বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩২

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩২
জাওয়াদ জামী

কোর্ট থেকে বেরিয়ে তাহমিদ নীরাকে বাসায় পাঠিয়ে দিল। ওর পাশেই তাওহীদ ভারাক্রান্ত মনে দাঁড়িয়ে আছে। নীরার সাথে কথা বলার মুখ ওর নেই। এতগুলো দিন ও মেয়েটাকে মিছেই কষ্ট দিয়েছে।
তাওহীদ ছোট ভাইয়ের সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ খুঁজছে। ও সিদ্ধান্ত নিল তাহমিদের সাথে মেডিকেলে যাবে। সেখানেই ওর সাথে কথা বলবে।

” প্রফেসর সাহেব, আপনি এখনও এখানেই দাঁড়িয়ে আছেন! আপনার কাজ শেষ। আপনি এখন কর্মস্থলে যেতে পারেন। ” তাহমিদ ব্যঙ্গ করে বলল।
তাওহীদ বুঝতে পারছে এমনটাই হবে। তাহমিদের যে রা’গ, এখন পর্যন্ত ওকে থাপ্পড় মা’রে’নি এটাই অনেক।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমাকে কয়েকটা মিনিট সময় দে। ” তাওহীদ অনুনয় করল।
” তোমার সাথে কথা বলার কোন রুচি আমার নেই। আর হ্যাঁ, তুমি বাসায় যাবেনা। বাসায় কেউ জানেনা, তুমি ঢাকায় এসেছ। আমি কাউকে জানতেও দিতে চাইনা। আর ভাবির সাথে কোনরূপ যোগাযোগ তুমি করবেনা। আমার কথা মনে রাখলে তোমার জন্য ভালো হবে। ” তাহমিদ কঠোর গলায় বলল।

” প্লিজ তাহমিদ, আমার কথা একটাবার শোন। আমাকে এক্সপ্লেইন করার একটা সুযোগ দে। ”
” এক্সপ্লেইন! কিসের এক্সপ্লেইন! আমার সাথে কথা বলতে তোমার লজ্জা করছেনা? ” গর্জে উঠল তাহমিদ। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কয়েকজন ওর দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে। সাথে সাথেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। এরপর দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

” তোমার কোন এক্সপ্লেইন শোনার ইচ্ছে আমার নেই। তুমি ভদ্রলোকের মত এক্ষুনি ঢাকা ছাড়বে। ভাবিকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলে না? এবার উল্টোটা হবে। ভাবি তোমাকে ডিভোর্স দেবে। এবং সেটা এক সপ্তাহের মধ্যেই। ”
” তাহমিদ চল আমরা কোথাও বসি। লোকজনের ভেতর এভাবে কথা বলা যায়না। ” তাওহীদ তাহমিদের হাত ধরে কোথাও নিয়ে যেতে চাইলেই, তাহমিদ ওর হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয়।

” তোমার মত আহাম্মকের সাথে কথা বলতেই আমার রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে। আর তুমি কিনা বলছ কোথাও বসবে! আরে আহাম্মক, কোন সম্পর্কের ভিত্তিই হল বিশ্বাস। তুমি একজনের সাথে বছরের পর বছর সংসার করেছ, সন্তান জন্ম দিয়েছ কিন্তু তাকে চিনতেই পারনি! এরপরও তুমি নিজেকে স্বামী হিসেবে যোগ্য মনে করছ? তুমি ভাবির যোগ্যই নও। একটা মেয়ে দিনের পর দিন চোখের পানি ফেলেছে, গুমড়ে ম’রে’ছে। তার মূল্য শোধ করবে কি দিয়ে?

একদিকে ব্ল্যাকমেইলের শিকার, অন্যদিকে স্বামীর অবহেলা, অপমান। সেই মেয়ে এতদিন কি করে সহ্য করেছে এসব, সেই ধারনা তোমার আছে? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কি শুধুই শরীরের মধ্যে সীমাবদ্ধ? ভালোবাসা আর বিশ্বাস থাকলে শরীর ম্যাটার করেনা।

একটা মানুষকে চিনতে কয়েক বছর লাগেনা। তার মন পড়ার জন্য কয়েকটা দিনই যথেষ্ট। একটাবারও তূরের কথা ভেবেছিলে? তোমার একটা সিদ্ধান্ত তার ওপর কিভাবে প্রভাব ফেলত সেটা তুমি একবারও চিন্তা করেছিলে? তোমার কোন কথা আমি শুনবনা। তুমি চলে যাও। ” তাহমিদ আঁড়চোখে দেখল আশেপাশে বেশ কিছু উৎসুক জনতা ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

” ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। তবে যাওয়ার আগে নীরা আর তূরকে নিয়েই যাব। তোর কোন বাঁধাই আমি মানবনা। ”
” তুমি যদি বাসায় যাও, তবে আমি তোমার বাবার বাড়িতে আ’গু’ন লাগিয়ে দেব। চিরতরে বাসায় আসার সাধ মিটিয়ে ছাড়ব। ” তাহমিদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।

