মহাপ্রয়াণ পর্ব ১৫+১৬

মহাপ্রয়াণ পর্ব ১৫+১৬
নাফিসা তাবাসসুম খান

বরফে আচ্ছন্ন বিশাল উচ্চতার পাইন গাছগুলোকে মাথা উঁচু করে দেখতে দেখতে হাঁটছে ক্যাথরিন। এমন নয় যে সে আগে কখনো বরফে আচ্ছন্ন পাইন গাছের সমারোহ দেখে নি। বরং শীতকালে মেসিডোনিয়ায় গ্র্যানির বাসায় গেলে এমন দৃশ্য তার বহুবার দেখা হয়েছে। আনাস্তাসিয়াকে নিয়ে সে কাস্টোরিয়ার জঙ্গলে ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াতো প্রায়ই। কিন্তু এখানে আসার পর আজ প্রথম দিনের আলোয় সে বাহিরে বেরিয়েছে তাই কিছুটা উত্তেজনা কাজ করছে তার মধ্যে।
ক্যাথরিনের পিছু পিছু নীরবে ধীরেসুস্থে হেঁটে চলেছে আরোণ। আড়চোখে কৌতুহলী ক্যাথরিনের পানে চেয়ে আছে। হঠাৎ একটা শুকনো ডালের উপর ক্যাথরিনের পা পড়তেই কিছুটা মড়মড়ে শব্দ হয়ে উঠে। শব্দ হওয়ার সাথে সাথেই মাথার উপর একঝাঁক নাম না জানা পাখি শব্দ করে ডানা ঝাপ্টে উড়ে যায়। ক্যাথরিন মাথা উঁচু করে সেদিকে তাকায়। আরোণ পিছন থেকে বলে,

” এই অরণ্যে শুধু আমাদের মতো জানোয়ারদের ছাড়া পাখিরাও বাস করে। ”
ক্যাথরিন ঘাড় পিছনে ঘুরিয়ে বলে,
” তোমার মতো জানোয়ারের ভয়ে নাজুক পাখি গুলোও উড়ে পালিয়েছে। ”
” আমার মতো জানোয়ারের সাথে এদের বসবাস বহু বছরের। কিন্তু জানোয়ারের রাজ্যে সূর্য প্রতিমার প্রবেশে তারা তোমায় স্বাগত জানালো। ”
আরোণের এহেন জবাবে নিস্তব্ধতা বয়ে গেলো চারিদিকে। আরোণ চমৎকার হেসে তাকিয়ে থাকে ক্যাথরিনের দিকে। ক্যাথরিন চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকায়। বিড়বিড়িয়ে বলে,
” মেয়েদের সাথে এসব কথা বলার অভিজ্ঞতা নিশ্চিত হাজার বছর পুরনো। অসভ্য কোথাকার। ”
আরোণ অপর পাশে ফিরে বলে,
” না আমার বয়স রেখা হাজার বছর ছুঁয়েছে আর না আমি ইতিপূর্বে কোনো মেয়ের সাথে এধরণের কথা বলেছি। ”
ক্যাথরিন এবার আরো বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” সর্বশ্রোতা কোথাকার! ”
আরোণ স্মিত হেসে ক্যাথরিনের পিছন পিছন পা বাড়িয়ে হাঁটতে থাকে। আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ আরোণ এগিয়ে এসে ক্যাথরিনের হাত ধরে। ক্যাথরিন রাগ হয়ে কিছু বলবে তার আগেই আরোণ নিজের মুখের উপর এক আঙ্গুল রেখে চুপ থাকার ইশারা করে। ক্যাথরিন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে আরোণ ফিসফিসিয়ে বলে,
” কিছু শুনতে পাচ্ছো? ”
কিছু শুনতে পাচ্ছে না বুঝানোর জন্য মাথা দু’দিকে নাড়ায় ক্যাথরিন। আরোণ আবার আগের ন্যায় ফিসফিসিয়ে বলে,
” চোখ বন্ধ করে মন দিয়ে শুনো। ”
ক্যাথরিন চুপচাপ চোখ বন্ধ করে মনযোগ দেয় কিছু শোনা যায় নাকি বুঝার জন্য। কিছুক্ষণের মাঝেই সে শুনতে পারে ক্ষীণ পানি প্রবাহের শব্দ। সাথে সাথে সে চোখ মেলে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় আরোণের দিকে। আরোণ হেসে বলে,

” সামনে থেকে দেখতে চাও? ”
ক্যাথরিন মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বলে। আরোণ ক্যাথরিনের কাছে এগিয়ে মুহূর্তের মাঝে ওকে পাজাকোলে তুলে নেয়। আকস্মিক ঘটনায় ক্যাথরিন প্রথমে চমকে উঠলেও পরিস্থিতি বুঝতে পেরে রাগে চেচিয়ে উঠে।
” তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে ছোঁয়ার? ”
” আজ প্রথম আমার কোলে উঠো নি তুমি। ”
” আমি নিজ থেকে কখনো বলি নি আমাকে কোলে তুলে তুমি ঘুরে বেড়াও। নামাও আমাকে এই মুহুর্তে। সুযোগ পেয়েই মাথায় চড়ে বসেছ। অসভ্য কোথাকার। ”
আরোণ এবার শান্ত স্বরে বলে,

” আমার উপর ভরসা রাখো। আমার কাধে হাত রেখে তোমার চোখ বন্ধ করো কিছুক্ষণের জন্য। ”
ক্যাথরিন মনে মনে ভাবে আর যাই হোক আরোণ ওকে মারবে না এটুকু নিশ্চিত। আর না ওর কোনো ক্ষতি করবে। আরোণ যে ওর উপর ভালোই দূর্বল তা ক্যাথরিনের ভালো করে জানা আছে। তাই আর কিছু না বলে এক হাত আরোণের ঘাড়ে এবং অপর হাত তার কাধে রেখে চোখ বন্ধ করে সে। তৎক্ষণাৎ সে অনুভব করে কিছু সময়ের অন্তর বাতাসের বেগে আরোণ তাকে নিয়ে দৌড়ে অন্য কোথাও এসে থেমেছে। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই ক্যাথরিন কাছ থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে পানির ঝপঝপিয়ে পড়ার শব্দ। আরোণ ক্যাথরিনের কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
” চোখ খুলো ক্যাথ। ”
ক্যাথরিন ধীরে ধীরে চোখ মেলে আরোণকে দেখে। আরোণ মৃদু হেসে বলে,
” সামনে তাকিয়ে দেখো। ”

ক্যাথরিন ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকায়। বিস্মিত ও বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সে। তার সামনে বিশাল বড় এক জলপ্রপাত। উঁচু পাহাড়ের গা ঘেসে সেই জলপ্রপাত হতে পানি নিচে প্রবাহিত হয়ে এক সরু লেকের সাথে মিশে যাচ্ছে। সেই পাহাড়ের চারিদিকে আবার অসংখ্য ফুলের বাহার। লেকের পাশে সবুজ পাতার ভিড়ে বেশ কয়েক গুচ্ছ লাল ও গোলাপি ক্যামেলিয়া ফুলের বাহার। বরফে ঘেরা পাহাড়ের একপাশের গা ঘেসে থাকা শুকনো ডাল বেয়ে বয়ে উঠেছে জেসমিন ফুলের বাহার। তারই নিচে সমভূমিতে বরফকুচি ভেদ করে ফুটে আছে অসংখ্য সাদা রঙের স্নো ড্রপ ফুল এবং বেগুনি রঙের ক্রোকাস ফুল। ক্যাথরিনের মনে হচ্ছে সে এই মুহুর্তে কোনো রূপকথার বরফের রাজ্যে চলে এসেছে। বরফে ঘেরা চারিদিকের মাঝে এই লেক, জলপ্রপাত, ফুলের বাহার এবং লেকের পাড়ে অসংখ্য ছোট বড় সাদা পাথর যেন এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য তুলে ধরেছে। প্রকৃতির এমন সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে সে এক হাত দিয়ে মুখ ঢেকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে,

” ঈশ্বর! কি অপরূপ সৌন্দর্য! ”
ক্যাথরিন ভুলে যায় গত একমাসে হওয়া তার সঙ্গে সকল ঘটনা সম্পর্কে। ভুলে যায় এই গহীন অরণ্যে বাস করা মানবরূপী হিংস্র নেকড়েদের সম্পর্কে। খিলিখিলিয়ে হেসে উঠে সে। প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রাণবন্ত হেসে উঠা রমণীকে বিমোহিত হয়ে দেখছে এক নেকড়ে মানব। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে আরোণ প্রকৃতির রূপ বেশি সুন্দর নাকি তার প্রিয়তমার হাসি? সাথে সাথে তার হৃদয় উত্তর দেয় তার প্রিয়তমার হাসির তুলনায় মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আর দ্বিতীয়টি নেই। আরোণ সন্তপর্ণে ক্যাথরিনকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। ক্যাথরিন আরোণের দিকে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করে দৌড়ে লেকের তীরে চলে যায়। আরোণ লক্ষ্য করে ক্যাথরিন হাসলে তার বাম গালে টোল পড়ে। আগে কখনো এটা দেখে নি সে। অবশ্য গত একমাসে ক্যাথরিন একবারও মন খুলে হাসে নি তাই এটা আগে লক্ষ্য না করা স্বাভাবিক বিষয়।

হঠাৎ ধপাস করে পড়ার শব্দে আরোণ ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। বরফে পা পিছলে নিচে পড়ে গিয়েছে ক্যাথরিন। আরোণের সামনে এভাবে পড়ে যাওয়ায় লজ্জায় তাজ্জব বনে গিয়েছে সে। আরোণ এগিয়ে গিয়ে ক্যাথরিনের দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বলে,
” লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি কিছু মনে করি নি। ”
ক্যাথরিন চোখ বাকা করে আরোণের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। আরোণ হাত ধরতেই নিজে উঠার বদলে হাত দিয়ে টান মেরে আরোণকেও নিচে ফেলে দেয় সে। খিলখিলিয়ে হেসে বলে উঠে,
” লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি কিছু মনে করি নি।”
এটা বলে আরোণের দিকে তাকিয়ে দেখে আরোণের চোখ কুচকে আছে। চেহারায় রাগের ভাব ফুটে উঠেছে। ক্যাথরিনের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সে তো মজার ছলে এমনটা করেছে। এতে এতো রেগে যাওয়ার কি আছে? রেগে এখন ক্যাথরিনকে আছাড় মেরে যদি এই জলপ্রপাতের উপর থেকে নিয়ে ফেলে দেয়? ক্যাথরিন বসা অবস্থায়ই সামান্য পিছনে গিয়ে কাপা স্বরে বলে,
” আমি তো মজা করছিলাম শুধু। ”

আরোণ কিছুক্ষণ ক্যাথরিনের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হাতে করে বরফ কুচি নিয়ে ছুড়ে মারে ক্যাথরিনের দিকে। আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে যায় ক্যাথরিন। সামনে তাকাতেই দেখতে পায় আরোণ চাপা হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। ক্যাথরিন রাগে পাশ থেকে বেশ কিছু বরফ কুচি হাতে তুলে নিয়ে আরোণের দিকে ছুড়ে মারে কিন্তু তার আগেই আরোণ বাতাসের গতিতে সেখান থেকে সরে যায়। ক্যাথরিন আবার বরফ তুলে আরোণকে মারতে নিলে আবারো একইভাবে আরোণ সেখান থেকে সরে যায়। এভাবে বেশকিছু বার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে বিরক্ত হয়ে ক্যাথরিন সেখানেই বসে রয় মুখ ফুলিয়ে। আরোণ হেসে বলে,
” যদিও আমাকে এতো সহজে কখনোই বাগে পেতে না তুমি। তবুও যাও কথা দিলাম এখন আর একচুল ও নড়বো না এখান থেকে। যত ইচ্ছে বরফ ছুড়ে মারো। ”
ক্যাথরিন বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

” এবার তোমার পালা। ”
এই বলে নিচ থেকে বরফ তুলে ছুড়ে মারতে থাকে আরোণের দিকে। আরোণ দু হাত মেলে চোখ বুজে রয়। ক্যাথরিন আবার বরফকুচি নেওয়ার জন্য নিচে ঝুকে বরফ তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সামনে আরোণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ক্যাথরিন থমকায়৷ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। পিছনে সড়ে যায়। কিন্তু সে আরোণ থেকে দূরে যাওয়ার জন্য পিছু হটলে আরোণ উল্টো আরো কদম বাড়িয়ে সামনে আসে। তিন চার কদম পেছানোর পর ক্যাথরিন অনুভব করে তার পিঠ পিছনে থাকা ক্যামেলিয়া গাছের সাথে গিয়ে ঠেকেছে। ক্যাথরিন অপ্রস্তুত হয়ে সামনে থাকা আরোণের দিকে তাকায়। খুব কাছে চলে এসেছে সে। ক্যাথরিনের মস্তিষ্ক খালি হয়ে যায়। চোখ বুজে ফেলে সে। পরপরই আরোণের কণ্ঠ কানের পাশে বেজে উঠে।

” ধ্বংস আমি, সৃষ্টি তুমি
হিংস্র নেকড়ের হৃদয়ের মায়াবিনী তুমি।
উচ্ছিষ্ট আমি, শ্রেষ্ঠ তুমি
কলঙ্কিত চাঁদের সূর্যের প্রতিমা তুমি। ”
চোখ মেলে তাকায় ক্যাথরিন। জেসমিনের সুবাস বয়ে যায় হীম বাতাসে। আরোণ সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই এক পা দু পা করে পিছিয়ে যায়। এক হাত উঁচু করে ক্যামেলিয়া গাছের একটি ডালা ধরে মৃদু ঝাকানো শুরু করে। ক্যামেলিয়ার বর্ষণ শুরু হয় ক্যাথরিনের উপর। গোলাপি ও লাল রঙের ক্যামেলিয়াতে সাদা বরফ ঢাকা পড়ে। আরোণকে অবাক করে দিয়ে ক্যাথরিনের গাল লাজে লাল হয়ে উঠে। দৃষ্টি নত করে সে লাজ লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। আরোণের আধারে আচ্ছন্ন জীবনে কালোই ছিল তার প্রিয় রঙ। কিন্তু এই মুহুর্তে সে উপলব্ধি করে ক্যাথরিনের লাজে রাঙা লাল রঙের আভা তার সবচেয়ে প্রিয় রঙ। ক্যাথরিন নিচে তাকিয়ে থেকেই প্রশ্ন করে,
” এই জায়গার নাম কি? ”
আরোণ অস্ফুটস্বরে উত্তর দেয়,
” বরফ খামে ক্যামেলিয়ার লাজ। ”

