মহাপ্রয়াণ পর্ব ১১+১২

মহাপ্রয়াণ পর্ব ১১+১২
নাফিসা তাবাসসুম খান

কাস্টোরিয়ায় আসার পর থেকেই রাতে ঠিকঠাক ঘুমোতে পারছে না আনাস্তাসিয়া। সারাদিন গ্র্যানি ও লিয়ামের সাথে পার করলেও রাতে ঘুমোতে আসলে একাকিত্ব তাকে গ্রাস করে ফেলে। কখনো কখনো ঘুমোতে খুব দেরি হয়ে যায় আবার কখনো কখনো সারারাত জেগে বসে থাকে। শুয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে উঠে বসে সে। চোখ পড়ে কক্ষের এক কোণায় রাখা আয়নার উপর। আয়নার একপাশে ঝুলে আছে একটি কালো কাপড়। এটিই সেই কাপড় যেটা রিকার্ডোর সাথে শেষ সাক্ষাৎের পর সে ভুল করে নিয়ে এসেছিলো।

কিছুক্ষণ এই পানে তাকিয়ে থেকে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে আনাস্তাসিয়া। আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে পরখ করে নেয়। হালকা সবুজ রঙের নাইট গাউন পড়ে আছে সে। কিছু একটা ভেবে কক্ষের কয়েকটা মোম সে ফু দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে আবার আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে আয়নার একপাশে অগোছালো ভাবে ঝুলে থাকা কালো কাপড়টা নেয়। পরপরই রিকার্ডোর মতো সেই কাপড়টা শরীরে জড়িয়ে রিকার্ডোর মতো মুখ ঢাকার চেষ্টা করে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উহু। হচ্ছে না রিকার্ডোর মতো। বিরক্ত হয় আনাস্তাসিয়া। আবার চেষ্টা করে। আবারও ব্যর্থ হয়। কাপড়টা শরীর থেকে সড়িয়ে ফেলতে নেয় আনাস্তাসিয়া কিন্তু হঠাৎ একটা গন্ধ তার নাকে অনুভব করে সে। গন্ধটা এই কালো কাপড় থেকেই আসছে কিন্তু গন্ধটা কিসের তা সে ঠাওর করতে পারছে না। আনাস্তাসিয়া গায়ে জোড়ানো কাপড়টা নাকের কাছে নিয়ে আরেকবার গন্ধ নেয়। তার মন ও মস্তিষ্কে রিকার্ডো নামের ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। সবুজ নেত্র পল্লবের সেই সুদর্শন যুবককে যে আনাস্তাসিয়া গত কয়েকদিনে ভুলে গিয়েছে তেমনটা নয়। বরং এক মুহূর্তের জন্যও তাকে ভুলতে পারছে না সে। আয়নায় আরেকবার নিজেকে দেখে নিয়ে আনাস্তাসিয়া অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,
” রিক। ”

ক্রিয়াস বিরক্তিতে মুখ কালো করে নিজের কামরায় বসে আছে। গতকাল রাতেই আরোণ তাকে খুব শাসিয়েছে। তার উপর শুধু কিছু ছুড়ে মারা বাকি ছিলো। খবর নিয়ে জানতে পেরেছে ক্যাথরিনের কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর থেকেই এতো রেগে আছে আলফা। প্রথমত সে এটা ভালো করেই লক্ষ্য করছে যখন থেকে এই ক্যাথরিন এসেছে আলফার মাঝেও খুব পরিবর্তন এসেছে। ক্যাথরিনের উপর আলফার মেজাজ নির্ভর করছে৷ আবার আলফা যতই বলুক ক্যাথরিন তার শিকার তাকে মেরে ফেলবে এমন কোনো লক্ষণ ক্রিয়াস দেখছে না। কারণ যদি মেরে ফেলারই হতো আরোণ প্রথম দর্শনেই ক্যাথরিনকে মেরে ফেলতো। এসব লক্ষণ ক্রিয়াসের কাছে মোটেও ভালো ঠেকছে না। তাদের আলফা কি দূর্বল হয়ে পড়ছে? তাও কোনো মানবীর উপর?

গতরাতে আরোণের দেওয়া গোপন দায়িত্ব পালনের জন্য ক্রিয়াসকে এখনই বের হতে হবে। কিন্তু সে আরোণের জন্যও চিন্তা করছে। আরোণ সকল নেকড়েদের মাঝে সর্বশক্তিমান তা অজানা নয় কারো। কিন্তু ক্যাথরিনের প্রতি আরোণের নিষিদ্ধ এই অনুভূতি যে কতোটা ভয়ংকর আর সর্বনাশা হয়ে দাঁড়াবে তা ভালো করেই জানে ক্রিয়াস। এই অনুভূতির একমাত্র পরিণতি দগ্ধ হয়ে নিঃশেষ হওয়া। এসব ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্রিয়াস কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে গোপন অভিযানে।

বারান্দার শক্ত পরিপক্ক রেলিঙে দুহাত রেখে দাঁড়িয়ে ক্রিয়াসের প্রস্থানের দৃশ্য দেখছে আরোণ। এই একজনের উপরই সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে আরোণ। বাকি সবাই তাকে ক্ষমতাধর হিসেবে মান্য করলেও ক্রিয়াস তাকে সম্পূর্ণ মন থেকে মান্য করে তা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত সে। যদিও এই কাজের জন্য সে নিজেই যেত কিন্তু ক্যাথরিনকে একা ফেলে যাওয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এভাবেই ক্যাথরিন যথেষ্ট দূর্বল হয়ে পড়েছে। নিজেকে রক্ষা করার মতো বিন্দুমাত্র শক্তিও তার মাঝে অবশিষ্ট নেই। এই অবস্থায় বিপদ আশংকার মাঝে তাকে কারো ভরসায় রেখে যেতে পারে নি আরোণ।
তার ভাবনায় ফোড়ন কাটে দরজার কড়া নাড়ার শব্দে। পিছনে না ফিরেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে বলে,