তাহমিদের কথা শুনে তাওহীদের মুখ শুকিয়ে গেছে। ও ভালো করেই জানে তাহমিদের কথা না শুনলে কি হতে পারে। তাই আর কোন কথা না বলে একটা রিক্সা ডেকে উঠে পরল। এখন বড়মা’ই ওর একমাত্র ভরসা।
তাহমিদ বড় ভাইয়ের দিকে নজর না দিয়ে গাড়িতে উঠল।

তাওহীদ তুলনামূলক নির্জন স্থানে এসে আফরোজা নাজনীনকে ফোন দিয়ে সবকিছু খুলে বলল। সব শুনে আফরোজা নাজনীন স্তম্ভিত। তিনি ভাবতেই পারেননি নীরার সাথে এতকিছু ঘটেছে। অথচ মেয়েটাও কাউকে কিছুই না বলে চুপচাপ সব সহ্য করেছে! আফরোজা নাজনীন তাওহীদকে বাসায় যেতে বললেন। এখন যা করার তাকেই করতে হবে। তাহমিদের রাগ সম্পর্কে তার ভালো করেই জানা আছে।

আফরোজা নাজনীন তাওহীদকে বাসায় ডাকলেন। তিনি চাননা এসব নিয়ে কোন ঝামেলা হোক। তিনি কিছুতেই সংসারে ভাঙ্গন চান না।
তাওহীদ নীরা, তূর, কুহু আর সিক্তার জন্য অল্পস্বল্প কেনাকাটা করল। দিদুনের জন্য তার পছন্দের মিষ্টি আর দই নিয়েছে। মা আর বড়মার জন্যও তাদের পছন্দের মিষ্টি নেয়। ওর বাবা আর চাচ্চু মিষ্টি খুব একটা পছন্দ করেনা তাই তাদের জন্য ফল নিল। কিন্তু তাহমিদের জন্য কিছুই নিলনা। কারন তাহমিদ যদি জানে, বড় ভাইয়া ওর জন্য কিছু কিনেছে, তাহলে নির্ঘাত সেগুলো রাস্তায় ফেলে আসবে। তাই তাওহীদ ছোট ভাইয়ের রা’গ কমার অপেক্ষায় আছে। তাহমিদের রা’গ কমলেই ওকে কিছু কিনে দেবে।

তাওহীদ পুরো রাস্তা চিন্তা করতে করতে আসল। ও নীরার সামনে কিভাবে দাঁড়াবে বারবার সেই চিন্তাই করছে। নিজের ভুলে ও মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। গত দেড় বছরে ওকে ছুঁয়েও দেখেনি। এটা একটা কম অসম্মানের নয়।
নীরা কোর্ট থেকে বাসায় এসে সেইযে নিজের রুমে ঢুকেছে আর বের হয়নি। গত দেড় বছরের সমস্যার আজ সমাধান হয়েছে। কিন্তু তবুও নীরার কিছুই ভালো লাগছেনা। কেন ওর সাথেই এসব হল!

কেন তাওহীদ ওকে চরমভাবে অসম্মানিত করল? কেন তাওহীদ এতদিন ওর থেকে নীরাকে দূরে রাখল? আজ নির্দোষ প্রমানিত হওয়ার পরও কেন বারবার কষ্টে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ও? এত অস্থির লাগছে কেন? বারবার ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা এখন যদি ও ম’রে যায়, তবে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে? চিন্তার ঝড় উঠেছে নীরা মস্তিষ্কে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। আর কিছু ভাবতে পারছেনা ও। চোখ মুছে দিদুনের রুম থেকে তিনটা স্লিপিং পিল নিয়ে আসে। আজকে ওর গভীর ঘুম দরকার। গত দেড় বছরের কত রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছে, তা কেবল নীরা আর সৃষ্টিকর্তা জানে।

আফরোজা নাজনীন নীরার রুমে এসে ঘুমন্ত নীরাকে দেখে, ওর কাছে গিয়ে বসলেন। নীরার মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিলেন কিছুক্ষণ। মেয়েটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে দেখে ডাকলেননা। আজ তার ভিষণ আফসোস হচ্ছে, কেন একটিবার মেয়েটার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলেননা! এই মেয়েটাও বুকে কত দুঃখ পুষে রেখে হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলে গেছে!

তাওহীদ বাসায় এসে সবার সাথে কথা বলে নিজের রুমে এসে নীরাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখল। তূর নীরার পাশে বসে খেলছিল। নীরার দিকে তাকাতেই তাওহীদের বুকের পাঁজর ভাঙতে থাকল। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পরেছে। কতদিন পর ও নীরার দিকে তাকাচ্ছে সেটা মনে করতেই পারলনা! চোখের পানি মুছে মেয়েকে কোলে নিয়ে ওর সাথে কিছুক্ষণ খুনসুটি করে বড়মার কাছে যায়।

আফরোজা নাজনীনের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে তাওহীদ। আজ ওর কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার অবস্থা নেই। নিজেকে একজন নিকৃষ্ট স্বামী আর নিকৃষ্ট বাবা মনে হচ্ছে।
” তোর কাছ থেকে এটা আশা করিনি, তাওহীদ। তোকে বরাবরই বুঝদার ছেলে হিসেবে আমরা জেনে এসেছি। কিন্তু এত বুঝদার হয়েও এমন ভুল কিভাবে করলি?

নীরার সাথে একটাবারও আলোচনা করতে পারলিনা! যার সাথে কয়েকটি বছর পার করে দিলি, তাকে কিভাবে অবিশ্বাস করলি! কোন নারীর সাথে কয়েকমাস কাটালেই বোঝা যায় সে চরিত্রহীনা নাকি চরিত্রবান। কিন্তু তুই কয়েক বছর সংসার করেও নীরাকে চিনলিনা! এতবড় ভুল তুই কি করে করলি? তোর বাবা আর চাচ্চু শুনলে কত কষ্ট পাবে জানিস? আর তাহমিদকে কিভাবে সামাল দেব! নীরার সামনে কিভাবে দাঁড়াবি একবারও চিন্তা করেছিস? ও যদি নিজ থেকে সব ছাড়তে চায়, তবে আমাদের তাকে আটকানোর সাধ্য কোথায়! ”

” বড়মা, তুমি কি করে সব সামলাবে সেটা তুমিই জানো। তবে আমি আমার স্ত্রী-সন্তান, আমার পরিবার নিয়ে বাঁচতে চাই। নীরার সাথে আমি চরম অন্যায় করেছি, এটা আমি স্বীকার করছি। আমাকে যে শাস্তি দেবে, আমি মাথা পেতে নেব। কিন্তু নীরাকে আমার থেকে দূরে রাখার শাস্তি তোমরা দিওনা। আমি এতটুকু সময়ের মধ্যেই ভেতর থেকে নিঃস্ব হয়ে গেছি। বাকিটা জীবন নীরার ছেড়ে থাকার কথা ভাবলেই আমার শ্বাস আটকে আসছে। আমি ম’রে যাব, বড়মা। ” তাওহীদ আফরোজা নাজনীন দুই হাত নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে কাঁদছে।

” তুই রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি খাবার দিচ্ছি। নিশ্চয়ই সকাল থেকে কিছুই খাসনি? চোখ মুছে স্বাভাবিক হ। তাহমিনাকে এসব বুঝতে দিসনা। ও কষ্ট পাবে। এই পরিবারকে আঁকড়ে ধরে, তোদেরকে আঁকড়ে ধরেই ও বেঁচে আছে। ওর নিজের বাপের বাড়ি থেকেও নেই। তোরা দুই ছেলেই ওর সব। এত বোধবুদ্ধিহীন কাজ করলে চলে কিভাবে বলতো? তুই যা। তাহমিদ আসলে আমি ওর মুখোমুখি হব। তবে আর কখনোই নীরার সাথে এমন অন্যায় করিসনা। ” তাওহীদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আফরোজা নাজনীন।

” আমার শিক্ষা হয়ে গেছে, বড়মা। একই ভুল বারবার করার মানুষ আমি নই। নিজের জিনিসকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখব। একটুও ফসকাতে দেবনা। তুমি দোয়া কর, বড়মা। ”

” আমার দোয়া সব সময়ই তোদের সাথে আছে থাকবে। তোদের জন্ম না দিয়েও আমি তোদের মা হয়েছি। আমাকে মা’য়ের জায়গাটুকু তোরা দিয়েছিস। তোদের জন্য দোয়া না করলে যে আমার পাপ হবে। ”
তাওহীদ ওর বড়মাকে জড়িয়ে ধরে। ও ভালো করেই জানে পুত্রহীনা এই বড়মা, ওদের জন্য কি। এই পরিবারের জন্য কি। তার জন্যই এই পরিবার আজও টিকে আছে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩১

তাওহীদ রুমে এসে ফ্রেশ হতেই, আফরোজা নাজনীন মনিকে দিয়ে রুমেই খাবার পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ওর ক্ষুধা থাকলেও খেতে ইচ্ছে করছেনা। তাই খাবারগুলো ঢেকে রেখে, নীরার পাশে শুয়ে পরল। নীরাকে জড়িয়ে ধরে ওর কপাল, চোখ, নাক, ঠোঁটে চুমুয় চুমুয় ভরিয়ে দেয়। ক্লান্তিতে ওর দুচোখ বুজে আসছে। বিরহের আ’গু’নে ও-তো কম জ্ব’লে’নি। ভালোবাসা হারানোর ব্যথা মাঝেমধ্যে রুদ্ধ করত ওর শ্বাস-প্রশ্বাস। আজ থেকে চিন্তা মুক্ত হল। আজ একটু শান্তিতে ঘুমাবে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৩