মন বিনিময় পর্ব ২৯

মন বিনিময় পর্ব ২৯
তাসফিয়া হাসান তুরফা

হলুদের স্টেজে বসে আছে কনে। ওকে এক-এক করে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে সবাই। বিবাহিতরা জোড়ায় জোড়ায় আসছে, হলুদ লাগিয়ে কনেকে খাইয়ে দিচ্ছে, একিসাথে ছবি তুলে চলে যাচ্ছে। ব্যতিক্রম হলোনা স্বপ্নিল-রাহিতার সাথেও। দুজন একত্রে, পাশাপাশি স্টেজে উঠে বসলো কনে অর্থাৎ নীতির পাশে। পালাক্রমে হলুদ লাগিয়ে ছবি-টবি তুলে তারপর নামলো স্টেজ থেকে।

ওদের পালা শেষ হতে না হতেই সিংগেল কাজিনরা সব চলে এলো স্টেজের কাছে। সবাই মিলে একত্রে হাম’লা করে হলুদ লাগিয়ে দিলো তাদের বোনকে। দীপ্ত যাওয়ার সময় স্বপ্নিলকেও টেনে নিয়ে গেছে। রাহিতাকে যেতে বললে সে হাসিমুখে মানা করে। বরং ওদের সব ভাইবোনের এমন মুহুর্ত দেখে আনন্দ নেওয়াই পছন্দ করলো সে। একেকজন হলুদ লাগিয়ে ভুত বানিয়ে দিয়েছে বউকে, সেই সাথে একে-অপরকে লাগানো তো আছেই! ক্যামেরাম্যানও বেশ উৎসাহ নিয়ে ভিডিও করছিলো সবটা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দূর থেকে এসব থেকে হাসছিলো রাহিতা, হঠাৎ ক্যামেরাম্যানকে দেখে তারও মাথায় এলো মুহুর্তটা ক্যামেরাবন্দী করার! যা ভাবা সেই কাজ, ফোন বের করে সবার ভিডিও করছিলো সে। এরই মাঝে রাহিতার চোখ আটকে গেলো ভাইবোনদের সাথে হাসতে থাকা স্বপ্নিলের দিকে। যে স্বপ্নিলের ঠোঁটে এক মাস আগেও হাসি ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলো, সেই স্বপ্নিলকে এখন প্রায়শই হাসতে দেখা যায়!

যে হাসিতে প্রতিনিয়ত মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায় রাহিতার। স্বপ্নিলের হাসি দেখে হাসি ছড়িয়ে গেলো রাহিতার ঠোঁটেও! আর সবাইকে ছাড়িয়ে ক্যামেরা জুম করে ছবি তুললো শুধুমাত্র স্বপ্নিলের হাস্যোজ্জ্বল মুখের। আর কেউ দেখার আগেই টুপ করে চুমু দিলো সে ছবির উপর! অতঃপর নিজের কান্ডে নিজেই লাল হলো লজ্জায়! মনে মনে ভাবলো, স্বপ্নিল কি কখনো বুঝবেনা রাহিতার মনে ওর জন্য লুকিয়ে থাকা সুপ্ত অনুভূতির কথা? কেন ওর চোখের দিক তাকিয়ে স্বপ্নিল নিজের জন্য প্রবাহিত ভালোবাসার নদী দেখতে পায়না? কবে বুঝবে সে? কবে আসবে সেইদিন? আর কবে?

হলুদ শেষে বাড়ির মেহমান খাওয়াদাওয়া করে প্রস্থান করলে বাড়ির লোকেরা একসাথে খেতে বসলো। স্বপ্নিলের পাশে রাহিতা বসেছে, ওদের সামনে দিলারা বেগম। দীপ্ত ও তার মা নিজ দায়িত্বে সার্ভ করছে সকলকে। অন্য কাউকে কিছুই কর‍তে দিচ্ছেন না তারা! খাবারদাবাড় নেওয়ার মাঝেই টেবিলের একপ্রান্তে চিংড়ির আইটেম দেখে রাহিতা নিজ দায়িত্বে এভোয়েড করছিলো ওটাকে। বাকি খাবার নিজের মতো নিয়ে এটাসেটা দিয়ে খাচ্ছিলো চুপচাপ। সেদিকে হঠাৎ চোখ পড়লো স্বপ্নিলের মামির। তিনি বেশ কয়েকবার রাহিতাকে সাধলেন, রাহিতা হাসিমুখে এলার্জির কথা বলে মানা করলো। তবুও স্বপ্নিলের মামি দম নিলেন না। ভাবলেন নতুন বউ হয়তো লজ্জা পেয়ে চিংড়ি নিতে চাইছেনা, নয়তো এ সুস্বাদু খাবার কেউ ছাড়ে? তাইতো একগাল হেসে রাহিতার দিকে তাকিয়ে স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন,

