মেঘের অন্তরালে পর্ব ১০+১১+১২

মেঘের অন্তরালে পর্ব ১০+১১+১২
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা

নিহান স্তব্ধ হয়ে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত ইসরার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো। পকেট থেকে নিজের রুমাল বের করে কাটা জায়গাটা শক্ত করে বেঁধে দিলো। ইসরার বাবা তখনো মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিহান কিছু না ভেবে দ্রুত ইসরাকে কোলে তোলে বের হয়ে গেলে ইসরার বাবাও পেছনে ছুটে যায়। নিহান বাসায় আসার সময় নিজের বাবার গাড়িটা নিয়ে এসেছিলো। ইসরাকে পেছনের সীটে শুইয়ে দিলে ইসরার বাবা ভেতরে গিয়ে ইসরার মাথাটা কোলে নিয়ে বসলো। নিহান দ্রুত ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
ইসরার বাবা বিড়বিড় করে বলছে, আমি খুন করেছি আমার মেয়েকে। আমার জন্য আজ, আমার মেয়ের এমন অবস্থা। আমি খুন করেছি আমার মেয়েকে।

হসপিটালে পৌঁছালে নিহান পুনরায় ইসরাকে কোলে তুলে নিলো। ইসরার বাবা শুধু পুতুলের মতো নিহানের পেছনে যাচ্ছে। সে এখন নিজের মধ্যে নেই।
ইসরাকে ইমারজেন্সি কেবিনে নেওয়া হয়। নিহানের সাদা রুমালটা রক্তে ভিজে গেছে। রুমালের উপর দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পরছে। নিহান আর ইসরার বাবা দু’জনেই ক্লান্ত হয়ে সারিবাঁধা চেয়ারে বসে পড়লো।
ইখতিয়ার আহমেদ এখনো বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে, আমি খুন করেছি আমার মেয়েকে। আমি নিজের হাতে নিজের মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দিয়েছি।
নিহান দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। মেয়েটা এমন একটা স্টেপ নেবে সে ভাবতে পারেনি। যদি ইখতিয়ার আহমেদ না যেতেন তাহলে কী হতো ভাবতেই নিহানের কলিজা কেঁপে উঠছে। নিহান অফিসে চলে যেতো আর ইসরা সারাদিন ওভাবেই পড়ে থাকতো আর একটা সময় হয়তো নিঃশব্দে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতো। পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠলে নিহান বের করে দেখে অফিস থেকে কল দিয়েছে। নিহান উঠে একটু দূরে গিয়ে রিসিভ করলো।
স্যার আমি মিটিংয়ে আসতে পারছি না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিহান তুমি এখন এটা কী বলছো ? পুরো প্রজেক্ট তুমি দেখেছো আর তুমি সবচেয়ে ভালো জানো। এখন শেষ মুহূর্তে এসে না করলে আমি বিপদে পরে যাবো।
স্যার আমার খুব কাছের একজন হসপিটালে, অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমি এখন কোথাও যেতে পারবো না।
ঠিক আছে তুমি শুধু মিটিংটা করেই চলে যেও। ক্লাইট অলরেডি চলে এসেছে। বেশি সময় লাগবে না, তুমি আমাকে বিপদে ফেলো না প্লিজ।
নিহান একটু ভেবে বললো, ওকে স্যার আমি আসছি।

নিহান একবার ইখতিয়ার আহমেদের দিকে তাকিয়ে বের হয়ে গেলো হসপিটাল থেকে। সে জানে না তার যাওয়া উচিত হচ্ছে কিনা তবু যাচ্ছে। আজ মিটিংয়ে না গেলে কোম্পানির অনেক বড় লস হয়ে যাবে। কোম্পানির লস হলে মালিক নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দিবে না। এদিকে ইসরার কিছু হলে ইসরার বাবা তাকে কী করবে সেটাও তার জানা নেই। নিহান নিজের চারদিকে অন্ধকার দেখছে। বাসায় গিয়ে মিটিংয়ের ফাইল নিয়ে দ্রুত অফিসে চলে গেলো।
এদিকে নার্স বের হয়ে বললো, রোগীর সাথে কে আছেন ?
ইখতিয়ার আহমেদ মাথা নিচু করে কাঁদছিলেন। নার্সের কথায় উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে আমার মেয়ের ?
রোগীর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত রক্ত নেই। যা আছে তাতে হবে না আরো লাগবে।আপনি তাড়াতাড়ি রক্তের ব্যবস্থা করুন।
আমার আর ইসরার রক্তের গ্রুপ একই। যত রক্ত লাগে আমার থেকে নিন। শুধু আমার মেয়েকে ঠিক করে দিন।
ঠিক আছে আসুন আমার সাথে।

ইখতিয়ার আহমেদ নার্সের সাথে যাওয়ার আগে কল করে পারভীন বেগমকে সংক্ষেপে যতটা পারলেন বলে দিলেন। যত তাড়াতাড়ি পারে হসপিটালে আসতে বললেন। ইখতিয়ার আহমেদ রক্ত দিতে চলে গেলো। পারভীন বেগম কী করবে বুঝতে পারছে না ? এমন খবর পেয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। ইমন কাছেই ছিলো সে ফোনটা নিয়ে হুরকে কল দিলো। হুর সব জানা মাত্রই ইসরার বাড়ি গিয়ে পারভীন বেগম আর ইমনকে নিয়ে হসপিটালে চলে গেলো। হসপিটালে যাওয়ার বেশ অনেক সময় পর ইখতিয়ার আহমেদ আসলেন। রক্ত দিয়ে তাকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। পারভীন বেগম আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না। সবাই চুপচাপ বসে আছে কেবিনের বাইরে, ইসরার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। নিহান কোনোরকমে মিটিং শেষ করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো। মিটিংয়ে একদমই মনোযোগ দিতে পারছিলো না, বস সবটা সামলে নিয়েছে। নিহানকে সবার আগে ইমনের চোখেই পড়লো।

ইমন দৌড়ে গিয়ে নিহানকে মারতে লাগলো আর বলছে, তুমি আমার আপুকে মেরে ফেলেছো ? কেনো মেরেছো আমার আপুকে ? আমার আপু কতো ভালো তুমি কেনো মেরেছো আমার আপুকে ? আমিও তোমাকে মেরে ফেলবো, তোমার মতো বাজে ভাইয়া চাই না আমার।
নিহান ইমনের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে ইমনকে বাধাও দিচ্ছে না। আজ ইমন বড় থাকলে হয়তো নিহানকে এতো সহজে ছেড়ে দিতো না। হুর গিয়ে ইমনকে ছাড়িয়ে নিলো।

কঠিন গলায় বললো, কেনো এসেছেন এখানে ? এখনো বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সেটা জানতে ?
হঠাৎ ডক্টর বের হলে ইখতিয়ার আহমেদ তার সামনে গিয়ে দাড়ায় আর ভেজা গলায় বলে, আমার মেয়ে কেমন আছে ডক্টর ?
এখন বিপদমুক্ত, একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে। পেশেন্ট মানসিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। উনি রেসপন্স করতে চাইছিলেন না। তাই আমাদের এতো কষ্ট করে হলো। দেখুন সুইসাইড কেইস আমাদের পুলিশকে ইনফর্ম করতে হবে।
আমাদের কোনো অভিযোগ নেই কারো উপর। আমার মেয়ে বেঁচে আছে এটাই অনেক আমার জন্য। আমি চাই না এটা নিয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি হোক। আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি পুলিশকে জানাবেন না।
ডক্টর রাজি না হলে অনেক রিকুয়েষ্ট করার পর রাজি হয়।
আমরা ওর সাথে দেখা করতে পারি ?

পেশেন্ট কারো সাথে দেখা করতে চাইছে না।
ডক্টর চলে গেলে ইখতিয়ার আহমেদ নিহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ভেবেছিলাম আবার তোমার সামনে গেলে হাত জোর করে ক্ষমা চাইবো। কিন্তু এখন আর সেটা প্রয়োজন মনে হচ্ছে না। কারণ আমার করা অন্যায়ের খুব ভালো প্রতিশোধ নিয়েছো আমার মেয়ের উপর। আশা করি আর কোনো ক্ষোভ নেই আমার বা আমার মেয়ের উপর। আমি কথা দিচ্ছি আজকের পর আর কোনোদিন তুমি আমার মেয়ের মুখও দেখবে না। আমি নিজে চেষ্টা করবো যাতে ডিভোর্সটা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। তোমার জন্য নয় নিজের মেয়ের জন্য। এখন তুমি আসতে পারো।
নিহান নিচু গলায় বললো, আঙ্কেল ?

ইখতিয়ার আহমেদ কিছু না বলে নিহানের সামনে হাত জোর করে চলে গেলেন। নিহান মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। হুর নিহানের সামনে গেলো।
সেদিন আপনার অফিসে গিয়েছিলাম ইশুর হয়ে সাফাই গাইতে নয়। ইশু নির্দোষ সেটা প্রমাণ করতে।
ইসরা নিজের ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করে নিহানের সামনে ধরলো।
নিহান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে হুর বলে, এটা বিয়ে ভাঙার জন্য আপনাকে পাঠিয়েছিলো ইশু। দূর্ভাগ্য সেটা ফুপার হাতে পরে যায়।
বিয়ের আগে হাজারবার ইশু চেষ্টা করেছিলো বিয়েটা ভাঙার। হাজারবার আপনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো। ফুপার জন্য ওর সব দিকের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। যেটুকু সুযোগ ছিলো সব চেষ্টা করেছে।
নিহান চিঠিটা নিয়ে বললো, আমি একবার দেখা করতে চাই ওর সাথে।
সেটা আর সম্ভব নয় মিস্টার নিহান রেজওয়ান। অনেক উপকার করেছেন, ওকে হসপিটালে আনতে সাহায্য করে। এখন আপনি আসতে পারেন।

ইমন আবার রেগে নিহানের দিকে তেড়ে গেলে হুর ইমনকে টেনে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো।
উপরের সাদা ছাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে ইসরা। একহাতে স্যালইনের ক্যানেলা আর অন্যহাতে রক্তের। মুখটা কেমন ফ্যাকাসে লাগছে তার। ইসরা মনে করার চেষ্টা করলো ইখতিয়ার আহমেদকে কল দেওয়ার পর সে কী কী করেছিলো। কল কেটে দেওয়ার পর ইসরার নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছিলো। নিজের মাথার চুল টেনে কান্না করেছিলো চিৎকার করে।
হঠাৎই মনে হলো, বাবা কেনো আমাকে নিতে আসবে ? সে আসবে না আমাকে নিতে। আজ শুধু তার জন্য আমাকে এতো এতো অপমান মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে। আমি তো তার বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম তাই এভাবে তাড়িয়ে দিয়েছে। না না আমি আবার তাদের বোঝা হতে পারবো না। এর থেকে ভালো হবে এতো দূরে চলে যাবো যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। সেখানে আমি কারো এতো সমস্যার কারণ হবো না। আমাকে এতো অপমান সহ্য করতে হবে না।

ইসরা আনমনে এসব বলে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে থাকে। সাইড টেবিলে আপেলের সাথে রাখা ফল কাঁটার ছুরি তার কাজটা একদমই সহজ করে দিয়েছে। বামহাতের উপর বসিয়ে একটা টান ব্যস এটুকুই।
ইসরা,,,,
কারো ডাকে ঘাড় কাত করে তাকাতেই নিজের গর্ভধারিনী মাকে দেখে চোখের শুকনো জলের ধারা আবার ভিজে উঠে।
একবার আমার কথা ভাবলি না ? একবার মনে হলো না আমার মা, যে আমাকে জন্ম দিয়েছে সে আমার লাশ কীভাবে সহ্য করবে ? একবার আমার মুখটা ভেসে উঠলো না তোর চোখে। আমি কী অন্যায় করেছি ? আমাকে কেনো এতোবড় শাস্তি দিচ্ছিলি ?
মায়ের কথায় ইসরা কেঁদে উঠে বলে, আমাকে মাফ করে দাও মা। আমি আর কখনো এমন ভুল করবো না।
পারভীন বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে আর ইসরাও মাকে জড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।

ইমন কোথা থেকে দৌড়ে এসে বললো, আপু আমি আর কোথাও যেতে দিবো না তোকে। ঐ বাজে ভাইয়াটার সাথে তো একদমই না। তুই আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাবি না কথা দে।
ইসরা ছোট ভাইটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বড় ভাই হলে হয়তো কিছু করতে পারতো বোনের জন্য। ইখতিয়ার আহমেদ এতোক্ষণ কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো।
মাথা নিচু করে ঢুকে বলে, তুই হয়তো কোনোদিনই তোর পাপী বাবাকে মাফ করতে পারবি না। বিশ্বাস কর মা আমি তোর ভালোর জন্য এসব করেছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি আমার ভালো চাওয়া আমার সন্তানের জীবনে কাল হয়ে আসবে, তবে আর ভুল করবো না আমি। এই সমাজ যা ইচ্ছা বলুক আর করুক আমি তোর পাশে আছি। এবার থেকে যা হবে সব তোর ইচ্ছেতে হবে।

হসপিটালের সামনের খোলা জায়গায় একটা বেঞ্চে বসে আছে নিহান। আজ সবকিছু বিষাক্ত লাগছে তার কাছে। নিজের কাজের জন্য প্রচন্ড অনুশোচনা হচ্ছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই আজ। সব তার হাতের বাইরে চলে গেছে। হুরের দেওয়া চিঠিটা এখনো হাতে। খুব বেশি কিছু নয় মাত্র কয়েক লাইনের একটা চিঠি আবার চিরকুটও বলা চলে।
আমি আনজুম ইসরা, যার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তবে সে নই আপনি যাকে দেখেছেন। আপনি যাকে দেখেছেন সে আমার মামাতো বোন হুর ছিলো। এটা আমার বাবার ভয়ংকর পরিকল্পনা। হুরের মতো সুন্দরী মেয়েকে দেখিয়ে নিজের কালো মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা। আপনার ভালোর জন্য বলছি আপনি বিয়েটা ভেঙে দিন। আমি হুরের মতো নই বরং তার বিপরীত। দয়া করে আপনি আমার বাবাকে বলবেন না এসব আমি আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি। যত তাড়াতাড়ি পারেন বিয়েটা ভেঙে দিন, আল্লাহ হাফেজ।
আরো একটা মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে যাচ্ছিলে তুমি। পারবে তো নিজেকে ক্ষমা করতে।

কারো কথায় হকচকিয়ে তাকায় নিহান। পাশেই ছেঁড়া আর ময়লা পোশাকে এক পাগল বসে আছে। অন্যসময় হলে হয়তো নিহান ঘৃণায় মুখ কুঁচকে নিতো। কিন্তু পাগলের বলা কথায় সে বিস্মিত। আরো একটা মৃত্যুর দায় মানে কী ?
পাগলটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, বুঝতে পারছো না আমার কথা ? আমাকে চিনতে পেরেছো ? জানি চিনতে পারোনি। মোহিনীকে মনে আছে তোমার, নাকি তাকেও ভুলে গেছো ?
নিহান নিজের অতীত খুঁজে মোহিনী নামের কাউকে পেলো না।
কপাল কুঁচকে বললো, আপনি কোন মোহিনীর কথা বলছেন ?
আজ থেকে সাত বছর আগে তোমার জন্য কেউ আত্মহত্যা করেছিলো আর তুমি এতো তাড়াতাড়ি তাকে ভুলে গেলে।
কথাটা কানে যেতেই নিহানের গায়ের লোম কাটা দিয়ে উঠলো। হ্যাঁ মনে পরে গেছে নিহানের। আজ থেকে সাত বছর আগে তারই জন্য তার ভার্সিটির এক হিন্দু মেয়ে আত্নহত্যা করেছিলো। প্রত্যক্ষভাবে সে দায়ী না হলেও পরোক্ষভাবে সম্পূর্ণ সেই দায়ী।
নিহান ভয়ে ভয়ে বললো, আপনি ?

চিনতে পেরেছো তাহলে ? হ্যাঁ আমি সেই হতভাগী মোহিনীর বাবা। সেদিন তোমাকে আমি একটা ডাইরি দিয়েছিলাম। তুমি হয়তো পড়োনি, যদি পড়তে তাহলে আজ এই হসপিটালের সামনে বসে থাকতে না, সাথে তোমার জন্য আর কোনো মেয়েও মৃত্যুকে আপন করার কথা ভাবতো না। তোমার ভেতরের কুৎসিত মনটা মরে যেতো সেই ডায়রি পড়লে।
নিহান ফট করে উঠে দাঁড়ালো আর নিজের গাড়ির দিকে যেতে লাগলো। লোকটা পেছন থেকে হাসতে হাসতে বললো, চোখের পানির মূল্য তোমাকে দিতে হবে। নিজের কর্মের ফল থেকে কেউ পালাতে পারে না। তুমিও পারবে না, কখনো না।

নিহান গাড়ি নিয়ে বাসার দিকে গেলো, বাসায় পৌঁছে নিজের রুমে পাগলের মতো ডাইরিটা খুঁজতে লাগলো। মোহিনী মারা যাওয়ার পাঁচদিন পর ডাইরিটা মোহিনীর বাবা নিহানের কাছে পাঠিয়েছিলো নিহানের এক বন্ধুর হাতে। মোহিনীর আত্নহত্যা নিয়ে পুলিশ নিহানকে অনেক হয়রানি করেছিলো তাই রাগে ডাইরিটা ছুঁড়ে ফেলেছিলো রুমের এক কোণে। তারপর আর কখনো খোঁজ করেনি সেই ডায়রির। সাত বছর আগের ডাইরি এখন কী খুঁজলেই পাবে ? নিহান সারারুম তন্নতন্ন করে খুজেও ডাইরি পেলো না। এলোমেলো রুমের ফ্লোরে বসে পড়লো মাথায় হাত দিয়ে। হঠাৎ কী মনে করে নিজের মাকে ফোন দিলো।
মা আমার রুমে একটা ডাইরি পেয়েছিলে ?

নিহানের মা তাড়াহুড়োয় বললো, তুই আবার ডাইরি লিখতে শুরু করলি কবে থেকে ?
মা আজ থেকে সাত বছর আগে তুমি আমার রুমে কোনো ডাইরি পেয়েছিলে ?
নিহানের কথা শুনে নিহানের মা একদম চুপ হয়ে গেলো। নিহান বারবার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
নিহানের মা গম্ভীর গলায় বললো, সেদিন বলেছিলাম অতীত হাঁতড়ে দেখ নিজের কোনো অন্যায় খোঁজে পাস কিনা। নিজের অন্যায় নিজের চোখে সহজে পরে না রে নিহান। দেখ তুই নিজেই নিজের করা অন্যায় খুঁজে পেতে সাতটা বছর সময় লাগিয়ে দিলি।
ডাইরিটা কোথায় মা ?

প্রতিদিনের মতো সেদিনও তোর রুম পরিষ্কার করতে গিয়েছিলাম। তোর ডাইরি লেখার অভ্যাস নেই, তাই তোর রুমে ডাইরি দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। কৌতূহলের বশেই ডাইরিটা নিয়ে পড়েছিলাম। সেদিন মনে হয়েছিলো তোর মতো ছেলেকে জন্ম দিয়ে পাপ করেছি আমি। নিজের উপর প্রচন্ড ঘৃণা হয়েছিলো। চোখ দুটোর বৃষ্টি সেদিন থামতেই চায়নি।
মা, ডাইরিটা কোথায় আছে ?
আমার আলমারির একদম নিচের তাকে, জুয়েলারি বক্সের নিচে। আলমারির চাবি ড্রয়ারে আছে।
এতোটুকু বলেই ফোন কেটে দিলো নিহানের মা। যে ছেলেকে নিয়ে সবসময় গর্ব হতো সেই ছেলেকে নিয়ে আজ সাত বছর ধরে লজ্জা হয় নিহানের মায়ের। তিনি নিজেই চান ইসরা চলে যাক নিহানের জীবন থেকে। কারণ নিহানের মতো মানুষ ইসরার মতো মেয়েকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে ডিজার্ভ করে না।

#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১১

নিহান প্রায় দৌড়ে নিজের মায়ের রুমে গেলো। চাবি নিয়ে আলমারি খোলে একটু খুঁজতেই ডাইরিটা দেখতে পেলো। নীল রঙের একটা সুন্দর ডাইরি। ডাইরিটা হাতে নিতে নিহানের হাত অস্বাভাবিক কাঁপছে। কাঁপা হাতে ডাইরিটা নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো। বেতের চেয়ারটাতে বসে ডাইরির প্রথম কয়েক পাতা উল্টালো সবই সাদা। বেশ কয়েকটা পাতা যেতেই ঝরঝরে বাংলায় নীল কালিতে লেখা কিছু কথা। হাতের লেখার প্রশংসা না করাটা অন্যায় হবে। নিহান লেখার উপর একবার আলতো করে হাত বুলিয়ে পড়তে লাগলো।
নীল নাকি বেদনার রঙ আবার বিষের রঙও নীল। তাই নিজের জীবনের বিষাক্ত কিছু অভিজ্ঞতা লেখার জন্য নীল ডাইরি আর নীল কলমই বেছে নিলাম। আমার নাম মোহিনী রায়। আমার বাবা দীপক রায়ের পুরো পৃথিবী আমি। আমার মা মারা যায় আমার জন্মের সময়।

বাবা-মায়ের লাভ ম্যারেজ ছিলো। মাকে খুব ভালোবাসে বাবা আর আমাকেও। তাই আমার দিকে তাকিয়ে জীবনে আর বিয়ে করেনি। বাবা-মা দুজনের বৈশিষ্ট্যের বাইরে গিয়ে আমার গায়ের রঙ হয়েছে কালো। কালো হওয়ার জন্য জীবনে অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমাকে কিন্তু আমার বাবা সবসময় আমার পাশে ছিলো। তাই কারো কথায় মাথা না ঘামিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসিখুশি থাকতাম সবসময়। কেউ কিছু বললে খারাপ লাগতো কিন্তু বাবার মুখের হাসি দেখলে আবার সব ভুলে যেতাম। বেশ চলছিলো আমাদের বাবা মেয়ের ছোট একটা পৃথিবী৷ বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য ভর্তি হলাম ইন্জিনিয়ারিং এ। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম সবসময়। একদিন ভার্সিটির ক্যাম্পাসে একটা মেয়ে একটা ছেলেকে প্রপোজ করছে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। জানার কৌতূহল হলো ছেলেটা কী করে ? খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি আমি। ছেলেটা মেয়েটার হাতের ফুল নিয়ে উঠে দাঁড়াতে বললো। মেয়েটাও খুশি হয়ে উঠে দাঁড়ালো।

মেয়েটা দাঁড়াতেই ছেলেটা নিজের হাতের ফুল মেয়েটার হাতে দিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, সরি নট ইন্টারেস্টেড।
সেই মুচকি হাসিতে যেনো হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। এরপর প্রায় দূর থেকে তাকে দেখতাম। মাঝে মাঝেই মেয়েরা তাকে প্রপোজ করতো আর সে মুচকি হেঁসে মানা করে দিতো। আমি শুধু তার হাসিটা দেখতাম। আস্তে আস্তে তার বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। নাম নিহান রেজওয়ান, সে মুসলিম। আমার এক বছরের সিনিয়র। তাকে দূর থেকেই দেখতে ভালো লাগতো আমার। সবচেয়ে ভালো লাগতো তার মুচকি হাসিটা। এভাবেই চলতে থাকে সময়। এক্সাম চলে আসায় সবাই ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে, অনেকদিন হলো নিহানের মুচকি হাসিটা দেখি না। সবসময় গম্ভীর মুখে বইয়ে ডুবে থাকে। অপেক্ষা করতে করতে অসহ্য হয়ে উঠলাম। এক্সাম এগিয়ে আসছে পড়াশোনয় মন বসাতে পারছিলাম না। একদিন তাকে ভার্সিটির পুকুরপাড়ে একা বসে বই পড়তে দেখে অদ্ভুত ইচ্ছা জাগলো মনে। আমি জানি তার উত্তর কী হবে তবু তাকে প্রপোজ করে তার মুচকি হাসিটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। আশেপাশে তাকিয়ে ভার্সিটির ভবনের সামনের গোলাপগাছ দেখতে পেলাম। সুন্দর একটা গোলাপ নিয়ে তার সামনে চলে গেলাম। পড়ায় এতোটাই ডুবে ছিলো আমার উপস্থিতি বুঝতে পারলো না।

তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে একটু জোরেই বললাম, আই লাভ ইউ।
আমার আওয়াজ তার কানে যেতেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে, কী বললে ?
আই লাভ ইউ।
নিহান বেশ কিছু সময় আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো আর উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। আমি তার মুচকি হাসিটা ভালোবাসি কিন্তু তার উচ্চস্বরে হাসি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছিলো।
নিহান হঠাৎ হাসতে হাসতেই উচ্চস্বরে বললো, এই তোরা কে কোথায় আছিস দেখে যা। এই নিহান রেজওয়ানের কতো খারাপ দিন এসে গেছে যে, এমন মেয়ের থেকেও প্রপোজ পেতে হচ্ছে।
নিহানের ডাকে অনেকেই এসে জড়ো হলো আর সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসছিলো। তাদের সবার হাসি গুলো আমার শরীরে কাঁটার মতো বিঁধছিলো আর নিহানের হাসিটা হৃদয়ে বিষাক্ত তীরের মতো আঘাত করছিলো। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে অনেকটা ভীড় জমা হয়ে গেলো সেখানে।

নিহান আমার চারপাশে একবার ঘুরে বললো, তোমাকে আমি আজ কিছু টাকা দিয়ে দিবো। বাড়ি যাওয়ার সময় একটা আয়না কিনে নিয়ে যেও আর রোজ বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে নিজের চেহারাটা একবার দেখে এসো। আমার মনে হয় তোমার বাড়িতে আয়না নেই। যদি থাকতো তাহলে তোমার সাহস হতো না নিহান রেজওয়ানকে প্রপোজ করার। নিহান রেজওয়ানকে প্রপোজ করার জন্যও মিনিমাম যোগ্যতা লাগে।
নিহানের কথায় উপস্থিত সবাই হাসতে লাগলো আর নানা বাজে কথা বলতে লাগলো আমাকে। সেখান থেকে এক ছু্ঁটে চলে এসেছিলাম বাসায়, দুদিন ভার্সিটি যাইনি। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এখানেই যে শেষ ছিলো না, তা আমার অজানাই ছিলো।

আচ্ছা নিহান তোমার কাছে আমার একটা প্রশ্ন। যদিও হয়তো সামনে করতে পারবো না কোনোদিন। কী অন্যায় করেছিলাম আমি ? সবার মতো আমাকেও তো মুচকি হেঁসে বলতে পারতে নট ইন্টারেস্টেড, নাহয় বিরক্তি নিয়েই বলতে। আমার বেলায় সব পাল্টে কেনো গেলো ? আমার গায়ের রঙটা বাকিদের থেকে আলাদা ছিলো বলে ? বিশ্বাস করো আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য ভালোবাসিনি নিহান। আমার ভালোবাসাটা একতরফা আর নিঃস্বার্থ ছিলো। জানো তো নিহান আমার অন্যায়টা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি তোমাদের সভ্য সমাজের একটা নিয়ম ভেঙেছিলাম।
এই সভ্য সমাজে মেয়েদের ভালোবাসা বিক্রি হয় ছেলেদের টাকার বিনিময়ে আর ছেলেদের ভালোবাসা বিক্রি হয়ে মেয়েদের রুপের বিনিময়ে।

আমি তোমাদের সভ্য সমাজের এই গুরুত্বপূর্ণ নিয়মটা ভেঙেছিলাম তোমাকে ভালোবেসে। তাই বলে শাস্তিটা এতো ভয়ংকর ? ভার্সিটি পা রাখতে পারি না সবার অপমানে। আমি হয়ে উঠেছি সবার হাসির খোরাক। যারা আমাকে চেনেও না তারাও আমাকে অপমান করার সুযোগ ছাড়েনি কখনো। এক্সামে প্রথমবার খারাপ রেজাল্ট হয়েছে আর বাবা খুব কষ্ট পেয়েছে। ভালোবাসার শাস্তি এতো কঠিন হয় জানলে কখনো চোখ তুলেই তাকাতাম না তোমার দিকে। উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করবো তুমি যেনো নিজের মনের মতো কাউকে পাও। যার সৌন্দর্য তোমাকে মুগ্ধ করবে, মনের সৌন্দর্য না বাইরের সৌন্দর্য। কারণ মনের কোনো দামই তো নেই তোমার কাছে। কাউকে এতোটা ভেঙে গুড়িয়ে দিও না, যাতে তার জীবনটাই মিথ্যা মনে হয়। বেঁচে থাকাটা অর্থহীন মনে হয় আর নিজেকে মনে হয় মূল্যহীন। ভালো থেকো প্রিয়, আজ থেকে তোমাকে এই ডাইরিতে বন্দী করে রাখলাম আর ভাববো না তোমার কথা। আজ থেকে শুধু নিজের আর নিজের বাবার কথা ভাববো, আলবিদা।

এতটুকু লেখার পর আর কিছু লেখা নেই। নিহান নিজের ঝাপসা চোখ মুছে সাদা পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলো।
মাঝামাঝি আবার লেখা, নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে হেরে গেছি। এই পৃথিবীর বাতাস আমার জন্য বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, নিশ্বাস নিতে পারছি না। আমাকে মাফ করে দিও বাবা।

তারপর সব পৃষ্ঠা সাদা, শেষের দিকে এসে আবার কিছু লেখা পেলো। তবে সেটা মোহিনীর হাতের লেখা নয় দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
আমার মোহিনী অনেক সাহসী ছিলো। এতোকিছুর পরও ভেঙে পড়েনি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু এই সভ্য সমাজ আমার মেয়েকে বারবার ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে তার আত্নবিশ্বাস। একের পর এক খারাপ রেজাল্ট আমার মেয়েকে শেষ করে দিচ্ছিলো। মানুষের অপমান সহ্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো। কখন যে মেয়েটা নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে হেরে গেলো বুঝতেই পারলাম না। সেদিন ভোরে মেয়েটার ঘুম আর ভাঙলো না। চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লো। আজ চারদিন হলো আমার মেয়েটা নেই, এখনো আমার গায়ে আমার মোহিনীর শরীর পোড়া গন্ধ লেগে আছে। সবাই বলছে আমি পাগল হয়ে গেছি মেয়ে হারানোর শোকে। আমি পাগল হয়নি, তবে যে সমাজ আমার মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে সেই সমাজে আমি থাকতে চাই না। কিন্তু দেখতে চাই উপরওয়ালা তোমার জন্য কী শাস্তি লিখে রেখেছে নিহান রেজওয়ান, নিজের চোখে দেখে যেতে চাই।

ডাইরিটা বন্ধ করে নিহান চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। আজ মাত্র তিন মাস নিহান মানুষের হাসি ঠাট্টা আর তেতো কথা সহ্য করেছে। তাতেই সে হাঁপিয়ে গেছে আর ইসরা তার হাসির খোরাক হওয়ার কারণে, প্রতি মুহুর্তে তাকে আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষতে করেছে। আর সেখানে মোহিনী মাসের পর মাস মানুষের অপমান সহ্য করেছে। মানুষের হাসির খোরাক হয়েছে আর শেষ পর্যন্ত নিজের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এই স্বার্থপর পৃথিবী থেকেই চলে গেছে। এতো অন্যায়, এতো পাপ কোথায় গিয়ে মুছবে নিহান। এতোকিছুর পরও মোহিনী তাকে কোনো শাস্তি দেয়নি। তার সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চায়নি কেনো তার জীবনটা এভাবে বিষিয়ে দিয়েছে। নিহান ডাইরিটা বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়লো। হঠাৎ কিছু ভেবে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। নিজের রুমে গিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেলো। হসপিটালের সেই জায়গাটায় গেলো যেখানে মোহিনীর বাবার সাথে দেখা হয়েছিলো। পুরো এরিয়া তন্নতন্ন করে খোঁজেও তাকে পেলো না। সবাইকে জিজ্ঞেস করলো কিন্তু কেউ বলতে পারছে না। নিহান ক্লান্ত হয়ে ফুটপাতে বসে পরলো আর কাঁদতে লাগলো। নিহানের চোখের পানিতে বুকে আঁকড়ে ধরে থাকা ডাইরির পাতাগুলো একটু একটু করে ভিজে যাচ্ছে।

দূর থেকে মোহিনীর বাবা নিহানকে দেখে বললো, এই চোখের জলই হয়তো তোমার মনের কালোটা ধুয়ে নিয়ে যাবে আর তোমাকে প্রকৃত একজন মানুষ তৈরি করবে।
মোহিনীর বাবা কথাটা বিড়বিড় করে বলে অচেনার উদ্দেশ্যে পারি দিলো। তার কোনো গন্তব্য নেই আছে শুধু পথচলা। যার পরিসমাপ্তি কোথায় জানা নেই তার।
নিহান হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মোহিনী বা তার বাবার কাছে আমি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু ইসরার সাথেও তো কম অন্যায় করিনি। ইসরার বাবা আমার সাথে যতটা অন্যায় করেছে তার থেকে হয়তো আমার করা অন্যায় নেহাত কম নয়।
নিহান চোখ মুছে নিলো আর উঠে দাঁড়ালো। হসপিটালের দিকে চলে গেলো। কিন্তু তার জন্য সেখানেও অপ্রত্যাশিত কিছুই অপেক্ষা করছিলো। হসপিটালে গিয়ে জানতে পারলো ইসরা হসপিটালে থাকতে চাইছিলো না কিছুতেই। এই অবস্থায় তার উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয় তাই তার কথা মতো তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার বাকি চিকিৎসা তার বাড়িতেই হবে।

Time and tide wait for none.
সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। তারা নিজের গতিতে বয়ে চলে। নিহানের সামনে রাখা আছে ডিভোর্স পেপার আর তাতে ইসরার সিগনেচারও করা আছে। কেটে গেছে আরো তিনটা মাস। অনেক চেষ্টা করেও নিহান ইসরার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করতে পারেনি। ইখতিয়ার আহমেদ নিজের কথা রেখেছেন। নিহান আর ইসরার মুখ দেখেনি সেদিনের নেতিয়ে পড়া সেন্সলেস মুখটা দেখার পর। নিহান এই দিনের অপেক্ষায় তো ছিলো তাহলে আজ কেনো কলমটা সে ধরে রাখতে পারছে না। অস্বাভাবিক কাঁপছে নিহানের হাতটা, মস্তিষ্ক বলছে নিহান সাইনটা করে দে আর মন বলছে সত্যি কী তুই সাইনটা করতে চাস ?
কী হলো নিহান সাইনটা করো।

পাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠে কথাটা কানে লাগলো। তার কাঁধে হাত রেখে বসে আছে তার হবু স্ত্রী নীলাদ্রিতা, সবাই তাকে নীলা বলেই ডাকে। ইসরা চলে যাওয়ার পরই নিহানের জন্য মেয়ে দেখা শুরু হয় আবার। এবার আর কোনো ভুল করা যাবে না। নীলা দেখতে এক কথায় অসাধারণ সুন্দরী। হুরের থেকেও এক ধাপ এগিয়ে, দুধে আলতা গায়ের রঙ, টানা টানা চোখ আর গোলাপি ঠোঁট। নীলা ঠিক তেমনটাই দেখতে যেমনটা নিহান সবসময় চেয়েছে নিজের স্ত্রীর মধ্যে। আজ তবু যেনো কোথাও একটা শূন্যতা কাজ করছে নিহানের মনে। সে কী চাইছে নিজেই বুঝতে পারছে না। নীলার সাথে বিয়েটা আঁটকে আছে শুধু এই ডিভোর্সের জন্য। সাইনটা করে দিলে হয়তো আজ বাদে কালই তাদের বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে যাবে।

আকরাম রেজওয়ান নিহানের কাঁপা হাতের দিকে তাকিয়ে বললো, এতোদিন তো এটাই চেয়েছিস। ইসরার সাথে ডিভোর্স আর তোর পাশে সুন্দরী হবু স্ত্রী। তোর চাওয়া সবই তোর সামনে, তাহলে কী এতো ভাবছিস ?
আমিরা হাসি মুখে বললো, ভাইয়া সাইন করো তো। কখন থেকে অপেক্ষা করে বসে আছি। আমি আর নীলা ভাবি একটু পার্লারে যাবো।
নিহান চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে বৃষ্টি ভেজা ইসরার মুখটা ভেসে উঠলো। কী অদ্ভুত আনন্দ উপচে পড়ছিলো সেদিন ইসরার মুখে। বৃষ্টিতে যেনো নিজের খোলস থেকে বের হয়ে এসেছিলো।

নীলা নিহানের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বললো, কী হলো আর কতক্ষণ এভাবে কলম হাতে বসে থাকবে ?
নিহান নীলার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। মেয়েটার চোখেমুখে বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে কাঁপা হাতে সাইনটা করেই দিলো নিহান। আজ থেকে সে ইসরার সাথের মিথ্যা সম্পর্ক থেকে মুক্ত। নিহানকে ঠকানোর শাস্তি ইসরার বাবা যথেষ্ট পেয়েছে আর নিহান পেয়েছে শিক্ষা। ইসরার জীবন নষ্টের জন্য নিহান দায়ী না হলেও মোহিনীর জীবনটা নিহানই নষ্ট করে দিয়েছে। ধ্বংস করে বাবা মেয়ের ছোট্ট একটা পৃথিবী। নিহানের সাইন করা হলে যে যার মতো নিজেদের কাজে চলে গেলো। আজ শুক্রবার কারো অফিস নেই সবাই বাড়িতেই আছে। ডিভোর্স পেপার নিহানের কাছে আরো দুদিন আগেই এসেছে। কেনো জানি সাইনটা করে উঠতে পারছিলো না। আজ সবার সামনে করতেই হলো। ডিভোর্স পেপারের সাথে আলাদা একটা খাম এসেছে। নিহান নিজের রুমে গিয়ে খামটা খোলে দেখলো একটা চিঠি আর দশ লক্ষ টাকার একটা চেক। যেটা বিয়েতে দেনমোহর হিসাবে দিয়েছিলো নিহান। নিহান চেকটা পাশে রেখে চিঠিটা খুললো।

কেমন আছেন মিস্টার নিহান রেজওয়ান ? আশা করবো অনেক ভালো আছেন। কারণ আজ আপনার সব ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। আমার সাথের মিথ্যা সম্পর্কটা থেকে আজ আপনি মুক্ত। দেনমোহরের টাকাটা ফেরত দিলাম, যেখানে বিয়েটাই মিথ্যা ছিলো সেখানে দেনমোহরের অধিকারও আমার নেই। হুর বললো চিঠিটা আপনাকে দিয়েছে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি আপনাকে ইচ্ছে করে ঠকায়নি। তাও যদি সন্দেহ থাকে আপনাকে আরো একটা প্রমাণ দিচ্ছি যেটার কথা হুরও জানে না।বিয়ের দুদিন আগে আপনাকে একটা ম্যাসেজ করেছিলাম। সেটা হয়তো আপনি দেখেননি। দেখলে হয়তো এতোগুলো দিন আপনার আমাকে সহ্য করতে হতো না, আর না আমাকেও এতোকিছু সহ্য করতে হতো। ম্যাসেজ করার আগে দুবার কলও করেছিলাম কিন্তু রিসিভ করেননি।

নিহান মনে করার চেষ্টা করতেই মনে পড়ে গেলো। বিয়ের ছুটি নেওয়ার জন্য অফিসে তার কাজের চাপ বেড়ে গিয়েছিলো। মিটিংয়ে থাকাকালীন ফোনটা কেঁপে উঠে। মিটিং শেষে বাইরে এসে দেখে আননোন নাম্বার তাই এতোটা গুরুত্ব দেয়নি। একই নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজও আছে। ম্যাসেজ ওপেন করে পড়তে যাবে তার আগেই পিয়ন এসে জানায় বস তাকে ডাকছে। ফোনটা পুনরায় পকেটে রেখে বসের কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। এরপর সেই ম্যাসেজের কথা পুরোপুরি মাথা থেকে বেড়িয়ে যায় অফিসের কাজ আর বিয়ের চাপে। নিহান দ্রুত নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে ম্যাসেজ খুঁজতে লাগলো। ম্যাসেজ ডিলিট করার অটো অপশন অন করা নেই, তাই ডিলিট না করলে সব ম্যাসেজই থেকে যায়। সিম কোম্পানির অনেক ম্যাসেজের ভিড় থেকে নিহান খুঁজে পেলো ম্যাসেজটা।

বিয়ের দুদিন আগে সবাই যখন ব্যস্ত। ইসরা বাবার রুমে গিয়ে নিজের ফোন খুঁজতে লাগলো। নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ইসরা ক্লান্ত হয়ে গেছে। সব চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে, তাই একটা শেষ চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ারে দুটো ফোনই পেয়ে গেলো। যে ফোনটা দিয়ে হুর নিহানের সাথে কথা বলেছিলো সেটা দিয়ে ডায়াল করতে জানতে পারলো তাতে ব্যালেন্স নেই। কাঁপা হাতে নতুন ফোনে নাম্বারটা তুলে কল করলো কিন্তু রিসিভ হলো না। একটু চিন্তা করে ম্যাসেজ লিখে পাঠিয়ে দিলো।
আমি আনজুম ইসরা, যার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। দয়া করে বিয়েটা ভেঙে দিন। আপনি যাকে দেখেছেন সেটা আমি নই আমার বোন হুর। একটা ভয়ংকর পরিকল্পনা আমার বাবার। পুরোটা এখানে বলা সম্ভব নয়, বিয়েটা ভেঙে দিন নাহলে আপনাকেই ঠকতে হবে।

বাইরে ইখতিয়ার আহমেদের গলা শুনে কাঁপা হাতে এতটুকু লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলো ইসরা। কী লিখবে ভেবে পায়নি, তাই যা মনে এসেছে লিখে দিয়েছে। ম্যাসেজ পাঠিয়ে ফোনগুলো আগের জায়গায় রেখে দরজার কাছে যেতেই ইখতিয়ার আহমেদের সামনে পরে যায়। ইখতিয়ার আহমেদ সন্দেহের চোখে তাকালে ইসরা পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। বিয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসরা আশায় ছিলো নিহান বিয়ে ভেঙে দিবে। সময়ের সাথে যখন বিয়েটা হয়েই যায় তখন ইসরা বুঝতে পারে নিহান হয়তো তার ম্যাসেজটা দেখেইনি।

ম্যাসেজ পরে নিহান কী রিয়াকশন দেবে ভুলে গেছে। মাত্র একটা মিনিট সময় নিয়ে যদি ম্যাসেজটা পড়তো তাহলে হয়তো সব অন্যরকম হতো। কিন্তু আজ শুধু অনুশোচনা ছাড়া কিছুই করার নেই। নিহান এখন শুধু চায় ইসরার কাছে একবার ক্ষমা চাইতে। নিহানের জানা নেই সে সুযোগ আদোও কোনোদিন হবে কিনা তার। সামনে নীলার সাথে বিয়ে কিন্তু নীলার প্রতি একবিন্দু মনোযোগ দিতে পারছে না সে। বাড়িতে বলেছিলো কিছুটা সময় নিতে কিন্তু সবাই একই কথা বলছে। ঝামেলা শেষ হলে ওয়েট করবো কীসের জন্য ? নীলা আমির রেজওয়ানের বন্ধুর ভাগ্নী। নিহানের বিষয়ে তারা সবই জানে আর সব জানার পর ইখতিয়ার আহমেদের কাজের বেশ নিন্দাও জানিয়েছে।

দোষ যেহেতু নিহানের ছিলো না আর বিয়েটারও কোনো মূল্য ছিলো না। তাই নিহানকে মেনে নিতে তাদের আপত্তি নেই এক বিন্দু।
আগের থেকেও ধুমধামে বিয়ে হচ্ছে নিহান আর নীলার। আজ তো নীলার মুখটা ঘোমটার আড়ালে ঢাকা নেই। নীলা তো সেজেগুজে বসে আছে নিহানের থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে। নিহান চোখ তুলে তাকালেই নীলা তাকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিচ্ছে বারবার। তাহলে নিহান কেনো পারছে না কবুল বলতে। মনে হচ্ছে গলাটা কেউ শক্ত করে চেপে ধরে আছে। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে নিহান আজ দ্বিতীয় বিয়ে করছে। তবে প্রথম বিয়েতে যে নিহান ছিলো আর আজ যে নিহান আছে দুজনের মধ্যে অনেক অনেক ফারাক। নিহান যেনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার। যাকে চায়নি তার বেলায় কতো সহজে কবুল বলে দিয়েছিলো আর আজ তার সামনে তার প্রত্যাশিত কেউ বসে আছে তবু কবুল শব্দটা তার কাছে আজ খুব বেশি জটিল মনে হচ্ছে। অনেকটা সময় ব্যয় করে দিলো নিহান কবুল বলতে। তবে শেষমেশ নিহান পেয়েই গেলো সবসময় চাওয়া অনুযায়ী একজন জীবন সঙ্গিনী। যার রুপ এক পলকে মুগ্ধ করার মতো।

#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১২

ইশু কী করছিস একা একা ?
হুরের কথায় পাশ ফিরলো ইসরা। মেয়েটা তাকে অনেক সাপোর্ট করেছে এতোদিন। এক মুহুর্তের জন্য একা ছাড়েনি ইসরাকে। সেই ঘটনার পর পুরো এক মাস সে ইসরার সাথেই ছিলো এই বাড়িতে। ইসরা অনেকটা সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরই হুর নিজের বাসায় ফিরে যায়।
কী হলো কী করছিলি বললি না তো ?
ইসরা কিছু না বলে হুরের দিকে নিজের ফোনটা এগিয়ে দিলো। হুর ফোনের স্কিনে তাকিয়ে কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলো।
বিস্মিত কণ্ঠে বললো, নিহান বিয়ে করে ফেলেছে ?
ইসরার ফোনের স্কিনে জ্বলজ্বল করছে নিহান আর নীলার বিয়ের ছবি। দু’জনকে দেখলে যে কেউ বলতে বাঁধ্য হবে পারফেক্ট জুটি। হুর ইসরার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
তুই কোথায় পেলি এই ছবি ?

আমিরা পাঠিয়েছে আর বলেছে, দেখে নাও কেমন মেয়ে আমার ভাবি হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
হুর একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। নিহান বিয়ে করবে সেটা জানাই ছিলো কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি করে ফেলবে হুর ভাবতেও পারেনি।
হুর ইসরার দিকে তাকিয়ে মলিন গলায় বললো, কষ্ট হচ্ছে তোর ?

হুরের কথায় ইসরা অবাক হয়ে তাকালো, আমার কেনো কষ্ট হবে বলতো ? নিহান আমার সাথে এমন কোনো আচরণ করেনি, যার জন্য তার প্রতি আমি সামান্যতম দূর্বল হতে পারি। যে মানুষটা আমাকে অপমান করার একটা ক্ষুদ্রতম সুযোগ ছাড়েনি তার জন্য কষ্ট হবে ? আর যা আমার ছিলোই না তা হারানোর জন্য কষ্ট পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। নিহান আমার জীবনের এমন একটা অধ্যায় যা আমি চাইলেও কখনো ভুলতে পারবো না। নিহান আমার জীবনের চরম একটা শিক্ষা, হয়তো ভবিষ্যতে সামনে আগাতে নিহান আর তার পরিবারের করা প্রত্যেকটা আঘাত আমাকে সাহায্য করবে। আমি থেমে যেতে চাইলে সেই আঘাত গুলো আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বেশ অনেকটা সময় নিরবতা বিরাজ করলো। দু’জনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে নীল আকাশে উড়া মুক্ত পাখি দেখতে লাগলো।
হোস্টেলে যেতে চাইছিস কেনো ?

ইসরা মুচকি হেঁসে বললো, সমাজের তিক্ত কথা থেকে পালাতে। সমাজের সাথে লড়াই করার যোগ্যতা অর্জন করে তবেই সমাজের মানুষের সামনে দাঁড়াবো। সেদিন প্রত্যেকের বলা প্রত্যেকটা কথার উত্তর দিবো।
তুই এখানে থেকেই সব করতে পারিস। তোর পরিবার তোর সাথে আছে, আমি তোর সাথে আছি।
আমার জীবনের দুর্গম পথটা আমি একাই চলতে চাই।
তার মানে তুই হোস্টেলে যাচ্ছিস ?
হুম, আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি।

তুই এই ঘাসফুলের মধ্যে কী খুঁজে পাইছিস বল তো আয়মান। সেই কখন থেকে একটা ঘাসফুলের ছবি তুলে যাচ্ছিস। আরে ভাই এর থেকে আমার ছবি তোল সেটা বেশি ভালো হবে।
আয়মান চোখের সামনে থেকে ক্যামেরা সরিয়ে তৌফিকের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকালো। কাজের সময় বিরক্ত করা একদম পছন্দ না আয়মানের আর তৌফিকের কাজই হলো তাকে কাজের সময় বিরক্ত করা।
তৌফিক আমতা আমতা করে বললো, ভাই তুই অনেক দেশে ঘুরছিস, অনেক ভালো ভালো ফটোগ্রাফি করেছিস। শেষমেশ এই ভাঙাচুরা বাংলাদেশে কেনো আসতে গেলি বলতো ?

তৌফিকের কথায় রাগী চোখে তাকালো আয়মান আর বললো, নিজের দেশ নিয়ে এমন কথা বলতে লজ্জা করলো না তোর ? বাংলাদেশের সৌন্দর্য সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাই নেই। সারাদেশ ঘুরে দেখার পর তুই বাংলাদেশের কথা কখনো ভুলতে পারবি না।
তৌফিক ভ্রু কুঁচকে বললো, আমি যতদূর জানি তুই বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার সময় খুব একটা বড় ছিলি না তাহলে এতকিছু জানলি কী করে ?
সেটা তোর জেনে কাজ নেই, তুই নিজের কাজ কর যা।

আয়মান আবার ঘাঁসফুলটির দিকে তাকিয়ে দেখলো আবছা কুয়াশায় ঘেরা ভেজা ঘাঁস ফুলটাতে একটা রঙিন প্রজাপতি বসে আছে। সেই অপরুপ দৃশ্য নিজের ক্যামেরায় বন্দী করে নিলো। মানুষ যেটাকে খুব সামান্য বা তুচ্ছ কিছু ভেবে অবহেলা করে আয়মান সেই জিনিসের মধ্যেই অতুলনীয় কিছু খোঁজে পায়। আর দশটা মানুষের কাছে যা অতি সাধারণ আয়মানের কাছে তা অতুলনীয়। আবার সবার কাছে যা অতুলনীয় মনে হয় আয়মানের কাছে তা খুবই সাধারণ জিনিস। আয়মান একজন ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফার। বেশ কয়েকবার ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট ফটোগ্রাফারের এওয়ার্ডও পেয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্জন বনজঙ্গল ঘুরে অনেক দুর্লভ ছবিও তুলেছে। যা অন্য কোনো ফটোগ্রাফারের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। আয়মান এবার এসেছে বাংলাদেশে। আয়মান এদেশ ছেড়ে গেছে প্রায় যুগ পেরিয়ে গেছে। তবু নিজের জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা কমেনি এক বিন্দু। আয়মান এবার ঠিক করেছে বাংলাদেশের সব মনোরম আর অপরুপ চিত্র নিজের ক্যামেরায় বন্দী করবে আর তুলে ধরবে সারা বিশ্বের সামনে। রাঙামাটির দুর্গম এক গ্রামে এসেছে আয়মান আর তার সাথে তৌফিক, রুবেল, জ্যাক আর এথেন্স। তারা মুলত একটা গ্রুপ। আয়মান, রুবেল আর তৌফিক জন্মগত বাংলাদেশি হলেও এখন ইউএসের নাগরিক আর জ্যাক এথেন্স দুজনেই জন্মগতভাবেই আমেরিকান। তাদের একটা যৌথ ইউটিউব চ্যানেল আছে। তাতে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা কোনো হলিউড সুপারস্টারের থেকে কম নয়। এই পাঁচজনের ফ্যানের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বিভিন্ন দেশের দুর্গম সব জায়গায় ভ্রমণ করে সেসব ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করে তারা। আয়মানের ফ্যানের সংখ্যা বাকিদের তুলনায় অনেকটা বেশি তার কারণ আয়মানের ফটোগ্রাফার পেশা।

তৌফিক আবার আয়মানের সামনে গিয়ে বললো, এবার চল ওরা সবাই জিপে ওয়েট করছে। যে বাজে রাস্তা পৌছাতে অনেক সময় লাগবে।
আয়মান মুখে কিছু না বলে শেষ ছবিটা তুলে জিপের দিকে যেতে লাগলো। জিপে উঠতেই জ্যাক আয়মানের হাতের ক্যামেরা প্রায় কেঁড়ে নিয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগলো। তৌফিক ছবি দেখে হা করে আছে। আয়মানকে ঘাঁসফুলের ছবি তুলতে দেখে সে বিরক্ত হয়েছিলো, যদিও সেটা নতুন কিছু ছিলো না। তবে এখন ছবিগুলো দেখে তৌফিক অবাক না হয়ে পারছে না। এতো সুন্দর লাগছে ঘাঁসফুল আর প্রজাপ্রতিটা।
তৌফিক মুচকি হেঁসে বললো, ভাই তোর হাতে জাদু আছে। তুই হাত দিয়ে যা ছুঁয়ে দিস তাই অতুলনীয় হয়ে যায়।
আয়মান কড়া চোখে তাকালো, তাতে তৌফিক ক্যাবলা মার্কা একটা হাসি দিয়ে সামনে তাকালো। কুয়াশার জন্য গাড়ি চালাতে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে এথেন্সকে। এসব রাস্তায় গাড়ি চালানোয় পটু এথেন্স, তাই আজও দ্বায়িত্বটা তার কাঁধেই পড়েছে। সবাই আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে গেলো শুধু এথেন্স আর আয়মান ছাড়া। এথেন্স বেশ মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছে আর আয়মান গভীর চোখে আশপাশে পর্যবেক্ষণ করছে।

রাঙামাটির অত্যন্ত দুর্গম এক গ্রামে মেডিকেল ক্যাম্পে এসেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস কোর্স শেষে সদ্য ইন্টার্নি কমপ্লিট করা একদল চিকিৎসক। এই গ্রাম দেখতে যতটা মনোরম, ঠিক ততটাই দুর্গম, যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই খারাপ। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া দুষ্কর। এখানকার মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকেও অনেকটা বঞ্চিত। সরকারি ভাবেই এই ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোট ১০ জন চিকিৎসক পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে পাঁচজন সদ্য ইন্টার্নি শেষ করে এসেছে আর পাঁচজন সিনিয়র। সব গুছিয়ে নিতেই দুদিন চলে গেছে। এখানে পনেরো দিন থাকবে মেডিকেল ক্যাম্প আর আশেপাশে সকল গ্রামের মানুষকে ফ্রী চিকিৎসা সেবা ও মেডিসিন দেওয়া হবে। চিকিৎসকদের থাকার ব্যবস্থা ক্যাম্পেই করা হয়েছে আর খাবার ব্যবস্থাও।

জানুয়ারির শেষ আর ফেব্রুয়ারির শুরুর সময় এটা। মোটামুটি শীতটা ভালোই পড়ে এখনো। আশপাশের পাহাড়গুলো যেনো লজ্জায় কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। খোলা মাঠের মতো একটা জায়গায় ক্যাম্প করা হয়েছে। সামনে বড় একটা লেক আর লেকের ওপাশে বড় বড় পাহাড়। জায়গাটা এতোটাই সুন্দর, বর্ণনা করাও কষ্টকর। একটা শাল গায়ের জড়িয়ে মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এক পঁচিশ বছর বয়সী রমণী। গায়ে কালো রঙের শাড়ীটা শীতে কালো হয়ে যাওয়া হাতটার সাথে যেনো মিলে গেছে। চোখে একটা মোটা ফ্রেমের চশমা। খুব সাদামাটা একজন মানুষ। তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই আজ এখানে পৌঁছাতে এই গ্রামের চাইতেও দুর্গম একটা পথ সে পাড়ি দিয়ে এসেছে।

ইসরা,,,,
ডক্টর মিষ্টির ডাকে পাশ ফিরে তাকালো ইসরা। ফজরের নামাজটা পড়েই এখানে চলে এসেছে। আশেপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না কুয়াশায়। তবু ভালো লাগছে ইসরার কাছে।
মিষ্টি হাতে হাত ঘঁষে পাশে দাঁড়িয়ে বললো, এতো সকালে এখানে কী করছো ? কুয়াশায় ঠান্ডা লেগে যাবে তো ?
লাগবে না।
ভেতরে চলো কিছু কাজ আছে গুছিয়ে নিতে হবে। একটু পর থেকেই পেশেন্ট আসা শুরু হয়ে যাবে।
ইসরা সামনে তাকিয়ে বললো, তুমি যাও আমি আসছি।

মিষ্টি চলে যাওয়ার একটু পরই হাজির হলো ইমন। ইমন এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র এখন। কলেজ বন্ধ থাকায় বায়না ধরে ইসরার সাথে এসেছে। ইসরার সব খরচ সরকার বহন করলেও ইমনের খরচ ইসরাকেই বহন করতে হবে। ইমন খুব ভ্রমন পিয়াসু ছেলে, তার ভ্রমণ করতে ভালো লাগে। তাই ভ্রমণ করার মতো কোনো সুযোগ সে হাতছাড়া করতে রাজি নয়।
আপু এখানে তো একটুও নেটওয়ার্ক নেই।
আফসোসের স্বরে ইমনের কথা শুনে ইসরা ঘুরে ইমনের কান টেনে ধরলো, তোকে আমি বারবার বলেছিলাম সেখানে একটুও নেটওয়ার্ক পাবি না। তবু জেদ ধরে আমার সাথে চলে এলি, ওদিকে মা বাড়িতে একা। এখন যদি নেটওয়ার্ক নেই নেটওয়ার্ক নেই বলে আমার মাথা নষ্ট করিস তাহলে আবার বাসায় পাঠিয়ে দিবো।
ওফ আপু কানটা ছাড়, ছিঁড়ে যাবে তো। নেটওয়ার্ক লাগবে না তবু আমি বাসায় যাচ্ছি না। তুই যতদিন এখানে থাকবি আমিও এখানেই থাকবো।

তাহলে আমার মাথা নষ্ট না করে যা এখান থেকে।
ইমন একবার সরু চোখে তাকিয়ে আবার নিজের তাবুতে চলে গেলো। ইসরা একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিজেও তাবুর দিকে গেলো। মিষ্টি ডেকে গেছে বেশ কিছু সময় হলো, এখন যাওয়া উচিত।
গ্রামের মাইকেল নামক এক চাকমা ছেলের সাথে বেশ ভাব হয়ে গেছে ইমনের। ছেলেটার ভাঙা ভাঙা বাংলা খুব ভালো লাগে ইমনের কাছে। ব্রেকফাস্ট করে সেই ছেলের সাথে গ্রাম দেখতে বেড়িয়েছে ইমন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে চললো তবু ইমনের কোনো খোঁজ নেই। ভয়ে কাঁপছে ইসরা, ইমনের কিছু হলে সে বা তার মা কেউ বাঁচবে না৷
ইসরা বিকেল থেকেই কান্না করছে আর সবাইকে বলছে যাতে ইমনকে খোঁজে বার করে। গ্রামের মানুষ খুঁজতে চলেও গেছে অনেকে।
আপু,,,,

ইমনের গলা কানে যেতেই ইসরা চমকে উঠে সামনে তাকালো। দৌড়ে ইমনের কাছে গিয়ে ঠাস করে গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
কোথায় গিয়েছিলি তুই, তোকে সাথে আনাই ভুল হয়েছে আমার। আগামীকাল সকালেই তুই ঢাকায় ফিরে যাবি। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি মায়ের সামনে দাঁড়াতাম কীভাবে ?
আপু আমার কথা তো শোন আগে।
আমি তোর কোনো কথা শুনতে চাই না তুই কাল,,,
ইসরা কথা শেষ করার আগেই গ্রামের লোকজন এক লোককে ধরাধরি করে ক্যাম্পে নিয়ে এলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এক্সিডেন্ট করছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত লেগে আছে।

ইসরা ব্যস্ত গলায় বললো, উনি কে আর এমন অবস্থা হলো কী করে ?
ইমন লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো, উনি ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফার মিস্টার আয়মান র,,,
ইসরা তাড়াতাড়ি উনার ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে, তুমিও এসো প্লিজ।
মিষ্টির ডাকে ইমনের পুরো কথা শোনা হলো না ইসরার, সেও ছুটলো মিষ্টির সাথে। শরীরের কাটা জায়গাগুলো ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগলো। ডান পায়ের অবস্থা ভালো নয়, হাঁটুর উপরে ক্ষতটা বেশ গভীর।
তুমি একটু পাশে বসো আমি দেখি মুরাদ কোথায় গেলো, সবাই তো ইমনকে খোঁজতে এদিক ওদিক চলে গেছে। তাদের খবর পাঠাতে হবে ইমন চলে এসেছে।
ইসরাকে কিছু বলতে না দিয়ে মিষ্টি বের হয়ে গেলো। তাবুতে রয়ে গেলো আয়মান আর ইসরা একা। আয়মানের অবশ্য এখনো সেন্স ফেরেনি। ইসরা আয়মানের জন্য মেডিসিন খুঁজতে লাগলো মেডিসিন বক্সে।

আপু,,
ইসরা পাশ ফিরে দেখলো ইমন দাঁড়িয়ে আছে।
ইসরা আবার মেডিসিন খুঁজতে লাগলো আর বললো, হুম বল কী বলবি।
আপু আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না, আমার আইডল আমার সামনে।
ইসরা ভ্রু কুঁচকে বললো, এ আবার কোনো দেশের প্রসিডেন্ট যে তোর আইডল হলো ?
ফেমাল ফটোগ্রাফার আর ইউটিউবার। আমি উনার কতবড় ফ্যান তুই জানিস ?
তা তোর এই আইডলের এমন হাল হলো কী করে ?

জানি না, আসলে সারাদিন মাইকেল এতো সুন্দর সুন্দর জায়গায় নিয়ে গেছে ফেরার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।বিকেলের ফেরার সময় রাস্তার থেকে অনেকটা দূরে এই অবস্থায় পেয়েছি। উনার সাথে আরো চারজন থাকে সবসময় তাদের দেখিনি কোথাও। প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে চিনতে পেরেছি আর সাথে নিয়ে এলাম।
দেখে তো মনে হচ্ছে এক্সিডেন্ট করেছে।
হতে পারে, জানি না।
ইসরা আর ইমনের কথার মাঝেই সেন্স ফিরে এলো আয়মানের, পিটপিট চোখে তাকালো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গেলে ব্যাথায় আহ্ করে উঠলো। সেই আওয়াজে ইমন আর ইসরা দুজনেই কাছে এসে দাঁড়ালো।
ইমন পাশে বসে বললো, এখন কেমন লাগছে স্যার ?

আয়মান ইমনকে দেখে চিনতে না পেরে বললো, আমি কোথায় আছি ? আমার সাথে যারা ছিলো তারা কোথায় ?
ইমন মুখ কালো করে বললো, আর তো কাউকে পাইনি শুধু আপনাকেই পেলাম।
আয়মান মনে করার চেষ্টা করলো কী হয়েছিলো, মাথাটা ব্যাথায় টনটন করছে তার। আয়মান অন্যমনস্ক হয়ে ফোনে গেইম খেলছিলো জিপে বসে। হঠাৎ সামনে কিছু এসে পড়ায় এথেন্স মোড় নিয়ে নেয় কিন্তু পাহাড়ি রাস্তা হওয়ায় গাড়ি সামলে উঠতে পারেনি সামনের বড় গাছে ধাক্কা খায়। আয়মান ড্রাইভিং সীটের পাশের সীটে বসেছিলো আর সীট বেল বাঁধেনি। সবাই জীপ থেকে এদিক ওদিকে পড়ে যায় আর আয়মান ছিটকে রাস্তা থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে পড়ে। আয়মানের খুব চিন্তা হচ্ছে ওরা সবাই কেমন আছে সেটা ভেবে।
আয়মান উঠে বসার চেষ্টা করতেই ইসরা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, উঠবেন না আপনি অসুস্থ।

মেঘের অন্তরালে পর্ব ৭+৮+৯

ছোট একটা কথা আয়মানের কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। আওয়াজটা আয়মানের কানে নয় বরং হৃদপিণ্ডে গিয়ে আঘাত করেছে। নিভু নিভু চোখে তাকালো ইসরার দিকে। স্পষ্ট দেখতে পেলো না তার আগেই চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো আবার সেন্সলেস হয়ে গেলো।
ইমন ব্যস্ত হয়ে বললো, আবার কী হলো আপু ?

এতো হাইপার হওয়ার মতো কিছু হয়নি একটু পরই আবার জ্ঞান ফিরে আসবে। তুই এখানে থাক আমি স্যারের সাথে কথা বলে আসছি।
ইমনকে আয়মানের কাছে রেখে ইসরা বের হয়ে গেলো। ইমন আবার আয়মানের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মুখটায় চাপদাড়ি সৌন্দর্যটা বৃদ্ধি করেছে। ইমনের খুব ইচ্ছে ছিলো জীবনে একবার হলেও আয়মানের সাথে দেখা করবে। আজ আয়মান তার সামনে, ছেলেটার যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না। ইমন ভ্রমণ পিয়াসু হওয়ায় আয়মানকে তার এতো পছন্দ। এছাড়া আয়মানের স্টাইলও ফলো করার মতো। ইমন পকেট থেকে ফোন বের করে সেন্সলেস আয়মানের সাথে কয়েকটা সেলফি তুলে নিলো।

ইসরা তাবুতে এসে ইমনের কান্ডকারখানা দেখে বললো, আগে ফ্রেশ হয়ে নে, সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরেছিস কে জানে ?
ইসরার কথা শুনে ইমনও বাধ্য ছেলের মতো ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ইসরা আয়মানের পাশে বসে হাতটা ধরে পালস চেক করতে লাগলো। ইসরা হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলো, বুঝতে পারলো পালস একটু কম। আয়মানের হাত ছেড়ে দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো ইসরা। কারণ আয়মান তার দিকেই তাকিয়ে আছে নিভু নিভু চোখে।

মেঘের অন্তরালে পর্ব ১৩+১৪+১৫