অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৮

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৮
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

‘ঢাকা বিভাগ জুড়ে পরপর আটটা রহস্যময় খু’ন। এতোদিন যাবত খু’নির সন্ধান করছিলেন সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর তুহিন আহমেদ। কিন্তু খু’নি অবধি পৌঁছতে পেরেছেন কি-না তা এখনো ধোঁয়াশা। শোনা গেছে, পলিটিশিয়ান শওকত মীর্জার জেষ্ঠ্য পুত্র শান মীর্জার ওপরের প্রা’ণ’ঘা’তি হামলা হয়েছে। মিডিয়ায় সামনে এই বিষয়ে এখনই কোনরকম কোন তথ্য দিতে রাজি হননি তুহিন আহমেদ। কয়েকবার চেষ্টার পরেও কোনরকম সাক্ষাৎকারে আনা যায়নি তাকে। তবে গতকাল কমিশনারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বোঝা গেছে সম্ভবত খু’নির সন্ধান পাওয়া গেছে। এখন কেবল তাকে পুলিশের আওতায় আনার অপেক্ষা।’

বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল তুহিন। আর পড়ল না। পড়ার প্রয়োজন বোধ করল না। অনেকটা অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মতোই পেপারটা ফেলে রাখল একপাশে। ধোঁয়া ওঠা কফির মগটা হাতে নিয়ে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়াল। বাইরে ঘন কুয়াশা। বেশিদূর কিছু দেখা যাচ্ছেনা। কনকনে শীত। চারপাশটা এইমুহূর্তে সাদাকালো সিনেমার মতো লাগছে ওর। ভিউটা খারাপ না। ভালোই। প্রকৃতির সৌন্দর্য বিশ্লেষণ ছেড়ে কেইসটার দিকে আবার মনোযোগ দিল তুহিন। খু’নির ছবি মিডিয়া আর নিউজপেপারে দেওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেছিল তুহিন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ও চায়নি খু’নি রুদ্র আমের এখনই জানতে পারুক সে ধরা পড়ে গেছে। এমনিতেই প্রচন্ড চালাক রুদ্র। কোনমতে টের পেয়ে গেলে ওকে ধরা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে যাবে। তাই খু’নির খোঁজ যে পাওয়া গেছে সে ব্যপারটা সম্পূর্ণ চেপে রাখতে বলা হয়েছিল ডিপার্টমেন্টকে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ নিজেদের জাহির করতে না পারলে শান্তি পায়না। অতি উত্তেজনায় নিশ্চয়ই বেফাঁস কিছু বলে দিয়েছে কমিশনার। না হলে কাগজে এধরণের কথা লিখবে কেন? কথাগুলো চিন্তা করতে করতে কফির মগে চুমুক দিল তুহিন। আজ একটু দেরী করেই বের হবে। ইরার সঙ্গে একটু কথা বলে যেতেই পারে।

কথাটা ভেবে ফোন বের করেই চমকে উঠল তুহিন। মনে পড়ে গেল ওদের বিচ্ছেদের কথা। এইতো সেদিনই দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্কের ইতি টেনেছে দুজনে। এখন আর কোন সম্পর্কে নেই তারা। কখনও ভাবেনি ওদের বিচ্ছেদ এতোটা সহজ হবে। এতো সামান্য কারণে ওরা আলাদা হয়ে যাবে। সামান্য! কারণগুলো কী আদোও সামান্য ছিল? সে বিষয়ে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে গিয়ে কেমন অন্ধকার দেখল তুহিন।

মনে হল ঘোলা পানিতে তলিয়ে গেছে। এতো জটিল জটিল কেইস সহজেই সমাধান করে ফেলা তুহিন এতো সহজ ব্যপারটার সমাধান খুঁজে পেল না। তুহিন বাস্তববাদী মানুষ। প্রেমে বিচ্ছেদ অস্বাভাবিক কিছু নয়। ও নিজেও যথেষ্ট স্বাভাবিকভাবে নিতে চাইছে ব্যপারটা। তবুও শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে। সত্যিই কী হারিয়ে ফেলেছে সে তার ইরাবতীকে? আর কিছুই করবার নেই। হতাশ হয়ে ফোনটা আবার রেখে দিল তুহিন। বুকের ভেতর কেমন খাঁ খাঁ করে উঠল ওর।

