মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৭

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৭
ফাবিয়াহ্ মমো

গভীর রাত। নিরিবিলি কোয়ার্টার। একটা ঠান ্ডা ভাব চর্তুদিকে ছড়িয়ে আছে। ট্যাপের ছলছল পানিতে মাথা ভিজছে। চুলের গোড়ায়-গোড়ায় আঙ্গুল চালিয়ে সিক্ত করছে। কখনো গরম মুখে ঠান্ডা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কখনো কপালের উপর পানি ছুঁয়ে জ্বর নিবারণ করছে। দীর্ঘকেশের গোছাটা বালতির মধ্যে ডুবে আছে। একরাশ শ্রান্তিতে চোখ বুজে আছে মেহনূর।

তার সুতনু দেহে খুব যত্নের সাথে শুশ্রূষা চলছে। যখনই জ্বরতপ্ত মুখে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পায়, তখনই ওর শরীরটা অদ্ভুত ভাবে শিউরে উঠে। শিরশির অনূভুতিটা বিদ্যুতের মতো সমস্ত দেহে বিচরণ করে। পায়ের তলায় কেমন সুড়সুড়ি অনূভুতি হয়। প্রতিটা ক্ষণেক্ষণে মনটা নরম হয়ে আসে। অসুস্থতার সময় একটুখানি সেবা পাবার জন্য মন কেমন আকুলিবিকুল করে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এই আকুলতা নিজের একান্ত মানুষকেও বলা যায় না, কখনো তাকে বিশদভাবে বোঝানোও যায় না। শুধু মন থেকে একটু বিশেষ সমাদর পাবার জন্য মনটা খুব উৎকণ্ঠায় ভোগে। কেউ যেনো তার অসুস্থতার সময় সেবা করুক, তার প্রতি দর‍দ মাখা সৌহার্দ্য দেখাক, সান্ত্বনার বুলি দিয়ে ক্ষুদ্ধ মনটা প্রসন্ন করুক, সেই রোগাক্রান্ত মানুষটা শুধু এটুকুই চায়। মেহনূর কথাগুলো ভাবতে-ভাবতে আবেগান্বিত হয়ে গেলো। চক্ষুজোড়া একটুখানি খুলে মাহতিমকে দেখার চেষ্টা করলো। ডানহাতটা তুলে ওই মানুষটার গাল ছুঁয়ে অম্লানবদনে বললো,

– হাত ব্যথা করে না?
প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসলো সে। ওর কপাল থেকে হাত সরিয়ে ট্যাপ বন্ধ করলো। হাসিটুকু ঠোঁটে রেখে হালকা সুরে বললো,
– করছে না।

এমনই উত্তর আশা করেছিলো মেহনূর। মুখ ফুটে তো কোনোদিন বলবে না। ট্যাপটা বন্ধ করতেই হালকা একটা টান দিয়ে বসিয়ে নিলো। একটা শুকনা টাওয়েল দিয়ে ভেজা মাথাটা মুছিয়ে দিলো। ভরা বালতি থেকে চুলের গোছাটা উঠিয়ে চটপট লম্বা চুলগুলো ঝেড়ে দিলো। মেহনূর নিরবে-নিরবে দুই চক্ষু মেলে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর, কি যত্নের সাথে সাদা টাওয়েলটা মাথায় পেঁচিয়ে দিলো। পুনরায় শরীর গুটিয়ে কোলে তুললো মাহতিম, রুমের দিকে হাঁটা ধরলে মুখের পানে চাইলো।

আজ গলাটা জড়িয়ে ধরেনি মেহনূর, হাতদুটো বুকের কাছে মুঠো করে কাঁপা-কাঁপি করছে। তখনই মাহতিমের খেয়াল হলো, গায়ের শাড়িটা, কালো ব্লাউজটা ভিজে গেছে। এই অবস্থায় আরো কিছুক্ষণ থাকলে ভয়াবহ ঠান্ডা লাগবে। এই ঠান্ডায় নিউমোনিয়া হলে বিপদের-উপর-বিপদ! মাহতিম চটজলদি বিছানায় নামিয়ে আলমারির দ্বার খুললো। সেখান থেকে বিশালাকার এক স্বচ্ছ প্যাকেট ফ্লোরে বের করলো। সাদা চেইনটা বাম থেকে ডানে টানতেই প্যাকেটের মুখটা উঠিয়ে ফেললো সে। একটা মোটা-ভারী কম্বল বিছানার উপর রাখতেই ফ্যানের রেগুলেটর কমিয়ে বললো,

