নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪৪

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪৪
Mousumi Akter

রজনি প্রান্তিকের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ” সাত-সাকালে আমাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে এলেন কেনো বলুন তো মাই ডিয়ার হাজবেন্ড। ”
“আমি আমার বউকে কখন কোলে তুলব তার জন্য কি নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন আছে হ্যাঁ। আমি আমার বউকে সারাজীবন কোলে রাখতে চাই তোমার কি তাতে হ্যাঁ ”

“এইভাবে কেউ কোলে তোলে।যদি কেউ দেখে ফেলত।”
“কেউ তো দেখে নি। বাট ডাকব দেখার জন্য এইবার।”
“ছিঃ লজ্জা নেই আপনার। ”
“ইউ নো রজনিগন্ধ্যা আমি বউ পা-গ-ল পুরুষ। তাই লজ্জা কম।আর বউ তো আমার তাইনা? লজ্জা কীসের? লজ্জা থাকলে কি তোমার আম্মাকে গিয়ে সরাসরি বলতে পারতাম আপনার মেয়েকে আমি ভালবাসি।”
“আসলেই বউ পা*গ*ল একটা আপনি।এইবার বলুন কেনো রুমে এনেছেন? কিছু বলবেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোমাকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করেনা রজনিগন্ধ্যা। একটা সেকেন্ড নষ্ট করতে ইচ্ছা করেনা।ঘড়ির কাটা যেন দ্রুত যাচ্ছে। ঘড়ির কাটা যদি কোনো শক্তির মাধ্যমে আটকে দেওয়া যেত তবে আমি তাই করতাম। আটকে দিতাম সময়। আর তোমাকে আজীবন দেখতাম।তোমাকে দেখার লোভ আমার কোনদিন ফুরাবে না।তোমাকে দেখার তৃষ্ণা আমার কোনদিন মিটবেনা।

তোমাকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্খা পাওয়ার আমার কোনদিন ফুরাবেনা।খুব স্বার্থপরের মত বলতে হচ্ছে রজনিগন্ধ্যা আমার যদি হঠাৎ মৃত্যু হয় তুমি কোনো পুরুষের সংস্পর্শে যেওনা।আমার জন্য অপেক্ষা করো। পরকালে আমাদের আবার দেখা হবে।আমরা এক নারী-পুরুষে আসক্ত দম্পতি।একই সাথে জান্নাতে যাবো। তোমার প্রতি আমার ভালবাসা এতই তীব্র আমি খুব স্বার্থপর হয়ে গিয়েছি। মহানায়কদের মত বলতে পারলাম না তুমি একা থেকোনা। আমার চেয়ে ভাল কাউকে পেয়ে যাবে। না রজনিগন্ধ্যা আমি এসব বলতে পারলাম না।আমি তোমার নিঃস্বার্থ প্রেমিক নই রজনিগন্ধ্যা।আমি স্বার্থপর প্রেমিক।”
এটুকু বলেই প্রান্তিক রজনিকে নামিয়ে দিল।বকুল ফুলের মালা রজনীর খোপায় পেঁচিয়ে দিয়ে বলল, ” ভয়ংকর সুন্দর লাগছে। ”

রজনি যেন থম মেরে গিয়েছে। এখনি কেদে দিবে। কিছু মুহুর্তে মানুষ এতই আবেগপ্রবন হয় মুখ দিয়ে কিছুই উচ্চারিত হয়না। প্রান্তিক পেছন থেকে রজনির কোমর জড়িয়ে ধরে ধরে চুলের খোপায় নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিল।মোহনীয় ঘ্রাণে প্রাণ জুড়িয়ে এল।প্রান্তিকের কন্ঠস্বর কেমন ভারী হয়ে এল। ভারী কন্ঠে বলল,

” তুমি কাছে এলেই আমি কেমন হারিয়ে যায় রজনিগন্ধ্যা। তুমি কাছে এলেই অন্য রকম এক সুগন্ধি নাকে ভাষে। তুমি কাছে এলেই সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে যায়। কি এক নেশা আমাকে টানে। এই নেশার নাম কি আমি জানিনা। তবে বিষাক্ত,ধারালো,আফিমের চেয়েও নেশালো।জানো আমি মাঝে মাঝে ভাবি এই পৃথিবীতে তো আমি চিরকাল বেঁচে থাকব না। কেউ ই থাকবেনা। কাউকে না কাউকে যেতেই হবে।

মৃত্যুর ভ-য় আমার করেনা রজনিগন্ধ্যা। কিন্তু তোমায় ছাড়ার নেশা আমায় কষ্ট দেয়।ভীষণ কষ্ট দেয়।তোমায় ছাড়া একটা সেকেন্ড আমি থাকতে পারিনা।সেখানে অন্ধকার কবরে একা থাকার কথা ভাবতেও পারিনা। তার চেয়ে বেশী ভয় করে আমার কিছু হয়ে গেলে তোমার কি হবে। কে তোমাকে দেখবে। কে তোমাকে আগলে রাখবে। আমি বেঁচে থাকতে চাই রজনিগন্ধ্যা।এই সুন্দর পৃথিবীতে তোমার জন্য বেঁচে থাকতে চাই।

তোমার হাত ধরে এই পৃথিবী ঘুরে দেখতে চাই। এই বিশ্ব ভ্রমন করতে চাই। আরো কয়েকটা যুগ তোমাকে আলিঙ্গন করে ঘুমোতে চাই, ঘুম ভাঙতেই তোমার চুলের ঘ্রাণ চাই, কনকনে শীতে এই কম্বলের নিচে তোমার উষ্ণতা চাই, এক কাপে চা ভাগ করে খেতে চাই, বৃষ্টির দিনে খোলা আকাশের নিচে ভিজতে চাই, রোজ তোমার প্রেমিক হতে চাই, একটি করে রজনিগন্ধ্যা আর গোলাপ দিয়ে বলতে চাই আমি প্রতিদিন ই তোমাকে চাই রজনিগন্ধ্যা।বৃদ্ধকালে তোমার ভাজপড়া চেহারা দেখে যেন বলতে পারি তুমি আজ ও শ্রেষ্ট সুন্দরী রজনিগন্ধ্যা।ঠিক সেদিনের মত। যেদিন কলেজে প্রথম তোমার চোখের নেশায় পড়েছিলাম।তুমি আমার জীবনে আসার আগে বুঝিনি পৃথিবীটা এত সুন্দর। ভালবাসার মানুষ থাকলে পৃথিবী এত সুন্দর হয় আগে বুঝিনি রজনিগন্ধ্যা।”

রজনির চোখ দিয়ে টপ টপ দিয়ে পানি পড়ছে।সে ঘুরে দাঁড়াল। প্রান্তিক কে জড়িতে ধরল। শব্দ করে কেদে দিল।প্রান্তিক ও খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেদে দিল।
রজনি কাদতে কাদতে বলল, ” আপনি এসব বললে আমার কি হবে। আপনি জানেন না এই পৃথিবীতে আপনি ছাড়া আমি ভীষণ একা। কেনো ওইসব ছাইপাশ খান আপনি।আমাকে এত বড় শাস্তি দিতেই কি এত সুখ দিয়েছিলেন।কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তাকে ভালবেসে ছেড়ে চলে গেলে আর কিছু লাগেনা তাইনা?”

“এখন খুব আফসোস হয়! কষ্ট হয়! কেনো সিগারেট খেয়েছি?শুধু সিগারেট নয়। বন্ধুদের সাথে মিশে সব ধরণের সিগারেট ই খেয়েছি। আর শ্রাবণ কি কি মিশিয়ে দিয়েছে আমি নিজেও জানিনা।খুব আফসোস নিয়ে বলতে ইচ্ছা করে রজনিগন্ধ্যা জন্মের পরেই যদি বুঝতাম জীবনে তুমি আসবে -জীবনটা এত সুন্দর হবে।আমাকে তুমি এত ভালবাসবে।জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত এত সুন্দর হবে আমি সর্বদা চেষ্টা করতাম নিজেকে সুস্থ রাখার। যা খেলে অসুস্থ হতে হয় ভুলেও ওসব স্পর্শ করতাম না।যারা সিগারেট খায় ওদের দেখলে বলতে ইচ্ছা করে কেউ সিগারেট খাইস না ভাই। আমার মত ভুল কেউ করিস না।আমার জীবনে সব থেকে বড় ভুল করেছি। যার মাসুল আজ দিতে হচ্ছে।”

প্রান্তিক কাদতে কাদতে রজনিকে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বলছে।জীবনে প্রথম বার প্রান্তিক কাদছে।রজনিকে ছেড়ে যাবার ভয় আজ প্রান্তিক কে কাদাচ্ছে।
রজনি নিজেকে সামলাতে না পেরে বেসামাল ভাবে কেদে কেদে বলছে, ” সিগারেট এর গায়েই তো লেখা থাকে সিগারেট এর কারণে ক্যান্সার হয়। তবুও কেনো? কেনো আপনি খেয়েছেন? আপনার বুক আমার শ্রেষ্ট নিরাপদ আশ্রায়স্থল। এখানে মাথা না রাখলে আমার একটা রাত ও ঘুম হয়না।এই আপনি ছাড়া আমার একটা পা ও চলা অসম্ভব আপনি কি তা জানেন না।আপনার কিছু হবে না।আপনার কিছু হলে আমি নিজেকে শেষ করে দিব। ”

প্রান্তিক রজনিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ” আমি যদি ম’ রে’ ই যায় রজনি গন্ধ্যা। তুমি মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করো,ধুমপানের বিরুদ্ধে কাজ করো।সমাজসেবা মূলক কিছু কাজ অন্তত করো।যুব সমাজ কে এই মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করো প্লিজ। এই মাদকের জন্য আমাদের শ্রাবণের জীবন টা শেষ। হয়ত আমিও। আমি জানি আমার রজনিগন্ধ্যা পারবে।অন্তত আমার মত কয়েকজন প্রান্তিক বা শ্রাবণ কে বাঁচাতে পারবে।”

“আপনি ছাড়া আমি শূন্য। আমি কিচ্ছু পারব না। আর আপনি এসব কি বলছেন।আপনার কি হবে হ্যাঁ। ”
“কিছুই হবেনা।আমি শুধু ধারনার কথা বললাম।”
রজনি কাঁন্নায় একেবারে ভেঙে পড়েছে।প্রান্তিক জানে এভাবে রজনিকে সামলানো যাবেনা।প্রান্তিকের নিজের ও কষ্ট হচ্ছে।মাঝে মাঝে প্রকৃতির বিপরিতে আমরা কিছুই করতে পারিনা। প্রান্তিক রজনিকে সামলাতে রজনির কপালে চুমু দিল। চোখের পানি মুছে দিয়ে দুই গালে চুমু দিয়ে বলল, ” এসব ইমোশনাল কথাবার্তা বলে কি আমাকে বাবা হওয়া থেকে বঞ্চিত করতে চাও। নিড আ আদর সুইটহার্ট। এন্ড নিড আ স্মল রজনিগন্ধ্যা।”

রজনি আদুরে আর অভিমানে কন্ঠে প্রান্তিকের বুকে ধাক্কা দিতে দিতে বলল, ” কথা বলব না আপনার সাথে।”
” কথা বললে আমাদের প্রিন্সেস হবে কীভাবে? বহুত ফ্যামিলি প্ল্যানিং হয়েছে।আর কোনো ফ্যামিলি প্ল্যানিং করব না।”
রজনি অভিমানি মুখ করে বিছানায় গিয়ে বসল। প্রান্তিক পাঞ্জাবীর হাতা গোটাতে গোটাতে গিয়ে রজনির সামনে গিয়ে ঝুঁকে রজনির ওষ্টে ওষ্ট মেলাতেই লতিফা ডাকল বাবা প্রান্তিক চা তো ঠান্ডা হয়ে যায়।
রজনি প্রান্তিক কে ধাক্কা দিয়ে বলল, ” যান চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
“ঠান্ডা জিনিস ঠান্ডা হতে দাও। আপাতত গরম গরম চুমু খেতে দাও সুইটহার্ট। ”

কেটে গেল এক মাস। ধীরে প্রিয়তা একটু একটু করে সুস্থ আর স্বাভাবিক হতে শুরু করল। শরীর আগের থেকে বেশ ভাল।শরীর ভাল হলেও মনের দিকে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। এখনো চুপচাপ নিরিবিলি থাকে।রাত এলেই মন খারাপ যেন তাকে ঘীরে ধরে।সারারাত হিসাব করে কি হয়ে গেল তার জীবনে।কি এমন পাপ করেছিল সে জীবনে।তার এই অভিশপ্ত জীবনের শাস্তি অন্ত কেনো ভোগ করছে।

অকারণ অন্ত রাতের পর রাত জাগছে। প্রিয়তাকে ধরে গোসল করানো,খাওয়ানো,ওষুধ খাওয়ানো,হাত ধরে হাঁটানো, প্রতিটা মুহুর্তে পাশে থাকা এযেন প্রিয়তার জীবনের আরেক অধ্যায়ের সূচনা।অন্ত জানে প্রিয়তা কোনদিন ই তাকে ভালবাসবেনা।সে সম্ভবনা কখনোই নেই। কিছু পাওয়ার আশায় অন্ত কিছুই করছেনা। তার ভালবাসার মানুষকে ভাল রাখার জন্যই যা করার করছে।বিগত এক মাস প্রিয়তার খুব কাছাকাছি থেকে অন্ত প্রিয়তার প্রতি আগের তুলনায় অধিক দূর্বল হয়ে গিয়েছে।

এই মুহুর্তে প্রিয়তা তাকে ছেড়ে চলে গেলে অন্তর পক্ষে বেঁচে থাকায় অসম্ভব হয়ে যাবে।এই দিকে প্রিয়তার মন প্রাণ জুড়ে সব টায় শ্রাবণ।ভালবাসার এই ত্রিকোন খেলায় কারো কোনো দোষ ছিলনা। একজন কে ভালবেসে অন্য জনের সাথে ঘর করার মত যন্ত্রণা ভোগ করছে প্রিয়তা।প্রতিটা রাত ভয়ানক যন্ত্রণায় কাটছে।সে বিশ্বাস করে একদিন শ্রাবণ ফিরে আসবে। শ্রাবণ প্রতিটা মুহুর্ত যন্ত্রণায় ছটফট করছে প্রিয়তা তার কাছে ফিরে আসবেই। তার ভালবাসা সত্য ছিল। দিনের পর দিন একাকিত্ব যন্ত্রণা আর বিষাদে পুড়ে পুড়ে প্রাণহীন দেহটা পড়ে আছে শ্রাবণের।যে সুদর্শন ছেলেটার দিকে তাকালে হাজারো মেয়েরা হা করে তাকিয়ে থাকত সেই ছেলেটাকে চেনায় যায়না।

কাল বাংলাদেশে ফিরবে অন্ত আর প্রিয়তা।অন্তর মন খারাপ।অন্ত জানে প্রিয়তা বাংলাদেশে ফিরেই শ্রাবণের কাছে ফিরে যাবে।পেয়েও আরেকবার হারিয়ে যাবে তার ভালবাসা।ব্যাগ গোছাতে গোছাতে অন্ত প্রিয়তাকে জিজ্ঞেস করল, ” শ্রাবণের সাথে দেখা করবে না দেশে গিয়ে?”

“হুম।”
“এখনো অনেক ভালবাসো তাইনা?”
“উত্তর টা শ্রাবণ কেই দিব অন্ত ভাইয়া। অনেক উত্তর নেওয়ার আছে ওর থেকে। আর হ্যাঁ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।আমার অসময়ে আমার পাশে থাকার জন্য।”

“শ্রাবণ কে বিয়ে করছো কবে?”
“আপনার দেখছি খুব তাড়া শ্রাবণের সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য।”
“কারণ আমি জানি তুমি শ্রাবণ কে অনেক ভালবাসো।”
“আমার যে জ্বর সেটা কি জানেন?”

“কীভাবে জানব।যদি কপালে হাত দিয়ে স্পর্শ করতে না পারি।”
“আমি কি নিষেধ করেছি।তা স্পর্শ করে দেখুন।আমার ভাইয়া এত দূর আপনার ভরসায় পাঠিয়েছে।তা হাত দিয়ে দেখুন।”
অন্তর ভেতরে কেমন এক আনন্দ অনুভব হল।সে প্রিয়তার কপালে হাত রাখল।হাত টা কেমন কাঁপছে।হাত দিয়ে দেখল সত্যি জ্বর।প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বলল,

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪৩

” কি বুঝলেন?”
” হুম জ্বর।”
“এই জ্বর নিয়ে কোথাও যাবোনা।”
“আর কিছুদিন থাকবে।”
“হ্যাঁ আমি একটু ঘুরব।টাকা খরচ এর ভ*য় পাচ্ছেন।”
“কি যে বলো।”

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪৫