মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ গল্পের লিংক || লেখিকাঃ দিশা মনি

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১
লেখিকাঃ দিশা মনি

নিজের হবু পাত্র হিসেবে এসএসসি পরীক্ষার ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখে অবাক হয়ে গেলো ইভানা। সাথে সাথেই লাফিয়ে উঠে বলল,
‘এই ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য আমি ম্যাট্রিক ফেল করেছি, ব্যাটা বজ্জাত আমার পাশ থেকে নড়ছিলই না। নাহলে ঠিকই পাশের জনের খাতা দেখে লিখে পাস করতাম। একে তো আমি ম’রে গেলেও বিয়ে করবো না।’

কথাটা বলেই এক ছুটে নিজের রুমে চলে আসে ইভানা। পুরো নাম তানজিলা ইসলাম ইভানা। তবে তার দাদা বাদে কেউই তানজিলা বলে ডাকে না। গতবছর এসএসসি দিয়েছে সে। কিন্তু পাস করতে পারেনি। যার ফলে এই এক বছর তাকে নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখতে হয়েছিলা। কারণ বাইরে গেলে যখন কেউ রেজাল্টের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করত তখন লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতো না। আবার অনেকে তো টিটকারি করতো তাকে নিয়ে। যার কারণে তার জীবন পুরোপুরি নরক হয়ে গেছিল। এসবের জন্য সে এই ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়ী করে। তাই এখন যখন তার পাত্র হিসেবে এই ম্যাজিস্ট্রেট এসেছে তখন তার মাথায় রাগ উঠে গেল। মনে পড়ে গেল এতদিনের সব অপমানের কথা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বড়লোক বাবার আদরের ছোট মেয়ে সে। তার বাবা তারিকুল ইসলাম শহরের একজন স্বনামধন্য ডাক্তার। ইভানার পড়াশোনার পেছনে কম চেষ্টা করেন নি তিনি। কিন্তু ইভানা একদমই বই নিয়ে বসতে চায় না। যার কারণে আজ তার এই দশা। এমনকি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়েও ইভানা কোনরকমে পাস করেছে। অথচ তার বড় বোন তোহা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। তোহাও নিজের বাবার মতো বড় ডাক্তার হওয়ার আশা করে।

দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিয়েও খারাপ রেজাল্ট করার কারণে ইভানার উপর খুব রেগে গেছে তার বাবা। যার ফলে ইভানার বিয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যেই মেয়ে পড়াশোনা করে না, তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাইয়ে কি লাভ?
এই নিয়ে অবশ্য ইভানার কোন মাথাব্যথা নেই। পড়াশোনা তার এমনিতেও ভালো লাগে না। কিছুদিন আগেই তার ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে, তাই এখন আর বিয়ে করতে বাধা নেই। ইভানার আপত্তি শুধু একটা যায়গাতেই, তার জন্য তার বাবা যাকে পাত্র হিসেবে নির্বাচিত করেছে তাকে সে বিয়ে করতে পারবে না।

এই কারণে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয় ইভানা। অতঃপর রুমে এসে ফোন লাগায় তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী আনহাকে। আরহা ইভানার বান্ধবী হলেও পড়াশোনায় অনেক ভালো, একজন মেধাবী ছাত্রী। এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন A+ পেয়েছিল। এখন সে ইন্টারে পড়ছে। এসএসসি পরীক্ষায় ইভানার পিছনেই আরহা বসেছিল। ইভানা মূলত আরহার ভরসাতেই পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। ভেবেছিল আরহার দেখে লিখে পাস করবে।

