মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৯

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৯
ফাবিয়াহ্ মমো

একটু ভয়, একটু জড়তার সাথে তাকালো। ছোট-ছোট পা ফেলে সামনে এগুলো। রুমের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ছোট্ট ঢোক গিললো। দরজাটা চাপানোর জন্য হাত বাড়িয়ে ঠেললো। আস্তে-আস্তে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রুমের চর্তুদিকে ক্রমশ শান্ত অবস্থা। বড়-বড় জানালা দিয়ে গজরানো বাতাস ঢুকছে। পর্দাগুলো হেলেদুলে লুটোপুটি খাচ্ছে। শাড়ির শেষপ্রান্তে খুঁট পাকাচ্ছে মেহনূর। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বারান্দার দিকে চেয়ে আছে।

দুপুরের পর সামনে যায়নি সে। খাবারের টেবিলে বসে থাকলেও মাহতিম তখন ব্যস্ত ছিলো। বাইরে থেকে আসার পর মাহতিম বেশ চিন্তিত। কি নিয়ে গবেষণা করছে মেহনূর জানে না। একটু পরপর নোমানের সাথে কথা বলছে। তাও কর্কশকণ্ঠে ধমকের সাথে চেঁচাচ্ছে। নোমানের অবস্থা এখন কতটা নাজেহাল, সেটাই চিন্তা করছে মেহনূর। একেকটা রামধমক খেয়ে চুপসে যাচ্ছে নোমান। বেচারার জন্য মায়া হলো ওর।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাহতিমকে আঁটকানোর পন্থা জানা থাকলে সুবিধে হতো। মেহনূর নিজেই যেখানে বেকুব বনে আছে, কেন ওর হাতদুটো ছুটিয়ে মাহতিম ইগনোর করলো, কেন ওয়াশরুমের দরজাটা বিকট শব্দ করে লাগালো, খাবার‍ের টেবিলে অপেক্ষা করার পরও কেন এলো না, মেহনূর অবশ্য জানে না। বারান্দা থেকে উচ্চকন্ঠের হুংকার ভেসে আসছে। কন্ঠের ঔদ্ধত্য দেখে সাহস পাচ্ছে না সে। যদি মাহতিম চটে যায়? যদি বিরক্ত হয়ে ক্ষোভ দেখায়? কিন্তু কেন রাগ করবে মাহতিম?

মেহনূর তো এমন কোনো দোষ করেনি, যার জন্য ভয় পাওয়া লাগবে। বাইরে পড়ন্ত বিকেল। বারান্দাটা খোলামেলা। রেলিংয়ের কাছে দাঁড়ালে শান্তি লাগে। দূর থেকে দেখা যায় শহর। অদূরে যানবাহন চলছে। এখান থেকে সেটা পিঁপড়ার মতো লাগে। আকাশে তাকালে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সূর্যাস্তের দৃশ্যটা কি চমৎকার! কোনো উপমা দিয়ে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। মেহনূর পা বাড়িয়ে বারান্দায় ঢুকলো। মুখটা ফেরালো ডানদিকে, যেদিকে মাহতিম ফোনে কথা বলছে।

পুরুষ্টু পিঠটা ওর দিকে ফেরানো, ডানহাতে ধরা ফোন। বসে আছে ঝুলন্ত কাউচে। গায়ে কালো স্ট্রিপের অফ হোয়াইট শার্ট। শার্টের বোতাম বোধহয় লাগায়নি। পেছন থেকে শার্টের দুপাশটা হাওয়ায় থেমে-থেমে উড়ছে। তাড়াহুড়োর জন্য স্লিভদুটো ফোল্ড করেনি। মেহনূর সেদিক বরাবর দৃষ্টি রেখে পা চালিয়ে দিলো। দুটো হাত পেটের কাছে মুচলেকা করছে সে। জড়োসড় চোখদুটোতে অপ্রস্তুত ভয়। বাঁপাশ থেকে টাটকা হাওয়া ছুটে আসছে, ডানদিকে রুমটার আয়তাকার জানালা। মেহনূর এগুতে-এগুতে কাউচের ঠিক পেছন এসে থামলো। বুকভর্তি দম নিয়ে মিহি গলায় কাশলো। ধমকের শেষ মূহুর্তে আঁটকে গেলো মাহতিম। শব্দটা তার কানে পৌঁছেছে। কানে ফোন ধরা অবস্থায় ফ্লোরে পা ঠুকে পাক দিয়ে ঘুরলো। মেহনূরের দিকে চড়া দৃষ্টি ফেলে উত্তরের জন্য তাকালো। মেহনূর আমতা-আমতা করে সরল গলায় বললো,

