মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২০

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২০
ফাবিয়াহ্ মমো

প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে মেহনূর। কোত্থেকে এসেছে? কে লিখেছে? এ ধরনের কার্যকলাপ ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। এতো গুপ্তভাবে কাজ? কেন? কিসের প্রয়োজন এটা? মেহনূর এলোমেলো চিন্তায় অপেক্ষা করতে বসলো। ঘড়িতে এখন বিকেল পাঁচটা। ডানহাতে তামাটে রঙের খাম। উপরে বড়-বড় বোল্ড হরফে ‘ M. Ansari ‘ লিখা। লেখাটায় বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁইয়ে মেহনূর মোবাইলের দিকে তাকালো। একদম দেরি না-করে বডিগার্ড মাসুদকে ফোন করলো। কলের টিউন যেতেই ঢোক গিললো মেহনূর, সময়ক্ষেপণ না-করেই রিসিভ হলো কলটা।

– ম্যাম, কোনো প্রয়োজন? ভেতরে আসবো?
মেহনূর হুলস্থুল ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
– আসতে হবে না। আপনি শুধু বলুন চিঠিটা আমি খুলতে পারবো কিনা। আপনার স্যার এখনো আসেননি। চিঠিটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ লাগছে।
মাসুদ একটু ভেবে হালকা গলায় বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– জ্বী ম্যাম। স্যারের অনুপস্থিতিতে আপনি উনার কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন। এ ধরনের অর্ডার আমরা পেয়েছি। এতে সমস্যা নেই। আপনি চিঠি খুলুন।
মেহনূর খুব শান্তমনে খামের মুখটা ছিঁড়লো। খামটা কোলের উপর উপুড় করতেই ভাঁজকৃত চিঠিটা বেরুলো। বুকটা দুরুদুরু করছে। চিঠির পাতায় হুমকিস্বরূপ কিছু পাঠালো? কোনো ভয়াবহ সন্ত্রাসী সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে? খুনের জন্য আগাম বার্তা পাঠালেও আশ্চর্য হবে না সে। মাহতিমের কর্মকাণ্ডের পেছনে শত্রু থাকাটা স্বাভাবিক ও শক্ত। মেহনূর দুহাতে চিঠিটা মেলে চোখের সামনে ধরলো। স্পষ্টভাষায় সেখানে লিখা,

আনসারী,
খবর পেলাম আপনি কোয়ার্টারে উঠেছেন। রাস্তায় এ্যাটাকের শিকার হয়েছেন। শোকর আলহামদুলিল্লাহ আপনারা সুস্থ আছেন। ভাবীকে আমার সালাম। আপনার সাথে দেখা করাটা খুব জরুরী। আপনি খুব বাজেভাবে ফেঁসে যাচ্ছেন ব্রাদার। কেসটায় তদন্ত করতে গেলে বিপদ। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপের মুখোমুখি হবেন। আমি কিছু ইনফো পেয়েছি যেটা শোনা খুব দরকার। আপনি আগামী সোমবার, রাত সোয়া এগারোটা, মালিবাগের কাছে দেখা করবেন। গাড়ির রঙ নেভি ব্লু, শেষ চার সংখ্যা আট-তিন-শূন্য-ছয়।

পুনশ্চ : আমি ওয়াসিফ পূর্ব থাকতে আপনার বিপদ হতে দেবো না ব্রাদার! যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি; আপনার চারপাশ থেকে সব ধরনের বিপদ তুলে নেবো। আমার মানুষ অলরেডি চর্তুপাশে ছড়িয়ে গেছে। যেকোনো সময় রণক্ষেত্রের বাজ পরবে। আপনি তৈরি থাকুন। একসময় আপনি যেই হেল্পটা করেছিলেন, আমি ভুলিনি আনসারী সাহেব। আমার বিপদের বেলায় আপনার নিঃস্বার্থ অবদানটা কোনোদিন ভুলবো না। আমৃত্যু আপনার প্রতি সম্মান থাকবে। আজ আপনার জন্য কিছু করার সুযোগ এলে আমি জান-প্রাণ এক করে প্রতিদান দেবো।

