মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ২০

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ২০
আবরার আহমেদ শুভ্র

থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে রওশন প্যালেস জুড়ে। কিছুক্ষণ আগেই যে আনন্দঘন মূহুর্তে ভরপুর ছিলো তা এখন আর নেই বললেই চলে। ছোফায় নওশাদ আরমান ও নাবিল আরমান ওকিলের সাথে বসে আছে। চেহারায় তাদের রাগ স্পষ্ট! পাশেই মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তানিম। মুখ তুলে তাকাতে পারছে না কারো দিকে সে। এমন বেহাল দশার মাঝে যে পরতে হবে তাকে সে কখনোই সেটার কল্পনাও করে নি। তার নিরব নিস্তব্ধতায় গর্জে উঠলেন তার বাবা নওশাদ আরমান,

–এখানে এমন হাবলার মতোন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছো কেন এখন? অথৈ মামনি কেন ডিভোর্স চাইছে তোমার কাছ থেকে? তোমাদের মাঝে কি এমন হয়েছে যেকারণে সে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে?
তার বাবার এমন কন্ঠে মোটেও বিচলিত হলো না সে। বরং নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে রইল সে। এবার মুখ খুললেন নাবিল আরমান। যাকে পরিবারের সকলেই একত্ব চিত্তে সমীহ করে। গম্ভীর কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–ভাইজান যেহেতু অথৈ ওর কাছে থেকে মুক্তি চায় তাহলে আমরা নিশ্চয়ই এর কারণ তার কাছ থেকে অর্থাৎ তানিম সাহেবের কাছ থেকে জানতে চাইবো। অতঃপর প্রশ্ন করার পরেও সে যদি নীরবতা পালন করে তাহলে মনে করা যায় নিশ্চয়ই সে মারাত্মক কিছু করেছে বা কোনো কিছুর সাথে জড়িয়ে আছে তাই হয়তো তার থেকে মুক্তির জন্যই অথৈ ডিভোর্স চাই। সো, সেক্ষেত্রে আমি অথৈয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে চাই। তোমরা কি বলো?
নওশাদ আরমান অসহায় চোখে তাকালো অথৈয়ের দিকে। সেও নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পরিস্থিতির স্বীকারে সে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।

–তুই যা বলবি তাই হবে। জানিস আমি নাহিদের পর তোকেই বেশি ভালোবাসি। আর তোর মতামতকে শ্রদ্ধা করি। তাই আমি বলছি তুই যা বলবি তাই হবে।
নাবিল আরমান এবার এক পলক তাকালেন তানিমের দিকে। তারপরে অথৈকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
–অথৈ যেহেতু আমার মেয়ের মতোন, তাই আমিও আমার মেয়ের ভালোই চাইবো। কেননা আমারও দুটো মেয়ে আছে। তাই আমি অথৈয়ের পক্ষেই মতামত দিলাম। ডিভোর্সটা হয়ে যাক। অন্তত আমার মেয়েটা শান্তি পাবে।
তানিম এবার অবাক চোখে তাকালো তার চাচার দিকে। বলেন কি তিনি? সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে গম্ভীর স্বরে বলেই ফেললো,

–ছোটাব্বু আমি জানি, আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি তার সাথে কিন্তু সেটার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে সে তো কম কিছু করে নি। জানি যেটা সে ভালোই মনে করেছে সেটা করেছে সে। কিন্তু ডিভোর্সটার মানে কি? সবটাই কি ছেলেখেলা? সে কি একবারও ভেবেছে আমার সদ্য নবজাতক ছেলেটার কি হবে? হা মানছি আমি একজনকে ভালোবাসতাম। সে অবশ্যই তানজিম‌! তার সাথেও অামি অন্যায় করেছি সেই ফলস্বরূপ অথৈয়ের কাছ থেকে আজ এই মূল্য পেয়েছি।

