রঙিন রোদ পর্ব ১৩

রঙিন রোদ পর্ব ১৩
নাজমুন বৃষ্টি

রাতে মৃত্তিকা তার মা’কে খাওয়ার উদ্দেশ্যে ডাকতে রুমের সামনে গিয়েই দেখল ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। মৃত্তিকা কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মা তো দরজা বন্ধ করেন না, আজ হঠাৎ কী হলো! সে দুয়েকবার ডাকলো কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেল না। হঠাৎ মনের ভেতর ভয় এসে বাধা বাঁধলো। মৃত্তিকা কাঁপা কাঁপা সরে ডেকে আবার দরজা ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে ভরাট কণ্ঠে আওয়াজ আসলো,

-‘খাবো না।’
মৃত্তিকা কিছুক্ষন দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মা হঠাৎ এমন ভরাট কণ্ঠে কেন কথা বলছে! মনে হচ্ছে যেন কান্না করছে কিন্তু কেনই বা কান্না করবে। মৃত্তিকা আরও কয়েকবার ডেকে কোনো সাড়া না পেয়ে রুমে এসে গেল। তার মায়ের মাঝে মাঝেই এমন হয় আবার সকালে ঠিক হয়ে যায়। হয়ত বাবার কথা ভীষণ মনে পড়েছে তাই আর না ডাকা-ই শ্রেয় মনে করে সে ফিরে আসলো।
মৃত্তিকা রুমে এসে খাটে শোবার পরেও অনেকক্ষন ঘুম এলো না মায়ের চিন্তায়। ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই তার মনে হলো, কেউ একজন খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে আছে আর তার চোখে-মুখে উপচে পড়া ছোট ছোট চুলগুলো খুব যত্ন সহকারে কানের পিছনে গুঁজে দিচ্ছে।
মৃত্তিকা অনেকক্ষণ চোখ খুলতে চেয়েও ঘুমের জন্য পারলো না। এক পর্যায়ে জোর করে চোখ গুলো টেনে খুলতেই দেখলো সারারুম জুড়ে রাতের নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে। তাহলে এতক্ষন এটা কী ভ্রম ছিল!

হঠাৎ ব্যালকনির দিকে চোখ যেতেই দেখলো পর্দার উপারে কেউ একজনের আবছা ছায়া। মৃত্তিকা প্রথমে ভয়ে গুটিয়ে গেলেও পরে ভয়কে আড়ালে ঢেকে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো। ততক্ষনে ছায়াটা মিলিয়ে গিয়েছে। ব্যালকনির ওখানে গিয়ে ভয়ে ভয়ে পর্দা সরাতেই কাওকে দেখল না। মাত্রই তো মনে হয়েছিল কেউ একজন এখানে আছে কিন্তু এসেই কেউ নেই! এটা কিভাবে সম্ভব! হঠাৎ ব্যালকনিতে চোখ যেতেই দেখলো, ব্যালকনির কাঁচটা খোলা। এটা কে খুলবে! মৃত্তিকা প্রাচীর দিয়ে নিচের দিকে তাকানোর পরও কাউকে দেখতে না পেয়ে রুমে এসে গেল।

খাটে এসে শুতেই আর ঘুম এলো না। সে কিছুক্ষন হাটাহাটি করতেই রুমের দরজায় আওয়াজ হলো। এতো রাতে কেই বা দরজা ধাক্কাবে! বাসার কারো কিছু হলো না তো! মৃত্তিকা দরজা খুলতেই সামনের আগন্তুকটাকে দেখে থমকে গেল। এটা কী আধো ভ্রম না-কি সত্যি! কতদিন পর মানুষটাকে দেখলো। মানুষটার দৃষ্টি অগোছালো। তার দৃষ্টিতে কী যেন একটা ছিল! অস্তিরতায় ভরা সেই দৃষ্টি। মৃত্তিকা আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না। সে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেলল। এই চোখের দিকে তাকালে তার দুনিয়া উলোটপালোট হয়ে যায়। মৃত্তিকার বক্ষপিঞ্জরের হৃদপিন্ডটা ধপধপ করছে।

-‘কেমন আছিস মৃত্তি?’
মানুষটার শীতল দৃষ্টি দিয়ে এক বাক্যের কথাটা কানে যেতেই মৃত্তিকার মন শীতলতায় ছেয়ে গেল। সে তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিতে পারলো না।
-‘বলছিস না যে!’
-‘আপনি…? কোথায় ছিলেন এতদিন!’ কথাটা বলতে গিয়ে মৃত্তিকার ঠোঁট কেঁপে উঠল। বুঝতে পারলো, মানুষটার উপর ভীষণ-রকম অভিমান জন্মেছে। দূরে থেকেও বুঝি ভালোবাসা হয়!

মৃত্তিকার এমন অভিমান-ভরা কণ্ঠস্বর শুনে ঈশানের অস্থির দৃষ্টি’গুলো হঠাৎ করে হাসি হাসি হয়ে ঠোঁটের কোনায় আপনা-আপনি মুচকি হাসি এসে ভর করলো। সে হেসে এগিয়ে মৃত্তিকার গালে হাত রাখতেই মৃত্তিকা উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঈশান তা দেখে তার প্রিয়তমাকে এক হাতে জড়িয়ে নিল। মৃত্তিকাও বিড়াল ছানার মতো একদম গুটিসুটি হয়ে ঈশানের বক্ষপিঞ্জরে গুঁজে রইল।

আজ অনেকদিন পর রুমি আহমেদের মনে আগের স্মৃতিগুলো হানা দিচ্ছে। তার সাথে শফিকের প্রথম থেকে শুরু সবকিছুই আবার নতুন করে মনে পড়ছে। তার সাথে শফিকের প্রথম দেখা এরপর প্রণয়, লজ্জা পাওয়া সব মিলিয়ে কী রঙিন স্মৃতি! কিভাবে ভুলবে সে মানুষটাকে!
রুমি আহমেদের চোখের সামনেই হানা দিল সেই বিশ বছর আগের ডাইরির রঙিন পাতাগুলো।

তখন সবে মাত্র সদ্য কিশোরীতে পা দিয়েছে রুমি আহমেদ। ফুটফুটে মেয়ে ছিল। সম্পূর্ণ বাসা মাথায় তুলতো তার চঞ্চলতায়। বাবা ছিল না। দুই ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে কোনোমতেই টানাপোড়োনে সংসারটা চালিয়ে নিতো তাদের মা রাশিদা বেগম। একমাত্র মা’টার উপরও একদিন অসুস্থতা ভর করলো। বাসায় যা অর্থ ছিল সব শেষের পথে। দিন যতই যায় ততই অসহায় হয়ে পড়ে তারা। সাহায্য চেয়েও ব্যর্থ হয়। কেউই এগিয়ে আসে না।

একদিন লুৎফর আহমেদ মাঝপথে পড়াশোনা রেখে সম্পূর্ণ বাসার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নেয়। কেমন করে সে সংসার চালাতো বলা যায় না। আস্তে আস্তে সুখের সংসার গড়ে উঠছিল। সদ্য কিশোরী বয়সে পা রাখা চঞ্চল রুমি সংসারের কাজ’গুলো এক হাতে সামলে নিয়েছিল। মা সারাদিন বিছানায় শুয়ে-বসে দিন কাটাতো। লুৎফর আহমেদ খুব সুন্দরভাবে সংসারটা সাজিয়ে তুলেছিল। এর কয়েকমাসের মধ্যে হঠাৎ করেই তাদের সংসারটা আরও সুন্দর হয়ে উঠল। কোনো কিছুর কমতি নেই। বিরাট বিরাট দালান বানালো লুৎফর আহমেদ। ছোট দুই ভাই-বোনকে খুব ভালোভাবেই পড়াশোনা করিয়ে বড়ো করে তুলছিল।

আগে লুৎফর আহমেদের কাছ থেকে ছোট দুই ভাই-বোন কোনো আবদার ধরলে তার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠতো অথচ এখন আর চিন্তার রেখা ফুটে উঠে না। ওরা খোঁজার আগেই সব হাসিমুখে তাদের সামনে এনে দিতো লুৎফর আহমেদ। আস্তে আস্তে গাড়ি-বাড়ি সব হলো। তার ভাইয়ের অনেক বড়ো ব্যবসা হলো। তার সামনে পিছে অনেক মানুষ ঘুরে। তেমনি একদিন ভাইয়ের সুবাদে দেখা হয়ে গেল শফিকের সাথে। সেদিন চঞ্চল কিশোরী গুনগুন করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল। সেসময় শফি লুৎফর আহমেদের অপেক্ষায় সোফায় বসেছিল। দু’জনের প্রথমবারের মতো দেখা।

লুৎফর আহমদের সাথে কাজের সুবাদে শফিক আহমেদ সবসময় রুমিদের বাসায় আসা-যাওয়া করতো। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে দৃষ্টি বিনিময় তারপর প্রণয়। সব মিলিয়ে দিন ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন শফিক আহমেদের আসা বন্ধ হয়ে যায় কারণ হচ্ছে লুৎফর আহমেদ রুমি-শফির বিষয়টা খেয়াল করতে পেরেছিল যার ফলে তিনি শফিককে বাসায় আসতে নিষেধ করেন কিন্তু চঞ্চল রুমি তো তা মানতে চায় না। লুৎফর আহমেদের এমন কড়া নিষেধাজ্ঞা শুনে শফি আর বাসায় আসার সাহস পায় না আর তাদের এমন প্রণয়ে লুৎফর আহমেদের এমন চিন্তা-ধারা দেখে ভবিষ্যতের কথা ভেবে সম্পর্কটা শেষ করে দেয়।

তারপর চঞ্চল রুমি একদিন হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। লুৎফর আহমেদ তার একমাত্র বোনকে এমন রূপে দেখতে পারেনি। তিনি খেয়াল করলো তার বোন আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে যাচ্ছে, এক রুমে নিজেকে আবদ্ধ করে নিয়েছে। এসবকিছুর পেছনে কী আছে তা লুৎফর আহমেদ খেয়াল করে শফিককে একদিন হুট্ করে বাসায় ডেকে এনে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এরপর পরই রুমি আহমেদের মুখে হাসি ফুটে উঠে।

মূলত শফিক আহমেদ ছিল একজন এতিম তাই লুৎফর আহমেদ তার আদরের বোনটাকে এর হাতে তুলে দিতে চায়নি কিন্তু শেষপর্যন্ত বোনের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো।

এরপর পরই তাদের বিয়ে। সুখেই চলছিল সব। মৃত্তিকা হওয়ার দুইমাসের মাথায় শফিক আহমেদকে সবসময় চিন্তাগ্রস্থ দেখা যেত, রুমি আহমেদ কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলতো না। হঠাৎ মৃত্তিকার তিন মাসের মাথায় খবর এলো শফি খুন হয়েছে। খবরটা তার একমাত্র আদরের বড়ো ভাই’ই এনেছিল তার সাথে শফিকের হাতের রক্তমাখা ঘড়ি আরও অন্যান্য জিনিস। এতে রুমি আহমেদের বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না।

এরপর রুমি আহমেদ একমাত্র মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আর শফিকের স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়।
তিনি ভেবেছিলেন, তার সাথে আর কেউ না থাকলেও তার একমাত্র বড়ো ভাই লুৎফর আহমেদ আছে কিন্তু এতদিন পর সে এটা কী শুনলো! তাও বা তার বড়ো ভাই! কীভাবে করতে পারলো তার ভাই এই কাজটা! সে তো জানতো, রুমি আহমেদ শফিকে কতটা ভালোবাসে! কীভাবে পারলো খুন করতে! রুমি আহমেদ যেন পাথর হয়ে গিয়েছেন।

রুমি আহমেদ তখন লুৎফর আহমেদের কাছ থেকে বাকি কথাগুলো না শুনে রুম থেকে দ্রুতপদে বেরিয়ে এসেছিল যার ফলে পেছনে লুৎফর আহমেদ অস্পষ্ট সুরে রুমি আহমেদকে আরও কিছু বলতে চেয়েছিলেন সেগুলো আর শুনেননি। তিনি তার একমাত্র বোনকে হয়ত বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন ভেবে বোনকে সামলাতে শোয়া থেকে উঠার চেষ্টা করতেই মেঝেতে পড়ে গেলেন। রুমি আহমেদ অতদিকে খেয়াল না দিয়ে সোজা রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

রঙিন রোদ পর্ব ১২

কিন্তু কেনই বা খুন করলো সেটাই আর শোনা হয়নি। কাল সকালেই তিনি তার ভাইয়ের কাছ থেকে সব শুনবে। কেন তার প্রাণ প্ৰিয় স্বামীকে সে খুন করেছে! তার কী হাতও কাঁপলো না! এতদিন এই ভাইকে সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে ভেবে এসেছিল অথচ আজ সব মিথ্যে! তার ভাই একটা খুনি!

রঙিন রোদ পর্ব ১৪