– বেলা চারটা বাজে। খাবেন না?
মাহতিমের চোখদুটো ডানে-বামে ঘুরলো। বুঝাই যাচ্ছে, কিছু একটা ভাবছে। কয়েক মূহুর্ত চুপ থেকে চোখদুটো স্থির করলো সে, মেহনূরের দিকে চোখ ফেলে স্বীকৃত গলায় বললো,
– আনো, তবে আমি বেশি খাবো না।

দুঠোঁটে মুচকি হাসলো মেহনূর। পেটের কাছে হাতদুটো স্বাভাবিক হলো তার। খাবারের জন্য চটপট ভঙ্গিতে ছুটে গেলো সে। ফিরে এলো কাঁচের প্লেট নিয়ে। ডানহাতে প্লেট, বাঁহাতে পানির বোতল নিয়ে কাউচের সামনে বসলো। মাহতিম তখনও কথার জরিপে ব্যস্ত। মেহনূর যখন পায়ের কাছে ফ্লোরে বসে পরলো, তখন নিচে বসার জন্য ঘোরতর আপত্তি জানালো মাহতিম। উঠে এসে পাশে বসার জন্য বাক্য ব্যয় করলো।

কিন্তু, শুনলো না মেহনূর। ঠোঁটের কাছে আঙ্গুল রেখে চুপ করতে বললো। মাহতিম অবাক! কান থেকে ফোনটা বন্ধ করে মেহনূরের দিকে তাকালো। তার প্রতিটি কথাকে পরাস্ত করে আপনমনে ভাত মাখাচ্ছে মেহনূর। ঝাল-ঝাল বাদাম ভর্তার সাথে ভাত মাখিয়ে লোকমা তুলে ধরলো। বাড়িয়ে দেওয়া লোকমার দিকে একপলক তাকালো মাহতিম, পুনরায় মেহনূরের দিকে দৃষ্টি রেখে সেটা মুখে পুড়ে নিলো। এই ছোট-ছোট আচরণগুলো মায়ের কথা ভাবাচ্ছে। ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরলে মা এভাবে খাইয়ে দিতো। মাহতিম বসতো বিছানায়, মা বসতো মেঝেতে।

পাশে বসার জন্য মাহতিম যখন রাগারাগি করতো, তখন এভাবেই ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চুপ করাতো সে। আজ মাহতিম বড় হয়ে গেছে। মা হয়েছে বৃদ্ধ। শৈশবের স্মৃতিগুলো এখন অতীতকাল। পুরোনো দিনগুলো ঠিক স্বর্গীয় সুখ। হাতছানি দিয়ে সেই যুগটা চলে গেছে। আজ বড়বেলায় কোনো আনন্দ নেই। কোনো সুখ নেই। ছোটবেলার মতো শাষন নেই। ধীরে-ধীরে বড় হতে গিয়ে সবকিছু বদলে গেছে। একসময় মাকে জড়িয়ে ধরা যেতো, কোনো বাছবিচার ছিলো না।

আর এখন দুহাত মেলে ধরতে গেলে অনেক কিছু ভাবতে হয়। সে আজ বড় হয়ে গেছে, আগের মতো ছোট নেই। আজ মা কতদূরে আছে। কতদিন দেখা নেই। আগে তো মায়ের আঁচল ছাড়া চলতো না। আর এখন? আনমনে লোকমাটা গিলতেই ঠোঁটের কাছে দ্বিতীয় লোকমার আর্বিভাব হলো। একটু ম্লান হাসলো মাহতিম। লোকমার দিকে তাকিয়ে শূন্য গলায় বললো,

– একসময় বড় হবার জন্য ছটফট করতাম। আজ আমি মুক্ত, স্বাধীন। আজ পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।
লোকমাটা ধীরে-ধীরে নামিয়ে ফেললো মেহনূর। প্লেটটা কোলের উপর রেখে মাহতিমের উরুতে হাত রাখলো সে। তার মনটা স্বস্তি পাচ্ছে না। ইদানিং মাহতিমের কথাগুলোর ভেতর এমন সুক্ষ্ম কিছু লুকানো থাকে, যেটা ভয় ধরিয়ে দেয়। মেহনূর নিজেকে শান্ত রেখে নম্রভাবে বললো,