– দুই মিনিট।
ঠোঁট ফাঁক করে ঠকঠক করতেই চোখ খাটো করলো মেহনূর। ‘ দুই মিনিট ‘ কথাটার ভাষা বুঝতে পারেনি সে। শীতে তার সমস্ত শরীর যে-হারে কাঁপছে, তার বক্ষতালু পযর্ন্ত প্রচণ্ড শিহরণে ঠুকছে। মেহনূর কাঁপুনে গলায় ঠেকে-ঠেকে বললো,
– ফ্যানটা বন্ধ করলে হয় না?

চট করে সুইচ টেপার শব্দ হলো। চর্তুদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে চারধার আবদ্ধ হলো। রুমের ভেতর নূন্যতম আলো নেই। অন্ধ তমিস্রায় ঢেকে আছে রুম। জানালাগুলোতে লম্বা-লম্বা পর্দা দেওয়া। বাইরের এ্যানার্জি বাল্বের আলো ফাঁকফোঁকর দিয়ে ঢুকছে না। মেহনূর এহেন কাণ্ডে চরম বিষ্ময় প্রকাশ করলো। কেন বাতিটা বন্ধ করলো? উনি কি শীতের অবস্থা দেখছেন না? কম্বলটা নিয়ে কাছে আসবেন না? কেন অন্ধকারটা করে দিলেন? এটা কি ভুলবশত করে বসলেন?

এমন সব প্রশ্নের কাছে জর্জরিত হতেই উঠে দাঁড়ালো মেহনূর, তখনই কাধের উপর হাত রাখলো কেউ। চমকালো না মেহনূর। হাতটা তার কাছে অন্ধের মতোই পরিচিত। সে চোখ বন্ধ করে এমন স্পর্শটা চিনতে পারে। অন্ধকারটা এখনো চোখ সয়ে আসছে না। বাঁ কাধের উপর হাতটা কিছু একটা করছে। কাধের কাছে ছোট্ট সেইফটিপিনটা খুললে চট করে সম্পূর্ণ আঁচলটা মেঝেতে পরে গেলো। আরক্ত মেহনূর তৎক্ষণাৎ হাতদুটো মুঠো করে ফেললো। সংকুচিত লজ্জায় ঢোক গিলে চোখ খিঁচালো সে। বুকের ছোট্ট যন্ত্রটা ঢিপঢিপ করে ছুটছে। দুটো শক্ত-দৃঢ় হাত মেহনূরের বাহুদুটো আঁকড়ে কাছে টেনে নিলো।

সিক্ত দেহটা অনুভব করলো শক্ত উন্মুক্ত বুক। কপালটা আস্তে-আস্তে নিশ্চিতভাবে পেশিময় বুকটায় ঠেকিয়ে দিলো মেহনূর। হাতদুটোর মুঠো খুলে সৌষ্ঠব্য পিঠটা আঁকড়ে ধরলো সে। চোখ বন্ধ করে বিহ্বলচিত্তে মিশে যেতে চাইলো, অধীর ভাবে ব্যাকুরচিত্তে লুকিয়ে পরতে চাইলো। নিজেকে আবদ্ধ করতে চাইলো মাহতিমের কাছে। মেহনূরের টাওয়েল পেঁচানো মাথায় থুতনি রাখলো মাহতিম। চোখ বন্ধ করে বুক ফুলানো নিশ্বাস টেনে জড়িয়ে ধরলো মেহনূরকে। সেই বিদঘুটে দিন, সেই অবসন্ন বিকেল, সেই ছেড়ে যাওয়া ক্ষণটুকু স্মরণ করলো মাহতিম।