কিছুক্ষণ পর বারান্দার দরজার কাছে এসে দাঁড়লেন মাহমুদা। কিছুক্ষণ প্রাণভরে দেখলেন তুহিনকে। এমন একটা ছেলে যদি তার থাকত! সেই আফসোসটাই ত্যাগ করতে পারেন না মাহমুদা। কিন্তু এটা ভেবে শান্তিও পান যে, পেটে ধরেনিতো কী হয়েছে? মায়ের মতো যত্ন করে ভালোবাসা তো দিতে পারছে। এই বা কম কীসে? মৃদু হেসে মোলায়েম গলায় তুহিনকে ডেকে বললেন, ‘বাবা, আজ এখনো বাড়ি যে? অফিস যাবেনা?’
তুহিন ঘন কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, ‘যাবো। একটু দেরী হবে।’

‘ খাবার দেব?’
তুহিন একবার সময়টা দেখে নিয়ে বলল, ‘দাও।’
তুহিন ডাইনিং টেবিলে গিয়ে দেখল মাহমুদা পরোটা আর আলু দিয়ে মুরগির মাংস রান্না করেছেন। খিদেতে পেট চোঁ চোঁ করছে তুহিনের। তাই সময় নষ্ট না করে দ্রুত খেতে বসে পড়ল। মাহমুদা খাবার দিয়ে বসল তুহিনের পাশে। তুহিনের দিকে গভীরভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কী হয়েছে, বাবা?’
তুহিন খেতে খেতেই বলল, ‘ কই? কী হবে?’

‘ তোমাকে দেখছি আমি। কেমন একটা হয়ে আছো। কোনকারণে মন ভালো নেই তোমার?’
তুহিন হাসল। মাহমুদার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘কী দেখে এমন মনে হলো তোমার?’
মাহমুদা তুহিনের প্লেটে আলু দিতে দিতে বলল, ‘তোমার চেহারা, হাবভাব দেখে যে কিছু বুঝব সে উপায় রাখো তুমি? কিন্তু তোমাকে সেই ছোটবেলা থেকে চিনি আমি। এইটুকু বুঝি। কী হয়েছে? ইরা আম্মুর সাথে ঝগড়া করেছো আবার? কিন্তু তোমাদের ঝগড়াতো এক দুইদিনের বেশি থাকেনা। মারাত্মক কিছু?’

তুহিন মলিন হেসে বলল, ‘তেমন কিছু না। নতুন কেইসটা নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত আছি এই আরকি। ঠিক হয়ে যাবে।’
মাহমুদা নিজেও এবার হাসলেন। তুহিনের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মিথ্যে বলে লাভ আছে? কঠিন কাজ পেলে তুমি খুশি হও। বেশি ব্যস্ত হয়ে যাও ঠিকই কিন্তু মনমরা থাকোনা।’
তুহিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে আনমনে খাবার চিবোলো। তারপর একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওর কথা ভুলে যাও খালা। ওর সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক নেই আমার এখন। যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে।’

আঁতকে। উঠলেন মাহমুদা। নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে। বিস্মিত গলায় বললেন, ‘কীসব কথা বলছো বাবা! এসব বলতে নেই। ছোটখাটো মান-অভিমান সব সম্পর্কেই হয়। তাই বলে সম্পর্ক ছিন্ন করতে আছে না-কি?’
‘ ব্যপারটা এখন আর ছোটখাটো মান অভিমানে আটকে নেই, খালা।’
‘ তাই বলে এভাবে..। একবার কথা বলেই দেখোনা। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ইরা আম্মুকে চিনি আমি। দেখবে, রেগে থাকতেই পারবে না।’
‘ ছাড়োনা। ওকে থাকতে দাও ওর মতো। যা ঘটে গেছে, গেছে। ভালো লাগছেনা এসব নিয়ে কথা বলতে আর। আরেক পিস মাংস দাও তো।’

