মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৮

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৮
ফাবিয়াহ্ মমো

মাহতিম কোনোদিন আঁচ করতে দেয়নি। ঘুণাক্ষরে বুঝতে দেয়নি। খুবই শান্ত-ধীর-চতুরতার সাথে প্রতি পদক্ষেপ এগিয়েছে। বুঝতে দেয়নি কেন মেহনূরকে সরিয়ে আনলো। কেন মা মরা শোকের মধ্যে থাকতে দিলো না। কেন সেদিন রওনার জন্য অস্থির ছিলো। কেন পথিমধ্যে দূর্ধর্ষ হামলার শিকার হলো। এতোসব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েও মাহতিম চুপ থেকেছে। শক্ত কারণটা বলেনি সে। বলাটা নিজের ভেতর গোপন রেখে সবার কাছে লুকোচ্ছে।

মোল্লাবাড়িতে আসার পর যেটুকু সময় থেকেছে, পুরোপুরি মেহনূরকে সঙ্গ দিয়েছে। তন্মধ্যে মাহমুদার গমন ছিলো আকস্মিকভাবে। সেখানে মানুষের হাত ছিলো না। প্রকৃতির নিয়মে যে চলে যাচ্ছে, তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা মানুষের নেই। বিপর্যস্ত পরিবেশ থেকে মেহনূরকে তুলে আনাটা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু অনুমানের বাইরে ছিলো রাত দশটার হামলা। এরকম কিছু আন্দাজ করার ক্ষমতা মাহতিমের ছিলো না। সে কাউকে বলেনি, কাউকে জানায়নি সেই রাতে সে ফিরছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

যেহেতু সে জানায়নি, তার মানে এখনো কেউ নজর রাখছে। নিশ্চয়ই মোল্লাবাড়ির পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছায়। নাহলে এতো সুক্ষ্ম হামলার চিন্তা সঠিকভাবে হতো না। ভাগ্য সহায় ছিলো, মাহতিম সেদিন মোকাবিলা করতে পেরেছে। কিন্তু আর কতো? দফায়-দফায় এসব কাণ্ড যেন বেড়ে চলেছে। থামার অবকাশ নেই। নাটকীয়ভাবে প্রতিবার বেঁচে গেলেও শেষপর্যন্ত আশা নেই। কখন কি হবে কেউ জানে না। রাজনৈতিক পলাবদল যখন সঙ্গোপনে ঢুকে গেছে, তখন লড়াই ছাড়া উপায় নেই।

যতপ্রকার কুকর্ম, অসৎকর্ম, উগ্রপন্থী আছে, এবার সব একযোগে মাঠে নামবে। বাঁচার জন্য ফাঁকফোঁকর যে থাকবে, তা অবশ্য আশা করা যায় না। রহসের গাছকে ছুঁয়ে ফেলেছে মাহতিম। ধীরে-ধীরে পাতায়, শাখায় ধাবমান হয়ে মাটিস্থ শিকড়ের দিকে এগোচ্ছে। এবার হয় শিকড় সুদ্ধো উপড়ে ফেলবে, নয়তো মূল-সহ ভষ্ম করে দেবে। কিন্তু একদণ্ড ছাড় দিবে না সে। জীবনের যেই ক্ষতযুক্ত সময় সে কষ্টের সাথে কাটিয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ যন্ত্রণা এবার রোমে-রোমে ভোগ করিয়ে ছাড়বে।

চর্তুলোভী মানুষের ছায়া খরার মতো ধ্বংস করবে মাহতিম। আর ছাড় নয়। আর ছাড় নয়। মূলহোতা, মূল ব্যক্তিকে ধরার জন্য বদ্ধপরিকর সে। এজন্যই সবদিক থেকে রাস্তা ক্লিন করে সামনের দিকে এগুচ্ছে। মাকে পাঠিয়ে দিয়েছে বিদেশ। চিকিৎসার অজুহাতে আঁটকে দিয়েছে সে। সৌভিকের কাকা সৌভিককে বেশ ভালোভাবে জব্দ করেছে। দেশের মাটিতে পা ফেলার ফুরসত দেয়নি কাকা।

নীতি-প্রীতিরা যথেষ্ট মডার্ণ। এদিক থেকে বিপদের গন্ধ পেলে তারা নিজেরাই সটকে পরবে। তৌফরা একধাপ বেশি চালাক। ঘুড়ির নাটাই হাতে নিয়ে চড়কি ঘুরাতে প্রস্তুত। বাকিটা যদি মাহতিম বাতলে দেয়, তখন মুখোমুখি রণক্ষেত্র হতে বেশি দেরি নেই। সমুদ্রের বুকে মাহদির খুন হয়েছে। মাহদি যেখানে বাঘের মতো বড়ভাইকে ভয় পেতো, মাহতিমের প্রতিটি কথা মেনে চলতো, সেখানে বেশি পানিতে যাওয়াটা ঠিক অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। কি কারণে মাহদি সেদিন পানিতে নামলো? কি শুনে ওইটুকু ছেলে সমুদ্রের বুকে নেমে পরে? ওর নিষ্পাপ কানদুটোতে কিসের বুলি শুনিয়েছিলো শকুনের দল?

