নয়নে লাগিল নেশা শেষ পর্ব 

নয়নে লাগিল নেশা শেষ পর্ব 
Mousumi Akter

হসপিটালের সামনে আসতেই প্রান্তিক একেবারেই ঢুলে পড়ল।নিজের সমস্ত ক্ষমতা হারাল।আর বসে থাকতে পারল না বাইকে।কেমন যেন ঢুলছে।বাইক থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলো।প্রান্তিকের বাবা আর ধরে রাখতে পারছিল না।প্রান্তিকের মত একটা মানুষ কে মাহবুবের একার পক্ষে সামলানো সহজ ছিলনা।অন্ত সাথে সাথে বাইক থামাল।বাইক থামাতেই শ্রাবণ এগিয়ে এসে প্রান্তিক কে ধরল।অন্ত শ্রাবণ কে ফোন দিয়েছিলো হসপিটালের সামনে আসতে।

প্রিয়তার সাথে শেষ দেখা হওয়ার পর শ্রাবণ আর কখনো কারো সামনে আসেনি।দীর্ঘদিন পর আজ শুধুমাত্র প্রান্তিকের জন্য ছুটে এসেছে।শ্রাবণ প্রান্তিক কে ধরে বাইক থেকে নামিয়ে দেখল প্রান্তিক প্রচুর ঘামছে চোখ দুটো বুজে আছে। মুডি গম্ভীর তেজী মানুষটার এমন অবস্থা দেখে শ্রাবণ প্রান্তিক কে জড়িয়ে ধরে জোরে কেদে উঠে বলল, ” ভাই আপনার কি হয়েছে? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন ভাই? অন্ত ভাই এর কি হয়েছে?ভাই তো এত দূর্বল হয়না কখনো। ভাই এর কি অসুখ আবার বেড়েছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অন্ত খেয়াল করল প্রান্তিকের অবস্থা ভালনা। চোখ বন্ধ করে নেতিয়ে পড়ে আছে শ্রাবণের কাঁধে মাথা দিয়ে।কোনো নড়াচড়া নেই। অন্তর মনের মাঝে কেমন বাড়ি মে-রে উঠল।প্রান্তিকের কিছু হবেনাতো।শ্রাবণ আর অন্ত নিজেদের প্রা*ণে*র থেকেও প্রান্তিক কে বেশী ভালবাসে। ওরা যে তিন মায়ের র*ক্ত তা কখনো বোঝা যায়না।বাইক থামানোর সময় অন্তর পায়ের স্যান্ডেল খুলে গেল।অন্ত পায়ের স্যান্ডেল হসপিটালের গেটেই বাইকের সাথে রেখে প্রান্তিক কে ধরল।খুব উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“শ্রাবণ ভাইকে দ্রুত ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে নিতে হবে। কুইক।”
মাহবুব চৌধুরী চিৎকার দিয়ে বলল, ” ও বাবা চোখ খোলো।তোমাকে এমন দেখা যাচ্ছে কেন?কি হয়েছে তোমার? ”
অন্ত বলল, “বাবা আপনি দোয়া পড়ুন।ভাই এর কিচ্ছু হবেনা।প্লিজ কাদবেন না বাবা।এখনি ভাবি এসে যাবে হসপিটালে। ভাবিকে সামলানো যাবেনা।”

আরো কয়েকজন লোক এগিয়ে এল ওদের দেখে।অন্ত আর শ্রাবণ দু’জনে ধরে প্রান্তিক কে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে নিল।গেট থেকে কয়েকজন সাথে গেল।কারণ প্রান্তিক কে কম বেশী সবাই চিনে।ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে ক্রিটিকাল রুগি গেলে ডাক্তার রা অন্য রুগি রেখে আগে সেই রুগিকেই দেখে।প্রান্তিক কে নিয়ে সুইয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই ডাক্তার এগিয়ে এল।এগিয়ে এসে প্রেশার চেক করল। তখন হাই প্রেশার প্রান্তিকের।ডাক্তার বলল,

” ওহ মাই গড! প্রেশারের অবস্থা ভাল না।”
দু’জন ডাক্তার তখন ইমারজেন্সিতে। দু’জনকেই চিন্তিত দেখা যাচ্ছে।ডাক্তারদের চিন্তিত দেখে অন্ত আর শ্রাবণ দু’জনেই চিন্তায় পা-গ-ল হয়ে যাচ্ছে।এইদিকে বাসা থেকে দু’মিনিট পর পর ফোন আসছে।অন্ত ফোন তুলছে না।ফোন তোলার মত অবস্থায় নেই।প্রান্তিক একেবারে অচেতন হয়ে পড়ে আছে শুধু পেট টা উঁচু নিচু হচ্ছে।নার্স স্যালাইন রেডি করছে।একজন ডাক্তার আরেকজন কে বলছে, “স্ট্রোক মনে হচ্ছে।”

শ্রাবণ ডাক্তার কে বলল, ” কিছু বুঝলেন স্যার?”
“এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছেনা।তবে স্ট্রোক এর অনুমান করা হচ্ছে।”
“হোয়াট? ”
“বিচলিত হবেন না। আমরা চেষ্টা করছি।আগে কোনো সমস্যা ছিল?”
অন্ত মুখটা মলিন করে বলল,

“জি ফুসফুসে ক্যান্সার ছিল।”
ডাক্তার যেন অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে গেল।চোখ বড় বড় করে অন্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
“বলেন কি?”
“ঠিক ই বলছি স্যার।”
“ধূমপান করত?”
“অতিরিক্ত সিগারেট খাওয়ার ফলেই ক্যান্সার হয়েছিলো।পাশাপাশি হৃদরোগ ও ছিল।”
“ওহ মাই গড! বলেন কি?এত সমস্যা।”
“জি স্যার।”

“ট্রিটমেন্ট কোথায় করেছেন?”
“ট্রিটমেন্ট এর কোনো কমতি ছিলনা।সিঙ্গাপুর গিয়ে ট্রিটমেন্ট নিয়েছিলো।সেখান থেকে ফুসফুস অপারেশন করা হয়।নিয়মিত চেকাপসহ সব চিকিৎসা চলছিল।মাঝে স্বাভাবিক হয়েছিলো সমস্যা একটু কম হয়েছিলো।শারিরীক ভাবেও ভাল রেসপন্স পাচ্ছিলো।ডাক্তার বলেছিলো ঠিক হয়ে যাবে।বলতে গেলে একদম ই সুস্থ হয়ে গিয়েছিল।”
“এখন কি হঠাৎ অসুস্থ হয়েছে?”

“জি স্যার হঠাৎ অসুস্থ হয়েছে।একদম ই সুস্থ মানুষ ছিল।”
এরই মাঝে প্রান্তিকের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।অক্সিজেন মাস্ক রেডি ছিল।দ্রুত অক্সিজেন মাস্ক দেওয়া হয়।অন্ত আর শ্রাবণ প্রান্তিকের দুই পাশে দাঁড়িয়ে দুই পাশ দিয়ে প্রান্তিকের হাত ধরে রেখেছে।মাহবুব পাশেই বেঞ্চে কাঁন্নাকাটি করছে।প্রান্তিক নিজের মুখের মাস্ক খুলে শ্রাবণের হাতটা শক্ত করে ধরল।শ্রাবণের দিকে ঘাড় কাত করে তাকাল।চোখের পাতা মেলতেও কষ্ট হচ্ছে প্রান্তিকের।তীব্র কষ্ট নিয়ে বলল,

“আমার সময় বোধহয় শেষ শ্রাবণ। আমার মা-বাবার কেউ নেই।তু-তুই দেখিস।আমার রজনিগন্ধ্যা কোথায়? রজনিগন্ধ্যা কে দেখে রাখিস।ওর খুব কষ্ট হবে। ওকে তোরা দেখে রাখিস ভাই।আমার বোধহয় শেষ দেখাটা আর হলনা আমার রজনিগন্ধ্যাকে।” এটুকু বলতেই প্রান্তিকের দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। গলা জড়িয়ে গেল।আর যে কি বলার চেষ্টা করল অন্ত আর শ্রাবণ দু’জনের কেউ কিছুই বুঝতে পারল না।অনেক্ষণ ধরে প্রান্তিক কিছু বলার চেষ্টা করল কিন্তু কিছু বলতে পারল না। শ্রাবণ আর অন্ত চেষ্টা করল প্রান্তিকের কথা বোঝার জন্য।কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারল না। শ্রাবণ বারবার বলল,
” ভাই আপনার কিছু হবেনা। না ভাই আপনার কিছু হবে না।”

আবার ও শ্বাষকষ্টের মাত্রা বেড়ে গেল প্রান্তিকের।দ্রুত অন্ত অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে দিল।প্রান্তিক আস্তে করে চোখ বুজল।একেবারেই শান্ত হয়ে গেল।অক্সিজেন চলছে, পেটের ওঠানামা অনেক বেশী বেড়ে গিয়েছে।শ্রাবণ ডাক্তার কে বলল,
” স্যার এভাবে চোখ বুজে গেল কেন?”
“ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছি। ঘুম দিক দু’ঘন্টা সুস্থ হয়ে যাবে।”

শ্রাবণ বলল, ” চোখ,কান, ফুঁসফুস যা লাগে আমার থেকে নিন প্লিজ স্যার ভাইকে বাঁচিয়ে তুলুন। ভাইকে বাঁচিয়ে তুলুন।ভাই ছাড়া অনেক গুলো মানুষ অসহায় হয়ে যাবে।”
অন্ত খেয়াল করল অক্সিজেন চলছে না।প্রান্তিকের পেট ও আর নড়ছে না।চিৎকার দিয়ে বলল,
“স্যার কুইক দেখুন। ভাই এর অক্সিজেন চলছে না।পেট ও নড়ছে না।”

ডাক্তার চিন্তিত হয়ে তাকাল।খুব অভিজ্ঞ নয়নে প্রান্তিক কে খেয়াল করল।অন্ত আর শ্রাবণ প্রান্তিকের হাত পায়ের তালু ঘষে দিচ্ছে।হাত পায়ের তালু গরম আছে।কিন্তু অক্সিজেন চলছে না।পেট ও নড়ছে না।শ্রাবণ চিৎকার দিয়ে বলল,
“অন্ত ভাই এর পেট নড়ছে না কেন?ভাই ঠিক আছেতো।”
অন্ত ডাক্তার কে বলল, “প্লিজ স্যার দেখুন না কি হল? ভাই কে ঠিক করে দিন স্যার। ভাই এর কিছু হলে ভাবি ম-রে যাবে।”

“উনি ম্যারেড?”
“জি।”
ডাক্তার যেন কথাটা শুনে আহত হল।ডাক্তারের মুখটা দেখে অন্ত আর শ্রাবণ বুঝতে পারল খারাপ কিছু হতে চলেছে।ডাক্তাররা রোজ ই এমন শত শত রোগি দেখে থাকে।একবার দেখলেই তারা অনেক কিছু বুঝে যায়।ডাক্তার বুঝেও চুপ আছে।প্রান্তিক কে ঘিরে অনেক মানুষের ভিড় জমেছে।কারণ প্রান্তিক কে সবাই চিনে।হসপিটালের নার্স ডাক্তার রা বলাবলি করছে উনিই সেই মানুষ যে তার ওয়াইফ কে প্রচন্ড ভালবাসে।একদিন হসপিটালে নিয়ে এসছিলো।সুস্থ হচ্ছিলো না বলে ডাক্তার নার্স সবাইকে মা-র-তে এসছিলো।ডাক্তার প্রান্তিকের বুকে দুই হাত দিয়ে বার বার চাপ দিয়ে দিয়ে দেখছে।প্রান্তিকের বাবা বলছে,

“বাবা অত জোরে চাপ দিওনা আমার ছেলে ব্যাথা পাবে।জন্মের পরে আমি ওকে একটু ব্যাথা ও দিই নাই।”
একজন বাবার আঁকুতি দেখে ডাক্তারের চোখে পানি চলে এল।কিচ্ছু করার নেই।ডাক্তারের কাজ ডাক্তার কে করতেই হবে।ডাক্তার বুকে প্রচন্ড জোরে চাপ সৃষ্টি করছে যেন প্রান্তিক রেসপন্স করে।কিন্তু কোনোভাবে রেসপন্স করছে না।ডাক্তারের মুখটা মলিন হয়ে আছে সাথে ভীষণ চিন্তিত।

প্রান্তিকের চোখে পাতা উল্টায়ে দেখছে।সব ভাবে পরীক্ষা করছে কোনো রেসপন্স করে কীনা? নাকে হাত দিয়ে দেখল শ্বাস নিচ্ছে বা ছাড়ছে কীনা?এত কম বয়সী একটা ছেলের এত ক্রিটিকাল অবস্থা দেখে ইমারজেন্সি ওয়ার্ড ভরে গিয়েছে মানুষে।
মেইন রাস্তা দিয়ে গেলে হাসপাতালে পৌছাতে দেরি হবে।অঞ্জুমান আর রজনি শর্টকট রাস্তা ধরে একটা বাগান দিয়ে হাঁটছে।

আঞ্জুমান আর রজনির মাথায় কাজ করছে না।ঠিক কোন রাস্তা দিয়ে গেলে সহজে হাসপাতালে পৌছাবে।বাসা থেকে হেঁটে গেলে পনেরো মিনিটের রাস্তা।ওই টাইমে ওরা বাড়ির গাড়িতে আসবে নাকি মেইন রাস্তা দিয়ে অটো বা সিএনজি তে উঠবে সেই খেয়াল নেই।রজনির কাছে মনে হচ্ছে রাস্তা ফুরাচ্ছে না।মন দৌঁড়ালে কখনো পথ ফুরায় না।স্যান্ডেল পরে হাঁটলে মনে হচ্ছে দেরি হচ্ছে তাই রজনি পায়ের স্যান্ডেল খুলে ফেলে দিল।আঞ্জুমান শুধু আল্লাহ কে ডাকছে আর বলছে,

“আল্লাহ তুমি আমার সন্তান কে ভিক্ষা দাও।আমার আয়ু আমার ছেলেকে দিয়ে দাও।তবুও আমার ছেলেকে অক্ষত রাখো।”
রজনি আঞ্জুমান কে বলল, ” আম্মা আপনার ছেলের কিছুই হবেনা।দেখবেন আমরা হসপিটালে গেলে বলবে হুদাই আমাকে এখানে আনার কি দরকার। চলো বাড়ি চলো।”

“তাই যেন হয় মা।”
“কিন্তু পথ ফুরাচ্ছে না কেন আম্মা?সেই এক ঘন্টা ধরে হাঁটছি কিন্তু পথ শেষ হচ্ছেনা।এত দূর লাগছে কেন আজ?আর ওরা ফোন তুলছে না ক্যানো?”
“জানিনা মা। তুমি সাবধানে হাঁটো।”
“আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছিনা আম্মা।আমার এত অস্থির লাগছে কেন? অকারণ কাঁন্না পাচ্ছে।”

অন্ত, মাহবুব, কেউ ফোন তুলছে না।রজনি দৌঁড়াচ্ছে আর ক্রামাগত ফোন দিচ্ছে।ধৈয্য ধরতে না পেরে প্রান্তিকের নাম্বারে ফোন দিল।প্রান্তিকের পকেটে ফোন বেজে উঠল।শ্রাবণ পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল স্ক্রিনে ভাষছে রজনির নাম্বার।নাম্বার টা সেভ করা লাইফ পার্টনার দিয়ে।শ্রাবণ ঠোঁট চেপে কেদে দিয়ে ফোনটা রেখে দিল।

অনেক মানুষ প্রান্তিকের ফোনের দিকে তাকাল।সবাই লাইফ-পার্টনার নামটা দেখে ব্যাথিত হল।কি করুণ দৃশ্য।সবাই বলাবলি করছে আহারে!এসে যখন স্বামির এই অবস্থা দেখবে কী করবে মেয়েটা।এবার ও কেউ ফোন তুলল না।অবশেষে রজনি আর আঞ্জুমান হসপিটালের গেটে পৌছাল।বাইক আর স্যান্ডেল ফেলে রাখা দেখে রজনির বুক কেঁপে উঠল।এভাবে বাইক টা ফেলে রাখা কেন? তাহলে কি উনার অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে।রজনি আঞ্জুমান কে পেছনে রেখেই দোঁড় দিল।এক দৌঁড়ে গিয়ে দেখল ইমারজেন্সিতে প্রচুর মানুষের ভীড়।অন্ত ডাক্তার কে বলেই ফেলল,

“স্যার ভাই কি আর নেই আমাদের মাঝে?”
ডাক্তার মুখটা কালো করে বলল, ” নার্স অক্সিজেন টা খুলে দিন।”
রজনির কানে এই কথাগুলো দূর থেকে ভেষে যাচ্ছে।তার পা আর চলছে না।পা’দুটো আর বাড়াতে পারল না।ভেতরে কি হয়ে যাচ্ছে তা বোঝানোর ক্ষমতা নেই।

অন্ত বলল, “কেন অক্সিজেন খুলবে কেন? ভাই এর কিছু হয়েছে?কিছু বলছেন না কেন আপনারা?”
ডাক্তার কিছু না বলে সাদা কাপড় দিয়ে প্রান্তিক কে ঢেকে দিল।নার্স অক্সিজেন টা খুলে দিল।শ্রাবণ আর অন্ত দু’জন দু’জনের দিকে তাকাল।শ্রাবণ অন্তকে বলল,
“ডাক্তার কিছু বলছে না কেন রে অন্ত?”
অন্ত বলল, “স্যার কিছু বলেন?”

“দুঃখিত।আমরা উনার ট্রিটমেন্ট করার ও সুযোগ পেলাম না।হৃদরোগের পেশেন্ট। উচ্চ রক্তচাপে হার্ট স্ট্রোক করেছে।কোনো টাইম নেয়নি।আমরা একটু দেখার ও সুযোগ পেলাম না।এত কম বয়সী সুদর্শণ ছেলের মৃত্যু আমার হাতে এটাই প্রথম হল।”

মৃ’ ত্যু কথাটা ওদের হৃদয়কে কাঁপিয়ে তুলল।মৃ*ত্যু মানে প্রান্তিক চৌধুরীর মৃ*ত্যু। ওরা ওদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।যেন মনে হচ্ছে ওরা ভুল শুনেছে।এটা সঠিক নয়।এটা কোনো দুঃস্বপ্ন।ঠিক তখন ই রজনি ভিড় ঠেলে ভেতরে গেল।ভেতরে গিয়েই দেখল সাদা কাপড়ে একটা মানুষ কে ঢেকে রাখা।তার দুই পাশে অন্ত আর শ্রাবণ।অন্ত উঠে শ্রাবণের কাছে গেল।শ্রাবণ কে জড়িয়ে ধরে অন্ত আর শ্রাবণ কাঁন্নায় ভেঙে পড়ল।

তারা এটা মেনে নিতে পারছে না প্রান্তিক নেই।রজনি অন্ত আর শ্রাবণের কাঁন্না দেখে সাদা কাপড়ে ঢাকা মানুষটার দিকে তাকাল।সমস্ত শরীর কাঁপছে রজনির ওদের কাঁন্না দেখে।সামনে রাখা সাদা কাপড়ে ঢাকা মানুষটা কে? তার প্রাণপ্রিয় মানুষ টা কোথায়? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না এখানে।এই সাদা কাপড়ের নিচে বা কে আছে? এই কাপড়ের নিচেই কি তাহলে প্রান্তিক।না এটা হতে পারেনা।রজনি ভূমিকম্পনের মত থরথর করে কাঁপছে।

চারদিকের মানুষ তাকিয়ে আছে রজনির দিকে।সব মানুষ ফিসফিস করে বিভিন্ন কথা বলছে।বলছে এটাই মনে হয় বউ।ইশ! কত বয়স কম।দু’জনকে মানিয়েছে খুব সুন্দর। যেন রাজপুত্র আর রাজরানি।রজনি কাঁপাকাঁপা হাতে এক টানে সাদা কাপড় টা ফেলে দিল।সাদা কাপড় টা ফেলতেই তার প্রাণপ্রিয় মানুষটার প্রাণহীন দেহটা দেখল।নিথর দেহটা পড়ে আছে।একদম টলমল করছে দেখতে।

রজনি কি বলবে? কি করবে কিছুই বুঝছে না।শুধু কাঁপছে।জীবনের সব চেয়ে বড় আনএক্সপেক্টেড শকড পেলে মানুষ সেই মুহুর্তে যেন পাথর হয়ে যায়।তার পুরা দুনিয়াটা ঘুরছে। এখনি হার্ট এট্যাক হয়ে যাবে।রজনি শকড হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার চারদিক কেমন কাঁপছে।মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেল।দপ দপ করছে মাথার ভেতর।শ্রাবণের নজর গেল রজনির দিকে।শ্রাবণ অন্তকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

“অন্ত ভাবি।ভাবিকে সামলা প্লিজ!”
অন্ত রজনির কাছে এগিয়ে এল।কি বলবে সে রজনিকে।কি বা বলা যায় এমন মুহুর্তে। অন্ত কাঁন্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“ভাবি সব শেষ হয়ে গিয়েছে আমাদের।সব শেষ হয়ে গিয়েছে।”

রজনি ভেতর থেকে ফুলছে,কাদছে কিন্তু শব্দ হচ্ছেনা।সে যা ভাবছে তা কি সত্য।তা সত্য হলেও সে মেনে নিতে পারবে না,সহ্য করতে পারবে না।ছলছল নয়নে অন্তর দিকে তাকাল কিছু বলল না।তার কানে যেসব আসছে তা যেন মিথ্যা হয়। এসব যেন দুঃস্বপ্ন হয়।রজনির মনে হচ্ছে প্রান্তিকের কিছুই হয়নি।সে প্রান্তিকের পাশে গিয়ে বসল।প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেদে দিল।

সেই কাঁন্না এমন করুণ আর হৃদয়বিদারক ছিল প্রতিটা মানুষ কেদে ভাষিয়ে দিচ্ছিল।কারো ভালবাসা এতটাও গভীর হয় রজনির কাঁন্না না দেখলে কেউ বুঝত না।প্রান্তিকের দুই গালে হাত রেখে কাদতে কাদতে বলল,
“আপনার কি হয়েছে? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?ওরা এসব কি বলছে। আমি এখনি দম বন্ধ হয়ে ম-রে যাবো।আপনি কথা বলুন।আপনার পায়ে ধরি, আল্লাহর দোহাই লাগে আপনি কথা বলুন।আমি মানুষের এসব কথা সহ্য করতে পারছি না।আপনি কথা বলুন।আপনাকে কথা বলতে হবে।”

শ্রাবণ বলল, “ভাই আর কথা বলবে না ভাবি।আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে।”
রজনি অন্ত আর শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে কাদতে কাদতে বলল,
“উ’ উনার কি হয়েছে?”
“ভাই,ভাই আর নেই ভাবি।ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে।”

রজনির কর্ণকুহরে কথাটা যেতেই রজনির মুখটা খন্ড বিখন্ড হয়ে গেল।ত্রিভুবণ যেন কাঁপতে শুরু করল।রজনির কাঁন্নার মাত্রা আরো বহুগুন বেড়ে গেল।কোনো ভাবে এই কথাটা মিথ্যা হয়ে যাক। কাদতে কাদতে বলল,
“কি আজেবাজে কথা বলছেন আপনি? উনি একটু আগেই ভাল ছিলেন।কিছুক্ষণ আগেই আমার কাছ থেকে এসছে।উনার কিছু কীভাবে হবে?একটা ভাল মানুষ বাড়ি থেকে এসেই নেই হয়ে গেল।মানুষ হাসপাতালে কেন আসে তাহলে? এখানে এসে যদি ফুরিয়েই যাবে আমি তাহলে উনাকে পাঠাতাম না।ডাক্তারকে ডাকুন।বলুন ভালভাবে দেখতে উনি সুস্থ হয়ে যাবেন।”

কেউ কোনো উত্তর দিল না।এই মুহুর্তে রজনিকে বলার মত কিছু নেই।চারপাশে মানুষ তাকিয়ে দেখছে রজনিকে।রজনি আবার ও কাদতে কাদতে বলল,
“আপনি উঠুন।ওরা এসব কি বাজে কথা বলছে দেখুন না।আপনি উঠুন।দেখুন আমি এসছি।আপনার রজনিগন্ধ্যা। আপনি কেন চুপ আছেন?”

ডাক্তার এসে রজনিকে বলল, ” আপনি শান্ত হন। এটাই জগৎ এর নিয়ম।সবাইকেই ছেড়ে যেতে হবে।”
রজনি ডাক্তারের দিকে তাকাল।মাথা ঠিক নেই তার।ডাক্তারের এপ্রোণ খামছে ধরে বলল,
“উনাকে ভাল করে দিন।উনাকে ভাল করে দিতে হবে আপনাকে।আমার স্বামিকে ভাল করে দিন দোহাই লাগে।আপনাকে উনাকে সুস্থ করে দিতেই হবে।আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনা।উনার কি মরার বয়স হয়েছে যে মরে যাবে।মানুষ একশ বছর ও বাঁচে।”

ডাক্তারের মুখে কোনো ভাষা নেই।রজনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ” আমদের হাতে কারো জীবন দেওয়ার ক্ষমতা নেই মিসের চৌধুরী।মৃত্যুর কোনো বয়স ও নেই।আপনাকে কি বলব আমি আসলেই জানিনা।এই কঠিন বাস্তবতা আপনাকে মেনে নিতেই হবে।”

“তাহলে আমার জীবন ও নিয়ে নিন।আমার জীবন ও নিয়ে নিন আপনি।আপনি জানেন উনি আমাকে কত ভালবাসে।আপনি আরো একটু ভালভাবে দেখুন না প্লিজ।দেখুন উনি বেঁচে আছে।”
“আমি সব ভাবেই দেখেছি।উনি আর বেঁচে নেই।”

