মন বিনিময় পর্ব ৪৫ (২)

মন বিনিময় পর্ব ৪৫ (২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা

স্বপ্নিলের কথায় রাহিতা অবাক হয়। বেশ অনেকক্ষণ বিস্মিত নজরে চেয়ে রয়। কিছুক্ষণের মাঝে অনুভব করে নয়ন বেয়ে গড়িয়ে পড়া দু’ফোটা নোনা অশ্রুজল! কিন্তু সে কাদছে কেন? সে তো এ মুহুর্তেরই অপেক্ষায় ছিলো এতগুলো দিন, বিগত কয় মাস! অথচ আজ প্রাপ্তির পর সুখগুলো দু’চোখের অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে কেন! রাহিতা ভেবে পায়না। এর মাঝে অনুভব করে স্বপ্নিলের ওষ্ঠপুট নিজ দায়িত্বে শুষে নিয়েছে সে জল। আবেগে মত্ত রাহিতা মায়াভরা চোখে স্বপ্নিলের দিকে তাকাতেই দুই ভ্রু নাচিয়ে ঠাট্টার ছলে স্বপ্নিল বলে,

—কি হলো, তুমি কাদছো কেন? আমি তো মজা করছিলাম। আমি তোমায় আবার ভালোবাসি নাকি?
এবার স্বপ্নিলের কথায় রাহিতা হেসে ফেলে। মেকি রাগ দেখিয়ে চিম’টি কা’টে পেটে। তৎক্ষণাৎ ওকে ছে’ড়ে দেয় স্বপ্নিল। রাহিতা ভ্রু কুচকে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—সবকিছুতে শুধু ফাজলামি, তাইনা? আপনি আর ভালো হবেন না?
স্বপ্নিল বুকে দুই হাত গুজে দাঁড়ায়। রাহিতার পানে চেয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
—কি হবে ভালো হয়ে? তুমি কি আমায় ভালো থাকতে দাও কখনো? আসলে তোমাকে না এ কথাটা বলাই উচিত ছিলোনা আমার!
স্বপ্নিলের কথায় রাহিতা প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়। সে কি বলছে বুঝার চেস্টা করে জিজ্ঞেস করে,

—এভাবে বলছেন কেন? আমি কি করেছি?
এবার যেন স্বপ্নিল সুযোগ পায় এতদিনের মনের মাঝে পুষে রাখা রা’গ কমানোর। এতদিন মনের মাঝে চেপে রাখা ক্রো’ধ যেন হুট করেই জ্ব’লে উঠে বুকে। দু’চোখে আগু’নের ফুল্কি জ্বা’লিয়ে সে হঠাৎ দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসে রাহিতার দিকে। এভাবে হুট করে স্বপ্নিল রে’গে যাওয়ায় রাহিতা ভড়কায়! কিন্তু কিছু বলার আগেই স্বপ্নিল দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরে ওর বাহু। তে’জী কণ্ঠে বলে,

—কি করেছো বুঝোনি? নাকি এটাও আবার আমাকেই বুঝিয়ে বলতে হবে?
—আপনি হঠাৎ এভাবে রে’গে যাচ্ছেন কেন? এতক্ষণ তো ঠিকি ছিলেন! কি হয়েছে বলুন? আমি আসলেও বুঝতে পারছিনা।
চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে রাহিতা। ওর কথায় স্বপ্নিল ক্ষণিকের জন্য থামে। বারকয়েক শ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে ঠান্ডা গলায় বলে,

—বেশ! তবে বলছি শুনো। রাহিতা, তুমি তো একটা ম্যাচিউর মেয়ে৷ নিশ্চয়ই তুমি এতটাও অবুঝ নয় যে আমার মনে এখন তোমার জন্য কি অনুভুতি চলে সেটা এতদিন বুঝতে পারোনি? আমি জানি ঠিকি বুঝেছো এবং হয়তো অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরেছো। তবে কেন তুমি আমার সাথে এরকম করো? এই যেমন ধরো, যেদিন আমি বিদেশ চলে যাই। যাওয়ার আগে আমি তোমায় ইনডাইরেক্টলি বুঝিয়ে দিয়ে গেছি আমি তোমার জন্য কি ফিল করি। তুমি কি সেদিন আমার ভালোবাসা বুঝোনি? ভালোবাসা ব্যতীত তোমায় ছোঁয়ার অধিকার কি আমি দেখিয়েছি আগে কখনো?