– আপনি ঘুমাচ্ছেন?
চিন্তার-ভাবনার-আক্রোশের দুনিয়া থেকে চোখ খুললো মাহতিম। মুখের উপর ঝুঁকে আছে হাসিমাখা মুখ। গালে হাত বুলিয়ে তাকিয়ে আছে মেহনূর। যখনই মাহতিম পুরোনো কাহিনি নিয়ে মশগুল হয়ে পরে, তখনই সে বিক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। অজানা কারণে তার মনটা ক্ষুণ্ণ হয়। ঘাসের উপর শুয়ে আছে মাহতিম, মাথার নিচে তার হাতদুটো পাতা।

সটান হয়ে শুয়ে আছে কোয়ার্টারের পেছন দিকটায়। যেখানে বড়-বড় গাছের সুশীতল ছায়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কচি ঘাসের মৃদ্যু-মৃদ্যু পরশে মন ঠান্ডা হয়। প্রকৃতির প্রাণখোলা বাতাসে গরমের রেশটা উবে যায়। শহরের মতো কানজ্বালা হর্ণ এখানে নেই। কান পেতে থাকলে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যায়। বাতাসে মিশে আছে মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ। মাহতিম চোখদুটো পুনরায় বন্ধ করে গম্ভীর সুরে বললো,

– না, ঘুমাইনি।
গালে হাত বুলানো থামিয়ে দিলো মেহনূর। চোখে কৌতুহল টেনে গম্ভীর মুখটার পানে চাইলো। এই সুন্দর মূহুর্তে কেন কর্কশকণ্ঠে জবাব দিলো? কিছুক্ষণ আগে তো সব ঠিক ছিলো। ঘাসের উপর বসে-বসে মাহতিমের গালে-বুকে আদুরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। কখনো চুলে হাত ডুবাচ্ছিলো, কখনো ছুঁয়ে দিচ্ছিলো মাহতিমের মুখ। আসল কারণটা জানার জন্য আঁকুপাঁকু করছে মেহনূর। ক্লিনশেভের গালটায় হালকা চাপ দিয়ে বিনীত সুরে বললো,
– আমাকে বলা যায় না? বললে ক্ষতি হবে? কখনো তো চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করিনি। সবসময় তো ‘ না না ‘ বলে

কথা এড়িয়ে যান। আজ নাহয় বলুন। দেখি কতটুকু শুনতে পারি। না-বললে তো কিছু বুঝবো না।
মাহতিম এক মূহুর্ত্তের জন্য ভাবলো। যে কথাগুলো চিন্তা করলেই মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, সেগুলো বলার সময় যদি গলা চড়িয়ে ফেলে? বলা যায় না। সে তো মেহনূরের সাথে উচ্চকন্ঠে কথা বলে না। যতটা পারে, রয়েসয়ে শান্তভাবে উত্তর দেয়। কিন্তু যে ব্যাপারে ও জানতে চাচ্ছে, সেটাতো এখন বলা সম্ভব না। মাত্রই শোকের মূর্ছা থেকে তুলে আনলো, এখন যদি এসব কথা বলে দেয়, তাহলে তো ঘায়ের উপর করাঘাত পরবে। মাহতিম চিন্তা শেষে চোখদুটো খুললো। যতটা সম্ভব শান্ত হয়ে নির্মল গলায় বললো,

– তোমাকে বললে ক্ষতি নেই। ক্ষতি তাদের জন্য হয়, যারা কথা রাখতে জানে না। তোমাকে তো সবই বলি, লুকানোর কিছু নেই। আমার কাছে জীবনটা রহস্যখেলা লাগে। কখন-কোনদিক দিয়ে পানি বয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। তুমি এখন আমার বুকে হাত রেখে বসে আছো। আমার পাশে সময় কাটাচ্ছো। এরকম চিন্তা গতবছর করতে পারতে? তোমার সাথে না-ছিলো যোগাযোগ, না-ছিলো কথাবার্তা।

ছ’মাস আগেও আমরা আলাদা ছিলাম, দুই বছর আগেও তোমার মা সুস্থ ছিলো, তিন বছর আগেও মাহদি বেঁচে ছিলো। অথচ, আজ দ্যাখো, চোখ খুললেই কেউ নেই। মাত্র কটা বছরের মধ্যে সুন্দর ছবিটা পালটে গেলো। আমাদের জীবন কত অদ্ভুত মেহনূর। এখন তো নিজেকে নিয়ে চিন্তা হয়। এই ইহজীবনে আর কতটুকু আয়ু আমার জন্য বরাদ্দ আছে জানি না। আর কতদিন চাকরিজীবন করতে পারবো, শেষপর্যন্ত তোমার পাশে থাকতে পারবো কিনা তাও জানি না। আমরা কত অনিশ্চয়তার সাথে দিন কাটাচ্ছি, তাই না?

মেহনূর করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো। গ্রীষ্মের থমথমে প্রকৃতির মতো চোখের পলক যেনো পরলো না। শব্দগুলোর মধ্যে বিষ মাখানো কিছু ছিলো, যেটা শোনার পর বাক্য ফুটতে চাইছে না। গাল থেকে নীরবে হাত সরালো মেহনূর, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিষণ্ণবদনে বললো,

– তবুও আমরা আশা রাখি। সব পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেব চুকিয়ে রাতে ঘুমোতে চাই। এটা কোনোদিন ভাবি না, আদৌ আমাদের জন্য আগামীকালটা বরাদ্দ আছে কিনা। জানেন, এখনকার দিনে বিচ্ছেদ হওয়াটা সহজ। আলাদ হওয়াটা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু, আমার মতো যারা একপাক্ষিক, যারা ভালোবাসার মর্ম শুধু একমাত্র পুরুষের কাছে শিখেছে, তাদের ক্ষেত্রে পুনরায় ভালোবাসাটা কোনোদিন সম্ভব না।

অন্য পুরুষের ছোঁয়া, আবার সংসার করা, এসব ভাবলেই মাথাটা ভোঁ-ভোঁ করে। আমার রুচিটা বোধহয় আদিকালের মতো। মানুষ শুনলে খুব হাসবে। এসব কথা তো মানুষকে বলতে পারি না, তারা আমাকে ‘ সেকেলে ‘ উপাধি দিবে। আপনার কাছে বলতে কোনো বাধা নেই। মন খুলে সব বলতে পারি। আপনার একটা জিনিস খুব সুন্দর। আপনি মানুষের কথাকে খুব মন দিয়ে শোনেন। আজকাল তো এরকম দেখি না। দুটো কথা কারোর কাছে বললে সেও একদিন বিরক্তমুখ দেখায়।

দুনিয়াতে কথা শোনার মানুষ কম। সেদিন যদি আপনি একগুঁয়েমি করতেন, আমিও যদি রাগ রেখে বিমুখ হয়ে যেতাম, সেদিনের ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরো প্যাঁচাতাম, তাহলে বোধহয় আমাদের সম্পর্ক টিকতো না। তখন সকলের মুখে-মুখে আমাদের বিচ্ছেদ নিয়ে মুখরোচক ঘটনা শোনা যেতো। আপনার চরিত্র নিয়ে নাক ছিঁটকাতো, আমার ভাগ্য নিয়ে অপয়া বলতো, আরো কত কুৎসিত কথা যে বলতো।

কিন্তু ভেতরকার কথা তো শুধু আমরা জানি। কিভাবে ছোট-ছোট ঘটনা মিলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো, সেই কথা তো কেউ জানে না। আমি বড্ড ভুল করেছি জানেন। সম্ভবত সেটার জন্য এতোগুলো মাস কষ্টভোগ করলাম। আমার উচিত ছিলো দুটো মিনিট আপনার কাছে বসা। যা যা অভিযোগ ছিলো, সব আপনাকেই শোনানো। যদি এই কাজটা করতাম, তাহলে আপনিও সব ভুলে চুপচাপ কথাগুলো শুনতেন। আমার সমস্যাটা বুঝতে আপনি পারতেন। আমি সেটা না-করে উলটো আপনাকেই দোষারোপ করেছি। যার হিতে-বিপরীতে দুজনই খুব দুঃখ পেলাম।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহতিম। ঠোঁটে মৃদ্যু-মৃদ্যু হাসি। মুখের উপর প্রশান্তিময় ছাপ। মেহনূরের চুপচাপ মূর্তিটা মনে পরলো ওর। এভাবে কথা শোনার জন্য খুব উদগ্রীব থাকতো। মেহনূর হবে স্পষ্টভাষী বক্তা, মাহতিম হবে মুগ্ধ শ্রোতা। সেই বক্তার সুমধুর কন্ঠে দিনভর ডুবে থাকবে, শুধু চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনবে। মাহতিম বুক ফুলিয়ে গভীরভাবে নিশ্বাস নিলো, মাথার নিচ থেকে ডানহাত বের করে মেহনূরের গাল ছুঁয়ে সশব্দে দমটা ছাড়লো। ঠোঁটে গর্বসূচক হাসি ঠেলে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো,

– হাতের মুঠোয় করে ছোট্ট একটা চারাগাছ এনেছিলাম। আমার গাছটা বড় হয়ে গেলো। যেদিন আমি বার্ধক্যে পৌঁছে যাবো, সেদিন তার প্রতি আমার দায়িত্ব শেষ।
মেহনূর প্রাণবন্ত ঠোঁটে হাসলো। ইঙ্গিতটা বুঝে গেছে।

কর্তব্য নিয়ে হেলা করেনি মাহতিম। যথাযথ ভাবে পালন করেছে। তিনদিনের ভেতর মেহনূরের বোর্ড পালটে অন্য বোর্ডে ফিরিয়ে এনেছে। সবটুকু কাজ সম্পন্ন করলো ক্ষমতার জোরে। সুপারিশের খত পাঠিয়ে দিলো উর্ধ্বতন জায়গায়। যেখানে ঘুষ দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো, সেখানে খাটালো বুদ্ধি। কিছু শক্ত ব্যক্তিদের আওতায় এনে কাজ করালো মাহতিম। যদিও এই বিশেষ লোকেরা মাঝে-মাঝে সাহায্য করে।

পুরোপুরি সাহায্যের ব্যাপারে আসে না। এখানে তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। সবাই নিজেদের গদি আঁটকাতে ব্যস্ত। ক্ষমতার লোভ কে ছাড়তে চায়? তারা সেদিক দিয়ে বেশি এগিয়ে। মাহতিম যেহেতু ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে হেডঅফিস থেকে সুপারিশ চেয়েছে, তাই কর্তৃপক্ষ সাহায্য করতে বাধ্য ছিলো। যেহেতু মাহতিমের হাতে সব কেস গ্রীন সিগন্যাল দিতো, তাই কর্তৃপক্ষ দ্বিধা করেনি। কিন্তু এ পন্থা অন্যান্য মেম্বারের জন্য খাটেনি। তাই নিয়ে অন্যান্য সদস্যরা বেশ ঈর্ষার চোখে দেখছে।

এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই মাহতিমের। সবকটাকে একরেখায় টেনে মৃদ্যু টাইট দিলেই কাজ শেষ। জঘন্যভাবে নাকানিচুবানি খাবে। সবার বিরুদ্ধে একটা-না-একটা জালিয়াতির প্রমাণ আছে। সেটা যদি কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে অনেকের চাকরি নিলামে উঠবে। এদিক দিয়ে মাহতিম স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক। কেউ তার সামনে চোখ তুলে তাকায় না, গলার স্বর উর্ধ্ব করে না, কোনোরূপ অসভ্য নেচার দেখায় না। রুলস মোতাবেক, কোনো শক্ত কারণ ছাড়া উচ্চপদস্থ কাউকে হেয় করলে সাথে-সাথে বরখাস্ত। এ নিয়ে মামলা অবধি করতে পারে। তাই আগ বাড়িয়ে মাহতিমকে ক্ষেপায় না। ক্ষেপাতে গিয়ে নিজেরাই বিপদে পরে। সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করে কোয়ার্টারে ফিরে মাহতিম। টয়েটো গাড়িটা গ্যারেজে রেখে ঘরে ফিরে সে। দরজার নব্ মোচড়ে ভেতরে ঢুকতেই হাসিমুখে ডাক দেয়,

– ও মেহনূর?
থমকে দাঁড়ায় সে। দুই ভ্রুঁ একত্র করে চর্তুদিকে তাকায়। প্রচণ্ড বিষ্ময় নিয়ে আবার ডাকতে থাকে,
– মেহনূর? তুমি কি ঘরে নেই? এ্যাই মেয়ে কোথায় গেছো?
চারিদিকে নজর বুলালো সে। তাড়াতাড়ি খাটের উপর ফাইল ছুঁড়ে দিলো। বারান্দায় চুপি দিলো সে, ওখানে কেউ নেই। ওয়াশরুম চেক করলো, সেখানেও খালি। পাশের বেডরুমে নব্ মোচড়ে ঢুকলো, রুমে কেউ নেই।