রজনি সাথে সাথে দুই কানে হাত দিয়ে এত জোরে চিৎকার দিল।সেই চিৎকারে ছিল হৃদয় ফাঁটা আর্তনাদ।রজনি এক চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ল।ফ্লোরে হাত পা ছোড়া ছুড়ি করতে করতে বেসামাল কাঁন্নায় ভেঙে পড়ল।সেই বেসামাল কাঁন্নায় শুধু হৃদয় ফাঁটা আর্তনাদ আর চিৎকার করে যাচ্ছে।রজনি সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে পড়েছে।একটা উ*ন্মা*দ যা করে ঠিক তাই করছে।কয়েকজন মানুষ ওকে সামলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সামলে উঠতে পারছেনা।এরই মাঝে আঞ্জুমান এসে ঘটনা দেখে ছেলের লা*শে*র উপর হুমড়ি দিয়ে পড়ল।মাহবুব কাদতে কাদতে জ্ঞাণ হারিয়েছে।আঞ্জুমানকেও সামলানো যাচ্ছেনা।শুধু আমার বাবু আমার বাবু বলে চিৎকার করছে।রজনি আবার বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রান্তিক কে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বলল,

” আপনি এটা কি করলেন প্রান্তিক চৌধুরী।এত বড় শাস্তি আমাকে কীভাবে দিতে পারলেন।আমি কীভাবে বেঁচে থাকব।আমার কি হবে এখন।আপনার তো জানাই হলনা আপনি বাবা হতে চলেছেন।আপনার সন্তানকে জন্মের আগেই এতিম করে দিলেন।এত নিষ্টুর আপনি।একজন নিষ্টুর স্বামি আপনি।আমি আপনাকে ছাড়া এক মুহুর্ত এই পৃথিবীর নিঃশ্বাস নিতে পারবা না।আমি ম-রে যাবো।এভাবে একা করে যদি চলেই যাবেন তাহলে কেন আমাকে এত ভালবাসলেন। আপনি জানেন না আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই। ”

আঞ্জুমান উঠে দাঁড়িয়ে রজনিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” আমার ছেলে এটা কি করল মা রজনি।”
“আপনার ছেলেকে বলুন আম্মা আমি ম-রে যাবো সে ছাড়া।আমি বাঁচব না।আমার কষ্ট হচ্ছে।আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।”
“আমার বাবুর দায়িত্ব তোমাকে দিয়েছিলাম।আমার বাবুকে তুমি বাঁচাতে পারলে না মা।”

“আমি হেরে গিয়েছি আম্মা।উনাকে ছাড়া এই পৃথিবীর আমি এক সেকেন্ড ও থাকব না।আমি থাকতে পারব না আম্মা।”
বলেই রজনি ছুটে গিয়ে ওয়ালে নিজের মাথা আঘাত শুরু করল।রজনি তীব্র যন্ত্রনায় ছটফট করছে। কেউ সামলাতে পারছে না।রজনি আবার ও প্রান্তিকের কাছে গেল।আবার ও প্রান্তিক কে জড়িয়ে ধরে বলল,

” আমি আপনাকে ভালবাসি প্রান্তিক চৌধুরী। নিজের চেয়েও বেশী ভালবাসি।আমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের এক অংশ ও পূরণ না করে কোথায় হারিয়ে গেলেন আপনি।আপনি না বলেছিলেন আমরা এক সাথে বৃদ্ধ হবো।তাহলে কেন হারিয়ে গেলেন।প্লিজ আমায় ছেড়ে যাবেন না।আপনি ছাড়া কিচ্ছু নেই আমার” বলতে বলতে রজনি জ্ঞান হারাল।

রাত বারোটা বাজে।হসপিটালের কাজ শেষ করে প্রান্তিক কে বাসায় আনা হল।আঞ্জুমান, মাহবুব কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।একমাত্র ছেলের মৃত্যু কোনো বাবা মায়ের সামনে হওয়া মানে তাদের মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগের সমান।রজনিকে অচেতন অবস্থায় গাড়ি থেকে নামানো হল।প্রান্তিকের মৃ*ত্যুর সংবাদে পুরা শহরের মানুষ ভীড় জমিয়েছে।প্রতিটা মানুষ রজনির পা*গ*লা*মি দেখে বলছে, “এই মেয়েটাকে বাঁচানো যাবেনা।এতটাও ভালবাসা সম্ভব কাউকে।”

পরের দিন সকালে প্রান্তিকের লা*শ দাফন শেষ করে যখন সবাই নিয়ে যাচ্ছিলো।বাড়ির সবাই কাদলেও রজনি কাদছে না।সে এক নজরে তাকিয়ে আছে প্রান্তিকের দিকে।চোখ দিয়ে পানি ফেলে বলল,” আমার ভালবাসা এতটাও ঠুনকো নয় যে আপনাকে রেখে বেশীদিন একা থাকব। আমি আসব আপনার কাছে খুব শিঘ্রই আসব।আমাদের দেখা হবে প্রিয় পুরুষ। আপনি ছাড়া অসম্পূর্ণ আমি।এই অসম্পূর্ণ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকব না আমি।আমি এখনো বেঁচে নেই। যে মুহুর্তে আপনার নিথর দেহটা দেখেছি ওই মুহুর্তে আমার আত্মার মৃ*ত্যু ঘটেছে।শুধু পড়ে আছে দেহটা।কেউ আর বলবে না তোমার নয়নের কাজল কালো চাহনি দেখে আমার নয়নে লাগিল নেশা।”

তারপর থেকে রাজনি আর স্বাভাবিক আচরণ করেনি।কখনো ঠিক ভাবে খায়নি, ঘুমোয় নি।রজনির মা-বাবা ভাই গ্রাম ছেড়ে মেয়ের কাছে চলে এসেছে।রজনি যে কোনো মুহুর্তে খারাপ কিছু ঘটাতে পারে।রজনি মানসিক ভারসাম্যহীন একটা মানুষের মত আচরণ করে।সব সময় একা একা প্রান্তিকের সাথে কথা বলে।কখনো খুব জোরে চিৎকার দিয়ে কেদে ওঠে,কখনো হাসে।কখনো একা একা রজনিগন্ধ্যা ফুল হাতে নিয়ে প্রান্তিকের মত কথা বলে।সবাই জানে রজনি ভয়ানক শকড পেয়েছে।

এটা কোনো ডাক্তার বা মানুষের কোনো স্বান্তনা মূলক কথা দিয়ে ঠিক করা যাবেনা।বাসায় নিয়মিত ডাক্তার এসে দেখে যাচ্ছে।ডাক্তার ও কিছু ঠিক করতে পারছে না।প্রিয়তা,আঞ্জুমান,মাহবুব কেউ ভাল নেই।একটা সুখের পরিবার এক নিমিষেই সব রং হারাল।প্রিয়তা ঠিকভাবে ছেলের যত্ন করতে পারেনা।অন্ত আর অন্তর মা-বাবা ই ওদের সন্তান কে দেখাশোনা করে।সবাই সময়ের সাথে একটু একটু স্বাভাবিক হলেও স্বাভাবিক হতে পারেনি রজনি।

আর একটা মানুষ আছে যে প্রতিনিয়ত প্রান্তিকের কবরের কাছে গিয়ে চোখের পানি ফেলে।সে হল শ্রাবণ।সুখ বা শান্তি বলে কিছুই নেই শ্রাবণের জীবনে।প্রতিদিন বেশীরভাগ সময় সে প্রান্তিকের কবরের কাছে সময় কাটায়।প্রতিনিয়ত প্রান্তিকের কবরের কাছে গিয়ে ক্ষমা চায়।হাত জোড় করে বলে, “আপনার মৃ*ত্যুর জন্য আমি দায়ী ভাই।আমাকে ক্ষমা করে দিন ভাই।আমাকে ক্ষমা করে দিন ভাই।সব হারিয়ে আজ নিঃস্ব একা আমি।যদি আমার হাতে কোনো ক্ষমতা থাকত আমি আপনার জায়গা থাকতাম আপনাকে ভাবির কাছে পাঠিয়ে দিতাম।ভাবি ভাল নেই ভাই।আপনি ছাড়া ভাবি অনেক কষ্টে আছে।”

দেখতে দেখতে কেটে গেল ৬ বছর।
শ্রাবণ চা বানাচ্ছে। আধো আধো কন্ঠে একটা বাচ্চা বলে উঠল, “পাপ্পা আমি দুধ চা খাবো।”
শ্রাবণ কিচেন থেকে আদুরে গলায় বলে উঠল,
“বাচ্চাদের চা খেতে নেই বাবা।”
“আমি চা খাবো পাপ্পা।দুধ চা আর পারুটি খাবো।”

শ্রাবণ ট্রেতে করে দুধ চা আর পারুটি নিয়ে এল।অদ্ভুত সুন্দর চেহারার একটি ছেলে বাচ্চা কার্টুন দেখছে।শ্রাবণ লে দেখেই হেসে দিল।বাচ্চাটার চোখ দু’টো শ্রাবণের মত কটা হয়েছে।ধবধবে সাদা গায়ের রং।শ্রাবণ পায়ের কাপে পারুটি ভিজিয়ে বাচ্চাটার মুখে দিতে দিতে বলল, ” আজ তোমার স্কুলের প্রথম দিন। আমাকে কথা দিতে হবে প্রা’ণ বাবা তুমি আজ থেকে মন দিয়ে পড়াশুনা করবে। কোনদিন ধুমপান বা কোনো নেশা জাতীয় জিনিস ধরবে না।”
“আচ্ছা পাপ্পা।জানো পাপ্পা বিকালে খেলতে গেলে বলে তোর পাপ্পা অনেক ভাল।”

“তোমার পাপ্পা সত্যি অনেক ভাল ছিলেন।সাথে তোমার মাম্মি ও।যাও মাম্মির কাছে গিয়ে দোয়া নিয়ে এসো।”
বাচ্চাটা ডিভান থেকে উঠে রজনি আর প্রান্তিকের ছবির কাছে গেল।রোজ তিন বেলা করে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে।ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, ” মাম্মির সাথে তোমার কোনো ছবি নেই কেন? সব ছবি আপণ পাপ্পার সাথে কেন?”
শ্রাবণ প্রা*ণ কে কোলে তুলে বলল, “তুমি রোজ তোমার মাম্মি আর পাপ্পার জন্য দোয়া করবে বাবা।ওরা তোমাকে অনেক ভালবাসে আমার চেয়েও বেশী ভালবাসে।দেখো তোমার মাম্মি কত সুন্দর ছিল, তোমার পাপ্পা কত সুন্দর ছিল।উনিই তোমার আপণ পাপ্পা।”

“আর তুমি?”
“আমিও তোমার আপণ পাপ্পা।”
শ্রাবণ বাচ্চাটাকে অত ডিটেইলস বলে না।বাচ্চা ছেলেটার ব্রেইণে অত প্রেশার সৃষ্টি করেনা।
প্রিয়তা স্কুলের গেইটে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলের হাত ধরে।শ্রাবণ প্রা*ণ কে নিয়ে স্কুলের সামনে গেল।প্রিয়তার মুখোমুখি হল।কিন্তু শ্রাবণ প্রিয়তার মুখের দিকে তাকাল না।শ্রাবণ আজ ও প্রিয়তার মুখের দিকে তাকাতে পারেনা।শ্রাবণের ভালবাসা একটুও কমেনি।আজ ও সেই প্রথমদিনের মতই আছে প্রিয়তার প্রতি।প্রিয়তা ভুলে গিয়েছে শ্রাবণ কে।মনের কোনে কোথাও শ্রাবণের নাম আছে কীনা কে জানে।প্রিয়তা প্রা*ণ কে দেখেই কোলে তুলে নিল।শ্রাবণ প্রিয়তার ছেলেকে কোলে তুলে নিল।প্রিয়তা প্রা*ণের গালে চুমু খেতে খেতে বলল,

“আমার ভাই -এর সব তুই পেয়েছিস বাবা।”
“ফুপ্পি তোমার ভাই কে? আমার পাপ্পা।”
প্রিয়তা আচমকা শ্রাবণের দিকে তাকাল।শ্রাবণ ও প্রিয়তার দিকে তাকাল।সময়টা আজ কত বদলে গিয়েছে।সব কিছু পাল্টে গিয়েছে।প্রিয়তার ছেলে প্রিয়ম আর প্রা*ণ দু’জনে হাত ধরে খেলছে।প্রিয়তা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলল,

” সত্যি শ্রাবণ তুমি অসাধারণ। একটা সময় আমি ভুল বুঝেছিলাম তোমাকে।রাগ ছিল অনেক।কিন্তু এখন আর নেই।তুমি আমার ভাইয়া আর রজনির সন্তান কে যেভাবে বুক দিয়ে আগলে রেখেছো অন্য কেউ হলে তা পারত না।জানিনা ওরা কিছু দেখতে পায় কীনা? দেখতে পেলে ওরা অনেক নিঃশ্চিন্তে থাকতে পারবে।ওদের সন্তানের আদরের কোনো কমতি তুমি রাখোনি।সেই একদিনের বাচ্চা টাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর যত্নে আগলে রেখেছো।তোমার প্রতি সত্যি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।আজ মা-বাবা ও পৃথিবীতে নেই।সবাই কে হারিয়ে নিঃস্ব আমরা।তুমি না থাকলে বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেতনা।”