প্রথম কয়েকটা পরীক্ষা ঠিকই চলছিল কিন্তু গণিত পরীক্ষার দিন বাধে বিপত্তি। ম্যাজিস্ট্রেট ফারহান কবীর খবর পান যে পরীক্ষার হলে নাকি খুব দেখাদেখি চলে। এই খবর কানে আসা মাত্রই তিনি রেগে যান। কারণ পরীক্ষায় অনিয়ম তার পছন্দ না। সেই কারণে গণিত পরীক্ষার দিন তিনি সারাক্ষণ হলেই থাকেন। সবার মধ্যে ইভানা একটু এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল জন্য তিনি ইভানার দিকে লক্ষ্য রাখেন। যার কারণে ইভানা পিছনে ঘুরে আনহার দেখে লিখতেই পারে না৷ যার ফলস্বরূপ সে পরীক্ষায় ফেল করে। কারণ গণিতের কোন অংকই সে পারে না৷

ফোন সমান তালে বেজে চলেছে। কিছু সময় পর আনহা ফোন রিসিভ করতেই ইভানা বলে ওঠে,
‘জানিস দোস্ত কি হয়েছে?’
আনহা সবে বই খুলে পড়তে বসেছে। তার খুব ইচ্ছা বুয়েটে চান্স পাওয়ার। তাই অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে। এমন সময় ইভানার ফোন আসায় কিছুটা বিরক্ত হয় আনহা। তবে বান্ধবীকে তো আর উপেক্ষাও করতে পারে না। তাই আনহা যথাসম্ভব শান্ত থেকে বলে,
‘তুই না বললে জানব কিভাবে?’

আনহার এমন ত্যাড়া কথায় রাগ উঠে ইভানার। তবে এখন কথা বলাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ জন্য বলে,
‘আব্বু আমার বিয়ে দিতে চাইছেন।’
‘এটা তো ভালো কথা। তুই তো পড়াশোনা করতে পারিসও না করতে চাসও না। বিয়ে করে নে, সেটাই ভালো।’
‘বিয়ে নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে জানিস? আমাদের এসএসসি পরীক্ষার সময় যেই ম্যাজিস্ট্রেটের ডিউটি ছিল তার। ঐ শা’লার জন্য আমি পাস করতে পারিনি। আর আমি কিনা ওকে বিয়ে করব?’
ইভানার কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে যায় আনহা। কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে ইভানাকে পরামর্শ দেয়,

‘তুই বরং বিয়েটা করেই নে।’
‘কি বলছিস এটা তুই? যার জন্য ফেল করলাম তাকে বিয়ে করব!’
‘আমার কথাটা আগে শোন, ঐ ম্যাজিস্ট্রেটের উপর তোর অনেক রাগ তাইতো?’
‘রাগ থাকবে না? তুই তো দেখেছিস গণিত পরীক্ষার দিন কেমন শত্রুতা করেছিল আমার সাথে।’
‘সেইজন্যই তো বলছি তুই বিয়েটা করে নে। বিয়ের পর শোধ তুলতে পারবি।’
ইভানা চকিত হয়ে বলে,

‘বাহ, তুই একদম ঠিক বলেছিস। এটা তো আমি ভেবেই দেখিনি। এইজন্য তুই A+ পাওয়া ছাত্রী আর আমি ফেলটুস ছাত্রী।’
‘আচ্ছা। যা বললাম তাই কর। আমার অনেক পড়া বাকি আছে। পরে কথা হবে। বাই।’
‘উম্মা দোস্ত বাই।’
ফোন রেখে দিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নেয় আনহা। অতঃপর বিড়বিড় করে বলে,
‘ইভানার বিয়েটা হলে তো ভালোই হবে। আরেকটা বিয়ে খেতে পারব।’

ফারহান অনেকক্ষণ থেকে সোফায় বসে আছে। তবে এবার তার সত্যি অনেক বিরক্ত লাগছে। শুধুমাত্র নিজের মায়ের কথায় আজ পাত্রী দেখতে এসেছিল সে। ফারহানের তো এখন বিয়েশাদি করার কোন ইচ্ছাই নেই৷ কিন্তু আজকাল তার মা বিয়ের জন্য এত চাপ দিচ্ছে যে, মেয়ে দেখতে আসতেই হলো। কিন্তু কে জানতো, এমন একটা মেয়েকে দেখতে আসতে যে কিনা ম্যাট্রিক ফেল। এমনকি এখন তার ফেল করার জন্য সে ফারহানকে দোষ দিচ্ছে। ফারহানের ইচ্ছা ছিল এখনই এখান থেকে উঠে যাওয়ার কিন্তু তার মা ফারজানা বেগম তাকে চুপচাপ বসে থাকতে বলেছে। ফারহান সবার সামনে মায়ের অবাধ্য হতে চায়না জন্যই এতক্ষণ যাবৎ বসে আছে।

তারিকুল ইসলাম সোফায় বসে ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। নিজের ছোট মেয়ের উপর রাগ তার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। একেই তো পরীক্ষায় ফেল করে তার মান সম্মান নষ্ট করে দিয়েছে তার উপর এখন যেসব কাণ্ড করছে তাতে তার মুখ আরো ছোট হচ্ছে। তারিকুল ইসলাম ক্ষুব্ধ গলায় নিজের স্ত্রী ইশরাত খাতুনকে বললেন,
‘তোমার মেয়েকে ডেকে আনো এখুনি। কি পেয়েছে টা কি ও?’
‘আমাকে ডাকতে হবে না। আমি এসে গেছি।’

গুটি গুটি পায়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল ইভানা। এসে একপলক তাকালো ফারহানের দিকে। ফারহান হয়তো প্রথম দেখায় তাকে চিনতে পারেনি কিন্তু ইভানা ঠিকই চিনে গেছে। আমরা যাকে ঘৃণা করি বা ভালোবাসি তাকে এত সহজে ভুলতে পারিনা। সেখানে ইভানা এই লোকটাকে তার ম্যাট্রিক ফেল করার একমাত্র কারণ মনে করে৷ তাই এক বছর পরেও মুখটা খুব ভালো করেই মনে রেখেছে। ফারহানের দিকে তাকিয়েই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয় ইভানা,
‘আমি প্রতিশোধ নেবোই। ফেল করার কারণে যত অপমান আর অবহেলা সহ্য করেছি তার শোধ আপনার থেকেই তুলব মিস্টার ম্যাজিস্ট্রেট।’

তারিকুল ইসলাম ইভানাকে শাসনের ভঙ্গিমায় বলেন,
‘তুমি কোন সাহসে এখান থেকে উঠে গেলে? আর কিরকম ব্যবহার করলে ছি!’
ইভানা নিজেকে সামলে নেয়। প্রতিশোধ নিতে চাইলে এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। তাই বেশ নম্রভাবে বলে,
‘দুঃখিত, আসলে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে গেছিলাম। গত একবছরের বিশ্রী স্মৃতিগুলোর জন্যই,,,’

‘তুমি ফেইল করেছ সেটা তোমার দোষ, অন্যকারো না। আমি কি তোমার কোন কমতি রেখেছিলাম? প্রাইভেট, কোচিং-এ হাজার হাজার টাকা ঢেলেছি। কিন্তু তুমি তো ফাকিবাজি করে গেছ। যার ফলও হাতেনাতে পেয়েছ।’
ইভানাকে তাচ্ছিল্য করে উক্ত কথাগুলো বলেন তারিকুল ইসলাম। ইভানা মাথা নিচু করে থাকে। তারিকুল ইসলাম এবার ফারহানের মা ফারজানা বেগমের কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিমায় বলেন,

‘আমার মেয়ের ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে থাকলে দুঃখিত। ও যেমন ব্যবহার করল তারপর আমি আর কোন মুখে আপনাদের কিছু বলি। আমার এই মেয়ে আপনার ছেলের যোগ্য নয়। আপনারা শুধু শুধু এখানে এসে নিজের সময় নষ্ট করলেন।’
ফারজানা বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘আপনি ভুল ভাবতাছেন। আমাদের সময় মোটেই নষ্ট হয় নাই। আপনার মেয়েকেই আমি পোলার বউ করে ঘরে তুলমু।’

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ২