মন বিনিময় পর্ব ২৭

মন বিনিময় পর্ব ২৭
তাসফিয়া হাসান তুরফা

পরদিন সকাল হতেই যথারীতি আত্মীয়সজনে ভরে গেলো স্বপ্নিলের নানিবাড়ি। যথারীতি বাজতে লাগলো বিয়ের ঢাকঢোল। ছোটদের চোখেমুখে আনন্দ, বড়দের চোখেমুখে ব্যস্ততার ছাপ। অবশ্য একেকজনের মাঝে একেক কাজ বন্টন করে দেওয়া হয়েছে, সে হিসেবেই যে যে নিজ নিজ কাজ করছে। স্বপ্নিল ব্যস্ত ছেলেদের সাথে বাজার করতে, পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সবকিছু হাতের নাগালে আছে কিনা এসব তদারকি করতে৷ একিভাবে রাহিতা একবার রান্নাঘরে টুকিটাকি কাজ করছে মামী-খালাদের সাথে, অন্যদিকে স্বপ্নিলের মামাতো খালাতো বোনদের সাথে ফাঁকে ফাঁকে গল্প করছে। এসবের মাঝেই কেটে গেলো দিন। বেলা গড়িয়ে হয়ে গেলো দুপুর থেকে বিকেল।

সবাই যে যার মতো করে মেহেদি দিচ্ছে, কাল থেকে স্বপ্নিলের মামাতো বোন অর্থাৎ নীতির বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু। ড্রয়িংরুমে বড়রা বসে চা-নাস্তা খাচ্ছে। আর বউয়ের রুমে বসেছে মেয়েদের আসর। নীতিকে ব্রাইডাল মেহেদি লাগিয়ে দিতে বাহিরে থেকে আর্টিস্ট নিয়ে আসা হয়েছে আর বাকি সবাই যে যার মতো করে নিজেরাই নিজেদের হাতে মেহেদি লাগাচ্ছে, অন্যকে লাগিয়ে দিচ্ছে৷ রাহিতাও ফ্রি হয়ে এসে বসলো রুমের এক কোণায়৷

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পাশের সেন্টার টেবিলে রাখা ডালায় বেশ ক’টা মেহেদির কোণ থাকলেও সে চুপ করে অন্যদের মেহেদি দেওয়া দেখছে, তার কারণ সে নিজে মেহেদি দিতে পারেনা। সবসময় বোন, ফ্রেন্ড না হয় কাজিনদের থেকেই দিয়ে নিতো। স্বপ্নিলের ছোট মামার দুটো জমজ মেয়ে আছে, হিয়া ও রিয়া। তারা দুজনই মেহেদি লাগাতে পটু। রাহিতাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে হিয়া এগিয়ে আসে ওর কাছে। ওকে দেখে সহাস্যে তাকায় রাহিতা। হিয়া মুচকি হেসে বলে,

—কি গো নতুন ভাবী, একা একা বসে আছো কেন এখানে? মেহেদি লাগাবেনা?
—লাগাতে তো চাই। কিন্তু কিভাবে লাগাবো সেটাই বুঝছিনা।
—তুমি মেহেদি লাগাতে পারোনা?
—নাহ। কার থেকে লাগিয়ে নিবো ওটাই ভাবছিলাম বসে বসে। তুমি পারো মেহেদি লাগাতে?

রাহিতার প্রশ্নে চোখমুখ চকচক করে উঠলো হিয়ার৷ সে যেন এটারই অপেক্ষায় ছিলো! কাউকে মেহেদি লাগিয়ে দিতে, নিজের প্রতিভায় অন্যকে রাঙিয়ে দেওয়ার মাঝেই যেন ভিন্ন এক সুখ পায় সে! তাইতো হাস্যোজ্জ্বল মুখে রাহিতাকে বললো,
—অবশ্যই, ভাবী। তুমি আমায় আগে বলবেনা? আমি আর রিয়াই তো সবাইকে দিয়ে দিচ্ছি। দেখো তাকিয়ে! তোমার হাতেও এক্ষুনি মেহেদি লাগিয়ে দিবো। দাড়াও নতুন কোন নিয়ে আসছি!