তানিমের কথায় সবাই অবাক হলো। তাদেরই অগোচরে তানিম তানজিমের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলো অথচ কেউ কখনোই খেয়াল করতে পারে নি। প্রেম করেছিলো ঠিক কিন্তু তাকে ধোঁকা দিয়েছে সে সেটা কোনো মতেই মানতে পারছে না কেউই। কেমন কটমট চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তানিমের দিকে সকলে। আর তানজিম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। তার ঠিক ডান পাশেই ফুয়াদ দাঁড়িয়ে। চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে সে। রাগে থরথর করে কাঁপছে তার পুরো।শরীর। তবে বেশ শান্ত স্বরেই তানিমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

–অথৈ তোমাকে যে পাপের শাস্তি দিয়েছে তুমি তার যোগ্য নও। তোমার এর চেয়েও বেশি শাস্তি দিলেও আমি মনে করি তোমার জন্য তার খুবই কম হবে। কেননা একসাথে দু দুটো মনকে তুমি আঘাতে জর্জরিত করেছো দিনের পর দিন। একজনকে কষ্ট দিয়ে অন্যজনকে বিয়ে করেছিলে। শেষে তাকেও কষ্ট দিয়েছো তুমি! মনুষ্যত্বহীন হয়ে গেছিলে তুমি। তারপরও চাওটাই বা কি তুমি? ভালোবাসা? তোমার তো আরও শাস্তি পাওয়া উচিত। পাষাণ হৃদয়টাকে একটু মনুষ্য শেখাও। কোমল মনের হও! বুঝলে? এখন তুমি কি মনে করবে আমার কথায়, ইটজ ডাজন্ট আ্ মেটার! আজ অথৈ কি চায় সেটাই তোমার ফেভার করবে। দিজ ইজ হার ডিসিশনস!

ফুয়াদের গাঁ ঝাঁজালো কথাটা তানিমের বেশ খারাপ লাগলো। যতই খারাপ লাগুক সে মনে মনে এটাই মেনে নিলো যে এগুলো তার প্রাপ্য ছিল। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর তানিমও এবার বেশ শান্ত ও ক্ষমার কন্ঠে বলে উঠলো,
–আমি আমার জীবনে অনেক ভুল করেছি, তার মধ্যে এটা জঘন্যতম ভুল। তবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তানজিম প্লীজ আমায় ক্ষমা করে দিস। জানি না, তোর সাথে যা অন্যায় করেছি তার ক্ষমা কখনো পাবো কিনা কিন্তু নিজেকে আমি কখনো ক্ষমা করতে পারবো না।

তবে এটাই বলবো তোদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। আর কখনোই হয়তো দেখা হবে না কারো সাথে। তাই আজ হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি তোদের কাছ থেকে। অথৈও হয়তো আমার যাওয়ার বেলায় আমার সাথে কথায় বলবে না। আমার ছেলেটাকেও কখনো ছোঁয়ার সুযোগ হয়তো আল্লাহ আমায় দিবেন না কখনোই। হা, ওকে আমি কখনোই ডিভোর্স দেয়ার কথা মাথায় আনি নাই আর আনবও না। ওরে ভালো থাকতে বলিস।
বলেই লাগেজ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে তানিম। যারপরনাই অবাকই হলো সকলে। কখন সে লাগেজ ঘুছিয়ে নিয়েছে কেউই বুঝতে পারলো না। কিন্তু যখন ওকে আটকাতে ছুটে এলো সবাই ততক্ষণে অনেক দেরি করে ফেলেছে। কারণ, তারা সকলে আসার আগেই তানিমের গাড়ী খানিকটা দূরে চলে গেছে।

