মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ৪

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ৪
লেখিকাঃ দিশা মনি

ইভানা নিজের ঘরেই বসে আছে। মন মেজাজ বেশি একটা ভালো নেই তার৷ আজ সকাল থেকেই বাড়িতে অনেক অশান্তি চলছে। হাশেম আলী ক্ষুব্ধ হয়েছেন তারিকুল ইসলামের উপর। মূল কারণ কেন তিনি ইভানার বিয়ের ব্যাপারে হাশেম আলীকে কিছু জানিয়ে বিয়েটা ঠিক করলেন। নিজের নাতনীর উপর কি তার কোন অধিকার নেই?

ইভানার জন্য বিয়েটা করা অনেক
জরুরি। নাহলে সে ফারহানের উপর কিভাবে প্রতিশোধ নেবে? সেই কারণেই ইভানা সিদ্ধান্ত নিলো হাশেম আলীকে বোঝানোর উদ্দ্যেশ্যে তার ঘরের দিকে রওনা দিলো। নিজের দাদার রুমে গিয়ে সে দেখল তার দাদা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ইভানা দাদার রুমে ঢুকে মিষ্টি হেসে বললো,
‘তুই কি মন খারাপ করেছ দাদাজান?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হাশেম আলী কোন উত্তর দিলেন না। ইভানা এসে তার পাশে বসে পড়ল। অতঃপর তার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
‘আমি জানি তোমার মন খারাপ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আমি তোমার একমাত্র নাতনী,আমাকে নিয়ে তোমার কত স্বপ্ন সেখানে আব্বু তোমার অনুমতি না নিয়ে আমার বিয়ের কথা ফাইনাল করে ফেললো। কিন্তু দাদাজান এই বিয়েটা আমি করতে চাই।’

‘তুই যদি এই বিয়েতে রাজি থাকিস তাহলে আমার অমত করার কিছু নেই। তুই তো জানিস তানজিলা তোর সুখেই আমি সুখ খুজে পাই।’
ইভানা মৃদু হাসল। তার দাদাজানের এরপর আর আপত্তি করার কোন আশংকা নেই। হাশেম আলী কিছু সময় চুপ থেকে বললেন,

‘যা সিদ্ধান্ত নিবি ভেবে চিন্তে নিস। বিয়ে কিন্তু কোন ছেলেখেলা নয়, এটা জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।’
ইভানা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। অতঃপর দাদাকে বিদায় জানিয়ে রুম থেকে বের হয়ে চলে আসে রান্নাঘরে। যেখানে ইশরাত খাতুন রান্নাবান্নায় ব্যস্ত ছিলেন। ইভানা ইশরাত খাতুনের গা ঘেষে দাড়ায়। ইশরাত খাতুন ইভানার মনোভাব ঠাহর করতে পারলেন না। তাই ইভানাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘তুই কি কিছু বলবি আমায়?’
‘আম্মু আমি রান্না শিখতে চাই।’
‘তুই রান্না শিখে কি করবি?’
‘ওহ আম্মু তুমি বুঝতে পারছ না। দুদিন পর আমার বিয়ে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির সবাইকে রেধে খাওয়াতে হবে না?’
‘তুই কি রান্না করতে পারবি?’
‘চেষ্টা করে দেখি।’

ইশরাত খাতুন মানা করলেন না। ইভানাও খুন্তি হাতে নিয়ে রান্না করার প্রস্তুতি নিলো। কিছু সময় চেষ্টা করেই হাফিয়ে উঠল সে। রান্না করা তো আর এত সহজ ব্যাপার না। গ্যাসের তাপ তার একদম সহ্য হচ্ছিল না। তার উপর ডাল নাড়াচাড়া করতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা হয়ে গেল। ইভানা বিরক্ততি ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে বলল,

‘ধুর, আমার দ্বারা এসব রান্নাবান্না হবে না। আমি চললাম।’
কথাটা বলে এক মুহুর্ত রান্নাঘরে দাড়ালো না ইভানা। দ্রুত পায়ে হেটে বেরিয়ে এলো৷ ইশরাত খাতুন মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
‘এই মেয়ে যে বিয়ের পর কি করবে আল্লাহ মালুম।’

আকাশে কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। সকাল থেকে ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজমান। আজকের দিনটা পুরোই বৃষ্টিমুখর। এই বাদলা দিনে ইভানা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। ইশরাত খাতুন নিজের মেয়েকে ডাকতে এসে বিরক্ত হয়ে গেলেন। সকাল ১০ টা বেজে গেছে অথচ মেয়েটা এখনো ঘুমোচ্ছে! এই মেয়ের নাকি ক’দিন পর বিয়ে! ইভানাকে বেশ কয়েকবার ডাক দিলেন তিনি। কিন্তু ইভানার ঘুম থেকে ওঠার কোন নামই নেই। তাই বাধ্য হয়ে একপ্রকার টেনে ঘুম থেকে তুললেন।
ইভানা বিরক্ত হলো প্রচুর। নিজের মায়ের উপর রাগ দেখিয়ে বললো,

‘আরেকটু ঘুমালে কি অসুবিধা হতো আম্মু? আজকের আবহাওয়া কত সুন্দর।’
‘আবহাওয়া সুন্দর জন্য কি সারাদিন ঘুমাবি নাকি? আজ বাদে কাল তোর বিয়ে। এখন একটু নিজের বদভ্যাস গুলো বদলানোর চেষ্টা কর। আমি তোর মা জন্য এসব সহ্য করি। সবাই তো আর করবে না।’

ইভানা চুপচাপ বিছানা থেকে উঠে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ চুপ থাকল। অতঃপর আবেগপ্রবণ হয়ে বললো,
‘আমি এখন থেকেই তোমার মূল্য বুঝতে পারছি আম্মু। আমি জানি আমি মেয়ে হিসেবে একদম ভালো নই। খুব খারাপ মেয়ে আমি। কিন্তু আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া যে তোমার মতো মা পেয়েছি আমি। মা হিসেবে তুমি একদম পার্ফেক্ট।’
ইশরাত খাতুনের চোখে জল চলে এলো। তবে তিনি খুব সন্তপর্ণে সেই জল মুছে ফেললেন। ইভানার উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
‘এখন ছাড়া আমাকে। রান্না বসিয়ে এসেছি।’

ইভানা ছেড়ে দিতেই ইশরাত খাতুন ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলেন। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা যে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। একজন মায়ের কাছে সবথেকে আপন হয় তার সন্তান। কত আদর যত্নে সেই সন্তানকে মানুষ করে তারা। সেই সন্তানকে যখন চিরকালের মতো অন্য কারো বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হয়, সেই কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

দুপুরে খাওয়ার টেবিলে লাঞ্চের জন্য বসেছে সবাই। শুরুর দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও খাওয়ার মাঝখানে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়। তারিকুল ইসলাম পরিবারের সবাইকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,
‘ফারহানের মায়ের সাথে আজ কথা হলো। তিনি বললেন এই সপ্তাহের মধ্যেই বিয়েটা দিতে চান।’
হাশেম আলী তেতে উঠে বলেন,

‘এটা কি ধরণের কথা? এক সপ্তাহের মধ্যে কিভাবে সম্ভব? আমার আদরের নাতনীর বিয়ে বলে কথা। আমার কত সাধ যে বড় অনুষ্ঠান করে, ধুমধাম করে বিয়ে দেবো।’
‘উনি বলেছেন খুব সাদামাটা ভাবেই বিয়েটা দিতে চান৷ খুব কাছের খুব আত্মীয় স্বজন ছাড়া কেউ আমন্ত্রিত থাকবে না।’
‘এটা আমি মানবো না। এত সাধারণভাবে আমার নাতনির বিয়ে হবে না। তুই এই শহরের একজন নামীদামী ডাক্তার। তোর কত চেনা জানা লোক আছে। তাছাড়া আমাদের কত আত্মীয় স্বজন আছে। আমার নাতনীর বিয়েতে সবাইকে দাওয়াত দিবো। সবাই আসবে, হই হুল্লোড় করে বিয়ে হবে। সেখানে এসব কি বলছিস তুই?’

‘আমি কিছু বলছি না আব্বু, যা বলার পাত্রর মা বলেছেন।’
‘এমন হলে এই বিয়েটা দিতে হবে না। আমার নাতনী এতটা ফেলনা হয়ে যায় নি যে ওকে যেন তেন ভাবে বিয়ে দেবো।’
‘তোমার নাতনী যা রেজাল্ট করেছে তাতে ওর জন্য যে এত ভালো পাত্র পাওয়া গেছে সেটাই অনেক। তাই এই বিয়েটা আমি ভাঙ্গতে চাইছি না।’
হাশেম আলী ভাতে পানি ঢেলে দিয়ে বললেন,

‘তোদের যা ইচ্ছা কর। আমার মতামতের তো আজকাল কোন দামই নেই। আমি যে একজন মুরুব্বি মানুষ আসি সেটা তোদের খেয়ালই নেই। যা পারিস কর। আমি আর কিছু বলব না।’
ইভানা বলে উঠল,
‘তুমি কোন চিন্তা করো না দাদাজান। আমার বিয়েটা তুমি যেমন করে চাও তেমন করেই হবে। প্রয়োজনে আমি কথা বলবো ওনাদের সাথে।’

তারিকুল ইসলাম গর্জন করে বললেন,
‘তুমি এসব ব্যাপারে একদম নাক গলিও না। তোমার বাড়াবাড়ির জন্য না এত ভালো সম্মন্ধটা ভেঙে যায়।’
ইভানা প্রতিবাদ করতে চেয়েও করলো না। নিজেকে বোঝালো ঠান্ডা মাথায় সবকিছুর সমাধান করতে হবে। নাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

ইভানা খুব চতুরতার সাথে তার আম্মুর থেকে ফারহানদের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে নেয়। উদ্দ্যেশ্য সেখানে গিয়ে ফারহানের মায়ের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলা।
তারিকুল ইসলাম হাসপাতালে চলে যাওয়ার পরই ইভানাও বেরিয়ে পড়লো। এখন তার গন্তব্য ফারহানের বাড়ি। ইভানাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটি ক্যাব বুক করে নিলো। অতঃপর সেই ক্যাবে করেই রওনা দিলো ফারহানের বাড়ির দিকে।
কিছু সময় এভাবেই কা’টল। একপর্যায়ে ইভানা পৌছে গেল তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। ইভানা ক্যাব থেকে নেমেই ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো বাড়িটা। দুতলা বিশিষ্ট একটা বাড়ি। দেখে মনে হয় নতুন তৈরি হয়েছে বাড়িটা।

ইভানা বেশিক্ষণ দাড়ালো না বাইরে। যদিও তার বুক থেকে ধকধক আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। হাত পা রীতিমতো কাপছিল। বিয়ের আগে প্রথমবারের মতো নিজের হবু শ্বশুর বাড়িতে ঢুকতে চলেছে সে। তাই বেশ উত্তেজিত সে।
কাপা কাপা হাতে কলিং বেলে চাপ দিলো। এক বার, দুইবার করে মোট তিন-চারবার কলিং বেলে চাপ দেওয়ার পরে কেউ একজন এসে দরজাটা খুলে দিলো।

ইভানা একপলক তাকালো সামনের দিকে। তার সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে সে ঠিক চিনতে পারলো না। ফর্সা,লম্বা, সুঠামদেহী একজন ছেলে দাড়িয়ে আছে তার সামনে। ইভানা খেয়াল করে দেখলো ফারহানের সাথে চেহারার অনেকটাই মিল। তবে পার্থক্য হলো ফারহানের গায়ের রং শ্যামলা আর এই ছেলেটা অনেক ফর্সা। ইভানা বুঝে নিলো এটা হয়তো ফারহানের ভাই হতে পারে।