রাহিতা মাথা নাড়ে। সেদিন ফ্লাইটে উঠার আগে ওটাই প্রথমবার স্বপ্নিলের তরফ থেকে ভালোবাসার ঘনিষ্ঠ স্পর্শ ছিলো ওদের মাঝে। এর আগে সে কখনো এভাবে নিজের অধিকার দেয়নি ওর উপর।
রাহিতা কিছু বলবে তার আগে স্বপ্নিল আবারো বলতে শুরু করে,

—তবুও তুমি কি করলে? এই যে আমি এতদিন নিজের মনের সাথে লড়াই করে, নিজের অনুভুতিদের স্বীকার করে প্রথমবার যেই না তোমার দিকে কদম বাড়ালাম, ওমনি তুমি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে? দু-দুটো সপ্তাহ ধরে কোনোরুপ যোগাযোগই করলেনা আমার সাথে! এটা কি বেশি বেশি ছিলো না? আমি চলে আসার আগে তোমায় কতবার বলেছিলাম, আমাদের মধ্যে যেন কোনোকিছু না বদলায়। অথচ তুমি কি করলে? আমার ভয়কে সত্যে রুপান্তর করে আমার থেকে দূরত্ব বাড়ালে! এ ক’দিন একা একা বিদেশের মাটিতে আমি কিভাবে ছিলাম, একটাবারও ফোন দিয়ে খোজ অব্দি নিলেনা আমার!

—আমি প্রতিদিন আপনার খোজ নিয়েছি, বিশ্বাস করুন! মা যখনি আপনার সাথে কথা বলতো ফোনে আমি সবসময় তার পাশেই ছিলাম, আপনার ব্যাপারে না জেনে, আপনার কণ্ঠ না শুনে আমি কোনোদিন ঘুমোতে যাইনি!
স্বপ্নিলের কথা শেষ না হতেই ওকে বাধা দিয়ে এসব বলে উঠে রাহিতা। এতক্ষণ স্বপ্নিলের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে সে অপরাধবোধে দ’গ্ধ হচ্ছে ভীষণভাবে! আসলেই তো। সে তো এভাবে কখনো ভেবেই দেখেনি! নিজের কস্টটা ভাবছিলো শুধু কিন্তু স্বপ্নিলের অনুভুতি নিয়ে ওভাবে মাথা ঘামায়নি!

নিশ্চয়ই মানুষটা কস্ট পেয়েছিলো ভীষণ? ইশ! কেন যে সে এসব ছেলেমানুষী করতে গেলো! রাহিতার বড্ড রা’গ হয় নিজের উপর। বিচলিত রাহিতার দুঃখের মাঝেই স্বপ্নিল উদাস কণ্ঠে বলে,

—অন্য কারও থেকে খোজ নেওয়া আর নিজে থেকে খোজ নেওয়ার মাঝে বিস্তর পার্থক্য আছে, রাহিতা। আমার বউয়ের অভাব অন্য কেউ পূরণ করতে পারবেনা। তুমি ও মা মিলে এ ক’দিনে আমার সাথে যা কিছু করেছো আমি তা ভুলতে পারবোনা। আজকে তুমি আমায় কোনোকিছু না বলে এখানে চলে এসেছো, ফোনটাও ধরছিলেনা আমার। কাল রাতেও ঠিকমতো কথা বলোনি আমার সাথে। একদিকে এই টেনশন। আবার অন্যদিকে যখন মা-কে জিজ্ঞেস করলাম যে তুমি কই গেছো, তখন মা আমায় কি বললো তুমি জানো?

