মন বিনিময় পর্ব ৪৪

মন বিনিময় পর্ব ৪৪
তাসফিয়া হাসান তুরফা

বাপের বাড়িতে নিজ রুমের বারান্দায় একা একা বসে আছে রাহিতা। ফোনটা বিছানার উপরে রাখা, বারকয়েক রিং হয়ে ওখানেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। রাহিতা জানে এ সময় এতবার কে ফোন দিচ্ছে, কিন্তু স্বপ্নিলের ফোন ধরার ইচ্ছে-আকুলতা কোনোটাই এ মুহুর্তে ওর মাঝে নেই। রাহিতা বুঝেনা এ ছেলেটার সমস্যা কি!

কাছে থাকলে তো কখনোই ভালোবাসার কথা বলেনা, তবে দূরে গেলে কেন এত ব্যাকুল হয়? একটু শান্তিতে ক’দিন একা থাকার জন্য রাহিতা এসেছে এ বাসায়। এখন স্বপ্নিলের সাথে কথা বলে সে শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাবেনা সে আর! রাহিতার ভাবনার মাঝেই রুমে আসেন ওর মা। ওকে বারান্দায় একা বসে থাকতে দেখে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—কি রে, একা বসে আছিস কেন এভাবে?
—কিছুনা, মা। এমনিতেই বসে আছি। তুমি এখানে যে? রান্নাবান্না সব শেষ? কিছু হেল্প লাগবে আমার?
—হ্যাঁ। তুই একটু ডেজার্ট বানিয়ে দে তো, রাহি। আমি পোলাও রোস্ট সব বানিয়ে রেখেছি। এত কাজ সব ঠিকঠাক মিটে গেলেই হলো!
—ঠিক আছে। তুমি চলো, আমি আসছি।

মায়ের সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে যায় রাহিতা। এক ফাকে উঁকি মারে বোনের রুমে। মূলত ওর ছোটবোন রিদিতাকে দেখতে আজ ছেলেপক্ষ আসবে বাসায়। প্রেমের সম্পর্ক ছিলো দুজনের, ছেলেরা অন্য শহরে থাকে। এ বছর সে বিদেশ চলে যাচ্ছে মাস্টার্স করতে তাই দেখা-সাক্ষাৎ করে সময়-ক্ষণ ঠিক করে সবার সম্মতিতে আকদ পড়িয়ে রাখতে চায় দুটো পরিবার। এজন্যই আজ ছেলেপক্ষকে লাঞ্চের দাওয়াত দিয়েছে রাহিতাদের বাড়ি থেকে। যার দরুন এত আয়োজন! রিদিতাকে নতুন জামাকাপড় পড়তে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে যায় রাহিতা। আয়নার সামনে দাঁড়ানো বোনের পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাধে হাত রেখে বলে,

—রেডি হওয়া শুরু করিসনি কেন এখনো? তোর শশুড়বাড়ির লোকেরা তো একটু পরেই আসবে।
—এইতো শুরু করবো এখন। ওর সাথে তো বেশিরভাগ সময় অনলাইনেই কথা হয়েছে, আপু। সামনাসামনি দু-তিন বার দেখা হয়েছে। তাই আজ পরিবার নিয়ে বিয়ের কথা বলতে আসছে দেখে বেশ নার্ভাস লাগছে।
রাহিতার হাত ধরে বলে রিদিতা। বোনের কথা শুনে আনমনেই হাসে রাহিতা। নিজের বিয়ের সময় এমন পরিস্থিতি সে পার করে এসেছে। যদিও স্বপ্নিল ও ফাহিম (রিদিতার হবু স্বামী) দুজনের মধ্যে পার্থক্য আছে। স্বপ্নিল এসেছিলো অনিচ্ছায়। আর ফাহিম আসছে স্বেচ্ছায়, নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার জন্য। তাই বোনকে অভয় দিতে রাহিতা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

—এ সময় এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক, রিদি। তবে তুই একদমই টেনশন করিস না। ফাহিমকে তো তুই চিনিসই, তাইনা? ওর পরিবারও ঠিকি তোকে পছন্দ করবে দেখিস। বাকিটা আমরা সামলে নেবো সবাই মিলে। এখন এসব ভাবা বাদ দিয়ে জলদি রেডি হ। আমি মা-কে হেল্প করি। খালামনি, মা দুজন মিলেই রান্না করছে। আমায় ডেজার্ট বানাতে বললো। যাই আমি? তোর কোনো হেল্প লাগলে ডাক দিস!

ঘড়ির কাটা পেরিয়ে দুপুরের ২টো বাজলো মাত্র। ফাহিম ফোন করেছে রিদিতাকে, বাসা সঠিক খুজে পাচ্ছেনা ওরা। রওনক অফিস থেকে এখনো বাড়ি পৌছায়নি বিধায় রাহিতার মা ওকে বললেন,
—তুই একটু এগিয়ে গিয়ে ওদের বাসা চিনিয়ে দিবি, রাহি? তোর বাবা তো মিস্টি আনতে বেরিয়েছে একটু আগে এখনো এলোনা। এদিকে ছেলেরা প্রায় পৌছেই গেছে। দাঁড়িয়ে রাখাটা ঠিক হবেনা।
—আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। কোনো সমস্যা নেই। তুমি রিদিকে বলো ফাহিমের নাম্বার আমায় পাঠিয়ে দিতে। ওরা কোথায় আছে কথা বলে নিয়ে আসছি বাসায়।

রাহিতা বেরিয়ে যাওয়ার আগে মায়ের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে। এদিকে রাহিতাদের বাসা গলির শেষপ্রান্তে হওয়ায় গলির সামনে গাড়ি সাইড করে রেখে আগেই নেমে গিয়েছে ফাহিম। উদ্দেশ্য বাড়ির এক্সাক্ট ঠিকানা শুনে সেই দিকে গাড়ি নিয়ে যাওয়া। সরু গলিতে একবার ভুল দিকে গাড়ি ঢুকিয়ে ফেললে পরে দিক ঘুরাতে ঝামেলা পোহাতে হয়। কিছুক্ষণ গলির ভেতর হেটে যেতেই একটি গাড়ি চোখে পড়ে ওর। গাড়িওয়ালাকে এই এলাকার লোক মনে করে তাকে থামিয়ে বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করে ফাহিম।

রা’গের চোটে বের হয়ে শশুড়বাড়িতে আসছিলো স্বপ্নিল। কিন্তু রাহিতাদের বাড়ির ওই গলির সম্মুখে ঢুকতেই একজনের ডাকে গাড়ি থামালো সে। পাশে তাকাতেই একটি শ্যামবর্ণের সুদর্শন পুরুষ নজরে এলো স্বপ্নিলের। স্বপ্নিলকে গাড়ি থামাতে দেখে ছেলেটা জানালার কাছে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললো,

—এখানে আজমল শিকদার সাহেবদের বাসা গলির কোনদিকে আপনি কি বলতে পারেন? আসলে এই এলাকায় নতুন এসেছি তো তাই চিনতে পারছিনা। কোন পাশ দিয়ে যাবো? ডান দিকে না বাম দিকে?
হঠাৎ এক আগন্তুক ছেলের মুখে নিজ শ্বশুরের নাম শুনে স্বপ্নিল খানিকটা অবাক হয়। একবার বাড়ির ঠিকানা বলতে গিয়েও বলেনা পাছে। খানিকটা কৌতুহল নিয়েই জিজ্ঞেস করে,

—হ্যাঁ, চিনি তো। তবে আপনাকে তো চিনলাম না। আপনি কি তাদের আত্মীয়?
স্বপ্নিল বাড়ি চিনে শুনে ফাহিম মনে মনে বেশ খুশি হলো! সেই খুশির রেশ ওর চোখেমুখে খেলা করলো, যেদিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে রইলো স্বপ্নিল। এরই মাঝে ফাহিম হালকা হেসে বললো,

—জি, এখনো আত্মীয় হইনি। তবে খুব শীঘ্রই হতে যাচ্ছি বৈকি!
—তা কিভাবে?
—আসলে যার বাড়িতে যাবো উনি আমার হবু শ্বশুর মশাই। মেয়ে দেখতে যাচ্ছি তো, প্রথম বার এদিকে আসলাম। তাই রাস্তা চিনছিনা। বাই দ্যা ওয়ে, থ্যাংক ইউ..

ফাহিম কথা বলা শেষ করবে এরই মাঝে ওর ফোনে কল আসায় সে থেমে যায়। স্বপ্নিল তখনো খটকায়! মেয়ে দেখতে আসছে মানে? এসব কি বলছে এই ছেলে? কপালে চিন্তার ভাজ নিয়ে থাকার মাঝে হঠাৎ করে ফাহিমের কথায় স্বপ্নিলের হৃদপিণ্ড থমকে যায়, কান খাড়া হয়, নজর তীর্যক হয়।

—হ্যালো? ওহ! রাহিতা? জি জি, আমি আপনাদের গলির মাথাতেই আছি। এলাকার ফার্মাসির সামনে। না না, আসতে হবেনা।
ফাহিম কথা শেষ করবে এরই মাঝে স্বপ্নিল তড়াক করে দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে এবং মুহুর্তেই ওর সামনে চলে আসে। কল কেটে সামনে তাকাতেই স্বপ্নিলকে নিজের সামনে দেখে খানিকটা অবাকই হয় ফাহিম। তবু পাশ কাটিয়ে পেছনে নিজেদের গাড়ির দিকে যেতেই স্বপ্নিল ওকে বাধা দেয়। ওর চোখমুখ বেজায় শক্ত।

মাথার ভাজে বিবিধ চিন্তার পাক। ফাহিম ওর শশুড়বাসায় মেয়ে দেখতে যাচ্ছে, এর মধ্যে আবার রাহিতার সাথে ফাহিমের কথা। এ সবকিছু কোনদিকে ইংগিত করছে? এজন্যই কি এভাবে চলে এলো রাহিতা? সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত চিন্তায় কপাল ঘামতে শুরু করেছে স্বপ্নিলের। একদিকে ওর মন বলছে – রাহিতা ওর সাথে এমন করতে পারেনা, কিন্তু কাল রাতে রাহিতার ওসব কথা, একিসাথে আজ সকালে মায়ের কথাবার্তা শুনে স্বপ্নিলের অশান্ত মস্তিষ্ক তা মানতে নারাজ! রাহিতা যদি সত্যিই ওকে ছাড়তে চায়?

