অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৭ (১)

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৭ (১)
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

বারো তলা বিল্ডিং এর ছাদে বেতের চেয়ারে গা ছেড়ে বসে আছে শান। এক হাতে মদের গ্লাস, অন্য হাতের আঙ্গুলের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট ধরা আছে। জীবনের সবচেয়ে অসহ্যকর সময় পাড় করছে সে এখন। একটু আগে শওকত মীর্জা ফোন করেছিল। বারবার বলে দিয়েছে ফ্ল্যাট থেকে বের না হতে। দরজা জানালা সব বন্ধ করে রাখতে। সঙ্গে দিয়েছে তার কাকা পলাশ মীর্জার মৃত্যু সংবাদ।

কাকার মৃত্যু নিয়ে শোক নেই তার। কোথাকার কে, তারজন্যে তাকে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে। এটাই তার সমস্ত বিরক্তির কারণ। ও শান মীর্জা। ও কেন কারো ভয়ে লুকিয়ে থাকবে। নিজের অপার সাহস প্রদর্শনের জন্যেই বাবার আদেশ অমান্য করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে এসেছে। এটাই প্রমাণ করতে যে সে কারো ধার ধারেনা। তাকে মারার ক্ষমতা কারো নেই। তবে বিল্ডিং থেকে বের হয়নি। শান স্বীকার না করলেও পলাশ মীর্জার খু’ন ওর মনে ভয়ের সৃষ্টি করেছে। যখন শুনেছে খু’নি শওকতকে কল করে পলাশের আর্তনাদ শুনিয়েছে, তখন ভয়ের মাত্রা আরও বেড়েছে। চোখের সামনে নৃশংস অতীত ভেসে আসছে। এরকম নৃশংসতাতো তারাও করেছিল কারো সাথে। এক নিঃশ্বাসে গ্লাসে পড়ে থাকা বাকি মদটুকু গিলে নিলো শান। তখনই গম্ভীর কন্ঠে কেউ বলে উঠল, ‘জীবন কতো সুখের তাইনা?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে থমকে গেল শান। নড়ার শক্তি পেলোনা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। কিন্তু শক্ত নার্ভের কারণে মুহুর্তেই সামলে নিল নিজেকে। অবাক কন্ঠে বলল, ‘ তুমি!’
আর কিছু বলার আগেই কাঁচের বোতলের তীব্র আঘাত পড়ল শানের মাথায়। আকস্মিক আঘাতে হতভম্ব হয়ে গেল শান। চোখে সর্ষে ফুল দেখল। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো।

উত্তরা থেকে সাভারে পৌঁছেই উত্তেজনা বেড়ে গেল তুহিনের। গাড়ির জানালা দিয়ে একবার তাকাল বাইরে। রাত অনেক হয়েছে। তাই গাড়ি কম। তুহিন রাস্তায় নজর বুলিয়ে অন্যমনস্ক গলায় ড্রাইভারকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চালাও।’
তমাল ফ্রন্ট সিট থেকে পেছন ঘুরে বলল, ‘স্যার চিন্তা করবেন না। পুলিশের গাড়ি পৌঁছে গেছে এতক্ষণে।’
‘কিন্তু আমি এখনো পৌঁছতে পারিনি।’ রাস্তার দিকে ব্যস্ত চোখে তাকিয়ে বলল তুহিন।

তমাল নিজেও একবার রাস্তাটা দেখে নিলো। সত্যিই কী আজ খুনি ধরা পড়বে? পড়লেও কীভাবে পড়বে? কে হবে খুনি? রুদ্র? নাকি অন্যকেউ? এতোগুলো রহস্যময় খুনের কারণ জানা যাবে আজ। ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত রোমাঞ্চ বোধ করছে তমাল। উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করল, ‘স্যার? আপনার সত্যিই মনে হয় খু’নি কে আমরা জানতে পারব আজ?’
‘ জানিনা। তবে আমি এইটুকু মোটামুটি নিশ্চিত যে খু’নি আজ সাভারের ঐ ফ্ল্যাটে যাবে। শান মীর্জার কাছে।’
‘ ওসির কলটাও আসছেনা এখনো। আশ্চর্য! আমরা ধরতে পারব তো ওকে?’