এদিকে ফাহিম ইভানার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ছিল। যেহেতু সে ইভানাকে চেনে না তাই বললো,
‘তুমি কে? আর কাকে চাই এখানে?’
‘সেটার কৈফিয়ত আপনাকে দিতে যাবো কেন? আর আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? অচেনা কাউকে তুমি করে কেউ বলে নাকি? আপনি করে বলতে হয় জানেন না?’
‘এটুকু একটা পুচকে মেয়েকে নাকি আপনি বলে ডাকতে হবে।’
হয়তো এই তর্ক আরো কিছুক্ষণ চলতো কিন্তু তার মাঝেই আগমন ঘটলো ফারহানের। ফারহান এসে ইভানাকে দেখে অবাক হলো প্রচুর। সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,

‘তুমি এখানে?’
ফাহিম ফারহানকে বললো,
‘তুই চিনিস এই মেয়েটাকে? দেখ না এটুকু একটা মেয়ে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে যে ওকে আমার আপনি করে বলতে হবে।’
ফারহান কিছু বলে না। নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে ইভানার দিকে। ইভানা তো চুপ থাকার মেয়ে নয়। সে বলে,
‘এই যে শুনুন আমার পরিচয় কি জানেন? আমি এই লোকটার(ফারহানের দিকে ইশারা করে) হবু বউ। আর আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে আপমি হলেন ওনার ভাই তাই না? তার মানে আমি আপনার হবু ভাবি। সো, আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবেন।’

ফাহিম তাচ্ছিল্য করে বললো,
‘ওহ তাহলে তুমি সেই মেট্রিক ফেইল মেয়ে।’
ইভানার গায়ে লাগলো খুব। সে প্রতিবাদী সুরে বললো,
‘এভাবে কথা বলবেন না আমার সাথে।’
‘এভাবে বলবো না তো কিভাবে বলবো? যা সত্যি তাই বলছি। ছোট থেকে একটা প্রবাদ শুনে আসছি বাদরের গলায় মুক্তোর মালা। এখন তো সেটা বাস্তবেও দেখছি।’

‘মানে কি বলতে চাইছেন আপনি?’
‘এই যে তুমি বাদর আর আমার ভাইয়া মুক্তোর মালা।’
‘মুখ সামলে কথা বলুন।’
‘মুখ সামলানোর কিছু নেই। তুমি যে আমার ভাইয়ার নখের যোগ্য নও সেই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই আমি ভুল কিছু বলছি না।’

ইভানার চোখে জল চলে এলো। এত অপমানিত জীবনে সে কোনদিনই হয়নি। ইচ্ছা করছে গলা ফাটিয়ে কাদতে। ইভানার অবচেতন মন বারবার চাইছিল ফারহান তার হয়ে কিছু বলুক। প্রতিবাদ করুক তার জন্য, কিন্তু সেসব কিছু হচ্ছিল না। ফারহান নীরব দর্শক হয়ে সবকিছু দেখছিল। ইভানা আর থাকতে না পেরে ফারহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপনার ভাই আমাকে এত কিছু বলছে আর আপনি কিছু বলবেন না? আমি হবু স্ত্রী হই আপনার। আমার হয়ে কিছু তো আপনার বলা উচিৎ।’

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ৩

ফারহান ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
‘আমার ভাই তো ভুল কিছু বলে নি।’
এই কথাটা ইভানার মনকে আরো বিষিয়ে দিলো। সে একপ্রকার দৌড়ে ফারহানদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো। বাইরে এসে জোরে জোরে কাদতে লাগল৷ অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরল। বাড়িতে এসেই নিজের রুমে প্রবেশ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। এখন কিছুক্ষণ একা থেকে মাথা ঠান্ডা করতে চায় সে।

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ৫