মেঘের অন্তরালে পর্ব ১৮+১৯

মেঘের অন্তরালে পর্ব ১৮+১৯
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা

মিস্টার নিহান রেজওয়ান ?
অফিস থেকে ফিরে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো নিহান। অচেনা আওয়াজে দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘুরে তাকিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে থাকা ছেলেকে চিনতে পারলো না নিহান।
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, কে আপনি ?
আয়মান উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত পকেটে গুঁজে বললো, চিনতে অসুবিধা হচ্ছে ? হবারই কথা এতোগুলা বছর যে পেড়িয়ে গেছে মাঝে।
হেয়ালি না করে নিজের পরিচয় দিন।
বলছি বলছি এতো তাড়া কীসের ?
দেখতেই পাচ্ছেন অফিস থেকে ফিরেছি, এতোটুকু কমনসেন্স নিশ্চয়ই আছে। অফিস থেকে ফিরে মানুষ ক্লান্তি অনুভব করে। কে আপনি আর বাসায় ঢুকলেন কী করে ?
নিশান বাবা এই নে তোর ফেবারিট পায়েস।

নিহান নিজের মায়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, নিশান ?
আয়মান নিহানের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, দুটো জিনিসই অপছন্দের তালিকায় চলে গেছে বড় মা।
নিহান এবার তাকালো আয়মানের দিকে। নিহান কিছুই বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে এখানে। সব তার মাথায় উপর দিয়ে যাচ্ছে।
নিহানের মা আয়মানের কথার মানে বুঝতে না পেরে বললো, মানে ?
যে নামটাতে ডাকলে আর যেটা বানিয়ে নিয়ে এসেছো দুটোই অপছন্দের তালিকায় চলে গেছে অনেক বছর আগেই।
নিহান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আয়মানের দিকে। কথার ধরণ আগের মতোই আছে। ভালো করে খেয়াল করতেই চেহারায় মিলও পেলো আগের মতো। এবার আর চিনতে অসুবিধা হলো না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিহান আয়মানের কাছে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, কেমন আছিস ভাই ?
আয়মান আস্তে করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, বাহ্ যে বাড়িতে থাকলে তুই বাড়িতেই থাকবি না আজ সে তোর ভাই হয়ে গেলো ? বড় মা আজ সূর্যটা কোনদিক থেকে উঠেছিলো ?
নিহান মাথা নিচু করে বললো, তখন ছোট ছিলাম তাই বুঝতে পারিনি প্লিজ মাফ করে দে ভাই।
আয়মান চোখ মুখ শক্ত করে বললো, কয়টা ভুলের জন্য মাফ করবো তোকে ?
নিহান অবাক হয়ে বললো, মানে ?
ইসরা সাথে এমনটা কেনো করলি ?
নিহান আর নিহানের মা দুজনেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো আয়মানের কথায়। এতো বছর পর নামটা শুনে কেঁপে উঠলো নিহান।

কাঁপা গলায় বললো, কোন ইসরা ?
আয়মান হাতে তালি দিয়ে বললো, ওয়াও দ্যাট’স গ্রেট, নিজের প্রাক্তন স্ত্রীকে চিনতেই পারছিস না ?
নিহান জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, তুই ইসরাকে কীভাবে চিনিস ?
আমি উত্তর জানতে এসেছি, তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে নয়। আমি মানছি ইসরার বাবা তোর সাথে চরম অন্যায় করেছে আর সে তার শাস্তিও পেয়েছে। নিজের হাতে নিজের কলিজার টুকরো মেয়ের জীবন শেষ করেছে, এটা কোনো বাবার জন্য কম শাস্তি নয়। কিন্তু তোরা কী করেছিস ? এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ জানোয়ারের মতো আচরণ করেছিস মেয়েটার সাথে।
নিহান ধমক দিয়ে বললো, নিশান।
আয়মান নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বললো, হুঁশ আমার সাথে জোর গলায় কথা বলার সাহস দেখাস না। আমি একটা মিথ্যা কথাও বলিনি। প্রত্যেকটা কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। বাড়ির একটা কুকুরের সাথে মানুষ এমন আচরণ করে না, তোরা যেটা ঐ মেয়ের সাথে করেছিস।

নিহানের মা আয়মানকে বললো, তুই সবটা না জেনে এভাবে রিয়াক্ট করছিস নিশান।
ডোন্ট কল মি দ্যাট, নামটা সাথে বয়ে বেড়াচ্ছি ঠিকি কিন্তু শুনতে একদমই পছন্দ করি না। আমাকে আয়মান বলে ডাকার হলে ডাকো নাহলে প্রয়োজন নেই। আর হ্যাঁ আমি না জেনে কিছুই বলছি না। আমার প্রত্যেকটা কথা সত্যি। দুটো মাস ইসরা এখানে ছিলো নরক যন্ত্রণা উপভোগ করে। শেষ পর্যন্ত সুইসাইড এটেম করতে বাধ্য হয়েছিলো।
নিহানের মা অবাক হয়ে বললো, মানে কী বলছিস এসব ?

