রঙিন রোদ পর্ব ১৪

রঙিন রোদ পর্ব ১৪
নাজমুন বৃষ্টি

সকাল হতেই আহমেদ বাড়িতে শোকের ছায়া পড়লো। লুৎফর আহমেদ মাঝরাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। মুহূর্তের মধ্যে বাড়িটা আশেপাশের মানুষে ভরে গেল। সবাই মুখ চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। রুমি আহমেদ যেন পাথরে রূপ নিয়েছে। কথায় বলে না? অতি শোকে পাথর। তার সাথেও এমন হচ্ছে। কাল রাতে এক সত্যি জানার পড়ে এক রাশ ঘৃণা এসে জন্ম নিয়েছিল ভাইয়ের প্রতি অথচ এখন! তার এই পৃথিবীতে দুইজন আপনজন ছিল। শফি আর তার ভাই।

যখন শফি খুন হয়েছিল মনে করেছিল এই পৃথিবীতে তার শ্রেষ্ঠ ভাই তার সাথে আছে অথচ কাল শুনল সেই প্রিয়জনকে না কি আরেক প্রিয়জন খুন করেছে। তাও বা পাপের রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল বলে! আর এখন সেই ভাইটাও বিদায় নিল! রুমি আহমেদের বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটাও তাকে ছেড়ে বহুদূর চলে গেছে। কীভাবে বাঁচবে সে! সে যেন পাথর হয়ে আছে। চোখ দিয়ে কোনো অশ্রুই বের হচ্ছে না। শোয়া অবস্থায় নিশ্চুপ শান্ত ভাইকে সে এভাবে মানতে পারছে না। এতদিন তাকে আগলে রাখা ভাইটাও অনেক দূরে পাড়ি জমিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুমি আহমেদ মেঝেতে তার ঘুমন্ত নিশ্চুপ ভাইটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাথাটা হঠাৎ করে ভীষণ যন্ত্রনা করছে, চোখগুলো আর খুলে রাখতে পারছে না। বসা থেকে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো ঝাঁপসা দৃষ্টিতে ভাইয়ের মুখখানা দেখে নিল এরপর চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এল।

মৃত্তিকা তার বড়ো মামী আর রিনিকে কোনোমতে অল্প কিছু খাইয়ে দিয়ে এসে মা’য়ের রুমে গেল। বড়ো মামার মৃত্যু যেন মা মেনে নিতে পারছে না।
মৃত্তিকা স্যুপের বাটি নিয়ে মায়ের রুমে ঢুকতেই নার্সটা তার কাছ থেকে বাটি নিতে চাইলে মৃত্তিকা নিজে খাওয়াতে পারবে বলে ইশারা করলো।

মায়ের পাশে এগিয়ে যেতেই মৃত্তিকার চোখ ফেটে অশ্রু ঝরে পড়লো। তার মা কী নিশ্চুপ হয়ে পুবের জানালাটার বাইরের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! এক ঝটকায় রুমি আহমেদ একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার মায়ের এই পৃথিবীতে একমাত্র আপনজন বলতে এই ভাই-টাই ছিল। সেই ভাইয়ের এতো অল্প বয়সে বিদায় মেনে নিতে পারেননি তিনি যার ফলে একেবারে শুয়ে গিয়েছেন। ভাইকে শেষবারের মতো দেখতেও পেল না। ডাক্তার বলেছে, তিনি মানসিকভাবে একদম ভেঙে পড়েছেন। সুস্থ হওয়ার আশংকা একদম কম। তার পাশে সবসময় একটা নার্স থাকা জরুরি। নাহলে যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে।
মৃত্তিকা চোখ মুছে মা’য়ের পাশে বসলো। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে মা’কে ডাকলো।

