মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২৬

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২৬
ইফা আমহৃদ

“চড়ুই কোথায় যাচ্ছ তুমি? স্যরি বলেছি তো আবারও বলছি, স্যরি। তবুও যেও না।”
ধ্রুবের অসহায় কণ্ঠে পাজোড়া স্থির হল। এক পলক তার মুখের দিকে তাকালাম। আকুতি ভরা চোখের পাতা। যেতে না দেওয়ার হাহাকার, কিন্তু থামানোর অধিকার নেই। আমি তোয়াক্কা করলাম না। থমথমে গলায় বললাম,
“এখানে আমি আসতে চাইনি। কেউ একজন জোর করে নিয়ে এসেছে। সমস্যা সমাধান হওয়ার পরিবর্তে আরও সমস্যার সৃষ্টি করল। সেটাই সমাধান করতে যাচ্ছি।”

ধ্রুব উচ্চ শব্দে ব্যঙ্গ করেন। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। মাথা চুলকালেন। বিদ্রুপ করে বললেন, “ছেলেদের ভয়ে রাস্তা দিয়ে পাগ’লের মত দৌড়ানো পাবলিক যখন বলে, সমস্যা সমাধান করতে যাচ্ছি। তখন মনে হয়, সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। যখন তখন বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে‌।”
ভ্রু কুঁচকালাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তিনি পিছিয়ে গেলেন। আমি ব্যাগ থেকে ছুরিগুলো বের করলাম। কয়েক কদম ফেলে ধ্রুবের গলায় ধরে বললাম,
“আপনি নিজেকে ওভার স্মার্ট ভাববেন না। আমিও কিছুটা জানি।”
ধ্রুব লেপ্টে গেল বিছানায়। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “তুমি এটা দিয়ে কী করবে? ওদের হাতে তুলে দিয়ে বলবে, এটার বিনিময়ে আমাকে যেতে দিন।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ধ্রুব সোজাসাপ্টা বললেন। আমি ছুরিটা ব্যাগে রাখলাম।‌ পিছিয়ে আসতে নিলেই থেমে গেলাম অতিশয় সূক্ষ্ম আঘাতে। সূচালো বাঁধল পায়ে। জ্বলে উঠল জায়গাটা। স্তব্ধ হয়ে স্থির রাখলাম দৃষ্টি। ধীরে ধীরে ঝাপসা হল সবকিছু। পা উঁচুতে তুলে নিলাম দ্রুত। এতক্ষণ জমিয়ে রাখা অশ্রুধারা এবার গড়িয়ে পড়ল। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল। স্পর্শ করল গাল। মাটি ভিজে উঠল রক্তে। হাতরে সেন্টার টেবিল ধরে সামলে নিলাম। পলক ফেলার পূর্বেই ধ্রুব জাপটে ধরল আমায়। হা হুতাশ করে বললেন, “কী হয়েছে চড়ুই?”
আমি প্রত্যুত্তর না করে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ভর ছেড়ে দিলাম ধ্রুবের উপর। বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলেন। কোলে তুলে বিছানার কিনারায় বসিয়ে দিলেন। পা হাঁটুর উপর তুলে দেখলেন। সংশয়িত গলায় বললেন, “কতটা কেটে গেল, দেখে শুনে হাঁটবে না? এই হাঁটা নিয়ে আবার..

শেষ করলেন না তিনি। উচ্চ স্বরে বললেন, “কে কোথায় আছো, দ্রুত ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এসো।”
ধ্রুব পুনরায় পা দেখতে মনোযোগী হলেন। স্টার্ফরা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইল নত হয়ে। ধ্রুব স্টার্ফদের পানে না চেয়েই বাজখাঁই গলায় বললেন,
“সমস্যা কী, বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।”
ধ্রুবের বাক্য থামার পূর্বেই হনহনিয়ে প্রবেশ করল সকলে। ফার্স্ট এইড বক্স বিছানায় রেখে নতস্বরে বললেন, “স্যার সরুন, আমি দেখছি।”
“আপনাদের ওর পা দেখতে হবে না, দ্রুত কাঁচ পরিষ্কার করুন।”

