অন্তর্হিত কালকূট গল্পের লিংক || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

প্রচন্ড ভয় নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে এককোণে বসে আছে শায়লা। খানিক বাদে বাদে চোরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে সোফায় পায়ে পা তুলে বসে থাকা সুঠাম দেহি পুরুষের দিকে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে তার। হিম-শীতল রাত্রিতেও কপাল বেয়ে নামছে সরু ঘামের স্রোত। মেয়েটার হাত-পা যে বাঁধা আছে তা কিন্তু নয়। কিন্তু সামনে থাকা ব্যক্তির হাতে থাকা পিস্তল আর চোখের কঠিন দৃষ্টি তাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে, বিন্দুমাত্র নড়লেই গুলি তোমার শরীর ছেদ করবে।

স্বামীর অপেক্ষা করতে করতে সবে কিছুটা তন্দ্রা ভাব এসেছিল শায়লার চোখে। এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ। ঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটা। স্বামী এসেছে ভেবে শাড়ি ঠিক করে দ্রুত দরজা খোলার উদ্দেশ্যে ছুটলো শায়লা। দরজা খুলতে দেরী হলেই হয়তো গালে আজও শক্ত হাতের ভয়ানক থাপ্পড় পড়বে। মাতাল হয়েই এসেছে তা-তো নিশ্চিত। সে ছাড়া আর কেউ আসেনা এই ফ্ল্যাটে। সপ্তাহে দু-একবারই আসে। সেই দু-এক রাতই বড্ড নরকীয় মনে হয় শায়লার। কারণ মাতাল অবস্থায় এসে মারধর করা আর নিজের দৈহিক চাহিদা মেটানো ব্যতীত বিশেষ কিছুই করেনা তার স্বামী। স্বামী সোহাগ নামক ব্যপারটার সাথে পরিচিত নয় সে। কিন্তু ডোর হোল দিয়ে চেক করে দেখল তার স্বামী নয় বরং অন্য কেউ। শায়লা কাঁপাকাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ কে?’
দরজার ওপাশ দেখে কেউ বলে উঠল,
‘ আপনার স্বামীর গুলি লেগেছে, গুরুতর আহত। দরজা খুলুন দ্রুত!’
এমন কথা শুনে কিছু ভাবার আর পরিস্থিতি রইল না শায়লার। কিছু চিন্তা না করেই দরজা খুলে ফেলল মেয়েটি। খুলে দেখল সুঠাম দেহি এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। পড়নের পোশাক দেখে মনে হচ্ছে কয়েকদিন যাবত এক পোশাকেই ঘুরছে। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে শায়লা দ্রুত আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
‘ ক-কোথায় উনি?’
আগন্তুক কিছু না বলে শায়লাকে ঠেলে সোজা ভেতরে চলে এলো। মেয়েটা চিৎকার করার আগেই আগন্তুক তার মুখ চেপে ধরে গলায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল,

‘বাঁচতে চাইলে একদম চুপ করে থাকুন। আমি আপনার কোন ক্ষতি করতে আসিনি। আমি এখন ঠিক যা যা বলব ভদ্রভাবে ঠিক তাই তাই করবেন। আপনার কিছু হবেনা। কিন্তু ততক্ষণ যতক্ষণ আপনি আমার কথা শুনবেন। শুনবেন তো?’
গলায় পিস্তল ঠেকাতেই শায়লার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেছে। প্রাণের ভয়ে দ্রুত হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল সে। আগন্তুক ওকে নিচে বসিয়ে দিয়ে নিজে সোফায় বসল। শায়লার ফোনটাও নিজের দখলে নিয়ে নিল। আর শায়লাকে কড়া নির্দেশ দিয়ে দিল একটা শব্দও না করার জন্যে। প্রাণের ভয়ে আধঘন্টা যাবত সেই আদেশেরই পালন করে চলেছে মেয়েটা।

লিফ্টের দরজা খুলতেই পিটপিটে চোখে একবার বাইরে তাকিয়ে বেরিয়ে এলো সাজ্জাদ। আজকে নিজের তিন নম্বর বউয়ের কাছে আসার তেমন ইচ্ছে ছিলোনা। কিন্তু রাতে ভরপেট মদ গেলার পর যে মেয়েটার সাথে রাত কাটানোর কথা ছিল সে শেষ মুহূর্তে আসতে পারবেনা বলে দিয়েছে। এতো রাতে কোন কলগার্ল পাবেনা আর। আগে থেকে বলে না রাখলে পাওয়া মুশকিল। তাই সেই প্রয়োজন মেটাতেই আজ বউয়ের কাছে আসা। তাইতো আসার আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে, সে আসছে। ফিরে আসতে আসতে নিজের মনে সেই কল গার্লকে অকথ্য ভাষায় কিছু গালিও দিয়েছে। পা দুটো মৃদু টলছে সাজ্জাদের। টলমলে পায়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে নিজের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে গিয়ে কলিংবেল চাপল। সে নিজেও জানেনা আজ এখানে আসাটা তার জীবনের কতবড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এই ভুলের জন্যে হয়তো আফসোস করারও অবকাশটুকু পাবেনা সে।

দ্বিতীয় কলিং বেলের আওয়াজে চমকে উঠল শায়লা। আগন্তুকের এতক্ষণ স্হির চোখদুটো চঞ্চল হয়ে উঠল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল হালকা বাঁকা হাসি। শিকার এসে গেছে তাহলে? শায়লা তার দিকে তাকাতেই সে তর্জনী আঙুল ঠোঁটে ঠেকিয়ে চুপ থাকার ইশারা করল। এরপর সে উঠে গিয়ে শায়লার সামনে ডান হাঁটু ভেঙ্গে বসে চাপা আওয়াজে বলল,
‘ একদম চালাকি করার চেষ্টাও করবেন না। তাহলে দুজনেই মরবেন। দরজা খুলে দিন।’

শায়লা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুধু। আরও একবার বেল বাজতেই যুবক উঠে গিয়ে দরজার পাশে দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে চোখের ইশারায় শায়লাকে আদেশ করল দরজাটা খোলার জন্যে। শায়লা একটা ঢোক গিলে উঠে দরজার কাছে গিয়ে কাঁপাকাঁপা হাতে দরজাটা খুলে দিল। দরজা খুলতেই সাজ্জাদ জঘন্য ভাষায় কয়েকটা গালি দিতে দিতে ভেতরে ঢুকে বলল,
‘ কোন নাগর ঢুকাইছিস ঘরে? খুলতে এতো দেরী হল কেন?’

শায়লা ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ‘কথা বলস না কেন?’ বলে সাজ্জাদ রেগে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে যেই চড়টা মারবে বলে হাত তোলে তখনই দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হয়। সে শব্দ শুনে সাজ্জাদ পেছনে তাকিয়ে দেখে এক সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে দরজায় হেলান দিয়ে। লোকটাকে চিনতে না পেরে ভ্র কুঁচকে শায়লার দিকে তাকিয়ে রাগে জ্বলে উঠল সাজ্জাদ। সত্যিই তাহলে নাগর জুটিয়ে রেখেছে? তেড়ে গিয়ে শায়লার চুলের মুঠি ধরল সে। শায়লা ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল। সাজ্জাদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ শালী! শরীরে এতো জ্বালা তোর? আমি আসিনা বলে ঘরে ব্যাটামানুষ এনে ঢুকাইছিস? এতো সাহস?’
‘ ওনাকে ছাড়।’

ঠান্ডা গলায় কথাটা শুনে তীব্র ক্রোধে আগন্তুকের দিকে তাকাল সাজ্জাদ। কিন্তু তাকিয়ে থমকে গেল সে। নেশা কেটে গেল নিমেষেই। যুবকের হাতে পিস্তল দেখেই যা বোঝার বুঝে গেল সাজ্জাদ। দ্রুত পেছন থেকে পিস্তল বের করতেই একটা ফ্লাওয়ার ভাস ছুড়ে মারল যুবক সাজ্জাদের হাতে। পিস্তল পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে যুবক দ্রুত এগিয়ে সেটা তুলে নিজের অধিনস্ত করে নিল। সাজ্জাদ তেড়ে আসতে নিলেই আগন্তুক পিস্তলের পিছন দিক দিয়ে ওর কানে তীব্র আঘাত করল। কান ধরে আর্তনাদ করে বসে পড়ল সে। সাজ্জাদের পিস্তলের ম্যাগাজিনটা রিলিজ করে সাইডে ফেলে দিল সে। সাজ্জাদের কান বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। যুবকটি এগিয়ে গিয়ে কলার ধরে তুলে দাঁড় করাল তাকে। শায়লার উদ্দেশ্যে বলল,

‘ খুন সহ্য না হলে ভেতরের রুমে চলে যান।’
শায়লা এক মুহূর্তও দেরী না করে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। আপনি বাঁচলে তবেই তো বাপের নাম। এদিকে ‘খুন’ শুনেই রক্ত হিম হয়ে গেছে সাজ্জাদের। ওর পিস্তল নেই, এমন সুঠাম দেহি যুবকের সাথে খালি হাতে পারবেনা। মৃত্যু নিশ্চিত! আগন্তুক সাজ্জাদকে সোফায় ধাক্কা দিয়ে ফেলতেই সাজ্জাদ কাঁপা গলায় বলল,
‘ ক-কে আপনি? আমা- আমাকে মেরে আপনার কী ল-লাভ?’
আগন্তুক সাজ্জাদের পাশ দিয়ে সোফার ওপর বা পা রেখে বলল,

