মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১১

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১১
লেখিকাঃ দিশা মনি

চোখে সূর্যের কিরণ এসে পড়তেই ইভানার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল। চোখ মেলতেই সে নিজেকে পড়ার টেবিলে আবিষ্কার করল। মনে পড়ে গেল গতকাল রাতের কথা।
ইতিহাস বইয়ের প্রথম অধ্যায় পুরোটা শেষ করার কথা ছিল তার। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ৪-৫ পৃষ্ঠার বেশি মুখস্থ করতে পারে নি। ইভানার মুখটা ভাড় হয়ে গেল।
ফাহিম ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সবেমাত্র বেড়োলো। ইভানা উঠতে দেখেই সে ইভানার কাছাকাছি চলে এলো। বলল,

‘তোমার পড়া কি হয়েছে?’
ইভানা মলিন হেসে বলল,
‘অনেক চেষ্টা করেও পুরো অধ্যায় শেষ করতে পারলাম না। আমার দ্বারা মনে হয় পড়াশোনা হবে না।’
ফাহিম ইভানার মুখটা ভালো করে খেয়াল করল। তার মুখটা কেমন মলিন দেখাচ্ছে। চোখের নিচেও কালো দাগ। দেখে মনে হচ্ছে কাল রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারে নি। ফাহিম বলল,
‘তুমি যে পড়েছ এটাই অনেক। আমি ইচ্ছা করেই তোমাকে একদিনে একটা অধ্যায় পড়ার কথা বলেছিলাম। একদিনে একটা অধ্যায় পড়া তো সম্ভব নয়। কিন্তু কম পড়তে বললে তুমি কম করে পড়তে। তাই আমি একটা ট্রিকস খাটিয়েছিলাম। বাই দা ওয়ে, কতদূর পড়েছ বলো আমি সেখান থেকেই প্রশ্ন করব।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইভানা নাক গাল ফুলিয়ে নিলো। লোকটা ইচ্ছা করেই তাকে এত খাটালো। ইভানা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘প্রথম ৫-৬ টা পৃষ্ঠা।’
‘আচ্ছা বলো পলাশীর যুদ্ধ কত সালে হয়েছিল?’
‘১৭৫৭.’
‘নবাব সিরাজ উদ-দৌলার খালার নাম কি?’
ইভানা মাথা চুলকাতে লাগল। কালকে রাতেই পড়েছিল কিন্তু এই মুহুর্তে নামটা মনে পড়ছে না। নিজের মস্তিষ্কে কিছুটা চাপ প্রয়োগ করতেই নামটা মাথায় চলে এলো। ইভানা সন্দিহান গলায় শুধালো,

‘ঘষেটি বেগম?’
‘কোন সন্দেহ আছে নাকি?’
‘এটাই তো পড়েছিলাম।’
‘ঠিকই পড়েছ। এবার বলো ইংরেজরা কত বছর ভারতবর্ষ শাসন করেন?’
‘১৯০ বছর।’

‘গুড। এভাবেই পড়তে থাকো। চারদিন পরেই তোমার কলেজে এডমিশন হবে। আশা করি তুমি মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে এবং এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করবে। বাই দা ওয়ে তুমি কি হতে চাও? মানে তোমার ড্রিম কি?’
‘আমি আমার বাবার মতো ডাক্তার হতে চাই।’
ফাহিম হেসে ফেললো। বিদ্রুপ করে বলল,
‘তুমি আর্টস থেকে পড়ে ডাক্তার হবে?’
ইভানার গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। ব্যাপারটা একদম মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। তবুও নিজের সম্মান বজায় রাখতে দাতে দাত চেপে বললো,

‘ডাক্তার হতে পারব না তো কি হয়েছে ডাক্তারের থেকে বড় কিছু হবো।’
‘ট্রাই ইউর বেস্ট।’
বলেই ফাহিম রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ইভানা ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল।

ঘড়ির কা’টায় এখন বিকেল ৩ টা। আজকে সূর্য অনেক বেশি তেজ দেখাচ্ছে। প্রচণ্ড গরমে জনজীবন অতীষ্ঠ। এই অসহ্যকর গরমে ইভানা ছাদে দাড়িয়ে আছে!
বিচিত্র কিছু ইচ্ছা থাকে মানুষের। তেমনই ইভানার বিচিত্র ইচ্ছা রোদ উপভোগ করা। ফাহিম ইভানার খোজ করতে করতে ছাদে চলে এলো। ইভানাকে এভাবে দিব্যি ছাদে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
‘এই রোদে ছাদে দাড়িয়ে কি করছ?’

ইভানা ঘুরে তাকালো ফাহিমের দিকে। ফাহিম লাল কালারের খুব সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পড়েছে। ফাহিমের ফর্সা শরীরে খুব ভালো মানিয়েছে পাঞ্জাবীটা। ইভানা অপলক তাকিয়ে রইল ফাহিমের দিকে। ফাহিম ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলল,
‘আমার দিকে তাকানো শেষ হলে নিচে চলো। তোমার পরিবারের লোকেরা সবাই চলে এসেছে। তোমাকে খুজছে।’
‘আমি মোটেও আপনার দিকে তাকাচ্ছিলাম না। আমি তো পাঞ্জাবীটা দেখছিলাম। যে তৈরি করেছে তার হাতে নিশ্চয়ই যাদু আছে। কি সুন্দর কারুকাজ করা।’

ইভানার এই মিথ্যেটা সহজেই ধরে ফেললো ফাহিম। তা স্বত্বেও কিঞ্চিৎ ঠেস মে’রে বলল,
‘তাহলে নিশ্চয়ই আমার চোখেও যাদু আছে? কারণ আমিই তো এটা পছন্দ করে কিনেছি।’
ইভানা স্বভাবতই ঝগড়ুটে। যুক্তিতে না পারলে ঝগড়া করা তার স্বভাব। স্বভাব অনুযায়ী ঝগড়ার ভঙ্গিমায় বলল,
‘আপনার চোখে তো চশমা আছে। চাশমিশ একটা।’
এমন অপমান মোটেই পছন্দ হলো না ফাহিমের। তেতে উঠে বলল,

‘আমার সম্পর্কে এমন কথা একদম বলবে না। এই চশমা আমার ব্রিলিয়ান্ট স্বভাবের পরিচায়ক। ছোটবেলা থেকেই দিনরাত জেগে বই পড়তাম। তাই অল্প বয়সে চশমা পড়তে হয়েছে। আর এমনিতেও চশমায় খুব হ্যান্ডসাম লাগে আমায়।’
‘চাশমিশ ছেলেরা একটু হ্যান্ডসামই হয়,,,কিন্তু কা’না তো কানাই,’
‘তবে রে,,,’

বলেই ফাহিম ইভানার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। ইভানা কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো। হুঠ করেই পিছলে পড়ে যেতে নিলে ফাহিম তাকে ধরে নেয়। দুজনে একে অপরের চোখের মায়ায় হারিয়ে যায়। এভাবে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ফাহিম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্বাভাবিক হয়। চশমায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘একটু দেখেশুনে চলাফেরা করো নাহলে যেকোন সময় যেকোন কিছু ঘটে যাবে।’

ইভানা কিছু বলল না৷ তার হৃদস্পন্দনের গতি ভীষণ রকম বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে বুকের মধ্যিখানে কেউ হা’তুড়ি দিয়ে বা’রি মা’রছে। এই প্রথম কোন পুরুষের এত সন্নিকটে এলো সে। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতির ছোয়া।
ফাহিম ইভানার দিকে তাকাতেই যেন বেসামাল হয়ে গেল৷ তাকে স্পর্শ করে দেওয়ার বাসনা জাগলো মনে। ফাহিম অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রেখে বলল,
‘নিচে চলো এখন।’
ইভানা কথা বাড়ালো না আর। ফাহিমের সাথে ছাদ থেকে নামতে লাগল।

