মেঘের অন্তরালে পর্ব ১৩+১৪+১৫

মেঘের অন্তরালে পর্ব ১৩+১৪+১৫
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা

ইসরা নিজেকে সামলে মুচকি হেঁসে বললো, এখন কেমন লাগছে আপনার ?
আয়মান উত্তর না দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইসরার দিকে। ইসরার অস্বস্তি লাগছে আয়মানের দৃষ্টিতে। ইসরা আবারও একই প্রশ্ন করলো।
আয়মান মৃদু আওয়াজে বললো, ভালো।
ঠিক আছে, আপনি একটু রেস্ট নিন। আমি আপনার জন্য কিছু তরল খাবারের ব্যবস্থা করছি। স্যালাইন শেষ হলে খাবার দিতে হবে।
আয়মান কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে আছে। ইসরা নিজের কথা শেষ করে বের হয়ে গেলো। ইসরা বের হওয়ার দু’মিনিটের মধ্যে ইমন তাবুর ভেতরে এলো।

আয়মানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, স্যার আপনি ঠিক আছেন ?
আয়মান মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে ঠিক আছে।
ইমন একটা চেয়ার টেনে বেডের সামনে গিয়ে বসলো, আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান। ইচ্ছে ছিলো জীবনে একবার হলেও আপনার সাথে দেখা করবো।
আয়মান একটু অবাক হয়ে বললো, তুমি আমাকে চেনো ?
আপনাকে চিনবো না মানে, কী বলছেন ? আমি আপনাদের পাঁচজনকেই খুব ভালো করে চিনি। আপনাদের সব ভিডিও আমি দেখি আর আপনার ফটোগ্রাফির কথা তো বাদই দিলাম।
আমাকে এখানে কে এনেছে ?
আমি নিয়ে এসেছি, গ্রাম ঘুরে দেখতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে রাস্তা থেকে অনেকটা দূরে রক্তাক্ত অবস্থায় পেয়েছি আপনাকে। তবে আর কেউ ছিলো না সেখানে।
আমার ক্যামেরা বা ফোন কিছু পেয়েছো ?
ইমান হতাশ গলায় বললো, না।
তোমার কাছে ফোন আছে ?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফোন তো আছে কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক নেই একটুও। তাই কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়।
আয়মান হতাশ হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তার পায়ের যে অবস্থা, এই অবস্থায় এখান থেকে যাওয়া সম্ভব নয়। ওদের নিদিষ্ট কোনো জায়গায়ও ঠিক করা ছিলো না, যেখানে যোগাযোগ করবে। ওদের খোঁজতে হলে আয়মানের নিজে গিয়ে খুঁজতে হবে।
আমি এখন যাই, আপু যদি দেখে আমি আবার আপনাকে বিরক্ত করছি তাহলে বকবে।
আয়মান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, আপু ?
আপনাকে যে চিকিৎসা করছে সে আমার আপু, ডক্টর আনজুম ইসরা। এখন আপাতত আপনি আপুরই পেশেন্ট। আপনার দ্বায়িত্ব আপুকেই দেওয়া হয়েছে।
ইমন কথাগুলো বলে বের হয়ে গেলো। আয়মান নিজের মনে ইসরার নাম আওড়াতে লাগলো বারবার। একটা সময় নিজের অজান্তেই মুচকি হাঁসলো।

নিশি তোর পাপা এসে যদি দেখে তুই এখনো খাওয়া শেষ করিসনি, বকা দিবে কিন্তু।
খাবারের প্লেট নিয়ে পাঁচ বছরের নিশিতার পেছনে ছুটছে নিশিতার দাদী৷ কাজটা হয়তো তার মায়ের করার কথা ছিলো কিন্ত নিশিতা সেই ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি। মায়ের ভালোবাসা নিশিতার ভাগ্যে জুটেনি। জন্মের পর থেকে দাদীর কাছেই বড় হয়েছে।
নিশি তোমার স্কুলের জন্য লেট হচ্ছে, তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো।

নিশিতা ড্রায়িংরুমে দৌড়াচ্ছিলো খাবে না বলে। গম্ভীর আওয়াজ শুনে দাঁড়িয়ে গেলো নিশি। নিজের পাপার দিকে একবার তাকিয়ে চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো খেতে লাগলো। ফর্মাল পোশাকে বুকে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে নিহান। মেয়ের দিকে সে যতবার তাকায় ততবারই একটা মুখ চোখের সামনে ভাসে। সেটা অবশ্যই নীলা নয়, কারণ নীলার সাথে নিশিতার আকাশ পাতাল তফাৎ। অবিশ্বাস্য হলে সত্যি, নিশিতা দেখতে একদমই ইসরার মতো, শুধু গায়ের রং নয় মুখের ফেসও। নিহানের বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। নিশিতার খাওয়া শেষে নিহান নিশিতাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো। ওকে স্কুলে দিয়ে নিজেও অফিসে যাবে। ছেলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো নিহানের মা।

কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ কখনো সুখে থাকতে পারে না। নিহানও পারেনি সুখী হতে৷ সুখ তার জীবনে ধরা দিয়েও ফাঁকি দিয়ে চলেও গেছে আবার। নিহানের সাথে নীলার বিয়ের পর বেশ ভালোই চলছিলো নিহান নীলার সংসার। মাত্র কয়েক মাসে নিহান যেনো সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলো মোহিনী আর ইসরার কথা। অপরাধবোধ উবে গিয়েছিলো তার, সুখ যেনো উপচে পড়ছিলো তাদের জীবনে। একবছর সব ভালোভাবেই কাটে কিন্তু তারপর অজানা ঝড়ে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করে নিহান। গুরুতর আহত অবস্থায় হসপিটালে নেওয়া হয় তাকে।

সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও নিহানের পা দু’টো অকেজো হয়ে যায়। ডক্টর জানায় চিকিৎসা করলে ঠিক হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। নিহান পুরোপুরি ভেঙে পড়ে এসব শুনে, তবে নীলা তার পাশে ছিলো। নিহান হসপিটালে থাকতেই নীলা একদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে তার সামনে। নার্স গিয়ে দ্রুত ডক্টরকে ডেকে আনে। ডক্টর চেক করে জানায় নীলা প্রেগনেন্ট, তবু সিউর হওয়ার জন্য কিছু টেস্ট করানো হয়। রিপোর্ট পজিটিভ আসলে এতো বিষাদের মাঝে যেনো এক টুকরো খুশি ছড়িয়ে পড়ে। নিহানকে হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। নীলা অফিস চলে গেলে নিহানের মা নিহানের দেখাশোনা করে। সময় যত যেতে থাকে নীলা তত পরিবর্তন হতে থাকে। নীলার যখন ছয় মাস চলে সে হঠাৎ একদিন বলে, এ বাচ্চা সে জন্ম দিতে পারবে না।

এসব শুনে যেনো সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। নিহান কারণ জানতে চাইলে নীলা বলে নিহানের সাথে সে আর থাকতে পারবে না। নিহান যেমন একজন সুন্দরী বউ ডিজার্ভ করে নীলাও একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের সাথে নিজের জীবন কাটাতে চায়। সে আর নিহানের সাথে থাকতে পারবে না, অন্য একজনকে ভালোবাসে সে। এসব শুনে নিহান নিজের বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। সবাই অনেক বুঝাতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। নীলা বলে দেয় সে কোনো পঙ্গুর সাথে থেকে নিজের জীবন নষ্ট করতে পারবে না। নীলা নিজের বসের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। নীলাকে তার বস আগে থেকেই পছন্দ করতো, সেটা অনেকবার বলেছেও আর নীলা নিহানকে ভালোবাসে বলে কাটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নিহানের অসুস্থতায় নীলা একটু একটু করে বসের প্রতি দূর্বল হয়ে গেছে। এখন আর নিহানের কাছে থাকা সম্ভব নয় তার।

নিহান যখন বুঝতে পারলো নীলাকে তার ফেরানো সম্ভব নয় তখন শর্ত দিলো নীলা তাকে সন্তান দিলে তবেই সে নীলাকে ডিভোর্স দেবে। বাধ্য হয়ে নীলাও রাজি হয়ে যায়। সময় যত অতিবাহিত হতে থাকে নিহানের প্রতি নীলার আচরণ ততই বিষাক্ত হতে থাকে। কথায় কথায় পঙ্গু, জড়পদার্থ, অকেজো নানা বাজে কথা বলতো। নিহান শুধু নিজের সন্তানের কথা ভেবে সব মুখ বুজে সহ্য করে গেছে। নিজে নীলাকে কিছু বলেনি আর বাড়ির কাউকে কিছু বলতেও দেয়নি। নীলার এতো কাছের মানুষ ছিলো আমিরা, তার খাওয়া নিয়ে আর তাকে মোটি বলে কথা শুনাতে ছাড়েনি।

আমিরা একটু স্বাস্থ্যবান আর সে খেতে পছন্দ করে আমিরার ক্ষুতটা তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে নীলা। নিহান ভেবেছিলো সন্তান জন্ম নিলে তার দিকে তাকিয়ে নীলার মন ঘুরবে। কিন্তু নিশিতাকে দেখে নীলা মুখ কুঁচকে ফেলে। এতো কালো বাচ্চা তার, সেটা মানতেই পারেনি। মেয়ের মুখ দেখার পর একবার কোলেও নেয়নি। হসপিটাল থেকে সোজা নিজের বাবার বাড়ি চলে যায়, নিহানদের বাড়ি না গিয়ে। নিহানের অসুস্থতার কথা চিন্তা করে নীলার বাবা মাও নীলাকে সমর্থন করে। ডিভোর্স পেপার পাঠালে নিহান টলমলে চোখে সাইন করে দেয়।

নিশিতা বড় হতে থাকে নিহানের মায়ের কাছে আর অন্যদিকে নিহানের বাবা নিজের সর্বস্ব দিয়ে একমাত্র ছেলের চিকিৎসা করতে থাকে। নিজের মেয়ের সাথে নিহানও হাঁটতে শেখে আবার। নিহান ইসরাকে নিজের জীবন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো প্রতারণা করেছে বলে নয় বরং ইসরা কালো ছিলো বলে। সুন্দর হলে হয়তো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতো কিন্তু একবারও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করার কথা ভাবেনি ইসরার গায়ের রঙের জন্য। কিন্তু নিহান নিজের মেয়েকে দূরে ঢেলে দিতে পারেনি গায়ের রঙ দেখে। মেয়েটা যখন তার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেঁসে উঠতো নিহান যেনো এতো বিষাদের মাঝে এক টুকরো সুখ খোঁজে পেতো। নিশিতা যখন প্রথম ভাঙা ভাঙা বাংলায় বা বা বলেছিলো সেই অনুভূতি নিহান প্রকাশ করতে পারবে না।

পাপা স্কুল তো পেছনে রেখে এলে, গাড়ি থামাও।
মেয়ের কথা শুনে নিহান দ্রুত ব্রেক কষলো। নিজের অতীতে হারিয়ে গিয়েছিলো। নিহান গাড়ি ব্যাকে নিয়ে স্কুলের গেইটের কাছে নিলো। নিশিতা গাড়ির দরজা খুলতে গেলে নিহান দরজা লক করে দিলো। নিশিতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো নিহানের দিকে। কথায় কথায় ভ্রু কুঁচকানোর অভ্যাস নিজের বাবার থেকেই পেয়েছে নিশিতা।
কী হলো দরজা লক করলে কেনো ?
গতকালকের জন্য এখনো রাগ করে আছে নিশিতা নিজের পাপার উপর ?
নিশিতা গাল ফুলিয়ে বললো, আমি কারো উপর রেগে নেই।

ওকে আমি কানে ধরে সরি বলছি আর প্রমিস করছি আজ অবশ্যই ঘুরতে নিয়ে যাবো আমার নিশি মাকে।
তুমি সবসময় প্রমিস করে ভুলে যাও। তুমি জানো আমি গতকাল রেডি হয়ে কত সময় ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু তুমি কী করলে ? রাতে আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর বাসায় এসেছো।
তুমি বুঝতে পারছো না কেনো আমার সুপারগার্ল ? বস আমাকে এতো এতো কাজ দিয়েছিলো।
পঁচা বস তোমার, তাকে ইচ্ছে মতো বকে দিবা।
ঠিক আছে বকে দিবো, এবার খুশি ?

নিহান নিশিতার সামনে এক গাদা চকলেট দিয়ে বললো। চকলেট দেখে নিশিতার মলিন মুখে হাসি ফোটে উঠলো, নিহান সবসময় যে হাসিটা নিজের মেয়ের মুখে দেখতে চায়। নিশিতা চকলেটগুলো নিজের স্কুলব্যাগে ভড়ে নিহানের গালে চুমু খেয়ে নিলো।
ইউ আর দ্যা বেস্ট পাপা ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড। আমি সবার সাথে শেয়ার করে খাবো।
নিহান নিশিতার কপালে চুমু খেয়ে বললো, গুড গার্ল হয়ে থাকবে, কারো সাথে ঝগড়া করবে না।
তুমিও গুড বয় হয়ে থাকবে আর খাবার খেয়ে নিবে।
নিশিতা কথাটা বলে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। নিহানের ঠোঁটে মেয়ের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি ফোটে উঠলো। সে ভালো মানুষ হতে পেরেছে কিনা তার জানা নেই, তবে ভালো বাবা অবশ্যই হতে পেরেছে। নিশিতা গেইটের ভেতরে চলে গেলে নিহান অফিসের দিকে চলে গেলো।