স্বপ্নিলের হৃদপিণ্ডের ছটফটানি বাড়ে, অসহ্য দহনে বুকের ভেতর কেপে উঠে। অত্যন্ত হিং’স্র অথচ গম্ভীর কণ্ঠে ফাহিমের উদ্দেশ্যে বলে,
—যেখান থেকে এসেছো, সেখানেই চলে যাও!

আচমকা স্বপ্নিলের মুখে এমন কথা শুনে ফাহিম চমকে উঠে। লোকটা কে? আর এটা কেন-ই বা বলছে তাকে? আশ্চর্য তো! তবে স্বপ্নিলের কথাকে সে বিশেষ পাত্তা দেয়না। আগের মতোই নির্বিকারভাবে হেটে চলে যেতে লাগে নিজের গাড়ির দিকে। যা দেখে স্বপ্নিলের রাগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ক্রো’ধে দ্বিকবিদিক ভুলে যাওয়া স্বপ্নিল দ্রুতবেগে এগিয়ে এসে ফাহিমের কলার চেপে ধরে। আচমকা এহেন আক্রমণে ফাহিম বেশ অবাক হয়, একিসাথে রে’গেও যায়। স্বপ্নিলের হাত থেকে নিজের কলার ছাড়ানোর চেস্টা করতে করতে বলে,

—কি সমস্যা আপনার? পা’গল নাকি? এভাবে চিনেন না জানেন না এমন মানুষের কলার চে’পে ধরছেন কেন? আজব তো!
ফাহিমের কথায় এতক্ষণ আটকে রাখা মেজাজ নিমিষেই সপ্তাকাশে উঠে স্বপ্নিলের। একপ্রকার চেচিয়ে ওকে ধমক দিয়ে বলে,

—আমি পাগ’ল না? আমার কথা না শুনলে এখন তোর এমন অবস্থা করবো যে তুই নিজেই পা’গল হয়ে যাবি, বুঝেছিস? তোকে ভালোভাবে বলছি যেখান থেকে এসেছিস সেখানেই ফেরত চলে যা। ওই বাসায় মেয়ে দেখতে যেতে হবেনা!
—দেখেন মিস্টার, আপনাকে দেখে যথেষ্ট ভালো পরিবারের মনে হচ্ছে। আমি জানিনা আপনি কেন এরকম গু’ন্ডার মতো বিহেভ করছেন। কিন্তু আমি আপনার কথা মানতে বাধ্য নই। একবার কেন, একশবার মেয়ে দেখতে যাবো। আমার হবু বউকে আমি দেখতে যাচ্ছি, এতে আপনার কি?

—আমার কি মানে? আমারই তো সব! তুই যাকে দেখতে যাচ্ছিস সে আমার! একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, রাহিতা আমার বউ। ও শুধু আমার। রাহিতার দিকে চোখ দিলে কিভাবে সেই চোখ টে’নে তুল’তে হয় তা স্বপ্নিলের ভালোভাবেই জানা আছে! এজন্যই বলছি ভালোই ভালোই এখান থেকে চলে যা নয়তো…

স্বপ্নিলের মুখে রাহিতার নাম শুনে ফাহিম কিছুটা আন্দাজ করতে পারে কি হচ্ছে এখানে। স্বপ্নিল যে ওকে ভুল ভাবছে তা দিব্যি বুঝতে পারছে সে। তাই নিজেকে সামলে বেশ খানিকটা বল প্রয়োগ করে স্বপ্নিলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে,
—হোয়াট? আপনি এসব কি বলছেন? দেখুন, এখানে একটা বড় মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। আমি রাহিতাকে না…
ফাহিম কথা বলা শেষ করতে পারেনা। তার আগেই স্বপ্নিল ফুসে উঠে ওর দিকে আংগুল তাক করে হিস’হিসিয়ে বলে,
—খবরদার রাহিতার নাম মুখে নিবিনা। আর কখনো যদি রাহিতার সাথে যোগাযোগ করার চেস্টা করেছিস তবে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা…

মন বিনিময় পর্ব ৪৩

স্বপ্নিল কথা শেষ করতে পারেনা কারণ এরই মাঝে রাহিতা সেখানে চলে আসে। ওকে ছুটে আসতে দেখে নিজ হতেই স্বপ্নিলের মুখ থেমে যায়। সারাদিন পর নিজের সামনে প্রেয়সীর দেখা পেয়ে স্বপ্নিলের অন্তর শীতল হয়, গতি মন্থর হয়। এতক্ষণ মনের ভেতর টগ’বগ করতে থাকা অনল নি’ভে যায়।

মন বিনিময় পর্ব ৪৫ (১)