মন বিনিময় পর্ব ৪৫

মন বিনিময় পর্ব ৪৫
তাসফিয়া হাসান তুরফা

ত্রস্ত পায়ে রাহিতা ছুটে এসে স্বপ্নিলের বাহু ধরে ফাহিমের কাছে থেকে টেনে সরিয়ে নেয়। অবশ্য সরিয়ে নেয় বললে ভুল হবে। হৃষ্টপুষ্ট স্বপ্নিলকে টেনে সরানোর মতো জোর ওর নেই, বরঞ্চ ওকে কাছে আসতে দেখে স্বপ্নিল নিজ হতেই সরে গেছে। বাহুতে প্রেয়সীর ছোয়া পেয়ে পুরুষালি দেহের ভাজে লুকোনো কোমল সত্ত্বা বেড়িয়ে এসেছে নিজ হতেই। এদিকে স্বপ্নিলকে ছাড়ানো শেষে লজ্জিত রাহিতা ব্যস্ত কণ্ঠে ফাহিমের উদ্দেশ্যে বলে,

—ফাহিম, আই এম রিয়েলি সরি। উনার পক্ষ থেকে আমি মাফ চাইছি। প্লিজ তুমি ভুল কিছু ভেবোনা। এখানে বড় একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে!
রাহিতার কথা শুনে ফাহিম শ্বাস ফেলে। তার মানে সে যা ভেবেছিলো তাই হয়েছে। এটা নিশ্চয় রাহিতার স্বামী। তাই মনের প্রশ্ন সরাসরি করে বসে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—উম, ইটস ওকে। আমি নিজেও বুঝেছিলাম কিছু একটা ভুল বুঝাবুঝি অবশ্যই হয়েছে। নয়তো অচেনা মানুষের সাথে এমন কেউ করেনা।
ফাহিমের কথায় রাহিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে! যাক ছেলেটা উল্টাপাল্টা কিছু ভাবেনি এতেই শান্তি। এরই মাঝে ফাহিম আবারো বলে,

—বাই দ্যা ওয়ে রাহিতা, ইনি কি আপনার হাসবেন্ড?
—জি। এজন্যই ভুল ভেবেছিলেন। আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ। অলরেডি অনেক সময় ওয়েস্ট হয়ে গেছে। গাড়িতে আপনার বাবা-মা অপেক্ষা করছে নিশ্চয়ই? গাড়ি কোথায়? দেখছিনা যে?
—ওহ, তাই তো! আমি তো এসবের মাঝে ওটা ভুলেই গিয়েছিলাম। গাড়ি গলির শুরুতে রেখে আমি এসেছিলাম দিক চিনে নিতে, কিন্তু এসবের মাঝে আর খেয়াল ছিলোনা। এখন যাই কেমন? বাবা-মা নিশ্চয়ই ভাবছে ঠিকানা খুজতে যেয়ে আমি কই নিখোজ হয়ে গেছি!

ফাহিমের মশকরায় হেসে ফেলে রাহিতা। ফাহিমকে ওদের বাসার দিক-নির্দেশনা দেখিয়ে দিয়ে, একিসাথে অনুরোধ করে ওর বাবা-মাকে মাত্র ঘটে যাওয়া বিষয়ে কিছু না বলতে! পরে সব ঘটনা শুনবে এ আশ্বাস নিয়ে ফাহিম নিজের গাড়ির দিক ফেরত চলে যায়। ফাহিম যেতেই স্বপ্নিলের বাহু ছেড়ে দেয় রাহিতা। একিসাথে কড়া চোখে তাকায় ওর দিকে। স্বপ্নিল শুধু চুপচাপ শুনছিলো দুজনের কথাবার্তা। এতক্ষণে সে নিজেও বুঝেছে তার কোনো একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। কিন্তু সেটা কি তা এ মুহুর্তে একদমই মাথায় আসছেনা! স্বপ্নিলের দিকে কিছুক্ষণ সেভাবেই তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষে’প করে রাহিতা হেটে চলতে ধরে বাড়ির দিকে। কিন্তু এখানেও বাধ সাধে স্বপ্নিল। ওর হাত ধরে মুহুর্তে থামায় ওকে। বিরক্ত চোখে রাহিতা পেছন ফিরতেই স্বপ্নিল বলে,