স্টার্ফরা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হল। ধ্রুব বক্স খুলে তুলো দিয়ে সাবধানে রক্তগুলো মুছলেন। কাঁচের টুকরো তুলতে রক্ত দ্রুত গতিতে প্রবাহিত হল। প্রচণ্ড আঘাতে আর্তনাদ করে উঠলাম। ধ্রুব দিশেহারা হয়ে পড়ল। ঘামতে শুরু করল। না! এটা তার দ্বারা সম্ভব নয়। ধ্রুব উঠে দাঁড়ালেন। স্টার্ফদের কড়া আদেশ দিলেন,
“আমি একটু বের হচ্ছি, কখন আসব ঠিক নেই। আপনারা ওকে দেখে রাখবেন। পা ব্যান্ডেজ করে কিছু খাইয়ে দিয়েন। কিছুতেই বাইরে যেতে দিবেন না।”
ধ্রুব কাবার্ড থেকে কাপড় মোড়ানো বস্তু সন্তর্পণে পকেটে নিলেন। বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করতেই তড়িগড়ি করে বললাম, “আমি যাবো।”

“ওরা সব আমার হাতে বন্দি। তুমি গিয়ে কী করবে শুনি? ভাঙা পা নিয়ে হা-ডু-ডু খেলে দেখাবে? যত্তসব!”
তোয়াক্কা না করে উঠে দাঁড়ালাম একপায়ে। পরবর্তী পা ফেলার পূর্বে ধ্রুব ইশারা করলেন। তৎক্ষণাৎ ধরে ফেললেন হাত। ধ্রুব ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলেন। ধরে রাখার ফলে যেতে পারলাম না। বসে পড়লাম বিছানায়। ওরা ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজ করে দিল‌। পায়ে তিল পরিমাণ ব্যথা অনুভব করলাম না, অতি যত্নে কাজ শেষ করলেন। কিছু হলে ধ্রুবের কাছে তাদের জবাবদিহিতা করতে হবে।
ধ্রুব যাওয়ার মিনিট দশেকের মাথায় মামুনি আর রমিলা আন্টি এলেন। আমি হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিলাম। জোর করে পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেও জোর করে খাওয়ানো সম্ভব নয়। আন্টির ডাকে বাস্তবে ফিরি,

“কি হয়েছিল এখানে?”
স্টার্ফরা ধীরে ধীরে বলল, “আমরা এতকিছু জানি না। স্যার ম্যামরে টানতে টানতে ধরে এনেছে। ভয়ংকর রেগে ছিল। আমরা এসে দেখি, ম্যামের পা থেকে রক্ত ঝরছে। গালে চড়ের দাগ। জিনিসপত্র ভাঙা। স্যার মা’রছে মনে হয়।”
তারা এক কথা অন্যভাবে উপস্থাপন করলেন। হ্যাঁ, ধ্রুব আমাকে চড় দিয়েছে। কিন্তু ঘরের জিনিসপত্র ভয় দেখাতে ভেঙেছে, আর পা আমার দোষে কেটেছে।
মামুনি ছুটে এলো। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিলেন। তেজ নিয়ে বললেন,

“আপনার ছেলে তো এখন মানুষ নাই। বউ মা’রতেও দ্বিধা করে না। কোন কারণে এমন করল? আমি এক্ষুনি চড়ুইকে নিয়ে যাবো, ও থাকবে না এখানে। সত্যি সত্যি এবার ওর বিয়ে দেবো।”
রমিলা আন্টি থমথমে গলায় বললেন, “ধ্রুব আসুক আজ, বিদেশ থেকে এই শিক্ষা নিয়ে এসেছে..
দু’জনের কথপোকথন শুনে বললাম, “আন্টি ধ্রুব..
“চুপ! তুই ঘুমা।”

চিৎকার-চ্যাঁচামেচির আওয়াজে ঘুম ভাঙল আমার। সূর্য নেই, মেঘলা আকাশ। থমথমে পরিস্থিতি। গাঁ হিম দেওয়া আবহাওয়া। বারোটা ছাড়িয়েছে অথচ তেমন হেলেদুলে নেই প্রকৃতির। ঠিক নেই কিছু। নিভু নিভু চোখে অবলোকন করতেই অজানা অচেনা পরিবেশে আবিষ্কার করলাম নিজেকে। দেয়ালে দেয়ালে ধ্রুবের ছবি। বড় করে বাঁধানো আমার ছবি। সম্প্রতিক সময়ের। বই পড়ছি লাইব্রেরীতে। আগেরবার যখন এসেছি, এমন কিছু দেখতে পাইনি। তখন অন্য একটা ঘরে তাকে থাকতে দেখেছি। একদম ভিন্ন। ধীরে ধীরে মনে পড়ল কালকে রাতের ঘটনা। ধ্রুবের কথা। পায়ের দিকে তাকালাম। ব্যান্ডেজের উপরেও রক্ত শুকিয়ে আছে। বিন্দু পরিমাণ নড়লেই ব্যথায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। আমি কম্বল ভাঁজ করে রাখলাম। বালিশ ঠিক করে বিছানা গুছিয়ে নিলাম। এক পায়ে সম্পূর্ণ ভর এবং ব্যথার্ত পায়ের আঙুলে স্বল্প ভর দিয়ে অগ্ৰসর হলাম সামনের দিকে। নিচে রমিলা আন্টি কাঁদছেন। মামুনি তাকে শান্ত করছেন। আমি একপায় ভর দিয়ে হাঁসফাঁস করে বললাম, “কী হয়েছে, কাঁদছেন কেন আন্টি?”