‘পারা উচিত। না পারলে সেটা আমাদের ব্যর্থতা হবে। তবে আজ কিছুতো একটা হবে। এইটুকু নিশ্চিত। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।’
তুহিন কৌতূহলী হয়ে বলল, ‘ কী কথা স্যার?’
‘ শান মীর্জাকে আদোও জীবিত পাবোতো?’

তুহিনের কথা শুনে লোম দাঁড়িয়ে গেল তমালের। মাঘের রাত, কনকনে শীত, তারসাথে এরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি। কী হতে চলেছে আজ? শান মীর্জাকে বাঁচাতে পারবে? খুনিকে ধরতে পারবে ওরা? তমালের এসব ভাবনার মাঝেই তুহিনের ফোন বেজে উঠল। ইষৎ চমকে উঠল তমাল। তুহিনও চমকেছে। ফোনটা হাতেই ছিলো দ্রুত রিসিভ করে বলল, ‘হ্যালো?’
ওপাশ থেকে কেউ কিছু একটা বলল। যা শুনে ভ্রু জোড়া কুঁচকে গের তুহিনের। ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘একটা পোকাও যেন বিল্ডিং থেকে বের হতে না পারে। আমি আসছি।’

কথাটা বলে কল কেটে দিল তুহিন। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ড্যাম ইট!’
তমাল ঘাবড়ে গেল। উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘ কী হয়েছে স্যার?’
‘ তাড়াতাড়ি চল।’ অদ্ভুত ঠান্ডা কিন্তু কঠোর শোনালো তুহিনের গলা।

শানে মীর্জার ফ্ল্যাটের বিল্ডিং এর নিচে এসে থামল তুহিনের গাড়ি। দ্রুত নামল গাড়ি থেকে। পুলিশের গাড়ি দাঁড় করানো আছে নিচে। সঙ্গে একটা অ‍্যাম্বুলেন্স। দেখে বোঝা যাচ্ছে এইমাত্রই এসেছে। তুহিন আর তমাল দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল তখন আবারও তুহিনের ফোন বেজে ওঠে। ইরা ফোন করছে তখন থেকে। কিন্তু তুহিন রিসিভ করেনি এতক্ষণ। এইমুহূর্তে ঝগড়া করার ইচ্ছা ওর নেই। ফ্রী হয়ে, ঠান্ডা মাথায় কথা বলে ব্যপারটা ঠিক করতে হবে। কিন্তু ইরা কল করেই যাচ্ছে। তুহিন তমালকে ভেতরে ঢোকার ইশারা করে একটু সাইডে চলে এলো। ফোনটা রিসিভ করে বলল, ‘ আমি ব্যস্ত আছি এখন। আই’ল কল ইউ ব্যাক।’

‘ জাস্ট এক মি..’
‘ ইরা বললাম পরে কল করব আমি। প্লিজ!’
‘ আমি..’
কিন্তু ইরার কথা শোনার সময় হলোনা তুহিনের। নিজের কথাটুকু বলেই ফোনটা রেখে দিল। পেছন ঘুরে দেখল রাস্তা দিয়ে একটা বাইক চলে গেল। কালো রঙের। বাইকচালকও কালো জ্যাকেট পড়া ছিল। দু সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে রইল তুহিন। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো ওর। ভেতর ভেতর শিরশির করে উঠল যেন। সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে প্রায় দৌড়ে চলে গেল ভেতরে। গেইটের কাছে দুজন হাবিলদারকে গার্ড দিতে দেখে সন্তুষ্ট হলো। কেউ বের হতে পারেনি তাহলে।

শান মীর্জার রক্তাক্ত শরীরটা স্ট্রেচারে তুলে নিচে নিয়ে গেল পুলিশ। ছাদের চারপাশটা ভালোভাবে লক্ষ্য করল তুহিন। হেঁটে হেঁটে সবটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝল, ছাদ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোন চান্স নেই। খু’নিকে সিঁড়ি দিয়েই নামতে হয়েছে এবং বিল্ডিং এর গেইট দিয়েই বের হতে হয়েছে। তুহিন চারপাশে তাকাতে তাকাতে ডাকল, ‘ওসি সাহেব।’
দ্রুত তুহিনের কাছে এগিয়ে এলো ওসি। বলল, ‘ইয়েস স্যার?’

‘ এখানে যখন পৌঁছলেন তখন শান এখানে একা ছিলেন?’
‘ জ্বি, স্যার।’
শান মীর্জা জীবিত। তারমানে পুলিশ চলে আসায় খু’নির পক্ষে মা’র্ডা’র করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ তখনও খু’নি বিল্ডিং এর ভেতরেই ছিল। তুহিন বলল, ‘গোটা বিল্ডিং চেক করেছেন?’
‘ চেকিং চলছে স্যার। এখনো অবধি পাওয়া যায়নি।’
এরমধ্যেই একজন হাবিলদার এসে হাজির হলো। হাপাতে হাপাতে বলল, ‘ স্যার পেছনের গেইটের একজন হাবিলদারকে অজ্ঞান অবস্থায় গাছের পেছনে পাওয়া গেছে।’

আঁতকে উঠলেন ওসি। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ কী বলছো? তুমি কী করছিলে?’
‘ আমিতো একটু..’ কনিষ্ঠা আঙুল তুলে দেখাল লোকটা। বলল, ‘ফিরে এসে দেখি ও নেই। তারপর একটু খুঁজতেই অজ্ঞান অবস্থায় পেছনে..’
কথাটা শেষ করতে পারল না হাবিলদার। তার আগেই ওসি ধমক দিয়ে বলল, ‘কাজের সময়ই তোমাদের ‘ইয়ে’ পায় ননসেন্স! এখন এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার চেহারা না দেখে ওটার জ্ঞান ফেরাও। পেছনের গেইটে আরও দুজন পাঠাচ্ছি আমি।’

তুহিন গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘তার আর দরকার নেই। পালিয়ে গেছে ও।’
ওসি তাকিয়ে রইলেন তমালের দিকে। কিন্তু কিছু বললেন না। তুহিনের মেজাজ ভয়ানক খারাপ হচ্ছে। পরপর ন’জনকে খু’ন করেছে। এরকম একজন সিরিয়াল কিলারকে আটকাতে এতো দুর্বল লোক কারা রাখে? মজা করছে এরা সবাই ওর সাথে? কিন্তু মুখে কিছু বলল না। তমালকে বলল, ‘কালো বাইকে করে কালো জ্যাকেট পড়া একজনকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেছি আমি। আই থিংক পেছনের গেইট দিয়ে বেরিয়ে বাইক নিয়ে সামনের রোড দিয়ে চলে গেছে। বুঝতেই পারিনি এই বিল্ডিং থেকে বেরিয়েছে।’

একটুর জন্যে! জাস্ট একটুর জন্যে খুনি হাতছাড়া হয়ে গেল ভেবে নিজেরই মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হলো তুহিনের। তুহিনের কথা শুনে তমাল কিছু একটা ভাবল। ভেবে চমকে গিয়ে বলল, ‘স্যার, আমি সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় কালো পোশাক পড়া একজনকে নামতে দেখেছিলাম।’
চমকে উঠল তুহিন। তমালের দিকে ঘুরে বলল, ‘কাকে?’
‘ আনফরচুনেটলি আমি চেহারাটা দেখতে পাইনি। তার আগেই নেমে গেছে।’
‘ থামাও নি কেন?’ ধমকে উঠল তুহিন।

‘ আমি ভেবেছিলাম নিচের ফ্লোরের কেউ। আর বাইরে গার্ডও দেখে এসছিলাম। ভেবেছিলাম বাইরে নিশ্চয়ই যাচ্ছেনা। ছাদে আসাটা বেশি ইম্পর্টেন্ট মনে হয়েছিল। তাই_’
তুহিন চোখ-মুখ খিচে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেকে বিরত রাখল এদের কড়া কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেওয়া থেকে। জাস্ট একটুর জন্যে কেসটা সলভ হতে গিয়েও হলোনা। তখন যদি ইরার সঙ্গে কথা বলতে না যেতো তাহলে হয়তো এতো বড় ব্লান্ডারটা হতো না। ও নিজেই দেখতে পেতো খু’নিকে। তুহিন ওসিকে জিজ্ঞেস করল, ‘শওকত মীর্জাকে খবর দেওয়া হয়েছে?’
‘ইয়েস স্যার। উনি বলে দিয়েছেন তার ছেলের চিকিৎসার যাতে কোন ত্রুটি না হয়। উনি সব টাকা পাঠাবেন। আর শীঘ্রই বাংলাদেশ আসার চেষ্টা করবেন।’