—হেটে যাচ্ছো কেন? আমি তো গাড়ি নিয়েই এসেছি। তোমাদের বাসাতেই যাচ্ছি। গাড়িতে এসো।
বলেই পাশে দাঁড়ানো নিজের গাড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে রাহিতার জন্য দরজা খুলে দেয় স্বপ্নিল। অগত্যা এ মুহুর্তে আর কথা বলতে অনাগ্রহী রাহিতা চুপচাপ গাড়িতে চেপে বসে। তা দেখে স্বপ্নিলও আর দেরি না করে উঠে বসে গাড়িতে। দুজনের মাঝে আর কথা হয়না। দেখতে দেখতেই মিনিট দুয়েকের মাঝে রাহিতাদের বাসায় পৌছে যায় ওরা দুজনে!

ছেলেপক্ষদের মাত্রই ড্রয়িংরুমে বসিয়ে আপ্যায়ন করা শুরু করছিলেন রাহিতার মা-খালারা। রাহিতার মা খাবার নিতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলেন এমন সময় বাড়ির ভেতরে রাহিতা ও স্বপ্নিল প্রবেশ করে। স্বপ্নিলকে দেখে বেশ অবাক হয়ে যান রাহিতার মা। বলাবাহুল্য, বড় মেয়েজামাই সচারাচর তাদের বাসায় আসেনা। বিয়ের পর এক-দুই বারই এসেছে। সেই ছেলে আজ হঠাৎ এই সময় বিনা নিমন্ত্রণে হাজির হওয়ায় বিস্মিত হওয়ারই কথা। তাইতো স্বপ্নিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে তিনি বলেন,

—আরে বাবা, তুমি হঠাৎ এলে যে? তোমার শরীর এখন ভালো আছে? রাহিতা যে বললো তোমার জ্বর এসেছে।
অতঃপর রাহিতার দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন,
—জামাই আসবে তুই আমায় বলিসনি কেন? ছেলেটা আসছে আগে থেকে জানালিও না!
মায়ের ধ’মকে এতক্ষণের বিরক্ত মুখ আরেকটু কুচকে যায় রাহিতার। মায়ের কাছেও স্বপ্নিলের জন্য ধমক শুনতে হচ্ছে ওকে! সেভাবেই উত্তর দেয়,

—উনি যে আসবেন তা আমি নিজেও জানতাম না, মা। তাই আমাকে কিছু বলোনা।
রাহিতার কথা শেষ না হতেই স্বপ্নিল শাশুড়ির উদ্দেশ্যে জবাব দেয়,
—এখন বেটার ফিল করছি, মা। ভাবলাম বাসায় যেহেতু আছি, অনেকদিন দেখা হয়নি আপনাদের সাথে তাই দেখা করে আসি।
স্বপ্নিলের কথায় খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন রাহিতার মা। মেয়েজামাই শখ করে দেখতে এসেছে শুনেই তার মন জুড়িয়ে এলো। স্বপ্নিলকে ড্রয়িংরুমের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,

—তুমি এসেছো বলে অনেক খুশি হয়েছে, বাবা। আসলে আজ রিদিতাকে দেখতে ছেলেপক্ষ আসবে। তাই রাহিতাকে ডেকেছিলাম বাসায়। তোমাকেও আনতে বলেছিলাম পরে শুনি তুমি নাকি অসুস্থ। রাহিতাও কাল পর্যন্ত আসতে চেয়েছিলোনা। পরে কি মনে করে যেন আজ সকালে চলে এলো। যাক! এখন তোমাদের দুজনকে পেয়ে আমরা খুব খুশি। ড্রয়িংরুমে সবাই বসে আসে। ওখানেই বসো। তোমার শশুড়ও আছেন সেখানে।

