মহাপ্রয়াণ পর্ব ৫৫+৫৬

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৫৫+৫৬
নাফিসা তাবাসসুম খান

আকাশে সোনালী চাঁদ উঁকি মেরে আলো ছড়াচ্ছে। মৃদু কনকনে বাতাস এসে আনাস্তাসিয়াকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। শীতকাল পেরিয়ে বসন্তকাল এলো বেশ কিছুদিন হয়েছে। তবুও এই মৃদু বাতাসে আনাস্তাসিয়া কেপে উঠছে। দু হাত আর গলা যেন বরফে জমে গিয়েছে মনে হচ্ছে। লজ্জায় এবং আড়ষ্টতায় কক্ষে বসে থাকতে না পেরে মাথার মুকুট এবং পর্দা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। রিকার্ডোর আসার কোনো নাম গন্ধ নেই এখনো।

দূরের পাহাড় গুলো যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের অন্ধকারে মনে হচ্ছে সেই পাহাড়গুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আনাস্তাসিয়াকে। এসব আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই এক জোড়া শীতল হাত নিজের কোমরের দু’পাশে আবিষ্কার করে আনাস্তাসিয়া। কাধে গরম নিঃশ্বাসও টের পায়। লজ্জায় জমে থাকা আনাস্তাসিয়া যেন রিকার্ডোর ছোঁয়ায় লজ্জাবতী গাছের ন্যায় খানিকটা নুইয়ে যায়। স্পর্শ আরেকটু গভীর হতেই আনাস্তাসিয়া নিজের শরীরের ভার রিকার্ডোর বুকে ছেড়ে দেয়। কানের লতিতে আলতো কামড় অনুভব করতেই আনাস্তাসিয়া মৃদু আর্তনাদ করে উঠে। রিকার্ডো ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” তবে লজ্জাও পেতে জানো তুমি? ”
আনাস্তাসিয়ার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে রিকার্ডো হালকা স্বরে ডাকে তাকে।
” নাসিয়া? ”
” হুম? ”
” আমার দিকে ফিরো। ”
আনাস্তাসিয়া চুপচাপ রিকার্ডোর দিকে ফিরে। কিন্তু মুখ তুলে তাকায় না৷ রিকার্ডো আবার বলে,
” আমার চোখের দিকে তাকাও নাসিয়া। ”
আনাস্তাসিয়া ধীরে ধীরে তাকায় রিকার্ডোর দিকে। রিকার্ডো তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। চোখাচোখি হয় দুজনের। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার কানের দুল এবং গলার হার খুলে দেয় আলতো হাতে। আনাস্তাসিয়া প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই রিকার্ডো বলে উঠে,

” এতক্ষণ ধরে এগুলো পড়ে বসেছিলে কেন? কান লাল হয়ে আছে তোমার। ”
আনাস্তাসিয়া বলে,
” আমার খেয়াল ছিলো না। ”
রিকার্ডো বলে উঠে,
” তোমার কাউন্টেস হওয়ার মানে এই না নাসিয়া যে তোমার নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা থাকবে না। নিজেকে কষ্ট দিয়ে কখনো কিছু সইতে যাবে না তুমি আজকের পর থেকে। ”

আনাস্তাসিয়া ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রিকার্ডোর দিকে। আনাস্তাসিয়ার নিজেরও খেয়াল ছিলো না যা তাও রিকার্ডো খেয়াল করে ফেললো ভাবতেই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। রিকার্ডোর সম্মোহনী দৃষ্টি তাকে আকৃষ্ট করছে। আনাস্তাসিয়ার ঘোর লেগে যায়। কিছুক্ষণ আগের লজ্জা ভুলে সামান্য বেপরোয়া হয়ে পড়ে সে। আনমনে তার দু’হাত চলে যায় রিকার্ডোর কাধে। আনাস্তাসিয়ার দৃষ্টি পরখ করে রিকার্ডো নিজেই আনাস্তাসিয়াকে কাছে টেনে নেয়। উষ্ণ ছোঁয়ার মাতাল অনুভূতিতে যখন মত্ত হয়ে উঠে আনাস্তাসিয়া তখন আচমকা রিকার্ডো তাকে ছেড়ে দেয়। আচমকা রিকার্ডোর এহেন কান্ডে আনাস্তাসিয়া কিছুটা লজ্জা পায়। রিকার্ডো বলে উঠে,

” আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলেই গিয়েছি প্রায়৷ ”
” কি? ”
” তুমি বসো আমি আসছি। ”
এটা বলেই রিকার্ডো কক্ষে প্রবেশ করে। আনাস্তাসিয়া আর কোনো কথা না বলে ডিভানের একপাশে গিয়ে বসে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিকার্ডো একটা বেশ বড় কাঠের বাক্স হাতে বারান্দায় এসে উপস্থিত হয়। রিকার্ডোর হাতে এতো বড় বাক্স দেখে আনাস্তাসিয়ার ভ্রু জোড়ার মাঝে ভাজ পড়ে। সে প্রশ্ন করে বসে,

” এটা কি? ”
” আমাদের রাজ বংশের একটা রীতি হলো যে বিয়ের দিন রাতে স্ত্রীকে কিছু একটা উপহার দিতে হবে। আমি অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি দেওয়া যায়। এই প্রাসাদের একটি কক্ষে আমার মা বাবার অনেক জিনিসই রাখা ছিলো। সেগুলোর মধ্যে আমি এটা খুঁজে পাই। ”
এটুকু বলেই রিকার্ডো কাঠের বাক্সটা খুলে। বাক্স খুলতেই আনাস্তাসিয়া দেখতে পায় বাক্সের ভেতরে একটি বেহালা। আনাস্তাসিয়া উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠে,

” বেহালা? ”
” হ্যাঁ। এটা আমার মায়ের ছিলো। তিনি বেহালা বাজাতে জানতেন। এটার কিছু তন্তু পুরনো হয়ে গিয়েছিলো। তাই আমি এক বাদ্যকরের থেকে এটা ঠিক করিয়ে এনেছি পাশাপাশি নিজেও বাজানো শিখে নিয়েছি। ”
আনাস্তাসিয়ার চোখে মুখে উচ্ছ্বাস। সে বায়না ধরে রিকার্ডোকে যেন তাকে বেহালা বাজিয়ে শুনানো হয়। রিকার্ডো তার প্রেয়সীর কথা ফেলতে পারে না। রাজি হয়ে যায়। আনাস্তাসিয়া একপাশ হয়ে ডিভানে পা তুলে দ আকৃতিতে বসে। তার লম্বা গাউন মেঝের অর্ধেক ঢেকে রেখেছে। রিকার্ডো বারান্দার রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে বেহালা বাজানো শুরু করে। আনাস্তাসিয়া মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে তার স্বপ্ন পুরুষের দিকে। বেহালার রোমাঞ্চকর ধ্বনি তার হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রাসাদের প্রতিটা কোণে পৌঁছায় বেহালার সুর। সকলেই নিজ নিজ কক্ষ থেকে শুনতে পেরে বেরিয়ে আসে যে যার কক্ষের বারান্দায়। বেহালার শব্দ যে রিকার্ডোর কক্ষ থেকেই আসছে তা বুঝতে কারো বাকি থাকে না।

আরোণ এবং ক্যাথরিনও আজ এই প্রাসাদেই রয়ে গিয়েছে। তারাও বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই সুর উপভোগ করতে থাকে। অপরদিকে ম্যাথিউ তার বারান্দায় বসে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে৷ একই রাতে কারো জীবনে বসন্ত এসেছে তো কারো জীবনে বর্ষার ঘন কালো মেঘ। কেউ তার আরাধ্যের ফল সরূপ যেন চাঁদ পেয়ে গিয়েছে তো কেউ কেবল বামণ হয়ে দূর থেকে চাঁদকে দেখেই গেলো। যাকে চাওয়ার কিংবা ছোঁয়ার সাধ্যি তার নেই।