কেউ কোনো জবাব দিলনা। উপায়হীন হয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তবুও নিশ্চুপ। স্টার্ফদের জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে? তারা সংক্ষেপে বলে, ধ্রুবকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
তাদের কাছে ফোন থাকার কারণে পুলিশে ফোন করে জানায়, তবে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ধ্রুব ইচ্ছামত মেরেছেন। সবাই ইমার্জেন্সিতে ভর্তি। পুলিশ এসে ধ্রুবকে থানায় নিয়েছে। মামা ও রাহাত স্যার উকিলের কাছে গেছেন। জামিন করতে পেরেছেন কি-না জানা নেই।
একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম, কেউ আমার সাথে তেমন কথা বলছে না। সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। ঘরে এসে গুটিয়ে রইলাম। কী অপরাধ করেছি আমি? কেন সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে আমায়।

গালে ঠান্ডা স্পর্শ পেতেই নড়েচড়ে উঠলাম। তন্দ্রার ছেদ ঘটল। চোখের পাতা মেললাম না। উল্টো কাত হলাম। কম্বলটা টেনে শরীর ঢেকে ঘুমানোর প্রয়াস করলাম। সম্ভব হচ্ছে না, ওপাশের মানুষটা শান্তি দিবে না। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাতেই ধ্রুবকে দেখে লাফিয়ে উঠলাম। চোখ পরিষ্কার করে পুনরায় তাকালাম। না দৃষ্টিভ্রম নয়। মুখ ফিরিয়ে ধীরে ধীরে বললাম, “তিনি কখন এলো। তিনি তো থানায়!”
টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছতে ছিলেন তিনি। পড়নে ঢিলেঢালা টি শার্ট ও ট্রাউজার। মাত্র শাওয়ার নিয়েছেন, বুঝাই যাচ্ছে। তবে কখন এসেছেন? নিশ্চয়ই অনেক আগে, ডাকেনি কেন আমায়? আদৌও বাবুইয়ের ভিডিও ডিলেট করতে পেরেছেন তিনি?

মৃদু শব্দে বললেও ধ্রুবের কর্ণদ্বয়ে ঠিকই পৌঁছালো, কিন্তু কোনোরুপ প্রতুক্তি করলেন না। ব্যাপারটাকে পুরোপুরি অগ্ৰাহ্য করলেন। বালিশ নিয়ে পাশে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ করলেন। মাথায় হাত দিয়ে আড়াল করলেন মুখশ্রী। কথা বলছেন না কেন? সবাই কেন আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে?
গম্ভীর গলায় বললেন, “ভিডিওটা তোমার ফোনেই আছে শুধু, যেই মানুষটা করেছে সে নেই। ডিলেট করার দরকার নেই।”

“আপনি থানায় ছিলেন, কখন এলেন? ডাকেননি কেন?”
“তুমি ঘুমিয়ে ছিলে।” রিনরিনে গলায়।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললাম, “কী করেছি আমি? কী করেছি? দোষ কোথায় আমার, সবাই কেন আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিচ্ছেনা।”
“কে তোমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে চড়ু..

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২৫

বাক্য থেমে গেলেন। তবে শব্দ থামল না। চাপা আর্তনাদ করলেন। পিঠ ধরে উঠে বসলেন। পিঠ থেকে টাওয়াল সরিয়ে বললেন, “একটু মলম লাগিয়ে দিবে?”
বেসামাল হয়ে শুধালাম, “কীভাবে শরীরের এই অবস্থা হল? এত কালচে দাগ কেন?”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২৭