– পুরোনো দিন মনে করে লাভ আছে? ওগুলো সুন্দর স্মৃতি। ওগুলো রেখে দিন। বড় হবার বাসনা সবার থাকে। সবাই চায় শাসনের বেড়াজাল ছিঁড়ে উড়াল দিতে। কিন্তু, শাসনগুলো যে বড়দের আদর ছিলো, সেটা অবশ্য বোঝা যায়নি। বড়রা আমাদের বুঝতে দেয়নি। ছোটবেলায় সব ব্যথা-কথা মুখ ফুটে বলা যেতো, বড়বেলায় সেটা মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। দাড়িপাল্লা দেখেছেন তো? দুটো পাল্লা সমান-সমান করার জন্য একটায় বাটখারা, অন্যটায় সামগ্রী রাখা হয়। যদি কোনোভাবে গড়মিল হয়, তাহলে কিন্তু উঁচুনিচু হয়ে যায়।

আপনার অবস্থাটা এখন ভারী পাল্লার মতো। আপনি কথার পাহাড় নিয়ে এতো মশগুল থাকছেন যে, আমাদের সম্পর্কের মধ্যে উঁচুনিচু অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। এইযে আপনি কথা চেপে সহ্য করছেন, সেটা কি ঠিক? আপনার চেহারায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আপনি মুষড়ে পরছেন। আপনার সহকারীকে যেভাবে ধমকাচ্ছেন, ওই বেচারা তো ভয়েই নাকাল হচ্ছে। শুনুন, খাওয়ার সময় কখনো মিথ্যা বলা যায় না। সত্য বলা নিয়ম। যেই দক্ষতার সাথে সবটা চেপে যাচ্ছেন, সেই দক্ষতার সাথে আমাকে খুলে বলুন।

মাহতিম মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটে-মুখে তৃপ্তির ঝিলিক। ডানহাত উঠিয়ে স্নেহার্দ্রে মেহনূরের মাথা বুলিয়ে দিলো। স্ত্রী হিসেবে এমন সৎ নারীকে পেয়ে গর্বে বুকটা জুড়িয়ে গেলো। মনটা ভীষণ আপ্লুত হলো তার। এমন নিবিড় আবেদন ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। মাথায় হাত বুলিয়ে স্বচ্ছ কন্ঠে বললো,
– সমুদ্র কিছু নিলে তা একসময় ফিরিয়ে দেয়। যেই সমুদ্রের বুকে মাহদির দম গেলো, ওটা এক্সিডেন্ট ছিলো না। ওকে খুন করা হয়েছে। হয়তো বাঁচার জন্য অনেক ছটফট করেছে, কিন্তু মাহদি পারেনি।

মাহতিম নির্লিপ্ত ভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার কাতর দৃষ্টি এখন আকাশের দিকে। কথাগুলো বলার পর মেহনূরের দিকে তাকায়নি। ওই দুঃখী-দুঃখী চোখে তাকাতে পারবে না। আপন কারোর দুঃখ দেখা খুব মুশকিল। উপর দিয়ে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, কিন্তু ভেতর-ভেতর পুড়ে যাচ্ছে সব। মাহতিমের মনে হলো, এই নিয়মটা শুধু সরল মানুষের জন্য খাটে। তারা আপনজনের দুঃখ নিতে পারে না। যদি মেহনূর সামনে না থাকতো, তবে তার চোখ দিয়েও দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরতো। কিন্তু সে স্বাভাবিক। যেনো কিছুই হয়নি। এরকম ঘটনা যেনো অহরহ ঘটে। কানে দু-একবার নাক টানার শব্দ পেলো, তবুও সেদিকে দৃষ্টি দিলো না। এরপর দ্বিতীয় যেই শব্দটা পেলো, সেটা শোনার সাথে-সাথে মুখ নামালো সে।

– খাওয়াটা শেষ করুন। খাবার নষ্ট করবেন না।
মাহতিম কোনো আপত্তি করলো না। চুপচাপ ছোট-ছোট হাতের লোকমাগুলো নীরবে খেয়ে নিলো। মেহনূরের চোখ-মুখ বড্ড লাল। নাক টানার শব্দ হলেও ফিসফিস জাতীয় আওয়াজ নেই। চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে, মুখ একদম স্বাভাবিক। যেনো খাইয়ে দেওয়াটা মূখ্য কর্ম। অন্যদিকে হুঁশজ্ঞান নেই। এরকম মূহুর্ত্তের জন্য বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কথাটি লিখেছিলো,
‘ যারা শান্তরূপে সহ্য করে, তারা গভীরতর রূপে আহত হয় ‘।