বলে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল তুহিন। মাহমুদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘তুমি বুঝদার, বাবা। আমার তোমাকে বোঝানোর কিছু নেই। তবে একটা কথা মনে রেখো। অহম্ কিন্তু ভয়াবহ বিষ। যে সম্পর্কে একবার অহম্ জায়গা করে নেয়, সে সম্পর্কে বিচ্ছেদ অনিবার্য।’
তুহিন খাওয়া থামিয়ে দিল। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। এরপর নিজেকে সামলে হেসে বলল, ‘ ভালো দার্শনিকদের মতো কথাবার্তা বলোতো তুমি! হাইয়ার স্টাডি করলে ভালো কিছু করতে।’
মাহমুদা হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলেন তুহিনের দিকে। উনি জানেন, সবদিক দিয়ে ঠিক থাকলেও এই ছেলের অহম্ বেশি। মাথা নিচু করতে নারাজ সে।

বারোতলা একটা বিল্ডিং এর ছয়তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র আমের। পরনে একটা কালো শার্ট, ধূসর রঙের ময়লা জিন্স। গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হালকা কালি পড়া চোখে একটা বাইনকুলার ধরল। খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করল ঠিক কিছুটা দূরের এক হসপিটালের পাঁচতলা বিল্ডিং এর নির্দিষ্ট কেবিনে। যা যা দেখার প্রয়োজন মতো দেখে নিয়ে বাইনকুলার নামিয়ে রাখল চোখ থেকে। খালি চোখে সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল রুদ্র। সারা দেশজুড়ে খোঁজা হচ্ছে ওকে। অথচ ও এখানে। শান মীর্জাকে ভর্তি করা হসপিটালটার খুব কাছের একটা বিল্ডিংয়ে। যে জায়গার কথা চিন্তা করাও মুশকিল। তাইতো এরকম একটা জায়গাই বেছে নিয়েছে রুদ্র।

পকেট থেকে সোনালী রঙের একটা সিগারেট কেস বের করল রুদ্র। সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো। মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে নিজের বা হাতের মুঠো খুলল। দুটো লকেট। লকেট দুটোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎই সিগারেটে ঘনঘন কয়েকটা টান দিল রুদ্র। চোখ জ্বালা করছে ভীষণ। সিগারেটের ধোঁয়ায় নাকি অন্যকারণে জানা নেই ওর।

নিজের কেবিনে বসে ল্যাপটপে কিছু ফাইল ঘাটছে তুহিন। ডার্ক নাইট গ্রুপ আর শওকত মীর্জা সম্পর্কে কিছু তথ্য দেখছে। কিন্তু ওখানে ওর মনোযোগ নেই তেমন। ও ভাবছে রুদ্রর কথা। পুরো ডিপার্টমেন্ট লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ওর পেছনে। তবুও ওর টিকির সন্ধানও পাচ্ছেনা কেউ। ছেলেটা কী দিয়ে তৈরী? এতো চতুর!
এরমধ্যেই দরজায় তমাল এসে উপস্থিত হলো। ও কিছু বলার আগেই তুহিন হাতের ইশারায় ভেতরে আসতে বলল ওকে। তমাল দ্রুত ভেতরে এসে বলল, ‘স্যার, এখনো রুদ্রকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোন জায়গা থেকে এখনো পর্যন্ত কোন খবর আমাদের কাছে আসেনি স্যার।’

তুহিন যেন জানতো এমন কিছুই বলবে তমাল। তবে ওর মধ্যে হতাশ হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলোনা। ও গভীরভাবে ভাবছে কিছু একটা। গভীরভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করে তুহিন বলল, ‘তমাল, রুদ্র গাধা না। এমন কোন জায়গায় ও যাবেনা যে জায়গার কথা আমরা সহজেই চিন্তা করতে পারব। ও এমন কোথাও আছে যেখানে সহজে ওকে আমরা খুঁজব না।’
‘ কোথায় হতে পারে স্যার?’ তমালের কন্ঠে তীব্র কৌতূহল স্পষ্ট।
তুহিন চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিল। দু হাতের আঙুল একত্রিত করে আঙুল নাড়াতে নাড়াতে মিনিটখানেক চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘শান মীর্জা যে হসপিটালে আছেন সেখানে কড়া সিকিউরিটি আছে। তাইনা?’