হিয়ার আগ্রহ দেখে হাসে রাহিতা। ও কোন নেওয়ার জন্য যেতেই চোখ ফিরিয়ে রিয়াকে দেখে সে। রিয়া একজনকে মেহেদি পড়াতে ব্যস্ত, সাথে আরেকজন সিরিয়ালে বসে অপেক্ষা করছে। এরই মাঝে নতুন মেহেদি নিয়ে ফিরে আসে হিয়া। সরে ওকে সোফায় বসার জন্য জায়গা করে দেয় রাহিতা।

রাহিতাকে ডিজাইন পছন্দ করতে বললে সে হিয়াকে বলে নিজের মনমতো কোনো সুন্দর ডিজাইন করে দিলেই হবে। হিয়াও রাজি হয়। অতঃপর লেগে যায় রাহিতার হাত মেহেদি লাগিয়ে দেওয়ার কাজে। ঘণ্টা দুয়েক পার হয় মেহেদি সম্পূর্ণ হতে। পুরো কাজ শেষ হওয়ার পর নিজের হাতের দিক তাকিয়ে মুগ্ধ হয় রাহিতা৷ তার হাত দুটোকে কি সুন্দরভাবেই না রাঙিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে হিয়াকে ধন্যবাদ জানায় সে। রাহিতার পর যারা হিয়ার কাছে মেহেদি দেওয়ার জন্য সিরিয়ালে ছিলো ওরাও বেশ প্রশংসা করে মেহেদির। সব শেষে গর্বিত মুখে হিয়া বলে,

—দেখলে তো? বলেছিলাম না আমি আছি? কি সুন্দর-ই না লাগছে গো তোমার হাত দুটো, ভাবী! আর মেহেদিটা ভালো, বেশ রঙ হবে মনে হচ্ছে।
বিনিময়ে রাহিতা হাসলো শুধু। এরই মাঝে কি যেন মনে হতেই হুট করে হিয়া দুস্টু কণ্ঠে বলে উঠলো,
—এই রে, আসল কাজই তো করিনি এখনো।
—কি কাজ?
—এই যে, এত সুন্দর করে তোমার হাতে মেহেদি দিয়ে দিলাম, কিন্তু এর মাঝে আমার ভাইয়ের নামটাই লিখলাম না! মেহেদিটা তো অপূর্ণ থেকে গেলো! হাতটা বাড়াও দেখি, কোথাও ফাঁকা পাই কিনা। ভাইয়ার নাম লিখে দেই৷

দুস্টুমি করে বললো হিয়া। ওর কথায় তাল মেলালো আশেপাশে বসে থাকা স্বপ্নিলের বোনেরাও। সবার এমন রিয়েকশন দেখে লজ্জায় পড়ে যায় রাহিতা। মনে মনে সে নিজেও চায় স্বপ্নিলের হাত নিজহাতে লিখাতে। কিন্তু মনের ইচ্ছের কথা বাইরে প্রকাশ করা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে৷ এরই মাঝে হিয়া আবারো বলে,

—কি এত ভাবছো, ভাবী? আরে হাত দুটো দাওনা। স্বপ্নিল ভাই দেখলে খুশি হয়ে যাবে।
রাহিতা থমকায় এক মুহুর্ত। মনে মনে ভাবে, স্বপ্নিল কি আদৌ খুশি হবে? মাত্রই তো সবকিছু ঠিক হতে শুরু করেছে তাদের দুজনের মাঝে। যদি পাছে স্বপ্নিল কিছু মনে করে? আবার পরমুহুর্তে নিজের চিন্তাভাবনায় নিজেই বোকা বনে গেলো রাহিতা৷ নিজের মনকে শাসালো, স্বপ্নিল কেন কিছু মনে করবে? সে তো ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে, আগের মতোন হচ্ছে। কাল রাতে ওর বলা কথাগুলোই তার প্রমাণ! নাহ, সে মোটেও রাগ করবেনা।

এটুকু তো চিনেছে স্বপ্নিলকে এতদিনে। কিন্তু সে নিজেকে নিয়ে চিন্তায় আছে কারণ তার লজ্জা। এই যে স্বপ্নিল যখন ওর হাতে মেহেদি দেখবে, মেহেদিতে জ্ব’লজ্ব’ল করতে থাকা নিজের নাম দেখবে। তখন ওর রিয়েকশন কেমন হবে? নিশ্চয়ই ক্ষে’পাবে ওকে, লজ্জা দিবে বেশ? আপাতত কাল রাতের পর রাহিতা নিশ্চিত হয়ে গেছে ছেলেটা মোটেও তার মতো নয়, তলে তলে বেশ নির্লজ্জ আছে বটে। তার বেহায়াপনা বের হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তাই লাজুক হেসে রাহিতা সিদ্ধান্ত নেয় সে নিজের হাতে স্বপ্নিলের নাম লেখাবে। হিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,

—আচ্ছা লিখো। তবে পুরো নাম লিখোনা। শুধু “S” লিখে দাও ছোট করে এক কোনায় তাহলেই হবে।
—ওমা? শুধু এস কেন? পুরো নাম লিখতে কি সমস্যা? সবাই তো তাই লিখে!
—সবাই তাই করলেও আমার ভাবী যে সবার মতো না, হিয়া আপু। আমার ভাবী প্রচুর লাজুক। ভাইয়ার একটু কথায় লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তাই শুধু এস লিখতে বলছে। এসব তুমি বুঝবেনা!
রুমে ঢুকতে ঢুকতে হাসির সুরে বলে সামিরা। ওর কথায় বাকি সবাই হেসে উঠে, বেচারি রাহিতা আরেকদফা লজ্জার সম্মুখীন হয়৷ অতঃপর সবার হাসিঠাট্টা, আড্ডা দেওয়ার মাঝে সে রাতের মেহেদি মাহফিলের সমাপ্তি ঘটে!

সারাদিনের কাজ শেষে রুমে ফিরেই গোসলে ঢুকেছিলো স্বপ্নিল। এত এত কাজের তদারকি করে ঘেমে-নেয়ে একাকার সে৷ রাহিতা রুমে না থাকায় বাথরুম থেকে গায়ে শুধু তোয়ালে পেচিয়ে খালি গায়েই বের হয় সে। অন্য তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হতেই সামনে তাকিয়ে চমকে যায় সে। রাহিতাও মাত্র রুমে ঢুকেছিলো, বাথরুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সেদিক যেতেই হুট করে স্বপ্নিলকে এভাবে আসতে দেখে ভড়কে যায় সে।

চমকে উঠে চোখ বড় বড় করে তাকায়। হুট করে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ায় থমকে যায় স্বপ্নিল নিজেও, মাথা মোছার তোয়ালেটা হাত থেকে নিচে পড়ে যায়। লজ্জায় চোখ খিচে বন্ধ করে অন্যদিক ঘুরে তাকায় রাহিতা। কি করবে ভাবতে না ভাবতে বাথরুমের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় সে, একিসাথে স্বপ্নিল সামনের দিক অগ্রসর হওয়ার চেস্টা করে৷ ফলশ্রুতিতে দুজনের মাঝে সংঘ’র্ষ হয়। স্বপ্নিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে ধরে রাহিতা। পড়ে যাওয়া বাচানোর জন্য ওর কোমড় আকড়ে ধরে নিজের দিক টেনে সামলে নেয় স্বপ্নিল৷ ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত রাহিতা কোনোমতে নিজের মেহেদি লাগানো হাতদ্বয় বাচিয়ে মুহুর্তেই ছিটকে পড়ে স্বপ্নিলের দিকে। কিছুক্ষণ দৃষ্টি বিনিময়ের মাঝেই অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একে-অপরের কাছে থেকে সরে যায় দুজনে। স্বপ্নিল কিছু বলতে যাবে তার আগেই মুখ অন্যদিক করে রাহিতা বলে ফেলে,

—আপনিই আগে যান। কাপড় পড়ে আসুন।
ওর কথা ও আচরণে মনে মনে হাসি পায় স্বপ্নিলের। হঠাৎ মাথায় ওকে জ্বা’লানোর দুস্টু বুদ্ধি চাপে। কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
—কেন? এভাবে থাকলেও কি সমস্যা? যে গরম পড়েছে আজকে! ভাবছি আজ এভাবেই থাকবো। তোমার সমস্যা নেই তো?