এদিকে লেফট পকেট থেকে মোবাইল জানান দিচ্ছে, রিংটোনের তীব্র আওয়াজ চর্তুদিকে ছড়াচ্ছে। মনেহচ্ছে দেয়ালে-দেয়ালে দামামা করছে রিংটোন। মাহতিমের সেদিকে একদম হুঁশ নেই। তার বুকের ভেতর ধড়ফড়-ধড়ফড় করছে। এখান থেকে বের হবার পূর্বে সব ঠিক ছিলো। মেহনূরও টেবিলে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ও কোথায়? ও এখানকার কিছুই চেনে না।

এখনো কোয়ার্টারের বাইরে নিয়ে যায়নি মাহতিম। দু-একজন অফিসারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাও ফর্মাল পরিচয়। মাহতিম কারো সাথেই মাখো-মাখো সম্পর্ক রাখে না। রিংটোন বাজতে-বাজতে বন্ধ হতেই আবার বেজে উঠলো। সংবিৎ পেলো মাহতিম। চমক ভাঙ্গার মতো কেঁপে উঠতেই পকেটে হাত ঢুকালো। বস্তুটাকে ঠান্ডা করে কানে চাপলো সে। ভেতর থেকে কথা বেরুতে চাচ্ছে না, তবুও ঠেলেঠুলে বললো,

– হ্যালো,
বিপরীত পাশ থেকে জবাব দিলো,
– আমাকে চিনতে পেরেছেন?
সতর্ক হলো মাহতিম। কপালের ভাঁজগুলো আরেকটু কুঁচকে গেলো। ঠোঁটের কোণাটা কামড়ে ভেবেচিন্তে বললো,
– সাগ্রত?
মার্জিত গলায় সায় দিলো সাগ্রত। হালকা কেশে বললো,

– জ্বী স্যার, তাশরিফ সাগ্রত বলছিলাম। মার্ডার কেস রিলেটেড। আপনি সম্ভবত বহুদিন আগে ইমেইল করেছেন, আমি ব্যস্ততার জন্য দেখতে পাইনি। সরি ফর মাই ইনকম্পিট্যান্স। আপনি যদি ফ্রি থাকেন, তাহলে একটা টাইম ফিক্সড করুন। আপনার সাথে আর্জেন্ট মিটিং জরুরি। কথাগুলো সামনা-সামনি বলতে চাই। আপনি যে ব্যাপারে ডাউট করছেন, সেটা ঠিক। ওটা এক্সিডেন্ট ছিলো না। গভীর বুদ্ধিসম্পন্ন খু:ন ছিলো। আপনিতো বডি পোস্ট মর্টাম করতে দেননি। আই নো, আপনার সফট কর্নার ছিলো। আপনি কাঁটাছেড়া চাননি। সেদিন পোস্ট মর্টামের অর্ডার দিলে আপনি সবটা জেনে যেতেন।

ধাক্কাটা নিতেই চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। কানে ফোন চেপে ঢোক গিললো সে। চোখের অন্ধকার পর্দায় মাহদির ছবিটা ভাসছে।বিশেষ কিছু বললো না মাহতিম। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে ছোট্ট করে বললো,
– টাইমটা ম্যাসেজ করে দিবো। আজ রাখি।
কলটা কেটে দিলো সে। ওমনেই পেছন থেকে দুটো হাত আস্তে করে জড়িয়ে ধরলো। আবেগময় কন্ঠে উচ্ছল সুরে বললো,
– আপনার কোয়ার্টারটা খুব সুন্দর। সবচেয়ে বেশি সুন্দর এই বাড়ির ছাদটা। ওখানে এতো ফুল, আমার না ছাদেই ভালো লাগে।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৭

মাহতিম নির‍্যুত্তর। কোনো প্রতিক্রিয়া দিলো না। বুকের কাছ থেকে হাতযুগলটা খুলে দিলো। কোনোকিছু না-বলে বিমুখ ভঙ্গিতে চলে গেলো। একবারও পিছু ফিরে মেহনূরকে দেখলো না। বেডরুমে চলে যেতেই ওয়াশরুমের দরজাটা ঠাস করে লাগালো। উৎকট শব্দের চোটে শিউরে উঠলো মেহনূর। তখনও অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিলো সে। পুরো মুখে আশ্চর্যের ভেলকি। মাহতিমের সরিয়ে দেওয়া হাতদুটো এখনো অটল। রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থমকে গেছে মেহনূর।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৯