‘ জ্বি স্যার।’
‘ তারমানে তার আশেপাশের ফ্যাল্ট বা বিল্ডিং গুলোকে নিয়ে আমরা তেমন মাথা ঘামাচ্ছি না। তাইতো?’
তমাল টানা পাঁচ সেকেন্ড তাকিয়ে রইল তুহিনের দিকে। তারপর হালকা হেসে বলল, ‘ বুঝে গেছি, স্যার।’
‘ কী বুঝলে?’
‘ বিল্ডিংগুলো নিয়ে এবার মাথা ঘামাতে হবে।’

তুহিন কিছু না বলে চোখ বন্ধ রেখেই মৃদু হাসল। তমালের ফোনের আওয়াজে চোখ খুলল তুহিন। কল রিসিভ করে এক মিনিট কথা বলল তমাল। এরপর ফোন রেখে তমাল তুহিনের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় বলল, ‘জ্যোতিকে পাওয়া গেছে, স্যার। নিয়ে আসা হচ্ছে ওকে।’
কথাটা শুনে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল তুহিন। যেন বহু কাঙ্ক্ষিত কিছু পেয়ে গেছে। কিছু একটা চিন্তা করে বলল, ‘ওর সঙ্গে আর কেউ?’

‘ না স্যার, জ্যোতিকে রাস্তা থেকেই ধরে আনা হচ্ছে। পালাচ্ছিলো। ওর সঙ্গে আর কেউ ছিলোনা।’
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি বিল্ডিংগুলোতে খোঁজ নাও দ্রুত। জ্যোতিকে ইন্ট্রোগেট আমি করব।’
‘ জ্বি স্যার।’
বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল তমাল। খুব বেশি হতাশ হয়নি তুহিন। একজন তো পাওয়া গেলো। এবার অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। অনেক রহস্য থেকে পর্দা উঠবে এবার।

একটা চেয়ারে বসানো হয়েছে জ্যোতিকে। বাঁধতে বারণ করেছে তুহিন। তবে দুজন মহিলা কন্সটেবল ওর দু পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঠিক মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসেছে তুহিন। থুতনিতে হাত রেখে জ্যোতিকে পা থেকে মাথা অবধি একবার দেখে নিল। ধূসর রঙের একটা সুতি শাড়ি, কালো সুতি কাপরের ব্লাউজ। মাথায় এক পাশে বেনী করা। এই মাঘের শীতেও সারা মুখ ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। ঘনঘন ঢোক গিলছে। বাঁ হাতের নখ দিয়ে বারবার চেয়ারের হাতলে আঁচড় কাটছে। ডান হাতে আঁচল দিয়ে ইতিমধ্যে মুখ মুছে নিয়েছে দু’বার।

সবকিছুই তীক্ষ্ম চোখে খেয়াল করল তুহিন। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে থেকেই এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল জ্যোতির দিকে। জ্যোতি একবার তুহিনের দিকে তাকাল। দু সেকেন্ড ইতস্তত করে আর অপেক্ষা করল না। ঢকঢক করে খেয়ে নিল সবটুকু পানি। পানি খেয়ে ঘন কয়েকটা শ্বাস নিয়ে স্হির করল নিজেকে। তুহিন তাড়াহুড়ো না করে অপেক্ষা করল। জ্যোতি একটু শান্ত হতেই মুখ খুলল তুহিন। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ভালো আছেন?’
জ্যোতি উত্তর দিলোনা। তুহিন উত্তরের অপেক্ষাও করল না। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছুড়লো, ‘আপনাকে এখানে কেন আনা হয়েছে জানেন?’

