মেঘের অন্তরালে পর্ব ৪+৫+৬

মেঘের অন্তরালে পর্ব ৪+৫+৬
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা

ইসরা কিছুটা সময় ছাঁদে থেকে নিচে চলে গেলো। তবে ইসরার ভাগ্যটা আজ হয়তো একটু বেশিই খারাপ। দুতলায় আসতেই আমিরার সামনে পরে গেলো। ইসরাকে দেখে বিরক্তি নিয়ে তাকালো আমিরা। নিহানের কোনো ভাইবোন নেই, আমিরা এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে তাই সবাই তাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। সবার আদরে একটা বাঁদর তৈরি হয়েছে বলা চলে।

ইসরা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যাবে তার আগেই আমিরা বলে উঠলো, এই আলকাতরার কৌটা।
ইসরা থেমে গেলো আমিরার ডাকে তবে কিছু বললো না। আমিরা ইসরার সামনে এসে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।
তোমার ভাগ্যটা বড্ড খারাপ আর একটু ফর্সা হলে ভালোই লাগতো তোমাকে, কিন্তু আমার দেওয়া উপাধিটা তোমার জন্য একদম পার্ফেক্ট। তোমার ভাগ্য খারাপ বললাম আরো একটা কারণে, সেটা কী জানো ?
না বললে জানবো কী করে ?

নিহান ভাইয়া ছোটবেলা থেকে কালো মানুষদের দেখতে পারে না। ভাইয়া মনে করে কালো মানুষের মন তাদের গায়ের রঙের থেকেও কালো হয়। আর তুমি তারই বউ হয়ে গেছো। আচ্ছা একটা কথা বলো, তোমার লজ্জা করে না এতো বড় একটা ধোঁকাবাজি করলে ?
লজ্জা করতো যদি এতে আমার কোনো দোষ থাকতো।
তুমি চাইলেই বিয়েটা ভাঙতে পারতে কিন্তু তুমি তোমার ঐ ঠকবাজ বাবার সাথে মিলে আমাদের ঠকালে।
ইসরা আমিরার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো আর বললো, আমি কী করেছি আর কী করিনি সেটা আমি ভালো করে জানি। আমার ভাগ্য কতটা খারাপ সেটাও আমি আগে থেকেই জানি। তবে তোমার ভাইয়ার ভাগ্যটা যে খারাপ সেটা বুঝে গেছি। সে নিজের ভাগ্য দোষে ঠঁকে গেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

একেই হয়তো বলে চোরের মায়ের বড় গলা। এতোবড় একটা অপরাধ করে তোমার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই বরং নিজেকে নির্দোষ মনে করো। তুমি আসলেই একটা অভদ্র মেয়ে।
আমিরা তুমি কিন্তু দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো। কার সাথে কীভাবে কথা বলছো সেটা তোমার মাথায় থাকে না।
ইসরা কিছু বলবে তার আগেই পেছন থেকে কারো আওয়াজে দুজনেই ঘুরে তাকালো। নিহানের মা দাঁড়িয়ে আছে তাদের পেছনে।
বড় মা তুমি এই ঠকবাজ মেয়েটার জন্য আমাকে এসব বলছো ?
কফির জন্য কিচেনে যাচ্ছিলে তাই যাও, আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না।
আমিরা ইসরার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে চলে গেলো। ইসরা নিহানের মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই নিহানের মায়ের গম্ভীর আওয়াজে থেমে গেলো।

কোথায় গিয়েছিলে ?
ইসরা মাথা নিচু করে বললো, ছাঁদে।
সকালে নিহান ছাঁদে যায় তাই আর কখনো সকালে ছাঁদে যাবে না।
ইসরা নিচু গলায় উত্তর, ঠিক আছে।
নিজের রুমে যাও আমি মনিরাকে দিয়ে তোমার খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ইসরা নিজের রুমে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো। এই দুনিয়া শক্তের ভক্ত নরমের জম। এখানে নিজেকে নরম প্রমাণ করলে হয়তো আরো অনেক কিছু সহ্য করতে হবে। কিন্তু নিজেকে সবার সামনে যতো কঠিন প্রমাণ করতে চাইছে ভেতর থেকে ঠিক ততটাই দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। নিহানের প্রতিটা কথা যেখানে তাকে ধাঁরালো অস্ত্রের মতো আঘাত করছিলো সেখানে সে ঠোঁটের কোণে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে পুরোটা সময়। সে তো নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছিলো বিয়েটা আটকানো। তাহলে তাকে কেনো বার-বার শুনতে হচ্ছে ধোকাবাজ, প্রতারণ, ঠকবাজ ?

কেনো করলে বাবা, কেনো ? যেখানে তুমি নিজেই নিজের কালো মেয়েকে মেনে নিতে পারোনি সেখানে অন্য একটা পরিবার কীভাবে মেনে নিবে ? আজ যদি কালো হয়ে জন্ম না নিতাম, তাহলে তো তুমি এমন জঘন্য একটা পথ বেছে নেওয়ার চিন্তাও করতে না।
ইসরা কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। উপরে সে যতটা শক্ত ভেতরে তার থেকে কয়েক হাজার গুণ বিধ্বস্ত।
পুরো পৃথিবী যেখানে সৌন্দর্যের পূজারী সেখানে নিহানের কী দোষ ? সে ভালো কাউকে পাওয়ার সম্পূর্ণ যোগ্যতা রাখে। কোনো সুন্দরী রমণী তার স্ত্রী হোক এটা চাওয়া তো কোনো অন্যায় নয় তার,সেটা সে চাইতেই পারে। তার জন্য কোনো অভিযোগ নেই আমার মনে। কিন্তু আমার সহ্যের সীমা কতটা হওয়া প্রয়োজন। এসব যে আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। মুক্তি চাই আমি এই অভিশপ্ত জীবন থেকে।