রুমি আহমেদ মেয়ের ডাক শুনে জানালা থেকে আস্তে আস্তে দৃষ্টি সরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালো কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না। ডাক্তার বলেছে, তিনি কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি হয়তো বেঁচে থাকার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছেন।
মৃত্তিকা মায়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেও ভালো নেই। একের পর এক ঘটনা তার মনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সিয়ার মৃত্যু এখনো তাকে বারেবারে কাঁপিয়ে তুলে। এরপর পড়াশোনা স্থগিত। আদিবের এমন পরিবর্তন। এখন আবার বড়ো মামার বিদায়, যার মুখ দেখে এতদিন মৃত্তিকা তার বাবার কথা ভুলতো সেই মানুষটার এভাবে বিদায়টা মৃত্তিকা মেনে নিতে পারছে না তবুও উপরে সবার ভালোর জন্য নিজেকে শক্ত রাখতে হচ্ছে কিন্তু প্রতিনিয়ত সে কী পারবে!

মৃত্তিকা মা’কে খাইয়ে দিয়ে মাথার উপর হাত বুলিয়ে দিল। রুমি আহমেদ মলিন চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আস্তে আস্তে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালে মৃত্তিকা তার মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
এরপর খাবারের আরেকটা প্লেট নিয়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো।
রুমে গিয়েই দেখলো ঈশান খাটের সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। হাঁটুর উপর এক হাত রেখে মাথা নিচু করে আছে।
মৃত্তিকা নিজেকে সামলে চোখ মুছে ঈশানের দিকে এগিয়ে গেল।
-‘ঈশান ভাই?’

মৃত্তিকার ডাকে ঈশান তার দিকে মাথা তুলে তাকাল। চোখদুটো ভীষণ লাল হয়ত কেঁদেছে। মৃত্তিকা তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিল। এই মানুষটাকে কষ্ট পেতে দেখলে তার নিজেরই যে ভেতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যায়।
-‘সেই সকাল থেকে তো কিছুই খাননি। অল্প কিছু খেয়ে নিন।’
-‘বাবা’কে ছাড়া আমি নিজেকে এক মুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না। কেন এতো তাড়া ছিল উনার!’

মৃত্তিকা কিছু বলতে পারলো না। তার নিজেরও যে প্রচন্ড খারাপ লাগছে, কাকে বুঝাবে সে! একের পর এক তার প্ৰিয় দুইটা মানুষ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ভেতরটা তার ফেটে যাচ্ছে কিন্তু কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। এই মুহূর্তে ঈশান ভাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা সে পাচ্ছে না। সে একটা মলিন শ্বাস ফেলে ঈশান ভাইয়ের কাঁধে আলতো করে ডান হাতটা রাখতেই ঈশান মৃত্তিকাকে ঝাপ্টে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।

ঈশান মৃত্তিকার কাঁধে মুখ গুঁজে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। মৃত্তিকারও এতক্ষন যে কান্নাগুলো আটকে রেখেছিল তা সব বেরিয়ে এলো। এই বাসাটা হয়ত কেউ বড়ো মামাকে ছাড়া কল্পনাও করেনি অথচ আজ সেই দিন দেখতে হচ্ছে। বাসাটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে এক সপ্তাহের ভেতর।

দেখতে দেখতে আরও কয়েকদিন কেটে গেল। মেডিকেলটা আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ’ভাবে উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তাদের হাতে করতলগত হয়েছে। ঈশান সেদিকে আর খেয়াল দেয়নি।
মৃত্তিকা’র কাছে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই। ঈশান হয়ত কিছুটা হলেও জানে কিন্তু বলছে না। নাহলে এতো বড়ো মেডিকেলটা অন্যরা ভেঙে জায়গা দখলে নিয়ে নিয়েছে তবুও ঈশান সেদিকে কেন ভাবনা দিল না! এই ব্যাপারটা মৃত্তিকাকে বারেবারে ভাবাই কিন্তু তবুও সে মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করে না। মানুষটা সবে মাত্র একটা শোক কাটিয়ে উঠেছে তার উপর এই কয়েকদিনে মৃত্তিকা মানুষটাকে প্রচন্ড-রকম ভালোবেসে ফেলেছে।