স্বপ্নিলের এমন কথা শুনে রাহিতার মুখ আপনাআপনিই হা হয়ে গেলো। একি বলছে নির্লজ্জটা? এটা যে স্বপ্নিল ওকে জ্বা’লানোর জন্যই বলছে রাহিতা বেশ বুঝে। তাই চোখমুখ পাকিয়ে মুখ খুলবে তার আগেই স্বপ্নিল আবারো বলে বসে,
—সমস্যা নেই, তাই বলবে তো? হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি। অবশ্য সমস্যা থাকার তো কথাই না, আফটার অল আমি তোমার একমাত্র স্বামী। কোনো পরপুরুষ তো আর নই।

—ছি! এই আপনি চুপ করবেন? সারাদিন পর অসময়ে এসব ফালতু কথা শুরু করেছেন কেন? এগুলো বাদ দিয়ে হয় নিজে দ্রুত তৈরি হন নয়তো আমায় যেতে দিন।
রাহিতার কথায় ঠোঁট বাকিয়ে হাসে স্বপ্নিল। গেঞ্জি বের করে পড়তে পড়তে বলে,
—আচ্ছা, সবই মানলাম। কিন্তু তোমার যে দু’হাতে মেহেদি লাগানো। তুমি বাথরুমে যেয়ে করবেটা কি?
স্বপ্নিলের কথায় বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে যায় রাহিতার। সেভাবেই বলে,

—আমার চুল খোলা, দেখতে পারছেন? বেসিনের পাশে চুলের কাটা রেখেছিলাম গোসলের আগে। সেটাই নিতে যাচ্ছি। চুলে লাগিয়ে নেবো কারও থেকে।
কথা বলার মাঝে রাহিতা বাথরুমে ঢুকে। নখের সাহায্য আলতোভাবে ধরে কাটা নিয়ে বের হয়ে আসে। এরই মাঝে স্বপ্নিল পুরোপুরি রেডি হওয়া শেষ। রাহিতা রুম থেকে বের হতে যাবে সে সময় স্বপ্নিল আবারো সামনে চলে আসে৷ প্রশ্ন করে,
—এখন আবার কই যাও?

উত্তর না দিয়ে ইশারায় নিজ হাতে থাকা চুলের কাটার দিকে ইশারা করে রাহিতা। সেদিক চেয়ে স্বপ্নিল হুট করে সেটি কেড়ে নেয় ওর হাত থেকে। রাহিতা ভ্রু কুচকে তাকাতেই নির্দ্বিধায় বলে,
—আমি থাকতে তুমি অন্য কারও কাছে কেন যাবে? আমি চুলে বেধে দিচ্ছি আসো।
চমকে উঠে স্বপ্নিলের কথা শুনে মেয়েটা। এক মুহুর্তের জন্য ভাবে স্বপ্নিল কি বলছে? ওর ভাবনার মাঝেই বিছানায় ওকে বসিয়ে পাশে নিজেও বসে স্বপ্নিল। নিজ থেকেই চুলের কাটা নিয়ে কিছুক্ষণ গবেষণা করে কোনোভাবে চুলে আটকে দেয় সেটা। অতঃপর নিজ সাফল্যে খুশি হয়ে গর্বের সহিত বলে,

মন বিনিময় পর্ব ২৬

—দেখলে তো? বলেছিলাম না পারবো? এটা এমন কি কাজ? স্বপ্নিল সব পারে।
ওর কথায় হেসে ফেলে রাহিতা। মনে মনে ভাবে, এই যে স্বপ্নিল মনের অজান্তেই ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। এটার খবর কি সে জানে?

মন বিনিময় পর্ব ২৮