কীরে নিহান মন খারাপ করে বসে আছিস কেনো ?
হাতের কলম ঘুরানো বন্ধ করে দিলো নিহান। কম্পিউটারের স্কিনের দিকে তাকিয়ে হাতে কলম ঘুরিয়ে যাচ্ছিলো। পাশ থেকে রুপমের আওয়াজ শুনে বিরক্তি নিয়ে তাকালো।
নতুন বিয়ে করেছিস এখন তো ফুরফুরে মেজাজে থাকবি সবসময়। তা না করে পেঁচার মতো মুখ করে বসে আছিস কেনো তখন থেকে ?
চরম বিরক্তি নিয়ে নিহান বললো, সবটা জানার পরও ইচ্ছে করে এমন মজা করছিস ?
রুপম হেঁসে বললো, সত্যি ভাই এই যুগে এমন ঘটনা ভাবা যায় না। তোর শশুর মনে হয় আদি যুগ থেকে টাইম মেশিন দিয়ে এই যুগে চলে এসেছে।

সব বিষয়ে মজা আমার একদম পছন্দ না রুপম।
আচ্ছা ভাই, সিরিয়াস একটা কথা বলছি। তোর বউ, মানে ঐ মেয়েটা তোকে কিছু জানানোর চেষ্টা করেনি ?
ঐ মেয়ে তো বাপের মতোই ধোঁকাবাজ। আমার মতো ছেলে হাতছাড়া করা যায় নাকি ?
তবু একবার জানতে চাইতি কেনো কিছু জানায়নি তোকে।
এই মেয়ের আচরণ দেখে তোর মনে হবে না কোনো অনুশোচনা আছে। ঐ মেয়ে আরো একবার প্রমাণ করে দিয়েছে কালো মানুষের মনটাও তাদের মতো কালো হয়।

এটা কিন্তু তোর ভুল ধারণা। সবাই যে করিম চাচার মতো হবে এমনটা কিন্তু নয়, আর সেও কিন্তু খারাপ মানুষ ছিলেন না। ছোটবেলার একটা সামান্য বিষয় নিয়ে তোর মনে এমন ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। এটা থেকে বেরুতে না পারলে তোর আফসোস করতে হবে পরে।
এতো জ্ঞান না দিয়ে নিজের কাজ কর আর আমাকেও কাজ করতে দে। ঐ মেয়ের কথা মনে করিয়ে মেজাজ খারাপ করিস না।
স্যার আপনার সাথে একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে।

পিয়নের কথা শুনে নিহান আর রুপম দুজনেই সামনে তাকালো।
নিহান অবাক হয়ে বললো, আমার সাথে আবার কে দেখা করতে আসবে, তাও আবার অফিসে ?
রুপম দুষ্টুমি করে বললো, হয়তো তোর বউ এসেছে।
নিহান রেগে চোখ মুখ শক্ত করে বললো, ঐ মেয়ে এখানে এলে খুন করে ফেলবো একদম।
নিহান উঠে বড় বড় কদমে ওয়েটিং রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। রাগে হাত পা কাঁপছে নিহানের। কিন্তু ওয়েটিং রুমে গিয়ে যাকে দেখতে পেলো, তাতে নিহান অবাক হয়ে গেলো, সাথে রাগটাও এক ধাপ বাড়লো।
আপনি এখানে ?

নিহানের কথায় হুর দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। অনেকটা সাহস নিয়ে এখানে এসেছিলো কিন্তু নিহানের রাগী চেহারা দেখে সব সাহস ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো।
আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো ?
নিহান দাঁতে দাঁত চেপে বললো, কিন্তু আমার কোনো কথা নেই আপনার সাথে।
হুর জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, ইসরার ব্যাপারে কিছু বলার ছিলো।
ওয়াও কি সুন্দর ব্যাপার। এক প্রতারক এসেছে আরেক প্রতারকের হয়ে সাফাই গাইতে। প্রশংসা করা উচিত আপনাদের সবার।
আপনি আমাকে প্রতারক বলতে পারেন কিন্তু ইসরা একদমই নির্দোষ।

আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না আপনার থেকে। এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হয়ে না গেলে সিকিউরিটি ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে বাধ্য হবো। আপনাদের আচরণে নিজের ভদ্রতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পরছে আমার পক্ষে।
হুরের কোনো কথা না শুনে নিহান রেগে বের হয়ে গেলো ওয়েটিং রুম থেকে। হুর হতাশ হয়ে সোফায় বসে পড়লো। কতটা ঝুঁকি নিয়ে সে এখানে এসেছে সেটা একমাত্র সেই জানে। ইসরা যদি কোনোভাবে জানতে পারে তাহলে হুরকে কী করবে সেই ভালো জানে।

দুপুরে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে নিহান বাড়ি ফিরলো। বাড়িতে নিহানের মা, ইসরা আর মনিরা ছাড়া কেউ থাকে না এই সময়। আজও তিনজনই বাসায় আছে। ইসরা নিজের রুমে বেডে বসে কিছু চিন্তা করছিলো। বাইরে মনিরার গলা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলো।
বাবা তুমি এই সময়ে বাসায় ?
ঐ মেয়েটা কোথায় আন্টি ?
কেডা, তোমার বউ ?

মনিরার কথায় রাগী চোখে তাকালো নিহান। নিহানের চোখ দেখে মনিরা ভয়ে ঢোক গিলে বললো, নিজের রুমেই আছে।
নিহান ইসরার রুমের দিকে এগিয়ে গেলে আর মনিরা গেলো নিহানের মাকে ডেকে আনতে। নিহান যেভাবে রেগে গেছে তাকে কোনো অঘটন না ঘটে যায়। নিহান কিছু না বলে ইসরার রুমের দরজায় সজোরে আঘাত করতে লাগলো। শব্দটা বেশি হওয়ায় ইসরা প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। পরপর আঘাত করলে ইসরা উঠে গিয়ে দরজা খোলে দেয়৷ দরজা খুলতেই নিহানকে দেখে চমকে উঠলো। নিহান কিছু না বলে পরপর সজোরে দু’টো থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ইসরার গালে। ইসরা কিছু বুঝে উঠার আগেই স্তব্ধ হয়ে গেলো নিহানের কাজে। আরো একটা থাপ্পড় দিতে যাবে তার আগেই কেউ হাত ধরে ফেললো।