আস্তে আস্তে রুমি আহমেদের শরীরের অবনতি হচ্ছে। শহরের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারকে দেখিয়েও লাভ হলো না। ডাক্তার’রা বলল,’যদিও আশা করা যায় না তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা শারীরিক-ভাবে উনাকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করছি কিন্তু উনি মানসিক-ভাবে ভেঙে পড়েছেন অনেক আগেই। উনি উনার মনের কষ্টগুলো কাউকে বলতে না পেরে চিন্তায় আরও ভেঙে পড়ছেন। উনি বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছে। যার ফলে উনাকে বাঁচানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে তবুও আমরা চেষ্টা করছি। এইবার বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’

মৃত্তিকা ভীষণ করে ভেঙে পড়েছে। সে এসব আর মানতে পারছে না। এই পৃথিবীতে তার ভালোবাসার মানুষ খুব সীমিত। সেই সীমিত থেকেও বারেবারে সবার বিদায় নেওয়া সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। এই মা চলে গেলে সে কীই-বা নিয়ে বাঁচবে!
রিনির অনেক আগে থেকে দেশের বাইরে পড়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু পরিবারের এই পরিস্তিতিতে সে ইচ্ছে-টাকে জলাঞ্জলি দিয়েছিল। ঠিক সেসময় ঈশান রিনিকে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিল রিনিকে। সে চায়না, তার জন্য তার একমাত্র আদরের বোনটার ইচ্ছেটা পূরণ না হোক। রিনিকে একা যাওয়ার অনুমতি দিলেন না আমেনা রহমান। তার এক কথা, সে এই মেয়েটাকে একা ছাড়বে না। যেতে হলে সেও মেয়ের সাথে চলে যাবে। ঈশানও রিনির সাথে মায়ের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল।রিনিও বাধ্য মেয়ের মতো সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মা’কে নিয়ে সুদূর বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। ঈশান’ও চায় সে এদেশ খুব তাড়াতাড়ি ছাড়বে। মৃত্তিকাকে নিয়ে বহুদূর পাড়ি দিবে। যেখানে সে আর মৃত্তিকা ছাড়া আর কেউ থাকবে না।

মৃত্তিকা এখন সারাদিন মায়ের পাশে বসে মায়ের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রাতে ঘুমায়ও না। খাবারের ঠিক নেই। ঈশান সময়ে সময়ে গিয়ে কোনোমতে জোর করে অল্প কিছু খাইয়ে দেয়। তারও মাথার উপর ভারী চিন্তা। মেয়েটার চোখ-মুখ দুইদিনের ভেতর কোটরে ঢুকে গিয়েছে। চেহারা শুকিয়ে কাঠ। চোখের নিচে কালো দাগ বসে গেছে। ঠিকমত চুল আচড়ায় না। ঈশান সারাদিন এখানে ওখানে দৌড়ে রাতে বাসায় ফিরে।

ক্রান্তিতে চোখ বুজে যায় তবুও সে মুখের উপর পানির ঝাপটা দিয়ে ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা টেনে মৃত্তিকার চুল আচড়িয়ে দেয়, তার যত্ন করে। মৃত্তিকা মলিন চোখে ঈশানের দিকে তাকিয়ে হাসে। সারাদিন ঈশান এতো ব্যস্ততা শেষে রাতে যখন মৃত্তিকাকে কাছে টেনে বুঁকের ভেতর জড়িয়ে ধরে তখন তার সব ক্রান্তি মুহূতের মধ্যে উবে যায়। এটাই তো তার প্রশান্তি! এই মেয়েটার মধ্যেই তার সব শান্তি নিহিত। ঈশানের ভীষণ খারাপ লাগে। কেন এতো পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে পরিবারটা!

রঙিন রোদ পর্ব ১৩

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। রি-চেক দেওয়া হয়নি। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। গল্পের সাথে বাস্তবতা মিলাবেন না দয়া করে। )

রঙিন রোদ শেষ পর্ব