জীবনের প্রতিটি ক্ষণ এখন বাক নিচ্ছে। মোড় নিচ্ছে অজানা পথের দিকে। সেই পথের দিশা কোথায় ঠেকছে কেউ জানে না। মেহনূর কথাগুলো মেনে নিয়েছে। সে এখন শান্ত। মাহতিমকে পালটা প্রশ্ন করেনি। রান্নাঘরে এঁটো প্লেটটা রাখতে গিয়ে চোখ থেকে টলটল করে অশ্রু পরছিলো। মুখ চেপে শব্দটা আঁটকে নিয়েছে সে। তার যতটা যন্ত্রণা হচ্ছে, এর চেয়ে কঠিন যন্ত্রণা মাহতিমের হচ্ছে। এই নির্মম সত্যটা জানার পর উনি নিশ্চয়ই থেমে নেই। ফোনের-পর-ফোন করাটা স্বাভাবিক। মেহনূর যদিও খুনির ব্যাপারে শক্ত কিছু জানে না, কিন্তু খুনটা কে করতে পারে, সেটা সে আঁচ করেছে।

এবার হচ্ছে দেখার পালা। মেহনূর চোখের পানি মুছে নিজেকে স্থির করলো। কি কারণে মাহদির করুণ দশা হলো, জানতে চায় সে। তথাকথিত কি কারণে পেছনে লেগেছে? এটা কি প্রতিহিংসা? না অর্থের লোভ? কি কারণে চাল ফেলছে খুনিপক্ষ? মেহনূর ক্যালেন্ডারের পাতায় গোল মার্ক করলো। আজ ফেব্রুয়ারির আঠারো তারিখ। আসন্ন পরীক্ষার জন্য সময় নেই। বর্তমানে মাধ্যমিকের পরীক্ষা চলছে। এরপর শুরু হবে উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা। মনটা শক্ত করলো মেহনূর। তাকিয়ে রইলো ক্যালেন্ডারের দিকে। ঠিক তখনই বেজে উঠলো মোবাইল ফোন। ধ্যান ভাঙ্গলো ওর। মাথা ঘুরিয়ে বিছানার দিকে চাইতেই সেদিক বরাবর চলে গেলো। ফোনটা তুলে দেখলো, শানাজ দিয়েছে। মাহতিম এখন ঘরে নেই। সে গিয়েছে জরুরী কাজে। ফিরতে কিছুটা দেরি হবে সঙ্গে এটাও জানিয়েছে। মেহনূর কথাটা শোনার পর একটা মাত্র প্রশ্ন করেছে,

– সঙ্গে ভারী জিনিসটা নিয়েছেন?
দরজাটা খুলেই মাথা ঘুরায় মাহতিম। মেহনূরের দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসে। জুতা পরা ডান পা-টা ঠকঠক করে ফ্লোরে ঠুকে। ইঙ্গিতটা শান্তভাবে ছুঁড়ে নব্ মোচড়ে বেরিয়ে যায়। সদর দরজাটা নিজ থেকে লেগে যায়। শানাজের কলটা রিসিভ করে মেহনূর। প্রথম শব্দটা সে-ই বললো,

– আসসালামুআলাইকুম বুবু। কেমন আছো?
শানাজ একরাশ দুঃখ নিয়ে বললো,
– তুই কি আগের মতো…ওয়াআলাইকুমসসালাম। আছি কোনোরকম। এখন তো হাঁটাচলা করতে পারি নারে। পেটের বাবুটা এতো যন্ত্রণা দেয় যে কি বলবো। রাতে ঘুমাতে পারি না। তোর কথা বল। তুই কেমন আছিস? ওখানে সব ঠিক আছে তো?
মেহনূর যথাসম্ভব প্রফুল্ল কন্ঠে বললো,

– শান্তিতে আছি বুবু। এখানে কোনো সমস্যা নেই। শুধু একটা ব্যাপারে খারাপ লাগে। উনি যখন বাইরে যান, তখন খালি বাড়িতে থাকা যায় না। যেদিকে তাকাই, শুধু ভয়-ভয় লাগে। গা ছমছম করে। ভালো লাগে না।
ফিক করে হেসে ফেললো শানাজ। হালকা টিটকারি মেরে বললো,
– কিরে, বিয়ে তো আমার আগে করলি। এখনো আদর-ফাদর আদায় করলি না?
কথা শুনে মেহনূর চোখ বড়-বড় করে হা করলো। কি তাজ্জব কথা! বুবু এসব কি বলছে! মেহনূর সঙ্গে-সঙ্গে কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

– ছিঃ ছিঃ, কিসব বলছো বুবু! তুমি দেখছি লজ্জা-শরম ধুয়ে ফেলেছো।
শানাজ হো-হো করে হাসতেই বললো,
– ওমা! তুই লজ্জা পাচ্ছিস? তোর কি এখনো লজ্জা পাওয়ার বয়স আছে? সেইযে মাহতিম ভাইয়াকে চিনলি, এরপর থেকে তো তার কাছেই লুকাস। বাড়ির ঘটনাও দু-একটা শুনলাম। মরিচ পুড়িয়ে কি জঘন্য শিক্ষা দিলি! আবার বলে রান্নাঘরে খুচুর-মুচুর করেছিস? ডিফেন্সের ব্যাটারা সারাবছর দূরে থাকে তো। ওদের মনে প্রেম বেশি। তার উপর কোমলমতি বউ! আহাহাহারে, তুই জিতে গেছিস রে মেহনূর! তুই জিতে গেছিস।

রাগে কঠিন হতেই হেসে দিলো মেহনূর। ডানহাতে কপাল চাপড়ে চোখ বুজে ফেললো। ওপাশ থেকে শানাজ বকবক করে যাচ্ছে। এপাশ থেকে মেহনূর সব শুনে হাসছে। হঠাৎ সদর দরজায় ‘ ঠকঠক ‘ শব্দ হলো। মেহনূর হাসি থামিয়ে কৌতুহলী চোখে রুমের বাইরে তাকালো। শব্দটা বাইরে থেকে আসছে। আবারও ‘ ঠকঠক ‘ শব্দটা দরজায় আঘাত দিলো। এবার স্পষ্ট শুনেছে মেহনূর। চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শানাজ এখনো কথা বলে যাচ্ছে, সেদিকে মনোযোগ নেই মেহনূরের। সে এখন দরজার দিকে চেয়ে আছে। কানে ফোন আঁটা অবস্থায় নিচু স্বরে বললো,

– কলটা কাটো বুবু। কে যেনো এসেছে। দরজায় ‘ খটখট ‘ করছে।
চকিতে থেমে গেলো শানাজ। তৎক্ষণাৎ সাবধানী গলায় বললো,
– এ্যাই? ভাইয়া কি দারোয়ান রেখে যায়নি? তুই ফট করে দরজা খুলিস না। আগে দাঁড়া, ‘ কে ‘ সেটা জিজ্ঞেস কর।
মেহনূর স্থির চোখে দরজার দিকে এগুচ্ছে। আর কয়েক কদম দূরে আছে দরজাটা। শানাজের চাপা উদ্বেগের কন্ঠ শুনে মেহনূর ওকে আশ্বস্ত করলো। রয়েসয়ে বললো,

– চিন্তা কোরো বুবু। উনি শুধু দারোয়ান না। গার্ডও লাগিয়েছে। বাড়ির সামনে দুটো, পেছনে দুটো। মোটমাট চারটা লোক রাইফেল হাতে পাহারা দেয়।
শানাজ তবুও শান্ত নেই। বিপদ কখনো বলে-কয়ে আসে না। মেহনূর এখন একা আছে। যদি কিছু হয়ে যায়? শানাজ প্রচণ্ড ভয় নিয়ে কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই মেহনূরের গলা ভেসে এলো। কিন্তু কথাটা যেনো ওকে না, অন্য কাউকে বললো। কলটা এখনো কাটেনি। সবটা শুনতে চায় শানাজ। আবারও পেটের পীড়াটা বাড়ছে। ব্যথায় কপাল কুঁচকালো সে। বাঁহাতে ফুলা পেটটা বুলাতে-বুলাতে ঠোঁট কামড়ে রইলো। এখনো ডান কানে ফোন চেপে আছে। মেহনূর যেনো বললো,

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৮

– চিঠি? এই চিঠি কে পাঠালো? এখন কি চিঠির যুগ? আমার কোনো আত্মীয় তো চিঠি লেখে না। এটা কোথায় পেলেন মাসুদ ভাই?
শানাজ চুপ করে শোনার চেষ্টায় আছে। ওপাশ থেকে একটা মোটা কন্ঠ শুনতে পেলো,
– এটা ফেলে দিবেন না ম্যাম। এটা রেখে দিন। এটা আপনার জন্য না। এটা আনসারী স্যারের জন্য। এখানে কিছু কাগজ আছে। যেটা এসেছে বনানী থেকে। বাড়ির নাম ‘ স্বপ্নমহল ‘। আপনি বাইরে বেরুবেন না। দরকার পরলে আমাদের ডাক দিবেন।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২০