মিতুর গল্প শেষ পর্ব 

মিতুর গল্প শেষ পর্ব 
অনন্য শফিক

আর আজমল মাস্টারের কানে যখন কথাটা পৌঁছাল তখন তার ভেতরে ভয়ংকর যন্ত্রণা শুরু হলো।
আজমল মাস্টার এটা কোনদিন আশা করেননি তার মেয়ের কাছে! তার হয়তোবা ধন সম্পদ নাই। কিন্তু ইজ্জত আব্রু ছিল।এটা নিয়ে তিনি নিজেই নিজেই গর্বিত হতেন। আনন্দ পেতেন। এবং এই ইজ্জত আব্রু নিয়েই তিনি এতো দিন বেঁচে থেকেছেন।আজ থেকে এই ইজ্জত আব্রুও তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে দূরে সরে গেল।তার আর বাঁচার কোন উপায় নাই। তিনি কাউকে এই মুখ আর কোনদিন দেখাতে পারবেন না!

মিতুকে সবাই দূর দূর করছে যেভাবে একটা কুকুরকে মানুষ দূর দূর করে। শুভকে তো মিতুর ছোট চাচা ঘাড় ধরে বাড়ি থেকেই বের করে দিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে।কত যে গালাগাল করেছেন শুভকে। বলেছেন, ভাইজান দুধ দিয়ে এতো দিন কাল সাপ পুষেছে। ছিঃ!
তারপর তিনি মিতুকেও মন্দ মন্দ কথা বলেছেন। শুধু কী তিনি একাই বলেছেন এসব?মিতুর মেজো চাচীও তো কম বলেনি! এমনিতেও ওই মহিলা বিষমুখী। তিনি এসে এমন সব নোংরা নোংরা কথা বলতে শুরু করলেন যে মিতুর গা গুলিয়ে বমি আসতে শুরু করলো একেবারে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ততক্ষণে অবশ্য অনেক পাড়া প্রতিবেশী এসেও এখানে উপস্থিত। তাদের সবাই মিতুকে দূর দূর করছে।কেউ কেউ বলছে, বিয়ের পরেও এইসব! এদের দু’টুকেই জেন্দা কবর দেয়া উচিৎ!
কেউ বলছে,আরে না।কবর দিলে তো শেষ।শইল্যের তেজ মিটাইবার লাইগা এরে বেশ্যাখানায় পাঠানো উচিৎ! এমন সুন্দর জামাই থুইয়া যে পর পুরুষের কাছ থাইকা মজা নিতে চায় হের লাইগা বেশ্যাখানায় উপযুক্ত!
এইসব কথা শুনে মিতুর ইচ্ছে করছে মরে যেতে।সে জানে না এই জীবনে বড় কোন পাপ করতে। কিন্তু পাপ না করেও এতো বড় শাস্তি সে পাচ্ছে কেন? মিতু কিছুতেই বুঝতে পারছে না।

ধ্রুব তাকে ভুল বুঝেছে।ধ্রুবর ভুল ভাঙিয়ে দিতে সে ধ্রুবর কাছে গিয়ে ধ্রুবর পা ধরতে চেয়েছিল।বলতে চেয়েছিলো সবকিছু খুলে। কিন্তু ধ্রুব কিছু শোনা তো দূরের কথা।এক লাথি দিয়ে আগেই দূরে ছিটকে ফেলে দিয়েছে মিতুকে।মিতু তখন দূর থেকেই কাঁদতে কাঁদতে বলেছে,’আমি এসব করিনি।আমরা তো শুধু গল্প করছিলাম!’
গল্প? অন্ধকার ঘরে পর পুরুষের সাথে কী গল্প গুজব হয়? এইসব সাত পাঁচ কথা বললেই হলো?এতো দেখি ঠাকুর ঘরে কে রে,আমি কলা খাই নার মতো অবস্থা!
সবাই এই কথা বলে উঠলো সমস্বরে।

ধ্রুব বললো,’তো মুরুব্বিরা আপনারাই বলেন এই পাপিষ্ঠ মেয়ের সাথে কী ঘর করা যায়?
উপস্থিত ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন,মাথা ভর্তি গোবর ওয়ালা সমাজপতিরা বললো, উঁহু।পাপ হবে। আল্লাহ নারাজ হবে এর সাথে সংসার করলে!
অবশেষে তালাকের ব্যবস্থা হলো।
অবশ্য তালাক দেয়ার আগে ধ্রুব গেল আজমল মাস্টারের কাছে। আজমল মাস্টারের তখন বাঁচা মরা অবস্থা। শরীরে যে প্রাণটুকু আছে তাই।বল নাই এক রত্তিও।এই মানুষটির কাছে গিয়েই ধ্রুব চেঁচিয়ে বলে উঠলো,’কেমন মেয়ে জন্ম দিয়েছেন হ্যা?যে রাত দুপুরে পর পুরুষের সাথে মেলামেশা করে! ছিঃ! এমন মেয়ের মুখ দেখার চেয়ে তো মরা ভালো!
আজমল মাস্টারের কথা বলার শক্তি নাই। তার চোখ থেকে শুধু টলটল করে গরম জল বেরিয়ে এলো। এবং তখনই তার মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু হলো।

এই মৃত্যু যন্ত্রণার ভেতরেই দেহ থেকে প্রাণ ত্যাগ করতে করতে তিনি শুনলেন ধ্রুব মিতুকে ডেকে এনেছে। তারপর চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে শুনিয়ে সে বলেছে,এক তালাক দুই তালাক তিন তালাক।
আজমল মাস্টার তিন তালাক শোনার পর পরই ইন্তেকাল করেছেন!

আজমল মাস্টারের মৃত্যুর পর ঘটনা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করলো। আজমল মাস্টারের ভাইয়েরা এতোই ক্ষীপ্ত হলেন মিতুর প্রতি যে তারা মিতুকে আজমল মাস্টারের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিলো না।তারা বললো, এমন পাপিষ্ঠ মেয়ে যদি আমার ভাইয়ের কাছে আসে তবে আমাদের ভাই জাহান্নামবাসী হবে!

মিতু কতো কন্নাকাটি করলো এতে কাজ হলো না। আজমল মাস্টারকে দাফন করার আগেই মিতুকে এ বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য বের করে দেয়া হলো। এমনকি এই গ্রামের মানুষেরাও তাকে বয়কট করলো। নিরুপায় মিতু বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে বিদ্রোহ করলো। এই দেশে অবশ্য মেয়েরা কখনোই এমন প্রতিবাদ করতে পারে না। কিন্তু মিতু প্রতিবাদ করলো।জোর গলায় উপস্থিত সব কজন মানুষকে লক্ষ্য করে বললো,’এই আপনারা হলেন সেই সব মানুষ যাদের জন্য আমাদের অবলা মেয়েগুলো পতিতা হয়!আপনারা কোন কিছু ভালো করে না জেনে না শোনেই ফতুয়া দিয়ে বসেন।
মেয়েদের শাস্তি দেন।গ্রাম থেকে পরিত্যাক্ত করেন। তারপর এই অসহায় মেয়েগুলো কোথাও বেঁচে থাকবার মতো জায়গা না পেয়ে কোথায় যায় জানেন? পতিতালয়ে! আপনাদের এতে আনন্দ হয়। বিশেষ করে আপনাদের পুরুষ কূলের।কেন আনন্দ হয় জানেন?কারণ আপনারা আরেকটা নতুন মানুষ পেয়ে যান ভোগ করার জন্য।অতি সস্তায়। পকেটের কিছু ভাঙতি টাকা হলেই চলে। লজ্জা করে না আপনাদের?আজ আমার সাথে আপনারা যা করছেন কাল আপনাদের মেয়ের সাথেও কী এমন হবে না?আর যে সমস্ত মেয়েরা আমায় অপবাদ দিয়ে বকাঝকা করে নিজেদের পূণ্যবতী ভাবছেন তারা একটু চিন্তা কইরেন প্লিজ! আপনি নিজেও জানবেন না পুরুষের কোন ছলে আপনি নিজেও এমন মহা পাপিষ্ঠা হয়ে গ্রাম ছাড়া হবেন!

এ দেশের মেয়েদের অপরাধ করতে হয় না।তারা যদি তাদের সাথে হওয়া অপরাধের জন্য মুখ খুলে তবেই তারা অপরাধী হয়ে যায়। নারীবাদী,ধর্ম বিদ্বেষী আর বেশ্যা পতিতার উপাধি পায়।আজ আমি হয়তো বা নিরুপায় হয়ে এই গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছি। তবে মনে করবেন না আমি কোন পতিতালয়ে যাবো!আমি নিজেকে শক্তিশালী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কোথাও চলে যাবো।আর ওখান থেকে আমি শক্তিশালী হয়েই ফিরে আসবো। এবং এসে আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের আমি কড়ায় গন্ডায় হিসেব নিবো!’