—শশুড়বাড়ি বলে কি লজ্জা পাচ্ছো, মা? আরে তোমাদের জন্যই তো রান্না করেছি৷ সামান্য এলার্জিতে কিছু হয়না! সবাই খাচ্ছে দেখো। তাছাড়াও তুমি শুকনো মানুষ, ভালোমতো পেট ভরে খাও। এভাবে খেলে তো মনে হবে নতুন বউকে ঠিকমতো আপ্যায়ন করতে পারছিনা আমরা!

—এসব হলো আজকালকার মেয়েদের ঢং। বুঝলে, ভাবী? আমাদের মনে হয় কোনোদিন এলার্জি হয়নি? আমরা মনে হয় এমন করেছি?
রাহিতাকে খানিকটা খোটা মেরেই স্বপ্নিলের মামির উদ্দেশ্যে কথাটা বললেন সীমা বেগম। স্বপ্নিল চুপচাপ খাচ্ছিলো আর সবার কথা শুনছিলো শুধু। এবার আর চুপ থাকতে পারেনা। মামির উদ্দেশ্যে বলে,
—রাহিতা সত্যিই চিংড়ি খেতে পারেনা, মামি ৷ ওকে দিয়োনা। আমি একদিন না জেনে ওকে খাইয়েছিলাম তারপর এলার্জিতে খারাপ অবস্থা হয়েছিলো ওর। চিংড়ি ছাড়া বাকিসব খাবে তো, আমি দেখছি। তুমি যাও বাকিদের দেখো। এত কিছু ভেবোনা তো!

স্বপ্নিলের কথায় মাথা নাড়িয়ে রাজি হলেন মামি৷ চলে গেলেন অন্যদিকে খাবার সার্ভ করতে। এদিকে মামি যাওয়ার পর স্বপ্নিল নিজের প্লেটে খাবার নিলো। ফের মুরগির মাংসের হাড়ি থেকে ঝোলসহ মাংস নিয়ে রাহিতার প্লেটে তুলে দিলো৷ এতগুলো মাংস দেখে রাহিতা মানা করতে ধরবে এমন সময় স্বপ্নিলের চোখ পাকানো দেখে নাকমুখ কুচকে মুখে কলুপ আটে সে। সামনে থেকে ওদের আচরণ লক্ষ্য করে হাসছিলেন দিলারা বেগম, যে হাসি চোখ এড়ালোনা সীমা বেগমের। রাহিতার সাথে স্বপ্নিলের এমন আচরণ ও দিলারা বেগমের খুশি দেখে তার মনে সৃষ্টি হলো অনাকাঙ্ক্ষিত ইর্ষার জোয়ার! চোখভরা হিংসা নিয়ে মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি এঁকে খানিকটা উচ্চ স্বরে বললেন,

—আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে লজ্জাই নাই দেখছি। সবার সামনেই আদিক্ষ্যেতা শুরু করে দেয়। আশেপাশে বড়রা বসে আছে, তারা যে দেখছে এ বিষয়ে কোনো হুশজ্ঞান নেই! যত্তসব।
উনার কথায় খেতে থাকা হাত থেমে গেলো রাহিতার, এক মুহুর্ত তাকালো তাদের থেকে খানিকটা দূরে টেবিলের অপরপ্রান্তে বসা সীমা বেগমের দিকে। কথাটা যে তিনি পরোক্ষভাবে তাদের দুজনকে মিন করে বলেছেন বুঝতে অসুবিধা হলোনা তার!