স্বপ্নিলের প্রশ্নে রাহিতা মাথা নাড়ে। অর্থাৎ, সে জানেনা৷ স্বপ্নিল তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রয় কিছুক্ষণ৷ শক্ত চোয়ালে বলে,
—মা বলেছে, তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেছো। আমার কাছে আর ফিরবেনা কখনো।
রাহিতা প্রকটভাবে চমকায়! দিলারা বেগম যে স্বপ্নিলকে এটা বলবেন, সে কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি৷ কিন্তু, তিনি হঠাৎ এভাবে বললেন কেন? রাহিতা ভাবে আনমনে৷ ওর ভাবনার মাঝেই স্বপ্নিল আবারো মেঘমন্দ্র কণ্ঠে গ’র্জে উঠে বলে,

—কি হয়েছে? এটুকুতেই শ’ক খেলে নাকি? পুরোটুকু তো বলিই নি এখনো৷ সেটুকুও শুনো।
অতঃপর স্বপ্নিল সবকিছু খুলে বলতে শুরু করে। সকালে উঠার পর থেকে সে কি কি ধা’ক্কার সম্মুখীন হয়েছে, কতটা মানসিক চাপে পড়েছে তার সবটুকুই বিস্তারিত বিবরণ দেয়, কোনোকিছুই লুকোয়না রাহিতার নিকট৷ একে একে এতকিছু স্বপ্নিলের মুখে শুনে রাহিতার মাথা ঘুরায়। সে উপলব্ধি করে স্বপ্নিল কেন তখন ফাহিমের সাথে ওরকম আচরণ করেছে। আর কেনই বা এভাবে বিনা নোটিশে ব্যধি’গ্র’স্থের মতো দ্বিকবিদিক ভুলে ছুটে চলে এসেছে ওর দোরগোড়ায়! সবটাই যেন এখন স্বচ্ছ জলের ন্যায় ঝকঝকে পরিষ্কার। ব’জ্রা’হত রাহিতার গলা শুকায়, স্বপ্নিলের চোখে চোখ রাখতেও যেন লজ্জা পায়। জিব দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে স্বপ্নিলকে বুঝানোর জন্য বলে,

—সত্যি বলছি স্বপ্নিল, আপনাকে ছেড়ে আসার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিলোনা। যেদিন মা আমায় ডিভোর্সের কথা বলে আমি সেদিনই স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছি আপনাকে ছাড়ার হলে আমি সেদিনই ছাড়তাম যেদিন আপনার অতীতের কথা জেনেছি, যখন আপনি আমায় ভালোবাসতে অস্বীকার করেছিলেন। এরপর যেদিন বিদেশ থেকে এলেন ওদিন রাতেই মা আমায় ফোন করে বলে রিদিকে দেখতে ছেলেপক্ষ আসবে, আমি যেন সকাল সকাল চলে আসি। তারপর তো বৃষ্টিতে ভিজে আপনার জ্বর হলো, তাই সকালে ডাকিনি আর ইচ্ছে করে। পরে মা-কে জানিয়ে চলে এসেছি। কিন্তু মা যে আপনাকে এসব বলবে আমি ভাবতেও পারিনি। কেন যে উনি বললেন বুঝলাম না! আমার মনে হয় উনি হয়তো দেখতে চাইছিলেন আমার চলে যাওয়ার কথা শুনে আপনার উপর কিরকম প্রভাব পড়ে…

—জাস্ট শাট আপ, রাহি! কি শুরু করেছো তোমরা আমায় বলবে? আই থিংক তোমাদের কারও কাছেই আমার ফিলিংস এর কোনো মূল্যই নেই আসলে। যার যখন মন চায় সেভাবেই আমার অনুভূতি নিয়ে খেলো তোমরা। অবশ্য এটা নতুন নয়। আমি যাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, তারাই আমার সাথে সবসময় এরকম করে। মায়ের কথা আর না-ই বলি। বাবা হারানোর পর থেকে আমি কখনোই মায়ের অবাধ্য হইনি। তার কস্টগুলো চোখের সামনে দেখেছি বলে কখনোই মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করা তো দূর, তার কোনো কথায় না বলিনা। অথচ আমার মা কি করে? সবসময় আমার সাথে এরকম করে। অবশ্যই এগুলো আমার খুশির জন্য করেন কিন্তু শুরুতে কস্টটা তো আমিই পাই। ঠিক আছে, তাও না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু তুমি?

