মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১০

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১০
লেখিকাঃ দিশা মনি

ইভানা পৌছে গেল তার শ্বশুর বাড়িতে। ফাহিম প্রথমে গাড়ি থেকে নামলো। অতঃপর ইভানার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘সাবধানে নেমে এসো।’
ইভানা ফাহিমের হাত ধরে গাড়ি থেকে নামলো। ফারজানা বেগম বরণ করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। ফাহিম ইভানাকে নিয়ে দরজার কাছে উপস্থিত হলো। ফারজানা বেগম ইভানাকে বরণ করে নিলেন। মৃদু হেসে বললেন,
‘এখন তুমি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করো ইভানা।’

ইভানা ভেতরে পা রাখতে যাবে এমন সময় ফারহান চলে এলো। ভীষণ এলোমেলো লাগছে তাকে। ফারহানের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সে ভীষণ ঝামেলার মধ্যে থেকে বের হয়ে এসেছে।
ফারহান বাড়ির সামনে এসে হতবাক হয়ে যায়। ইভানাকে দেখামাত্রই অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
‘এই মেয়েটা কি করছে এখানে?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফাহিম, ফারজানা বেগম সবার নজর যায় ফারহানের দিকে। ইভানা একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে দেয়। অপমানের কথাগুলো মনে পড়ে যায়। তার পা আর সামনে এগোয় না। আপনাআপনি থেমে যায়।
ফারজানা বেগম ফারহানকে দেখামাত্রই নিজের মুখশ্রী শক্ত করে নেন। নিজের বড় ছেলের প্রতি অনেক বিশ্বাস ও ভরসা ছিল তার। কিন্তু এখন সেটা আর অবশিষ্ট নেই। ফারজানা বেগম কিছু না বললেও ফাহিম ফারহানের দিকে কিঞ্চিৎ এগিয়ে গিয়ে বলে,

‘ভাইয়া তুই এসেছিস!’
ফারহান ফাহিমকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘এটা কি হচ্ছে ফাহিম? এই মেয়েটা এখানে কি করছে? আমি তো ওকে বিয়ে করিনি তাহলে ও এই বাড়িতে কেন?’
ফাহিম কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফারজানা বেগম বলে ওঠেন,
‘যা হওনের তাই হইছে। এই দুনিয়ায় কি হইবে, কি না হইবে সব আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে। জন্ম, মৃত্যু, বিয়া সব তারই হাতে। তাই তুই বিয়া না কইরে চলে আইলেও ইভানার বিয়া হইছে। ও এই বাড়িরই বউ হইছে। তোর ছোট ভাইয়ের বউ।’
ফারহান নিজের বিস্ময় দমিয়ে রাখতে পারে না। মনে হচ্ছে কোন স্বপ্ন দেখছে। নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে বলেই দিলো,

‘এসবের মানে কি আম্মু? আমি যেই মেয়েটাকে বিয়ে না করে চলে এলাম তুমি ফাহিমের সাথে তার বিয়ে দিয়েছ!’
‘হ। তাই। তোর নিশ্চয়ই আর কিছু কওনের নাই? তাইলে চুপ করে থাক। নতুন বউয়ের বাড়িতে ঢুকব। তাই তুই আর কিছু বলিস না। ইভানা তুমি ভেতরে আহো।’
ইভানা আর সময় ব্যয় না করে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলো।
ফারহান ফাহিমকে বললো,
‘ফাহিম এটা কি করকি তুই?’
‘তোর তৈরি করা ঝামেলা মিটালাম।’

বলেই ফাহিম বাড়িতে ঢুকে গেলো। ফারহান ঠাই দাড়িয়ে রইল। একেই অনেক বড় একটা সমস্যায় ফেসে গেছে সে। তার উপর বাড়িতে এসে এসব কি দেখতে হলো!

ফাহিমের কিছু ফুফাতো ও মামাতো বোন মিলে বাসর ঘর সাজাচ্ছে। সাথে বিভিন্ন গল্পগুজবও করছে। তাদের গল্পের মূল বিষয় এই বিয়েটা। কোথায় তারা এখানে এসেছিল ফারহানের বিয়ে খেতে আর এখানে এসে কিনা ফাহিমের বিয়ে খেতে হলো! ফাহিমের এক ফুফাতো বোন বলে,
‘কার জন্য বাসর সাজানোর কথা আর কার জন্য সাজাচ্ছি।’
মুহুর্তেই হাসির রোল ওঠে। কিন্তু হঠাৎ করেই সবার হাসি থেমে যায়। কারণ ইতিমধ্যে ফাহিম রুমে চলে এসেছে। ফাহিম রাগী স্বভাবের হওয়ায় সব কাজিনরাই তাকে ভয় পায় এবং সমীহ করে চলে।
ফাহিম এসেই গগম্ভীর মুখ করে বলে,

‘কি হচ্ছেটা কি এখানে?’
ফাহিমের মামাতো ভাই বলে,
‘তোমার বাসর সাজাচ্ছি ভাই।’
‘এসবের কোন প্রয়োজন নেই। আমি অনেক টায়ার্ড। তোরা এখনই এই রুম থেকে বেরিয়ে যা।’
‘কিন্তু,,’

‘কোন কিন্তু না। আমি ১ থেকে ১০ গুনব। তার মধ্যে রুম থেকে না বেরোলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।’
নিজের কথা সমাপ্ত করে ফাহিম যেই না গণনা শুরু করল সাথে সাথেই সবাই এক এক করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ফাহিম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে খাটে বসে পড়লো।
একটু পরেই আগমন ঘটল ইভানার। লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে বাসর ঘরে আসল সে। ফাহিমের ফুফাতো বোন তাকে রুমে ঢুকিয়েই চলে গেলো৷
ইভানা স্বাভাবিক ভাবে বিছানায় এসে ফাহিমের পাশে বসল। কিন্তু কোন কথা বলল না। ফাহিম ইভানার দিকে একপলক তাকিয়ে বললো,
‘তুমি সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ো।’

ইভানা ফাহিমের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। ফাহিম ইভানার এই চাহনি দেখে হেসেই ফেললো। ইভানা এই হাসির মানে বুঝল না। ফাহিম অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললো,
‘তুমি সিনেমা টিনেমা দেখো না নাকি? নায়ক নায়িকার অমতে বিয়ে হলে বিয়ের পর একজন সোফায়, আরেকজন বিছানায় শোয়।’
‘জীবনটা তো সিনেমা নয়।’

‘হুম তা ঠিক বলেছ কিন্তু সবকিছু তো সিনেমাটিক হচ্ছে। যাইহোক, কিছু মনে করো না আমি এমনি মজা করে বলেছি। তুমি এই বিছানাতেই থাকতে পারো।’
ইভানা মৃদু হাসল। ফাহিম বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো। উঠে বললো,
‘তুমি একটু এখানে বসে থাকো আমি আসছি।’
ইভানা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। ফাহিম রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

ইভানার কাধে একটি মশা বসলো৷ ইভানা টের পেয়ে সেই মশাটিকে মা’রার বৃথা চেষ্টা করল। কারণ সে হাত তোলা মাত্রই মশাটা উড়ে চলে গেলো।
ইভানা বিরক্ত হলো খুব। ফাহিম সেই কখন রুম থেকে চলে গেছে। একটু সময় অপেক্ষা করতে বলে এত সময় অপেক্ষা করাচ্ছে। ইভানার খুব রাগ হয় ফাহিমের উপর।
নিজের রাগের বহিঃপ্রকাশ করার জন্য সে বিছানায় থাকা একটা বালিশ নিয়ে দরজার দিকে ছু’ড়ে মা”রে। এমন সময় ফাহিম রুমে প্রবেশ করলো। বালিশটা হাত দিয়ে ধরে ফেললো সে। অতঃপর বললো,
‘এসব কি হচ্ছে? বালিশ ছু’ড়ছ কেন আমার দিকে?’

‘আমি তো আর জানতান না আপনি চলে আসবেন। সেই কখন চলে গেছেন, এতক্ষণে আপনার আসার সময় হলো। আমি সেই কখন থেকে বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছি।’
‘মুখ তো খুব চলে তোমার। ভেবেছিলাম প্রথম দিন তোমায় যেমন দেখেছিলাম তুমি হয়তো তেমন নও। বিয়ের পর শান্তশিষ্ট হয়ে থাকবে কিন্তু তুমি দেখছি এখনো সেই ঝগড়ুটে রয়ে গেছো। যাইহোক এই নাও।’
‘কি এটা?’

‘এটা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বই। আমি অনেক কষ্টে জোগাড় করলাম। তুমি তো এসএসসিতে সাইন্স নিয়ে ফেল করেছিলে শুনলাম, এবছর পরীক্ষা দিয়ে কোনরকমে পাস করেছ তাই ইন্টারে নিশ্চয়ই সাইন্স নিয়ে পড়বে না। তাই তোমাকে তো মানবিকই নিতে হবে। খুব শীঘ্রই তোমাকে কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করবো। এখন বইটা নিয়ে পড়া শুরু কর। বাসর রাতে সবাই তো জাগেই,,,তুমি নাহয় রাত জেগে বই পড়ো।’
‘পারব না আমি।’

‘পারব না বললে তো হবে না। তোমাকে বই পড়তে হবে। শিক্ষিত হয়ে আমার ভাইয়াকে দেখিয়ে দেবো যে তুমিও পারো। তবেই না মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ নিতে পারবে। প্রতিশোধ সবসময় ভয়ানক হয় না। কখনো কখনো নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করে সবাইকে দেখিয়ে দিয়ে মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ নেওয়া যায়।’
ইভানা আর কিছু বলল না। তার মধ্যে হঠাৎ জেদ চেপে গেলো। পড়ার জেদ।
ফাহিম কিছু সময় থেকে বললো,

‘আজ রাতের মধ্যে ইতিহাস বইয়ের প্রথম অধ্যায় পড়ে মুখস্থ করবে। আমি কিন্তু কাল সকালে উঠে প্রশ্ন করবো তোমায়। উত্তর দিতে না পারলে তোমার খবর আছে।’
বলেই ফাহিম বিছানায় শুয়ে পড়ল। ইভানাকে ইশারা করে তার রুমে থাকা টেবিল দেখিয়ে বললো,
‘যাও টেবিলে গিয়ে বসে পড়াশোনা করো।’
ইভানা বিড়বিড় করতে করতে উঠে এলো। বই খুলে কিছুক্ষণ পরতেই তার মাথা ঘুরতে লাগলো। পড়তে ইচ্ছা করছিল না। মনে মনে ফাহিমকে অনেক কিছুই বললো।

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ৯

‘নিজে শান্তিতে ঘুমাবে আর আমি রাতের ঘুম হা’রাম করে পড়বো।’
এরমধ্যেই ইভানার সব অপমানের কথা মনে পড়লো। তার মধ্যে একটা জেদ তৈরি হলো। সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বলল,
‘আমার নিজেকে প্রমাণ করে দেখাতেই হবে। আজ রাতেই আমি বইটা পড়বোই। প্রথম অধ্যায় পড়ে শেষ করব।’
বলেই পড়া শুরু করল। এভাবে রাত জেগে পড়লো।

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১১