” প্রবেশ করো। ”
মার্থা মাথা নত করে কক্ষে প্রবেশ করে। কুশল জানায়। আরোণ প্রশ্ন করে,
” কি সমস্যা হয়েছে মার্থা? ”
মার্থা আমতা আমতা করে বলে,
” আলফা কাল রাত আপনি আমাকে ক্যাথরিনের কক্ষে পাঠানোর পর থেকে আমি ওর সাথেই আছি। শেষ রাতে হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে যার ফলস্বরূপ আবার জ্বর জেঁকে ধরেছে ওকে। সকালে নাস্তা নিয়ে গেলাম সেটাও ফেলে দিলো। এরকম চললে তো ও দূর্বলতার ফলেই মারা যাবে। ”
আরোণ বলে,
” তুমি যেতে পারো এখন মার্থা। খাবার তৈরি করে নিয়ে আসো আবার। আমি দেখছি। ”
মার্থা মাথা নত করে কক্ষ থেকে বেড়িয়ে যায়।

লেকের পাশে থাকা মাল্টা গাছের সাথে হেলান দিয়ে পাথরের উপর বসে আছে আনাস্তাসিয়া। তার কোলে একটি আধা খোলা বই। হালকা কমলা রঙের গাউনের উপর আজকে ক্লকের বদলে একটি ছাই রঙা শাল জড়িয়েছে শরীরে। সেদিন ওরিয়নের বাসা থেকে ফিরার সময় ওরিয়ন এই বইটা ওকে দিয়েছে। বলেছে পুরোটা একবার পড়তে এবং এই বই সম্পর্কে ভুলেও কাউকে না জানাতে। এটাকে বই কম ডায়েরি বেশি বলা যায়। ওরিয়নের থেকে জানতে পেরেছে যে এটা আজ থেকে ১০০ শতাধিক বছর আগে লেখা হয়েছে। এতো প্রাচীন একটা ডায়েরি অথচ যত্নের ফলে এখনো এর মাঝে সেই প্রাচীনত্বের ভাব পুরোপুরি ফুটে উঠেনি।

আনাস্তাসিয়া সম্পূর্ণ ডায়েরি পড়া শেষ করেছে বেশ ক্ষাণিকক্ষণ আগেই। আপাতত তার মস্তিষ্ক এটা বুঝার চেষ্টা করছে যে যা কিছু এই ডায়েরিতে লেখা আছে তা কি আদৌ সম্ভব। এরকম কোনো স্বত্তার অস্তিত্ব আদৌ পৃথিবীতে আছে? তার মনে পড়ে যায় সেই রাতের কথা যে রাতে সে নিজের মা,বাবাকে ও ক্যাথরিনকে হারায় সেই জঙ্গলে। সেদিন রাতে শেষ যখন ক্যাথরিনকে সে দেখেছিলো তখন সেখানে রক্তিম চোখের ও প্রবল বেগের অধিকারী একটি লোকও ছিলো ক্যাথরিনের সাথে। তবে কি সেই লোকটি ভ্যাম্পায়ার ছিলো? এই ডায়েরিতে লেখা আছে ভ্যাম্পায়াররা চাইলে বাতাসের মতো প্রবল বেগে চলাফেরা করতে পারে। আবার তাদের রক্ত পিপাসা পেলে তাদের চোখের সাধারণ রঙ পরিবর্তিত হয়ে উজ্জ্বলরূপ ধারণ করে।

এখন সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্ব আছে। তাদের মাঝেই হয়তো সাধারণ মানুষের বেশ ধরে ঘুরে বেরাচ্ছে। সুযোগ বুঝে নিরপরাধ মানুষের রক্তে নিজেদের পিপাসা মিটিয়ে নিচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই আনাস্তাসিয়া রাগে ডায়েরি বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। ফিরে যাওয়ার জন্য পিছনে ফিরতেই দেখে কালো কাপড় দ্বারা অর্ধেক মুখশ্রী ঢাকা একজন পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে কাউকে দেখে কিছুটা ভরকে যায় আনাস্তাসিয়া। কিন্তু তার চোখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারে এটা রিকার্ডো। নিজের বুকে ফু দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রিকার্ডোকে প্রশ্ন করে,

” তুমি কি সবসময় এভাবেই সব জায়গায় হুটহাট উদয় হতে বেশি ভালবাসো? ”
রিকার্ডো হালকা হেসে পালটা প্রশ্ন করে,
” তুমি কি সবসময় একা আমার অপেক্ষায় থাকতে বেশি ভালবাসো? ”
আনাস্তাসিয়া কিছুটা রেগে বলে,
” প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করতে খুব ভালবাসো তুমি? ”
” ভালো তো আমি কোনো কিছুকেই বাসি না। তাই তোমার প্রশ্নের উত্তর না হিসেবে ধরে নিতে পারো তুমি। ”
আনাস্তাসিয়ার চোখ কুচকে আসে। শালটা টেনে আরেকটু পেচিয়ে নেয় শরীরে। রিকার্ডোর চোখে সরাসরি চোখ রেখে প্রশ্ন করে,

” এটা কিভাবে সম্ভব? তোমার পরিবারে কাউকেই তুমি ভালবাসো না? ”
” ভালোবাসার জন্য নিজের পরিবার নেই আমার। ”
বিস্মিত ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে আনাস্তাসিয়া। রিকার্ডোর মধ্যে তেমন কোনো হেলদোল দেখা গেল না। সে উত্তর দিয়ে গাছের সাথে হেলান দিয়ে পাথরের উপর বসে পড়ে। আনাস্তাসিয়া কিছুটা আবেগি হয়ে পড়ে। নিজ থেকেই বলে,
” আমি দুঃখিত। আমি না বুঝে এই প্রশ্ন করে বসেছি। ”

” দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আর এখানে একা বসে আকাশকুসুম ভাবনা ছাড়া আর কিছু করো না তুমি? ”
আনাস্তাসিয়া বুঝতে পারে রিকার্ডো প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই সেও নিজ থেকে আর এ বিষয়ে কোনো কথা বলে না আগ বাড়িয়ে। রিকার্ডোর থেকে কিছুটা দূরে আরেকটা পাথরের কাছে গিয়ে হাতের সাহায্যে সেটার উপর থেকে বরফ গুলো সরিয়ে রিকার্ডোর মুখোমুখি বসে পড়ে। এখানে লেকের পাশে এরকম অসংখ্য ছোট বড় সাদা পাথর ছড়িয়ে আছে। আনাস্তাসিয়া গালে হাত রেখে লেকের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে বলে,
” আকাশকুসুম ভাবছিলাম না। একান্ত সময় কাটানোর জন্য এই জায়গাটা আমার বেশ প্রিয়। বরফে ঘেরা চারিদিকের মাঝে গোধূলি লগ্নে লেকটার সৌন্দর্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। বসন্ত আসলে নিশ্চয়ই এখানের সৌন্দর্য অন্যরকম রূপধারণ করবে। ”

” তুমি এখানে থাকলে এই জায়গার সৌন্দর্য কখনোই স্লান হবে না। ”
আনাস্তাসিয়া সাথে সাথে রিকার্ডোর চোখের দিকে তাকায়। মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিকার্ডো। আনাস্তাসিয়া বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না সেই সবুজ নেত্রপল্লবের দিকে। চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। শাল গায়ে টেনে উঠে দাঁড়াতে নিয়ে লক্ষ্য করে সেই ক্রুশের হারটি তার গলায় নেই। আনাস্তাসিয়া বিচলিত হয়ে আশেপাশে সেই হারটি খোঁজা শুরু করে বরফের মাঝে। রিকার্ডো প্রশ্ন করে,
” কি খুঁজছো? ”
” আমার হার। আমার গলায় ছিলো। এখন পাচ্ছি না। ”
এটা বলেই আবার খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আনাস্তাসিয়া। রিকার্ডো উঠে আনাস্তাসিয়ার দিকে এগোতে এগোতে বলে,
” কি এমন আছে সেই হারে যে সেটা তোমার জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ? ”
” আমার গ্র্যানি আমাকে দিয়েছে সেটা। বলেছে সবসময় গলায় যেন থাকে। ক্রুশের হার গলায় থাকলে বিপদ আমার থেকে দূরে থাকবে। ”

চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রিকার্ডোর। মুখের হাসি উবে যায়। এগোতে এগোতে সে আনাস্তাসিয়ার পিছনে এসে দাঁড়ায়। তার কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে বলে,
” তুমি বিশ্বাস করো যে একটা সামান্য হার তোমাকে বিপদ থেকে বাঁচাতে সক্ষম? ”
” অবশ্যই। ফাদার বলে ক্রুশ সকল ধরনের অশুভ শক্তিকে দূরে রাখতে সক্ষম। ”
রিকার্ডো কণ্ঠ আরো খাদে নামিয়ে প্রশ্ন করে,
” তারমানে যেহেতু এখন তোমার সাথে ক্রুশ নেই যেকোনো অশুভ শক্তি তোমার কাছে আসতে পারবে? ”
আনাস্তাসিয়া থমকে যায়৷ হালকা ভয় হয় তার। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকাতে নেয়। কিন্তু তার আগেই রিকার্ডো তার কানের কাছে বলে,

” হুসস। পিছনে ফিরো না। ”
আনাস্তাসিয়া ভয়ে জমে যায়। সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ হলো। গ্র্যানি নিশ্চয়ই চিন্তা করছে খুব। আর রিকার্ডোর হঠাৎ কি হলো? এতো কাছে এসে এসব অদ্ভুত কথা কেন বলছে? রিকার্ডো আবার বলে,
” ধরে নাও সেই অশুভ শক্তি আমিই। কি করবে এখন আমার থেকে বাঁচতে? ”
আনাস্তাসিয়া চুপ করে রয়৷ চোখ বন্ধ করে জোরে একটি নিশ্বাস নেয়। শালের ভেতর গাউনের উপর পড়া বেল্টের বাধন থেকে একটি ছুড়ি বের করে তৎক্ষণাৎ পিছনে ফিরে আক্রমণ করে বসে৷ রিকার্ডোকে গাছের সাথে ঠেক দিয়ে তার গলায় ছুড়ি ধরে আনাস্তাসিয়া বলে,

