা না-করে পরিষ্কার জানিয়ে দিলো,
– আমি একা নই। বারবার একই কথা রিপিট করবো না। ক্যাম্পে থামানোর চেষ্টা করবে না। ওদের সাথে কুশল বিনিময় করতে আসিনি। ডিরেক্ট কোয়ার্টারে গাড়ি থামাও।

মাহতিমের স্পষ্ট আদেশ শুনে সেই মতো কাজ করলো। গাড়িটা ক্যাম্পের কাছে থামালো না। ভেজা সড়ক মাড়িয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটলো। পথিমধ্যে কোথাও দেরি করলো না। শেষের এক কিলোমিটার পথ মাত্র কয়েক মিনিটে টানলো। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে পৌঁছে গেছে। গেট দিয়ে ঢুকতেই দুপাশের দারোয়ান পা ঠুকে স্যালুট করলো। নোমান মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। এখানে ত্রিসীমানার ভেতর তাদেরই দাপট। অন্য কোনো যানবাহন ভুলে এখানে ঢুকে না। সবসময় সিকিউরিটি সিস্টেমে ঘেরা থাকে। অনুমতি ছাড়া কেউ প্রবেশ করে না।

রাস্তার দুধারে সারি-সারি ল্যাম্পপোস্ট। লম্বা ল্যাম্পপোস্টের মাথায় মস্ত গোলাকার বাতি। সেখান থেকে উজ্জ্বল আলোয় রাস্তাটা ফকফকা দেখা যাচ্ছে। নোমান এবার স্পিড কমিয়ে তুলনামূলক করলো। পেছন থেকে মাহতিম পথ-নির্দেশনা দিচ্ছে। সদ্য পাওয়া অফিশিয়াল কোয়ার্টারটা মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে পেয়েছে। এটা অবশ্য তার জন্য বরাদ্দ ছিলো। কিন্তু এতোদিন সে চূড়ান্ত আবেদন করেনি। তবে আজ করার সাথে-সাথে অফিস থেকে গ্রান্টেড হয়েছে। এ্যাপারমেন্টের রাস্তা ধরে সোজাসুজি বিশ মিনিট গেলো।

এরপর থামলো কোয়ার্টারের কাছে। গেটের বাইরে গাড়ি থামাতেই দু’বার হর্ণ বাজালো নোমান। বদ্ধ গেটটা থেকে ছোট একটা দরজা খুলে গেলো। সেখান দিয়ে বেরুলো দুজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সিকিউরিটি স্টাফ। দুজনের হাতে রাইফেল। মাথায় কালো টুপি। পায়ে শক্ত বুট। সেই বুট জুতা ঠকঠক করে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। মাহতিম জানালার কাঁচটা একটু নামিয়ে দিলে দুজনই সশস্ত্র ভঙ্গিতে স্যালুট করলো। দ্রুত ছোট গেট দিয়ে ফিরে বড় গেটটা খুলে দিলো। দুপাশ থেকে গেটটা খুলে যেতেই গাড়িটা স্টার্ট দিলো নোমান। সোজা ভেতরে ঢুকে কোয়ার্টারের দোরগোড়ায় থামালো।

বিছানায় শুয়ে আছে রজনী। রুমটা অন্ধকার। কপালের উপর কবজি ফেলে এখনো চিন্তা করছে। কতবার যে ঘড়ি দেখলো সে হিসেব নেই। নিঃশব্দ রুমটার ভেতর রিংটোন বাজছে। ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে। ফোনটা হাতে নিয়ে অস্থির ভাবে রিসিভ করলো। উৎকন্ঠার সাথে বললো,

– গা:ধার বাচ্চা! তোদের বলেছি না কল দিতে? দিয়েছিলি? কোথায় ছিলি এতোক্ষন? কল দিসনি কেন? খবর বল, তাড়াতাড়ি খবর বল। যদি একটা উলটাপালটা কথা শুনি, তোদের ছা:ল উঠিয়ে লবণ ঘষবো।
ওপাশ থেকে গালিটা তোয়াক্কাই করলো না। কন্ঠে একটা ক্ষমতাবান ভাব ফুটিয়ে বললো,

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৪

– চেতাচেতি কমায়া কইরেন। আমি এইসব ফছন্দ করি না। যারে মোল্লাবাড়ি থিকা তুইলা আনতে কইছিলেন, ছেড়িরে তুইল্লা আনোন যায় নাই। কেডায় জানি ম:রছে। আজকা নাগাল পায় নাই। আমাগোর এক গাড়ি উল্টায়াও দিছে। আর হুনেন, আপনের ভাইয়ে নতুন মালটারে মা:ইরা ফালাইছে। আমার ক্ষতিপূরণটা দিয়েন কইলাম। মাইয়াডা ওই লাইনে নতুন আছিলো। আপনের ভাইয়ে কামডা ঠিক করলো না। নেতা মানুষ হইয়া ইমিজ যে নষ্ট হইবো, হেই হুঁশডা হের এট্টুও নাই।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৬