আয়মান নিহানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, বাহ্ বাড়ির সবার থেকে লুকিয়ে গিয়েছিস এটা ?
সেদিন সবাই বাড়ি ফেরার পর নিহান বলেছিলো ইসরাকে তার বাবা এসে নিয়ে গেছে। ইসরার রুমটাও নিজেই পরিষ্কার করে ফেলেছিলো। বাড়ির কেউ ইসরার সুইসাইডের ব্যাপারে কিছুই জানে না।
নিহানের মা নিহানের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, নিহান ?

নিহান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলার মতো ভাষা সে খোঁজে পাচ্ছে না এই মুহূর্তে। নিহানের মা উত্তর না পেয়ে বুঝে নিলেন আয়মানের কথা সত্যি। সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো নিহানের গালে। তবু মুখ তুলে তাকায়নি নিহান।
আয়মান কঠিন গলায় বললো, ইসরার বাবা নিজের ভুলের মাশুল দিতে তোর জীবন থেকে তার মেয়েকে সরিয়ে নিয়েছিলো। তোকে কথাও দিয়েছিলো আর কখনো ইসরার মুখও তোকে দেখতে হবে না। তাহলে কেনো তাকে ভড়া অফিসে সবার সামনে অপমান করেছিলি তুই। সে ধাক্কা সামলাতে না পেরে সেদিন রাতেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে সে।
এবার নিহান মুখ তুলে তাকালো আয়মানের দিকে। তার চোখে মুখে বিষ্ময়, যেনো প্রথম শুনলো এই কথা।
ব্যস্ত গলায় বললো, আমি তাকে অপমান করিনি।

তোর শশুরের অফিসে তুই ইসরার বাবাকে অপমান করিসনি ?
আমি কেনো তাকে অপমান করতে যাবো ? নীলার বাবা জানতে চেয়েছিলো ইখতিয়ার আহমেদকে আমি চিনি কিনা। আমি শুধু বলেছিলাম উনিই ইসরার বাবা। তারপর নীলার বাবাকে যে পেপার দিতে গিয়েছিলাম সেটা দিয়ে তখনই চলে আসি সেখান থেকে। তারপরে সেখানে কী হয়েছিলো কিছুই জানি না আমি।
আয়মান হাসতে হাসতে সোফায় বসে পড়লো। তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিহান। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার আকুলতা তার চোখ মুখে স্পষ্ট।
আয়মান হাসতে হাসতে বললো, ভালো স্টোরি তৈরি করেছিস কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না রে। তোদের মতো মানুষকে বিশ্বাস করা যায় না।

বিশ্বাস কর নিশান সেদিন আমার কোনো ভুল ছিলো না। হ্যাঁ আমি এটা স্বীকার করছি, ইসরার বাবা আমার সাথে যে অন্যায় করেছে আমি ইসরার সাথে তার থেকে কিছু কম করিনি। কিন্তু ঐ দিনের ঘটনায় আমার কোনো হাত নেই।
পাপা
এক আওয়াজে তিনজনই সিড়ির দিকে তাকায়। একটা টেডি হাতে গোলাপি রঙের ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে আছে নিশিতা। পাপাকে দেখে হাসি ফোটে উঠেছে তার মুখে। নিশিতা দৌড়ে নিহানের কাছে যেতেই মেয়েকে কোলে তুলে নিলো নিহান।
আমার চকলেট কোথায় পাপা ?
নিহান পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে নিশিতার হাতে দিয়ে কপালে চুমু খেলো।
মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললো, নিজের সন্তানের মাথায় হাত রেখে কোনো বাবা মিথ্যা বলতে পারবে না। নিশিতার মাথায় হাত রেখে বলছি সেদিনের ঘটনার আমার কোনো দোষ ছিলো না।
আয়মান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিশিতার দিকে। যে এখন হাতের চকলেট খুলতে ব্যস্ত। নিহানের কথায় ঘোর কাটলো।
বিশ্বাস করা আর না করা এবার তোর উপর। তবু বলবো আগের নিহান আর এই নিহানের কোনো মিল নেই নিশান। সেই দাম্ভিক নিহান রেজওয়ান আর নেই।

নিহান মেয়েকে কোলে নিয়েই নিজের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। আয়মান চুপচাপ বসে রইলো নিজের জায়গায়। এখানে সবারই কিছু না কিছু ভুল ছিলো আর সবাই তার শাস্তি পেয়েছে। শুধুমাত্র ইসরাটা কোনো ভুল না করেই জীবনের সবচেয়ে বড় শাস্তি পেয়েছে। আয়মান উঠে দাঁড়ালো সোফা থেকে।
নিহানের মা বললো, তোর বাবা-মা আসা পর্যন্ত একটু ওয়েট কর।
আয়মান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, তারা যেমন ভুলে গেছে তাদের একটা ছেলে আছে, আমিও তেমন ভুলে গেছি আমারও বাবা-মা আছে।