ড্রয়িংরুমে বসে সবার সাথে পরিচয় হয় স্বপ্নিলের। সবার সাথে কথাবার্তা বলার মাঝে ওর মাথায় সবটা ঢোকে। তার মা যে তাকে বোকা বানিয়ে এখানে পাঠিয়েছে রাহিতার বাড়ি ছাড়ার কথা বলে, সেটাও এখন বুঝে সে। আর এতক্ষণ কিসব পাগলামি করেছে রাহিতাকে হারানোর ভয়ে ওসব মনে করে নিজ মনেই বেশকিছুক্ষণ হাসে স্বপ্নিল। অবশেষে সবকিছু জেনে শান্তিতে শ্বাস নিতে পারছে সে! যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে সেভাবেই তাকায় অদূরে বসে থাকা রাহিতার দিকে।

ছেলেপক্ষের সাথে কথাবার্তা শেষে ফাহিম ও রিদিতার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয় এ মাসের শেষের দিকে। সবকিছু শেষে বিকেলের শেষপ্রান্তে চলে যায় পাত্রপক্ষ। ক্লান্ত রাহিতা সবার আড়ালে একা একা ছাদে চলে আসে। তবে বাকিদের চোখের আড়াল হলেও স্বপ্নিল ঠিকি খেয়াল করে, একিসাথে ওর পিছে যেতে ধরে কিন্তু বাধ সাধে শ্বশুর মশাই। জামাইকে এতদিন পর পেয়ে সৌজন্যতার খাতিরে এটা-সেটা নানান কথা বললেন তার সাথে।

ভদ্রতার খাতিরে স্বপ্নিলও উঠতে পারলোনা। শ্বশুড়ের সাথে আলাপ চললো কিছুক্ষণ। অতঃপর সবাই ক্লান্ত হয়ে রুমে চলে গেলো রেস্ট নিতে৷ রাহিতার মা বড় জামাইয়ের জন্য নিজ হাতে রান্না করবেন বলে চললেন রসুইঘরে, সাথে স্বপ্নিলকে যেতে বললেন রাহিতার রুমে। সবাই চলে যাওয়ায়, সুযোগ বুঝে স্বপ্নিল উঠে গেলো ছাদে। রাহিতার সাথে অনেককিছুই সরাসরি কথা বলার দরকার তার আজকে!

সন্ধ্যার আকাশ গাঢ় লাল। সূয্যিমামাও অস্ত যেতে কোমড় বেধে প্রস্তুত। ছাদের কোণঘেঁষে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রাহিতা। চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই, তার মনোযোগ ওই দূরের আকাশে নীড়ে ফেরা পাখিদের দিকে মত্ত! স্বপ্নিল যে কখন এসে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে তা টেরই পায়নি সে। আনমনে পাশ ফিরতেই ওর দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকা স্বপ্নিলের দিকে চোখ পড়ে তার। এ চোখের দৃষ্টি রাহিতার অচেনা নয়। যবে থেকে স্বপ্নিলের চোখ পড়তে শিখেছে সে, তবে থেকেই রাহিতা জানে এ মানুষটা আনমনেই তার মায়ায় বাধা পড়েছে। তার মতোই প্রেমের সাগরে পাড়ি জমিয়েছে। তবু কখনো মুখে না বলায় রাহিতার অভিমান হয়। মূলত সে অভিমানের রেশ ধরেই ওর আজ এ বাড়িতে চলে আসা।