ওখানকার সব কাজ সেরে নিয়ে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলো তুহিন। এতক্ষণ একটু একটু লুকিয়ে রাখা ক্লান্তি যেন একঝাঁকে তীব্রবেগে হানা দিল শরীরে। গাড়ির ব্যাকসিটে বসে গা ছেড়ে দিল একদম। ঠিক সেই মুহূর্তে আবার কল এলো তুহিনের। যন্ত্রণায় মাথা যেন ধরে এলো তার। রিংটোনটা যেনো গা জ্বালিয়ে দিল একেবারে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সোজা হয়ে বসল তুহিন। ফোনটা বের করে দেখল স্ক্রিনে ‘ইরাবতী’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু আজ নিজের ইরাবতীর নামটা দেখে খুশি হতে পারল না তুহিন। বরং রেগে গেল। হঠাৎই মেয়েটার ওপর ভীষণই মেজাজ খারাপ হলো ওর। ফোনটা রিসিভ করে ইরা কিছু বলার আগেই ধমকে বলে উঠল, ‘বলেছিলাম না আমি কল ব্যাক করব? ব্যস্ত আছি? বলেছিলাম? এইটুকু অপেক্ষা সহ্য হয়না? কী চাইছোটা কী তুমি? আমার জব, প্রফেশন ফেলে আমি ঘরে বসে থাকি? এরপর তোমাকে ঘরে ডেকে এনে হা করে বসে বসে তোমার ফাল্তু বকবকানি শুনি? হ্যাঁ?’

ওপাশ থেকে ইরার বলল, ‘এভাবে কথা বলছো কেন?’
‘ ভুলতো কিছু বলিনি। আমি জানি আমি তোমাকে সময় দিতে পারিনা। তাই বলে তুমি যখন-তখন ফোন করবে? আরে তুমিতো আমার প্রফেশন সম্পর্কে জেনেই আমার সঙ্গে রিলেশনে জড়িয়েছিলে রাইট? তাহলে এখন এতো অভিযোগ কেন? কীসের? সময় অসময়ে কল করে খেয়েছি কি-না, ঘুমিয়েছি কি-না, বেঁচে আছি কিনা। বাচ্চা আমি? তোমার কোন ধারণা আছে এসবে কতোটা ডিস্টার্ব হয় আমার? বিরক্ত লাগছে এখন আমার। জাস্ট বিরক্ত। একটু শান্তি দাও। প্লিজ?’
কয়েক সেকেন্ড কোন কথা বলল না ইরা। এরপর কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, ‘সরি। তোমাকে ডিসটার্ব করার জন্যে। শান্তি উপভোগ করো।’

বলে ইরা কল কেটে দিল। তুহিন একপ্রকার ছুড়েই ফোনটা ফেলে রাখল একপাশে। এরপর আবার গা এলিয়ে দিলো গাড়ির সিটে গা ছেড়ে দিল। কী বলল, কাকে বলল জানেনা ও। জানতে চায়ও না। সবকিছুই বিরক্ত লাগছে। একমিনিটের মধ্যে তমাল এলো। তুহিনকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে বলল, ‘স্যার? ঠিক আছেন?’
তুহিন চোখ খুলল না। ক্লান্ত গলায় বলল, ‘গাড়ি চালাতে বলো।’
*

সকাল সাড়ে দশটার দিকে অফিসে পৌঁছলো তুহিন। রাত থেকেই মন-মেজাজ ভালো নেই ওর। সাথে আবহাওয়াও ভালো নেই। অর্ধেক দিন পাড় হতে চলল। কুয়াশা কাটছেই না। বের হতে একদমই ইচ্ছে করছিল না আজ ওর। কিন্তু কাজতো করতেই হবে। অফিসে পৌঁছতেই তমাল ওকে সেই জাল ইনফরমেশ তৈরীকারী তিনজনের কাছে নিয়ে গেল। ধরে নিয়ে আসা হয়েছে ওদের। তিনজনকেই ভালভাবে লক্ষ্য করল তুহিন। তারপর বলল, ‘কতদিন ধরে চলছে এই ধান্দা?’

একজন বলল ছয় মাস, বাকি দুজন বলল দেড় বছর। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এতোদিন ধরে জালিয়াতি করছে অথচ কেউ ধরতেই পারেনি। এদের সাহায্যে না জানি কোথায়, আরও কতরকম ক্রাইম করেছে কতলোক। নীতি নৈতিকতার কথা ছেড়ে কাজের কথায় পাড়ল তুহিন। ফেনীর সেই হোটেলে পাওয়া জ্বাল ইনফরমেশনের ডিটেইলস বের করে তিনজনকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা তোমাদের মধ্যে কে বানিয়েছে? মিথ্যা বলবেনা। সত্যি বের করার অনেক সুন্দর সুন্দর উপায় জানা আছে আমাদের। আমরা চাইনা সেটা ব্যবহার করতে।’

ডান পাশে বসে থাকা লোকটা শুকনো এক ঢোক গিলে তুতলে বলল, ‘ আ-আমি বানিয়েছি।’
তুহিন পকেট থেকে রুদ্রর ছবি বের করে ধরল লোকটার সামনে। প্রশ্ন করল, ‘ এই লোকটাই বানাতে বলেছিলো তাইনা?’
লোকটা ছবিটা দেখে সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ‘ জ্বি স্যার। রুদ্র ভাই। ‘

তুহিন তমালের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই তমাল দুজনকে বলল ওদের নিয়ে যেতে। ওরা চলে যেতেই তুহিন রুদ্রর ছবিটা তুলে ধরল নিজের চোখের সামনে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, ‘শুনেছিলাম যতো বড় ক্রি’মি’না’লই হোক না কেন একদিন না একদিন তাকে পেছলাতেই হয়। তোমার ক্ষেত্রেও সেটাই হলো রুদ্র। প্রমাণ, সাক্ষী সব আমার হাতেই আছে। আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। এরপর তোমাকে অ‍্যারেস্ট করার অফিশিয়াল ওয়ারেন্ট আমার হাতে থাকবে।’
এরপর তমালকে বলল, ‘ শান মীর্জার কী খবর?’

‘ আউট অফ ডেঞ্জার, স্যার। তবে জ্ঞান ফেরেনি।’
‘ মিসেস শায়লাকে খুঁজে পেয়েছো?’
‘ চাঁদপুর আছে স্যার। খোঁজ নেওয়া হয়েছে। লোক গেছে।কালকের মধ্যে ধরে নিয়ে আসবে।’
‘ আমের ভিলা, নীরব, মীরা কারো কোন খবর?’
তমাল চুপ হয়ে গেল। তুহিন ভ্রু কুঁচকে তাকতেই বলল, ‘আমের ভিলার কারো খোঁজ নেই স্যার। না নীরবের। জাফর আমেরের বউ বাচ্চা সিঙ্গাপুর থাকতো। ওখানে খোঁজ করছি স্যার। রিপোর্ট চলে আসবে। কিন্তু..’
‘ কিন্তু?’

তমাল আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘ মীরা বেঁচে নেই স্যার। বছরখানেক আগেই মারা গেছে। ডিটেইল চলে আসবে শীঘ্রই।’
তুহিন থম মেরে তাকিয়ে রইল তমালের দিকে। অর্থাৎ আমের ভিলার সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন সবার সঙ্গেই কিছু না কিছু হয়েছে। কেউ রেহাই পায়নি। কেউ না!

সন্ধ্যার পর জ্ঞান ফিরল শানের। বেশ গুরুতর কয়েকটা আঘাত পেয়েছিল। কিন্তু কোন আঘাতেই ইন্টারনাল কোন ক্ষতি হয়নি। তাই এখন মোটামুটি সুস্থ সে। তবে দুদিন হসপিটালের বেডে শুয়ে বিশ্রাম নেওয়ারই পরামর্শ দিয়েছেন ডক্টর। খবর পেয়েই হাসপাতালে পৌঁছলো তুহিন। কাল এতো প্রেশারে ক্যাচ করতে না পারলেও সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেই বুঝতে পেরেছে ব্যপারটা। শান যেহেতু বেঁচে আছে। নিশ্চয়ই ওর ওপর হা’ম’লাকারীকে দেখেছে। আর শানের কাছ থেকেই হয়তো খু’নির খোঁজ পাবে। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে শান সত্যি বলবেনা। নিজেকে বাঁচানোর জন্যে হলেও না।

শানের কেবিনে গিয়ে বসল একটা টুল টেনে। শান বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে। মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ। শানের চেহারা দেখে কেমন চেনা চেনা লাগল তুহিনের। আগেও কোথাও একটা দেখেছে বলে মনে হলো। সেসব ভাবনা বাদ দিয়ে তুহিন মুচকি হেসে বলল, ‘কেমন আছেন?’
শান গম্ভীর গলায় বলল, ‘ ভালো।’
‘ আপনার ওপর কে হামলা করেছিল? আর কেন?’
‘ আমার মনে হয় সেটা খুঁজে বের করা আপনার কাজ।’

শানের কঠোর, ত্যাড়া জবাবে ভ্রু কুঁচকে গেল তুহিনের। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ‘আমি জানি আমার কাজ কী। আর আমার কাজটাই আমি করছি মিস্টার মীর্জা। প্লিজ কোঅপারেট।’
‘ বলুন।’ শানের কন্ঠে বিরক্তি স্পষ্ট।
তুহিন শানের দিকে হালকা ঝুকে মৃদু গলায় বলল, ‘রুদ্রই আপনাকে খু’ন করতে এসেছিল। তাইনা?’

চমকে উঠল শান। কিন্তু নিজেকে সামলে নিতে সেকেন্ডের বেশি সময় নিলোনা। অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘কে রুদ্র?’
তুহিন হাসল। শানের ঐ সেকেন্ডের চমকে ওঠা ওর নজর এরায় নি। আঙুল দিয়ে নাক চুলকে বলল, ‘খুব অপরিচিত নাম। জীবনেও শোনেন নি। তাইনা?’
‘ না। শুনেছি। কিন্তু এই নামের কাউকে পার্সোনালি চিনিনা।’

‘ আচ্ছা। মেনে নিচ্ছি। কিন্তু যে আপনার ওপর হামলা করেছে তার চেহারার একটা ডেসক্রিপশনতো দিতেই পারেন তাইনা?’
শান তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ না পারিনা। কারণ ওর মুখ দেখিনি আমি। মাস্ক পড়া ছিল। পরনে একটা কালো জ্যাকেট ছিল। এইটুকু ছাড়া ওর সম্পর্কে আর কিছুই জানানোর নেই আমার।’
‘ আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?’

‘ আপাতত না। মনে হলে জানাতাম। এখন রেস্ট করতে দিন আমাকে। আপনি আসতে পারেন।’
তুহিন ঠোঁটে মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই বলল, ‘ যাব তো বটেই। তবে মিথ্যা বলে আপনার বিশেষ কোন লাভ হচ্ছেনা মিস্টার মীর্জা। বরং নিজের বিপদ বাড়াচ্ছেন। সত্যি অবধিতো আমি পৌঁছেই ছাড়ব। কিন্তু ততদিন আপনি থাকবেন কি-না সেটা ভাববার বিষয়। যদিও এখন থেকে কড়া পাহাড়ায় থাকবেন আপনি। তুবুও, নিজের খেয়াল রাখবেন।’
কথাটা বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল তুহিন। শানের চুপ থাকার কারণটা বুঝে গেছে ও। এ কয়েকদিনের রিসার্চে অনেক অজানা তথ্য ওর জানা হয়ে গেছে। অনেক সত্যি সম্পর্কে ও অবগত হয়েছে। তাই অনেক কিছুই পরিষ্কার তুহিনের কাছে।