বেশ অনেকক্ষণ পর রিকার্ডো বেহালা বাজানো বন্ধ করে চোখ মেলে তাকায়। ডিভানের দিকে তাকাতেই দেখে আনাস্তাসিয়া গুটিসুটি মেরে ডিভানে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। রিকার্ডো হাতের বেহালাটা রেখে আনাস্তাসিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে আনাস্তাসিয়ার পাশে বসে নিষ্পলক তার দিকে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষণ। তারপর এগিয়ে গিয়ে আনাস্তাসিয়ার কপালে অধর ছোঁয়ায় সময় নিয়ে। আনাস্তাসিয়া ঘুমের মাঝেই সামান্য কেপে উঠে। রিকার্ডো চুপচাপ আনাস্তাসিয়াকে কোলে তুলে কক্ষে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর নিজেও তার পাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
” শুভ রাত্রি নাসিয়া। ”

ঘুম ভাঙতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে আনাস্তাসিয়া। পুরো কক্ষে একবার চোখ বুলায়। কক্ষের একপাশে বিছানা এবং ঠিক তার সামনে বরাবর দেয়ালেই রয়েছে ফ্যায়ারপ্লেস। ফায়ারপ্লেসের পাশেই রয়েছে একটা বিশাল টেবিল এবং একটি চেয়ার। টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু বই এবং কাগজপত্র। হয়তো রিকার্ডোর দরকারি জিনিসপত্র সেসব। কক্ষের একপাশে আরেকটি খোলা দরজা আছে। সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই আরেকটি কক্ষ। সেই কক্ষ জুড়ে তার এবং রিকার্ডোর সব পোশাক এবং অলংকার গুছিয়ে রাখা। তাছাড়াও কক্ষে একটি কাঠের ক্যাবিনেট, সোফা সহ আরো কিছু আসবাবপত্র আছে।

কাল রাতে আনাস্তাসিয়া এতো কিছু লক্ষ্য করে নি। তার খেয়ালই ছিলো না। কিন্তু এখন একবার চারিদিকে তাকিয়ে সবকিছু পরখ করে নেয় সে। বেশ পরিপাটি সবকিছু। রিকার্ডোর মতোই। কিন্তু রিকার্ডো কোথাও নেই। আনাস্তাসিয়া হঠাৎ লক্ষ্য করে বিছানায় তার পায়ের পাশে একটি নীল গাউন রাখা। গাউনের উপর কিছু অলংকার এবং একটি চিরকুট রাখা। আনাস্তাসিয়া এগিয়ে গিয়ে চিরকুটটা তুলে হাতে নেয়। সেখানে লেখা,
” তৈরি হয়ে নাও। কক্ষ থেকে বের হতেই একজন দাসীকে দেখতে পাবে। সে তোমাকে যেখানে নিয়ে আসবে তার সাথে চলে আসবে। ”

আনাস্তাসিয়া বেশি মাথা না ঘামিয়ে চুপচাপ তৈরি হতে চলে যায়। তৈরি হয়ে কক্ষ থেকে বের হতেই দাসীর সাথে একটি কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। প্রহরীরা দরজা খুলে দিতেই আনাস্তাসিয়া কক্ষে প্রবেশ করে। দেখে রিকার্ডো দু’হাত পিঠের পিছনে ভাজ করে দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলছে। কার সাথে কথা বলছে তা দেখতে পায় না আনাস্তাসিয়া কারণ তার দিকে পিঠ করে দান আছে সে। আনাস্তাসিয়া কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে রিকার্ডোকে ডাকে,
” রিক? ”
রিকার্ডো আনাস্তাসিয়াকে দেখতেই হেসে বলে,