আপনার দুঃসময়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারবো না, সরি। কিছু দূর্নীতিবাজ, দুষ্ট লোকদের জন্য পিছু হটবেন না। আমার আকুল অনুরোধ! আমার হাত অন্যায়কারীরা বেঁধে দিয়েছিলো বলে সেদিন কিচ্ছু করতে পারিনি। আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জোচ্চোরের দলটা সেদিন হেসেছিলো। কোনো মানুষ আমাকে সাহায্য করতে পারেনি। আমার কাছের মানুষ আমাকে ক্ষতি করে গেছে। সৎভাবে থাকাটা কতো কষ্টের আমি বুঝি। আপনি স্বতন্ত্র, মুক্ত, স্বাধীনচেতা মানুষ। আপনার কাছে চমৎকার বলবুদ্ধির ক্ষমতা আছে। আপনি যদি আমার মতো বন্দি মানুষকে বের করার ক্ষমতা রাখেন, সেখানে আপনি সুউচ্চ চিন্তাভাবনা রেখেছেন নিশ্চয়ই। ভাবীর প্রতি সতর্ক থাকবেন। (মানুষকে দূর্বল দিক জানাতে নেই। সুযোগমতো আঘাত করতে দেরি করে না।)

ওয়াসিফ পূর্ব,
স্বপ্নমহল, ঢাকা।
বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে মেহনূর। চক্ষুকোটর স্থির। একনাগাড়ে চিঠিটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। মাথার উপর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে; তবুও সারা মুখ ঘেমে গেছে ওর। নিশ্বাস নিচ্ছে ধীরে-ধীরে। মূঢ় ভঙ্গিতে চিঠিটা নামিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে ‘ আল্লাহ্ রহম করো ‘ বললো। এতোকিছু কোনোদিন ভাবেনি সে। এতো গূঢ়তার সাথে মাথা ঘামায়নি। আজ তার মাথাটা বড্ড এলোমেলো হয়ে গেছে। জীবনের গতিধারা কত সরল ভাবি।

অথচ, আদৌ সেটা সরল? সরল নয় বলেই আমরা সাদামাটা গল্প খুঁজি। কোথায় একটু আনন্দের উৎস পাবো সেদিকে আকৃষ্ট হই। আজ মাহতিমের প্রতি মন দূর্বল হচ্ছে। অদ্ভুত কারণে তার প্রতি করুণার উদয় হচ্ছে। একটু-একটু করে অসহায় অনুভূতিটা বাড়ছে যেন। বেপরোয়া ভঙ্গিতে চলা শক্ত মানুষটা সবার কাছে যেমনই হোক; তার কাছে নরমসুলভ মানুষ। তার কাছে একটি সবুজ পাতার মতো মনোরম কেউ। ঠোঁটজোড়ার সরল হাসিটা যখন দেয়, তখন মনেহয় বাতাসে দুলতে থাকা নব্য ফুলের মতো স্নিগ্ধ। সেখানে কোনো মিথ্যে নেই, কৃত্রিমতার ছোঁয়া নেই, অভিনয়ের লেশ নেই। সে যেনো নিজের সরল মূর্তিটা মেহনূরের কাছে সপে দেয়। আপ্রাণ সুরে বলে, ‘ আমাকে পরমাহ্লাদে যত্ন করো, দিনশেষ আমি তোমারই হবো। ‘ চোখদুটো বন্ধ করলো মেহনূর। মনের ভেতর ভয়-সংশয়ের কুণ্ডলী পাক খাচ্ছে।