ঘরে এসেই হাতমুখ ধুয়ে বৌভাতের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল ইভানা। তোহা রুমে এসে তাকে সাহায্য করছে। দুই বোন যেন একদিনেই একে অপরকে ভীষণভাবে মিস করতে লেগেছে।
তোহা ইভানার শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে বলল,
‘জানিস কাল রাতে আমার ঘুমই আসছিল না। প্রতিদিন আমরা দুই বোন একই বিছানায় এক সাথে ঘুমাই। অথচ কাল তুই ছিলি না। খুব মিস করেছি তোকে।’
ইভানাও নাকমুখ ফুলিয়ে বলল,

‘আমিও তোকে মিস করি আপাই। ইচ্ছা করে ছুটে তোর কাছে চলে যেতে।’
এভাবেই দুই বোন গল্প করতে লাগল। গল্পের ফাকে সাজগোজ কমপ্লিট হয়ে গেল। অতঃপর তোহা ইভানাকে নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাড়ালো৷ বলল,
‘দেখ বোন কত সুন্দর লাগছে তোকে।’
ইভানা চোখ তুলে তাকালো। লাল রঙের একটা সিল্কের শাড়িতে খুব ভালো মানিয়েছে তাকে। সাথে প্রসাধনী এবং গহনা তার সৌন্দর্য যেন আরো বেশি ফুটিয়ে তুলেছে। ইভানা লাজুক হাসল।
তোহা ইভানাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,

‘তুই ঠিক আসিছ তো ইভানা?’
‘হুম। কেন বল তো?’
‘না মানে যেভাবে বিয়েটা হলো। আমার তো মনে হয়েছিল কোন বড় ঝামেলা হবে। আচ্ছা ফাহিমের বড় ভাই মানে ফারহান তোকে দেখে কোন রিয়্যাক্ট করে নি?’
ফারহানের নাম শুনতেই ইভানার গতকালের ঘটনা মনে পড়ে যায়। সে কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
‘না তেমন কিছু হয় নি। উনি শুধু একটু অবাক হয়ে গেছিলেন। আর তেমন কিছু না।’
‘ইভানা শোন, কোন সমস্যা হলে কিন্তু তুই আমার থেকে লুকাবি না। নির্দ্বিধায় বলবি।’
‘আচ্ছা।’

তোহার ফোনে কল আসে। তোহা ফোনে কথা বলতে বলতে রুম বাইরে বেরিয়ে যায়। এদিকে ইভানা আগে কখনো শাড়ি তেমন একটা পড়ে নি। তাই শাড়ি সামলানোর অভ্যাসও নেই তার।
শাড়ি সামলে হাটতে গিয়ে হোচট খেয়ে পড়ে ইভানা। ফলে তার কুচি পুরো নষ্ট হয়ে যায়। ইভানা নাকমুখ কুচকে বলে,
‘ধুর। আমার সাথেই যত ঝামেলা হয়।’
বিড়বিড় করতে করতে উঠে দাড়ায় ইভানা। শাড়ির আচল ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু অসফল হয়।
এমন সময় ফাহিম রুমে প্রবেশ করে। ইভানাকে শাড়ি নিয়ে বেসামাল অবস্থায় পড়তে দেখে বাকা হাসে৷ অতঃপর ইভানার সামনে এসে বলে,

‘দাও, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।’
‘আপনি শাড়ি ঠিক করতে পারেন?’
‘আমি সব পারি।’
‘গার্লফ্রেন্ডের শাড়ির আচল ঠিক করার এক্সপেরিয়েন্স আছে নাকি?’
‘আমার গার্লফ্রেন্ড শাড়ি পড়তো না।’
‘তার মানে সত্যিই আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিল!’

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১০

ফাহিম কিছু বলল না। শুধু ঠোট টিপে হাসতে লাগল। তার তো আদৌতে কোন গার্লফ্রেন্ড ছিলোই না। সেই ছোটবেলা থেকে পড়াশোনা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে প্রেম নিয়ে ভাবার সময় পায় নি। শুধু ইভানাকে জেলাস ফিল করার জন্যই কথাটা বলা। আর কথাটা কাজেও দিল!

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১২