” এসো নাসিয়া। তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে। ”
সাথে সাথেই সেই আগুন্তকঃ আনাস্তাসিয়ার দিকে ফিরে দাঁড়ায়। আগুন্তকঃকে দেখতেই আনাস্তাসিয়া অবাকের চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছায়। সে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
” ওরিয়ন? ”
ওরিয়ন হেসে বলে,
” শুভ সকাল কাউন্টেস। ”
রিকার্ডো বলে,
” তোমরা কথা বলো আমার একটু কাজ আছে। ”
ওরিয়ন বলে উঠে,

” আপনি চাইলে এখানে থাকতে পারেন কাউন্ট। আমার কোনো আপত্তি নেই। ”
রিকার্ডো হেসে উত্তর দেয়,
” আমার নিজের স্ত্রীর প্রতি আস্থা আছে। ”
এটুকু বলেই রিকার্ডো বেরিয়ে যায়। আনাস্তাসিয়া অবাক হয়ে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,
” ওরিয়ন? তুমি এখানে? কিভাবে? কবে এলে? ”
ওরিয়ন বলে,
” সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় অ্যানা। তুমি আমাকে উত্তর দাও যে রিকার্ডো যা সব বলে গেলো সব সত্যি? ”
আনাস্তাসিয়া প্রশ্ন করে,
” কি বলেছে ও তোমাকে? ”
ওরিয়ন আনাস্তাসিয়াকে বলে যে রিকার্ডো তাদের প্রণয়গাঁথা সম্পর্কে তাকে সব জানিয়েছে। আনাস্তাসিয়া উত্তর দেয়,

” হ্যাঁ। ”
” তবে ইনিই সেই পুরুষ যাকে তুমি মন দিয়ে বসেছিলে? ”
আনাস্তাসিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ওরিয়ন এবার বলে উঠে,
” তোমাকে সুস্থ, সবল এবং ভালো আছো দেখে খুব ভালো লাগলো অ্যানা। এখন আমার যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। ”
আনাস্তাসিয়া ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” কোথায় যাবে তুমি? ”
” গ্রীকে। আমি রোমানিয়ায় এসেছিলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা খুঁজতে। তা পেয়ে গিয়েছি। এখন আর এখানে থাকার আমার কোনো উদ্দেশ্য নেই। ”

এটুকু বলেই ওরিয়ন বেরিয়ে যেতে নেয়। আনাস্তাসিয়া পিছু ডেকে বলে উঠে,
” এতোদিন পর আমাদের দেখা হয়েছে আর তুমি এখন চলে যাবে? ”
ওরিয়ন ঘুরে তাকায়। আনাস্তাসিয়ার দিকে এগিয়ে এসে তার হাতে সেই ক্রুশের হারটি দিয়ে বলে,
” এটা তোমার। আর আমার এখন ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমি সবসময় প্রার্থনা করবো যেন আপনি ভালো থাকেন কাউন্টেস। ”
আনাস্তাসিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওরিয়ন হনহনিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে। আনাস্তাসিয়া ওরিয়নের যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার হাতের ক্রুশের হারটির দিকে তাকায়। মনে মনে সে বলে উঠে,
” আমি দুঃখিত ওরিয়ন। কিন্তু আমি প্রার্থনা করবো তুমিও যেন একজন উত্তম জীবনসঙ্গী পাও। আমি কখনো তোমার জন্য ছিলামই না। আমি কেবল রিকার্ডোর। আর কারো নয়। ”

আনাস্তাসিয়া এবং রিকার্ডোর থেকে বিদায় নিয়ে আরোণ, ক্যাথরিন এবং ক্যামেলিয়া বাসকোভ প্রাসাদে ফিরে আসে সন্ধ্যার দিকে। ক্যামেলিয়া রাস্তায়ই ক্যাথরিনের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই প্রাসাদে ফিরে ক্যাথরিন সাবধানে তাকে বিছানার পাশের ছোট্ট দোলনায় শুইয়ে দেয়। এই দোলনাটা ক্রিয়াস উপহার সরূপ দিয়েছে ক্যামেলিয়াকে। তার পৃথিবীতে আসার পূর্বেই ক্রিয়াস নিজে কাঠ কেটে এটা তৈরি করে। ক্যামেলিয়ার বোধহয় এটা বেশ পছন্দও হয়েছে। তাইতো আরামে চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকে দোলনায়।
ক্যামেলিয়াকে শুইয়ে দিয়ে ক্যাথরিন জামা পরিবর্তন করে নেয়। বেশ ক্লান্ত লাগছে তার। আরোণ প্রাসাদে ফিরে আর উপরে আসে নি। নিচে হলরুমে সকলের সাথে কথা বলছে। কথা শেষ করে আবার শিকারে বের হবে বলেছে। ক্যাথরিন বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখ বুজে আসে। মুহুর্তেই ঘুমে তলিয়ে যায় সে।

ক্যাথরিনরা চলে যাওয়ার পর আনাস্তাসিয়ার মন বেশ খারাপ হয়ে আছে। আজ সারাদিন রিকার্ডো বেশ ব্যস্ত। প্রধান সেনাপতির সাথে কোথায় যেন গিয়েছে। এখনো প্রাসাদে ফিরে নি। সারাদিন তাই ক্যামেলিয়ার সাথে সময় পার করেছে আনাস্তাসিয়া। ওরা চলে যাওয়ার পর একজন দাসীকে সঙ্গে নিয়ে সমগ্র প্রাসাদ ঘুরে দেখেছে সে। এতো বিশাল প্রাসাদ অথচ প্রহরী, দাস-দাসীদের ব্যতিত কেবল সেই একমাত্র মানুষ। রিকার্ডো, ম্যাথিউ, ক্যামিলো এরা তিনজনই ভ্যাম্পায়ার। বিরক্ত হয়ে একবার আনাস্তাসিয়া ভেবেছিলো সে ক্যামিলোর কাছে গিয়ে গল্প করবে। কিন্তু দাসী তাকে জানায় ক্যামিলো এবং ম্যাথিউ কেউই প্রাসাদে নেই। বিছানায় বসে রাগে ফুসতে ফুসতে আনাস্তাসিয়া বলে,

” পৃথিবীর প্রথম স্বামী যে কিনা বিয়ের পরের দিন স্ত্রীর কাছে আসার জন্য সারাদিনে একবারো সময়ই পায় নি। আজ আসুক। রিক হনুমানকে যদি আমি কৃষ্ণ সাগরের হাঙ্গরের পেটে চালান না করেছি তাহলে আমার নামও আনাস্তাসিয়া না। ”

আনাস্তাসিয়া বিছানায় হেলান দিয়ে রাগে ফুসতে থাকে। তখনই একজন দাসী দরজার কড়া নেড়ে দ্রুত এসে আনাস্তাসিয়াকে জানায় কাউন্ট প্রাসাদে ফিরেছে। এই দাসীকে আনাস্তাসিয়াই এই দায়িত্ব দিয়েছে। তার কেবল একটাই কাজ, রিকার্ডো প্রাসাদে ফিরলে সবার আগে আনাস্তাসিয়াকে তা জানানো। দাসী খবর দিয়ে বেড়িয়ে পড়তেই আনাস্তাসিয়া বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রিকার্ডো কক্ষে প্রবেশের জন্য দরজা খুলতেই আচমকা আনাস্তাসিয়াকে সামনে দেখে ভয় পেয়ে যায়। সাথে সাথে কক্ষে প্রবেশ করে সে দরজা লাগিয়ে দিয়ে আনাস্তাসিয়াকে একবার পরখ করে নেয়। নাকের ডগায় রাগ রাগ স্পষ্ট আনাস্তাসিয়ার। রিকার্ডো ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

” তুমি এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে কি দেখছো? তোমার সুদর্শন স্বামীকে? ”
আনাস্তাসিয়া হেঁটে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় চুপচাপ। তারপর কোনো কথা না বলেই একটা বালিশ তুলে হাতে নেয় সে। রিকার্ডো কিছু বুঝে উঠার আগেই সেই বালিশ আনাস্তাসিয়া তার দিকে ছুড়ে মারে। রিকার্ডো বলে উঠে,
” আরে! করছো কি? ”
” সুদর্শন নাকি বান্দর তা তুমি এখন টের পাবে। বিয়ের প্রথমদিন আমাকে সময় দেওয়ারও সুযোগ পাও নি তুমি৷ সারাদিন আমি একা কিভাবে পার করেছি তুমি জানো? ”
এটুকু বলেই আনাস্তাসিয়া আরেকটা বালিশ নেয় রিকার্ডোর দিকে ছুড়ে মারার জন্য। রিকার্ডো সাথে সাথে দৌড় দেয়। আনাস্তাসিয়াও রিকার্ডোর পিছনে ছুটতে থাকে৷ রিকার্ডো দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বলে,

” নাসিয়া। বিয়ের প্রথম দিনেই স্বামী নির্যাতন করছো? আবার আমাকে বান্দরও বলছো? তুমি জানো তোমার স্বামী কত সুদর্শন? রাজ্যের সকল মেয়েরা হা করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। ”
রিকার্ডোর কথা শুনে আনাস্তাসিয়া তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। আরো জোরে দৌঁড়াতে শুরু করে। বিছানার কাছাকাছি আসতেই রিকার্ডো দৌঁড়ানো থামিয়ে পিছে ফিরে আচমকা আনাস্তাসিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে। আনাস্তাসিয়া জুবুথুবু হয়ে আটকে রয় রিকার্ডোর বাহুডোরে। ছুটার চেষ্টা করেও লাভ হয় না বিশেষ। রিকার্ডো বাকা হেসে বলে উঠে এখন পারলে ছুটে দেখাও। আনাস্তাসিয়া তবুও ছুটার জন্য জোরে চেষ্টা করতেই দুজন আচমকা বিছানায় পড়ে যায়। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার উপর পড়ায় আনাস্তাসিয়া নড়তেও পারছে না। আবার নড়ার চেষ্টা করতেই রিকার্ডো এবার ধমক দিয়ে বলে উঠে,

” একদম চুপ। মোটেও নড়বে না আর। ”
আনাস্তাসিয়া রাগ চেপে রেখে চুপচাপ মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে শুয়ে থাকে। রিকার্ডো বুঝতে পারে বেশ ভালোই ক্ষেপেছে তার নাসিয়া৷ তাই রাগ ভাঙানোর চেষ্টা সরূপ সে কিছুটা ঝুকে আনাস্তাসিয়ার দিকে। আনাস্তাসিয়া চোখ বাকা করে তাকায় রিকার্ডোর দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রিকার্ডোর অধরের ছোঁয়া অনুভব করে সে৷ আনাস্তাসিয়া প্রথম কিছুক্ষণ বাধা দিলেও পরে নিজেও সাড়া দেয়৷
রিকার্ডো আজ নাসিয়া নেশায় মত্ত হয়েছে। উষ্ণ ছোঁয়া গভীর থেকে গভীরতম হতেই হঠাৎ রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার থেকে দূরে সরে যায়। আচমকা রিকার্ডোর এহেন কান্ডে আনাস্তাসিয়াও অবাক হয়। রিকার্ডো উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
” তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমার কিছু কাজ আছে। ”

