মন বিনিময় পর্ব ৪২

মন বিনিময় পর্ব ৪২
তাসফিয়া হাসান তুরফা

রাহিতা রুমে ঢুকতেই বিছানায় শয়নরত স্বপ্নিলের দিকে চোখ গেলো সবার আগে। ডানহাত কপালের উপর আর বাম হাত বুকের উপর রেখে সে শুয়ে আছে শান্তভাবে। সেদিক চেয়েই রাহিতা হেটে গেলো বিছানার নিকট, আস্তে করে স্বপ্নিলের হাত সরিয়ে দিলো কপালের উপর থেকে। কিন্তু স্বপ্নিল চোখ খুললোনা, রাহিতা বুঝলো জার্নির ধকলে ও সারাদিনের ক্লান্তিতে খেয়েদেয়ে বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুম পেয়ে বসেছে জনাবকে।

এখন যে হাজারবার ডাকলেও সে উঠবেনা ঘণ্টা কয়েকের আগে, এটা রাহিতা ভালোভাবেই জানে। তাই স্বপ্নিলকে না ডেকে আলতোভাবে ওর কপালে হাতের উল্টোপিঠ ছুয়ে তাপমাত্রা পরখ করে সে। কপালটা এখনো গরম, ছেলেটা ওষুধ খেয়েছে কিনা কে জানে? সে তো ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই এসেছিলো কিন্তু এখন স্বপ্নিলকে জাগিয়ে তুলতে সায় দিচ্ছেনা মন৷ কিছুক্ষণ ভাবা শেষে রাহিতা হাল ছেড়ে দেয়। স্বপ্নিলের এখন একটা ভালো ঘুমের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাই এসির উপযুক্ত টেম্পারেচার সেট করে ওর গায়ে কাথা টেনে দিয়ে রুম ছেড়ে বের হয় রাহিতা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এরই মাঝে ওর মায়ের ফোন আসে। হাসিমুখে ফোন ধরে মায়ের সাথে কথা বলতে বলতেই নিচে নেমে যায় রাহিতা। কথাবার্তা শেষে সামিরার রুমে উকি দিয়ে দেখে সেও স্বপ্নিলের মতো কাথা মুড়ি দিয়ে উপর হয়ে ঘুমোচ্ছে। এরা ভাই-বোন দুটো একিরকম!

মনে মনে মুচকি হেসে ভাবে রাহিতা। অতঃপর রান্নাঘরে এসে রহিমা খালাকে চায়ের পানি বসাতে বলে। মূলত বিকেলের এ সময়টা কড়া লিকারের আদা মিশানো রং চা খেতে পছন্দ করে তার শাশুড়ি এটা রাহিতা জানে। খানিকবাদে চা বানানো শেষ করে কাপ হাতে নিয়ে সে চলে যায় দিলারা বেগমের নিকট। কি এমন কথা তিনি বলতে চাইছিলেন, জানার জন্য রাহিতার তর সয়না আর!

দিলারা বেগম নামাজ পড়ে উঠেছেন মাত্র। এমন সময় রাহিতাকে চায়ের কাপ হাতে রুমে প্রবেশ করতে দেখে সৌজন্যমূলক হাসলেন তিনি। কাপ নিতে নিতেই বললেন,

—স্বপ্নিল ওষুধ খেয়েছে?
—উনি ঘুমাচ্ছেন, মা। আমি রুমে ঢুকেই দেখি গভীর ঘুমে মত্ত তাই আর ডাকিনি পরে।
চায়ে ফু দিতে দিতে একবার চুমুক দিয়ে দিলারা বেগম মাথা নাড়িয়ে বললেন,
—এই ছেলেটাও না! এরকমই করবে। নির্ঘাত রাতে জ্বর আসবে ওর দেখিস। ছেলে-মেয়ে দুটোই হয়েছে একরকম, কথা বুঝবেনা আমার। শুধু পাকনামি!
রাহিতা হেসে ফেলে উনার কথা শুনে। ওর হাসি দেখে মৃদু হাসলেন দিলারা বেগম নিজেও। তিনি নিরবে চা খাওয়ার মাঝেই প্রসঙ্গ তুলতে রাহিতা সুযোগ বুঝে বলে,

—তারপর বলুন, মা। তখন কি যেন বলতে চাইছিলেন আমায়। রুমে আসতে বল্লেন যে কারণে?
রাহিতার প্রশ্নে এক মুহুর্তের জন্য থমকালেও ধীরেসুস্থে চা শেষ করেন দিলারা বেগম। রাহিতা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। কাপ টেবিলে রেখে রাহিতার কৌতুহলী চেহারার দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,
—স্বপ্নিল আর তোর মধ্যে সব ঠিক হয়েছে, রাহি?

হঠাৎ এমন প্রশ্নে রাহিতা চমকায়। সত্যি বলতে সে ভাবেনি দিলারা বেগম এমন কিছু জিজ্ঞেস করবেন। নিজের বিস্মিত ভাব না ঢেকেই সে হালকা অবাক হওয়া গলায় প্রশ্ন করে,
—হঠাৎ এ প্রশ্ন করছেন যে, মা? আমাদের মধ্যে আবার কি হবে?
—না মানে বলছিলাম, স্বপ্নিল তো তোকে মন থেকে মেনে নিয়েছে তাই না?
রাহিতা এবার চমকালেও খেই হারায়না। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে উত্তর দেয়,

—হ্যাঁ। কিন্তু মা, এটা তো আপনি জানেনই। আপনাকে বলেছিলাম না আমি?
দিলারা বেগম প্রত্যুত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
—আমি জানি সবটাই। কিন্তু আমার জিজ্ঞেস করার পেছনে একটা কারণ আছে। তোর কাছে লুকিয়ে তো লাভ নেই। তাই যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনবি ও উত্তর দিবি। কেমন?
—ঠিক আছে।

—স্বপ্নিলের চলে যাওয়ার পর থেকে আমি খেয়াল করছি তোরা একে-অপরের সাথে আগেকার মতো কথা বলিস না। এমনকি ফিরে আসার পরেও তোদের দুজনের মধ্যে আগেকার সেই টান আমি খেয়াল করিনি। যেন একপ্রকার এড়িয়ে চলছিস তোরা দুজন একজন আরেকজনকে৷ এমনটাই মনে হয়েছে আমার কাছে। কিন্তু কারণটা কোনোভাবেই ধরতে পারলাম না! স্বপ্নিলের চেয়ে বেশি আমি তোর কাছে আশাবাদী এ সম্পর্ক নিয়ে তাই তোকেই ডেকে জিজ্ঞেস করছি। তোদের দুজনের মধ্যে আবার কোনো বড়সড় ঝামেলা হয়নি তো, রাহি? বিষয়টা নিয়ে আমি বেশ অনেকদিন থেকেই দুশ্চিন্তায় ভুগছি। কিচ্ছু লুকোস না এখন আমার থেকে। সব সত্যি করে বল তো আমায়!

এক শ্বাসে এতকিছু জিজ্ঞেস করে থেমে যান দিলারা বেগম। এদিকে শাশুড়ির মুখে এসব শুনে আকাশ থেকে পড়ে রাহিতা! মানুষ তিল কে তাল বানায় সে এতদিন শুনে এসেছিলো, এদিকে দিলারা বেগম নিজেও যে সেটা করে বসে আছেন। আজ সচক্ষে দেখেও নিলো! কিন্তু কিভাবে শাশুড়ির ভুল ধারণা ভাংবে রাহিতা ভেবে পেলোনা। যতই তিনি বলুক সবকিছু তাকে খুলে বলতে, তাই বলে আর স্বামী-স্ত্রীর ভেতরের সব কথা অন্য কাউকে তো বলা যায়না তাইনা! এ তো ভারী চিন্তার বিষয়!
স্তব্ধ রাহিতা নিজ ভাবনায় বিভোর থাকার মাঝেই দিলারা বেগম ওর হাত আকড়ে ধরেন। রাহিতার চিন্তাভরা চোখের দিক চেয়ে করুণ চোখে কম্পিত কণ্ঠে বললেন,

—কখনো ভাবিনি তোকে এ কথাটা বলবো। কিন্তু তুই যখন এতই দ্বিধা করছিস আমাকে বলতে তখন তোকে আশ্বাস দিতে এটুকু বলতে বাধ্য হচ্ছি আজ!
—ম,মানে?
রাহিতার গলা কাপে। শাশুড়ির চেহারার কাঠিন্য ও কণ্ঠের দৃঢ়তা দেখে তার বুক কাপে। এমন সময় দিলারা বেগম পুনরায় বলেন,

—তোর মনে আছে, রাহি? যখন তুই প্রথমবার আমার কাছে বিচার দিতে আসিস যে কেন আমি তোকে সবকিছু না বলেই তোর সাথে স্বপ্নিলের বিয়ে দিয়েছি? কেন তোকে অন্ধকারে রেখেছি, তোর সাথে অন্যায় করেছি। তখন আমি তোকে একটা কথা বলেছিলাম। একটা ওয়াদা করেছিলাম তোর কাছে?
পুরনো দিনগুলো স্মৃতি চারণ করে ঘোলা চোখে রাহিতা আস্তে-ধীরে মাথা নাড়তেই দিলারা বেগম বড়সড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

—আমি বলেছিলাম তোর যদি ভবিষ্যতে কখনো মনে হয় স্বপ্নিল তোকে স্ত্রী হিসেবে সম্পূর্ণ অধিকার দিচ্ছেনা বা তোর প্রতি অবহেলা করছে, তোকে ভালোবাসতে পারছেনা তবে তুই চাইলে আমি স্বেচ্ছায় তোদের দুজনকে আলাদা করে দিবো। বেশ ক’দিন ধরে তোদের মধ্যে যা দেখছি তাতে আমি প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি, এখন কি সে সময় এসে গেছে?
—মা..!

রাহিতা স্তব্ধ বনে যায়! দিলারা বেগম যে হঠাৎ করে ওকে ডেকে এনে এমন কথা বলবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি মোটেও! স্বপ্নিল যে এখন ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে, রাহিতা জানে। স্বপ্নিল মুখে না বললেও ও অনুভব করতে পারে। এমতাবস্থায় শাশুড়ির মুখে আলাদা হওয়ার কথা শুনে রাহিতার মাথা ঘুরায়। তবু চোখমুখ শক্ত করে নিজেকে সামলায়। গলার স্বর যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেস্টা করে বলে,

—আমি উনাকে ছাড়তে চাইনা, মা। যদি ছাড়ার হতো তবে তখনি ছেড়ে যেতাম যখন তিনি আমায় মেনে নেননি। এখন হঠাৎ করে এটার প্রশ্ন কিভাবে উঠলো? আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা আপনি এ কথা বলছেন। যে আপনি আমাদের দুজনকে এক করেছেন তিনি এ কথা বলছেন! এটা আমি কোনোভাবেই মানতে পারছিনা, মা!

রাহিতার কথায় দিলারা বেগম মাথা নোয়ান। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠে তার। তার মনে হলো রাহিতা মেয়েটা একটু বেশিই ভালো, স্বপ্নিলকে মন থেকে ভালোবাসে৷ তাই তো ওর পক্ষ থেকে এত অবহেলা পেয়েও ওর সাথেই থাকতে চাইছেন! দিলারা বেগমের বিশ্বাস ছিলো তার স্বপ্নিলের পাগলাটে ভালোবাসা দিয়ে রাহিতার শুরুর দিকের আক্ষেপ মিটে যাবে। স্বপ্নিল রাহিতা সেভাবেই ভালোবাসবে, ওর জন্য ততটাই পাগল হবে যতটা আনিকার জন্য ছিলো। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে তার ধারণা হয়তো ভুল ছিলো। তার ছেলে রাহিতার যোগ্য-ই নয়। কেননা সে পারেনি রাহিতাকে ভালোবাসতে, যেভাবে রাহিতা ওকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে।

মন বিনিময় পর্ব ৪১

রাহিতার দিক তাকিয়ে মনে মনে অনেকক্ষণ চিন্তাভাবনা করেন দিলারা বেগম।
এভাবেই তিনি রাহিতার সাথে দুজনের বৈবাহিক জীবনের আরও কিছু খুটিনাটি বিষয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আলোচনা করেন, রাহিতার সকল কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনেন। দুজনের দুপাক্ষিক কথার সাক্ষী হয় নিশ্চুপ কক্ষের বাকহীন দেয়াল।
অতঃপর রাহিতার অগোচরেই মনে মনে এক ফন্দি আঁটেন দিলারা বেগম।

মন বিনিময় পর্ব ৪৩