একটি নিঃশ্বাস ফেলে রাহিতা মনোযোগ দিয়ে তাকায় এবার স্বপ্নিলের পানে। ওর হলদেটে ফর্সা মুখে সূর্যের লালিমা এসে পুরুষালি সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ মানুষটাকে বিগত কত বছর ধরেই তো চিনে রাহিতা! অথচ সত্যি বলতে, সে কখনো ভাবেইনি এ মানুষটা একদিন ওর হবে! স্বপ্নিলকে ও ভালোবেসেছিলো ভালোবাসা বুঝতে শুরু করার আগে থেকেই। কিশোরী বয়সে মনে যখন প্রথম প্রণয় হাওয়া লেগেছিলো ঠিক তখনি তার জীবনে আগমন ঘটে স্বপ্নিল নামক এই স্বপ্নপুরুষের। সেদিনের কথা মনে হতেই সূক্ষ্ম হাসির রেখা খেলে যায় রাহিতার ঠোঁটে। খানিকবাদে স্বপ্নিলের স্পর্শে ধ্যান ফিরে আসে ওর। ওর মুখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খেলতে থাকা অবাধ্য চুলগুলোকে আলতোহাতে ঠিক করে দিতে দিতে স্বপ্নিল প্রশ্ন করে,

—হাসছো কেন?
রাহিতা থমকায়। কাল্পনিক জগত ছেড়ে বাস্তবে ফিরে আসে। এতক্ষণ আবেগঘন চোখে স্বপ্নিলকে দেখছিলো ভেবে লাজুকলতায় ছেয়ে যায় তন। সে তো অভিমান করেছে স্বপ্নিলের উপর! তবে কেন নরম হচ্ছে? না, ওর নরম হওয়া যাবেনা। স্বপ্নিল মনের কথা প্রকাশ না করা পর্যন্ত অভিমানের আড়ালে নিজের প্রেমিকা সত্ত্বাকে লুকিয়ে রাখতে হবে।। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় রাহিতা।
স্বপ্নিল পুনরায় বলে,

—এভাবে আমায় না বলে এলে কেন? আমি কত টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম তুমি জানো?
স্বপ্নিলের প্রশ্নে রাহিতা আড়চোখে তাকায়। গলার স্বর যথেষ্ট রুক্ষ করে বলে,
—বলে এলেও বা কি হতো? আমার থাকা, না থাকায় আপনার কি কোনো যায় আসে?
স্বপ্নিল মুহুর্তে রুষ্ট হয়। অন্তত ওর কুচকে যাওয়া ভ্রুযুগল তো তাই বলছে! দাতে দাত চেপে বলে,
—যায় আসে। অনেক বেশিই যায় আসে।

—কেন আসবে? আমি আপনার জীবন থেকে চলে গেলেও কিচ্ছু হবেনা। আপনি আবার আমায় ভালোবাসেন নাকি!
ঠাট্টার সুরে বলে রাহিতা। অতঃপর হাসে, যেন খুব বেশি মজার কোনো কৌতুক বলে ফেলেছে। ওর এমন আচরণে স্বপ্নিলের রা’গ হয়। মুহুর্তেই কদম এগোয়, শরীর ছুইছুই হয় দুজনের। রাহিতা কিছু বুঝে উঠার আগেই কোমড় জড়িয়ে টেনে নেয় নিজের কাছে। বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতেই হাসি থেমে যায় ওর। দু চোখে ভর করে বিস্ময়।

সে মায়াভরা চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নোয়ায় রাহিতার মুখের কাছে। দুজনের নিঃশ্বাস একে-অপরের গায়ে আ’ছড়ে পড়ে। অস্তমিত সূর্যের লালিমাকে সাক্ষী রেখে স্বপ্নিল প্রেয়সীর চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট কণ্ঠে ভালোবাসার স্বীকৃতি দেয়। স্বাগতিক কণ্ঠে বলে,

মন বিনিময় পর্ব ৪৪

—ভালোবাসি! যতটা তুমি জেনেছো, তার চেয়েও বেশি। যতটা তুমি চেয়েছো, তার চেয়েও অনেক বেশি। তুমি আমার আধার রাতের পূর্ণিমা, রাহি। আমার জীবন থেকে হারিয়ে যেয়োনা কখনো৷ আমি তোমায় হারাতে চাইনা। একটু ভরসা করে মন বিনিময় করবে আমার সাথে? কথা দিচ্ছি, খুব যত্নে আগলে রাখবো তোমার মনকে নিজের বক্ষপিঞ্জরে!

মন বিনিময় পর্ব ৪৫ (২)