মেঘের অন্তরালে পর্ব ৭+৮+৯

মেঘের অন্তরালে পর্ব ৭+৮+৯
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা

ডাইনিং টেবিলে চুপচাপ নিজেদের ব্রেকফাস্ট সেড়ে নিচ্ছে রেজওয়ান পরিবার। সবাই খাবার খাচ্ছে মনিরা আর নিহানের মা সার্ভ করছে। ইসরা অনেকটা সাহস নিয়ে নিজের রুমের বাইরে পা রাখলো। আজ সাহস না দেখালে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করবে সে।
ইসরাকে দেখে নিহানের মুখের কাছে নেয়া চামচ থেমে গেলো। ইসরাকে প্রথম সেই খেয়াল করেছে আর তারপর নিহানের মায়ের নজরে এলো।

একটু অবাক হয়ে নিহানের মা বললো, তুমি এখানে ?
নিহানের মায়ের আওয়াজে সবাই খাওয়া বন্ধ করে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ইসরাকে দেখতে পেলো। ইসরাকে দেখে বরাবরের মতোই সবার মাঝে বিরক্তি লক্ষ্য করা গেলো। ইসরা কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
নিহান বিরক্ত হয়ে বললো, সকাল সকাল তোমার ড্রামা দেখার জন্য এখানে কেউ বসে নেই। তোমার কোনো কাজ না থাকলেও, এখানে উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষের কাজ আছে। তাই কিছু প্রয়োজন হলে দ্রুত বলো আর নাহলে আমাদের সময় নষ্ট করো না, যাও এখান থেকে।
নিহানের বাবা গম্ভীর গলায় বললো, নিহান তোমার মা কথা বলছে তো, তুমি এর মধ্যে কথা কেনো বলছো ?
নিহান চুপ করে গেলে নিহানের মা ইসরাকে আবার একই প্রশ্ন করলো। ইসরা নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার বাইরে কিছু কাজ আছে, তাই বাইরে যেতে হবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমিরা উপহাস করে বললো, তোমার আবার বাইরে কী কাজ ?
নিহানের বাবা আমিরাকে চুপ করতে বলে নিজে বললো, কী কাজ আছে বাইরে ?
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছি, এডমিশনের জন্য কিছু কাজ আছে।
পড়াশোনার ব্যাপারে নিহানের বাবার মনে সবসময় একটা আলাদা জায়গা আছে। আমিরা ভালো স্টুডেন্ট, তার জন্য তিনি আমিরাকে তার পছন্দের জিনিস দিতে কার্পন্য করেনি কখনো। নিহানও ভালো রেজাল্ট করার পর কিছু চাইলে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করতেন দেওয়ার। ইসরার রেজাল্ট শুনে বেশ ভালো লাগলো তার।

গম্ভীর গলায় বললো, কার সাথে যাবে তুমি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ আমাদের বাসা থেকে বেশ অনেকটাই দূরে।
ইসরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, আমি একাই চলে যেতে পারবো, সমস্যা হবে না।
আকরাম সাহেব একটু চিন্তা করে বললেন, নিহান তোমার অফিস থেকে তো তোমাকে গাড়ি দেওয়া হয়েছে ?
নিহান ভ্রু কুঁচকে বললো, হ্যাঁ কিন্তু কেনো ?

বাসস্টপে নামিয়ে দিয়ে যেও ইসরাকে। তারপর ও একা চলে যাবে আর তুমি অফিস চলে যেও।
ইসরা একটু অবাক হলো আকরাম রেজওয়ানের ব্যবহারে। এই প্রথম ইসরাকে এই মেয়ে না বলে নাম ধরে বললো।
ইসরার ভাবনার মাঝেই আকরাম খাওয়া শেষ করে বললো, আমার অফিসে আজ একটু কাজ আছে আগে যেতে হবে, আমি আসছি।
আমিরার বাবা আমির রেজওয়ান বলে উঠলো, দাঁড়াও ভাইয়া আমারও যেতে হবে। আজ আমার গাড়ি আসবে না, তুমি একটু ড্রপ করে দিও।

ঠিক আছে তাড়াতাড়ি চল।
আকরাম আর আমির বের হয়ে গেলো। আমিরা আর তার মায়ের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে তারও নিজেদের রুমের দিকে চলে গেলো, ইসরার দিকে একবার বাঁকা চোখে তাকিয়ে। নিহান রাগী চোখে নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে, রাগে ইচ্ছে করছে ইসরাকে মাথায় তুলে আছাড় দিতে। এই মেয়েকে তার পাশের সীটে বসিয়ে নিয়ে যেতে হবে ভাবতেই রাগ লাগছে।
নিহানের মা নিহানের কাঁধে হাত রেখে বললো, কী হলো খাওয়া শেষ কর।
নিহান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, রেডি হয়ে থাকতে বলো। আমি কারো জন্য একদমই ওয়েট করতে পারবো না।
নিহান ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমের দিকে এগোতে লাগলো।

ইসরা সেদিকে তাকিয়ে মলিন হেঁসে নিজের রুমের দিকে এগোলে নিহানের মা বললো, কী বলেছে শুনেছো তো ?
জী শুনেছি, আমার কানে কোনো সমস্যা নেই।
নিহানের মা ভ্রু কুঁচকে তাকালে ইসরা তা উপেক্ষা করে নিজের রুমে চলে গেলো। তার প্রয়োজন ছিলো এই বাসা থেকে বাইরে যাওয়া। সেই অনুমতি পেয়েছে আর কিছুর প্রয়োজন নেই তার। নিজের সময় মতো রেডি হয়ে বাসার বাইরে বের হয়ে এলো। মনিরা দেখলেও কিছু বলেনি নিজের কাজ করেছে চুপচাপ। ইসরার জন্য বকা খাওয়ার পর সে ইসরার থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে। বাড়ির সামনে রাস্তায় কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতেই রিকশা পেয়ে গেলো আর তাতে উঠে পড়লো।
নিহান রেডি হয়ে নিচে এসে মনিরাকে বললো, আন্টি মেয়েটাকে আসতে বলো গিয়ে।
ঐ মাইয়া তো কখন বাইর হইয়া গেছে।

নিহান অবাক হয়ে বললো, বের হয়ে গেছে মানে ?
হ, বোরখা পরে একেবারে হাত-পা ঢেকে বের হয়ে গেছে আগেই।
রাগে নিহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। যেখানে সে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে সেখানে এই মেয়ে তাকে উপেক্ষা করে চলে গেছে। নিহান ভেবে পাচ্ছে না মেয়েটার সাহস হলো কী করে, তাকে এভাবে অপমান করার ? রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিহান অফিসের জন্য বের হয়ে গেলো। গাড়িতে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো আর সে ইসরাকে এর জন্য একটা শিক্ষা দেওয়ার চিন্তা করতে লাগলো।

কলিংবেলের শব্দে হুর বিরক্তি নিয়ে একবার মেইন ডোরের দিকে তাকালো। গলা ফাটিয়ে মাকে ডেকে কোনো সাড়া পেলো না। হুর জানে তার মা ইচ্ছে করে সাড়া দিচ্ছে না। কারণ তিনি হুরের উপর রেগে আছে মেডিকেলে চান্স না পাওয়ায়। হুর আশেপাশে তাকিয়ে কাজের মহিলাকে না দেখে নিজেই উঠে এলো অলস ভঙ্গিতে।
দরজা খোলে সামনের মানুষকে দেখে চিৎকার করে বললো, ইশু,,,,,
হুরের চিৎকার শুনে ইসরা কানে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। কিছুসময় পর পিটপিট করে তাকালো হুরের চিৎকার বন্ধ হয়েছে কিনা দেখার জন্য। ইসরার কিছু বুঝে উঠার আগেই হুর জাপ্টে জড়িয়ে ধরলো ইসরাকে।
কেমন আছিস বোন ?

আলহামদুলিল্লাহ, তুই কেমন আছিস ?
এতোক্ষণ ভালো ছিলাম না, এখন তোকে দেখে একদম ভালো হয়ে গিয়েছি, চল ভেতরে চল।
ইসরা ভেতরে যেতে যেতে বললো, তুই শুধু আমার চোখ দেখে সবসময় কী করে চিনে ফেলিস ?
হুর মুখ ভর্তি হাসি দিয়ে বললো, তোর মতো মায়াবী চোখ আমি এখনো কারো দেখিনি। তোর চোখদুটো পদ্ম পুকুরের স্থির জলের মতো, শান্ত অথচ গভীর।
ইসরা হুরের মাথায় থাপ্পড় মেরে বললো, সাহিত্যিক হতে হবে না, গিয়ে আমার জিনিসগুলো নিয়ে আয়।
হুর সিরিয়াস হয়ে বললো, তুই নিজে বাসায় গিয়ে নিয়ে আসতে পারতি তাহলে আমাকে দিয়ে কেনো আনালি ? ফুপিও তোকে দেখতে পেতো একটু। মানুষটা কাঁদিয়ে ভাসায় তোর জন্য। তুই কেনো গেলি না ?

আছে কিছু কারণ তবে এখনো সময় আসেনি তোর জানার। এখন গিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে আয়।
হুর নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। ইসরা হুরকে দিয়ে নিজের বাসা থেকে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আনিয়েছে। আপাতত নিজের বাসায় যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ইসরার নেই। হুরের কাছে সেই কাগজপত্র নিতেই এসেছে ইসরা। বেশ অনেকটা সময় সোফায় বসে রইলো।
ইসরার মামি কিচেন থেকে উঁকি দিয়ে ইসরাকে দেখে ড্রয়িংরুমে এসে বললো, কেমন আছো ইসরা ?
ইসরা সোফায় বসে ছিলো মামিকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আলহামদুলিল্লাহ,,, আপনি কেমন আছেন ?
আল্লাহর রহমতে ভালোই থাকি সবসময়। তা ওবাড়িতে ঠিক আছো তো তুমি ?

পরের কথাটা ইসরার মামি একটু অন্যভাবে বললো। সেটা ইসরা বুঝতে পারলেও হাসিমুখে বললো, আমি ঠিক আছি।
এতো কাহিনির পর কতো ঠিক আছো বুঝতেই পারছি। তা ব্রেকফাস্ট করে এসেছো, নাহলে হুরের সাথেই করো ?
যদিও ইসরা ব্রেকফাস্ট করেনি তবু বললো, আমি ব্রেকফাস্ট করেই এসেছি।
চল আমার হয়ে গেছে।
হুরের কথায় দু’জনেই হুরের দিকে তাকালো। হুর একদম রেডি হয়ে তবেই এসেছে।
হুরের মা ভ্রু কুঁচকে বললো, তুই কোথায় যাচ্ছিস ?
কোথায় আবার ইশুর সাথে যাচ্ছি।
ইসরার সাথে গিয়ে তুই কী করবি ? তুই তো আর চান্স পাসনি ?

এতোদিন পর ইশুর সাথে বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করবো ভেবেছো ?
ইসরা কিছু বলার আগেই হুর ইসরার হাত ধরে টেনে বাইরে যেতে লাগলো।
হুরের মা চেঁচিয়ে বললো, তোর জন্য যে নুডলস রান্না করতে বললি এখন সেটা কে খাবে, তোর বাপ ?
ঠিক আছে, বক্সে করে বাবার কাছে পাঠিয়ে দাও।
আর কিছু শোনার আগেই বের হয়ে এলো দু’জনে। একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লো।
ইসরা এবার মুখ খুললো, তুই না আসলেও হতো। মামি রাগ করলো মনে হয়।
ধূর তুই ছাড় তো মায়ের কথা। মা সবসময়ই এমন করে সেটা তো তুই জানিসই।
হুম, তো তুই কী করবি ঠিক করলি ?
ভাবছি ফ্যাশন ডিজাইনিং করবো। তুই তো জানিস এটার প্রতি আমার আগে থেকেই ইন্টারেস্ট একটু বেশি। বাবার সাথে কথা বলেছি বাবাও রাজি হয়ে গেছে। মা সেটা নিয়েই আরো রেগে আছে।

ওহ্
এখন চল, আগে ব্রেকফাস্ট করে নেই। আমি জানি তুই কিছু খাসনি, খেয়ে তারপর কাজ করা যাবে।
ইসরা মাঝে মাঝে অবাক হয় হুরকে দেখে। মেয়েটা তাকে যতটা বুঝে ততটা হয়তো আর কেউ বুঝে না। এতোটা বুঝার পরও এতবড় একটা ভুল কী করে করলো ইসরা জানে না। যে দুজন মানুষ আজ ইসরার এই জীবনের জন্য দায়ী, তারা দুজনেই ইসরাকে সবচেয়ে বেশি বুঝতো। ইসরা হুরকে মাফ করে দিয়েছে কারণ মেয়েটা প্রয়োজনের চেয়েও অনেকটা বেশি সহজসরল। তাকে যে কেউ নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে একটু ইমোশনাল কথা বলে। কিন্তু ইসরা নিজের বাবাকে মাফ করতে পারছে না কারণ সে তো হুরের মতো নয়। সে তো একজন বুঝদার মানুষ।

কী ভাবছিস বল তো ? কখন থেকে নামতে বলছি শুনতে পাচ্ছিস না ?
হুরের চিৎকারে ইসরা কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সরি বলে রিকশা থেকে নেমে পড়লো। দুজনেই আগে খাওয়াদাওয়া করে তারপর কলেজের দিকে গেলো। কাজ শেষ করতে দুটোর বেশি বেজে গেলো। তবু কমপ্লিট হয়নি আবার আরেকদিন আসতে হবে। ইসরা যেমন ক্ষুধা সহ্য করতে পারে, হুর আবার তার বিপরীত। ক্ষুধা পেলে তার হুঁশ উড়ে যায়। কলেজ থেকে বের হয়ে প্রায় পাগল হয়ে গেছে খাওয়ার জন্য। ইসরা বাসায় গিয়ে খাবি বলে অনেকটা পথ চলে এসেছে কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
মাঝরাস্তায় বাস থেকে নেমে গিয়ে বললো, না খাওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে এক পাও যেতে পারছি না।
ইসরা আশেপাশে তাকিয়ে বললো, চল রাক্ষুসী সামনের ঐ রেস্টুরেন্টে। যত পারিস খেয়ে নে তারপর বাসায় যাবো।
হুর খুশী হয়ে বললো, তাড়াতাড়ি চল।

হুর আগে আগে গেলে ইসরা পেছন থেকে বললো, পাগলী একটা।
চেয়ারে বসে ইঁদুরের বাচ্চার মতো ছটফট করছে হুর কখন খাবার আসবে। ইসরা গালে হাত দিয়ে হুরকে দেখছে।
তুই এতো খাস মোটা হসনা কেনো বল তো ?
এতো কোথায় খাই ? শুধু খাওয়ার টাইম হলে সহ্য করতে পারি না। খাওয়ার সময় তো পরিমাণ মতোই খাই।
তা অবশ্য ভুল বলিসনি।

খাবার চলে এলে হুর কোনোদিকে না তাকিয়ে খাওয়া শুরু করলো। ইসরা মুচকি হেঁসে তাকিয়ে আছে হুরের দিকে। হুরের প্রায় পেট ভড়ে এলে পানি খাওয়ার সময় খেয়াল করলো ইসরা এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে।
এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেনো ? আমার পেট খারাপ করবে তো, তুই নিজেরটা খা না বোন।
ইসরা হুরের মাথায় গাট্টি মেরে এক চামচ খাবার মুখে দিতে গিয়ে থেমে গেলো সামনে বসা মানুষটাকে দেখে। তার ঠিক সামনের টেবিলে নিহান বসে আছে আর নিহানের সামনে এক সুন্দরী মেয়ে। হুর ইসরার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিহানকে দেখে কিছু বলবে তার আগেই ইসরা ওকে চুপ করিয়ে দিলো।

মেয়েটা টেবিলের উপর নিহানের হাত আঁকড়ে ধরে বললো, দেখো নিহান আমি তোমাকে সেই কলেজ লাইফ থেকে ভালোবাসি। কিন্তু কখনো বলার সুযোগটা হয়ে উঠেনি। হঠাৎ তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায় আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বিয়ের পর যখন তোমার সাথে হওয়া প্রতারণার কথা আর তোমার ডিভোর্সের কথা জানতে পারলাম তখন মনে হয়েছে এটা হয়তো আমার জন্য একটা সুযোগ। এখনও না বলতে পারলে হয়তো সারাজীবন আফসোস করতে হবে।

হুর আর ইসরা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে মেয়েটার কথা শুনে। নিহানের আশেপাশে খেয়াল নেই তাই ওদের খেয়াল করেনি এখনো। ইসরার হাতের ফোনটা কেঁপে উঠলে ইসরার হুঁশ ফিরে, স্কিনে তাকিয়ে দেখে মায়ের নাম্বার।
ফোনটা নিয়ে উঠে একটু দূরে গিয়ে রিসিভ করতেই মায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো, ইশু তোর বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছে। অফিস থেকে সিটি হসপিটালে নিয়েছে, আমি সেখানেই যাচ্ছি, তুই পারলে এখনই আয় মা।
ইসরা পাথর হয়ে গেছে মায়ের কান্না জড়িত গলায় বলা কথাগুলো শুনে। নিহানের টেবিলের দিকে তাকিয়ে নিহানের হাতে রাখা মেয়েটার হাত আরেকবার দেখে নিলো। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে দ্রুত বের হয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে। ইসরাকে বের হতে দেখে হুর দ্রুত বিল মিটিয়ে ইসরার পেছনে ছুটলো।

#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৮

নিহান মাইশার ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে হাতটা সরিয়ে নিলো।
হাসিটা বজায় রেখে বললো, তুমি সরাসরি আমাকে কোনোদিন বলোনি তবে নিজের ব্যবহারে বুঝাতে চেয়েছো অনেকবার। আর আমি কোনো বাচ্চা ছেলে নই যে বুঝতে পারবো না। কিন্তু কখনো কিছু বলিনি কারণ তুমি আমাকে স্পষ্ট করে কিছু বলোনি তাই। তুমি যেমন বুঝাতে চেয়েছো তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমিও তেমন তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই তোমার প্রতি। তুমিও কোনো বাচ্চা মেয়ে নও যে বুঝতে পারবে না।
মাইশা হতাশ গলায় বললো, কিন্তু কেনো নিহান ?

সব কেনোর উত্তর হয় না। আজ তুমি আমাকে দেখা করার জন্য এতোবার রিকুয়েষ্ট করার সময়ই বুঝেছিলাম তুমি এসব বলার জন্যই দেখা করতে চাইছো। আমিও চাইছিলাম বিষয়টা শেষ করতে, তাই আসলাম। আশা করি তুমি তোমার উত্তর পেয়ে গেছো আর কখনো এটা নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগের করার চেষ্টা করবে না।
নিহান উঠে চলে গেলো আর মাইশা টলমলে চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো নিহানকে। কাউকে ভালোবেসে তাকে চাওয়াটা কী অপরাধ ? উত্তরটা নিহানের কাছে জানতে চাইলে হয়তো ভালো হতো। নিহান চোখের আড়াল হতেই মাইশার চোখ থেকে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে গেলো।

হসপিটালের করিডোরে মায়ের পাশে বসে আছে ইসরা। চোখ দুটোয় আজ শ্রাবণের ভারী বর্ষণ শুরু হয়েছে, থামার নাম নিচ্ছে না। পারভীন বেগম থেকে থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। ইমন এসবের কিছু জানে না এখনো, হুরকে পাঠিয়েছে ইমনকে স্কুল থেকে আনতে, প্রতিদিন পারভীন বেগমই যায় আজ হুর গেছে। ইখতিয়ার আহমেদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ইসরার মামা ঢাকার বাইরে আছে তাই আসতে পারেনি আর বড় চাচার পরিবার গ্রামে। একটা কথা সত্যি, বিপদে খুব কম মানুষকেই পাশে পাওয়া যায়।
ডক্টর বাইরে আসলে ইসরা আর তার মা দৌড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, ইসরা অস্থির গলায় বললো, ডক্টর আমার বাবা কেমন আছে ?
এবারের মতো বেঁচে গেছে কোনো ক্ষতি হয়নি, সময় মতো হসপিটালে আনার কারণে। তবে উনার দিকে খেয়াল রাখবেন যাতে কোনো বিষয়ে টেনশন না করে আর উত্তেজিত না হয়।

ইসরা চোখ মুছে বললো, খেয়াল রাখবো ডক্টর। এখন আমরা দেখা করতে পারি ?
এখন তো ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে, ঘুম ভাঙলে আপনারা দেখা করতে পারবেন। তবে আজ বাসায় নিতে পারবেন না দুদিন হসপিটালে থাকতে হবে।
ঠিক আছে ডক্টর, ধন্যবাদ।
ইট’স ওকে, এটা আমাদের কাজ।
মুচকি হাসি উপহার দিয়ে ডক্টর চলে গেলো। ইসরা পাশের চেয়ারে বসে পড়লো।

মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, বাবা এখন ভালো আছে। তুমি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে এসো, রাতে এখানে থাকতে হবে তো। তুমি যাও আমি এখানেই আছি। ইমনকে আজ হুরের কাছে নিয়ে রাখতে বলে দিবো আমি।
পারভীন বেগম আর কথা বাড়ালেন না। মেয়ের কথা মতো বাড়িতে চলে গেলেন। ইসরা চেয়ারে বসে রইলো ক্লান্ত ভঙ্গিতে। নিজের জীবনের নাটকীয়তা দেখে সে ক্লান্ত। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। ইসরা জানে এটা তার জন্য উচিত নয় তবু রেস্টুরেন্টে নিহানের হাতে মেয়েটার হাত দেখে তার অদ্ভুতভাবে কষ্ট হয়েছে। না চাইতেও বুক চিঁড়ে কান্না এসেছে। সেই একই মুহূর্তে আবার নিজের বাবার জীবনের আশঙ্কার মতো খবর তাকে হাজারটা টুকরো করে দিয়েছে।

ইসরা থাই গ্লাসের বাইরে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার জীবনে আর কতো নাটকীয়তা বাকি আছে খোদা, আর কতো ?
সন্ধ্যার কিছুসময় আগে ইখতিয়ার আহমেদের ঘুম ভেঙে গেলো। নার্স গিয়ে ইসরাকে খবরটা দিতেই ইসরা উঠে দাঁড়ালো। নিজের মনকে শান্ত করে কেবিনে ঢুকে গেলো। দরজা ঢেলে ভেতরে গিয়ে সাদা বেডটায় নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখলো নিজের বাবা নামক মানুষটাকে। বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। একটা চেয়ার টেনে বাবার কাছে বসে আলতো করে মাথায় হাত রাখলো। আলতো স্পর্শে চোখ মেলে তাকিয়ে মেয়েকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো ইখতিয়ার আহমেদ। বাবার চোখের পানি ইসরার বুকে তীরের মতো বিঁধছে।
ইখতিয়ার আহমেদ মেয়ের হাতটা বুকে জড়িয়ে ভাঙা গলায় বললো, আমাকে মাফ করে দে মা। আমি নিজের হাতে তোর জীবনটা শেষ করে দিয়েছি। মাফ করে দে আমাকে। এই অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

বাবা,,,,
দীর্ঘ এক মাস পর মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনে মরুভূমির মাঝে এক পশলা বৃষ্টির মতো কাজ করলো ইখতিয়ার আহমেদের মনে। বাবা বাবা বলে অস্থির করে তোলা মেয়েটা আজ এক মাস তাকে বাবা বলে ডাকে না। একজন বাবার জন্য এর থেকে কষ্টের আর কী হতে পারে ?
তুমি উত্তেজিত হইও না, তুমি অসুস্থ শান্ত হয়ে থাকো।
আমাকে মাফ না করলে আমি শান্তি পাচ্ছি না রে মা।
এবার বুঝতে পেরেছো তো, কেউ কাউকে ঠকিয়ে ভালো থাকতে পারে না ?
খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছি রে মা। নিহানকে পেলে তার কাছেও ক্ষমা চেয়ে নিবো।

ইসরা আর কিছু না বলে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। একটু পরই পারভীন বেগম প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে উপস্থিত হলেন। সব গুছিয়ে আসতে এতো লেট হয়ে গেছে। ইসরার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে ইসরা সেগুলো খেয়ে নিলো।
পারভীন বেগম আমতা আমতা করে বললো, তুই চলে গেলেই ভালো হতো ইসরা। ও বাড়িতে কাউকে জানাসনি।
ও বাড়িতে আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে বসে নেই। কিংবা ও বাড়ির কারো মন রক্ষা করে চলারও আমার কোনো দায় নেই। নিজের অসুস্থ বাবাকে রেখে আমি কোথাও যাচ্ছি না।
তবু একবার জানিয়ে দিলে হতো না ?
আমার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে আর এতোটা প্রয়োজনও নেই। কেউ খুঁজবে না আমাকে।
পারভীন বেগম আর কথা বাড়ালেন না। ইসরা বাবার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

ড্রয়িংরুমে চিন্তিত মুখে বসে আছে আকরাম রেজওয়ান সহ তার পুরো পরিবার। নিহানও বসে আছে সোফার এক কোণে। এতো রাত হয়ে গেছে ইসরা এখনো বাসায় ফেরেনি, এটাই সবার চিন্তার বিষয়। ইসরার কিছু হয়ে গেলে তার বাবা-মায়ের কাছে কী উত্তর দিবে সেটা ভেবে সবার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এদিকে ইসরার ফোনও সুইচ অফ বলছে সন্ধ্যা থেকেই।
নিহান বিরক্ত হয়ে বললো, বাবা আমি তোমাকে বারবার বলছি ঐ মেয়ে নিজের বাবার বাড়ি গেছে। তুমি ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করো আমার কথা মিলে যাবে।

আকরাম চিন্তিত গলায় বললো, আর যদি না গিয়ে থাকে। আর তারা জানতে চায় তাদের মেয়ে কোথায়, তখন কী বলবো ?
এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থেকেও তো কোনো লাভ নেই। সেখানে না গিয়ে থাকলে আমাদের পুলিশের কাছে যেতে হবে। তোমার কথা বলতে অসুবিধা হলে আমাকে নাম্বার দাও আমি জিজ্ঞেস করছি।
আকরাম সাহেব কিছু একটা ভেবে নিহানের দিকে নিজের ফোন এগিয়ে দিলো। নিহান ইসরার বাবার নাম্বারে কল দিলো কিন্তু সুইচ অফ বলছে। এরপর ইসরার মায়ের নাম্বারে কল দিলো।
পারভীন বেগম ওয়াশরুমে গেছে তাই ফোনটা ইসরা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই নিহান ইসরার গলা চিনতে পারলো। কোনো কথা না বলেই কল কেটে দিলো।

আকরাম সাহেব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, কী হলো কথা না বলে কেটে দিলি কেনো ?
নিহান চোখ মুখ শক্ত করে বললো, কারণ আমার কথাই সত্যি। ফোনটা ইসরার মা নয় বরং ইসরা রিসিভ করেছিলো। তাই এখানে বসে নিজেদের টাইম নষ্ট না করাই ভালো।
আমিরা হাই তুলে বিরক্ত হয়ে বললো, যেদিন থেকে এই বাড়িতে এসেছে একটার পর একটা নতুন ড্রামা দেখিয়ে যাচ্ছে। যাবে বলে গেলে কী হতো ? শুধু শুধু এই ফালতু মেয়ের জন্য আমার ঘুম নষ্ট হলো।
নিহান আর আকরাম বাদে সবাই নিজেদের রুমে চলে গেছে। আকরাম গম্ভীর গলায় বললো, আমাদের বলে গেলেই পারতো। এভাবে না বলে টেনশনে ফেলার মানে কী ?

নিহান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ড্রামাবাজ তো তাই ড্রামা না করলে তার ভালো লাগে না, যতসব।
নিহান নিজের রুমে চলে গেলে আকরাম ও উঠে দাঁড়ালেন। সে আজ প্রচন্ড বিরক্ত ইসরার উপর। ইসরা সকালে তার মনে যেটুকু ভালো জায়গা পেয়েছিলো মুহূর্তেই সেটুকু হারিয়ে গেলো।
সকালবেলা ইসরা কলিংবেল বাজালে মনিরা দরজা খোলে দিলো। সবাই তখন ব্রেকফাস্ট করছিলো ডাইনিং টেবিলে।
ইসরা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গেলে নিহান রাগী গলায় বললো, দাঁড়াও।
ইসরা দাঁড়িয়ে পড়লো নিজের জায়গায়। নিহান খাওয়া রেখে উঠে ইসরার সামনে দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, বাড়ির বাইরে কী লেখা আছে এটা আবাসিক হোটেল ?

ইসরা উত্তরে কিছু না বললে নিহান আবার বললো, এটা কোনো হোটেল নয় তোমার যখন ইচ্ছা বাইরে যাবে যখন ইচ্ছা আসবে। কাউকে কিছু না বলে যেখানে ইচ্ছে থেকে যাবে। এটা বাড়ি আর এখানে একটা ভদ্র ফ্যামিলি বসবাস করে। কিছু নিয়মকানুন আছে এই বাড়ির। তোমার কী এই বাড়ির কাউকে মানুষ মনে হয় না ? কাউকে না জানিয়ে নিজের বাবার বাসায় গিয়ে বসে আছো আর এদিকে সবাই সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করছে। সামান্যতম কমনসেন্স নেই তোমার মধ্যে, বাবা-মা কী এটুকু শিক্ষাও দেইনি ?

আমি বাবার বাসায় নয়, হসপিটালে ছিলাম।
নিহান অবাক হয়ে বললো, মানে ?
গতকাল দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে মা ফোন করে জানায় বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছে। তাই হসপিটালে গিয়েছিলাম ছুটে আর সারারাত সেখানেই ছিলাম।
নিহান চুপ করে গেলে আমিরা হঠাৎ বলে উঠে, তোমার ঐ ধোঁকাবাজ বাবা মরুক বাঁচুক আমাদের কী ? তুমি আমাদের কেনো হয়রানি,,,,
আমিরা,,,,,

আমিরার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো ইসরা। আমিরা কথা শেষ করার আগেই আমির রেজওয়ান উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে রেগে বললেন, আর একদিন যদি আমি তোমাকে দেখেছি বড়দের মাঝে কথা বলতে। তাহলে তোমাকেও তোমার ভাইয়ের মতো বাড়ির বাইরে পাঠাবো। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও ভালো করে।
বেশ কিছু সময় নিরবতা বিরাজ করলো তারপর আকরাম রেজওয়ান গম্ভীর গলায় বললো, একবার জানিয়ে দিলেই তো এতোগুলা মানুষ টেনশনে থাকতো না।
বাবার অবস্থা খারাপ ছিলো তাই আপনাদের জানানোর কথা মাথায় আসেনি। যখন বাবা একটু ঠিক হয়েছে তখন ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো চার্জ শেষ হয়ে।
তোমার মায়ের ফোন থেকে বলতে পারতে ?

আসলে আমি বুঝতে পারিনি আমাকে নিয়ে এ বাড়ির কারো কোনো সমস্যা হতে পারে। তাই আর অতটা গুরুত্ব দেইনি।
নিহান রেগে বললো, দেখেছো বাবা কেমন,,,
নিহানকে চুপ করতে ইশারা করলো আকরাম আর বললো, তুমি এই বাড়িতে যতদিন আছো ততদিন আমাদের দ্বায়িত্ব। এরপর থেকে কোনো সমস্যা হলে আগে বাড়িতে জানাবে, এখন নিজের রুমে যাও।
ইসরা কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে গেলো। ক্লান্তিতে শরীরটা আর চলছে না এখন। সারারাত ঘুমাতে পারেনি হসপিটালে। ইসরা ভাবছে মাত্র একদিন হসপিটালে থেকে তার এমন বেহাল অবস্থা তাহলে ডক্টর কীভাবে হবে ? আজগুবি চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হলো। বেডে সাইড টেবিলে সকালের ব্রেকফাস্ট দেখতে পেলো। সে ওয়াশরুমে থাকাকালীন হয়তো দিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইসরা কোনোরকমে খেয়ে ধপ করে বেডে শুয়ে পড়লো।

নিহান অফিসে বসে ভাবছে, না জেনে ইসরাকে এতোগুলো কথা বলা একদমই ঠিক হয়নি। কিন্তু সরিও বলতে পারেনি ইগোর জন্য।
আজ আবার উদাস কেনো নিহান ?
রুপমের কথা শুনে কাজে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে বললো, কই কিছু হয়নি।
তুই নিজেকে খুব সুন্দর মনে করিস তাই না ? আর তোর নিজের সৌন্দর্যের উপর খুব বেশি অহংকার।
নিহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, কী আবোল তাবোল বকছিস ?
ইসরা তোর আশেপাশে আছে তুই এটা সহ্য করতে পারছিস না। তাই এমন বিরক্ত মুডে থাকিস সবসময়।
নিজের কাজ কর বকবক বন্ধ করে।
সময় থাকতে নিজেকে শুধরেনে নাহলে জীবনে অনেক আফসোস করতে হবে তোকে। কালো মানুষের মন কালো হয় না নিহান, আর করিম চাচাও খারাপ মানুষ ছিলেন না।

নিহান বিরক্ত হয়ে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু মন বসাতে পারলো না কাজে। নিহান ফিরে গেলো আরো অনেকগুলো বছর পেছনে। নিহানের বয়স তখন কেবল পাঁচ কিংবা ছয়। নিহানদের বাড়ির দারোয়ান করিম চাচা ছিলেন কুচকুচে কালো আর সুঠাম দেহের মানুষ। নিহান খুব ভয় পেতো তাকে ভূত ভেবে । সেটা করিমের কাছে খুব ভালো লাগতো। সে বোকা টাইপের হওয়ায় সবাই তাকে নিয়ে মজাই করতো, কেউ ভয় পেতো না। নিহান তাকে ভয় পায় এটা তাকে বেশ মজা দিলো। তাই মাঝে মাঝে সবার আড়ালে সে নিহানে ভয় দেখাতো। নিহান তাকে মনে করতো ভূত। কিন্তু সেই মজাই একদিন তার কাল হয়ে দাঁড়ালো।

নিহান ঝোপের আড়ালে ক্রিকেট বল খুঁজতে গিয়েছিলো আর এদিকে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আবছা আলোয় ঝোপের আড়াল আরো অন্ধকার লাগছে। নিহান বল হাতে উঠে দাঁড়িয়ে আবছা আলোয় করিমকে দেখে ভূত বলে চিৎকার দিয়ে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। টানা সাতদিন জ্বর থাকার পর নিহান সুস্থ হয়। সবাই সব জানার পর করিমকে কাজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। এদিকে নিহান বড় হয়ে ভয়টা কাটলেও কালো মানুষের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করতে থাকে। তাকে কেউ বুঝাতে গেলে বলে কালো মানুষের মন যদি কালো না হয়, তাহলে করিম চাচা কীভাবে পারলো ইচ্ছে করে একটা বাচ্চাকে ভয় দেখাতে ?

সে একজন কুৎসিত চেহারার সাথে কুৎসিত মনেরও অধিকারী আর সব কালো মানুষই করিমের মতো। এতো বছরেও নিহানের এই ধারণা কেউ পাল্টাতে পারেনি। যে পাল্টাতে এসেছিলে সে এখন বাড়ি ছাড়া। এখন আবার ইসরার বাবার আর ইসরার ধোঁকা দেখে তার ধারণা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে কালো মানুষের মনও কালো আর কুৎসিত। নিহান ভেবেছিলো ইসরাকে সরি বলবে কিন্তু পুরনো কথা ভেবে আবার মন চেঞ্জ হয়ে গেলো। নিহান উল্টো ভাবতে লাগলো গতকাল সকালে ইসরার তাকে করা অপমানের প্রতিশোধ কীভাবে নেওয়া যায়। এদিকে ইসরা দুপুরের দিকে খেয়েদেয়ে আবার হসপিটালে চলে গেলো। আগামীকাল সকালেই ইখতিয়ার আহমেদকে রিলিজ দেওয়া হবে। সেসব নিয়েই ব্যস্ত ইসরা ভাবতেও পারছে না নিহান তার থেকে সামান্য বিষয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার ফন্দি আঁটছে।

#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৯

পরদিন সকালে ইসরা বাবা-মাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর রেজওয়ান বাড়িতে আসে। সকাল প্রায় এগারোটা বাজে ইসরা বাসায় পৌঁছায়। শাওয়ার নিয়ে বাইরে আসে কারণ তার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে।
কিচেনে মনিরা দুপুরের রান্নার ব্যবস্থা করছিলো, তার কাছে গিয়ে বলে, মনিখালা আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। কিছু আছে খাওয়ার মতো ?
মনিরা কিছু না বলে ফ্রিজে রাখা সকালের খাবার ওভেনে গরম করে ইসরার সামনে ধরলো। ইসরা খাবারের প্লেট নিয়ে বের হতে যাবে তার আগেই নিহানের মা কিচেনে প্রবেশ করলো।
ইসরাকে দেখে বললো, তোমার বাবা এখন কেমন আছে ?
ইসরা নিচুস্বরে বললো, আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো আছে ?
ঠিক আছে নিজের রুমে যাও।
ইসরা নিজের রুমে গিয়ে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গেলো। ক্লান্তিতে শরীরটা অসার হয়ে আসছিলো। ক্লান্ত থাকায় বেশ অনেকটা সময় ঘুমালো ইসরা। আগামীকাল আবার কলেজে যাবে ভর্তির বাকি কাজ শেষ করতে।

সকালে ইসরা বের হওয়ার সময় নিহানের সামনে পড়ে গেলো।
নিহান ইসরার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, তুমি কোথায় যাচ্ছো ? তোমার বাবা তো এখন সুস্থ।
ইসরা নিজের কাগজপত্র আর একবার চেক করতে করতে বললো, কলেজে যাচ্ছি কিছু কাজ বাকি আছে।
নিহান কিছু একটা ভেবে বললো, চলো আমি তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।
ইসরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, প্রয়োজন নেই আমি রিকশা নিয়ে চলে যাবো।
বাসস্টপ পর্যন্ত চলো বাকিটা বাসে চলে যেও। এখন অফিস টাইম রিকশা পাওয়া কষ্টকর হবে।

নিহানের অতিরিক্ত ভালোমানুষি ইসরার কাছে সন্দেহজনক মনে হলো। তবু একটু চিন্তা করে রাজি হয়ে গেলো। ড্রাইভার ড্রাইভ করছে নিহান আর ইসরা পেছনের সীটে বসে আছে। ইসরা বাইরে তাকিয়ে আছে আর নিহান ইসরার দিকে।
মনে মনে বললো, যে না কুৎসিত চেহারা তার জন্য আবার বোরখা পরে হাত-পা ঢেকে এসেছে। কুৎসিত চেহারা মানুষের থেকে আড়াল করার ভালো বুদ্ধি বের করেছে। এই মেয়ের আবার কেমন সাহস আমাকে উপেক্ষা করে নিজেই চলে গিয়েছিলো সেদিন। আজ তার শোধ তুলবো, অপমানের বদলে অপমান।
নিহান হঠাৎ বলে উঠলো, ড্রাইভার গাড়ি থামাও।

ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিলে ইসরা নিহানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করবে কেনো থামাতে বললো। তার আগেই দেখলো নিহান নিজের সাইটের জানালার কাচ নামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে।
তন্বী অফিস টাইম হয়ে গেছে তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো ?
তন্বী এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, দেখুন না স্যার সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি একটা রিকশাও পাচ্ছি না।
সমস্যা নেই তুমি আমার সাথে চলে এসো, এক অফিসেই তো যাবো।
তন্বী ভিতরে তাকিয়ে বললো, কিন্তু স্যার আপনার সাথে তো কেউ আছে মনে হচ্ছে।
নিহান ইসরার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি বরং এখান থেকেই রিকশা করে চলে যাও। তন্বীর লেট হচ্ছে, তোমার তো টাইম ফিক্সড করা নেই। লেট হলেও সমস্যা হবে না।

নিহানের কথায় ইসরা হতভম্ব হয়ে গেলো। নিজেই ডেকে এনে এখন মাঝ রাস্তায় নেমে যেতে বলছে। যেখানে এই মেয়েই রিকশা পাচ্ছে না, তাহলে সে কী করে পাবে ?
ইসরা থেমে থেমে বললো, উনি না-হয় সামনে,,,
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? ও একটা মেয়ে মানুষ ড্রাইভারের সাথে কীভাবে বসবে ?
তাহলে আপনি,,,
ইসরা কথা শেষ করার আগেই নিহান বললো, তুমি কিন্তু আমাদের লেট করাচ্ছো ।
ইসরা নিহানের দিকে একবার শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের ব্যাগ নিয়ে নেমে গেলো। নিহান তা দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেলো।
মনে মনে বললো, নিহান রেজওয়ানকে উপেক্ষা আর অপমান করার পরিণাম ভোগ করো এবার মিস আনজুম ইসরা। উপস সরি, মিসেস আনজুম ইসরা।
ইসরা নেমে যেতেই তন্বী খুশিতে গদগদ হয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। ইসরা নিহানের দিকে একবার তাকাতেই নিহান ভেতর থেকে জানলার কাঁচ উঠিয়ে দিলো।

গাড়ি চলতে শুরু করলেই তন্বী বললো, অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।
নিহান গম্ভীর মুখে বললো, লিফট দিয়েছি বলে খুশিতে গায়ে ঢলে পড়ার প্রয়োজন নেই। অফিসের গাড়ি অফিসের স্বার্থে ব্যবহার করেছি।
মনে মনে বললো, আর কিছুটা নিজের স্বার্থে।
তন্বী বেশ অবাক হলো নিহানের ব্যবহারে। এই তো বেশ হেঁসে কথা বলছিলো, এখনই আবার কী হয়ে গেলো ? তন্বী এ বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে গাড়ির বাইরে দৃষ্টি রাখলো।
নিহান কীভাবে ইসরাকে শাস্তিটা দেবে সেটাই ভাবছিলো আর এমন সময় তন্বী তার সামনে আসাটা যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো কাজ করেছে। এদিকে ইসরা বেশ অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা রিকশা পেলো। ইসরা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে, নিহানের এতো ভালোমানুষি করে গাড়িতে নিয়ে আসা আর মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দেওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে সেদিনের কথা মনে পরে গেলো। ইসরার বুঝতে বাকি রইলো না নিহান ইচ্ছে করেই এমনটা করেছে। নিজেকে বকতে লাগলে কেনো উঠতে গেলো নিহানের গাড়িতে। নিজের উপর বিরক্তির মাঝেই ইসরা বাসস্টপে পৌঁছে গেলো। এখন আবার বাসের জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে ?

দেখতে দেখতে সময়গুলো খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলো। আর মাত্র হাতে গুণা কয়েকটা দিন বাকি আছে। ইসরা নিজের পড়াশোনা নিয়েই পার করেছে এই লম্বা সময়টা। মাঝে মাঝে এ বাড়ির মানুষের তিক্ত কথাগুলো তাকে আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে দিতো। তবু মুখ বুজে সব সহ্য করতো কারণ অন্যায়টা তার বাবার ছিলো। ইসরা চাইলেও সেটা অস্বীকার করতে পারবে না। নিহানের বিরক্তি ইসরার উপর দিন দিন যেনো বেড়ে পাহাড় সমান হয়েছে। ইসরা সহজে নিহানের সামনে যায় না। কিন্তু ভুল করেও যদি নিহানের সামনে চলে যায় তাহলে হাজার অপমান করতে নিহান ভুলে না। আজ পুরো রেজওয়ান পরিবার কোনো আত্নীয় বাড়ি যাবে বিয়ে খেতে। মনিরা কয়েকদিন হলো ছুটিতে গেছে। এখন একা বাড়িতে ইসরাকে কীভাবে রেখে যাবে বুঝতে পারছে না আর ইসরাকে সাথে নিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব।

আমিরা সোফায় বসে ভ্রু কুঁচকে বললো, ঐ মেয়েকে বাড়িতে একা রেখে যাবে ,যদি আমাদের দামী জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায় ?
ইসরা ড্রয়িংরুমের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমিরার কথা শুনে বিস্ফুরিত চোখে তাকালো, আর কতো অপমান সহ্য করতে হবে ইসরার জানা নেই। সে নিজের বাবার বাড়ি চলে যেতো কিন্তু সেখানে তার সব ফুপিরা এসেছে। তারা আগে থেকেই ইসরাকে পছন্দ করে না। এখন যদি ইসরা বাড়ি যায়, তাহলে তার বাঁচা মুশকিল করে তুলবে এরা। ইসরা চাইছে না তারা থাকতে ও বাড়িতে যেতে। তাই বলে তাকে চোরের অপবাদও সহ্য করতে হবে ? ইসরার সারা শরীরের রক্ত যেনো হিম হয়ে আসছে।
আকরাম রেজওয়ান গম্ভীর গলায় বললো, আমিরা তুমি সবসময় বেশি কথা বলো। নিজেকে একটু শুধরানোর চেষ্টা করো, নাহলে এই অভ্যাসটাই একদিন তোমার কাল হবে।

কথাটা শুনে আমিরা মুখ কালো করে ফেললো। ইসরার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলো। এ পর্যন্ত আমিরা তার বাবা আর বড় আব্বুর কাছে কম কথা শুনেনি ইসরার জন্য।
হঠাৎ নিহান বলে উঠলো, আমিরা ভুল কী বলেছে ? নিউজপেপারে এমন অনেক ঘটনা দেখা যায় আজকাল।
ইসরা অপমানে চোখ বন্ধ করে ফেললো। চোখের কোণে নোনাজলের স্রোতধারা। মনে মনে হিসাব করতে লাগলে ও বাড়ি গেলে কী, এর থেকেও বেশি অপমানিত হতে হতো তাকে ?
ইসরার হিসাব নিকাশের মাঝে আকরাম গম্ভীর গলায় বললো, তোমরা একটু চুপ করবে সবাই ?
তার আওয়াজে ড্রয়িংরুমের গুনগুন আওয়াজ থেমে গেলে সে ইসরার দিকে তাকিয়ে বললো, ইসরা তুমি একা থাকতে পারবে এই বাড়িতে ?

ইসরা কোনোরকমে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
ও যেহেতু থাকতে পারবে তাহলে আমাদের সমস্যা কোথায় ? সকাল সকাল সবার মতো রেডি হয়ে যেও।
ড্রয়িংরুমের মিটিং শেষ হলে আমিরা ইসরার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো। ইসরাও নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজার সামনে ফ্লোরে বসে পড়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। জীবনের এই দুটো মাস ইসরা চাইলেও কখনো ভুলতে পারবে না। জীবনে এতো অপমান আর কখনো হয়তো হয়নি, এই বাড়িতে যতটা হয়েছে। ইসরা উঠে ক্যালেন্ডারের পাতায় হিসেব করতে লাগলো আর কতদিন বাকি আছে। লাল কালিতে গোল মার্ক করা তারিখটার কাছে যেতে আর মাত্র পাঁচটা দিন বাকি আছে। তারপর হয়তো এই অপমান থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাবে সে।

ইসরা সকালে রুম থেকে বের হয়নি। সবাই রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে কথা বলছে আর যারা বাকি আছে হয়তো তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বাইরের শোরগোল ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেলো। ইসরা বুঝতে পারলো সবাই চলে গেছে। হঠাৎ করেই ইসরার ভয় করতে শুরু করলো, এই বাড়িতে শুধু সে একা আর একটা মানুষও নেই। গা ছমছমে মনে হচ্ছে পুরো বাড়ি। পরক্ষণে আবার ভাবলো এই পৃথিবীতে যার কোনো প্রয়োজনই নেই তার নিজের জীবন নিয়ে ভয় পাওয়ার মানেই হয় না। আর এই বাড়িতে মানুষ থাকা আর না থাকা তার জন্য সমান। তার সাথে কেউ তো আর ভালো করে দুটো কথা বলতে আসে না।

নিহানরা সেখানে দুদিন থাকবে। ইসরা একবার নিজেকে সাহস দিচ্ছে তো আবার ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। দুপুরে নিজের জন্য কিছু রান্না করে খেয়ে নিলো। তার রান্নার হাত খুব বেশি ভালো না হলেও চলে যায়। রাতেও দুপুরের খাবার গরম করে খেয়ে নিলো। ভয়ে ভয়ে ইসরার দুদিন কেটে গেলো। কেউ একটা কল করে ইসরার খবরও নেয়নি দু’দিনে। তবে এই দুদিন ইসরার খুব একটা খারাপ যায়নি। যখন ইচ্ছা বাড়ির যেখানে সেখানে যেতে পেরেছে তার জন্য কারো কথা শুনতে হয়নি। যখন ইচ্ছে ছাঁদে বসে থেকেছে। মোটামুটি পুরো বাড়ি ভালো করে দেখে নিয়েছে দু’দিনে যেটা গত দু-মাসেও পারেনি। একটা রুমের সামনে লেখা নিশান। নিশান নামে এই বাড়িতে ইসরা কাউকে পায়নি। পরে চিন্তা করে বুঝতে পারলো এটা আমিরার ভাইয়ের রুম। ইসরার কৌতূহল হলো, নিশানকে নিয়ে দুমাসে দুটো কথাও শুনেনি সে। এ বাড়ির ছেলে অথচ কেউ তাকে নিয়ে কোনো কথা বলে না। দুমাসে তাকে দেখেনি ইসরা, কোথায় আছে সে ? হাজার ভেবেও কোনো উত্তর পায়নি তাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। এ বাড়ির কিছু নিয়ে সে আর ভাবতে চায় না।

ফজরের নামাজ সেরে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখলো আকাশ আজ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি নেমে যাবে। ইসরা আজ মুক্ত পাখি কেউ নেই তাকে কিছু বলার বা তার কাজে বাঁধা দেওয়ার। ইসরা দৌড়ে ছাঁদে চলে গেলো। আজ সে বৃষ্টিতে ভিজবে নিজের ইচ্ছে মতো। কেউ তাকে বাঁধা দিতে পারবে না। নিহানরা আসতে আজ বিকেল হয়ে যাবে, সে পর্যন্ত ইসরার স্বাধীনতা। ইসরা ছাঁদে গিয়ে দাড়ানোর দু মিনিটের মধ্যে সূর্য উঠার পরিবর্তে চারপাশ আরো অন্ধকার হয়ে ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো পৃথিবীর বুকে। ইসরা দু’হাত দু’দিকে মেলে মুক্ত পাখির মতো ভিজতে লাগলো। বৃষ্টির পানিতে গায়ের জামা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে।
ভেজা শরীর দেখিয়ে হাত করার চেষ্টা করছো ?

কথাটা ইসরার কানে গেলে কান গরম হয়ে উঠলো ঘৃণায়। চোখ মেলে ছাঁদের একপাশে ছাউনির নিচে নিহানকে দেখে অবাক, রাগ আর ঘৃণা তিনটাই হলো তার। ইসরা কিছু বলার আগেই নিহান তার সামনে এসে ইসরার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
রাগে চিৎকার করে বললো, ভেজা শরীর দেখিয়ে সংসার বাঁচাতে চাইছো ?
ইসরা নিজের বিস্ময় কাটিয়ে নিহানের কথায় রাগে দাঁত কিটিমিটি করে বললো, নিহান মুখ সামলে কথা বলুন ?
সকালবেলা সাদা পোশাকে বৃষ্টিতে ভিজছো। শরীর দেখানোর জন্য যদি না হয় তাহলে কেনো ? তুমি জানো এখন আমি ছাঁদে থাকবো আর তাই এটা করছো। লজ্জা করলো না এতটা নিচে নামতে ? প্রস্টিটিউটদের মতো শরীর দেখাতে লজ্জা করলো না ?
লজ্জা, ঘৃণা, রাগ আর অপমানে বৃষ্টির বরফ ঠান্ডা পানিগুলো ইসরার কাছে আগুনের ফুলকি মনে হচ্ছে। সারা শরীরে মনে হচ্ছে আগুন ধরে গেছে। চোখদুটো ভড়ে উঠছে অপমানের কষ্টে।

ইসরা হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, শাট আপ মিস্টার নিহান রেজওয়ান। অনেক বলে ফেলেছেন আর একটা শব্দও বলবেন না। এতোদিন বাবার অন্যায়ের জন্য মুখ বুজে সব সহ্য করেছি। কিন্তু আজ আপনি আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। আপনাকে শরীর দেখানোর জন্য বৃষ্টিতে ভিজছি ? মিস্টার নিহান আমার নিশ্চয়ই জানার কথা নয় আপনি পরিবার রেখে একদিন আগেই বাড়ি ফিরে আসবেন ? আজকের সকালটা আপনি বিয়ে বাড়ি না থেকে এখানে থাকবেন। এসব নিশ্চয়ই আমার জানার কথায় নয় ?
একটু দম নিয়ে আবার বললো, আজ আপনি যেটা করলেন এর জন্য আমি আপনাকে কোনোদিন মাফ করবো না নিহান রেজওয়ান।
ইসরা এক ছুটে ছাঁদের গেইট দিয়ে নিচে চলে গেলো।

নিহান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। গতকাল বিকেলে অফিস থেকে ফোনে জানানো হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে আজ সকালে। তাই গতরাতেই নিহান বাড়ি চলে আসে। নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে বাসায় ঢুকে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। ইসরার কোনোভাবেই জানার কথা নয় নিহান বাসায় আছে। অলসতার জন্য আজ মসজিদে না গিয়ে বাসায় ফজরের নামাজ আদায় করে ফেলেছে আর স্বভাবতই ছাঁদে এসেছে। ইসরা ছাঁদে এসে কোনো দিকে না তাকিয়ে ভিজতে শুরু করে দেয়। আর হঠাৎই ইসারার দিকে তাকিয়ে নিহানের চোখ আঁটকে যায়। সাদা পোশাকে শুভ্র একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।

বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ইসরার চিবুক বেয়ে নামতে দেখে একটা ঢোক গিলে নেয় নিহান। চোখ যায় বৃষ্টির ফোঁটায় কাঁপতে থাকা চোখের পাতার দিকে। নিহান যেনো অন্যকোনো জগতে হারিয়ে গিয়েছিলো কিছু মুহূর্তের জন্য। যখন হুঁশ ফিরে নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হয় ইসরাকে দেখে মুগ্ধ হওয়ার জন্য। আর সেই রাগটাই ইসরার উপর ঝেড়েছে নিহান। কিন্তু এখন নিহানের মনে হচ্ছে সে অনেক বেশি বলে ফেলেছে। একটা মেয়েকে প্রস্টিটিউটদের সাথে তুলনা করার মতো বড় অপমান হয়তো আর কিছু হয় না। নিহান ভেজা গায়ে পেছনের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ে, মাথার উপর টিনের ছাউনিতে ঝমঝম বৃষ্টি ফোঁটার শব্দ হচ্ছে। ছাদের এই জায়গাটাতে টিনের একটা ছাউনি তোলা আর সেখানে কিছু বসার চেয়ার। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে আর তার ভিতরে বইছে অপরাধবোধের ঝড়।

ইসরা দৌড়ে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। শাওয়ার ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ইসরার চিৎকার ওয়াশরুমের প্রতিটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। চোখের পানিগুলো ঝর্নার ঠান্ডা পানির সাথে মিশে যাচ্ছে। নিহানের কথাগুলো তাকে বিষের মতো যন্ত্রণা দিচ্ছে। কথাগুলো যেনো বিষাক্ত তীরের মতো সারা শরীরে বিঁধেছে। ইসরা নিজের চুল আঁকড়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদছে আর নিজের মাথার চুল টানছে। ইসরার জানা নেই সে কতটা সময় এভাবে বসে ছিলো। অনেকটা সময় পর উঠে বের হয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে, কোনোরকমে চেঞ্জ করে বাবার নাম্বারে কল করে।

ইখতিয়ার আহমেদ মেয়ের কল দেখে খুশি হয়ে রিসিভ করে বলে, হ্যাঁ মা বল কেমন আছিস তুই ?
ইসরা বাবার গলা শুনে শুধু বাবা শব্দটা উচ্চারণ করে ডুকরে কেঁদে উঠে। কোনোভাবেই নিজের কান্না আটকাতে পারছে না। মেয়ের কান্না শুনে ইখতিয়ার আহমেদের বুক কেঁপে উঠে। ব্যস্ত গলায় বারবার জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে ? কিন্তু ইসরা কিছু বলতে পারছে না শুরু কেঁদে যাচ্ছে।
অনেকটা সময় পর ভেঙে ভেঙে বললো, বাবা আমি এখানে আর এক মুহুর্ত থাকতে পারছি না। দয়া করে তুমি এখনই আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। তুমি এখনই আমাকে না নিয়ে গেলে, চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলবে তোমার মেয়েকে।

ইসরা আর কিছু না বলে কল কেটে দিলো। ইখতিয়ার আহমেদ বারবার কল দিতে লাগলেন কিন্তু ইসরা রিসিভ করছে না। তাই ব্যস্ত হয়ে রুম থেকে বের হলো। ডাইনিং টেবিলে কাজ করতে থাকা পারভীন বেগম বারবার জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাচ্ছেন ? কিন্তু ইখতিয়ার আহমেদের কোনো দিকে হুঁশ নেই। সে এখন পারলে বিদ্যুৎ গতিতে মেয়ের কাছে পৌঁছে যেতো কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। কিছু না বলেই দ্রুত বের হয়ে গেলো ইখতিয়ার আহমেদ। পারভীন বেগম চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে। আজ সকাল থেকেই তার মনটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু খারাপ হবে। মেয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছিলো এখন সেই চিন্তা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। রুমে গিয়ে নিজের ফোন এনে মেয়েকে কল দিলো কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না।

নিহান অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে পানি পান করছে। ইসরার রুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবলো অফিস থেকে এসে সরি বলবে। এখন গেলে হয়তো আরো রেগে যাবে। নিহান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেইন ডোরের দিকে যাবে তার আগেই কলিং বেজে উঠলো। নিহান চিন্তা করতে লাগলো এখন কে এলো ? সবাই আসতে তো বিকেল হবে। নিহান ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ইসরার বাবা দাড়িয়ে আছে তার সামনে। এ বাড়িতে আসতে তার প্রায় এক ঘন্টা লেগেছে, এতোটা সময় শুধু ছটফট করে গেছে।

মেঘের অন্তরালে পর্ব ৪+৫+৬

নিহান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ইসরার বাবা ব্যস্ত গলায় জানতে চাইলো ইসরা কোথায় ? দু তিনবার জিজ্ঞেস করার পর নিহান ইসরার রুমের দিকে ইশারা করলো। তিনি এক সেকেন্ড দেরি না করে ছুটে চলে গেলো সেদিকে।
দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো, দরজা খোল মা। দেখ আমি চলে এসেছি তোকে নিতে আর এখানে থাকতে হবে না তোকে।
নিহান রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ইসরার বাবা অনেক সময় ইসরাকে ডাকার পর নিহানের হুঁশ ফিরলো।ইসরা এখনো দরজা খোলেনি আবার সেন্সলেস হয়ে গেছে ভেবে দৌড়ে মায়ের রুমে গিয়ে চাবি এনে দরজা খোলে দিলো নিহান ।

ইসরার বাবা দ্রুত রুমে ঢুকে ইসরা বলে চিৎকার করে উঠলো। নিহান তার পেছনে ভেতরে ঢুকে আঁতকে উঠলো। সাদা ফ্লোর লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে আর ইসরা বেডের সামনে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে। একহাতে ছুরি আর অন্যহাতে এখনো রক্তের স্রোত বইছে। ইখতিয়ার আহমেদ আর নিহান দুজনেই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

মেঘের অন্তরালে পর্ব ১০+১১+১২