” নিজেকে রক্ষা করার জন্য যা প্রয়োজন তাই করবো। ”
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার চোখে চোখ রেখে দেখে এখনো সে বেশ ভীত। রিকার্ডো বলে,
” নিজেকে রক্ষা করার জন্য আগে তোমার আরো প্রশিক্ষণ দরকার। ছুড়ি চালানোর আগে যে মেয়ে দ্বিতীয় বার ভাবে সে কখনোই নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম না। আর তাছাড়া নিজের শত্রুর দূর্বলতা না জেনে তার উপর আক্রমণ করা সবথেকে বড় বোকামি। ”

আনাস্তাসিয়া কিঞ্চিৎ অপমানিত হয়। চোখেমুখে তার বিরক্তি ফুটে উঠে। রিকার্ডো নিজেই আবার বলে,
” সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো তোমার সামান্য এই ছুড়িতে আমাকে মারার মতো ধার নেই। ”
আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর গলা থেকে ছুড়ি সরিয়ে ফেলে। দু কদম পিছিয়ে যায়। মাথা উপর নিচে নাড়িয়ে বলে,
” ঠিক বলেছো তুমি। আমার ছুড়িতে হয়তো তোমাকে মারার মতো যথেষ্ট ধার নেই৷ ”

এই বলে আনাস্তাসিয়া পিছনে ফিরে যায়। দু কদম সামনে এগিয়ে আবার থমকে যায়। রিকার্ডো কিছু বুঝে উঠার আগেই পিছনে ফিরে রিকার্ডোর দিকে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে আসে সে। এবার সে ঠিকি ছুড়ি চালায় রিকার্ডোর চোখে চোখ রেখে। রিকার্ডো বিস্মিত ও হততম্ভ হয়ে পড়ে। পাশে ফিরে তাকায়। তার থেকে মাত্র চার ইঞ্চি দূরত্বে তার পিছনে থাকা কাঠগাছে আনাস্তাসিয়া ছুড়ি চালিয়েছে। চোখ ফিরিয়ে আবার সামনে আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকায় সে। এখন আর সেই চোখে কোনো ভয় দেখতে পায় না সে। আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর পিছনে থাকা গাছের সাথে নিজের একহাত ঠেক দিয়ে পা সামান্য উঁচু করে রিকার্ডোর সমান হওয়ার চেষ্টা করে। রিকার্ডো প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে আনাস্তাসিয়া বলে,

” কিন্তু পরের বার যখন এই ছুড়ি চালাবো তখন এই গাছের জায়গায় আমার নিশানা হবে তোমার বুক এবং আমার ছুড়িতে যথেষ্ট ধার থাকবে। ”
হততম্ভ ও বিস্ময়ে বিমূঢ় রিকার্ডোকে সেখানে রেখেই আনাস্তাসিয়া এগিয়ে পাথরের উপর থেকে ডায়েরিটা নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। রিকার্ডো আরেকবার পাশ ফিরে ছুড়িটার দিকে তাকায়।

জানালার কাঁচ ভেদ করে বাহিরের তুষারপাত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রিকার্ডো। কাস্টোরিয়ায় শীতকাল প্রায় শেষ হয়ে এলো। হয়তো এটাই বছরের শেষ তুষারপাত। ধীরে ধীরে বসন্তের আগমন ঘটবে। পরশু নাগাদই সে রোমানিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। ম্যাথিউও তার সাথে ফিরে যাবে। ব্যস এর আগে আর কোনো ভুল না করে বসুক সে। রিকার্ডো বারবার করে বলে দিয়েছে ম্যাথিউকে যেন পশু শিকার করে জঙ্গলে। যদিও ম্যাথিউ তার কথা শুনবে সেই আশা করাটাও বোকামি। তবুও রিকার্ডো চাচ্ছেনা এখান থেকে যাওয়ার আগে নতুন কোনো ঝামেলা হোক। বাহিরের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলো সে। যাওয়ার আগে শেষ একটা কাজ বাকি। হাতে থাকা কাগজের দিকে তাকায় সে একবার। রোমানিয়ায় ফিরে যাওয়ার আগে এই চিঠিও নিজ গন্তব্যে পাঠাতে হবে তার। চিঠিটা ভাজ করে প্যান্টের পকেটে রেখে দেয় সে। আবার বাহিরের দিকে দৃষ্টিপাত করে সে। যেই উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলো তা সফল হয় নি। কিন্ত এখানে এসে তার গন্তব্যে বিঘ্ন অবশ্যই এসেছে। আনাস্তাসিয়া। এই মেয়েটি তার গন্তব্যে কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আর নয়। একবার রোমানিয়ায় ফিরে গেলেই সে এখানকার সম্পৃক্ত সকল স্মৃতি মুছে ফেলবে মস্তিষ্ক হতে।

বারান্দার সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি মেঝেতে বসে আছে ক্যাথরিন। পিছনে থাকা দেয়ালের সাথে পিঠ হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে সে। এই কনকনে শীতেও শরীরে শুধু পাতলা গোলাপি রঙের কাপড়ের একটা গাউন পড়ে আছে সে। কক্ষ হতে লণ্ঠনে জ্বলিত আগুনের আলোর বিকিরণ বারান্দায়ও এসে পৌঁছেছে সামান্য। মৃদু বাতাসে শীত যেন আরো বেশি অনুভব হচ্ছে। ক্যাথরিনের সামনেই হাটু গেড়ে বসে আছে আরোণ। গত বেশ কিছুদিন ধরেই ক্যাথরিন এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। সারাদিন চুপচাপ থাকে, খাবার নিয়ে আসলে খায়না নাহয় ফেলে দেয় রাগ দেখিয়ে আবার এই হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডার মাঝে বারান্দায় এসে বসে থাকে গায়ে কোনো শীতবস্ত্র না পড়েই। আরোণের মনটা পুড়ছে ক্যাথরিনের এহেন আচরণে।