গোটা সূর্যটা অস্ত গেলো। দিনের শেষ আলোটা নিভে অন্ধকার হলো। আকাশে ছড়িয়ে পরলো বেগুনি রঙের আভা। নীড়ে ফেরা পাখ-পাখালি দলবেঁধে ফিরছে। তারও ইচ্ছে হয় সব তল্পিতল্পা গুছিয়ে বাড়ি ফিরতে। কিন্তু, ডিউটির জন্য সম্ভব হয় না। মাহতিম নীরবে আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দিকে চাইলো। পাকা রাস্তার দুধারে ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলেছে। বর্তমানে ড্রাইভে আছে নোমান। মাহতিম সদাসর্বদার মতো পায়ের-উপর-পা তুলে ভাবুক স্টাইলে গাড়িতে বসে আছে। তার পুরো ব্যক্তিত্বে যেনো সৌম্যতার ছাপ। তার ধারালো দৃষ্টিটা এখন নোমানের উপর বর্তমান। সুক্ষ্ম জিনিসটা ধরতে পেরে অকাট্য গলায় বললো সে,

– অকারণে স্পিড তুলতে নিষেধ করেছি। লাস্ট ওয়ার্নিং নোমান। অর্ডার না মানলে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবো!
হঠাৎ এ ধরনের নির্দেশ শুনে বিষম খেলো নোমান। চোখদুটো একপলকের জন্য লুকিং মিররে রাখলো; পেছনে থাকা রাগী মুখটা দেখতে পেয়ে খাটো সুরে বললো,
– সরি স্যার, আর হবে না। খেয়াল রাখবো।

নোমানকে শক্ত কথা বলার পর ভাবনায় ডুবেছে মাহতিম। ডিউটি শেষ চারটার দিকে। এরপর যেতে হয়েছে আর্জেন্ট কাজে। স্বনামধন্য গোয়েন্দাতুল্য মানুষ তাশরিফ সাগ্রতের আমন্ত্রণ ছিলো। সেখানে কেটে গেছে চার-চারটি ঘন্টা। সাগ্রতের কাছে উপস্থিত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। মুখোমুখি সোফায় দুজন বসতেই মোদ্দাকথা শুরু করে। হাতের ট্রান্সপারেন্ট ফাইলটা কাঁচের টেবিলে রাখতেই গলা খাঁকারি দেয় সাগ্রত। প্রথম কথাটা মার্জিত সুরে বললো,

– মাহদির মৃত্যুটা এক্সিডেন্ট না স্যার।
মাহতিম কথাটা শুনে গম্ভীরভাবে বললো,
– বুঝলাম। কিন্তু প্রমাণটা পেশ করুন।
সাগ্রত মাথা নাড়িয়ে সম্মতিয় জানালো। ফাইলটা খুলে কিছু কাগজ এগিয়ে বললো,
– এই ফাইলে পোস্ট মর্টাম রিপোর্ট আছে। যদিও কবরস্থ লাশ থেকে শক্ত ক্লু পাওয়া না। তবে এটা নিশ্চিত, ঘটনাটা পরিকল্পিত খুন ছিলো। এখানে মগজাস্ত্র ব্যবহার হয়েছে স্যার। শক্ত ব্লান্ট ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করা হয়নি। আই মিন, কোনো ছুঁড়ি-কাঁচি-পিস্তল এ ধরনের শক্ত জিনিস ইউজ করেনি।
ফাইলের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে মাহতিম। প্রতিটি অক্ষর মন দিয়ে পড়তেই অন্যদিকে সাগ্রতের কথা শুনছে। সাগ্রত কাগজে হাইলাইট করা একটি লাইন দেখিয়ে বললো,

– এটা একটু খেয়াল করুন স্যার। এখানে ক্লিয়ার রেফারেন্স দেওয়া আছে। ওকে এমন কিছু খাওয়ানো হয়েছিলো; যেটা কিছু সময়ের জন্য ওর নার্ভ দূর্বল করে দেয়। এটার সাইড ইফেক্ট বডিতে পরেছে। রিপোর্টেও সাফ-সাফ লেখা। মানেটা বুঝতেই পারছেন, ভিক্টিমের দশা অনেকটা অচেতন ছিলো। ওইসময় আপনাকে যাই বলা হবে, আপনি চুপচাপ সেটাই করতে বাধ্য হবেন। আপনারা যেদিন সমুদ্র-সৈকতে নেমেছেন, সেদিনও একটা ঘাপলা হয়েছে। মৌসুমভেদে সী-বীচের কিছু জায়গায় মানুষের জন্য নিষেধাজ্ঞা থাকে।

সেখানে কাউকে যেতে দেওয়া হয় না। মাহদি যেখানে ডুবেছে, ওই জায়গাটা সীল্ড জায়গা ছিলো। ফাইলের পরের পৃষ্ঠায় একটা ম্যাপ আঁকা আছে। সেখানে দেখবেন রেড ফ্ল্যাগ দেওয়া একটা মার্ক। এটাই সেই জায়গা। এখানে কিছু লোক পাহারায় থাকে। তবে, মাঝে-মাঝে জায়গাটায় কেউ না-এলে পাহারাদাররা উদাসীন হয়ে যায়। তারা অন্য কাজে ব্যস্ত হয়। আপনার স্টেটম্যান্ট মোতাবেক, আপনি সাঁতার কেটে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু পথিমধ্যে থেমে যান, দ্যান ব্যাক করেন। স্যার, এবার আপনাকে আরো একটা তথ্য দেই।
দুহাতের ফাইল থেকে চোখ তুললো মাহতিম। সরাসরি সাগ্রতের দিকে তাকালো। সাগ্রত ডানহাতের মুঠোটা ঠোঁটের কাছে এনে হালকা কাশি দিয়ে বললো,

– আততায়ী একজন ভাড়াটে খু;নি। আমি সিক্রেট সোর্স থেকে জানতে পেরেছি, সে লাখ টাকার বিনিময়ে কাজটা সম্পন্ন করেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে বহু আগে থেকেই যুক্ত। অনেককে সে টুকরো-টুকরো করেছে। কিন্তু, প্রশাসনের দূরবস্থার জন্য কোনোদিন শাস্তি পায়নি। ওর ফার্স্ট টার্গেট কিন্তু মাহদি ছিলো না। টার্গেটে ছিলো একটা মেয়ে। আমার ধারণা, আপনিও সেই টার্গেট সম্বন্ধে আগে থেকেই জানতেন।

দু’জোড়া বিচক্ষণ দৃষ্টি একে-অন্যের দিকে নিবদ্ধ।ফাইল ধরা অবস্থায় তাকিয়ে আছে মাহতিম। সাগ্রতের দূরদর্শী বুদ্ধিকে বাহবা দিতে হয়। অনেককিছুই অনুমান করেছে সে। মাহতিম ফাইলটা বন্ধ করে নিরুদ্বেগ গলায় বললো,
– হ্যাঁ, মেয়েটা আমার ওয়াইফ। ওকে টার্গেট করা হয় এটা জানতাম। শেষপর্যন্ত সব আমার কন্ট্রোলে ছিলো। কিন্তু, কোন ফাঁকে সামান্য ভুলটা হয়ে যায় ধরতে পারিনি। মাহদি কখন চোখের বাইরে চলে যায়, ওই হিসাব মিলানো দুষ্কর। খুনির হাতে কমপক্ষে পাঁচ-সাত মিনিটের মতো সময় ছিলো। যা করার এইটুকু সময়ের ভেতর করেছে।

সাগ্রত সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। শার্টের বুকপকেট থেকে ভাঁজকৃত কাগজটা মাহতিমের দিকে বাড়িয়ে বললো,
– আপনার মা থাইরয়েডের রোগী। এটার জন্য প্রায়ই উনাকে বিদেশে যেতে হয়। আপনার বাবা যেই উইলটা করে গেছেন, সেখানে আপনি সমস্যা করেছেন। এই ধরনের সমস্যাও ব্যতিক্রমভাবে দেখছি। আজীবন দেখলাম সম্পত্তির লোভে ভাইকে কতকিছু করে ফেলে। খুন করতেও দ্বিধা করে না। আর আপনি নিজের নাবালক ভাইয়ের জন্য নিজের অংশই ছেড়ে দিয়েছেন। মাহদি কি এটা জানতো?
মাহতিম বিষণ্ণ ঠোঁটে হাসলো। ভারী নিশ্বাস ছেড়ে করুণ হাসিতে বললো,

– নিজের সন্তানের মতো আদর করেছি তো, এজন্য কোনোদিন হিংসা করতে পারিনি। আমাকে ‘ ভাই ‘ বলে ডাকতো। স্কুলে গার্ডিয়ান হিসেবে আমার পরিচয়টা বাবার আগে দিতো। ওর জন্য বাবার উইলে নিজের অংশ চাইনি। যদি কখনো আমার ভেতর হিংসা ঢুকে যেতো, যদি কখনো ওর অংশের প্রতি খারাপ চিন্তা ঢুকতো, তখন কি করতাম আমি? ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্ব লেগে যেতো। নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারতাম না। আমিতো বাবার ভালোবাসাটা পেয়ে গেছি। কিন্তু মাহদি তো কোনোদিন পেলো না। তাই ভাবলাম, আমার অংশে বাবার যতখানি উইল জুড়তো, সেটা ওর নামে কনভার্ট করে দেই। কিন্তু কে জানতো, দিনশেষে মাহদিই থাকবে না?

মুখটা নিচু করলো সাগ্রত। কি বলে সান্ত্বনা দিবে জানে না। মাহতিমের ফ্যাকাশে হাসিটা অনেককিছু বোঝাচ্ছে। কতখানি দুঃখ পেলে শোকের কথাটা হাসি দিয়ে বলছে! সাগ্রত ফাইলের কাগজ গুছাতে-গুছাতে বললো,
– স্যার, আমরা মানুষকে ‘ মানুষ ‘ মনে করি না। মনেকরি ‘ পশু’। মানুষ মনে করলে ভুলেও খারাপ কথা বলতে পারতাম না। চিন্তা করতাম দশবার। খুন —
মাহতিম কথাগুলো শুনলো কিনা বোঝা গেলো না। দূরে কোনো শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। এক অদ্ভুত হিংস্রতার সাথে বিড়বিড় করে বললো,

– ডু অর ডাই। কারেঙ্গে ইয়া মা;রেঙ্গে। হয় ম;রবো, নয় মা;রবো। ছেড়ে দিবো না কাউকে।
‘ – স্যার? কোয়ার্টার এসে গেছে। ‘
ঝটকা মেরে চোখ খুললো মাহতিম। ভাবনার চমক ভাঙতেই চারপাশে তাকালো। নোমান ড্রাইভিং সীট থেকে পিছু তাকিয়ে আছে। ডানপাশের দরজা খুলে বাইরে বেরুলো মাহতিম। মাথা থেকে ইউনিফর্মের টুপিটা খুলতেই ভেতরে প্রবেশ করলো সে। সঙ্গে-সঙ্গে কালো পোশাকের দুজন রাইফেলধারী গার্ড পা ঠুকে স্যালুট করলো। সম্মতি জানালো মাহতিম। টুপিটা বাঁহাতে বগলদাবা করে কলিংবেল টিপে দিলো।

কি ব্যাপার? এখনো দরজা খুললো না? মাহতিম আবার কলিংবেল টিপলো। অপেক্ষা করলো কিছুক্ষণ। কিন্তু, না; দরজা তো খুলছে না। আবারও ছাদে গিয়ে ঘুরাঘুরি করছে নাকি? কি মসিবত রে বাবা! এই রাতেও ছাদে যাওয়া লাগে? চুল ছেড়ে ঘুরতে দেখলে আজ ইচ্ছামতো বকবে। গরমে হোয়াইট ইউনিফর্মের শার্টটা ভিজে আসছে। মাহতিম এক্সট্রা চাবির জন্য যেই ব্যাক পকেটে হাত দিলো, তখনই ভূতুড়ে কায়দায় দরজাটা খুলে গেলো তখন। মাহতিম পকেটে হাত ঢুকানো অবস্থায় খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ মেয়েলি সুরে গেয়ে উঠলো কেউ,

– ‘ দুঃখটাকে দিলাম ছুটি আসবে না ফিরে ‘,
মাহতিম অবাক হয়ে তাকাতেই হুট করে বাইরে চুপি দিলো নীতি। একগাল হাসি দিয়ে তাকাতেই নীতির পেছন থেকে আরো দুটো মিষ্টিমুখ উঁকি দিলো। নীতি ও ফারিনের মেয়েলি কন্ঠটা আনন্দের সাথে গাইলো,
– ‘ এক পৃথিবী ভালোবাসা রয়েছে ঘিরে ‘,
মাহতিম প্রচণ্ড খুশিতে আশ্চর্য হয়ে গেছে। আমোদের সাথে উচ্চকন্ঠে বললো, ‘ তোরা এখানে? ‘
ওরা মাহতিমকে কিছুই বলতে দিলো না। এবার যেনো তাল মিলালো সামিক-সৌভিকের কন্ঠ,
– ‘ মনটা যেন আজ পাখির ডানা ‘।

মাহতিম কয়েক মিনিটের জন্য সবকিছু ভুলে গেছে। ওদের আকস্মিক আগমনে সে বাক্যহারা! সিঁড়ির ধাপে পা ফেলে উঠতেই দরজাটা পুরোপুরি খুলে গেলো। হাসিতে-খুশিতে তৌফ ও সিয়াম একসঙ্গে সুর তুলে দিলো,
– ‘ হারিয়ে যেতে তাই নেইতো মানা। ‘
মাহতিম দরজা পেরিয়ে ঢুকতেই নীতি ফিসফিসানো ভঙ্গিতে ঠোঁটের কাছে হাত রেখে গাইলো,
– ‘ চুপি চুপি চুপি স্বপ্ন ডাকে হাত বাড়িয়ে ‘,

মাহতিম সরল হাসিতে প্রফুল্ল হতেই দুহাত দু’দিকে মেলে দিলো। সবাই একযোগে হুড়মুড় করে জাপটে ধরলো মাহতিমকে। চর্তুদিক থেকে ঘিরে ধরলো আট-আটটি শক্ত বন্ধন। তারা খেয়ালই করলো না, মাহতিম প্রচণ্ড ঘেমে গেছে। তোয়াক্কাই করলো না, ওর ঘামে জবজবা ইউনিফর্ম। সবাই একে-অপরকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে হঠাৎ নিরব হয়ে গেলো। পিনপতন নিরবতায় উল্লাসিত করিডোরটা থেমে গেলো।

বেডরুমের কাছে মারজা ও মেহনূর একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে ওদের পুরো দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছে। কোনো এক অজানা কারণে সবাই মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। নিঃশব্দে প্রতিটি চোখের অশ্রু ঝরছে। হয়তো এই গানটা সেদিনের স্মৃতি, যেদিন ওরা সমুদ্রমুখী হয়েছিলো। একদিন এই গানের সমাবেশে আরো একজন যুক্ত ছিলো। সেই একজনের শূন্যতা আজ সবার অশ্রুতে দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি যেনো তৌফের পিঠটা কাঁপছে। তৌফের সাথে খুনশুটিটা সবচেয়ে মজবুত স্মৃতি ছিলো।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৯

‘ মন চায়, মন চায়,
যেখানে চোখ যায়, সেখানে যাবো হারিয়ে… ‘

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২১