মিতুর এইসব কথা গ্রামের মোড়লদের কানে ঢুকেনি। মেয়েরাও স্বতর্ক হয়নি! মেয়েরা আরো তার দিকে থুথু ছিটিয়ে দিতে লাগলো।আর বলতে লাগলো,’ছিঃ ছিঃ লজ্জা শরম বলতে নাই!একে তো করছে চুরি তার উপরে সিনাজুরি!’
তারপর ওরা ঘাড় ধরেই মিতুকে অপমান অপদস্থ করে গ্রাম থেকে বের করে দিলো।
তারপর মিতু কোথায় গেল কে জানে! আমিও জানি না। হয়তো বা সে শুভকে বিয়ে করে দূরের কোন শহরে থেকে নিজেকে প্রস্তুত করছে গ্রামে ফেরার জন্য। তার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য!

তবে সে প্রতিশোধ নিতে পারবে কি না তা আমি জানি না। এই দেশে নারীর পক্ষে কথা বললে স্বয়ং নারীরাই তা পছন্দ করে না।তারা বরং পুরুষের পায়ের জুতো হয়ে পায়ের তলে পিষ্ট হতেই পছন্দ করে। মিতুকেও হয়তো বা ওরা এগিয়ে যেতে দিবে না। মিতুকে সারাদেশ এক ঘরে করবে। তারপর মিতুর কোথায় জায়গা হবে?
অন্য কোন দেশে?

অন্য কোন দেশে গিয়েও কী মিতু তার অধিকার ফিরে পাবে?
এই পৃথিবীতে কী নারীদের কোন মূল্য আছে? কোন ঘর আছে?
কোন দেশে আছে?
কেন নেই?কারণ এর জন্য দায়ী নারীরাই।নারীরা সব সময় পুরুষের যৌন দাসী আর কর্ম দাসী হয়ে থাকতেই পছন্দ করে। অনেকেই মনে করে ধর্ম এটাই বলেছে।অথচ যারা এই কথা বলে তারা ধর্ম গ্রন্থ পড়েনি।ধর্ম গ্রন্থ পড়লে তারা জানতো স্বামীর দাসী বাঁদি হওয়া ধর্মের বিধান নয়।এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরি করা বিধান!

মিতুর গল্প পর্ব ৫

গল্পটা ওখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু আরো দুটো লাইন আমার বলতে হবে।ইরম আর ধ্রুবকে নিয়ে। এইসব ইরম ধ্রুব আমাদের ঘরে ঘরে আছে।পাঠক আপনি তাকিয়ে দেখুন। আপনার ঘরের কেউও হতে পারে। আমাদের সমাজের নারীরাই ইরম আর ধ্রুবদের হাতে নিজেদের জীবন সঁপে দেয়।কতো কতো ইরমেরা কায়দা করে তাদের ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে যাচ্ছে। বোনের বরেরা ,ননদের বরেরা,দেবরেরা ।নারীরা চুপ থেকে এসব সহ্য করে যাচ্ছে।সহ্য করছে নিজেদের সংসার টিকিয়ে রাখতে।মুখ খুললে দোষটা ভাসুর দেবর বোন জামাইয়ের হবে না যে।দোষটা একান্তই হবে ধর্ষিতা নারীটির। এবং এখানেও আমাদের নষ্ট পুরুষদের সমর্থন করবে একজন নারী।ধর্ষিতা মেয়েটির শাশুড়ি।তিনিই যুক্তি তর্ক করে বের করবেন তার ছেলে কিংবা তার মেয়ের বর দোষী নয়। মূল দোষী তার পুত্রবধূ। সুতরাং তাকে সমাজচ্যূত করতে হবে। আর ধ্রুব ইরমদের দিতে হবে মুক্তি।ওরা এই সমাজে ভদ্র বেশেই বসবাস করবে। এবং নতুন করে নতুন নতুন অবলা নারীদের শিকার করতে শুরু করবে!

আর সেইসব নারীরা চুপ করে এসব সহ্য করবে। সংসার টিকিয়ে রাখতে।কেউ কেউ হয়তো বা মিতুর মতো মুখ খুলবে। কিন্তু এই মুখ খোলাটাই তার জন্য কাল হবে!
সুতরাং নারীগণ শুদ্ধ হয়ে যান।আজ আপনি একজন নারীর সাথে অনাচার করলে আগামীকাল কিন্তু আপনার দিন আসছে। আপনি এরকম অনাচারের শিকার না হলেও আপনার মেয়ে যে এসবের শিকার হবে না তা আপনাকে কে বলেছে?মনে রাখবেন।সময় পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু।সময় ঘূর্ণয়মান। বারোটার পর আবার বারোটা বাজে। একটার পর একটা। আপনিও যা করছেন তাও ফেরত আসবে।আজ অথবা কাল। প্রস্তুত থাকেন!

( লেখাঃ অনন্য শফিক ) এই লেখিকার আরও লেখা গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন এই গল্পের সিজন ২ পড়তে চাইলেও এখানে ক্লিক করুন