সকলে একসাথে বসে আছে বারান্দায়। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই। কিছুক্ষণ আগেই অথৈ রুমে গিয়ে বিছানার উপর একটা চিরকুট পেলো যাথে স্পষ্টভাবে লেখা তানিম ইউকে চলে যাচ্ছে যেখান থেকে সে কখনোই ফিরবে না। সেটা পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে। কারণ, সে খানিকটা নাটক করেছিলো ডিভোর্সের যাতে তানিম অন্তত তার ভুল বুঝতে পারে কিন্তু সেটা হয়নি উল্টো সেই তাকে ছেড়ে ইউকে তে পাড়ি জমিয়েছে। অথৈয়ের রুমে এসে তাকে এমন করে কাঁদতে দেখে অবাক হলো ফাইজা। তাকে জিজ্ঞেস করতেই ডুকরে কেঁদে উঠে সে আরও। বেড়ে যায় কান্নার শব্দ যা নিচে সকলের কান অব্দি পৌঁছাতে সময় লাগলো না।
অথৈ অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,

–আমি এখন কি নিয়ে থাকবো মা? উনি এমনটা কেন করলেন? একবারও কি আমায় জোড় করতে পারেন নি? আমি তো তার ভালোর জন্যই এসব করেছিলাম অথচ তিনি নিজেই রাগ করে আমাদের একা করে অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছে।
তানিমের মা অথৈয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর নিজেই মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন। তানবিন এবার যে কথাটা বললো তাতে যেন মরুভূমির মাঝে পানির দেখা পেলো তারা। তানবিন বলে উঠলো,

–আমরা যদি ভাইয়া একটা ভুল তথ্য দিই তাহলে হয়তো সে ফিরে আসতে পারে। আর কাল একটু করে কারো সাথে ফ্লাইট নিয়ে কথা বলছিলো। তখন আমি মেইবি পানি খেতে এসেছিলাম নিচে তখন ভাইয়া আমাকে খেয়াল করেনি। তবে এটা সিউর যে তার ফ্লাইট আজ নয় সে কাল বা পরশু চলে যাবে। এখন কোনোমতে তাকে এখানে নিয়ে আসতে পারলেই হলো।
সকলে সায় দিলো তানভিনের কথায়। তবে সমস্যা হলো কি করলে তানিম ফিরে আসবে। তবে বিকেলের মধ্যেই সকল সমস্যার সমাধান দিলো ধ্রুব। যা শোনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো অথৈ।

খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আনমনে তারা গুনছে তানজিম। আবার তানিম আর অথৈয়ের জন্যও চিন্তা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে তাশরিফের জন্য। তানিম-অথৈয়ের ছেলের জন্য। নিজেকেই বেশি দোষারোপ করছে সে। কিন্তু ঘাড়ে কারো তপ্তশ্বাস অনুভব হতেই পেছন ফিরে তাকালো সে। মূহুর্তেই ভুত দেখার মতো চমকালো সে। কারণ, ফুয়াদ একদম ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করেই ফুয়াদ তানজিমের কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো। চক্ষু জোড়া গোল হয়ে গেলো তানজিমের। এই প্রথম এতোটা কাছাকাছি ফুয়াদের সে। লজ্জায় নুয়ে গেলো তানজিম। শিহরণ বয়ে চলেছে দেহের সর্বাঙ্গে! তানজিমের কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো ফুয়াদ,,

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৯

–যদি সময়টা থমকে যেতো তোমায় সারাজীবন এভাবেই আগলে রাখতাম কেশবতী! তোমায় নিয়ে যে আমার বড্ড ভয় হয়। একবার হারিয়েছি, আর নয়। নিজের করে নেবো খুব শীঘ্রই!
ফুয়াদের এমন কথায় চোখ বন্ধ করে অনুবভ করলো তার উষ্ণ পরশ। মনে মনে সেও ঠিক এমনটাই চাইলো! ফুয়াদ বুঝতে পারলো তানজিমের কোনো দ্বিমত নেই এই নিয়ে। সুতারাং সে খুব শীঘ্রই তার করে নিবে তার প্রেয়সীকে। শুধুই সময়ের অপেক্ষা!

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ২১