আনাস্তাসিয়ার রাগ গাঢ় হয়। গতকাল রাতেও রিকার্ডো এরকম ব্যবহার করেছিলো। কিন্তু তখন আনাস্তাসিয়া আর তেমন গায়ে মাখে নি বিষয়টিকে। কিন্তু এখন তার আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে রিকার্ডো এহেন আচরণে৷ আনাস্তাসিয়া ক্রুদ্ধ স্বরে প্রশ্ন করে,
” কেন? ”
রিকার্ডো কিছু না বলে চুপচাপ চলে যেতে নেয়। কিন্তু হাতে টান অনুভব করতেই দাঁড়িয়ে পড়ে। আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর হাত ধরে রেখেই প্রশ্ন করে,
” কেন এমন ব্যবহার করছো? আমার কাছে আসতেই আচমকা এভাবে দূরে সরে যাচ্ছো কেন? আমাকে ভালো লাগছে না তোমার? ”
রিকার্ডো থমথমে গলায় উত্তর দেয়,
” তেমন কিছু না নাসিয়া। আমার কিছু কাজ বাকি।!
রিকার্ডো আবার যেতে নিলেই এবার আনাস্তাসিয়া তার সামনে গিয়ে কলার চেপে ধরে। আরো ঝাঝালো স্বরে বলে উঠে,

” আমার সামনে মিথ্যে বলে পাড় পাবে না তুমি। আমি ভুলিনি যে তোমাকে ক্যামেলিয়া হওয়ার পর সন্তানের কথা বলায় তুমি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলে। এমনকি কালকেও যখন ক্যাথরিন আমাদের সন্তানের জন্য আর্শীবাদ দিচ্ছিলো তখনও তোমার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গিয়েছিলো। তোমার সমস্যা কিসে? বাচ্চা তোমার পছন্দ না নাকি আমাকে? ”
রিকার্ডো তৎক্ষণাৎ বলে উঠে,
” তুমি বা বাচ্চা কোনোটাই আমার অপছন্দ না। আমি কেবল তোমাকে হারাতে চাই না। ”
আনাস্তাসিয়া অবাক হয়। প্রশ্ন করে,
” এই বিষয়ের সাথে আমাকে হারানোর কিসের সম্পর্ক? ”
রিকার্ডো কাপা স্বরে জবাব দেয়,
” কারণ আমার সন্তান তোমার গর্ভে এলে সে তোমাকে মেরে ফেলবে। ”
আনাস্তাসিয়া যেন আকাশ থেকে পড়ে। সে অবাক স্বরে প্রশ্ন করে,
” মানে? ”

” মানে স্পষ্ট নাসিয়া। তুমি একজন মানুষ। আর তোমার গর্ভে আমার সন্তান আসা মানে সে একজন ভ্যাম্পায়ার হবে। যার ফলে সে তোমার শরীরের সকল রক্ত শুষে নিবে। রক্তশূন্যতায় মারা যাবে তুমি। ”
আনাস্তাসিয়ার মাথা ভনভন করে ঘুরতে থাকে। রিকার্ডোর কলার ছেড়ে দিয়ে আচমকা সে বিছানায় বসে পড়ে ধপ করে৷ রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার সামনে বসে। নিজের হাতের মুঠোয় আনাস্তাসিয়ার হাত দুটি নিয়ে সে বলে উঠে,
” আমার সন্তান চাই না নাসিয়া। আমি নিসন্তান থাকতে রাজি কিন্তু আমার সন্তানের কারণে তোমার মৃত্যু আমি কখনো মানতে পারবো না। সেই সন্তানকে আমি কখনোই আদর করে নিজের কোলে তুলে নিতে পারবো না নাসিয়া৷ আমার জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তুমি৷ তুমি থাকলে আমার আর কিছু চাই না৷ এজন্যই তোমার কাছে গেলেও আমি নিজেকে সংবরণ করে নেই৷ ”

আনাস্তাসিয়া কোনো কথা বলতে পারে না। তার চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইছে। থেকে থেকে কান্নার দমকে কেপে উঠছে সে। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার কোলে মাথা রেখে কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠে,
” আমাকে ক্ষমা করো নাসিয়া। আমি জানি আমি স্বার্থপরের মতো কথা বলছি। কিন্তু তোমার জন্য আমি স্বার্থপর হতেও পিছুপা হবো না। ”