“কবেই ম*রে যেতাম।বেঁচে আছি ওর জন্য।নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা করে ওর জন্য।আমার ছেলেটাকে আমি সত্যি অনেক ভালবাসি প্রিয়তা।আমার জীবনে আর কোনো আফসোস নেই।আজ আমি বুঝি একটা সন্তান মানুষ কে কতটা প্রশান্ত দিতে পারে।ওর আধো আধো ডাক,ওর সব বায়না আমাকে শান্তি দেয়।আজ আমার মনেও কোনো কষ্ট নেই।

এখন আমার নিজের সাথে নিজের চ্যালেঞ্জ ওকে মানুষের মত মানুষ করা।ও যেন কখনো সিগারেট স্পর্শ না করে সেই খেয়াল রাখা।ভাই এর মত একজন সমাজ সেবক একজন আদর্শবান মানুষ হিসাবে তৈরি করা।আজ যদি ভাই থাকত ভাবি থাকত ওদের বেবিকে নিয়ে একটা সুখের সংসার হত।আমার চোখের সামনে ওদের সুখের সংসার টা সব সময় ভাষে।”
প্রিয়তা চোখের পানি ফেলে বলল, ” রজনি আর ভাইয়া জানতেও পারল না ওদের ফুটফুটে একটা মিষ্টি বেবি আছে।আমার ভাইয়া কত আদর করত।”

এরই মাঝে অন্ত এসে হাজির হয়।অন্ত প্রিয়তাকে বলল,
” একটু দেরি হয়ে গেল রা-গ করোনিতো।ভাই আর ভাবির কবর জেয়ারত করলাম বাবা-মায়ের কবর জেয়ারত করে এলাম।”

“তুমি এই কাজটা কখনো ভুল করোনা দেখি।”
“শুধু কি আমি সাথে শ্রাবণ ও।তোমার চোখে পানি কেন প্রিয়তা?”
“ভাইয়ার জন্য রজনির জন্য খারাপ লাগছে।”
“আমাদের প্রা*ণের মাঝেই তো ভাইয়া আছে।ও ফুল বাগানে যখন দৌঁড়াদৌঁড়ি করে মনে হয় ভাই ঘুরাঘুরি করছে।এই বয়স থেকেই ফুল ছিড়তে দেয় না কাউকে।বই এর কিছু পড়তে পারেনা তাও বই নিয়ে বসে থাকে।ভাই এর সব গু*ন পেয়েছে।”

প্রিয়তার ছেলের সাথে একই স্কুলে ভর্তি করা হল প্রা*ণ কে।বাইরে এসে প্রিয়তা আবার ও কাঁন্নায় ভেঙে পড়ল।অন্ত প্রিয়তার কাধে হাত রেখে বলল, “এভাবে কাঁদছো কেন আজ তুমি?”
” রজনির যন্ত্রণাদায়ক একটা বছর আমার বারবার মনে পড়ছে।একটা মেয়ে একটা ছেলেকে ঠিক কতটা ভালবাসলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিজেই মা*রা যায়।ওদের ভালবাসা স্বার্থক।”
“ওদের ভালবাসায় কোনো খাঁদ ছিলনা। এমন ভালবাসা ইতিহাসে বিরল।”
৬ বছর আগে……………

রজনির গর্ভে একটু একটু করে বাড়ছিলো প্রান্তিক আর তার সন্তান।কিন্তু রজনির সেদিকে কোনো খেয়াল ছিলনা।একজন গর্ভবতী মায়ের যে পরিমান মানসিক রিল্যাক্স,বিশ্রাম আর খাবারের প্রয়োজন তার কিছুই রজনি করছিল না।একটা রাত ও সে ঘুমায়নি।প্রান্তিকের ছবি বুকে জড়িয়ে সারারাত কাদত।মানসিক ভাবে ডিপ্রেশন এ ভুগছিলো।

দম বন্ধ একটা কষ্ট হচ্ছিলো।প্রতিনিয়ত শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো।সারাক্ষণ তার কানে প্রান্তিকের আদুরে ডাক গুলো বাজতে থাকত।কান চেপে ধরে রাখত।সহ্য করতে পারছিলো না কিছুই। আমার রজনিগন্ধ্যা,আমার ফুল বাগানের একমাত্র ফুল, আমার সুইটহার্ট এই কথাগুলো রজনির মস্তিষ্ক এলোমেলো করে দিচ্ছিলো।বেঁচে থেকেও ভয়ানক যন্ত্রণা ভোগ করছিলো সে।তাকে উপহার দেওয়া প্রান্তিকের সেই বাড়িতে চলে এসেছিলো ২ মাস পরে।

রজনি ড্রিম হাউস এর প্রতিটা ওয়াল যেন চিৎকার দিয়ে বলে এই ঘরে তোমাকে একাকি মানায়না রজনিগন্ধ্যা,প্রান্তিক চৌধুরীর রজনীগন্ধ্যা।তোমাকে বড্ড বেমানান লাগছে।এই ঘর জুড়ে তোমার একার নয় তোমাদের দু’জনের উপস্থিতি এই ঘরকে মাতিয়ে রাখত।অন্ধকার মাটির নিচে প্রান্তিক চৌধুরী একা কষ্ট পাচ্ছে।তুমি ছাড়া প্রান্তিক চৌধুরী এক সেকেন্ড নিঃশ্বাস নিতে পারেনি।তুমি ছাড়া এখন সে ভাল নেই।রজনি দুই কান চেপে ধরে আবার ও বসে পড়ে।ঘরের প্রতিটা কোনায় কোনায় প্রান্তিকের স্মৃতি। রজনি নির্বিকার তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে।

হঠাৎ যেন কখন এসে প্রান্তিক পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলবে আমার ফুল বাগানের শ্রেষ্ঠ ফুল টাকে বড্ড বেশী ভালবাসি।বুকশেলফ টা পড়ে আছে, ওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো পড়ে আছে, প্রান্তিকের শখের ফুল বাগান পড়ে আছে, প্রান্তিকের শখের গাড়িটা পড়ে আছে,সব থেকে বেশী কষ্টে পড়ে আছে প্রান্তিকের শখের নারী রজনিগন্ধ্যা।শরীরে এক বিন্দু গহনা নেই, চোখে আর কাজল পরে না এখন, একটা সাদা শাড়ি গায়ে।