রাতে আয়মানের তাবুতে ইমন ছিলো। আয়মানের অসহ্য লাগছে এভাবে বেডে শুয়ে থাকা। স্বভাবতই ফজরের আযানে ঘুম ভেঙে গেছে আয়মানের। এক জায়গায় দু দন্ড বসার মানুষ নয় সে আর এখন উঠে বসার শক্তিও পাচ্ছে না, শুয়ে থাকতেও ভালো লাগছে না। ইমনের দিকে তাকিয়ে দেখলো গভীর ঘুমে আছন্ন তাই নিজেই উঠে বসার চেষ্টা করতেই কাত হয়ে পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু পড়ে যাওয়ার আগেই কেউ ধরে ফেলে, আয়মানের মাথা গিয়ে পড়ে, ধরে রাখা মানুষটার বুকে। হার্টবিটের ধক ধক আওয়াজ আয়মানের কানে লাগছে। মাথা তুলে তাকাতেই চোখে পরে স্নিগ্ধ একটা মুখ। ইসরা নামাজ পড়ে আয়মানের কী অবস্থা সেটা দেখার জন্য এসেছিলো। তাবুতে ঢুকেই দেখে বসতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে আয়মান আর তাই দ্রুত গিয়ে ধরে ফেলে। পিঠের নিচে একটা বালিশ দিয়ে ভালো করে বসিয়ে দিলো আয়মানকে।
এভাবে একা একা বসতে যাচ্ছিলেন কেনো ? আমি সময় মতো না আসলে তো পড়ে যেতেন।
বেশী সময় এক জায়গায় থাকতে পারি না আমি। সেই গতকাল সন্ধ্যা থেকে এভাবে শুয়ে আছি। ভালো লাগছিলো না তাই বসার চেষ্টা করছিলাম।

ইমন ছিলো ওকে ডাকলেই পারতেন।
আয়মান পাশের বেডে তাকিয়ে দেখলো ইমন ঘুমিয়ে আছে বাচ্চা ছেলের মতো।
আয়মান মুচকি হেঁসে বললো, এতো সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে, জাগাতে ইচ্ছে করলো না।
ইসরা একবার ইমনের দিকে তাকিয়ে আবার আয়মানের দিকে তাকালো, কিছু খাবেন, ক্ষুধা পেয়েছে ?
ক্ষুধা তো পেয়েছিলো কিন্তু,,
ঠিক আছে আপনি বসুন আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি।

আয়মানের উত্তরের অপেক্ষা না করে ইসরা তাবু থেকে বেড়িয়ে এলো। আয়মান আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। গতকাল থেকে খেয়াল না করলেও এখন খেয়াল করলো জায়গাটা। একটা তাবুর ভেতর দুটো হসপিটালের বেড, একটা টেবিল তাতে অনেক অনেক মেডিসিনের বক্স রাখা। আরো অনেক হসপিটালের ছোট খাটো সামগ্রী। আয়মানের পর্যবেক্ষণের মাঝেই ইসরা সুপ নিয়ে তাবুতে এলো। গতকাল ইসরা খাইয়ে দিয়েছিলো তবে আজ আয়মানের সামনে রেখে খেতে বললো।
ফ্রেশ না হয়ে খাবো কী করে ? অন্তত দাঁত ব্রাশ তো করতে হবে।
সেটা আগে বলবেন তো।
আপনি আমার কথা শোনার আগেই তো চলে গেলেন।

ইসরা নিজের ভুল বুঝতে পেরে একটু লজ্জিত হলো। তারপর আবার গিয়ে একটা ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে নিয়ে এলো। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটু বেশি করেই আনা হয়েছে, কখন প্রয়োজন হয় বলা যায় না। তাই আয়মানের জন্য ব্রাশের ব্যবস্থা করতে কষ্ট করতে হয়নি ইসরাকে।
ইসরা আয়মানের হাতে ব্রাশটা দিতেই সে আশেপাশে তাকিয়ে বললো, এখানে ?
আপনাকে ধরে বাইরে নিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি আমার নেই।
আয়মান আর ইসরার কথোপকথনে ইমনের ঘুম ভেঙে গেলো। শেষে ইমন আয়মানকে ধরে বাইরে নিয়ে গেলো। এখানে ওয়াশরুম বলতে একটা টিউবওয়েল আছে আর টয়লেট। ইমন আয়মানকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করে আবার তাবুতে নিয়ে এলো। আগের মতো বেডে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে নিজেও ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
এবার খেয়ে নিন।

আয়মান ইসরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে চামচটা হাতে নিলো। হাতেও ব্যান্ডেজ থাকার জন্য ঠিকমতো ধরতে পারছে না। ইসরা তাকিয়ে দেখলো আয়মানের কষ্ট হচ্ছে নিজের হাতে খেতে। ইসরা একটু চিন্তা করে আয়মানের হাত থেকে সুপের বাটি আর চামচটা নিয়ে এক চামচ তুলে ধরলো মুখের সামনে। আয়মান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো ইসরার দিকে, অস্বস্তিতে পড়ে গেলো ইসরা।
ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না।
ইসরার কথায় আয়মান চোখ নামিয়ে নিয়ে সুপ টুকু মুখে নিয়ে আহ করে উঠলো।
ইসরা ব্যস্ত গলায় বললো, কী হলো ?
বেশী গরম কিছু খেতে পারি না আমি।

ইসরা খেয়াল করে দেখলো সুপটা ঢেকে রাখায় এখনো অনেক গরম আছে। পরের চামচ তুলে হালকা ফু দিয়ে ঠান্ডা করতে লাগলো। আয়মান ইসরার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো। তবে সেদিকে ইসরার খেয়াল নেই, তার দৃষ্টি চামচের দিকে। আয়মানের তাকিয়ে থাকার মাঝেই ইসরা চামচটা আয়মানের মুখের সামনে ধরলো। দৃষ্টি না সরিয়েই সুপ মুখে পুরে নিলো আয়মান। তার কাছে সবচেয়ে অখাদ্য উপাধিপ্রাপ্ত ভেজিটেবল সুপটাও আজ অমৃত লাগছে। আয়মান নিজের অনুভূতিতে নেই অবাক।
হাতের কাটা দাগটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইসরা। সাতটা বছর চলে গেছে, হাতের ক্ষতটা অনেক আগেই সেরে গিয়েছে। তবে দাগটা রয়ে গেছে এখনো।

ইসরা আনমনে বলে উঠলো, সাতটা বছর কম সময় নয় মিস্টার নিহান রেজওয়ান। হাতের ক্ষতটার মতো, আপনাদের দেওয়া মনের ক্ষতগুলো অনেক আগেই সেরে গেছে। তবে দাগগুলো রয়ে গেছে আগের মতোই। সেই দাগগুলো কখনো মুছবে না। চইলেও ভুলতে পারি না, আপনাদের করা সেই অপমানগুলো। আপনাদের জন্য আমার জীবন থেকে যা হারিয়েছে তার জন্য কখনো মাফ করবো না আপনাদের। মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে। নিজের মনের মতো স্ত্রী নিয়ে কেমন চলছে আপনার জীবন ? কতটা সুখী করতে পেরেছে আপনার সুন্দরী স্ত্রী, জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নিজেকে সামলে নেই আবার, অতীতের কোনো জায়গা নেই আমার জীবনে।

সেদিন সুইসাইডের চেষ্টা করে আমার মৃত্যু না, নতুন করে জন্ম হয়েছিলো। আগের সেই ইসরা মারা গিয়েছে সেদিন। জীবনে একদিন আপনার সামনে দাঁড়াবো, এটা বুঝাতে আপনি ছেড়ে গেছেন বলে আমি মেঘের অন্তরালে হারিয়ে যাইনি। মেঘের অন্তরাল থেকে সূর্যের আলোর মতো জ্বলজ্বল করছি। আমি ঠিক ততটা ভালো আছি, যতটা আপনার সাথে থাকলে কোনোদিন থাকতে পারতাম না। আমার সাথে যা করেছেন তার জন্য কোনো অভিযোগ নেই আপনার উপর, বরং আমি আপনার উপর কৃতজ্ঞ। জীবনের কঠিন সময়টুকু পারি দিতে আপনাদের করা অপমানগুলো আমাকে পাথরের মতো শক্ত হতে সাহায্য করেছে। কিন্তু আমার বাবার সাথে যা করেছেন তার জন্য কখনো মাফ করবো না।

আপু আজকে তো পেশেন্ট নেই তেমন, বিকেলে ঘুরতে যাবি ?
পেশেন্টের চাপ কম থাকায় মেডিসিন গোছাচ্ছিল, তখনই চোখ পরে হাতের কাটা দাগটার দিকে। গভীর ভাবে কেটেছিল বলে দাগটা এখনো স্পষ্ট, সেটা দেখে অতীত বিচরণ করছিলো ইসরা। এতো বছর পেরিয়ে গেছে তবু চোখ বন্ধ করলে প্রত্যেকটা অপমান এখনো কানে বাজে ইসরার। চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে রেজওয়ান বাড়িতে কাটানো বিষাদময় সেই দুই মাস। ইসরার জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম দুই মাস ছিলো সেটা। ইমনের ডাকে ইসরা ঘোর কাটে।
তুই তো ইচ্ছে মতো ঘুরছিস, আমাকে টানছিস কেনো এর মধ্যে ?
ইমন পাশের চেয়ারে বসে বললো, ইশ আপু তুই না একটা নিরামিষ। এতো সুন্দর একটা জায়গায় এতোদিন থেকেও যদি কিছু না দেখিস, তাহলে আসাটাই বৃথা যাবে তোর।

আমি এখানে বেড়াতে নয় বরং চিকিৎসা করতে এসেছি।
সেটা তো করছিসই, আমি তোকে কাজ বাদ দিয়ে যেতে বলছি নাকি ?
ইসরা কাজ রেখে ইমনের দিকে তাকিয়ে বললো, আমরা আর কতদিন আছি এখানে ?
ইমন হিসাব করে বললে, এই তো সাতদিনের মতো।
যাওয়া আগের দিন, যেখানে যেতে বলবি সেখানেই যাবো।

ইমন মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো ইসরার সামনে থেকে। আয়মান লেকের দিকে তাকিয়ে বুকে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়মান এখানে আছে আজ পাঁচদিনের মতো হলো। এখন খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে পারে, তবে ক্ষতটা গভীর হওয়ায় ঠিক হয়নি এখনো। ছোট ছোট যা আঘাত পেয়েছিলো, সবই ঠিক হয়ে গেছে অনেকটা। আয়মান ভাবছে ইসরার কথা। এই পাঁচদিন ইসরাই আয়মানের দেখাশোনা করেছে। ইসরা যতটা সময় আয়মানের সামনে থাকে অদ্ভুত অনুভূতি হয় আয়মানের। আয়মান শত চেষ্টা করেও সেই অনুভূতির কোনো নাম দিতে পারছে না। ইমন মুখ ফুলিয়ে আয়মানের পাশে এসে দাঁড়ালো।

আয়মান ইমনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, গাল ফুলানো মেয়েদের অভ্যাস। ছেলেটা গাল ফুলিয়ে থাকলে দেখে হাসি পায়।
মজা করবেন না ভাইয়া। আমি একদমই মজা করার মুডে নেই এখন।
ইমন এখন আয়মানকে ভাইয়া বলেই ডাকে। ইমন বারবার আয়মানে স্যার বলছিলো, তাতে অস্বস্তি হতো আয়মানের। তাই বলেছে যেনো ভাইয়া বলেই ডাকে।
তা কী কারণে মুড অফ তোমার ?
আপুকে বললাম আজ পেশেন্টের চাপ কম। চল বিকেলে কোথায় ঘুরতে যাই। কিন্তু গোমড়ামুখোটা রাজি হলো না।
তোমার আপু কী সবসময় এমন ?

ইমনের মুখটায় হঠাৎই কালো মেঘ ভীড় করলো মলিন গলায় বললো , আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আপু এমন ছিলো না। আপুর হাসির আওয়াজে বাড়ি মুখরিত হয়ে থাকতো সবসময়। মা মাঝে মাঝে রাগ করে বলতো ইশু মেয়েদের এতো শব্দ করে হাঁসতে নেই, লোকে খারাপ বলবে। আপুর সেই হাসি আর দেখা যায় না কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। এখন আপুর যে হাসিটা দেখা যায় সে হাসিতে কোনো প্রাণ থাকে না। কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে মানুষের সামনে নিজেকে হ্যাপি প্রমাণ করতে চায়।
আয়মান খুব মনোযোগ দিয়ে ইমনের কথা শুনছে।
ইমন দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তারপর হঠাৎ করেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। আপুকে মন খোলে হাসতে দেখি না আজ কতগুলো বছর।

আয়মান কৌতূহল নিয়ে বললো, এমন হয়ে যাওয়ার কারণ ?
ইমন রাগে চোখ মুখ লাল করে বললো, এমন কিছু মানুষ এর জন্য দায়ী, তাদের কখনো মাফ করবো না আমি।
ইমন আর কিছু না বলে চলে গেলো আয়মানের সামনে থেকে। আয়মান কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো ইমনের যাওয়ার পথের দিকে।

তুই আমাদের সাথে খেলতে পারবি না, তুই দূরে যা।
নিশিতা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমি কেনো খেলতে পারবো না ?
তুই যে কালো, আমাদের সাথে ছোঁয়া লাগলে আমরাও তোর মতো কালো হয়ে যাবো। তুই দূরে যা, এখানে আসবি না।
নিশিতা এবার শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। নিহান এসব দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ মেয়ের সাথে সময় কাটাবে বলে অফিস থেকে আগেই চলে এসেছে। নিশিতা পাশের পার্কে খেলতে এসেছে শুনে নিহান ফ্রেশ হয়ে মেয়ের কাছে এসেছে। মনিরা সাথে এসেছে নিশিতার তবে সে অন্য মহিলাদের সাথে গল্প করতে ব্যস্ত।
নিশিতা,,,

নিজের পাপার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকালো নিশিতা। নিহানকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।
কাঁদতে কাঁদতে বললো, পাপা আমাকে ওদের সাথে খেলায় নিবে না। আমি ছুঁয়ে দিলে ওরাও নাকি আমার মতো কালো হয়ে যাবে। পাপা আমি তো তোমাকে কত ছুঁই, দাদুকে ছুঁই তোমরা তো কালো হওনি।
মেয়ের কান্না শুনে নিহানের কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়ের চোখের এক ফোঁটা পানি তার বুকে তীরের মতো আঘাত করছে। ইচ্ছে করছে পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে।
নিহান ধরা গলায় বললো, কাঁদে না মা। কিছু হয়নি একদম কাঁদবে না।
নিহান নিশিতার দু গালে ধরে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু খেলো। নিশিতাকে কোলে তুলে সেই বাচ্চাদের কাছে গেলো। যে মেয়েটা নিশিতাকে এসব বলছিলো তাকে কাছে ডাকলো।
তোমার নাম কী মামুনি ?

মেয়েটা মুখ কালো করে বললো, আনিকা।
তো আনিকা মামুনি তোমার মনে হচ্ছে নিশিতা তোমায় ছুঁয়ে দিলে তুমিও কালো হয়ে যাবে।
হ্যাঁ হয়ে যাবো তো আর আমি এমন বিশ্রি দেখতে হতে চাই না।
কথাটা নিহানের বুকে আঘাত করলো। চোখ বন্ধ করে নিজের কষ্টটা গিলে নিলো।
দেখো নিশিতাকে আমি কোলে তুলে আছি। আমি কী কালো হয়ে গেছি ? নিশিতা সবসময় তার দাদীর কোলে থাকে, সে কী কালো হয়ে গেছে ?
আনিকা একটু ভেবে বললো, না।

তাহলে তোমরা কেনো কালো হয়ে যাবে নিশিতা ছুঁয়ে দিলে ? আর তোমার গায়ের দিকে তাকিয়ে দেখো কী রঙের জামা পড়েছো ?
আনিকা নিজের দিকে তাকিয়ে বললো, কালো ।
কালো রঙের জামা পড়ে তুমি কালো হয়ে যাচ্ছো না, তাহলে নিশিতা ছুঁয়ে দিলে কালো হয়ে যাবে ?
আনিকা কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেললো। নিহান আনিকার মাথায় হাত রেখে মনে মনে বললো, তুই তো বাচ্চা মেয়ে, অবুঝ। আমি একজন শিক্ষিত আর বুঝদার মানুষ হয়ে অমানুষের মতো আচরণে করেছি তাদের সাথে। আজ ঠিক বুঝতে পারছি তাদের কষ্টগুলো।
নিহান মুচকি হেঁসে বললো, নিশিতা কী খেলতে পারে তোমাদের সাথে ?

আনিকা মুচকি হেঁসে নিশিতার হাত ধরে নিজের সাথে নিয়ে গেলো। বাকি সবাইও নিশিতাকে তাদের সাথে খেলতে দিতে রাজি হয়ে গেলো। নিশিতার মুখে আবার হাসি ফোটে উঠলো। নিহানের চোখ থেকে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। কেবল তো শুরু, তার মেয়েকেও হয়তো জীবনে আরো অনেক মানুষের কথা শুনতে হবে। আজ বুঝতে পারছে ইসরার বাবার অবস্থা। মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে নিহান নিজেও আজ যে কোনো কিছু করতে রাজি। ইসরার বাবাও সেটাই তো করেছিলো, তবে তার পথটা ভুল ছিলো। নিহান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে পাশের বেঞ্চে বসে মেয়ের খিলখিল হাসি দেখতে লাগলো।

সন্ধ্যার আগে নিহান মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো, মনিরাকে আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলো। নিশিতা বাড়ি ফিরে দৌড়ে দাদীর কাছে চলে গেলো। নিহান রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে মাগরিবের নামাজে চলে গেলো। মোনাজাতে নিজের করা সব অন্যায়ের জন্য মাফ চাইলো আল্লাহর কাছে। তার পাপের শাস্তি যেনো তার মেয়ে না পায় আল্লাহর কাছে হাত তুলে কাঁদতে লাগলো। বাড়ি ফিরে মেয়েকে পড়তে বসালো। পড়ানোর মাঝেই খাইয়ে দিলো নাহলে না খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে। নিশিতা টিভিতে কার্টুন দেখছে আর বাকি সবাই ডিনার করছে।
আকরাম রেজওয়ান থমথমে গলায় বললো, নিহান তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।
নিহান খাওয়া রেখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, কী কথা বাবা ?
এভাবে আর কতদিন চলবে ?
মানে ?

তোমার কী মনে হয় না, তোমার এবার নিজের জীবন নিয়ে আগানো উচিত। আর কতদিন এভাবে একা থাকবে ? আমি ভাবছি তোমার আবার বিয়ে করা উচিত।
নিহান থম মেরে গেলো আকরাম রেজওয়ানের কথা শুনে। বিয়ে নামক সম্পর্কে আর জাড়ানোর ইচ্ছে নেই নিহানের। তার পৃথিবী এখন শুধু নিজের মেয়েকে নিয়ে।
একবার নয় বাবা, দু’বার তো হলো আর কত। আমার জীবনে যদি সুখ থাকতো তবে দু দু’বার আমার সাথে এমন হতো না।
নিহান সবার জীবনেই কিছু অতীত থাকে। তোমার অতীতটা নাহয় একটু বিষাদময়। অতীত আঁকড়ে আর কতদিন পড়ে থাকবে। জীবনটা ছোট নয় নিহান, এখনো অনেকটা পথ সামনে পড়ে আছে।
আমি অতীত আঁকড়ে পরে নেই। আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ আমার মেয়েকে ঘিরে। নতুন করে আর কোন ঝামেলা আমি চাই না। আশা করি এ নিয়ে আর কোনো কথা হবে না।

নিহান খাওয়া শেষ না করেই উঠে গেলো।
নিশিতা অনেক রাত হয়েছে, চলো ঘুমাবে। সকালে তোমার স্কুল আছে কিন্তু।
পাপা আর একটু দেখি না।
নিহান ধমক দিয়ে বললো, নিশিতা বেশি কথা আমি পছন্দ করি না।
নিশিতা ভয়ে টিভি অফ করে নিহানের আগে আগে রুমে যেতে লাগলো। নিহানের বাবা মা দুজনেই তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। ছেলেটার জীবন এমন অগোছালো হয়ে যাবে কখনো ভাবেনি তারা।
ভাইয়া আমিরা কল দিয়েছিলো আজ।
থমথমে গলায় আমিরের কথা শুনে ঘুরে তাকালো আকরাম। আমিরের মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না, খুব একটা ভালো খবর আছে।
কী বললো আমিরা ?

ভাইয়া ও তো আর থাকতে পারছে না। বেয়াইন আর তুষারের বড় বোন আমিরাকে যেনো সহ্য করতে পারে না। সব কাজে দোষ ধরে, সামান্য বিষয়ে বকাঝকা করে আর তুষারও মা আর বোনকে কিছুই বলে না।
তাহলে কী করতে চাইছো এখন ?
মেয়েটার কথা শুনে তুষারকে মেনে নেওয়াটাই ভুল ছিলো আমাদের। ছেলেটা আগে যেমন ছিলো এখন আর তেমনটা নেই। কী করবো কিছু বুঝতে পারছি না।
আমিরা ভালোবেসে বিয়ে করেছে তুষারকে। আমিরার পরিবারও মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে মেনে নিয়েছে। তুষারের পরিবারের পছন্দ ছিলো না আমিরাকে। সেটা নিয়ে শুরু থেকেই ঝামেলা ছিলো, দিন দিন যেনো সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রথম দিকে তুষার আমিরাকে সাপোর্ট করলেও সেও এখন তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। ভাইয়ের সংসারে বোনদের বাড়াবাড়ি করা কতটা খারাপ আমিরা ঠিক বুঝতে পারছে এখন। সে ইসরাকে যতটা জ্বালিয়েছে তার থেকে কয়েকগুণ তার ননদ তাকে জ্বালিয়ে মারছে। স্বামী বিদেশে আছে বলে সেও বাপের বাড়ি পরে আছে আর মায়ের সাথে মিলে আমিরাকে জ্বালিয়ে মারছে।

কী করছেন মিস ডক্টর ?
আয়মানের কথায় ইসরা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাঁসলো। অনেকটা ফ্রী হয়ে গেছে তারা।
এই তো বসে আছি, তা আপনার পায়ের কী অবস্থা এখন ?
আয়মান ইসরার পাশে ঘাসের উপর বসে বললো, এই যে হাঁটতে পারছি খুড়িয়ে খুড়িয়ে।
আপনার বন্ধুরা তো খোঁজতেও এলো না একবার।
খোঁজছে না সেটাও বা বুঝি কী করে আর ওরা কী অবস্থায় আছে সেটাও তো বুঝতে পারছি না। আদৌও সবাই সুস্থ আছে কিনা কে জানে ? আর আমিও যাওয়ার মতো সুস্থ নই।
এখনো তো ঠিক মতো হাঁটতে পারছেন না। তবে আশা করি আর দু-তিন দিনের মধ্যে অনেকটা সেরে যাবে।
হুম সেটা হলেই ভালো।

ইসরা কিছু বললো না, দুজনেই চুপচাপ কিছু সময় বসে রইলো। আয়মান আড়চোখে বারবার ইসরার দিকে তাকাচ্ছে, তবে ইসরার দৃষ্টি দূরের পাহাড়ের দিকে।
আপনি সবসময় এমন চুপচাপ থাকেন ?
ইসরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, কোথায় চুপচাপ থাকি ? নিজের পেশার জন্য হলেও বকবক করতে হয়।
প্রয়োজন ছাড়া কথা খুব কম বলেন।
অপ্রয়োজনীয় কথা বলে লাভই বা কী ?
অপ্রয়োজনীয় কথায় মন হালকা থাকে।
আপনাকে দেখেও মন হচ্ছে না প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলেন। যেটা নিজে করেন না সেটা আমাকে করতে বলছেন ?
আয়মান মুচকি হাঁসলো ইসরার কথায়। কথাটা ইসরা কিছু ভুল বলেনি।
আপনারা এখানে আর কতদিন আছেন ?
সাতদিনের মতো আছি, তবে সিউর বলতে পারছি না। সময় বাড়ানো হতে পারে।
আয়মান ছোট করে বললো, ওহ্।

ইমনের থেকে যতটা জেনেছি আপনি ইউএস থাকেন, এখানে কেউ নেই আপনার ?
ইসরার প্রশ্নটা কাঁটার মতো বিঁধল আয়মানের গায়ে। এই প্রশ্নটা সে বারবার এড়িয়ে যেতে চায় কিন্তু ভাগ্য এই প্রশ্নের কাছে দাড় করায়। উত্তর না পেয়ে ইসরা আয়মানের দিকে তাকালো। মুখটা কেমন থমথমে হয়ে গেছে তার।
আর ইউ ওকে মিস্টার ফটোগ্রাফার ?
রাগের মাঝেই ইসরার ফটোগ্রাফার ডাক শুনে অবাক চোখে তাকালো আয়মান।
মিস্টার ফটোগ্রাফার, এটা আবার কেমন নাম ?
কেনো আপনি তো ফটোগ্রাফারই ?
সেটা আমার পেশা, আমার নাম নয়।

ডক্টরও কিন্তু আমার পেশা নাম নয়। ওকে, নামটা মনে হচ্ছে পছন্দ হয়নি। ঠিক আছে মিস্টার আয়মান ?
আয়মান মুচকি হেঁসে বললো, আয়মান রেজওয়ান নিশান।
আয়মানের কথায় চমকে উঠলো ইসরা। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে তার, হাসিখুশি মুখটা মেঘের অন্তরালে ঢাকা পরে গেছে।
ইসরা কাঁপা গলায় বললো, আয়মান রেজওয়ান নিশান ?
আয়মান মুচকি হেঁসে বললো, ইয়েস ম্যাম, নিশান নামটা এমন একজনের সাথে মিলানো যাকে আমার একদমই পছন্দ নয়। তাই সবার কাছে আমি আয়মান নামেই পরিচিত ?
ইসরা চোখ বন্ধ একটা একটা ঢোক গিললো, চোখ বন্ধ রেখেই বললো, আমির রেজওয়ান ?

ইসরার মুখে নিজের বাবার নাম শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো আয়মান আর বললো, আমার বাবা, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে ?
ইসরা ফট করে চোখ খোলে তাকালো আয়মানের দিকে আর ভেজা গলায় বললো, রেজওয়ান পরিবার আমার জীবনের এমন একটা অধ্যায় যা চাইলেও ভুলতে পারবো না আমি। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে, এই পরিবার। আমার বাবাকে কেড়ে নিয়েছে আমার জীবন থেকে। জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত একরাশ ঘৃণা থাকবে রেজওয়ান পরিবারের উপর।
কথাগুলো শেষ করে ইসরা এক মুহূর্ত দেরি না করে উঠে গেলো আয়মানের পাশ থেকে। আজ বড্ড মনে পড়ছে বাবার কথা। একটা ভুলের শাস্তি কাউকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হয় জানা ছিলো না ইসরার। আয়মান হতভম্ব হয়ে বসে নিজের জায়গায়। ইসরার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে।

আজ কুয়াশার আনাগোনা সকাল থেকেই কম, পাহাড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল টকটকে একটা সূর্য। রক্তিম চোখে রক্তিম সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে ইসরা। সারারাত ঘুমাতে পারেনি, চোখের জলধারা সারারাতে একটুর জন্যও বন্ধ হয়নি। সে তো চলেই এসেছিলো নিহানের জীবন থেকে, তাহলে কেনো তারা ইসরার জীবন থেকে তার বাবাকে কেঁড়ে নিলো। তার বাবা তো নিহানকে কথা দিয়েছিলো আর কখনো ইসরার মুখ তাকে দেখতে হবে না, তবে কেনো এমন করলো তারা। আবার চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ছে ইসরার।
নিহান আর নীলার বিয়ের প্রায় মাস খানেক পর নিহান তার শশুরের অফিসে গিয়েছিলো কোনো কাজে। সেখানে গিয়ে দেখা হয়ে যায় ইখতিয়ার আহমেদের সাথে। নীলার বাবা ইখতিয়ার আহমেদের বস ছিলো।

ইখতিয়ার আহমেদকে দেখে নিহান সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়। নীলার বাবা নিহানকে জিজ্ঞেস করে সে ইখতিয়ার আহমেদকে চিনে কিনা। নিহানও তখন বলে দেয় উনিই ইসরার বাবা। অফিসে সবাই শুধু জানতো ইখতিয়ার আহমেদের মেয়ের বিয়ে নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়েছিলো, তবে পুরোটা অফিসের কেউ জানতো না। নীলার বাবা সব জানার পরে পুরো অফিসের সামনে ইখতিয়ার আহমেদকে অনেক কথাই শোনায়। যারা ইখতিয়ার আহমেদকে সম্মান করতো তারাও বাঁকা চোখে তাকায় তার দিকে। জীবনের এতোটা সময় ব্যয় করে অফিসে নিজের সততা আর নিষ্ঠা দিয়ে এতটা সম্মান অর্জন করেছিলো।

সব চোখের সামনে এক নিমিষে শেষ হয়ে গেলো। ইখতিয়ার আহমেদ সহ্য করতে পারেননি। বাড়ি ফিরে সেদিন রাতেই আবার হার্ট অ্যাটাক করে আর সবাইকে ছেড়ে পারি দেয় না ফেরার দেশে। ইসরার জীবনে নেমে আসে আরো একটা কালো অধ্যায়। বড় মেয়ে হওয়ায় নিজেকে শক্ত রেখে মা আর ভাইকে সামলেছে। ডাক্তারি পড়ার জন্য অনেকটা যুদ্ধই করতে হয়েছে তাকে। মামা আর বড় চাচা পাশে দাঁড়িয়েছিলো বলে আজ এখানে আসতে পরেছে। বাবাকে হারিয়ে আরো অনুভূতিহীন পুতুল হয়ে গেছে ইসরা। ইসরা চোখের পানি মোছার বৃথা চেষ্টা করলো, পুনরায় একাই ভড়ে উঠলো চোখ দুটো।

আপনি হঠাৎ এমন অদ্ভুত আচরণ কেনো করছেন আমি বুঝতে পারছি না।
আয়মানের আওয়াজ কানে যেতেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো ইসরার। অতীত যতই এড়িয়ে যেতে চায় কিন্তু অতীত ছায়ার মতো পিছু করতে থাকে।
আর আপনি আমার পরিবার সম্পর্কে জানলেন কীভাবে ?
ইসরা চোখ মুছে গম্ভীর গলায় বললো, নিজের কালো অতীতকে চিনতে কখনো কারো ভুল হয় না। আমিও অন্য সবার থেকে ব্যতিক্রম নই।
আয়মান অবাক হয়ে বললো, অতীত মানে ?
নিজের পরিবারের থেকে জেনে নিয়েন, সেটাই ভালো হবে।
ইসরা চলে যেতে নিলে আয়মান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, কোনো পরিবারের থেকে জানবো ? যাদের সাথে আমার যোগাযোগ নেই আজ প্রায় যুগ পেরিয়ে গেছে।
ইসরা থমকে দাঁড়ালো নিজের জায়গায়। মনে পরে গেলো নিশান নামটা সাত বছর আগেই ঐ বাড়িতে ছিলো বিলুপ্ত প্রায়। কারো মুখে নামটা পর্যন্ত শোনা যেতো না।
ইসরা থমথমে গলায় বললো, মানে ?

আয়মান বিষাদময় কণ্ঠে বললো, সে বাড়িতে আমার মতো ইনডিসিপ্লিন মানুষের জায়গা হয়নি। সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠো, ব্রেকফাস্ট করো, যার যার কাজে যাও আর রাত হলে এসে ঘুমিয়ে যাও। আমার এমন বিরক্তিকর লাইফ ভালো লাগতো না ছোটবেলা থেকে। আমি ছিলাম মুক্ত পাখির মতো, যাকে খাঁচায় বন্দী করা যায় না।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইসরা দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলো আয়মানের কথা। আয়মানের কথায় ছিলো বিষাদের ছায়া।
ছোটবেলা থেকে বাড়ি নিয়ম ভাঙার জন্য বকা খেতে হতো সবার কাছে। নিহান ছিলো আমার দু বছরের বড়।
নিহান নামটা কানে যেতেই মনটা যেনো বিষিয়ে উঠলো ইসরার। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো। আয়মান আবার বলতে শুরু করলো।

নিহানের নামের সাথে মিল রেখে বাড়িতে সবাই নিশান নামেই ডাকতো আমাকে। যেটা আরো বেশী বিরক্ত করতো আমাকে কারণ নিহানের সাথে আমার তফাত ছিলো আকাশ পাতাল। নিহান তেমন ছেলে, যেমনটা রেজওয়ান পরিবার চায় আর আমি ঠিক তার বিপরীত। স্কুল থেকে এসে প্রতিদিন নিহান আমার নামে কিছু না কিছু বিচার দিতো আর মায়ের হাতে মার খেতে হতো আমাকে। এভাবেই বড় হতে থাকি সময়ের সাথে আর নিহানের সাথে আমার দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। বড় ছিলো কিন্তু ভাইয়া ডাকতাম না তা নিয়েও বকা খেতে হতো। ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির দারোয়ান কাকা একবার নিহানকে ভয় দেখিয়েছিলো তারপর থেকে কালো মানুষ দুচোখে দেখতে পারে না নিহান। আমি কালো না, তবে ওর মতো ফর্সাও না, তাই আমার সাথে ওর এতো শত্রুতা।

একদিন সীমা ছাড়িয়ে ফেলে নিহান। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে চলে গিয়েছিলাম আবার ঠিক সময় বাড়িতেও চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু নিহান বাড়িতে সব বলে দেয় আর সেদিন বাবা বেল্ট দিয়ে অনেক মেরেছিলো। সেই রাগে নিহানকে মেরে হসপিটালে পাঠিয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই ওর থেকে লম্বা আর স্বাস্থ্য ভালো ছিলো ,তাই ও পেরে উঠেনি আমার সাথে। সেদিন বাবা আবার মারে আমাকে, আর বাড়ির সবাই কথা বন্ধ করে দিয়েছিলো আমার সাথে। নিহান অনেকটাই আহত হয়েছিলো, সুস্থ হতে বেশ সময় লেগে যায়। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর বাড়ি এসে বলে আমি বাড়িতে থাকলে ও এই বাড়িতে থাকবে না। বাড়ির আদর্শ ছেলেকে তো আর বাড়ি থেকে যেতে দেওয়া যায় না। তাই বাবা আমাকেই ইউএস পাঠিয়ে দিলো আমার ফুপির কাছে৷ সেই থেকে আমি পরিবার থেকে আলাদা, কেউ যোগাযোগ রাখেনি।

আমার সাথে কথা বলতো না, ফুপির থেকেই খোঁজ নিতো। প্রথম দিকে খুব কষ্ট হতো কিন্তু আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করিনি আমি। নিহানের বিয়ের সময় আমার জন্য ফুপিও আসেনি বাংলাদেশে। এই একজন মানুষ যে আমাকে অনেক ভালোবাসে। তার সাপোর্টে নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে আজ আমি এতদূর। আমার জীবনে বাবা-মা, ভাইবোন, পরিবার সব থেকেও নেই। আমার পৃথিবী আমার ফুপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে এসেছি প্রায় মাস হতে চললো কিন্তু রেজওয়ান বাড়ির কেউ জানেই না আমি বাংলাদেশে আছি এখন।
শেষের কথাটা আয়মান চাপা কষ্ট নিয়ে বললো। ইসরা আয়মানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চলে গেলো। আয়মান সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

আরো দুটো দিন কেটে গেলো, আয়মান অনেকটাই সুস্থ আর ইসরাদের এখানে থাকার মেয়াদও শেষ হয়ে আসছে। দু’দিনে ইসরা আয়মানকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। আয়মান আজ চলে যাবে ভেবেছে, তবে কাউকে জানায়নি। প্রতিদিনের মতো আজও ইসরা ফজরের নামাজ পড়ে লেকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর আয়মান গিয়ে পাশে দাঁড়ালো। এই দুদিন আয়মানকে দেখতেই ইসরা চলে আসতো, আয়মান ডাকলেও শুনতো না। আজও ইসরা যেতে নিলে আয়মান ইসরার হাত টেনে ধরে। আয়মান এই প্রথম ইচ্ছে করে ইসরাকে স্পর্শ করলো, ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলো ইসরা। অনেকটা বিষ্ময় নিয়ে ইসরা ঘুরে তাকালো আয়মানের দিকে।
আপনি আমার হাত,,,

ইসরাকে শেষ করতে না দিয়ে আয়মান বললো, হ্যাঁ ধরেছি।
আপনার সাহস হলো কীভাবে আমার হাত ধরার ?
আয়মান ইসরার হাত ধরে নিজের দিকে টেনে আনলো। মাত্র কয়েক ইঞ্চি দুরত্ব দুজনের মাঝে, ইসরা চমকে উঠলো আয়মানের কাজে।
আয়মান ইসরার দিকে ঝুঁকে বললো, আমার সাহস সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তোমার।
আরো একটা ধাক্কা খেলো ইসরা, বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললো, তুমি ?
আয়মান ভাব নিয়ে বললো, তুমি আমার থেকে কম হলেও ছয় সাত বছরের ছোট হবে। তাই তুমি বলায় অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ইসরা রাগী গলায় বললো, সমস্যা কী আপনার ?

আয়মান অসহায় গলায় বললো, সমস্যা আমার নয় তোমার ? আমি বুঝতে পারছি রেজওয়ান পরিবারের সাথে তোমার কোনো অতীত জড়িয়ে আছে। কিন্তু এতে আমার দোষ কোথায় বলো ? তাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্কই নেই।
ইসরা কঠিন গলায় বললো, শরীরে তো একই রক্ত বইছে।
সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই আমার, তবে তাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক থাকলেও মনের সম্পর্কটা নেই। তাদের ভুলের শাস্তি আমি কেনো পাচ্ছি ?
ইসরা ভ্রু কুঁচকে বললো, আমি কোথায় আপনাকে শাস্তি দিচ্ছি ? আমি তো আপনার সাথে কথাই বলিনি প্রয়োজন ছাড়া।
সেটাই তো আমার জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি।

ইসরা এবার অবাকের চরম পর্যায়ে। ভাবছে লোকটা মাথা ঠিক আছে তো নাকি, আবোল তাবোল বকে যাচ্ছে।
ইসরা কিছু না বলে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো আয়মানের দিকে। আয়মান এখনো ইসরার হাত ছাড়েনি আর তাদের মাঝের দূরত্বটাও আগের মতোই আছে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। একজনের চোখে বিরক্তি আর অন্যজনের চোখের ভাষা অন্য কিছু বলছে।
আয়মান ইসরার চোখে চোখ রেখে বললো, ভালোবাসি।
ইসরার বিরক্ত মাখা মুখটায় অবিশ্বাস ভড় করলো। ইসরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ভুল শুনেছে ভেবে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

জানি না কখন আর কীভাবে তোমার প্রতি এমন অনুভূতির শুরু হয়েছে। কিন্তু দুদিন তোমার এড়িয়ে চলা আমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তোমাকে ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ইসরা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। রক্ত লাল চোখে তাকালো আয়মানের দিকে। তবে আয়মানের মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো না। সে এখনো ইসরার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।
ইসরা কর্কশ গলায় বললো, কল্পনায় বাস করছেন আপনি, তাড়াতাড়ি বাস্তবে ফিরে আসুন। নাহলে এর থেকেও খারাপ পরিস্থিতিতে পরে যাবেন। নিজের পরিবারের থেকে আমার অতীতটা জেনে আসুন, ভালোবাসা উবে যাবে।
আমি জানতে চাই তোমার অতীত, তবে আমার পরিবার থেকে নয় তোমার নিজের মুখ থেকে। যেদিন সেচ্ছায় তুমি নিজের মুখে বলবে সেদিন শুনবো।

মেঘের অন্তরালে পর্ব ১০+১১+১২

ইসরা কিছু না বলে চলে আসতে নিলে আয়মান পেছন থেকে বললো, আজ বিকেলে চলে যাচ্ছি আমি। আজ সারাদিন সময় দিলাম তোমাকে, যাওয়ার আগে আমার উত্তরটা যেনো পাই আর হ্যাঁ ভেবো না এখান থেকে চলে গেলে আর খোঁজে পাবো না তোমাকে। তোমার পুরো বায়ো ডাটা আছে আমার কাছে।
ইসরা না দাঁড়িয়ে চলতে চলতেই আয়মানের সব কথা শুনতে পেলো৷ রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে ইসরার। এতো বছর পর কেনো অতীত তার সামনে আসলো, যে পরিবারকে জীবনে আর কোনোদিন নিজের চলার পথে আশা করেনি, ঘুরে ফিরে সেই পরিবারের সাথে দেখা হচ্ছে। সারাদিনে ইসরা কোনো কাজে মন বসাতে পারলো না। বারবার আয়মানের কথাগুলো মনে পড়ছে আর রাগ লাগছে। আয়মানও ঘুরে ফিরে বারবার ইসরার সামনেই আসছে কোনো না কোনো বাহানায়। দেখতে দেখতে পুরোটা দিন কেটেই গেলো। আয়মানের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে কিন্তু ইসরার দেখা নেই কোথায়ও। অনেকটা সময় অপেক্ষা করেও যখন ইসরার দেখা মিললো না, আয়মান হতাশ হয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

একবার পিছু ফিরে সবার মাঝে কাংখিত মানুষটাকে খোঁজে দেখলো, না নেই সে।
ভেবো না এতো সহজে তুমি ছাড়া পেয়ে যাবে। আয়মানের যেটা চাই সেটা সে আদায় করে নিতে জানে, ভয় নেই জোর করে নয়। মন জয় করে তোমার থেকে তোমাকে আদায় করে নিবো।
ইসরা ক্যাম্প থেকে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিলো আয়মানকে এড়িয়ে চলার জন্য। কিন্তু যখন মনে হলো ফেরা উচিত তখন দেখলো সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। এই কয়েকদিন ক্যাম্প থেকে একেবারের জন্যও বের হয়নি তাই কিছু চেনে না। ইসরা নিজেকে গালি দিতে লাগলো, কেনো একা বের হতে গেলো ভেবে। ইসরা যেদিকেই যাচ্ছে তার মনে হচ্ছে সে ঘুরে ফিরে একই জায়গায় আসছে।

নিহান নিশিতাকে স্কুল থেকে নিতে এসেছে আজ, নিশিতাকে বাসায় রেখে লান্স করে আবার অফিসে চলে যাবে। স্কুলে গিয়ে দেখলো অনেকক্ষণ আগে ছুটি হয়ে গেছে, প্রায় সব বাচ্চাই চলে গেছে। নিশিতাও নাকি অনেক আগেই চলে গেছে এক মহিলার সাথে। নিহান বাড়িতে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলো নিহানের মা এসে নিয়ে গেছে কিনা। কিন্তু নিহানের মা যখন বললো সে নিশিতাকে নিয়ে যায়নি, নিহানের পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। মেয়েটাই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তার, মেয়েটার কিছু হলে নিহান শেষ হয়ে যাবে৷ দারোয়ানের কাছে ভালো করে জিজ্ঞেস করে পাগলের মতো খোঁজতে লাগলো নিশিতাকে।

মেঘের অন্তরালে পর্ব ১৬+১৭