গুমোট অন্ধকার বিশাল হলরুমের মাঝ বরাবর মাথা ঝুকিয়ে রক্তাক্ত একজন পুরুষ নিজের জীবনের জন্য ভিক্ষা চাইছে। কক্ষের চার কোণে থাকা আগুনের মাশালের জ্বলজ্বল করা আলোয় তার চেহারা মৃদু স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। বয়স হয়তো চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ছাব্বিশ জন ভয়ংকর রক্তচোষা পিশাচ। সকলের মুখেই বিদ্রুপের হাসি। রক্তাক্ত পুরুষটি আরেকবার অনুনয় করে বলে,
” আমি বিশ্বাসঘাতকতা করি নি। বিশ্বাস করুন কাউন্ট। আমি কোভেনদের সাথে প্রতারণা করার কথা সপ্নেও ভাবতে পারি না। আমার বংশ চার প্রজন্ম ধরে আপনার সেবায় নিয়জিত। ”

বিশাল নিস্তব্ধ কক্ষে কারো পদচারণের শব্দ শুনা যায়। ধীরে ধীরে আধার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে আসে সেই ব্যক্তি। এক হাতে কাঁচের গ্লাস। সেই গ্লাসে লাল রঙের পানীয়। চোখের ইশারায় কাউকে ডাকতেই একজন মহিলা ট্রে হাতে এগিয়ে আসে তার দিকে। সেই ট্রে-তে গ্লাসটি রেখে এবার সেই রক্তাক্ত অবস্থায় নতজানু হয়ে থাকা পুরুষের দিকে এগোয় সে। অনুনয় করতে থাকা সেই পুরুষের চুলের মুঠি ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে বলে,
” হ্যাঁ এন্টন। একদম ঠিক বলেছ। তোমার বংশ চার প্রজন্ম ধরে বিশ্বস্ততার সাথে আমার সেবায় নিয়জিত ছিলো। ”
এটা বলেই সাথে সাথে এন্টনের মাথা গর্দান থেকে আলাদা করে ফেলে সে। উপস্থিত অনেকের মুখে রক্ত ছিটে পড়ে। তাদের মাঝে এক যুবতী মুখে ছিটে আসা রক্ত আঙ্গুল দিয়ে নিয়ে মুখে পুরে নেয়। বিতৃষ্ণা স্বরে বলে,

” ছি! এর রক্তের স্বাদও কি পানসে। ”
ড্যানিয়েল পাশ থেকে বলে,
” আহ রিকার্ডো! কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই একে মেরে ফেললে? ওর বংশ আমাদের সবথেকে বিশ্বস্ততার সাথে চাকরগিরি করেছে। ”
রাগী দৃষ্টি মেলে রিকার্ডো ড্যানিয়েলের দিকে তাকায়। চোয়াল শক্ত করে বলে,
” বিশ্বাসঘাতকদের জীবন নেওয়ার আগে তাদের কোনো কথা শোনার প্রয়োজন মনে করি না আমি। এন্টনের বংশের সকল পুরুষ গত চার প্রজন্ম ধরে বিশ্বস্ততার সাথে দাসত্ব করেছে। কিন্তু সেই ধারা এন্টন অব্যাহত রাখতে পারে নি৷ আমার দূর্গে আমার গোলামির নাম করে সে ওই হারামি জ্যাকসনের গুপ্তচর হিসেবে ছিলো। ”
ক্যামিলো প্রশ্ন করে,

” তুমি কিভাবে নিশ্চিত যে ও জ্যাকসনের গুপ্তচর হিসেবে দূর্গে ছিলো? ”
” সেটার কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না কাউকে। ”
এটি বলেই নিচে পড়ে থাকা এন্টনের লাশ ডিঙিয়ে রিকার্ডো সেখান থেকে প্রস্থান করে। ড্যানিয়েল ও ক্যামিলো রিকার্ডোর পিছু পিছু যায়। রিকার্ডো নিজের কক্ষে প্রবেশ করে ঘাড়ে একহাত দিয়ে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ড্যানিয়েল ও ক্যামিলো কক্ষে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। ক্যামিলো এগিয়ে এসে রিকার্ডোর কাধে হাত রাখতেই রিকার্ডো বলে,

” কোভেনদের সামনে আমার থেকে কোনো ধরনের কৈফিয়ত চাইতে তোমায় হাজার দিন বারণ করেছি আমি মা। তোমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করলে আমি নিজ থেকে জানিয়ে দিবো। আর এন্টন একজন বিশ্বাসঘাতক এটা বিশ্বাস করার জন্য তোমার আমার বলা যথেষ্ট মনে হয় নি? ”
” তোমার কথায় আমি বিশ্বাস করি কিন্তু কোভেনদের মনে এই নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে যথাযথ প্রমাণ না দেখালে। ”
” কার এতো সাহস যে আমার সিদ্ধান্তে প্রশ্ন তুলবে? ”
ক্যামিলো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার দুই ছেলেই যে এতোটা বেপরোয়া হবে তা সে কখনো ভাবেনি। এদের কিছু বুঝিয়েও লাভ নেই। পিশাচ স্বত্তার তবে এতো ক্ষমতা যে সে ভিতরের মানবতাকেও মেরে ফেলে? অবশ্য তার দুই সন্তানের ভিতর সে কখনোই মানব স্বত্তার ছিটেফোঁটাও দেখে নি। জন্মের পর থেকেই এরা রক্তের খেলার অংশ হয়ে গিয়েছে। আর রিকার্ডো! সে হয়ে গিয়েছে এই রক্তের খেলার সম্রাট।
ড্যানিয়েল এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,

” তুমি কোথায় ছিলে এতদিন? ”
রিকার্ডো বাকা হেসে জবাব দেয়,
” ম্যাথিউর থেকে যে কথা বের করতে পারো নি সেই কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করাটা বোকামি নয় কি? ”
ড্যানিয়েল রাগ হয় ভিতরে ভিতরে। ম্যাথিউ রিকার্ডোর সাথে ফিরে এসেই সাথে সাথে আবার দূর্গের বাহিরে চলে গিয়েছে। তাই তাকে এই প্রশ্ন করার সুযোগ পায় নি সে। কিন্তু তার ভালো করেই জানা আছে প্রশ্ন করে বিশেষ লাভ নেই। কারণ ম্যাথিউ কখনোই এর উত্তর দিবে না। মাঝেমধ্যে ড্যানিয়েল ভাবে ম্যাথিউ আসলেই তারই ছেলে তো! নাহয় নিজের সবথেকে অপছন্দের ও ঘৃণার ব্যক্তির তথ্য নিজের পিতাকে জানাতে কেন আপত্তি করবে সে?
ড্যানিয়েল আর কিছু বলার আগেই রিকার্ডো বলে,

” তোমরা এখন আসতে পারো। ”
ক্যামিলো হতাশ দৃষ্টি ফেলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে। ড্যানিয়েলও তার পিছু পিছু যেতে নেয় তখনই রিকার্ডো পিছন থেকে বলে উঠে,
” ড্যানিয়েল! আর কখনো যেন ভরা মজলিসের মাঝে আমার নাম উচ্চারণ করতে না দেখি তোমায়। বাকি সবার মতোই কাউন্ট বলে সম্বোধন করবে। এটাই আমার প্রথম ও শেষ সতর্কীকরণ। ”
রাগে অপমানে থমথমে মুখ নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে ড্যানিয়েল। আপাততর জন্য সে মুখ বুজে এই অপমান গিলে নেয়। সময়মতো সে এর জবাব দিবে।

কক্ষের একপাশের দেয়ালের মাঝ বরাবর রয়েছে বিশাল গোলাকৃতির বিছানা। তার সামনের সম্পূর্ণ দেয়াল জুড়ে এক বিশাল জানালা। তারই একপাশের দেয়ালে একটি আয়না, একটি ক্যাবিনেট ও একটি আলমারি রয়েছে। তার অপর পাশের দেওয়ালে রয়েছে ফায়ারপ্লেসের ব্যাবস্থা ও বারান্দায় যাওয়ার জন্য বিশাল দরজা।
রিকার্ডো আলমারির কাছে এগিয়ে যায়। আলমারি খুলে সেখান থেকে একটি ছুড়ি বের করে। ছুড়ির হাতলের দিকটায় সবুজ পাথরের কাজ করা। দেখতে খারাপ না। রাজকীয় ভাব আছে। আনাস্তাসিয়াকে মনে মনে বোকা বলে সম্বোধন করে রিকার্ডো। শেষ দেখার দিন এই ছুড়ি সেই কাঠবাদাম গাছে রেখেই আনাস্তাসিয়া চলে গিয়েছিলো। কি ভেবে যেন রিকার্ডো এটা নিয়ে নেয় নিজের সাথে।

এই মেয়ের অভ্যাস হয়তো প্রতিবার দেখা হলে কিছুনা কিছু ফেলে যাওয়ার। মাত্র তিনবার সাক্ষাৎ হয় রিকার্ডোর আনাস্তাসিয়ার সাথে। তিনবারই এই মেয়ে নিজের কিছু না কিছু ফেলে গিয়েছে রিকার্ডোর কাছে। প্রথম সাক্ষাতে আনাস্তাসিয়া নিজের চুলের চিকন এক সোনালী রঙের ফিতা ফেলে গিয়েছিলো, দ্বিতীয় সাক্ষাতে নিজের তলোয়ার ফেলে গিয়েছিলো এবং তৃতীয় সাক্ষাতে নিজের এই ছুড়ি ফেলে গিয়েছিলো। রিকার্ডো হাতের ছুড়িটা আলমারিতে রাখে। সেই ছুড়ির সাথেই থাকা তলোয়ার ও ফিতাটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে,
” ভুলো মনের মেয়ে। ”

বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গতকালের কথা মনে করছে ক্যাথরিন। গতকাল প্রাসাদে ফিরে আসার সময় আরোণ হঠাৎ ক্যাথরিনকে বলে,
” রোমানিয়ায় একটা প্রচলিত রীতি আছে জানো? ”
” কি? ”
” এখানে নববধূরা চুলে বিনুনি করে রাখতে পছন্দ করে এবং কুমারীরা চুল খোলা রাখতে। ”
আরোণের কথার মানে বুঝতে পেরে তাজ্জব বনে যায় ক্যাথরিন। তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলে,
” আমি জানতাম না। ”

দরজা খোলার শব্দে ভাবনা থেকে ফিরে আসে ক্যাথরিন। পাশ ফিরে দেখে আরোণ কক্ষে প্রবেশ করছে৷ আরোণ কাছে এসে সাথে সাথে ক্যাথরিনের হাত ধরে কক্ষের এক কোণায় নিয়ে যায়। আকস্মিক ঘটনায় ক্যাথরিন অবাক হয়। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। আরোণ ফিসফিসিয়ে বলে,
” এতো কথা বলার সময় নেই। তোমার প্রয়োজনীয় যা দরকার গুছিয়ে নাও। আজকে রাতে তুমি এখান থেকে চলে যাবে। ”
ক্যাথরিন এবার আরো অবাক হয়। প্রশ্ন করে,
” চলে যাবো মানে? ”
” আমাকে যেতে হবে ক্যাথ। গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। ”
” আমিও কি তোমার সাথে যাবো? ”

” না। আমি সহ পালের অনেকেই একটি কাজে সিবিউর বাহিরে যাবো। আমার অনুপস্থিতিতে তোমার এখানে থাকা মোটেও নিরাপদ নয়। তোমাকে একাও আমি ছেড়ে দিতে পারবো না। তাই ক্রিয়াসকে রেখে যাবো। আজকে রাতে তুমি ক্রিয়াসের সাথে প্রাসাদ থেকে সকলের অগোচরে বেড়িয়ে যাবে। ক্রিয়াস আমার বিশ্বস্ত একজন। ওর উপর বিশ্বাস করতে পারো তুমি। আর এই বিষয়ে তুমি, আমি এবং ক্রিয়াস ব্যতিত অন্য কেউ অবগত নয়। ”
খুবই ধীর স্বরে কথাগুলো বললেও আরোণের কণ্ঠে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট অনুভব করছে ক্যাথরিন। আরোণ ক্যাথরিনের সুরক্ষা নিয়ে এতো চিন্তা করছে কেন? তার অনুপস্থিতিতে তারই রাজ্যে কে ই বা ক্যাথরিনের ক্ষতি করবে? প্রশ্নগুলো ভাবায় ক্যাথরিনকে। আরোণ আবার বলে,

” আমার কথা বুঝতে পেরেছ? ”
” তুমি আবার কোনো সাধারণ মানুষ শিকার করতে যাবে তোমার পাল নিয়ে? আমার মা বাবার মতো আবার কারো মা বাবাকে মেরে তাদের সন্তানকে অনাথ করে দিবে? ”
ক্যাথরিনের কণ্ঠে ব্যথার ছাপ স্পষ্ট। আরোণ কিছুক্ষণ থেমে জবাব দেয়,
” আমি আমার শত্রুর কাছে যাচ্ছি ক্যাথ। মানুষ নয় রক্তচোষা পিশাচরা আমার শত্রু। সোফিয়ার মৃত্যুর জবাব দিতে হবে না? ”
ক্যাথরিন এবার আরোণের থেকে খানিকটা সড়ে দাঁড়িয়ে বলে,
” এমন তো নয় যে আমার কথায় তুমি নিজের সিদ্ধান্ত বদলাবে। যদি ওখানে তুমি ওদের হাতে মারা যাও তাহলে? তখন কি করবো আমি? ”
আরোণ এক মুহূর্তের জন্য ভাবে ক্যাথরিন হয়তো তার জন্য চিন্তা করছে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ক্যাথরিন বলে,

” তোমার সেই নেকড়ে ক্রিয়াস কি তখন আমাকে আমার দেশে ফেরত যেতে দিবে? ”
আরোণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
” আমি দুঃখিত ক্যাথ। কিন্তু কোনো পিশাচের এতো ক্ষমতা নেই যে আমার কোনো ক্ষতি করবে। আমি নেকড়ে পালের আলফা আরোণ রদ্রিগেজ। সর্বশক্তিমান আমি। শ’খানেক ভ্যাম্পায়ার এক হলেও আমার মোকাবেলা করার ক্ষমতা কারো নেই। তাই তুমি অপেক্ষা করবে। ফিরে আসবো আমি তোমার কাছে। ”
আরোণের এভাবে নিজের ক্ষমতার কথা বলায় ক্যাথরিনের রাগ হয়। নেকড়ের জাত হাজার হোক। সবজায়গায় নিজেকে সর্বশক্তিমান ভাবা এদের রক্তে মিশে আছে। আরোণের নিজের হিংস্রতা নিয়ে এই অহংকার ও আত্মবিশ্বাসকে দূর্বল করার জন্য ক্যাথরিন কঠিন কণ্ঠে বলে,

” করবো না তোমার অপেক্ষা। আশা করছি কখনো না ফিরে আসো তুমি আমার জীবনে। ”
আরোণ অসহায়ের মতো হাসি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে কক্ষ হতে। করিডোর দিয়ে নিজের কক্ষে যেতে যেতে আরোণ ভাবতে থাকে ক্যাথরিনকে নিয়ে। সে ভেবেছিলো হয়তো ক্যাথরিন কিছুটা হলেও নরম হয়েছে তার প্রতি। কিন্তু তার ধারণা ভুল। ক্যাথরিনের ঘৃণার পাহাড় এতোই বিশাল যে সেই পাহাড় কেটে ক্যাথরিনের মনে জায়গা করে নেয়া অসম্ভব বিষয়। অবশ্য ভালোই হয়েছে। সব ঝামেলা মিটিয়ে ক্যাথরিনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এভাবেই আরোণ তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিবে। একসাথে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই৷ তাই ক্যাথরিনের আরোণের প্রতি কোনো অনুভূতি না থাকাই উত্তম।

বিছানায় নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে আনাস্তাসিয়া। আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে ভাবছে। যা ভয় পাচ্ছিলো তাই হলো। নাথানের বলে যাওয়া সেই কথাগুলো পুরো কাস্টোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই ভাবছে আনাস্তাসিয়া ও ওরিয়নের মাঝে হয়তো কোনো সম্পর্ক আছে। নাহয় শান্ত চুপচাপ থাকা ওরিয়ন আনাস্তাসিয়ার জন্য এতোটা রেগে যাবে কেন? বিষয়টা এটুকু পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নেই। সবাই এখন আনাস্তাসিয়ার চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। আনাস্তাসিয়া নাকি ছলনা করে ওরিয়নের মতো ছেলেকে হাত করেছে। গ্র্যানিকে সেদিনের নাথানের ব্যবহার সম্পর্কে বলার পর গ্র্যানি নিজে এই বিয়ে নিয়ে নাকোচ করেছে। কিন্তু এখন সকলের কানাঘুষায় গ্র্যানি যদি তাকে ভুল বুঝে? অসহ্যকর লাগছে সবকিছু আনাস্তাসিয়ার। কালকে ভোর হতেই তার ওরিয়নের সাথে দেখা করতে হবে। তাদের সম্পর্কে যে কুটনা রটছে তা নিজেদেরই পরিষ্কার করতে হবে।

রাত গভীর হয়েছে। চারিদিক নিশ্চুপ হয়ে আছে। দরজা খুলে নিশব্দে ক্যাথরিনের কক্ষে প্রবেশ করে আরোণ। ক্যাথরিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোমরবন্ধ গির্ডেলসের বাধন বাধছিলো। হঠাৎ আরোণের প্রবেশে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সে। ক্যাথরিনের অস্বস্তি বুঝতে পেরে সাথে সাথে আরোণ অপর দিকে ফিরে যায়। ক্যাথরিন তাড়াতাড়ি গির্ডেলস পড়ে আরোণকে বলে,
” তৈরি আমি। এখন বেরোবো আমরা? ”
আরোণ এবার ক্যাথরিনের দিকে ফিরে। কালো রঙের গাউন এবং তার উপর একটি খয়েরী রঙের গির্ডেলস পড়েছে সে। আজকে চুল খোলাই রেখেছে। আরোণ এগিয়ে আসে ক্যাথরিনের কাছে। ক্যাথরিনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

” একটা জিনিস বাকি। ”
ক্যাথরিন একবার আরোণের বাড়ানো হাতের দিকে তাকায় আবার আরোণের দিকে তাকায়। আরোণ চোখের ইশারায় হাত ধরতে বলে। ক্যাথরিন আরোণের হাতে হাত রাখতেই আরোণ তাকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে নিজে হাটু গেড়ে ক্যাথরিনের সামনে বসে পড়ে। ক্যাথরিন চোখ কুচকে বুঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে। আরোণ এবার ক্যাথরিনের ডান পা নিজের হাঁটুর উপর রেখে তার গাউন হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে দেয়। ক্যাথরিন তেঁতে উঠে বলে,
” করছো কি তুমি? ”

আরোণ ক্যাথরিনের দিকে না তাকিয়ে নিজের পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে। রুমালটা ক্যাথরিনের হাঁটুর খানিকটা নিচে বেধে দিয়ে নিজের বেল্টের পাশ থেকে একটা খঞ্জর বের করে। ক্যাথরিন দেখে খঞ্জরটির হাতলটা সম্পূর্ণ একটি গোলাপের মতো কারুকার্য করা। আরোণ বলে,
” এটা তোমার জন্য। আশা করছি প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু তবুও কোনো বিপদ হলে তোমার আত্মরক্ষার জন্য এটি সাথে রাখবে সবসময়। ”
এই বলে আরোণ খঞ্জরটি ক্যাথরিনে পায়ের রুমালের বাধনের মাঝে সাবধানে বেধে দিয়ে গাউন নামিয়ে পা ঢেকে দেয়। ক্যাথরিনের দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে। আরোণ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