অতঃপর চোখ ফিরিয়ে তাকালো নিজের পাশে বসা স্বপ্নিলের দিকে, যে আপাতত শক্ত চোয়ালে চুপচাপ খাবার ধরে আছে মুখে৷ স্বপ্নিলের রাগ সম্পর্কে ধারণা থাকায় রাহিতা বুঝলো এ মুহুর্তে ওকে থামানো উচিত নয়তো ভরা টেবিলে মানুষের সামনে একটা বিশ্রি ব্যাপার ঘটে যাবে। স্বপ্নিল কিছু বলবে তার আগেই ওর উরুতে বাম হাত রাখে রাহিতা। কিছুটা থেমে ডান পাশে তাকায় স্বপ্নিল। রাহিতার চোখের ইশারায় অনুনয়, কোনো সিন ক্রিয়েট করতে মানা করে বিনা ভাষায়। স্বপ্নিলের মন গলে।

মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই ফের চোখ পড়ে নিজের মায়ের দিকে। উনিও মাথা নাড়িয়ে কিছু বলতে নিষেধ করছেন ওকে। মনে মনে স্বপ্নিল খানিকটা বিরক্ত হয় মা ও রাহিতার উপর। কেন তারা ওকে থামাতে চাইছে সে বুঝেনা! তাদের তো কোনো দোষ নেই, তবু কেন তারা সব শুনবে? দ্বিধাগ্রস্ত স্বপ্নিল হতাশায় একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ধীরেসুস্থে নিজের খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে চলে যায়।

মায়ের সাথে সবাইকে খাবার সার্ভ করছিলো দীপ্ত। এরই মাঝে সে এসে হুট করে সীমা বেগমের পাতে গরুর মাংস তুলে দেয়। বলাবাহুল্য, উনার হাই কলেস্টেরল থাকায় তিনি বরাবর রেড মিট জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলেন। এ ব্যাপারে দীপ্তর মা জানতেন তাই তিনি তাকে মাছ, মুরগি ও অন্যান্য খাবার বেড়ে গেছেন। এ দীপ্তটা কোত্থেকে উড়ে এসে তার পাতে গরুর মাংস দিলো ভেবে পাননা সীমা বেগম, নিমিষেই বেজায় চটে যান দীপ্তর উপর। বাজখাই কণ্ঠে বলেন,

—এটা কি করলি, দীপ্ত? এত বড় দামড়া ছেলে হয়েছিস অথচ এ কান্ডজ্ঞান নেই যে হাই প্রেসারের রোগীকে গরুর মাংস খাওয়াতে চাস? এটা খেলে আমার কি অবস্থা হবে ভাবতে পারছিস একবারো?
—সরি, ফুপি। আমি ভুলেই গেছিলাম তোমার প্রেসারের কথা। কিন্তু একদিন খেলে কি-ই বা হবে? প্রেসার বাড়লে ওষুধ খেয়ে নিয়ো না হয় পরে?

—নিজে থেকে অসুখ বাধিয়ে তারপর ওষুধ খাবো? এই বুদ্ধি দিচ্ছিস আমায়? আশ্চর্য! নিয়ে যা এ খাবার, আমার খাওয়া হয়ে গেছে।
কথাগুলো বলতে বলতে টেবিল গুছিয়ে উঠছিলেন সীমা বেগম। এমন সময় টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে টেবিলে ফিরে আসে স্বপ্নিল। এক পলক সীমা বেগমের দিকে তাকিয়ে ফের দীপ্তর কাধে হাত দিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,

—মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী, বুঝেছিস রে দীপ্ত? অন্যের বেলায় যত ভুল খোজে আর নিজের বেলায় সব ষোলআনা! অন্যের অবস্থা ততক্ষণ বুঝেনা যতক্ষণ না নিজের সাথেও তেমন কিছু ঘটে!
স্বপ্নিলের কথার ভাজে লুকিয়ে থাকা পরোক্ষ খোটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা সীমা বেগমের। সরু চোখে স্বপ্নিলের দিক চেয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,

—তুই কি কথাটা আমাকে বললি, স্বপ্নিল? দিন দিন কি আদব-কায়দা সব শেষ হয়ে গেছে তোর মধ্যে?
উনার কথায় যেন ভারী অবাক হলো স্বপ্নিল, এমন ভংগীতে আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললো,
—যাহ বাবা, আমি আবার কি করলাম! আমি তোমায় কেন কিছু বলবো বলো তো, খালামনি? তুমি কি আমায় এমন কিছু বলেছিলে যে আমি তোমায় কথা শুনাবো? আমি তো দীপ্তকে জীবনের সত্যিটা উপলব্ধি করাচ্ছিলাম। তাই না রে, দীপ্ত?
—হ্যাঁ, স্বপ্নিল ভাই তো আমাকেই বলছিলো। তুমি কি ভাবলে, ফুপি?

স্বপ্নিল ও দীপ্তর কথায় গা জ্ব’লে গেলো সীমা বেগমের। কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে না থাকায় একা একাই গিজগিজ করতে করতে প্রস্থান করলেন সে স্থান হতে। এখন প্রায় ফাকা খাবার টেবিল, বাড়ির মানুষও তেমন নেই বললেই চলে। দিলারা বেগম ও রাহিতাও হাত ধুয়ে চলে এসেছেন ইতিমধ্যে। স্বপ্নিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে এক হাত ওর কান টেনে ধরলেন দিলারা বেগম। ছেলের দিকে চোখ পাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললেন,

—স্বভাব যাবেনা তোর, তাইনা? কেউ কিছু বললেই তাকে কথা শুনাতেই হবে?
—উফ, মা। কান ছাড়ো তো! বিয়েবাড়িতে কান ধরে আমার মানসম্মান রাখবেনা দেখছি। আরে বাবা, তোমরা সবাই এভাবে রিয়েক্ট করছো কেন? আমি কি খালামনিকে কিছু বলেছি?
স্বপ্নিলের অভিনয়ে হেসে ফেললেন দিলারা বেগম, একিসাথে হাসলো তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাহিতা। ছেলের কান ছেড়ে বাহুতে হালকা চাপড় মেরে মা বললেন,

—বদমাইশ একটা। তুই আর সুধরাবিনা কোনোদিন!
তারপর দীপ্তকে নিয়ে রওনা দিলেন স্বপ্নিলের মামির কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তাদের যেতে দেখে এতক্ষণ চুপ থাকা রাহিতাও চলতে নিচ্ছিলো পিছু পিছু। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই আঁচলে টান পড়ায় থেমে যায় সে। অবাক চোখে পেছনে ফিরতেই ওর দিকে এগিয়ে আসে স্বপ্নিল। আঁচল ছেড়ে এবার পাশে দাঁড়িয়ে রাহিতার হাত মুঠোয় নিয়ে ওর সাথে হাটতে আরম্ভ করে। এরই ফাঁকে ভ্রু নাচিয়ে সুধায়,

—একা একা কোথায় যাওয়া হচ্ছে, হুম?
—কোথাও না। আমি তো এমনিই হাটছিলাম।
—তাই নাকি?
—হু
বেশি কথা বলেনা রাহিতা। যেন আনমনেই কিছু একটা ভাবতে ব্যস্ত সে। খানিকক্ষণ ওকে পরখ করে স্বপ্নিল প্রশ্ন ছুড়ে,

—কি হয়েছে তোমার? কি ভাবছো এত?
—কিছু হয়নি তো। ভাবছিলাম যে…
—ভাবছিলে যে?
—ভাবছিলাম যে মা ঠিকই বলেছেন! আপনি আসলেই অনেক দুস্টু!
বলতে বলতেই মুখ টিপে হাসে রাহিতা। হাসির মাঝে লক্ষ্যই করলোনা ওর দিকে আড়চোখে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকা স্বপ্নিলকে! রাহিতার হাসি উবে যায় সামান্যক্ষণ বাদে যখন আচমকা স্বপ্নিল নিজের দিকে টেনে নেয় ওকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

—আচ্ছা? কিন্তু তোমার সাথে তো আমি কোনো দুস্টুমি করি-ই নি এখনো। তাহলে আগেই কিভাবে বুঝলে?
স্বপ্নিলের কথাটা বোধগম্য হতেই হঠাৎ থমকে যায় রাহিতা, মুহুর্তে বড় হয়ে আসে চোখ। গালের দুপাশে লালিমা ছড়িয়ে পড়ে নিজ দায়িত্বে! সেদিক তাকাতেই আরেকটু গাঢ় হয় স্বপ্নিলের নজর। রাহিতাকে লজ্জা দিতে আগের ন্যায় ফিসফিসিয়েই বলে,

মন বিনিময় পর্ব ২৮

—আরে, কি ব্যাপার? তোমার গাল হঠাৎ লাল হলো কেন? উল্টাপাল্টা কিছু ভাবলে নাকি, রাহি?
এবার আর নিতে পারেনা রাহিতা, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় স্বপ্নিলকে নিজের থেকে৷ দ্রুত কদমে চলে যেতে যেতেই বলে,
—আপনি আসলেই খারাপ! ধুর!
সামনে অগ্রসর হয় রাহিতা। হয়তো একবার পেছনে ফিরলে নজরে পড়তো তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা এক হাস্যোজ্জ্বল স্বপ্নিলকে!

মন বিনিময় পর্ব ৩০