ঠান্ডা বাতাসে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় ক্যাথরিনের। বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে দখিনা বাতাস বইছে। ক্যাথরিন তাড়াতাড়ি উঠে বসে দরজা লাগানোর জন্য। দরজা লাগানোর জন্য যেতে যেতে বাতাসের প্রকোপে কক্ষের প্রায় অধিকাংশ মোমবাতি নিভে গিয়েছে। ক্যাথরিন তাড়াতাড়ি দরজা লাগাতে লাগাতে বলে,
” আচমকা আবহাওয়ার আবার কি হলো? ধূলিঝড় শুরু হবে নাকি? উফফ আরোণ এখনো ফিরলো না। ”
এটুকু বলে দরজা লাগিয়ে ক্যাথরিন দোলনার দিকে এগিয়ে যায় ক্যামেলিয়াকে দেখার জন্য। কিন্তু দোলনার কাছে গিয়ে ক্যাথরিন দেখে দোলনা খালি। ক্যাথরিনের মনে হালকা ধাক্কা লাগে। তবুও সে নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবে হয়তো ক্রিনা বা হান্নাহ হয়তো নিয়ে গিয়েছে। ক্যাথরিন রাতে একা থাকলে কেউ না কেউ প্রায়ই এসে তার খোঁজ নিয়ে যায়। ক্যামেলিয়া তখন ঘুমাতে না চাইলে তারা তাকে কোলে নিয়ে সম্পূর্ণ প্রাসাদ হাঁটে। তারপর ক্যামেলিয়া ঘুমায়৷ ক্যাথরিন বিলম্ব না করে দরজা খুলে বেরিয়ে প্রহরীদের প্রশ্ন করে,

” আমার কক্ষে কে এসেছিলো? ”
প্রহরীরা অবাক দৃষ্টিতে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর উত্তর দেয়,
” কক্ষে তো কেউই আসে নি। ”
ক্যাথরিনের বুক মোচড় দিয়ে উঠে। সে আতংকিত স্বরে প্রশ্ন করে,
” কেউ আসে নি মানে? ক্যামেলিয়া কোথায় তাহলে? ওকে কে নিয়ে গিয়েছে? ”
প্রহরীদের চোখমুখ ভীত দেখা যায়। ক্যাথরিনের মন কু ডাক গাইছে। সে ক্যামেলিয়ার নাম ধরে চিৎকার করে উঠে।

সদ্য প্রাসাদে ফিরেছে আরোণ। বাহিরে ধূলিঝড় শুরু হওয়ায় সে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। কিন্তু প্রাসাদে পা রাখতেই আচমকা ক্যাথরিনের চিৎকার শুনে সে ভয় পেয়ে উঠে। সকল নেকড়ে মুহুর্তেই যে যার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। আরোণ দৌঁড়ে উপরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। কিন্তু তার আগেই ক্যাথরিনকে সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে নামতে দেখা যায়। সকলের চোখে মুখেই আতংক। দৌঁড়ে নামতে নিয়ে গাউনে পা পেঁচিয়ে ক্যাথরিন পড়ে যেতে নেয়। আরোণ বাতাসের গতিতে গিয়ে ক্যাথরিনকে ধরে বুকের মধ্যে আগলে নেয়। আতংকিত স্বরে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে ক্যাথ? চিৎকার করলে কেন? কাদছো কেন? ”
ক্যাথরিন কাদতে কাদতে জবাব দেয়,

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৫৩+৫৪

” আমাদের মেয়ে আরোণ। ”
আরোণের বুক অজানা আতংকে নাড়া দিয়ে উঠে। কাপা স্বরে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে ক্যামেলিয়ার? ”
” ক্যামেলিয়া কোথাও নেই আরোণ। আমার মেয়েকে কেউ নিয়ে গিয়েছে। ”
এতটুকু বলেই ক্যাথরিন আরোণের বুকে পড়ে চিৎকার করে কাদতে থাকে। আরোণের শরীর ঝিমঝিম করে উঠে। মনে হচ্ছে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তবুও ক্যাথরিনকে বুকে আগলে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয় সে। ক্যাথরিন চিৎকার করতে করতে আরোণের বুকেই জ্ঞান হারায়।

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৫৭+৫৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here