কী করছিস নিহান, মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর ?
হ্যাঁ মা, মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার। এই মেয়ের জন্য আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। নরক করে দিয়েছে আমার জীবন। সবার সামনে হাসির খোরাক হতে হচ্ছে আমাকে।
কী হয়েছে সেটা বলবি তো ?
এই মেয়ে নিজের বোনকে আমার অফিসে পাঠিয়েছিলো নিজের সাফাই গাইতে। সেটা নিয়ে পুরো অফিস হাসাহাসি করছে আমার উপর। এই মেয়ের জন্য আমার বাইরে যাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে মা। আমি আর এসব নিতে পারছি না।
তুই আগে শান্ত হ। মাথা গরম করে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না নিহান। তুই চল আমার সাথে।

নিহানের মা নিহানকে জোর করে সাথে নিয়ে গেলে আর ইসরা দরজা ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পড়লো। চিৎকার করে কাঁদছে ইসরা। মনিরা ইসরাকে কী বলে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে তার। মেয়েটার জীবনটাও তো নষ্ট হয়ে গেছে। নিহান ছেলে মানুষ, একটা কেনো দশটা ডিভোর্স হলেও দিব্বি বিয়ে করতে পারবে আবার। কিন্তু একটা মেয়ের জীবনে এটা যে কতবড় দাগ সেটা কেউ বুঝতে পারবে না ভুক্তভোগী ছাড়া।
মনিরা ইসরার পিঠে হাত রেখে বললো, এটা একদম ঠিক করোনি মেয়ে। কী দরকার ছিলো তোমার বোনকে নিহান বাবার কাজের জায়গায় পাঠানের।

মনিরা চলে যেতেই ইসরা উঠে দরজা বন্ধ করে দিলো। সেখানেই বসে আবার কাঁদতে লাগলো। কেনো তার ভালো করতে গিয়ে বারবার তার ক্ষতিই করে। হুর কেনো গিয়েছিলো নিহানের অফিসে ?
ইসরা কাঁদতে কাঁদতে বললো, এবার তোমার শান্তি হয়েছে তো বাবা। এতো সুখের একটা জীবন তুমি আমাকে উপহার দিয়েছো, শান্তি হয়েছে তোমার ? না না দোষ তোমার একার নয়। আমার সব দরজা তুমি বন্ধ করলেও একটা দরজা তো খোলা ছিলো। সুইসাইড করে নিলে তো তুমি আর কিছুই করতে পারতে না। এই অভিশপ্ত জীবন থেকে আমিও মুক্তি পেতাম আর তোমরাও মুক্তি পেতে তোমাদের দায় থেকে।
নিহানের মা নিহানকে বুঝিয়ে একটু শান্ত করে।

দেখ নিহান তুই যদি মানুষের কথায় মাথা গরম করিস তাহলে মানুষ তোকে আরো পেয়ে বসবে। বাঙালি জাতির কাজই হলো অন্যের বিষয় নিয়ে সমালোচনা করা। এদের ফালতু কথায় যত রিয়াক্ট করবি এরা তত তোর পেছনে লাগবে। তুই যদি পাত্তা না দিস দেখবি একা একাই থেমে গেছে।
আমি কেনো এসব সহ্য করবো তুমি বলতে পারো ? আমি কী অন্যায় করেছি যে আমাকে এসব সহ্য করতে হবে ?
সত্যি কী কিছুই করিসনি কখনো ?
নিহান অবাক হয়ে বললো, মানে ?

নিহানের মা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, নিজের অতীত হাতড়ে দেখ, ঠিক খুঁজে পাবি। হয়তো এর থেকেও কয়েকগুণ বেশি কেউ সাফার করেছে, সেটাও শুধুমাত্র তোর জন্য। মানুষ ছেড়ে দিলেও সময় ঠিক বিচার করে।
নিহানের মা আর কিছু না বলে বের হয়ে গেলো নিহানের রুম থেকে। কিন্তু নিহানকে দিয়ে গেলো একটা গাদা চিন্তা। সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে অতীত হাঁতড়ে নিজের দোষ খুঁজতে লাগলো। কিন্তু মানুষের চোখে নিজের দোষ বড্ড কম ধরা পড়ে। তাহলে নিহান কী করে এতো সহজে নিজের করা অন্যায় খুঁজে পাবে।

রাতে সবার খাওয়া শেষে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো নিহানের পুরো পরিবার । বাড়ির কর্তা নিহানের বাবা সেই নির্দেশই দিয়েছেন।
আশেপাশে তাকিয়ে নিহানের বাবা বললো, মেয়েটা কোথায় ?
আমিরা বলে উঠলো, আমাদের পারিবারিক বিষয়ে তুমি ঐ মেয়েকে টানছো কেনো বড় আব্বু ?
আমিরার বাবা মেয়েকে ধমক দিয়ে বললো, আমিরা তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছো আজকাল। বড়দের মাঝে কথা বলা কোথা থেকে শিখছো ?

নিহানের বাবা বললো,থাক ওকে বকিস না, ও ছোট মানুষ। মেয়েটার বিষয়েই কিছু কথা ছিলো তাই তাকে খুঁজছি। আমি আজ এডভোকেটের সাথে কথা বলেছি। মেয়েটা এখানে তিন মাস থাকলেই হবে তার মধ্যে প্রায় একমাস চলেই গেছে। মানে আর দুমাস থেকে নিজের বাড়ি চলে যাবে। বাকিটা এডভোকেট দেখে নিবে বলেছে।
আপদ যত তাড়াতাড়ি বিদায় নেয় ততই ভালো।
আমিরার মায়ের কথা শুনে আমিরার বাবা তার দিকে কড়া চোখে তাকালেন। আমিরার মায়ের আচরণে মনে হয় ইসরা তার বড় জা এর ছেলে নয় বরং তার নিজের ছেলেকে ঠকিয়েছে। এদিকে নিজের ছেলের কোনো খবর নেই তার কাছে। পুরোটা সময় নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে নিহান।

নিহানের বাবা গম্ভীর গলায় বললো, মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে এসো নিহানের মা।
নিহানের মা মনিরাকে ইশারা করতেই মনিরা চলে গেলো ইসরার রুমের দিকে। কিন্তু অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। তখন ভয় পেয়ে ড্রয়িংরুমে এসে বললো ইসরা দরজা খোলছে না। সবাই কিছুটা বিরক্তি নিয়ে তাকালো মনিরার দিকে। নিহানের মা চরম বিরক্ত হয়ে নিজেই গেলেন ইসরার রুমের সামনে।
কিন্তু সেও যখন ব্যর্থ নিহান গিয়ে বললো, এই মেয়ে তুমি দরজা খুলবে নাকি আমি দরজা ভেঙে ফেলবো। আমাকে যদি দরজা ভাঙতে হয় তোমার কপালে দুঃখ আছে বলে দিলাম।
নিহানের এসব কথায় কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো না। এবার সবাই একটু ভয় পেয়ে গেলো। এই মেয়ে কিছু করে বসলো না তো আবার ?
নিহান ব্যস্ত গলায় বললো, মা রুমের চাবিটা নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।

#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৫

নিহানের মা দ্রুত রুমের চাবি নিয়ে নিহানের হাতে দিলো। রুমে ঢুকে সবাই চমকে উঠলো। ইসরা সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। নিহানের মা গিয়ে ইসরার মাথা নিজের কোলে তুলে নিলো।
গালে হালকা থাপ্পড় দিয়ে বললো, এই মেয়ে চোখ খোলো, তাকাও আমার দিকে।
নিহান সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে মায়ের হাতে দিলো। নিহানের মা ধীরে ধীরে পানির ছিটা দিতে লাগলো চোখেমুখে। নিহানের বাবা অলরেডি ডক্টরকে ইনফর্ম করে দিয়েছে। ডক্টরের বাসা কাছেই তাই আসতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না।
নিহান মেয়েটাকে বেডে শুইয়ে দে।
মায়ের কথায় নিহান ভ্রু কুঁচকে তাকালে নিহানের মা বলে উঠে, এখন এখানে কোনো ড্রামা দেখতে চাই না আমি। তাই যেটা বলছি দ্রুত কর।

নিহান বাধ্য হয়ে ইসরাকে কোলে তোলে বেড়ে শুইয়ে দিলো। ইসরার পুরোপুরি সেন্স ফেরেনি এখনো। চোখ খোলার মতো শক্তি পাচ্ছে না। কতটা সময় ধরে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে সেটাও বলতে পারবে না। একটু পরই ডক্টর এসে চেকআপ করলো।
ভয়ের কিছু নেই। কম ঘুমানো, খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম আর দুশ্চিন্তার জন্য এমন হয়েছে। বিপি অনেক কম দেখা যাচ্ছে। এসব বিষয়ে একটু নজর রাখলেই হবে। এখন কিছু খাইয়ে আমার দেওয়া মেডিসিন গুলো খাইয়ে দেবেন।
ডক্টর মেডিসিন লিখে দিয়ে বের হয়ে গেলো ইসরার রুম থেকে, নিহানের বাবা তার সাথে গেলেন।
আমিরা মুখ ভেংচি কেটে বললো, যত্তসব ঢং আর সবার সিমপ্যাথি পাওয়ার বাহানা।
নিহানের মা গম্ভীর গলায় বললো, আমিরা অনেক রাত হয়েছে নিজের রুমে যাও।

আমিরার এখানে থাকার কোনো ইচ্ছাও নেই, তাই বলার প্রায় সাথে সাথেই বের হয়ে গেলো রুম থেকে। নিহান দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমিরার বাবা-মা একটু পর চলে গেলো। মনিরা ইসরার পায়ের কাছে বসে পায়ে তেল মালিশ করছে।
এদিকে মেইন গেইটের কাছে এসে ডক্টর দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো, মিস্টার রেজওয়ান আমি আপনার ছেলের বিয়ের বিষয়ে সবই জানি। মেয়েটার পরিবার অন্যায় করেছে মানছি কিন্তু মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে আপনারা কী ঠিক করছেন ?
নিহানের বাবা বুঝতে না পেরে বললো, আপনার কথার মানে বুঝতে পারলাম না।
মেয়েটার গালে থাপ্পড়ের দাগ বসে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে। একজন মানুষ অপর একজন মানুষকে এভাবে কী করে আঘাত করতে পারে আমার জানা নেই।

ডক্টরের কথা শুনে নিহানের বাবার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো আর গম্ভীর গলায় বললো, আমি খেয়াল রাখবো এই বিষয়ে।
ডক্টর কিছু না বলে বের হয়ে গেলো। নিহানের বাবা হাতের মুষ্টি শক্ত করে ইসরার রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ইসরার বেডের কাছে গিয়ে গালটা ভালো করে দেখে নিলো।
গম্ভীর গলায় বললো, এই মেয়ের গালে থাপ্পড়ের দাগ কেনো ?
বাবার কথায় নিহান চমকে উঠে সামনে তাকালো আর নিহানের মাও ভয়ে ভয়ে তাকালো নিহানের বাবার দিকে। উত্তর না পেয়ে তিনি হুংকার ছেড়ে একই কথা বললেন।
উত্তরে নিহান আমতা আমতা করে বললো, আমি মেরেছি।
নিহানের বলতে দেরি হলেও তার গালে সজোরে থাপ্পড় পড়তে দেরি হলো না।

মিস্টার আকরাম রেজওয়ান হুংকার ছেড়ে বললেন, এই পরিবারের ছেলে হয়ে এমন কাপুরুষের মতো কাজ কীভাবে করলে ? কোনো সাহসে তুমি এই মেয়ের গায়ে হাত তুলেছো ? প্রতারণা করেছে তার জন্য তুমি ডিভোর্স চেয়েছো আমি কিছু বলিনি। কারণ তুমি এটা চাওয়ার অধিকার রাখো। কিন্তু এই মেয়ের গায়ে হাত তোলার অধিকার তোমার নেই। সে আমাদের পরিবারে মাত্র দু-মাসের অতিথি।
নিহান গালে হাত দিয়ে বললো, কিন্তু বাবা।

আমি তোমার আর কোনো কথা শুনতে চাই না। এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাও আর একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও ভালো করে। ফিউচারে যদি আবার কখনো এমন কাজ করো সেটা তোমার জন্য খুব খারাপ হবে।
নিহান ইসরার দিকে একবার তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
নিহানের মা ইসরার দিকে তাকিয়ে বললো, ছেলেটাকে এভাবে না বললেও পারতেন। বাড়ির ঝামেলা অফিস পর্যন্ত পৌঁছালে কারোই মাথা ঠিক থাকবে না।

নিহানের বাবা কথাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললেন, মেয়েটাকে কিছু খাইয়ে মেডিসিন খাইয়ে দাও। মনিরাকে বলে দিও আজ রাতে যেনো এখানেই ফ্লোরে বিছানা করে শুয়ে পড়ে।
উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজের রুমে চলে গেলো নিহানের বাবা। বেলকনির ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে নিলেন। নিহান তাদের একমাত্র সন্তান, তাই সবসময় আদর ভালোবাসায় ভড়িয়ে রেখেছে। আজ ছেলের গায়ে হাত তুলে তারও খারাপ লাগছে। কিন্তু ছেলেটার আচরণ দিন দিন তার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। মানুষকে মানুষ মনে করে না যেনো সে।
ছাঁদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে নিহান। রাগে হাত-পা কাঁপছে। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার বাবার হাতে থাপ্পড় খেলো নিহান। বেশ কিছু বছর আগে একবার থাপ্পড় খেয়েছিলো আমিরার বড় ভাই মানে নিহানের চাচাতো ভাইয়ের জন্য আজ খেলো ইসরার জন্য। ইসরার উপর নিহানের রাগটা যেনো তরতর করে বেড়ে চলেছে।

সকালে ইসরার ঘুম ভাঙলো ফজরের আযান কানে আসতেই। উঠে বসতে বেশ বেগ পেতে হলো শরীর দূর্বল থাকায়। ডিমলাইটের আলোতে মনিখালাকে দেখলো ফ্লোরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আজ ইসরার ঘুম এতোটাই গভীর ছিলো মনিরা এতো শব্দে নাক ডাকা তার ঘুমে অসুবিধা করে উঠতে পারেনি। ইসরা ধীর পায়ে বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ফ্রেশ হয়ে ওযু করে আয়নায় তাকালে গালের দিকে খেয়াল হলো। দাগটা কমে গেলেও ব্যাথাটা রয়ে গেছে।

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হয়তো থাপ্পড় দুটো মেরেছিলো। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে রুমে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো। এতোদিন এতোটাই হতাশ হয়ে গিয়েছিলো নামাজ পড়াটাও অনেকটা হেলাফেলা করেছে। আজ মনটা হালকা করতে ইচ্ছে করছে কারণ ইসরার মনে হচ্ছে কেউ তার বুকে একটা পাহাড় সমান পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। মন হালকা করার জন্য নামাজের থেকে ভালো কোনো উপায় ইসরার জানা নেই। নামাজ শেষ হতেই মনিরাকে দেখলো উঠে গেছে আর নিজের বেড গোছাচ্ছে। সে অবশ্য প্রতিদিনই খুব সকালে উঠে নিজের কাজ শুরু করে দেয়। এই বাড়ির সবাই সকাল আটটার মধ্যে নিজেদের ব্রেকফাস্ট সেরে নেয় আর পরে নিজের অফিস টাইমে বের হয়ে যায়।

জায়নামাজ ভাজ করে ইসরা বললো, একটু বাইরে নিয়ে যাবে মনিখালা ? অনেকদিন হয়ে গেছে প্রাণ ভড়ে নিশ্বাস নিতে পারি না।
ইসরার কথায় অনেক মায়া হলো মনিরার, তাই রাজি হয়ে গেলো। ইসরার থেকে একটু সময় চেয়ে নিলো ফ্রেশ হাওয়ার জন্য। অনুমতি পেয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো সে। ইসরা বেলকনিতে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ব্যস্ত ঢাকা শহর এখনো পুরোপুরি জেগে উঠেনি তাই গাড়ির হর্ণ শোনা যাচ্ছে না তেমন। যদিও আবাসিক এলাকা হওয়ায় প্রাইভেট কার, সিএনজি আর রিকশা ছাড়া অন্য যানবাহন খুব কমই চোখে পড়ে সামনের রাস্তাটায়।
চলো গো মেয়ে।

মনিরার কথায় ইসরা চোখ সরিয়ে নিলো সামনে থেকে আর মনিরার দিকে তাকালো।
তয় যাইবা কই বলো দেখি ? বাড়ির সামনে যে বাগান আছে খুব একটা বড় না।
আশেপাশে পার্ক আছে ?
মনিরা একটু ভেবে বলে উঠলো, হ আছে তো, সকালবেলা সেইহানে মানুষের মেলা বহে যেন। সবাই কোনোদিকে না তাকাইয়া শুধু হাঁটে।
ইসরা মুচকি হাঁসলো, মনিরা যে ডায়াবেটিস রোগীদের কথা বলছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে। কথা না বাড়িয়ে পাশের পার্কটার দিকে যেতে লাগলো ইসরা।
আইজ তোমারে একটু মানুষ মনে হইতাছে।
কেনো এতোদিন কী মনে হয়েছে ?
কাঠের পুতুল।

ইসরা আবারো মুচকি হাঁসলো আর বললো, আজ আমার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। তাই চাইছি আজ দিনের শুরুটা ভালো করতে, যাতে শেষটা ভালো হয়।
মনিরা হা করে তাকিয়ে বললো, তুমি ডাক্তার হইবা ?
ইসরা ছোট করে উত্তর দিলো, হুম সেটাই এখন আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
কথায় কথায় পার্কে চলে এলো। সকালে মানুষ এসব জায়গায় আসে মর্নিং ওয়াক করতে আর বিকেলে আড্ডা দিতে আসে অনেকে, আবার কেউ আসে প্রেম করতে। এখন যেহেতু সকাল তাই বসার জায়গাগুলো ফাঁকাই পরে আছে। ইসরা একটু ফাঁকা জায়গা দেখে বসলো। অনেক দিন পর মুক্ত আকাশে নিশ্বাস নিয়ে মন্দ লাগছে না ইসরার। বুকের ভারী ভাবটাও অনেকটা হালকা হয়ে গেছে।
এইটা তোমার ছেলের বউ না আকরাম ?

বন্ধু আলীর সাথে প্রতিদিন এখানেই মনিংওয়াক করে নিহানের বাবা আকরাম রেজওয়ান। আজও হাটছিলেন কিন্তু বন্ধুর কথায় পা থেমে গেলো। আলীর আঙ্গুল অনুসরণ করে তাকিয়ে ইসরাকে বসে থাকতে দেখলো মাথায় ঘোমটা দিয়ে আর পাশেই মনিরা দাঁড়িয়ে। আকরাম কী করবে বুঝতে পারছে না ? বড্ড রাগ হচ্ছে মেয়েটার উপর। এমনিতেই নিহানকে গতরাতে থাপ্পড় মারা নিয়ে উনার মুড অনেক খারাপ। এখন ইসরাকে বাইরে দেখে বেশ রেগেই গেলেন। উনি ইসরার কাছে যাওয়ার আগেই কিছু মহিলা সেখানে উপস্থিত হয়ে গেলো।
এই তুমি সেই মেয়ে না, রেজওয়ান বাড়ির নতুন বউ ?
ইসরা চুপ থাকলেও মনিরা ফট করে বলে দিলো, হ তয় কী অইছে ?

তারা নিজেদের মধ্যে বলে উঠলো, মেয়েটা সত্যি অনেক কালো। নিহান ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে ডিভোর্স দেওয়ার। এমন মেয়ে নিয়ে কী সংসার করা যায় ? এর হাতের খাবার খেতেও তো ঘেন্না লাগবে। হাজারবার হাত ধুয়ে এলেও মনে হবে ময়লা লেগে আছে। তার উপর আবার বাটপারিতেও পাকা।
ইসরা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে তাদের প্রত্যেকের মন্তব্য।
এমন মেয়ে দেখেশুনে কেউ বিয়ে করবে না, বাপ সেটা বুঝে গিয়েছিলো আর তাই এমন জালিয়াতি করার পরিকল্পনা করেছে।
তুমি বাড়ির বাইরে এসেছো কাকে বলে ? তুমি না অসুস্থ, তাহলে এই অবস্থায় বাইরে এসেছো কেনো ?

মোটা আর গম্ভীর গলা শুনে ইসরা ঘুরে তাকিয়ে নিহানের বাবাকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। আজ এটা নিয়ে আবার কী ড্রামা হবে কে জানে। ইসরা ভেবেছিলো কেউ জানার আগেই আবার বাসায় চলে যাবে কিন্তু সবটা এভাবে ঘেটে যাবে বুঝতে পারেনি। ইসরার এখন ইচ্ছে করছে দেয়ালে মাথা ঠুকে হিসাব করার। আজ কী সে দিনের শুরুটা ভালো করতে এসেছিলো নাকি অন্যদিনের থেকে আরো একটু বিষিয়ে তুলতে এসেছিলো এখানে ? দিনের শেষটা কেমন হবে সেটাই চিন্তা করছে ইসরা কারণ তার উপরই ইসরার পুরো জীবন নির্ভর করছে।

#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৬

ড্রয়িংরুমে সোফার এক কোণে বসে আছে ইসরা। তাকে বাইরে নেওয়ার অপরাধে বকা খাচ্ছে নিরপরাধ মনিরা।
মনিরা তুমি কার কথায় ওকে বাইরে নিয়ে গেছো ?
মাইয়াডার কথা শুনে না করতে পারি নাই। আসছে পর থেইকা একটা ঘরে বন্দী থাকে। তার একটু তো ইচ্ছা করে বাইরে যাইতে।
নিহানের মা রেগে বললো, যা বলবে তাই করতে হবে তোমার ? বেতন কী ওর থেকে নাও, নাকি আমার থেকে ?
মনিরা মাথা নিচু করে বললো, ভুল হইয়া গেছে আর হইবো না।
যাও নিজের কাজে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।

মনিরা নিজের কাজে চলে গেলো আর নিহানের মা এবার ইসরার দিকে তাকালো আর বললো, আর কতো হাসির খোরাক করবে আমাদের ? তোমার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে পারি না আমরা। আমাদের পরিবারের কাউকে দেখলে মানুষ হাসাহাসি করে, নানা কথা বলে। আমার ছেলেটা বন্ধুদের সাথে মিশতে পারে না তোমার জন্য। সবাই ওকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। এসব জানার পরও সকালবেলা নিজের এই কুৎসিত চেহারাটা পুরো মহল্লার মানুষকে না দেখালে চলছিলো না তোমার ?
ইসরার চোখ দুটো টলমল করছে পানিতে, বুক ফেটে কান্না আসছে। নিজের কাছেই নিজেকে ছোট লাগছে। এতোকিছুর পরও সে কী করে বাইরে গেলো ? তার বুঝা উচিত ছিলো সে মানুষ খুনের চাইতেও বড় অপরাধ করে, শাস্তি ভোগ করতে এসেছে এই সুন্দর বাড়ি নামক কারাগারে। আর অপরাধীরা কখনো বুক ভড়ে নিশ্বাস নেওয়ার অধিকার রাখে না। ইসরা নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে চায় না কারো কাছে। তাই আড়ালে চোখের পানি মুছে, বুক ফাঁটা কান্নাও গিলে নিলো।

উঠে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বললো, দুঃখিত এই ভুল আর কখনো হবে না।
ইসরা আর না দাঁড়িয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো৷ নিহানের মা সোফায় বসে পড়লেন ধপ করে। রোজকার এই ড্রামা তারও ভালো লাগছে না আর। মেয়েটার সাথে আজ বেশি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে ভেবে এখন আবার অনুশোচনা হচ্ছে তার। সেও ক্লান্ত হয়ে গেছে নতুন নতুন সব ঝামেলায়।

ইসরা সারাদিন আর রুম থেকে বের হয়নি। তার খাবার বরাবরের মতো রুমে দিয়ে যাওয়া হয়েছে আর সে খেয়েও নিয়েছে। প্রত্যেকবার রেজাল্টের আগে ইসরার প্রচন্ড ভয় হতো, যদিও সে ভালো এক্সাম দিয়েছে তবু। তবে আজ রেজাল্টের জন্য টেনশন হচ্ছে না, অথচ আজকের রেজাল্টের উপর তার পরবর্তী জীবন নির্ভর করছে। ইসরা বেলকনির ফ্লোরে বসে আছে চুপচাপ। হেলে পরা সূর্যের খানিকটা কিরণ ইসরার কালো পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার দুলতে থাকা গাছের পাতা সেই সূর্য কিরণ আড়াল করার চেষ্টা করছে৷ ইসরা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সেই লুকোচুরি খেলা, দেখতে মন্দ লাগছে না তার। হঠাৎ বিকট আওয়াজে ফোনটা বেজে উঠলে ইসরার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটলো। তবু অলস ভঙ্গিতে সেখানেই বসে রইলো। বেশ কয়েকবার ফোনটা বেজে কেটে গেলো। আবারও বেজে উঠলে ইসরা বিরক্ত হয়ে উঠে রুমে চলে এলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তার মায়ের নাম্বার।

গম্ভীর গলায় বললো, আসসালামু আলাইকুম মা।
মলিন গলায় পারভীন বেগমের উত্তর, ওয়ালাইকুম আসসালাম।
তারপর আবার বেশ কিছুটা সময় নিরবতা। মা মেয়ে দুজনেই যেনো আজ চুপ থাকার শপথ নিয়েছে।
শেষে পারভীন বেগমই নিরবতা ভেঙে বললো, কেমন আছিস মা ?
ইসরার কাঠ কাঠ উত্তর, মিস্টার ইখতিয়ার আহমেদ যেমনটা দেখতে চেয়েছিলেন তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো ?

পারভীন বেগম ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, মানুষটা ভালো নেই রে মা। নিজের হাতে সন্তানের জীবন নষ্ট করার দায় মাথায় নিয়ে কোনো বাবা ভালো থাকতে পারে না। খাওয়া ঘুম যেনো দিনদিন ভুলে যাচ্ছে। মাঝরাতে ডুকরে কেঁদে উঠে বলে আমার কলিজার জীবনটা আমি নিজের হাতে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছি। এই পাপ আমি কী দিয়ে মুছবো পারভীন ? মানুষটার কান্না দেখে পাথরের মুর্তিও কেঁদে দিবে সেখানে তো আমি রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। নিজেও কাঁদি তার সাথে।

বাবার কথা শুনে ইসরার চোখে পানি টলমল করছে। মানুষটা যতোই অন্যায় করুক, ইসরা তাকে খুব ভালোবাসে আর সেও মেয়েটাকে কলিজা মনে করে। কী করে সেই মেয়ের জীবন নিয়ে এতোবড় ভুল সে করলো ইসরা হিসার মেলাতে পারে না।
নিজের অনুভূতি আড়াল করে ইসরা কঠিন গলায় বললো, অন্যকে ধোঁকা দিয়ে কখনো ভালো থাকা যায় না মা।
পারভীন বেগম ভেজা গলায় বললো, উনি তো অন্যকে ঠকাতে গিয়ে নিজে ঠকে গেছে। নিহান ছেলে মানুষ কিছুদিন পর তার গায়ের ডিভোর্সের দাগ মুছে যাবে। কিন্তু তুই মেয়ে মানুষ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোর গায়ের এ দাগ মুছতে দেবে না এই সভ্য সমাজ।
জানো মা, স্কুলে থাকতে আমাদের একটা শিক্ষা দেওয়া হতো। ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। এখন আর ভেবে লাভ নেই। কর্মের ফল সবাইকেই ভুগতে হবে।

তাহলে অন্যের কর্মফল তুই কেনো ভোগ করছিস ? ভুল তোর বাবার ছিলো তোর তো নয়। তাহলে তুই কেনো এতোকিছু সহ্য করছিস তার উত্তর আছে তোর কাছে ?
কখনো কখনো বাবা-মায়ের কর্মফল সন্তানকে ভোগ করতে হয় মা। সেটা ভালো হোক বা খারাপ।
পারভীন বেগম আর কিছু বলতে পারলো না। আর কিছু বলার মতো ভাষায় আর জানা নেই।
ইমন কোথায় মা ?
কোথায় যেনো খেলতে গেলো একটু আগে।
ওহ্।
আবার কিছুটা সময় নিরবতা বিরাজমান।
রাখছি মা ভালো থেকো।
যেটা বলতে চেয়েছি সেটাই তো বলা হলো না।
কী সেটা ?

হাজারটা খারাপ খবরের মাঝে তোর জন্য একটা ভালো খবর পেয়েছি। তুই মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেছিস।
ইসরা চোখ বন্ধ করে বড় একটা নিশ্বাস নিলো। চোখের কোণ বেয়ে একবিন্দু নোনাজল বের হয়ে গেলো। কষ্টের নয় বরং সুখের অশ্রু। ইসরা যেনো ঘুটঘুটে অন্ধকারে একটা জোনাকির মিটমিটে আলোর সন্ধান খোঁজে পেলো। এটাই হয়তো তাকে আর লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।
ইসরা শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা ?
হ্যাঁ মা শুনতে পেয়েছি।
খবরটা জানার পর তোর বাবা ছটফট করছে কী করে তোকে খবরটা দেবে। তোর সাথে একটু কথা বলার জন্য তড়পাচ্ছে প্রতিদিন। একটু কথা বলবি তোর বাবার সাথে ?
আমি এখন রাখছি মা।
পারভীন বেগম কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। ইসরা কিছুটা সময় চুপ করে থেকে কল কেটে দিলো। বাবার সাথে ইসরার অদৃশ্য একটা দেয়াল তৈরি হয়েছে। কিছুটা রাগ, অনেকটা অভিমান, চাপা কষ্ট আর অদ্ভুত কিছু অভিযোগ দিয়ে তৈরি এই দেয়াল। ইসরার জানা নেই কতটা সময় লাগবে এই অদৃশ্য দেয়াল ভাঙতে। কিংবা আদৌ কোনোদিন এই দেয়াল ভাঙবে কিনা জানা নেই।