” নিজেকে শাস্তি দিয়ে কি শান্তি পাচ্ছো তুমি? কেন করছো এমন? ”
আরোণ করুণ কণ্ঠে বলে। ক্যাথরিনের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। আগের মতোই চোখ বন্ধ করে আছে সে।
” আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করো ক্যাথ। ভিতরে চলো। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে পরে সেটা তোমারই পছন্দ হবে না। ”
ক্যাথরিন এবার চোখ মেলে তাকায় আরোণের দিকে। মাথা সোজা করে বসে সে। সামান্য সামনে এগিয়ে প্রশ্ন করে,
” তোমার ধৈর্য্য? কি করবে তুমি? কি বাকি রয়ে গেছে তোমার করার? ”
” আমাকে অযথা রাগিয়ে তুলো না। চুপচাপ ভিতরে চলো। ”
” তোমার মতো জানোয়ার, খুনি, অমানুষ, পিশাচের সাথে একই প্রাসাদে একই ছাদের নিচে থাকার চেয়ে মৃত্যু অধিক শ্রেয়। ”

আরোণের চোখ দুটি মুহূর্তেই জ্বলে উঠে। ক্যাথরিন তা লক্ষ্য করে আবার বলে,
” তোমাকে দেখলেই আমার গা গুলিয়ে আসে। মনে পড়ে যায় তুমি আমার মা বাবার খুনী। না জানি কত হাজার মানুষের খুনের রক্ত তোমার হাতে লেপ্টে আছে। এসব ভাবলেই তোমার প্রতি এক কৃষ্ণ সাগর সমতুল্য গভীর ঘৃণা নিজের হৃদয়ে অনুভব করি। ”

এতো ঠান্ডার মাঝেও আরোণের মনে হচ্ছে তার শরীরে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তার মন অশান্ত হয়ে পড়ে। আগে তো ক্যাথরিনের এসব ধারালো কথায় তার কিছুই অনুভব হতো না। তবে এখন কেন এতো কষ্ট হচ্ছে এটা জেনে যে ক্যাথরিন তাকে কি পরিমাণ ঘৃণা করে। সে তো সবসময়ই এটা জানতো যে ক্যাথরিনের মনে তার জন্য ঘৃণা ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতির জায়গা নেই। এখানে আর ক্যাথরিনের সামনে থাকতে পারবে না সে। আজ রাতে সে শিকারে বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু তার আগে ক্যাথরিনকে ভিতরে নিয়ে যেতে হবে। এখানে বসে থাকলে ঠান্ডায় জমেই মরে যাবে এই নির্বোধ মেয়ে।
আরোণ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ক্যাথরিনকে পাজাকোলে তুলে কক্ষের দিকে অগ্রসর হয়। ক্যাথরিন আপত্তি না করায় কিছুটা অবাক হয় প্রথমে। কিন্তু তাকে আরো অবাক করে দিয়ে ক্যাথরিন নিজের দু’হাতে তার ঘাড় জড়িয়ে ধরে বলে,

” তুমি বারান্দায় প্রশ্ন করেছিলে না যে নিজেকে শাস্তি দিয়ে কি শান্তি পাচ্ছি আমি? ”
আরোণ হাঁটা থামিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় ক্যাথরিনের দিকে। ক্যাথরিন বলে,
” আমি নিজেকে না তোমাকে শাস্তি দিয়ে শান্তি পাচ্ছি। ”
আরোণের ভ্রু জোড়া এবার আরো কুচকে আসে। ক্যাথরিন স্মিত হেসে বলে,
” সমগ্র নেকড়ে পালের আলফা আরোণ রদ্রিগেজ। যার মনে দয়া, মায়া এবং মনুষ্যত্বের ছিটেফোঁটাও নেই সেই আরোণ কিনা শেষমেশ একজন তুচ্ছ মেয়ে মানুষকে মন দিয়ে বসলো? ”
আরোণ এবার অবাক হওয়ার চূড়ান্ত সীমান্তে পৌঁছায়। মনে মনে ভয় পেলেও বাহিরে তা প্রকাশ করে না। গলার স্বর উল্টো কঠিন করে বলে,

” কি যা তা বকছো? ”
” কেন বাসো না ভালো আমাকে? ”
” নিজের ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত তোমার। ”
” নিজের দূর্বলতা লুকানোর চেষ্টা করছো আমার থেকে? নাকি ভয় পাচ্ছো পাছে আমি আবার তোমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে তোমাকে মেরে পালাই কিনা? ”
” তুমি এবং তোমার ধারণা উভয়ই ভুল। ”
এই বলে আরোণ এগিয়ে গিয়ে ক্যাথরিনকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে উল্টো দিকে ফিরে দাঁড়ায়। ক্যাথরিন পিছন থেকে বলে,

” তোমার জীবনেও অপূর্ণতা রয়ে যাবে। যেভাবে তুমি আমাকে আমার পরিবার থেকে বঞ্চিত করেছ ঠিক একইভাবে তুমিও পুরো জীবন ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত থাকবে। তুমি যেমন আমার জীবনের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছ তেমনই ভাবে এই ভালোবাসাও তোমার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। নিঃস্ব হবে তুমি। ”
আরোণের মনে হয় তার গলায় কোনো বিষাক্ত কাঁটা আঁটকে আছে। তার সকল কথা গলায় এসে দলা পাকিয়ে যায়। কোনমতে পিছনে ফিরে ক্যাথরিনের দিকে এগিয়ে যায়। ক্যাথরিনের পায়ের কাছে থাকা চাদরটা টেনে তার শরীরে দিয়ে মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে ক্যাথরিনের চোখে চোখ রেখে বলে,
” এই প্রাসাদে দেয়ালেরও কান আছে। পরে আবার যেন এমন না হয়, তোমার এই ভুল ধারণা অন্য কেউ জেনে আমার সাথে শত্রুতার হিসাব মেটাতে তোমাকে বেছে নেয়। ”
এইটুকু বলেই আরোণ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আবার বলে,

” আর আমার নিঃস্ব হওয়ার মতো নতুন কিছু নেই। নিঃস্ব হওয়ার বদৌলতেই আমার সত্তা তোমার থেকে আলাদা। ”
এতটুকু বলে আরোণ এগিয়ে গিয়ে ক্যাথরিনের বারান্দার দরজার লাগিয়ে দিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে চলে যায়। ক্যাথরিন বিছানায় একা বসে রয়। চাঁদরটা আরেকটু টেনে ভালো করে শরীরে পেচিয়ে নেয়। এতক্ষণ বাহিরে ঠান্ডায় বসে থেকে তার মনে হচ্ছিলো সারা শরীর বরফে জমে যাবে। মনে মনে ক্যাথরিন বলে,
” এই জানোয়ারকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি যেকোনো কিছু সহ্য করতে রাজি আছি। ”

তার দৃষ্টি স্থির হয় বারান্দার বদ্ধ দুয়ার দ্বারের উপর। ক্যাথরিনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। ভালোবাসা অস্বীকার করেও এতো যত্ন নেওয়া হচ্ছে দেখে মনে মনে আরোণকে নির্বোধ বলে সম্বোধন করে। ক্যাথরিন সেই ভয়ংকর রাতের পর থেকে আরোণের ব্যবহারে এই অমূল পরিবর্তন দেখে প্রথমে ভেবেছিল আরোণ হয়তো নাটক করছে। কিন্তু পরে ঠান্ডা মাথায় ভাবার পর বুঝতে পারে যে আরোণের তার সাথে নাটক করার কোনো প্রয়োজন নেই। আর আরোণের এতো দুশ্চিন্তা এবং যত্ন ক্যাথরিনের কাছে সত্যি মনে হতে থাকে। তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য সেদিন রাতে সে বারান্দার রেলিঙের উপর দাঁড়ায়। যখন দেখে আরোণ তার কক্ষে প্রবেশ করেছে তখন নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে। আরোণ তাকে ভালোবাসে নাকি নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিজের জীবন ঝুঁকি নিয়ে ক্যাথরিন রেলিঙ থেকে নিজের পা পিছিয়ে নেয়। কিন্তু তার ভাগ্য ভালো যে আরোণ এসে তাকে বাঁচিয়ে ফেলে। সেই মুহূর্তেই ক্যাথরিন নিশ্চিত হয় আরোণ তাকে ভালোবাসে।
আরোণের একমাত্র দূর্বলতা সম্পর্কে জানতে পারায় বেশ আত্নবিশ্বাস কাজ করছে তার মধ্যে। এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়েই সে আরোণকে শেষ করবে। এই নেকড়ে পালের বিনাশ করার জন্য যা প্রয়োজন হয় তাই করবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

সবে মাত্র বাজার থেকে ফিরেছে আনাস্তাসিয়া। মূল দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় লম্বা চওড়া, কাধ সমান কোকড়ানো চুলের একজন পুরুষ বসার ঘরে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। তার পাশেই লিয়াম সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে বসে আছে। হঠাৎ নাথানকে দেখে কিছুটা অবাক হলেও তা প্রকাশ করে না আনাস্তাসিয়া। স্বাভাবিক ভাবেই ঘরে প্রবেশ করে হাতের ব্যাগটা নিচে একপাশে রেখে বলে,

” তুমি কখন এলে নাথান? ”
আনাস্তাসিয়াকে দেখেই সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ে নাথান। দুঃখজনক ভাবে বলে,
” ওহ আনাস্তাসিয়া। আমি আসতে খুব দেরি করে ফেলেছি তাইনা? গত পরশু আমি কাভালায় ফিরে বাবার কাছ থেকে জানতে পারি সবকিছু। তারপর সাথে সাথেই রওনা দেই কাস্টোরিয়ার উদ্দেশ্যে। ”
” তাহলে নিশ্চয়ই তুমি এটাও জানতে পেরেছ যে ক্যাথরিন, মা, বাবা তিনজনই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। তবুও কষ্ট করে এখানে আসতে গেলে কেন তুমি? ”
” আমি তোমার সাথে দেখা করার জন্য এসেছি এখানে। ইশ নিজের এ কি অবস্থা করেছ তুমি? তোমাকে দেখে মনেই হচ্ছে না তুমি কাভালা শহরের সনামধন্য বণিক মার্টিন অ্যালভেজের মেয়ে। ”
আনাস্তাসিয়া উপহাসের সুরে বলে,

” আমার তো মনে হচ্ছে তুমি এখানে আমাকে আমার পিতৃ পরিচয় মনে করিয়ে দিতে এসেছ। ”
নাথান কিছু বলার আগেই অফিলিয়া ট্রে-তে করে বিভিন্ন নাস্তা হাতে বসার ঘরে প্রবেশ করে। বেশ হাস্যজ্বল আজ তিনি। বেশ অমায়িকভাবে নাথানকে বলে,
” একি? দাঁড়িয়ে আছো কেন তুমি? বসো বসো। ”
নাথান ব্যস্ত পায়ে অফিলিয়ার কাছে গিয়ে তার হাত থেকে ট্রে নিয়ে বলে,
” ওহো গ্র্যানি! আপনি শুধু শুধু এতো কষ্ট করতে গেলেন কেন? আমি তো আর মেহমান না, আপনাদের পরিবারেরই একজন। ”

নাথানের এহেন আদিখ্যেতা দেখে বিরক্ত হয় আনাস্তাসিয়া। তার কাছে এসব নতুন কিছু না। নাথানের এই মাত্রারিক্ত ভালো মানুষি মুখোশের আড়ালে যে তার খারাপ রূপ লুকিয়ে আছে তা সম্পর্কে সে অবগত। তার মা, বাবা ও ক্যাথরিনকেও সে এই ভালো মানুষি রূপ দেখিয়ে বোকা বানিয়ে এসেছে এতো বছর। এখন আবার কোন উদ্দেশ্যে গ্র্যানিকে এতো মাখন মেরে কথা বলছে কে জানে। আনাস্তাসিয়া রাগ দেখিয়ে লিয়ামকে বলে,
” লিয়াম তুই উপরে যা। ”
বোনের আদেশ পেতেই লিয়াম দাত বের করে হেসে ট্রে থেকে একটি সামালি ও লোকুমদেসের প্লেট হাতে নিয়ে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। এবার আনাস্তাসিয়া দু হাত আড়াআড়ি ভাজ করে নাথানের দিকে তাকিয়ে বলে,
” আমার বোন আর নেই নাথান। তাই আমাদের সাথে কোন সূত্রে তোমার পারিবারিক সম্পর্ক এখনো আছে আমি কি জানতে পারি? ”
অফিলিয়া হালকা ধমকে উঠে আনাস্তাসিয়াকে বলে,

” অ্যানা! কিভাবে কথা বলছো তুমি? আমার সাথে আসো তুমি। আমি তোমাকে বুঝিয়ে সব বলছি। ”
নাথান অফিলিয়ার কথার মাঝে বাগড়া দিয়ে বলে,
” গ্র্যানি। আপনি কিছু মনে না করলে আমি আনাস্তাসিয়ার সাথে একা কথা বলতে পারি? আমিই ওকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলছি। ”
” হ্যাঁ অবশ্যই। ”
নাথান সামনে গিয়ে মূল দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে। আনাস্তাসিয়ার মোটেও ইচ্ছে করছে না এই নাথানের সাথে কথা বলার। কিন্তু অফিলিয়া চোখের ইশারায় যেতে বললে বাধ্য হয়ে সে নাথানের সাথে বের হয়।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটাই দূরে এসে পড়েছে আনাস্তাসিয়া ও নাথান। এখানে মানুষের সমাগম নেই বললেই চলে। আশেপাশে থাকা লম্বা পাইন গাছগুলোর কারণে জায়গাটা দেখতে কিছুটা জঙ্গলের মতো। অবশ্য সমগ্র কাস্টোরিয়ায় এরকম পাইন গাছের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় এখানকার দৃশ্য অনেকটা জঙ্গলের মতো। আনাস্তাসিয়া হাঁটা থামিয়ে বলে,

” কি বলার জন্য এতো আদিখ্যেতা দেখিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ? ”
নাথান দাত বের করে হেসে বলে,
” আমি এখানে আসার পরই গ্র্যানির সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছি। গ্র্যানি আপত্তি করে নি। এখন তোমাকেও বুঝিয়ে বলছি। মন দিয়ে শুনো। যেহেতু এখন তোমার মা, বাবা, ক্যাথরিন কেউই আর জীবিত নেই সেহেতু তোমাদের বাসা ওখানে কাভালায় খালি পড়ে রয়েছে। আবার তোমার বাবার সব ব্যাবসাও বা এখন কে সামলাবে? তাই আমি ঠিক করেছি আমি তোমাকে বিয়ে করে এসব কিছু এবং তোমাদের দায়িত্ব নিবো। এতে কারো আপত্তিও থাকবে না আর। ”
আনাস্তাসিয়ার এতক্ষণ দমিয়ে রাখা রাগ এখন সপ্তম আকাশে পৌঁছে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো বেরিয়ে আসে। সে ফুস করে উঠে। চেঁচিয়ে বলে,

” তোর মতো লোভীর নিয়ত সম্পর্কে আমার প্রথমদিন থেকেই সন্দেহ ছিলো। আজ তুই সেটার প্রমাণও দিয়ে দিলি। অসভ্য, লোভী কোথাকার। আমার বোনকে ভালোবাসিস বলে না মুখে ফেনা তুলতি তুই? কোথায় গিয়েছে তোর ভালোবাসা এখন? আমার বাবার ব্যাবসার প্রতি লোভ সামলাতে না পেরে এখানে এসে পড়েছিস আমাকে বিয়ে করতে? ”

” আনাস্তাসিয়া। আবেগ দিয়ে না ভেবে বিবেক দিয়ে ভাবো। আমি এখানে তোমার পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়ে আরো তোমার উপকার করছি আর তুমি উল্টো আমাকে লোভী বলছো। ”
আনাস্তাসিয়া রাগে ফুসতে ফুসতে বলে,
” তোর উপকার আর তুই কোনটারই প্রয়োজন নেই আমার এবং আমার পরিবারের। চুপচাপ কাস্টোরিয়া থেকে চলে যা তুই। ”

নাথান এবার আনাস্তাসিয়ার হাত ধরে ফেলে। কিন্তু এতে আনাস্তাসিয়া আরো রেগে চিৎকার করে উঠে। কিছু বুঝে উঠার আগেই নাথান নিজের মুখে শক্ত এক হাতের আঘাত অনুভব করে। আঘাতের ফলে সে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ে। নিজের নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখে তার নাক হতে রক্ত বের হচ্ছে। নাথানের চেহারা মুহূর্তেই পরিবর্তন হয়। হিংস্র চোখে সে পিছনে ফিরে তাকায়। আনাস্তাসিয়ার সামনে একটি যুবক দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষুদ্ধ চোখে সে নাথানকে একবার দেখে নিয়ে পিছনে ফিরে আনাস্তাসিয়াকে প্রশ্ন করে,

” তুমি ঠিক আছো আনাস্তাসিয়া? ”
আনাস্তাসিয়া রাগে ফুসছে এখনো। সে ক্রুদ্ধ স্বরে বলে,
” এই লোককে আমার চোখের সামনে থেকে যেতে বল ওরিয়ন। আর কখনো যেন কাস্টোরিয়ার আশেপাশেও সে না আসে। ”
ওরিয়ন আবার নাথানের দিকে ফিরে তাকায়। সামনে এগিয়ে গিয়ে নাথানের শার্টের কলার ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে বলে,
” আর কখনো যেন তোর ছায়া আনাস্তাসিয়ার আশেপাশে কেন কাস্টোরিয়ার আশেপাশেও না দেখি। ”
নাথান আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,

” ওহ তো এই কারণেই এতো রাগ? কাস্টোরিয়ার হাওয়া লেগেছে গায়ে। এখানে নতুন নাগর পেয়ে এতো তেজ বেড়েছে। মা বাবার ছায়াতল থেকে বেরিয়ে এতো স্বাধীনতা দুশ্চরিত্রা করে তুলেছে শেষমেশ। ”
ওরিয়ন রেগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। এগিয়ে গিয়ে নাথানকে মাটিতে ফেলে তার উপর বসে ইচ্ছেমতো এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে আনাস্তাসিয়া এগিয়ে এসে ওরিয়নের হাত ধরে তাকে টেনে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বিশেষ লাভ হয় না। তাদের চেঁচামেচিতে আশেপাশের মানুষ জমা হয়ে যায়। দু চারজন পুরুষ এগিয়ে এসে ওরিয়নকে জোর করে সড়ায় নাথানের উপর থেকে। তবুও তারা ধরে রাখতে পারছে না ওরিয়নকে। তাই আরো দুজন এগিয়ে এসে ওরিয়নকে ধরে রাখে। নাথান ক্রোধে ফুসতে ফুসতে বলে,
” এই দুশ্চরিত্রা মেয়ে এই ছেলের মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। কে জানে কি জাদু করেছে যে এই ছেলে অশরীরীর মতো আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে আক্রমণ করেছে। সবাই চিনে রাখো এই মেয়েকে। এই মেয়ে ছলনাময়ী। ”
ওরিয়ন চিৎকার করে বলে,

” আনাস্তাসিয়াকে নিয়ে আর একটা আজেবাজে কথা বললে তোর জিভ কেঁটে নেড়ি কুকুরদের খাওয়াবো আমি। ”
ওরিয়নের এমন ব্যবহারে আনাস্তাসিয়া সহ সকলেই অবাক হয়। কাস্টোরিয়ায় সকলেই ওরিয়নকে চিনে। বেশ ঠান্ডা ও নরম স্বভাবের ছেলেটার হঠাৎ এমন অগ্নিরূপ দেখে সকলেই হতভম্ব হয়ে আছে। নাথান মনে মনে ওরিয়ন ও আনাস্তাসিয়াকে বেশ গালাগালি করতে করতে সেখান থেকে প্রস্থান করে। এখানে বেশি বাড়াবাড়ি করাটা যে মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না তা সে বুঝতে পারে। যারা এতক্ষণ ওরিয়নকে ধরে রেখেছিল তারা ওরিয়নকে ছেড়ে সড়ে দাঁড়ায়। ওরিয়ন সবার দিকে একবার চোখ রাঙিয়ে বলে,

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৯+১০

” এই অসভ্যের কথার পুনরাবৃত্তি যদি অন্য কারো মুখে শুনি আমি তাহলে আমি মোটেও চুপ থাকবো না। ”
এই বলে ওরিয়ন আনাস্তাসিয়ার হাত ধরে সেখান থেকে প্রস্থান করে। আনাস্তাসিয়া কোনো শব্দ না করে চুপচাপ ওরিয়নের পিছনে হাঁটতে থাকে। সে এতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছে যে তার জীবনে বিশ্বাসযোগ্য গুটিকয়েক মানুষের মাঝে ওরিয়ন অন্যতম।

মহাপ্রয়াণ পর্ব ১৩+১৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here