জ্যোতি এবারেও কোন কথা বলল না। নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। তুহিন তৃতীয় প্রশ্ন করল, ‘আমের ভিলাতেই বড় হয়েছেন আপনি। ঠিক বলছি?’
জ্যোতি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, ‘জ্বী।’
এতক্ষণে জ্যোতি কথা বলায় মৃদু হাসল তুহিন। সঙ্গেসঙ্গেই গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ রাশেদ আমেরের সাথে কী সম্পর্ক ছিল আপনার? কেন থাকতেন ঐ বাড়িতে?’

জ্যোতিকে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে উঠতে দেখল তুহিন। যেন গভীর কোন অতীতে হারিয়ে গেছে। জ্যোতি স্হির ধীর কন্ঠে বলল, ‘আমার মা একজন পতিতা ছিলেন। আমি জন্মানোর পর মা আর থাকতে চাননি ওখানে। তাই ঐ পল্লী থেকে পালিয়ে এসেছিল আমাকে নিয়ে। কিন্তু শহরে একা এক মহিলা সদ্যজাত বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাবে বুঝতে পারছিল না। বাহিরের শেয়াল কুকুরেরা যেখানে পরিবারের সঙ্গে থাকা মেয়েদেরকেই ছাড়েনা। সেখানে আমার মাতো ছিলো একা। অসহায়।’

বলে থামল জ্যোতি। তুহিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জ্যোতির দিকে। জ্যোতি কথার খেই ধরে বলল, ‘ তখন মা আমের ফাউন্ডেশনের খবর পায়। রাশেদ বাবার কথা জানতে পারে। উনি নাকি অনেক ডোনেশন দিতেন অসহায় মানুষদের। মা ওখানে গিয়েছিল কটা টাকা দান পাওয়ার আশায়। কিন্তু রাশেদ বাবার হয়তো ওনার অসহায়ত্ব দেখে মায়া হয়। তাই আমাকে সহ মাকে আমের ভিলায় নিয়ে যায়। তারপর থেকেই ঐ বাড়িতে কাজ করতো মা। কিন্তু ঐ শান্তি বেশিদিন সহ্য হয়নি মায়ের। দু বছরের মাথাতেই চলে গেলেন। বাবার পরিচয়ই জানতাম না। আর মাও ঐ বয়সেই_’

আবার থামল জ্যোতির কেঁপে যাওয়া কন্ঠস্বর। তুহিন মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কথাগুলো। জ্যোতি থামতেই ও বলল, ‘আর তারপর থেকে ঐ বাড়িতেই আছেন আপনি?’
জ্যোতি একবার ওপর নিচে মাথা ঝাঁকালো। তুহিন ভাবল হিস্ট্রি জেনে ওর কোন লাভ নেই। তাই কাজের কথায় আসল। সোজাসুজি প্রশ্ন করল, ‘ আমের ভিলা আছে, কিন্তু আপনি সেখানে নেই। কেন?’
প্রশ্নটা শুনে জ্যোতি চোখ তুলে তাকালো তুহিনের দিকে। ব্যক্তিত্বে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল ওর। এতক্ষণে চেহারায় লেগে থাকা অসহায় ভাবটা কেটে গেছে। অদ্ভুত রহস্যময় লাগল ওকে দেখতে। জ্যোতি শান্ত গলায় বলল, ‘ কোন কিছুই শাশ্বত নয়। বাসস্হানও না।’

তুহিন মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ ঠিক। কিন্তু সবকিছুর পেছনেই কারণ থাকে। কেন ছাড়লেন আপনি আমের ভিলা?’
‘ ওখানে থাকা নিরাপদ ছিলোনা তাই।’ সহজ স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল জ্যোতি।
তুহিনের ভ্রু কুঁচকে উঠল। ও সোজা হয়ে বসে বলল, ‘কেন? কী এমন বিপদ ছিল ওখানে?’
‘জানিনা।’
‘ লুকিয়ে ছিলেন আপনি। পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। পুলিশ দেখেও পালালেন। মানুষ দুটো কারণে পালায় নিজে কোন অন্যায় করলে কিংবা তার সাথে কোন অন্যায় হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে। আপনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী?’
‘ দুটোই।’ এবারও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো জ্যোতি।