ইসরার আনন্দটা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে যখন জানতে পেরেছে, সে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে গেছে। এতো বিষাদের মাঝে এটা ইসরার কাছে মেঘের অন্তরালে উঁকি দেওয়া রৌদ্র কিরণের মতো। হুর মেডিকেলে চান্স পায়নি সেটা নিয়ে কেঁদে ভাসিয়েছে। আল্লাহ সবাইকে সবদিক থেকে দেয় না হুর তার প্রমাণ। মেয়েটা দেখতে অসম্ভব সুন্দরী হলেও পড়াশোনায় ইসরার ধারে কাছেও না। ছোটবেলা থেকে হুরের রোল নাম্বার সবসময় ইসরার পরেই ছিলো৷ তাই পরীক্ষায় সবসময় ইসরার পেছনের সীটেই জায়গা হয়েছে হুরের। ইসরার হেল্প নিয়েই বরাবর ভালো রেজাল্ট করে এসেছে, তবে দুর্ভাগ্যবশত একসাথে সিট না পড়লে হুর হলে বসেই হাত-পা ছড়িয়ে কান্না করতে থাকতো। সেই দুর্ভাগ্যের একটা অংশ হিসাবে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় হুরের সিট আলাদা হলে নয় বরং আলাদা শহরেই পড়েছিলো৷

নাক টেনে হুর বললো, তোর জন্য আমি ডক্টর হতে পারলাম না ইশু।
ইসরা মলিন হেঁসে বললো, ডক্টর হলেও তুই খবু বাজে ডক্টর হতি। তারচেয়ে যেটা ভালো পারিস সেটা কর। যেটা হবি একদম পার্ফেক্ট হবি।

হুর কিছু সময় চিন্তা করে বললো, সত্যি ইয়ার ডক্টর হলে, খুব বাজে ডক্টর হতাম। শেষে দেখা যেতো রোগীর হার্টের অপারেশনের বদলে বেবি সিজারের অপারেশন করে ফেলেছি। না বাবা আমার ডক্টর হয়ে কাজ নেই। কিন্তু আমি কী করবো এখন তাহলে ?
ইসরা আনমনে বললো, বিয়ে করে সংসার কর। এই সমাজ তোদের মতো বউই খোঁজে। এই সমাজ বুঝিয়ে দেয় সংসার করার জন্য তোদের জন্ম হয়েছে পৃথিবীতে। কিন্তু আমাদের মতো মানুষদের সংসার করার স্বপ্ন দেখার অধিকার নেই ভদ্র সমাজে।

হুরের মাথায় ইসরার আনমনে বলা গম্ভীর কথাগুলো ঢুকলো না। সে সরল ভাষায় বললো, মানে বুঝলাম না।
ঘরটা নাহয় তোরাই সামলা আর বাহিরের দ্বায়িত্বটা নাহয় আমরাই নিলাম। ঘরে যে আমাদের জন্য জায়গা নেই।
তোর মোটা মোটা কথা আমার চিকন মাথায় ঢুকছে না ইশু, একটু বুঝিয়ে বলবি ?
হুরের বিরক্তি মাখা গলা শুনে মুচকি হাঁসলো ইসরা আর বললো, মামার সাথে কথা বলে দেখ কী করতে বলে। এখন রাখছি ভালো থাকিস,,, আল্লাহ হাফেজ।

কলটা কেটে ঘুরে তাকাতেই নিহানকে পেছনে দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো ইসরা। হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত এগারোটার বেশি বাজে। হুরের সাথে কথা বলতে বলতে ছাঁদে চলে এসেছে খেয়াল নেই ইসরার। রাতের অন্ধকারে আগে ভয় লাগলেও অন্ধকারকে নিজের সঙ্গী করে নিয়েছে ইসরা তাই এখন আর ভয় হয় না।
নিহান কিছু বলার আগেই ইসরা বললো, আমাকে বলা হয়েছিলো আপনি সকালে ছাঁদে আসেন সেই সময়টাতে যেনো ছাদে না আসি। কিন্তু এই সময়টার জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি।
নিহান ইসরার কথা উপেক্ষা করে বললো, আমার জীবনটা শেষ করে দিয়ে বেশ ভালোই আছো দেখছি। বোনের সাথে বেশ হেঁসে হেঁসে কথা হচ্ছিলো।

মেঘের অন্তরালে পর্ব ১+২+৩

ইসরা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বললো, আপনার জীবনটা নষ্টের জন্য আমি দায়ী নই। তার জন্য আমার বাবা দায়ী আর বাকিটা দায়ী আপনার ভাগ্য।
নিহানের ভ্রু কুঁচকে গেলো ইসরার কথা শুনে। ছাঁদের ঝলমলে কৃত্রিম আলোয় সেটা পরখ করতে অসুবিধা হলো না ইসরার।
ইসরা মুচকি হেঁসে চলে যেতে গেলে নিহান বলে উঠলো, অসম্পূর্ণ কথা আমি পছন্দ করি না। আমার ভাগ্য দায়ী মানে কী ?
সেটা বলার সঠিক সময় এখনো আসেনি মিস্টার নিহান রেজওয়ান।
কখন সেই সঠিক সময় ?

আমি চাই না, আমি চলে যাওয়ার পরও আপনার মনে আমার প্রতি কোনো রাগ থাকুক। তাই চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যতটা পারেন রাগ ঝেড়ে নিন। সময় শেষে যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে সেটা দূর করার জন্য কিছু তো প্রয়োজন তাই না। এর মানেটাই সেদিন আপনার অবশিষ্ট রাগ টুকু দূর করার উপায় হবে।
ইসরা পা বাড়ালে নিহান বললো, তোমার হাতে আর দুমাস সময় আছে।

ইসরা ঘুরে তাকিয়ে মুচকি হাঁসলো আর চলে গেলো। নিহান দাঁড়িয়ে রইলো রেলিঙে হেলান দিয়ে। ইসরা মেয়েটাকে তার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হয়। তবে ইসরাকে নিয়ে সে কোনো প্রকার বিশ্লেষণ করতে চায় না। নিজের জীবনের একটা সেকেন্ড ব্যয় করতে চায় না তার জন্য। কিন্তু একটা বিষয় নিহান চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে। সে ভেবেছিলো ইসরা এখানে নিজের জায়গা তৈরি করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। কিন্তু ইসরার মধ্যে এমন কিছুই লক্ষ্য করতে পারছে না সে। এদিকে ইসরা রুমে এসে ভাবছে তার আগামীকাল বাইরে যেতে হবে। কিন্তু এই বাড়ি থেকে তার বাইরে যাওয়া নিষেধ তাহলে কীভাবে যাবে সে ?

মেঘের অন্তরালে পর্ব ৭+৮+৯