কোনমতে ঐ দিনটা কেটে গেল। তুহিন কেইসের কাজটা নিয়েই যথেষ্ট ব্যস্ত ছিল। একা একাই কীসব করছিল যা সম্পর্কে তমালের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলোনা। তবে এইটুকু বুঝতে পারছিল যে তুহিন আলাদাভাবে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। অবসর সময়টা হঠাৎ হঠাৎ ইরার কথা মনে পড়েছে তুহিনের। ভীষণ ইচ্ছা হয়েছে একটা কল করতে। কিন্তু ইগো নামক বস্তুটা বাঁধা দিচ্ছিল মাঝপথে এসে। মনে মনে আশা করেছিল ইরা নিজেই হয়তো একটা কল করবে। কিন্তু ইরাও ওকে কোন ফোন করেনি।

চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে শায়লা। ওর সামনেই তুহিন বসে আছে। শায়লাকে ঘামতে দেখে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল তুহিন। শায়লা কাঁপাকাঁপ হাতে গ্লাসটা নিল। তিন ঢোকে শেষ করে ফেলল পানিটা। তুহিন এবার ধীরেসুস্হে প্রশ্ন করল, ‘ আপনাকে বারবার বলেছিলাম ঢাকা ছাড়বেন না। আমাদের আপনাকে দরকার হবে। কিন্তু আপনিতো হঠাৎই গায়েব হয়ে গেলেন। আচ্ছা সেসব ছাড়ুন। আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। আমি জানি আপনি কিছুই করেননি। আপনি এসবের মধ্যেও নেই। কিন্তু একটা সত্যি আপনি আমাদের কাছে লুকিয়েছেন। খু’নির পরিচয়। এইটুকু আমার জানা। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো কারণ কী? কেন আড়াল করতে চাইছিলেন খু’নিকে?’

শায়লা কেঁদে ফেলল। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ আমার বাচ্চা।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুহিন। বলল, ‘ গেস করেছিলাম। কিন্তু এটাই কী একমাত্র কারণ?’
‘ না। ঐ লোকটা আমাকে মুক্তি দিয়েছিল স্যার। ঐ নরপিশাচটা নরক বানিয়ে রেখেছিল আমার জীবনটাকে। জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছিল। তাও তিন নম্বর বউ করে। ওর শুধু আমাকে রাতেই প্রয়োজন পড়তো। আর অত্যাচারের কথা কী বলব স্যার। শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।’

তুহিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘ আপনার এই চুঙপ থাকার কারণে আরও দুটো মানুষের মৃ’ত্যু হয়েছে। আরেকজন ম’র’তে বসেছিল। আপনার বাচ্চার কিচ্ছু হবেনা আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। কিন্তু আপনাকে সত্যিটা বলতে হবে। আর না বললে আপনার বাচ্চার ক্ষতি কেউ আটকাতে পারবেনা। কারণ খু’নি এতক্ষণে জেনে গেছে আপনি আমাদের এখানে এসেছেন। আর আপনি কিছু না বললেও ওর মনে হবে আপনি বলে দিয়েছেন। সুতরাং আপনাদের এখন আমাদের সুরক্ষা প্রয়োজন। বুঝেছেন?’

মাথা নাড়ল শায়লা। তুহিন টেবিলে রাখা রুদ্রর ছবিটার দিকে ইশারা করে বলল, ‘এটাই সেই লোক?’
‘ হ্যাঁ। কিন্তু লোকটার দাড়ি একটু বড় ছিল। মনে হচ্ছিল টানা কয়েকদিন সেভ করেনি।’
প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু আদায় করে শায়লাকে বিদায় দিল তুহিন। রুদ্রর ছবিটা দেখে ঠোঁটে অর্থপূর্ণ হাসি ফুটল ওর। আনমনে বলল, ‘খেলা শেষ, রুদ্র আমের।’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৬

[ রি-চেইক করিনি। ভুল হতে পারে। ৪৭(২) অংশটুকু ছোটই। কাল দেব। ফর শিওর। ]

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৪৭(২)