আয়মান এক পা এগোতেই নিহানের মা আবার বললো, ইসরাকে কীভাবে চিনিস ?
ভালোবাসি আমি ওকে আর খুব তাড়াতাড়ি বিয়েও করবো। তবে চিন্তা করো না এই বাড়ির বউ করে আনবো না। কারণ আমি নিজেই এই বাড়ির ছেলে হতে পারিনি সেখানে আমার স্ত্রীকে এবাড়ির বউ করার প্রশ্নই আসে না।
আয়মান আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে বের হয়ে গেলো বাসা থেকে। নিহানের মা বিস্ফুরিত চোখে তাকিয়ে আছে আয়মানের যাওয়ার পথে। ভাগ্য কাকে, কখন, কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় কারো বুঝার উপায় নেই।

আজ শরীরটা ভালো লাগছিলো না ইসরার। লাঞ্চের সময় বাসায় চলে যাওয়ার সীদ্ধান্ত নেয়। হসপিটাল থেকে বের হতেই আয়মানের সামনে পড়ে। সেদিন থাপ্পড় দেওয়ার জন্য মনে মনে অনুতপ্ত ইসরা। তবু মুখে সেটা প্রকাশ করলো না।
শক্ত গলায় বললো, আপনি এখানে কী করছেন ?
তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম, তা এখানেই দেখা হয়ে গেলো।
আমার কাছে কেনো যাচ্ছিলেন ? আপনাকে সেদিন বলেছি তো আমার সামনে আর কখনো আসবেন না।
তুমি বললেই আমি শুনবো, সেটা কী একবারও বলেছি ?
আপনি দিনদিন নির্লজ্জের মতো কাজ করছেন সেটা কী বুঝতে পারছেন আপনি ?
লজ্জা নারীর ভূষণ পুরুষের নয়।

আপনি সত্যি নির্লজ্জ একজন মানুষ। রাস্তা ছাড়ুন যেতে দিন আমাকে।
তুমি এখন আমার সাথে যাবে।
অসম্ভব আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।
তুমি যাবে আর অবশ্যই যাবে।
আপনি আমাকে জোর করবেন ?
ভালোর জন্য ছোট খাটো জোর করলে কিছু হয় না।
ইসরা আবার কিছু বলার আগেই আয়মান তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। ইসরা ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারলো না। আয়মান তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে চালাতে শুরু করলো।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে ? এখনই নামিয়ে দিন আমি বাড়ি যাবো।
স্কুলের বাচ্চার মতো বাড়ি যাবো বাড়ি যাবো করো না তো।
আপনি নামিয়ে দিবেন কিনা বলেন ?
না দিলে কী করবে তুমি ?
চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিবো।

চেষ্টা করে দেখতে পারো, নো প্রবলেম।
ইসরা গাড়ির দরজা খুলতে গেলে আয়মান শক্ত করে হাত আঁকড়ে ধরলো। ইসরা যতো ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আয়মান হাতের বাঁধন তত শক্ত করছে।
আহ্ লাগছে হাত ছাড়ুন আমার।
ইসরার কথা শুনতেই আয়মান হাত ছেড়ে দিলো আর গাড়ি সাইট করে পার্ক করলো।
ইসরার হাত আলতো করে ধরে বললো, দেখি কোথায় লেগেছে ?
ইসরার হাতে আয়মানের হাতের দাগ বসে গেছে।

আয়মান ব্যস্ত গলায় বললো, সরি সরি, তুমি তো পাখির মতো ছটফট করছিলে, তাই শক্ত করে ধরতে হয়েছে।
ইসরা আয়মানের কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললো, দয়া করে আমাকে বাসায় যেতে দিন।
আয়মান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে, সেগুলো বলে আমি নিজে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিবো।
ইসরা আর কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। আয়মান একটা কফিশপের সামনে গাড়ি থামালো। দু’জনে মুখোমুখি হয়ে বসে পড়লো। আয়মান দুটো কফি অর্ডার করে দিলো।
এবার বলো তোমার সমস্যা কোথায় ?
ইসরা থতমত খেয়ে বললো, কীসের সমস্যা ?

আমাকে মেনে নিতে তোমার সমস্যা কোথায় ? আমি দেখতে খারাপ, আমার প্রফেশনাল লাইফ খারাপ, আমি তোমার যোগ্য নই নাকি আমি রেজওয়ান পরিবারের ছেলে এইটাই আমার অন্যায় ?
শেষের কথাটা শুনে ইসরার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো সেটা চোখ এড়ালো না আয়মানের।
তার মানে আমি রেজওয়ান পরিবারের ছেলে এটাই আমার দোষ। কিন্তু ইসরা এখানে আমার দোষটা কোথায় একটু বুঝিয়ে বলবে ? তোমার সাথে আমার কথিত পরিবার যা করেছে সেটা অন্যায়, আমি সেটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু তুমিও কী তাদের মতোই করছো না ? তোমার বাবার অন্যায়ের শাস্তি যেমন আমার পরিবার তোমাকে দিয়েছিলো, একইভাবে আমার পরিবারের অন্যায়ের শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো।

ইসরা এবার তাকালো আয়মানের দিকে। আয়মান কী সত্যি ভুল কিছু বলেছে ?
আয়মান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা হয় আর তাদের চিন্তাভাবনাও আলাদা হয়। আমি রেজওয়ান পরিবারের ছেলে হলেও সেই পরিবারের পরিবেশে বড় হইনি। তাই তাদের সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলো না।
ইসরা ভাবনায় পরে গেছে আয়মানের কথায়। আয়মান তো একটা কথাও ভুল বলেনি।

আয়মান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তোমাকে পনেরো দিন সময় দিলাম। এই পনেরো দিনের মধ্যে আমাকে মেনে না নেওয়া সঠিক কারণ দেখাতে হবে। সেই কারণ দেখে আমার কাছে যদি মনে হয়, সত্যি আমি তোমার যোগ্য নই তাহলে আর কোনোদিন আমার মুখ দেখতে হবে না তোমাকে। আর যদি কোনো কারণ দেখাতে না পারো তাহলে বিনাবাক্যে মেনে নিতে হবে আমাকে। মনে রেখো এতো সহজে ছেড়ে দেওয়ার মানুষ এই আয়মান নয়। লাঞ্চ করে নাও তারপর বাসায় পৌঁছে দিবো।
ইসরা ভেঙে ভেঙে বললো, না আমি এখনই বাসায় যাবো, আমার শরীর খারাপ লাগছে।
জীবনের কোনো সিদ্ধান্তে তোমাকে জোর করবো না আমি। তবে প্রত্যেকটা না বাক্যের উপযুক্ত কারণ দেখাতে হবে আমাকে। চলো বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি।

গাড়িতে আর কোনো কথা হলো না। ইসরা বাসার ঠিকানা না বলতেই আয়মান ঠিক তার বাসার সামনে এসে গাড়ি থামালো। ইসরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
অবাক হওয়ার কিছু নেই, আগেই বলেছি তোমার সম্পূর্ণ বায়ো ডাটা আমার কাছে আছে।
ইসরা নিজের বিষ্ময় কাটিয়ে উঠে গাড়ি থেকে নেমে গেইটের ভেতরে চলে গেলো। আয়মানকে একটা ধন্যবাদ কিংবা বাসায় যাওয়ার কথাও বললো না। আয়মান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে গাড়ি ব্যাকে নিয়ে চলে গেলো।

সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করতে নিচে নামতেই সোফায় নীলার বাবাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো নিহান। কপাল কুঁচকে গেলো তার, মেয়ের হাতটা আরো শক্ত করে ধরলো। নিশিতাকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে গেলো। নীলার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে উঠে দাঁড়ালো সোফা থেকে।
নিহান গম্ভীর গলায় বললো, আপনি এতো সকালে এখানে কী করছেন ?
নীলার বাবা নিহানের সামনে হাত জোর করে বললো, বাবা আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে নাও দয়া করে।
নিহানের রাগ তড়তড় করে মাথায় উঠে গেলো। পেয়েছে কী এরা বাবা মেয়ে ? যখন প্রয়োজন ছিলো তখন ছেড়ে চলে গিয়েছিলো আর এখন ফিরে আসতে চাইছে। জীবনটা কী তাদের কাছে ছেলেখেলা ? রাগে নিজের মুষ্টি বদ্ধ করে নিলো নিহান। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো নীলার বাবাকে কিছু কথা বলার জন্য।

নিহান কর্কশ গলায় বললো, জীবনটা কী ছেলেখেলা মনে হয় আপনাদের কাছে ?
নীলার বাবা মাথা নিচু করে বললো, এভাবে বলো না বাবা। আমার মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে।
নিহান কঠিন গলায় বললো, আপনার এতবড় মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে বলে আপনার কষ্ট হচ্ছে। আমার দুধের বাচ্চা মেয়েটা যখন তার মায়ের জন্য কান্না করতে করতে অসুস্থ হয়ে যেতো, আমার কষ্ট হতো না তখন ? মা ডাক শেখার পর থেকে যতবার মা ডাকতো আমার কষ্ট হতো না, আমার মেয়ের জন্য ? অসুস্থ হয়ে যখন একটু মায়ের স্পর্শ খাঁজতো আমার কষ্ট হতো না তখন ?
নীলা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।
নিহান কঠিন গলায় বললো, আমিও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি মিস্টার মির্জা।
ফিরিয়ে নাও আমার মেয়েটাকে।

নিবিড় তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ফেলে দেওয়া থুতু কাউকে মুখে নিতে দেখেছেন কখনো ?
নীলার বাবা চমকে তাকালো নিহানের দিকে। তার বুঝা হয়ে গেছে নিহান আর কখনো নীলাকে মেনে নিবে না।
তখন বললো, নিশিতার কথা ভেবে হলেও।
নিহান ডাইনিং টেবিলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, নিশিতা মাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে নিয়েছে।
নিহান নিশিতাকে ডেকে বললো, নিশিমা এদিকে এসো একবার।
নিশিতা আসছি পাপা বলে দৌড়ে নিহানের কাছে চলে এলো। নিহান নিচু হয়ে মেয়ের কপালে চুমু একে দিলো।
এই ভদ্রলোককে একটু বলো তো তোমার পাপা কে ?
নিশিতা নীলার বাবার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিহানের দিকে তাকালো। খিলখিলিয়ে হেসে বললো, তুমি।
নিহান সিরিয়াস হয়ে বললো, এবার বলো তোমার মাম্মাম কে ?

নিশিতা এবার নিহানকে জড়িয়ে ধরে বললো, আমার পাপাও তুমি আর আমার মাম্মামও তুমি।
নিহান নিশিতাকে জড়িয়ে ধরেই তাকালো নীলার বাবার দিকে। তারপর নিশিতাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে হাত দিয়ে চুল ঠিক করে দিয়ে বললো, এবার তুমি তোমার দাদীর কাছে যাও।
নিশিতা ছুটে চলে গেলো ডাইনিং টেবিলে নিহানের মায়ের কাছে।
নিহান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, পেয়ে গেছেন উত্তর ? আর যে মা জন্মের আগেই নিজের গর্ভের ছোট প্রাণটা মেরে ফেলতে চায়। সে কেমন মা হবে কারো বুঝার বাকি থাকে না। আমার মেয়ের এমন মায়ের কোনো প্রয়োজন নেই।
নীলার বাবা মাথা নিচু করে ফেললো নিহানের কথায়।
নিহান কঠিন গলায় বললো, আর কখনো আমার বা আমার মেয়ের জীবনে যেনো আপনাদের ছায়াও না পরে।
নীলার বাবা মাথা নিচু করে বের হতে গেলে নিহান বললো, দাঁড়ান।

নীলার বাবা ভাবলো হয়তো একটু আশার আলো এটা কিন্তু তার ধারণা ভুল।
নিহান গম্ভীর গলায় বললো, আমি জানি না ইসরার বাবার সাথে আপনি অফিসে সেদিন কী করেছিলেন। যার জন্য তিনি হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। ইসরার পরিবার সেদিনের জন্য আমাকেই দোষী মনে করছে। নিজের পাপ কিছুটা কমানোর ইচ্ছে থাকলে তাদের কাছে সত্যিটা বলে দিবেন। এবার আপনি আসতে পারেন।
নীলার বাবা চলে গেলে নিহান মনে মনে বলে উঠলো, একটা নিষ্পাপ বাচ্চার কান্না কখনো বৃথা যেতে পারো না। তার প্রতিটা চোখের পানির মূল্য তোমাকে দিতে হবে নীলা, অবশ্যই দিতে হবে।
পাপা আমাদের লেট হচ্ছে তো।
হ্যাঁ আসছি মা।

সকালে ঘুম থেকে উঠে কেবল ড্রয়িংরুমে বসেছে ইসরা তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো, ইসরা ভাবলো পত্রিকা এসেছে। সারারাত আয়মানের কথা মাথায় ঘুরঘুর করেছে, ঘুম ভালো হয়নি। মাকে কড়া একটা চা দিতে বলে মেইন ডোর খুললো পত্রিকার আশায়।
চোখে ঘুম ঘুম যা ভাব ছিলো এক মুহুর্তে কেটে গেলো দরজা খুলে। হ্যাঁ পত্রিকা এসেছে তবে সাথে বড় একটা গোলাপের তোড়া। হাতে নিয়ে দেখলো একটা চিরকুট আছে সাথে।
আজ তোমার পনেরো দিনের প্রথম দিন। একটা সুন্দর দিনের শুভকামনা।
ইসরার বুঝতে বাকি রইলো না এটা আয়মানের কাজ। ইসরা হাসবে, কাঁদবে নাকি রাগ করবে বুঝতে পারছে না। এমনই ঐ আয়মান তার মাথা চড়ে লাফাচ্ছে আবার আরো ভালো করে মনে করিয়ে দিলো। ইসরা দরজা বন্ধ করে ঘুরতেই ইমনের সামনে পরলো।
ইমন ছুঁ মেরে ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে বললো, তোকে এটা কে দিলো আপু ?

ইসরা নিতে চাইলে ইমন ঘুরে দাঁড়িয়ে চিরকুট পরে ফেলে আবার বললো, কিসের পনেরো দিন আপু ?
ইসরা জোর করে ইমনের হাতে থেকে ফুলের তোড়াটা নিয়ে বললো, তোর এসবে কী কাজ ? নিজের কাজে মন দে।
ইমন চেঁচিয়ে বললো, মা দেখে যাও কে যেনো তোমার মেয়েকে ফুল পাঠিয়েছে।
পারভীন বেগম ইমনের কথা বুঝতে না পেরে বললো, আগে হাত মুখ ধুয়ে আয় তারপর ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি।
ইমন আবারও বলতে যাবে তার আগেই ইসরা বললো, পরিক্ষার পর নাকি তুই কোথায় যাবি বন্ধুদের সাথে। মাকে বলে দিলে আমি একটা টাকাও দিবো না তোকে।
ইমন ব্যস্ত হয়ে বললো, এই না না, আমি তো মজা করছিলাম। মাকে কিছু বলবো না কিন্তু তুই এমন করিস না।
কথাটা যেনো মনে থাকে।

ইসরা চলে গেলো নিজের রুমে আর ইমন পেছন থেকে বিড়বিড় করে বললো, একেই বলে ফাটা বাঁশে পা আটকে যাওয়া।
ইসরা রুমে গিয়ে ফুলের উপর আলতো করে হাত বুলালো। জীবনের প্রথম তাকে কেউ ফুল দিলো। অজানা কারণে ভালো লাগছে ইসরার। ফুলের তোড়া টেবিলে রেখে চিরকুট ডাইরির ভেতরে রাখলো যত্ন করে। যদিও ডাইরিতে কিছু লেখা নেই। ডাইরিটা ইমন ইসরাকে উপহার দিয়েছিলো জন্মদিনে। এটা ইমনের নিজের টাকায় কেনা। টিউশন পড়িয়েছিলো ইসরার জন্মদিনে উপহার দিতে। একটা ডাইরি, একটা কলম আর একটা কালো রঙের শাড়ি। ইসরা সেদিন খুশিতে কান্না করে দিয়েছিলো। যত্ন করে রেখে দিয়েছে তিনটা জিনিসই। ইসরা বলেছে ইমনের বিয়েতে শাড়িটা পড়বে।

ইসরা একদম রেডি হয়ে বের হলো রুম থেকে। ব্রেকফাস্ট করে ইমনকে সাথে নিয়েই বের হলো। ইমন কলেজের সামনে নেমে গেলে ইসরা এগিয়ে যেতে বললো রিকশাওয়ালাকে। হসপিটালের সামনে এসে না চাইতেও চোখ এদিক ওদিক যাচ্ছে। অবচেতন মন আয়মানকে খোঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু কোথাও তার দেখা নেই।
হঠাৎ ইসরার ফোন কেঁপে উঠলো, একটা ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজ দেখে ইসরার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো।
এদিকে ওদিক তাকিয়ে আমাকে খোঁজে লাভ হবে না। আমি ঠিক পনেরো দিন পরেই তোমার সামনে দাঁড়াবো।
ইসরা থতমত খেয়ে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে হসপিটালের ভেতরে চলে গেলো। নিজের চেম্বারে গিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। গ্লাসের সবটা পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। ইসরা এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো এটা আয়মান দেখেছে মানে সে আশেপাশেই ছিলো তার।

হাতে গোনা দিনগুলো এভাবেই কাটতে লাগলো। প্রতিদিন সকালে নতুন কোনো ফুলের সাথে একটা করে চিরকুট আর তাতে লেখা আর কতদিন বাকি আছে, সাথে সুন্দর দিনের শুভকামনা। রাস্তায় ইসরা এদিক ওদিক তাকালেই ফোনে ম্যাসেজ। কখনো বেখেয়ালি হয়ে কোনো কাজ করলে এক গাদা ঝাড়ি আর জ্ঞান বিতরণ। ইসরাকে এক মুহূর্ত সময় দেওয়া হয় না নিজের চিন্তা থেকে আয়মানকে সরানোর। ইসরা যেনো প্রতিটা নিশ্বাসের সাথেই ভাবে আয়মানের কথা। তবে এবার সে বিরক্ত হয়ে গেছে আয়মানের এই লুকোচুরি খেলায়। পনেরো দিন যেতে আর মাত্র দুদিন বাকি আছে। সময় যতো এগিয়ে আসছে ইসরা দোটানায় ভুগছে। রিকশা না পেয়ে হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে কিন্তু চিন্তায় তখনো আয়মান।

সকালে যাওয়ার সময় রিকশা পেতে একটু কষ্টই হয়। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় চলে এসেছে খেয়াল নেই ইসরার। একটা প্রাইভেট কার তার দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে সেদিকে খেয়াল নেই। গাড়িটা যখন একদম কাছাকাছি চলে এসেছে তখন হুঁশ ফিরলো ইসরার। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো ইসরা কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই হাতে টান অনুভব করলো। সব এতোটা তাড়াতাড়ি হয়েছে ইসরা বুঝে উঠতে পারিনি। চোখ বন্ধ করে কারো হার্টবিটের প্রচন্ড শব্দ শুনতে পেলো। এতো দ্রুত হার্ট বিট হচ্ছে যেনো হার্ট বেরিয়ে আসবে। ইসরা ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো। কেউ তাকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলবে। ইসরা চোখ তুলে তাকাতেই আয়মানকে দেখে চমকে উঠলো।
ইসরা ভেঙে ভেঙে বললো, আপনি ?

আয়মান কিছু না বলে রাগী চোখে তাকালো ইসরার দিকে। রাগে থরথর করে কাঁপছে আয়মান। ইসরার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গাড়িটার দিকে তাকালো। সামনে ল্যাম্পপোস্ট আঘাত করেছে সেটা আর সেখানে মোটামুটি মানুষের ভীড় হয়ে গেছে। আয়মান ইসরাকে ছেড়ে দিয়ে গাড়িটার কাছে গেলো মানুষের ভীড় ঠেলে। ইসরা আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। গাড়ির ভেতর থেকে টেনে বের করতেই বুঝতে পারলো পুরো নেশায় বুদ হয়ে আছে লোকটা। আরো রাগ বেড়ে গেলো আয়মানের। লোকটাকে কয়েকটা চড় থাপ্পড় মারতেই আশেপাশের মানুষ থামালো আয়মানকে। ইসরা রাস্তায় নামলেও মাঝের দিকে যায়নি বরং ফুটপাতের কাছ ঘেঁষে হাটছিলো তাই দোষটা ড্রাইভারের। একজন পুলিশকে খবর দিয়ে দিলো। আয়মান আবার ইসরার কাছে এসে দাঁড়ালো। রাগে মুখটা লাল হয়ে গেছে। ইসরা আয়মানকে শান্তশিষ্ট হিসাবেই জানে তবে আজ বুঝলো রেগে গেলে ভয়ংকর হয়ে যায়।

আয়মান ইসরার কোথায় লেগেছে কিনা দেখতে গেলে ইসরা বললো, আমি ঠিক আছি।
আয়মান আর কিছু না বলে ইসরার হাত ধরে টেনে নিজের গাড়িতে বসিয়ে দিলো। ইসরার পিছনে গাড়ি নিয়ে ধীর গতিতে চলছিলো আয়মান। ইসরা ফুটপাত রেখে রাস্তায় নেমে যেতেই আয়মানও নেমে যায় গাড়ি থেকে। উদ্দেশ্য কোনো উপায়ে ইসরার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটানো আর আবার ফুটপাত ধরে হাটাতে বুঝানো। কিন্তু তার আগেই গাড়িটা চোখে পড়ে যায় আয়মানের। একটু যদি লেট হতো কিংবা সে তখন গাড়ি থেকে না নামতো তাহলে কী হতো ভাবতেই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে আয়মান। ইসরা ভয়ে কিছু বলার সাহস পেলো না চুপচাপ বসে রইলো। গাড়ি হসপিটাল বা বাসা কোনো রাস্তায় যাচ্ছে না। এটা ঢাকার বাইরে যাওয়ার রাস্তা।

এবার ইসরা মুখ খুললো, এদিকে কোথায় যাচ্ছেন ? আমার ডিউটি আছে একটু পর থেকেই।
আয়মান লাল চোখে তাকাতেই ইসরা চুপ করে গেলো। আজ আয়মানকে দেখে ভয় করছে ইসরার।
বিড়বিড় করে বললো, মানুষ সামান্য একটা বিষয়ে এতটা রাগতে পারে কী করে ?
কথাটা শেষ করতেই ব্রেক কষলো আয়মান। ইসরা অনেকটা সামনে ঝুঁকে পড়ে আবার নিজেকে সামলে আয়মানের দিকে তাকালো বকা দেওয়ার জন্য কিন্তু আয়মানকে দেখে মুখ বন্ধ হয় গেলো। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
ইসরা ভয়ে ভয়ে বললো, কী হলো ?

আয়মান রেগে ইসরার দুবাহু চেপে ধরে বললো, এটা তোমার কাছে সামান্য বিষয় মনে হচ্ছে ? আমি ঠিক সময়ে না এলে, ঐ গাড়ির যে গতি ছিলো তাতে তোমার হাড়গোড় খোঁজে পাওয়া যেতো না।
ইসরা মুচকি হেসে বললো, জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। যার ভাগ্যে যা আছে সেটা হবেই।
আয়মান ইসরাকে এক ঝটকায় ছেড়ে দিয়ে বললো, তাই বলে কেউ বলেনি নিজের জীবন নিয়ে হেলাফেলা করতে। কেউ বলেনি খামখেয়ালি মতো রাস্তায় চলতে। যদি দেখেশুনে রাস্তা চলতে না পরো তাহলে রাস্তায় বের হবে না তুমি। একবার ভেবে দেখেছো এখন তোমার কিছু হয়ে গেলে কি হতো ? আমার কথা না-হয় নাই ভাবলে, নিজের মা আর ভাইয়ের কথা তো ভাববে।
রাগী চোখ দুটো এবার পানিতে টলমল করছে। চোখেমুখে প্রিয় মানুষটাকে হারানোর ভয় স্পষ্ট। ইসরার বুঝতে দেরি হলো না আয়মান তাকে কতটা ভালোবাসে। আয়মান নিজের চোখের পানি লুকানোর জন্য অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু ইসরার চোখ ফাঁকি দিতে পারলো না। ইসরা আলতোভাবে আয়মানের হাতটা ধরতেই আয়মান চমকে তাকালো ইসরার দিকে। আয়মানের চোখে তখনো পানি। ইসরা নিজের হাতে মুছে দিলো সেই পানি।

আবেগময় গলায় বললো, এতোটা ভালোবাসেন ?
আয়মান অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো, আমার ভালোবাসার মূল্য আছে কারো কাছে ?
ইসরা কিছু না বলে আয়মানের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। পৃথিবীতে সবাই ভালোবাসার কাঙাল। কে না চায় তার জন্য কেউ ভাবুক, তার একটু কষ্টেও কেউ ব্যাথিত হোক, কেউ তাকে ভালোবেসে পাগলামি করুক। রক্তে মাংসে গড়া প্রতিটা মানুষ ভালোবাসা চায়। ইসরা তো তাদের থেকে ব্যতিক্রম নয়। তাই আয়মানের ভালোবাসা তার পাথরের মতো মনও গলিয়ে ফেলেছে। অতীতটা বিষাক্ত তাই বলে কী ভবিষ্যতটাও বিষাক্ত হবে ? ইসরা একবার সুযোগ দিতে চায় আয়মানকে, নিজের মনকে আর নিজেকে। আর আয়মানের শর্ত অনুযায়ী আরমানকে রিজেক্ট করার সঠিক কোনো উপায় খোঁজে পায়নি ইসরা। কী বলে আয়মানকে রিজেক্ট করবে সে ?

মেঘের অন্তরালে পর্ব ১৬+১৭

আয়মান ইসরার চোখে পানি দেখে ব্যস্ত হয়ে বললো, আরে আরে তুমি কাঁদছো কেনো ? আমি তো মজা করেছি একটু। প্লিজ যদি কষ্ট পেয়ে থাকো মাফ করে দাও। তবু কান্না করো না দয়া করে। তোমার চোখের পানি আমার সহ্য হচ্ছে না।
ইসরা হুট করে জড়িয়ে ধরলো আয়মানকে। এক সেকেন্ডে চুপ করে গেলো আয়মান। কী হচ্ছে বুঝতে একটু সময় লাগলো। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো
কাঁপা গলায় বললো, তুমি আমাকে।

ইসরা আয়মানকে ছেড়ে দিয়ে বললো, দুদিন আগেই আপনার উত্তর দিয়ে দিচ্ছি। আপনাকে রিজেক্ট করার মতো কোনো কারণ আমার কাছে নেই। একটা আছে আর সেটা হচ্ছে আমিই আপনার যোগ্য নই। কিন্তু এটা আপনার কাছে উপযুক্ত কারণ নয় সেটা আমি জানি।
আয়মান ভাবুক হয়ে বললো, তাহলে ?
ইসরা মলিন হেসে বললো, আমি এখন আমার পরিবারের একমাত্র ভরসা। নিজের সুখের কথা ভেবে মা আর ভাইকে ফেলে চলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

আয়মান সিরিয়াস হয়ে বললো, ভালোবাসো ?
ইসরা উত্তরে মলিন হাসলো আয়মানের দিকে তাকিয়ে। গাড়ি থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি থামিয়ে তাতে উঠে গেলো। ট্যাক্সি চলতে শুরু করলে একবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে আয়মানকে রহস্যময় হাসতে দেখলো। যে হাসির মানে বুঝতে পারলো না ইসরা।

মেঘের অন্তরালে শেষ পর্ব