” ক্রিয়াস নিচে অপেক্ষা করছে। আর দেরি না করি। চলো। ”
ক্যাথরিন একটি লম্বা ক্লক নিয়ে পড়তে থাকে। আরোণ বিছানার উপর রাখা ক্যাথরিনের থলে একহাতে নিয়ে আরেক হাতে ক্যাথরিনের হাত ধরে কক্ষ থেকে বের হয় সাবধানে। এই মুহুর্তে এখানে কারো থাকার কথা নয়। তবুও খুব সাবধানে একবার চারিপাশ দেখে ক্যাথরিনকে নিয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে সে। ক্যাথরিন প্রশ্ন করে,
” তোমার কিছু নেওয়ার বাকি? তোমার কক্ষে কেন আসলাম আমরা? ”

আরোণ কথা না বলে এগিয়ে গিয়ে তার কক্ষের আলমারির সামনে দাঁড়ায়। আলমারির পাশে থাকা দেওয়ালের একটা বিশাল পাথর ধরে আরোণ টান মারতেই দেওয়ালের অংশ দু দিকে সড়ে গিয়ে একটি সুরঙ্গ সিঁড়ি দেখতে পায় ক্যাথরিন। ক্যাথরিন অবাক হয়ে কিছু প্রশ্ন করার আগেই আরোণ তাড়াতাড়ি তার কক্ষ হতে একটি লণ্ঠন হাতে নিয়ে ক্যাথরিনকে নিয়ে সেই সুরঙ্গের ভেতর প্রবেশ করে সেই প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয়। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আরেক দফা আরোণ একইভাবে পাথরটান দিয়ে দেওয়ালের একাংশ খুলে দেয়। এবার দেওয়াল সরতেই ক্যাথরিন দেখে ক্রিয়াস একটি কালো রঙের ঘোড়া নিয়ে দাঁড়ানো বাহিরে। জায়গাটা কিছুটা জঙ্গলের মতো। প্রাসাদের সামনে দিয়ে বের হওয়ার সময় এমন জায়গা কোথাও দেখে নি ক্যাথরিন। এটা হয়তো প্রাসাদের পিছনের দিকের রাস্তা। আরোণ তড়িঘড়ি করে ক্যাথরিনকে বলে,

” আমার পথ এটুকুই ছিলো। বাকি পথে ক্রিয়াস তোমার সাথে থাকবে। ও যেভাবে বলবে সেভাবে থাকবে। আর কাউকে বিশ্বাস করবে না। ”
একটু দম নিয়ে আরোণ আবার বলে,
” এই ঘোড়া তোমার জন্য। খুব সহজে পোষ মানে। যেভাবে চালাবে সেভাবেই বাধ্যের মতো পথে চলবে। ”
ক্যাথরিন প্রশ্ন করে,
” এর নাম কি? এটা তোমার ঘোড়া? ”
আরোণ অকপটে জবাব দেয়,
” তোমার ঘোড়া আজ থেকে ও। তুমি যা ডাকবে তাই ওর নাম হবে। ”
আরোণের এমন উত্তরে ক্রিয়াস চমকে তাকায়। আরোণ ক্রিয়াসের দৃষ্টি লক্ষ্য করে ঠান্ডা গলায় বলে,
” ওর কোনো ক্ষতি হলে আমি জবাবদিহিতা নিবো না ক্রিয়াস। জীবন নিবো। ”
ক্রিয়াস মাথা ঝুঁকিয়ে আস্বস্ত করে বলে,
” আপনার আমানত হেফাজতের জন্য যা করণীয় সব করবো আলফা। ”

আরোণ আর কথা না বাড়িয়ে ক্যাথরিনকে তাড়াতাড়ি ঘোড়ায় উঠতে সাহায্য করে। ক্রিয়াস মুহূর্তেই রূপ বদলে নেকড়ে রূপ ধারণ করে। ঘোরায় উঠে ক্যাথরিন একবার আরোণের দিকে তাকায়। আরোণের বিচলিত দৃষ্টিতে হাজারটা অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে। ক্যাথরিন মনে মনে ভাবে ভালোবাসার হাজারটা রূপ থাকে। কিন্তু একজন নেকড়ের ভালোবাসা কেমন হয়? একজন হিংস্র নেকড়ের হৃদয়ও কি ভালোবাসা হারানোর ভয়ে দগ্ধ হয়? ক্যাথরিনের ভাবনার মাঝে আরোণ ক্যাথরিনের এক হাতের উপর হাত রেখে বলে,

মহাপ্রয়াণ পর্ব ১৩+১৪

” খেয়াল রেখো ক্যাথ! ”
ক্যাথরিন কিছুক্ষণ আরোণের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
” এই ঘোড়ার নাম আজ থেকে ভ্যালেন্টাইন৷ ”

মহাপ্রয়াণ পর্ব ১৭+১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here