অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৭ (২)

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৭ (২)
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

সকাল সাড়ে ন’টা বাজে। ঠান্ডা পড়লেও রোদ ঝলমল করছে আকাশে। কুয়াশার বালাই নেই এখন। কফি এক্সপ্রেসের সামনে এসে দাঁড়াল তুহিন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দু সেকেন্ড ইতস্তত করে ঢুকেই গেল। একটু ভেতরের বসে আছে ইরা। তুহিনের আসার অপেক্ষা করছে। আজ সকালে ইরা নিজেই ফোন করে ডেকেছে ওকে। তুহিন মনেমনে এটাই চাইছিল। ইরার সাথে কথা বলা প্রয়োজন ওর। কিন্তু ইগোর কারণে কয়েকবার কল করতে গিয়েও করেনি। দুটো শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করে এগিয়ে গেল তুহিন। চেয়ার টেনে বসল। ইরা তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। সেটা দেখে তুহিন চোখ সরিয়ে নিল। নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে ওয়েটারকে ডেকে কফি অর্ডার করল।

কিছুক্ষণ কেটে গেল নীরবতার মধ্যেই। তুহিন কিছু বলছে না। শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আর ইরার চোখ সরছেনা তুহিনের থেকে। আসার পর থেকেই অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। এক দৃষ্টিতে। এরমধ্যে কফিও চলে এলো। তুহিন ইরার দিকে একবার তাকিয়ে ইতস্তত করে নিল কাপটা। দীর্ঘসময় পর তুহিনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের দিকে কাপ টেনে নিল ইরা। বলল, ‘ ধন্যবাদ। তোমার এতো ব্যস্ততার মাঝে আমার জন্যে খানিকটা সময় বের করতে পেরেছো তাই।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তুহিন প্রথমে খানিকটা ইতস্তত করল। এরপর হালকা গলা ঝেড়ে বলল, ‘ পরশু রাতের বিহেভিয়ারের জন্যে আ’ম সরি। আই রিয়েলি ডিডেন্ট মিন হোয়াট আই সেইড।’
ইরা খানিকটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘ত্রিশ ঘন্টারও বেশি সময় পড়ে তোমার সেটা রিয়ালাইজ হলো? আর সেটাও তখন যখন আমি নিজে তোমাকে ডাকলাম।’
‘ ইরা আমি ভীষণ প্রেশারে ছিলাম তখন। আর এখন চলমান কেইসটাও এতোটা ভাইটাল জায়গায় আছে, আমি এক মিনিটও স্বস্তিতে বসতে পারছিনা।’
‘তাই? এতোটাই প্রেশারে ছিলে যে গোটা একটা দিনে আমাকে কল দিয়ে এইটুকু জিজ্ঞেস করার সময় পেলেনা যে আমার কী হয়েছিল? কেন কল করেছিলাম।’

‘ সরি। আসলে আমার মাথায় ছিলোনা ঐ ব্যপারটা। এক্সট্রেইমলি সরি।’
‘ সেই! মনেতো থাকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। কিন্তু আমিতো টেকেন ফর গ্যারান্টেড। তাইনা?’
তুহিনের মেজাজ খারাপ হলো এবার। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল, ‘ওভার রিঅ‍্যাক্ট হচ্ছেনা? সরি বলছিতো।’
ইরা তুহিনের চোখে চোখ রেখে হাসল। দু সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ব্যথিত কন্ঠে বলল, ‘কাল আমার জন্মদিন ছিল তুহিন।’

তুহিন কিছুক্ষণের জন্যে বোকা বনে গেল। দ্রুত ফোনটা অন করে তারিখটা ভালোভাবে দেখে বুঝল ইরা সত্যি বলছে। কাল জন্মদিন ছিল মেয়েটার। এখন আফসোস হচ্ছে তুহিনের। জন্মদিনের দিনটাতেই মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিল? হালকা গলা ঝেড়ে তুহিন কিছু বলতে গেলে ইরা থামিয়ে দিল। বলল, ‘তোমার মনে থাকবেই সেই আশা আমি করিনা তুহিন। এতো প্রেশার, কাজের মধ্যে খাওয়ার কথাও তো মনে থাকেনা। জন্মদিন কীকরে মনে থাকবে? আমি জাস্ট কাল ফোন করে তোমাকে একটু কাছে চেয়েছিলাম। ঐ মুহুর্তেই না। যখন তুমি ফ্রি হবে। আধ ঘন্টার জন্যে হলেও কালকের দিনে কিছুটা সময় তোমার সঙ্গে কাটাতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তোমার তো আমার একটা লাইন শোনারও সময় নেই। এতো উদাসীনতা তুহিন? এতোটাই আনইমপর্টেন্ট আমি তোমার কাছে?’

তুহিন নরম গলায় বলল, ‘ইরা আমি সত্যিই সরি। আমার মনে..’
‘তোমার আমায় তখনই মনে পরে তুহিন, যখন তোমার কোন কাজ থাকেনা। যখন তোমার কাছে করার কিছু থাকেনা। তোমার অবসরের বিনোদন আমি। তাইনা?’
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল ইরা। তুহিন ধমক দিয়ে বলল, ‘ইরা!’

ইরা হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে বলল, ‘ধমকালে সত্যিটা বদলে যাবেনা। তোমার কাছে সবার আগে তোমার কাজ, তুমি, তোমার কলিগস্। সবকিছুর পর যখন তুমি একা হয়ে যাও। সেই একাকিত্ব ঘোচাতেই ব্যবহার করছো তুমি আমাকে।’
তুহিনের রাগ লাগলেও অনেক কন্ঠে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ‘ আমার লাইফ স্টাইলটাই এরকম ইরা। তুমি সব জানো।’
ইরা কঠোর গলায় বলল, ‘কিন্তু এরকম লাইফস্টাইলে আমি মানিয়ে নিতে পারছি না। নট এনি মোর। অনেক হয়েছে তুহিন। শুধুমাত্র কারো ফ্রি টাইমের রিফ্রেশমেন্ট হয়ে থাকতে পারব না আমি। তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবার।’

“ফ্রি টাইমের রিফ্রেশমেন্ট” কথাটা ভীষণভাবে গায়ে লাগল তুহিনের। নিজের রাগ সামলে রাখতে পারল না আর। ইরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কখনই তোমাকে জোর করে আটকে রাখিনি ইরা। যখন তোমাকে প্রপোজ করেছিলাম তখন শুধু বলেছিলাম “আই লাভ ইউ”। একবারও তোমাকে বলিনি আমার সঙ্গে রিলেশনে জড়াও বা সে “ইয়েস”। সেটা তোমার চয়েজ ছিল। আর এই তিনবছরেও আমি কখনও তোমাকে আটকে রাখার চেষ্টা করিনি। আজও করবোনা।’

ইরা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তুহিনের দিকে। ও ভেবেছিল তুহিন বলবে “চলো, বিয়ে করে ফেলি। সারাদিন না হোক দিনশেষে তো একসঙ্গে থাকতে পারব।” কিন্তু ও এরকম কিছু বলবে ইরা ভাবেও নি। তারমানে তুহিন চায় আলাদা হতে। এই সম্পর্কে ও আর থাকতে চায়না। এতোদিন বলার কোন সুযোগ পাচ্ছিল না। আজ সুযোগ পেয়ে বলে দিলো। মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ইরা। বুকে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো। কিন্তু বাইরে দিয়ে নিজেকে শক্ত রেখে বলল, ‘ সো ইউ ওয়ান্ট টু ব্রেক আপ?’

তুহিন হতভম্ব হয়ে গেল। কত ইজিলি বলে ফেলল ব্রেক আপের কথা! ও যেতে দিতে চাইলেই যেতে হবে? নাকি সত্যি সত্যিই যাওয়ার জন্যে ছটফট করছে ইরা? কথাগুলো ভেবে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তুহিনের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আপ টু ইউ।’
পুরো দুনিয়াটাই যেন দুলে উঠল ইরার। ও আশা করছিল তুহিন বলবে “এক থাপ্পড় মারব আরেকবার ব্রেকআপের কথা চিন্তা করলে।” কিন্তু তুহিনের কিছুই যায় আসেনা। ভুলটা ওরই ছিল। তুহিনের উদাসীনতাকে ও তুহিনের ন্যাচার ভাবতো। ভাবতো তুহিন এক্সপ্রেস করতে না পারলেও ভালোবাসে ওকে। কিন্তু ওর ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করল তুহিন। অনেক কষ্ট নিজের চোখের জল আটকালো ইরা। ঘনঘন দুটো শ্বাস নিয়ে বলল, ‘ওকে, লেটস ডু ইট।’

তুহিন তাকিয়ে রইল ইরার দিকে। শান্ত স্বরে বলল, ‘আর ইউ শিওর?’
ইরা শক্ত গলায় বলল, ‘ ডেফিনেইটলি।’
তুহিন কিছু বলল না। ইরা বিল দেওয়ার জন্য নিজের পার্সে হাত দিতে গেলে তুহিন বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ আমি দেখছি।’
ইরা আপত্তি জানালো না। পার্সটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তুহিনের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল, ‘ভালো থেকো। এন্ড আই উইশ তোমার লাইফে আমার চেয়েও অনেক ভালো একটা মেয়ে আসুক। যে তোমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালো রাখবে।’

তুহিন এবারও কিছু বলল না। ইরাও আর দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে বের গেল কফি হাউজ থেকে। তুহিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিল মিটিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

অফিসে গিয়ে সরাসরি ডিজির রুম‍ের দিকে পা বাড়াল তুহিন। দরজার কাছে গিয়ে বলল, ‘ মেই আই কাম ইন, স্যার?’
ল্যাপটপে কিছু একটা করছিলেন শাফায়াত হোসেইন। তুহিনকে দেখে সন্তুষ্টির হাসি হাসলেন। ল্যাপটপটা বন্ধ করতে করতে বললেন, ‘ কাম ইন মাই বয়।

তুহিন ভেতরে আসল। শাফায়াত হাতের ইশারায় বসতে বললেন ওকে। তুহিন বসল। শাফায়াত বললেন, ‘ ভালো হয়েছে এসেছো। তোমাকে ডেকে পাঠাতাম আমি। আমি জানতাম তুমি আমাকে নিরাশ করবে না। খু’নি অবধি তুমি পৌঁছেই ছাড়বে। এন্ড আমি ঠিক ছিলাম। ভেরী প্রাউড অফ ইউ। রুদ্রর ছবি প্রত্যেকটা নিউজ পেপারে, সংবাদ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের বাইরে যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ ওর। আর দেশেও বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবেনা।’

‘ সবটা এতোটাও সহজ হবেনা স্যার। ও রুদ্র আমের।’
‘ মানে?’
তুহিন বলল, ‘ নাথিং স্যার। শান মীর্জার ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। রুদ্র সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি তাকে শানকে জীবিত থাকতে দেবেনা ও।’
‘ সে বিষয়ে চিন্তা করোনা। ওর ওপর চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখা হচ্ছে।’
‘ প্রতিটা চেকপোস্ট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্টে রুদ্রর ছবি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে স্যার।’
‘ হ্যাঁ। আমি বলেছি। কাজ শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।’

তুহিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইতস্তত করে বলল, ‘আরেকটা কথা ছিল, স্যার।’
শাফায়াত হাসলেন। হেসে বললেন, ‘এতো ইতস্তত করছো কেন? বলে ফেলো।’
‘ স্যার, আমি জেনেছি সোলার সিস্টেম অর্থাৎ রাশেদ আমেরের প্রজেক্ট ঠিক কী ছিল। আর সে কী করতে চাইছিল।’
তুহিনের কথায় চমকে উঠলেন শাফায়াত। হতভম্ব গলায় বললেন, ‘ হোয়াট?’

‘ হ্যাঁ স্যার। ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা, মানি লন্ডেরিং ছাড়াও রাশেদ আমেরের প্রধান ব্যবসা ছিল অস্ত্রপাচার। বাইরের থেকে গমের বস্তায় করে বু’লে’ট আসতো আমের মিলসে। সেই বুলেটই আটার প্যাকেটে করে সারা দেশে সাপ্লাই করতো দ্য সোলার সিস্টেম। একই ভাবে বিভিন্ন পি’স্ত’ল এবং বেআইনি অ’স্ত্র’শ’স্ত্র চোরাচালানের মাধ্যমে বাইরে থেকে এনে বই, বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটে করে বিক্রি করা হতো। শুধু সোলার সিস্টেম নয় ডার্ক নাইট, ব্লাক হোলও এর সঙ্গে যুক্ত ছিল।

ডার্ক নাইট কোন একসময় সোলার সিস্টেমের পার্টনার ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কিছু ঝামেলার কারণে তাদের ব্যবসায়ীক বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। আর এরপর থেকে এই তিন দলের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো। সে অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু সমস্যা তখনই হয় যখন সোলার সিস্টেমের কাছে বারবার ব্লাক হোল আর ডার্ক নাইট মার খাচ্ছিল। আর সেই মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে দুবছর আগে রাশেদ আমের বেশ নামিদামি কয়েকটা দলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরিকল্পনা করে। আগামী বিশ বছর ঐসব দল শুধুমাত্র সোলার সিস্টেমের কাছেই অ’স্ত্র পা’চা’র করবে। তারা রাজিও হয়েছিল কারণ রাশেদ আমেরের অফার করা এমাউন্ট ছিলো লোভনীয়। বোকা না হলে এমন অফার কেউ ছাড়বেনা। কিন্তু সেই এমাউন্ট ম্যানেজ করতেই সোলার সিস্টেমকে অনেক খাটতে হয়েছে। আর এটাই ছিল রাশেদ আমেরের সেই সিক্রেট প্রজেক্ট।’

শাফায়াত হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। তুহিন বলে চলেছে, ‘ আর এটা জেনেই মাথায় একপ্রকার বাজ পড়েছিল বাকি দুই গ্রুপের। কারণ সবচেয়ে বেস্ট কোয়ালিটি ঐসব দলই দিতো। আর ওখান থেকে সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে পেটে লাথি পড়া। সবকিছু শেষ হয়ে যেতো ওদের। আর সেটা হওয়া থেকে আটকানোর জন্যেই ওরা সব করতে পারতো। সব। হিংস্রতার চরমে যেতেও ওরা রাজী ছিল। এন্ড আই গেইস ওরা গিয়েছিল।’
শাফায়াত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ এগুলো তুমি কীকরে জানলে?’

‘ স্যার আমি পরপর দুবার গিয়েছিলাম আমের ভিলায়। প্রথমদিন একটা ডায়েরি ছাড়া বিশেষ কিছু না পেলেও পরেরবার গিয়ে বুকসেল্ফের পেছনে রাখা একটা ব্রিফকেস পেয়েছিলাম। লক ছিল। ফরচুনেটলি রাশেদ আমেরের ডায়েরি ঘেঁটে নাম্বার পেয়ে যাই আমি। ব্রিফকেসটা খুলে কিছু পেপারস্ পাই। সেখানে স্পষ্ট করে না হলেও এই প্রজেক্টের বিষয়ে অনেক ইনফরমেশন ছিল। এরপর আমাদের অন্যসব গোয়েন্দা আর পুলিশের দেওয়া রিপোর্ট মিলিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার করে নিতে সমস্যা হয়নি আমার। আর মজার ব্যপার হলো এসব খু’নে যেসব বু’লে’ট পাওয়া গেছে ওগুলো ঐ পেপারে থাকা বেআইনি বু’লে’টের সঙ্গে মিলে গেছে।’

‘ সাপ্লাই ঠিক কারা দিতো বা রাশেদ আমেরের থেকে কারা কিনতো এ বিষয়ে কোন ধারণা?’
‘ না স্যার। তাদের ব্যপারে স্পষ্ট করে কিছুই জানা যায়নি। তবে একটা ব্যপার আমার মাথায় চলছে স্যার।’
‘ কী?’
তুহিন জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মনে মনে কথাগুলো একবার গুছিয়ে নিল। এরপর বলতে শুরু করল, ‘তিনটে গ্রুপই বহুবছর ধরে এধরণের বেআইনি কারবার করে চলেছে। কিন্তু ওদের কারো বিরুদ্ধে একটা এভিডেন্স জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। দলের অনেক ছোট ছোট চুনোপুঁটিকে ধরা গেলেও দলের মাথা একদম অক্ষত ছিল। কীকরে স্যার? পেছনে বড় কোন হাত না থাকলে এটা সম্ভব?’

‘ মানে?’
‘ মানে, আপনার মনে হচ্ছেনা স্যার, আমাদের কিছু গণ্যমান্য নেতা মন্ত্রীদের অর্থসম্পদ একটু বেশিই দ্রুত বাড়ছে? কাগজ বলে সবকিছু লিগাল। কিন্তু আমাদের চোখতো অন্যকিছু বলছে স্যার। ব্যপারটা অনেকটা আঙুল ফুলে গলাগাছ টাইপ না?’
নিজের চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন শাফায়াত। দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ আমি জানি তুমি কী বোঝাতে চাইছো। কিন্তু শুধু দেখলে, শুনলে, বুঝলেই হয়না। অন্যদেরও দেখাতে হয়, শোনাতে হয়, বোঝাতে হয়। যেটা সবচেয়ে কঠিন। তোমার কেইস মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে তুহিন। শুধু রুদ্রর ধরা পড়ার অপেক্ষা। আমার মনে হয় তোমার এখানেই থেমে যাওয়া উচিত।’

তুহিন মাথা নিচু করে হাসল। তারপর শাফায়াতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ রাস্তায় যখন হাটা শুরু করেছি রাস্তার শেষটা দেখে তবেই থামবো স্যার। অফিশিয়ালি যদি অনুমতি না পাই। আমাকে আনঅফিসিয়ালি কাজটা করতে হবে। এখন আসব স্যার?’
মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলেন শাফায়াত। তুহিন বেরিয়ে গেল। শাফায়াত তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। এই ছেলে শান্ত কিন্তু খুব জেদি। সে জানে। কিন্তু এই জেদের কারণে বড় কিছু মাথায় কোপের মুখে না পড়তে হয় ওকে।

নিজের কেবিনে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসল তুহিন। মানসিকভাবে ভীষণ ক্লান্ত আজ ও। কেইসটা মোটামুটি সল্ভ হওয়াতে ওর রিল্যাক্স হওয়ার কথা ছিল। শান্তি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এবারে অস্হিরতার পরিমাণই বেশি। এই কেইসটা জীবনেও ভুলবে না ও। কারণ এই কেইসের কাজ করতে গিয়েই ও ওর ইরাকে হারিয়েছে। ইরার সঙ্গে কাটানো কিছু সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত মনে করার চেষ্টা করল তুহিন। একসঙ্গে কাটানো স্পেশাল খুব বেশি মুহূর্ত পেলোনা স্মৃতির পাতা ঘেঁটে। হাতে গোনা কয়েকটাই পেল। তবে সে কয়েকটাই ভীষণ সুন্দর।

‘ স্যার আসব?’
তমালের কন্ঠস্বর শুনে চোখ খুলে তাকাল তুহিন। সোজা হয়ে বসে বলল, ‘ এসো। কোন খবর? রুদ্রকে পাওয়া গেছে?’
তমাল ভেতরে ঢুকে বলল, ‘না স্যার। মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রি’মি’না’ল ও এখন। বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে না। কিন্তু খবর আছে।’

‘ কী খবর?’
‘ সিঙ্গাপুর থেকে খবর নেওয়া হয়েছে স্যার। জাফর আমেরের বউ বাচ্চা মৃত স্যার। মা’র্ডা’র হয়েছে।’
তুহিন চমকে উঠল। তমাল বলল, ‘তারচেয়েও অবাক করার ব্যপার আছে স্যার। খু’নগুলো প্রায় আড়াই বছর আগেই হয়েছে।’

‘ হোয়াট?’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল তুহিন।
‘ আরও একটা খবর আছে, স্যার।’
তুহিন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তমালের দিকে। তমাল বলল, ‘ জ্যোতিকে দেখা গেছে স্যার। একটা ঔষধের দোকানে। কিন্তু ধরতে পারেনি। তার আগেই ভীড়ে মিশে গেছে। ওর কোলে একটা বাচ্চা ছিল স্যার। দেখে নাকি মনে হয়েছে কয়েকদিন আগেই জন্মেছে।’

তুহিন খানিকটা চিন্তা করে বলল, ‘ঔষধ যখন ওখান কিনছিল তারমানে ও আশেপাশেই কোথাও থাকছে। তাড়াতাড়ি খোঁজ শুরু করো। প্রয়োজনে পুরো এলাকা চোষে ফেলো। আই ওয়ান্ট হার।’
‘ ওকে স্যার।’
তমাল বেরিয়ে গেল। দুই হাত মাথার ওপরে তুলে চেয়ারে হেলান দিল তুহিন। জাফর আমেরের বউ-বাচ্চা বেঁচেই নেই। কে মারল ওদের? ওর ভাবনাই তবে ঠিক? কিন্তু এও হতে পারে? আর জ্যোতি? জ্যোতি পালিয়ে কেন বেরাচ্ছে। আর কোলে ছোট বাচ্চাটা কে ছিল। কার বাচ্চা ওটা?

অন্যদিকে রুদ্র কোথাও ছদ্মবেশ নিয়েছে, কোথাও নেয়নি। আর ও চাইলেই জাল ইনফরমেশন তৈরী করতে ছদ্মবেশেই যেতে পারতো। পুলিশ যে ঐখান অবধি পৌঁছে যাবে সেটা বুঝতে না পারার মতো বোকাতো রুদ্র না। কিন্তু ও সেটা করেনি। কেন? শায়লার সামনেই ও ছদ্মবেশে যেতে পারতো। তাও যায়নি। প্রথমে না ভাবলেও এখন বিষয়গুলো ভাবাচ্ছে রুদ্রকে। এগুলো কী সত্যিই রুদ্রর ভুল ছিল? নাকি ও জেনেশুনেই বিভিন্ন জায়গায় এই টুকরো টুকরো প্রমাণগুলো রেখে গেছে? কিন্তু এরকম কেন করবে রুদ্র। কী উদ্দেশ্যে? এতোগুলো প্রশ্নের কোনটারই উত্তর নেই তুহিনের কাছে। এসব প্রশ্নের উত্তর জ্যোতি আর রুদ্রই দিতে পারবে ওকে। এখন শুধু রুদ্র আর জ্যোতির ধরা পড়ার অপেক্ষা।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৭(১)

(প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি)
[ * শেষ হলো প্রথম অধ্যায়। জানি অনেকের কাছে অনেক কিছুই এখনো অস্পষ্ট। রুদ্র কী আদোও ধরা পড়বে? কেন করছে সে এতোগুলো খু’ন? এই বে’আইনি কারবারের মাথাদের মুখোশ খুলতে পারবে তুহিন? আমের ভিলার বাকিদের কী হলো? কোথায় এখন তারা? এগুলো সবই দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্পষ্ট হবে। শীঘ্রই দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হবে। ততক্ষণ ধৈর্য ধরুন।
* যারা যারা এতোদিন উপন্যাসটা পড়েছেন আশা করছি সকলেই রেসপন্স আর গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আর উপন্যাস সম্পর্কে নিজের মনোভাব প্রকাশ আলোচনা সমালোচনা করতে ? অনি’র মায়ামহল ?? গ্রুপে যুক্ত হতে পারেন। আশা করছি ভালো লাগবে। ]

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৮