তুমি তো জানতে আমায় তাইনা? যেদিন থেকে তোমায় আপন মেনে আমাদের সম্পর্ককে সুযোগ দিয়েছি, সেদিন থেকে আর কোনো কিছুই লুকোইনি তোমার থেকে। বন্ধুত্ব থেকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমরা কতদূর এগিয়েছি এটা আমাদের চেয়ে ভালো অন্য কেউ তো জানেনা, তাইনা? আমি বারবার তোমায় বলছিলাম, রাহিতা আমায় একটু সময় দাও। তোমরা সবাই জানো আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি, পাগলের মতো ভালোবাসি কিন্তু তোমাদের কারও সম্ভবত ধৈর্য হচ্ছিলোনা এজন্যই আজ আমার সাথে এমন করলে। তাই আমিও এভাবে তাড়াহুড়ায় নিজের অনুভুতি ব্যক্ত করতে একপ্রকার বাধ্য হলা…

স্বপ্নিল কথা শেষ করার আগেই থেমে যায়। হঠাৎই ওর পুরুষালি ওষ্ঠে রাহিতার উষ্ণ ছোয়া পড়তেই কথা আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে যায়! স্বপ্নিল কিছুক্ষণের জন্য থমকে যেতেই রাহিতা লাজুক ভংগিতে সরে আসতে ধরে, তবে স্বপ্নিলের জন্য তা সম্ভব হয়না। দৃঢ় হস্তে টেনে নেয় রাহিতাকে নিজের কাছে। গোধূলির অস্তমিত সূর্যের সাথে তাল মিলিয়ে ওদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। দুজনের অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পরম এ ভালোবাসার মুহুর্ত শেষ হয় রাহিতার মৃদু ধাক্কায়। বাধা পেয়ে স্বপ্নিল সরে যায়। দুজনে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়। রাহিতা কিছুক্ষণ হাসফাস করলেও স্বপ্নিল নির্বিকার।
খানিকক্ষণ ওর দিকে চেয়ে থাকে রাহিতা। অতঃপর আলগোছে এগিয়ে এসে স্বপ্নিলের গালে হাত রাখে। মায়াভরা চোখে ওর চোখের দিক চেয়ে বলে,

—অনেক বলেছেন, এবার তো থামুন! আপনার সব কথা শুনেছি আমি, সবকিছুই বুঝেছি। সব প্রশ্নের উত্তরও দেবো। এখন দেখুন অন্ধকার হয়ে গেছে। মা বলে, মাগরিবের পর ছাদে থাকতে নেই। এছাড়াও সবাই জানে আমরা রুমে। ওখানে না পেলে দেখা গেলো পরে আবার এখানেই খুজতে চলে আসবে! এখন নিচে যাই প্লিজ?

স্বপ্নিল জবাব দেয়না। চুপচাপ তাকিয়ে রয়। অতঃপর সেই মোহগ্রস্থ স্বপ্নিলের হাত ধরে নিচে নামে রাহিতা। মেয়েটার চোখেমুখে লেগে আছে স্পষ্ট লাজুকতার আভাস৷ আর স্বপ্নিল? সে তো চোখভরা মুগ্ধতা নিয়ে ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে একধ্যানে চেয়ে আছে রাহিতার দিকে!

মন বিনিময় পর্ব ৪৫

এ প্রথম লাজলজ্জা ভুলে রাহিতাও নিজ থেকে কদম বাড়িয়েছে ওর দিকে।
দুজন নিচে নেমে গেলো। রাতের আকাশ প্রজ্জ্বলিত হয়ে দ্যুতি ছড়ালো চন্দ্রিমা। মনে হলো যেন আঁধার দুনিয়াকে আলোকিত করে সে নিজেও হাসছে এই কপোত-কপোতীর মন বিনিময় এর সাক্ষী হতে পেরে!

মন বিনিময় পর্ব ৪৬