তুহিন কয়েক সেকেন্ড পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইল জ্যোতির দিকে। ওর এমন অতিরিক্ত সোজাসাপ্টা উত্তরে বিরক্ত হওয়ার কথা তুহিনের। হচ্ছেও। কিন্তু তবুও শান্ত থাকল। টপিকটাকে ওখানেই থামিয়ে তুহিন নতুন প্রশ্ন করল, ‘রুদ্র কোথায়, মিস জ্যোতি?’
জ্যোতি স্হির চোখে তাকাল তুহিনের দিকে। সেটা দেখে তুহিন বলল, ‘প্লিজ এটা বলবেন না রুদ্রকে চেনেনই না। এখন আমার হাসার ইচ্ছে নেই।’
জ্যোতি মলিন হেসে বলল, ‘অতো সাহস নেই আমার যে ওকে চিনতে অস্বীকার করব। কিন্তু এখন কোথায় আছে আমি জানিনা।’

‘ মিথ্যে বলছেন আপনি।’
‘ আমি মিথ্যে বলছিনা, স্যার। রুদ্র কোথায় আছে আমাকে বলেনি ও।’
‘ প্রিয়তাকেও না? প্রিয়তা, মানে রুদ্রর স্ত্রী কোথায় এখন?’
‘ সেটাও জানিনা।’
তুহিন অবাকই হলো কথাটা শুনে। কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ শেষ কবে দেখা হয়েছিল ওদের দুজনের সাথে আপনার?’

একটু চিন্তা করল জ্যোতি। তারপর বলল, ‘ ১১ই জানুয়ারি।’
তুহিন ভেবে দেখল। গুলশানে শেষ খুনটা হওয়ার ঠিক একদিন পর। তারমানে গুলশান ছেড়ে যাওয়ার পর ওরা আর দেখা করেনি জ্যোতির সাথে। কিন্তু কেন? কোথায় ওরা? তুহিন জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল ঠোঁটটা। বলল,
‘ একটা ছোট বাচ্চা ছিল আপনার সাথে। বাচ্চাটা কার?’
‘ আমার না।’

জ্যোতির এধরণের উত্তরে রেগে উঠছে তুহিন। তবুও পরের প্রশ্ন করল, ‘আর বাকিরা? আমের ভিলার বাকিরা কোথায়?’
‘ কাদের খবর দেব? জীবিতদের নাকি মৃতদের?’
প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই ঠান্ডা গলায় কথাটা বলল জ্যোতি। গা কেমন শিরশির করে উঠল তুহিনের। নিজেকে সামলে বলল, ‘মানে?’

জ্যোতি আবার নিরুত্তর রইল। আধ মিনিট পেরিয়ে গেলেও কিছু বলল না। মেজাজ এবার তুঙ্গে উঠল তুহিনের। ও টেবিলে একটা চাপড় মেরে বলল, ‘অনেকক্ষণ যাবত ঠান্ডা গলায় কথা বলছি আপনার সঙ্গে। আর আপনি আমাকে হলিউডের হরর মুভির ফিলিংস দিতে চাইছেন? মজা করছেন আমার সাথে? আপনি জানেন পরপর নটা খু’ন করেছে রুদ্র? আরও দুটো খু’ন করতে চলেছে? জানেন? যেকোন সময় অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে ও। আপনার সাসপেন্স উপভোগ করার সময় নেই আমাদের।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৭ (২)

তুহিনের কথাগুলো চুপচাপ চোখে চোখ রেখে শুনলো জ্যোতি। এরপর অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ল। তুহিন চমকে উঠল। অনেকটা বোকা বনে গেল ও। কেমন ভৌতিক মনে হচ্ছে ওর হাসি। নিজের অজান্তেই একটা ঢোক গিলে ফেলল তুহিন। কোনমতে হাসি থামিয়ে জ্যোতি বলল, ‘আপনি নিশ্চিত নটা খু’নের সবগুলোই রুদ্র করেছে?’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৯