সারাদিন গুটি সুটি মেরে পড়ে থাকে।মস্তিষ্কে ভয়াবহ যন্ত্রণা হয়। প্রেগন্যান্সিতে রজনির অবস্থা খুব একটা ভাল নয়।অতিরিক্ত দুঃচিন্তা,মানসিক অশান্তিতে চোখের নিচে কালি পড়েছে,শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।যে চোখের ভয়ংকর সুন্দর মায়ায় প্রান্তিক চৌধুরী পড়েছিলো সেই চোখে আজ কোনো মায়া নেই আছে শুধুই অশ্রু।চেহারায় সেই মাধুর্যতা নেই,টলমলে মেয়েটার গায়ে এক ফোঁটা মাংশ নেই।

এভাবেই কেটে গেল নয় মাস।রজনির হঠাৎ খিঁচুনি শুরু হল।দ্রুত ডাক্তারের কাছে নেওয়া হল।একলাম্পশিয়া শুরু হল রজনির।হাই পেশার এর জন্য একলাম্পশিয়া শুরু হয়।ডাক্তার জানায় মা-বাচ্চা কেউ ই বাঁচবে না। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে ডেলিভারিতে রজনি মা-রা গেলেও ওর বাচ্চাটা বেঁচে থাকে।রজনি মৃত্যুর আগে শ্রাবণ কে ডেকে বলে যায়, ” এই পৃথিবীতে একমাত্র আপনিই আছেন যে প্রান্তিক চৌধুরীর মত আমার সন্তান কে ভালবাসতে পারবেন।আপনার ও তো কেউ নেই এই পৃথিবীতে। আমার সন্তান কে আপনার হাতে তুলে দিলাম।ওকে আপনি আগলে রাখবেন।আমার সন্তান যেন কোনদিন সিগারেট স্পর্শ করে না।ওকে ওর বাবার মত করে মানুষ করবেন।আমাদের সন্তানের বাবা হয়ে এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকবেন আপনি।ও যেন মানুষের মত মানুষ হয়।”

একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে রজনির মা-বাবা ও ভেঙে পড়ে।শ্রাবণের সাথে সবাই মিলে রজনির সন্তান কে যত্ন করছিল।সবাই খেয়াল করত শ্রাবণের অন্য রকম একটা টান আর ভালবাসা রজনি আর প্রান্তিকের সন্তানের প্রতি।সবাই নিশ্চিন্তে শ্রাবণের কাছে ছেড়ে দেয় রজনি আর প্রান্তিকের সন্তান কে।এর দু’বছর পর ই প্রান্তিকের মা-বাবা ও দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়।তারপর থেকে অন্ত, প্রিয়তা,রজনির ভাই,মা-বাবা শ্রাবণ সবাই প্রচুর আদর করে প্রা*ণ কে।

শ্রাবণ সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলো।প্রান্তিকের জন্যই ভালবাসা হারিয়ে মৃ*ত্যুর মুখে চলে যাচ্ছিলো।রজনি আবার নতুন করে পবিত্র একটা প্রা*ণ শ্রাবণের হাতে তুলে দিয়ে নতুন ভালবাসায় বাঁচতে শেখায়।শ্রাবণ কোনদিন বিয়ে করবে না আর।তার জীবনের একটায় লক্ষ্য তার ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করবে।

(আজ ভীষণ খারাপ লাগছে।অনেক বেশী সমস্যার মাঝ দিয়ে উপন্যাস টা শেষ করলাম।এত দীর্ঘ টাইম নিয়ে আমি এর আগে কোনো উপন্যাস লিখিনি।ব্যক্তিগত ব্যস্ততা, চাকরি,লেখাপড়া সব নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম।পাঠক দের কাছে বিনীত ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী আপনাদের এত কষ্ট দেওয়ার জন্য।এত গ্যাপ দেওয়ার জন্য।অনেকেই জানেনা এই উপন্যাস শুরুর সাথে আমার চাকরি আর মাস্টার্স এক্সাম শুরু হয়।নতুন চাকরির জন্য সময়ের অভাব হয়,পরীক্ষার জন্য লেখায় গ্যাপ পড়ে।

আপনারা আমাকে ভালবাসেন বলেই অনেক অপেক্ষার পরেও গল্পটা পড়ে গিয়েছেন।উপন্যাসের এন্ডিং কারো মনের মত হবেনা এটাই স্বাভাবিক।আপনাদের অনুভূতি টা আজ প্রকাশ করবেন কিন্তু এন্ডিং নিয়ে মন্তব্য করবেন না।উপন্যাস এর শুরুতেই লেখক রা এন্ডিং আর থিম টা ভেবে রাখে।যদিও আমি এমন এন্ডিং ভেবেছিলাম না।কিন্তু অতিরিক্ত গ্যাপের জন্য আমার প্লট চেঞ্জ করতে হয়েছিলো।অনেক বড় একটা প্লট ছিল কিন্তু আমি সেই প্লটে আগাইতে পারিনি। শ্রাবণ প্রিয়তার মিল নিয়ে যারা আপত্তি করেছে তাদের বলব, ‘ যে কারণেই হোক এত এত অন্যায়ের পরেও কীভাবে মিল সম্ভব।বাস্তবতা বড়ই কঠিন। আর প্রান্তিক যে ভাবে সিগারেট খেত।সিগারেট এর কি বাজে প্রভাব পড়া স্বাভাবিক নয়।রজনির কি প্রিয় মানুষ হারিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল।সর্বোপরী কিছু গল্প ট্রাজেডি না হলে মনে রাখবেন কীভাবে এই লেখিকাকে আর এই চরিত্রগুলো বা কীভাবে মনে রাখবেন।

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৫০

আর একটা কথা এই উপন্যাস নিয়ে কেউ সমালোচনা করবেন না এটা আপনাদের কাছে অনুরোধ। এটা সিনেমাটিক আর কাল্পনিক উপন্যাস।বাস্তবের তেমন কিছুই নেই।আমি হাজার হাজার ভুল করেছি এই উপন্যাসে।অনেক গ্যাপ দিয়ে এই ভুল গুলো হয়েছে।এই ভুল গুলোর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আপনাদের কষ্ট হবে।আপনাদের মত আমার ও কষ্ট হচ্ছে।বিগত তিন রাত না ঘুমিয়ে এন্ডিং সাজানো হয়েছে।একটানা তিন দিন তিন রাত এই এন্ডিং ই লিখেছে।কত ঘন্টা সময় লাগল হিসাব করিনি।এত সময় কোনো গল্পের এন্ডিং এ আমার লাগেনি।ওদের অনেক মিস করব।এতদিন যেন আমার সাথে কতগুলো চরিত্র মিশে ছিল।এই অগোছালো গল্পটাকে ভালবাসার জন্য লেখিকার পক্ষ থেকে অনেক অনেক ভালবাসা।)

সমাপ্ত