বিচ্ছেদের ক্ষতটা রোমন্থন করতেই মেহনূরকে দস্যুর মতো জাপটে ধরলো। যেনো চুরি করা দামী বস্তুটা কেউ এক্ষুণি ছিনিয়ে নিবে। মেহনূর উষ্ণ আলিঙ্গনটুকু আশ্লেষের সাথে অনুভব করছে। এক নৈসর্গিক আবেশে ক্ষণেক্ষণে তলিয়ে দিচ্ছে। থেমে যাক মূহুর্ত, থেমে যাক। যখন গাছ থেকে অফুটন্ত ফুল ছেঁড়া হয়, মানুষ আকৃষ্ট হয়ে সেই নব্য ফুলের অস্ফুট পাতা একটা-একটা করে ছুটিয়ে ফেলে, তখন যেই ছোট্ট মুকুলটা বেরিয়ে সবশেষে আসে, ঠিক সেভাবেই মেহনূরের সমস্ত সিক্ত বসন একে-একে খুলে ফেললো মাহতিম। মাথার টাওয়ালটাও হালকা টানে খুলে দিলো। ভেজা চুলগুলো নিঃশব্দে ওর শরীর ছুঁয়ে হাঁটুর কাছে পরলো। সৌহার্দ্য আবেশে আচ্ছন্ন হৃদয়ে মেহনূরকে শুইয়ে দিলো মাহতিম। সদ্য আনা কম্বল দিয়ে গা ঢেকে নিজেও ওমের তলায় লুকিয়ে পরলো। নরম তুলতুলে বালিশটায় মাথা রাখলো সে। ডানদিক বরাবর কাত হয়ে দুহাত মেহনূরের দিকে বাড়িয়ে দিলো। অনুরোধের সুরে বললো,

– তোমার ভূষণ হবার সুযোগ দাও মেহনূর। আসো আমার কাছে।
চোখ সওয়া অন্ধকারে তাকিয়ে আছে মেহনূর। প্রচণ্ড শীত করছে। কম্বলের নিচে গুটিয়ে আছে সে। কিছুটা দূরত্বে শুয়ে আছে মাহতিম। বাড়িয়ে দেওয়া হাতদুটোতে একপলক চাইলো। আরক্তমুখে দৃষ্টি নামালো মেহনূর, লজ্জাতুর ক্ষীণ হাসিতে নিজের দিকে একপলক তাকিয়ে দু’চোখ বন্ধ করলো। এই বালিশ থেকে ওই বালিশের দূরত্বে যেতেই দুহাতে ওকে জড়িয়ে ফেললো মাহতিম। বুকের সাথে মিশিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ডানদিক থেকে বামদিকে এনে শোয়ালো। লম্বা চুলগুলো বালিশ ছাপিয়ে বিছানা গড়িয়ে ফ্লোরে যেয়ে পরলো। জড়িয়ে ধরা মেহনূরকে গভীর চুমু দিলো সে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেই প্রসন্ন কন্ঠে বললো,

– ঘুমিয়ে নাও। ঘুম থেকে উঠলে পুরোটা এরিয়া ঘুরিয়ে আনবো।
মাহতিমের উষ্ণকুঠিতে নিজেকে অর্পণ করলো মেহনূর। শ্রান্তির, তৃপ্তির, আসুপ্তির মেলবন্ধনে দুচোখ বুজে এলো তার। আরক্ষক মানুষটার কাছে নিশ্চয়তার আশ্বাস পেয়ে অনুরক্ত হলো সে। ছোট্ট একটা আবদার জানিয়ে বললো,
– সেদিন সন্ধ্যার মতো একটা গান শোনাবেন?
কপালে চুমু খেয়ে মাহতিম হাসলো। নিজের অপারগ ব্যাপারটা প্রকাশ করে বললো,
– গান যে পারি না। আমার তো চর্চায় নেই। একদম ভুলে গেছি। অন্য কোনো আবদার করো মেহনূর। ওসব রাখার চেষ্টা করবো।
মেহনূর গোঁ ধরে বসলো। আকুতি-মিনতি জানিয়ে আরেকবার বললো,

– শুধু একবার, একটুখানি, ওইদিনের মতো চোখে-চোখ রেখে একটুখানি শোনাবেন। আমি কিচ্ছু চাই না, কিচ্ছু চাইবো না। শুধু —
ঠোঁটে একটু ভালোবাসা দিলো মাহতিম। মাথাটা বুকে জড়িয়ে বললো,
– তাহলে এখন না। এখন ঘুমোও। একটু সময় দাও, দেখি কি করা যায়।

মনে-মনে একটা ব্যাপারে ভীষণ হাসি পেলো মেহনূরের। এই মানুষটা নিজেকে নিয়ে কত কথা বলেছিলো। রসকসহীন, ভোঁতা অনুভূতি, ক্রুদ্ধ মেজাজি আরো কতো কি। নিজেকে নিয়ে যথেষ্ট আক্ষেপ ছিলো তার। কিন্তু দিনশেষে মানুষটা ভীষণ রোমান্টিক। মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে পারে। কতটুকু আদর, কতটুকু যত্ন দিলে ভালোবাসার ব্যাখ্যাটা যথাযথ ভাবে বোঝানো যায়, সেটুকু সমাদর বুঝি মাহতিম আনসারী বুঝে।

শোকের ছায়াটা কাটেনি। বাড়ির অবস্থা থমথমে। সকাল এখন আটটা। মেহনূরের শূন্য রুমে বসে আছে শানাজ। পাশে কেউ নেই। শরীরটা বিছানার সাথে হেলান দিয়ে চুপ করে আছে। চোখদুটো ভরে-ভরে নীরব অশ্রু ঝরছে। ছোটমা নেই। বাড়িটা খালি হয়ে গেলো। যতবার চোখের সামনে ওই সরল-সহজ মুখটা ভাসে, বুকটা ডুকরে কেঁদে উঠে। নিজেকে খুব কষ্ট করে কান্না থেকে সামলায়। মনকে মিথ্যে কথার বুঝ্ দেয়। অনাগত সন্তানের জন্য নিজেকে শক্ত করে। পেটটা ফুলে উঠেছে ওর। আগের মতো অনেককিছুই করতে পারেনা সে। হাঁটাচলা করতে গেলেও সতর্ক হওয়া লাগে। খোলা দরজার কাছ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো তৌফ। হঠাৎ ঘরের ভেতরে চোখ পরতেই হাঁটা থামিয়ে ফেললো। দরজার কাছে ঠকঠক করে অনুমতি চাইলো তৌফ,

– ভাবী, আসি?
দরজার দিকে ধ্যান যেতেই হ্যাঁ জানালো শানাজ। হাতের উলটোপিঠে চোখ মুছে শান্ত হলো। অনুমতি পেয়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসলো তৌফ। আক্ষেপের সুরে সশব্দে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
– একা-একা কাঁদতাছো, এইটা ঠিক? এইসময় প্রেশার নিলে কেমন সমস্যায় পরবা জানো না? নিজের চিন্তা না-করলেও আমার ভাতিজার চিন্তাটা মাথায় রাইখো। আপাতত প্রেশার নিও না। খাইছো কিছু?
শানাজ চোখ বন্ধ করে নাক ফুলালো। গরম দু’ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে ঝরলো। হালকা করে ঢোক গিলে বললো,

– প্রেশার নিতে চাই না ভাইয়া। কিন্তু ছোটমা এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে ভাবতে পারিনি। আমার বাচ্চাটাকে দেখে যেতে পারলো না। এই দুঃখ কিভাবে বুঝাই? কিভাবে নিজেকে ঠান্ডা করি?
তৌফ পকেট থেকে ইনটেক টিস্যু বের করলো। প্যাকেটটা শানাজের দিকে বাড়িয়ে বললো,
– ঠান্ডা করা লাগবো। এছাড়া কোনো উপায় নাই। তুমি এভাবে হাউমাউ করে কাঁদলে আমার ভাতিজার প্রবলেম হইবো। টিস্যুটা ধরো। নাস্তা কিছু খাইছো?
তৌফের হাত থেকে টিস্যু নিলো শানাজ। চোখদুটো মুছে মাথাটা ‘ না ‘ ভঙ্গিতে নাড়ালো। নাক টেনে আস্তে করে বললো,

– গলা দিয়ে পানিই নামে না। খাবার কিভাবে খাবো? আপনি খাবারের জন্য জোরাজুরি করবেন না ভাইয়া। আমি সময় হলে খেয়ে নিবো। মেহনূরের কোনো খবর পেয়েছেন? কাল তো অনেকবার কল দিলাম। কেউ ধরলো না।
প্রসঙ্গ বদলে যেতেই চাঙ্গা হলো তৌফ। শানাজের কথায় সায় দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
– না, ওরা ঠিকঠাক মতো পৌঁছাইছে। রাতে —
কথা শেষ করার আগে ঘরে ঢুকলো সৌভিক। তৌফকে ইচ্ছে করে থামিয়ে শানাজের উদ্দেশ্যে বললো,
– তোমাকে সাবা ডাকছে। কি জানি দরকার আমাকে বলেনি। ওখানে একটু যাও, গিয়ে দেখো কিসের জন্য ডাকছে।

শানাজ সম্মতি জানিয়ে বিছানা থেকে নামলো। পা টিপে-টিপে সাবধানতা অবলম্বনে ঘর থেকে বেরুলো। সৌভিক ওর যাওয়াটা শেষপর্যন্ত স্বচক্ষে দেখে তৌফের কাছে ছুটে এলো। অনেকটা অস্থির ভাবে কন্ঠ খাটো করে বললো,
– তোর কি মাথা খারাপ? কি করতে যাচ্ছিলি? খবরদার কাউকে বলবি না। এখন যদি না-আসতাম তুই বলদের মতো শানাজকে বলে দিতি। ভাগ্যিস দরজার বাইরে দিয়ে যাচ্ছিলাম। মাহতিম যে বারবার শাষিয়ে দিলো তোর কানে ঢুকেনি? রামবলদের মতো এই কথা ফাঁস করতে গেছিলি কি জন্যে?
তৌফ নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে জিহবায় কামড় দিলো। ডান কান ধরে অপরাধীর ভঙ্গিতে বললো,

– সরি ভাই, সরি। বলতে সময় খেয়াল ছিলো না। বিশ্বাস কর্, মাহতিমের কথা একেবারে ভুলে গেছিলাম। আমার তো টেনশন হইতাছে সৌভিক। রাতে ডেন্ঞ্জারাস কিছু হইতে পারতো। কালকে আবার ওয়েদারও ভালো ছিলো না। তোর কি মনে হয়?
তৌফের কথাকে মান্য করলো সৌভিক। বিছানায় বসে ফ্লোরে তাকালো সে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শঙ্কিত গলায় বললো,

– কালকে বড় ধরনের বিপদ হতে পারতো। আল্লাহ্ রহম করেছে। আমিতো ভেবেই পাচ্ছি না, কে কাজটা করলো। মাহতিম যেখানে হুট করে যাওয়া স্থির করলো, সেখানে অপ্রত্যাশিত এ্যাটাক মানা যাচ্ছে না। ও যে কিভাবে সিচুয়েশনটার সাথে ডিল করেছে ভাবতেই আমার ভয় হয়। একবার চিন্তা করে দ্যাখ, মেহনূর অসুস্থ ছিলো। তার মধ্যে সম্পূর্ণ ভার ও একাই নিয়েছে। নোমান ড্রাইভে ছিলো। আমার জানামতে মাহতিম অস্ত্র নেয়নি। ও দাফনের সময়ও অস্ত্র নিয়ে যায়নি। ও শূন্যহাতে গোরস্থানে গিয়েছে, শূন্যহাতে গাড়িতে উঠেছে। এই অবস্থায় পিস্তল ছাড়া কিভাবে কন্ট্রোল করলো? কথা তাও না। কথা হলো, এ্যাটাকটা কোন্ পক্ষ করেছে?
প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো তৌফ। মনে-মনে উত্তরের ব্যাপারটা সাজিয়ে-গুছিয়ে নিলো। নিরঙ্কুশ গলায় শান্তভাবে বললো,

– পক্ষ একটাই। কেন করছে ওটাও বুঝিস। সবকিছু ব্যাখ্যা দিতে পারুম না। আঙ্কেলের একটা স্টেপের লিগা সব শেষ। সবকিছু বরবাদ। আফসোস লাগতাছে সৌভিক, যদি আঙ্কেল বাঁইচা থাকতো, অন্তত মাহতিমের কপালে দুঃখ আসতো না।
কথাটা শুনে বামে তাকালো সৌভিক। তৌফ একচুল ভুল বলেনি। তৌফের কথায় যুক্তি আছে। গভীর একবুক দম নিয়ে ধাতস্থ গলায় বললো,

– তৌফ? ওসব ডকুমেন্ট কোথায় আছে? এ ব্যাপারে তুই কিছু জানিস?
মাথাটা ‘ না ‘ করলো তৌফ। পরিস্কার জানিয়ে দিলো, ‘ জানে না ‘ । সৌভিক মুখটা ওর কাছ থেকে ফিরিয়ে নিলো। হাপিত্যেশের নিশ্বাস ছেড়ে স্থির চোখে বললো,
– ডকুমেন্ট মাহতিমের কাছেই আছে। নাহলে এ্যাটাক হতো না। কেন ওয়াসিফ পূর্ব চোখবন্ধ করে হেল্প করছে, এটাই বুঝতে পারছি না। সমস্যা হলো, পূর্ব ভাই মুখ খুলে না। কারণ জিজ্ঞেস করলে জীবনেও বলবে না।

রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। শান্ত-নিবিড়-ছিমছাম জায়গা। কোনো লোকাল যানবাহন চলে না। দূর-দূরান্ত পযর্ন্ত কোলাহল নেই। চারিদিকে সবুজ প্রকৃতি। পায়ের নিচে পাকা রাস্তা। পরিস্কার করা পরিবেশ। ঘুম থেকে উঠলেই মিষ্টি সুগন্ধ নাকে আসে। নাম-না-জানা বহু ফুল একত্র হয়ে মিষ্টি সুভাস ছড়ায়। সকালে ঠান্ডা বাতাস, মিষ্টি রোদ্দুর মন প্রফুল্ল করে। একটা সতেজ ভাবাপন্ন অবস্থা দেহমনে ছড়িয়ে পরে। বুকভর্তি নিশ্বাস টানলে নির্মল অক্সিজেন পাওয়া যায়। কম্বলের নিচে নড়েচড়ে উঠলো মেহনূর। নিদ্রার ভাবটা কেটে যেতেই মুখ থেকে কম্বল সরালো।

পুরো মুখের উপর এলোমেলো চুলগুলো সেঁটে আছে। মাথাটা ডানে-বামে নাড়া দিতেই কয়েকটা চুল সরে গেলো। মুখ হা করে হাই তুলতেই ডানদিকে হাত বাড়ালো। জায়গাটা শূন্য, কেউ নেই। ঘুম জড়ানো চোখে রুমের চারিদিকে তাকালো। ছিমছাম-সুন্দর-গোছানো রুমে উনি নেই। জ্বরটা ছাড়ার পর মাথাটা কেমন জানি করছে। শরীরটাও বুঝি দূর্বল। কম্বল সরিয়ে উঠতে যাবে, তখনই নিজের দিকে খেয়াল হলো। মেহনূর পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলো।

কম্বলটা বুকের কাছে দুহাতের মুঠোয় ধরলো। শাড়ি কোথায়? একটা বসন-ভূষণও গায়ে নেই। রাতের ঘটনা স্মরণ করলো মেহনূর। খুব জ্বর ছিলো, মাথায় পানি দিচ্ছিলো, এরপর… এরপর মনে পরলো ওর। শাড়িটা ভিজে যাওয়ার কারণে মাহতিম খুলে দিয়েছিলো। রাতের স্মৃতিগুলো ঘাঁটার জন্য চোখ বন্ধ করলো মেহনূর। কিভাবে বাহুডোরে আগলে রেখে আদর করেছিলো মাহতিম, কিভাবে আসঙ্গ মূহুর্তে — , ঠিক তখনই কানে ভেসে এলো পরিচিত সুর,
– ম্যাডাম উঠে গেছেন?

চোখ খুলে বামে তাকালো মেহনূর। কফি হাতে রুমে ঢুকছে মাহতিম। সরাসরি জানালার দিকে এগিয়ে দুহাতে পর্দাগুলো সরিয়ে দিলো। দিনের ফকফকা আলোয় পুরো রুমটা ঝকঝক করে উঠলো। মেহনূর কম্বলের নিচে আরেকটু সেঁটিয়ে বললো,
– আমার কাপড়?

থাই গ্লাসটা সরিয়ে দিলো মাহতিম। মাথা পিছু ঘুরিয়ে মেহনূরের দিকে চাইলো। ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে চোখদুটোয় ইশারা করলো। দেখিয়ে দিলো বিছানার কাছে। মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। একফালি সোনা রোদ্দুর মেঝেতে এসে পরেছে। জানালার পাটাতন থেকে কফির মগটা তুললো। গরম মগে ছোট্ট চুমুক দিয়ে আকাশে তাকিয়ে রইলো। নীল আকাশের বুকে থোকা-থোকা মেঘ। ভেসে বেড়াচ্ছে দিগ্বিদিক। কি চমৎকার! সুন্দর দৃশ্য, সাথে গরম কফি, সঙ্গে একটু গান। পকেট থেকে ছোট্ট রিমোট বের করে টিপ দিলো সে। হালকা ছন্দে মিউজিক সিস্টেমটা বাজতে লাগলো তখন।

গানের মিষ্টি-মধুর সুরটা চমৎকার লাগছে। চোখ জুড়ানো আকাশে নয়ন রাখতেই পেছন থেকে কাশির শব্দ এলো। কফিতে আরেক চুমু দিয়ে পিছু ঘুরলো সে। সাথে-সাথে কফি হাতে হেসে ফেললো মাহতিম। মুচকি হাসিতে আপাদমস্তক চোখ বুলালো সে। হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি, মোটা পাড়টা টকটকে লাল। চুলগুলো ডানপাশে সিঁথি কেটে আঁচড়ানো। লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। ব্লাউজটা অবশ্য লাল। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই কফিটা রেখে দিলো মাহতিম। অপলক দৃষ্টিতে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো।

মেহনূর লজ্জা মাখানো চোখে মাহতিমের ডানহাতটা আস্তে-আস্তে ছুঁলো। আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে কাছে এগিয়ে গেলো। খোলা জানালা দিয়ে দমকে হাওয়া আসছে। বেপরোয়া হাওয়ার তালে অদূরে বাজছে গান। মেহনূরের কোমরটা ধরে জানালার পাটাতনে বসিয়ে দিলো। হাতদুটো নিজের গলায় জড়ালো মাহতিম। চোখে-চোখ রাখতেই আবারও বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে। মাহতিম হাসি-হাসি ঠোঁটে ছন্দ মিলিয়ে গান ধরলো, আদর মাখানো সুরে গেয়ে উঠলো,

আজ এক নাম না জানা কোনো পাখি,
ডাক দিলো ঠোঁটে নিয়ে খড়কুটো।
আজ এলো কোন অজানা বিকেল,
গান দিলো গোধূলি এক মুঠো।
তুমি যাবে কি? বলো যাবে কি?
দেখো ডাকছে, ডাকলো কেউ।
তুমি পাবে কি? পা-পাবে কি?
সামনে বেপরোয়া ঢেউ।

এটুকু গাইতেই হাসি দিয়ে থামলো মাহতিম। মেহনূরের দিকে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ বাকি কলিটুকু পূর্ণ করে মেহনূর গেয়ে উঠলো,
ছুঁয়ে দিলে সোনাকাঠি খুঁজে পাই।
যদি যাই ভেসে, এমনি ভেসে যাই।
আজ এক নাম না জানা কোনো হাওয়া,
চোখ বুজে ভাবছে বেয়াদব ধূলো।
টুপটাপ বৃষ্টিফোঁটা গেল থেমে,
ভেজা-ভেজা খিড়কি দরজা তুমি খুলো।

থেমে গেলো মেহনূর। আবারও কয়েক সেকেন্ড চোখাচোখি তাকিয়ে একসঙ্গে গিয়ে উঠলো তারা। প্রকৃতির বাতাস সোল্লাসের সাথে জানালা দিয়ে, বারান্দা দিয়ে রুমের ভেতর ঢুকলো। দুটো গলা, দুটো সুর, দুটো অদৃশ্য মন একীভূত হয়ে গাইলো,

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৬

তুমি যাবে কি? বলো যাবে কি?
দেখো ডাকছে, ডাকলো কেউ।
তুমি পাবে কি? পা-পাবে কি?
সামনে বেপরোয়া ঢেউ।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৮