‘ নাম শুনলে ঠিক চিনবি। আমার নামটা মুখস্হ আছে তোর। সেটা বড় কথা না। বড় কথা হল তোকে মেরে আমার কী লাভ? কোন লাভ নেই। আমি তোকে মারতেও চাইছিনা। শুধু একটা প্রশ্ন করব। উত্তর দিয়ে দিলে আমি তোকে মারব না।’
‘ কী প্র-প্রশ্ন?’
সাজ্জাদের কথা শুনে আগন্তুক নির্বিকারভাবে পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনটা সাজ্জাদের মুখের সামনে তুলে ধরে বলল,
‘ কোথায় আছে ও?’
সাজ্জাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মোবাইলের স্ক্রিনে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘ আমি জানিনা।’

অচেনা যুবক কৃত্রিম হাসল। যদিও এখন তার মুখের ঐ হাসিটুকু কৃত্রিম-ই হয়। হেসে আবার পিস্তলের পেছন দিয়ে ঠোঁটের ওপর দিয়ে আঘাত করল। ব্যাথায় আবারও চেঁচিয়ে উঠল মাতাল সাজ্জাদ। ঠোঁট দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। এমনিই মাতাল ছিল। এমন মার খেয়ে মাথা নুইয়ে পড়ল তার। আগন্তুক পিস্তলটা ওর গলায় লাগিয়ে মাথা তুলে ধরে বলল,
‘ এতো ওয়াফাদারী ভালো না। প্রয়োজনে তোকে সরিয়ে ফেলতে ওরা দু-বারও ভাববে না। অথচ তুই ওদের জন্যে আমার হাতে নিজের প্রাণ দিবি? বোকামো হবে না?’

সাজ্জাদ ক্লান্ত চোখে তাকাল অচেনা এই যুবকের দিকে। যুবক এবার মাথা ঝাঁকালো। অর্থাৎ সে বুঝে গেছে সাজ্জাদ বলবে না। পিস্তলটা লোড করে সাজ্জাদের দিকে তাক করতেই সাজ্জাদ বলে উঠল,
‘ দুবাই, দু-বাই চলে গেছে। এখন দুবাইতেই আছে।’
‘ দুবাই এর কোথায়?’
‘ তা জানিনা।’
ছেলেটা মাথায় পিস্তল ঠেসে ধরতেই সাজ্জাদ ব্যথা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
‘ সত্যিই জানিনা আমি। বিশ্বাস করেন।’

লোকটা মিথ্যা বলছেনা সেটা নিশ্চিত আগন্তুক। কিছু একটা ভেবে সে সাজ্জাদকে বলল,
‘ এখানকার মেইন ডেরা কোথায়? যেখানে ও নিয়মিত যোগাযোগ রাখে?’
‘ ল-লক্ষ্মীবাজার।’
নাক-কান চেপে ব্যথা সহ্য করে বলল সে। সাজ্জাদকে দিয়ে নিজের মোবাইলে এড্রেসটা টাইপ করিয়ে নিল আগন্তুক। শীতেও ঘামে ভিজে প্রায় স্নান করে ফেলেছে সাজ্জাদ। তার সাথে সারা মুখে শরীরে বেয়ে পড়া রক্ততো আছেই।

হঠাৎ গুলি চলার আওয়াজে কেঁপে উঠল শায়লা। পাশের রুমের মারধরের আওয়াজ এক কোণে গুটিয়ে বসে শুনছিল সে। ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা তার এখন। গুলির আওয়াজে আর বসতে পারল না। দৌড়ে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল ওর স্বামীর মৃত শরীর সোফায় হেলান দেওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। চোখ দুটো খোলা স্হির, কপালের ঠিক মাঝ বরাবর গুলির গভীর ক্ষত। সোফা রক্তে ভিজে গেছে। চিৎকার করার শক্তিও হারিয়ে ফেলল শায়লা। স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আগন্তুক তাকিয়ে শায়লাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে বলল,

‘ কোন কষ্ট পায়নি। সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ! কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই চাননা আপনার সাত বছর বয়সী ছেলে যে এখন নিজের নানীর কাছে আছে, সেও এভাবে মরুক? শুনেছি রোজ স্কুলে যায়, না?’
আঁতকে উঠল শায়লা। কিছু বলার আগেই সেই যুবক তাকে থামিয়ে বলল,
‘ মারব না। কিন্তু আমার চেহারাটা আপনার একটুও মনে নেই। আর যদি ভুল করেও মনে পড়ে তো নিজের ছেলেকে ভুলে যেতে হবে। মনে থাকবে?’

শায়লা বুদ্ধিমতি। এই আচেনা পুরুষ ঠিক কী বলতে চাইছে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি তার। মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল শুধু। আগন্তুক মৃদ্যু হেসে প্রস্হান করল ঐ জায়গা থেকে। সে জানে শায়লা একান্তই বাধ্য না হলে পুলিশকে ওর ব্যপারে কিচ্ছু বলবেনা। এই নরপশুর মৃত্যুতে স্ত্রীর বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। বরং সে খুশিই হয়েছে। এখন দ্রুত এই জায়গাটা ছাড়তে হবে। লোকজন চলে আসার আগেই। তার এখন অনেক কাজ বাকি। শেষ কাজ।

শায়লা স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বামীর মৃত শরীরে দিকে। চোখ বন্ধ করে অশ্রু বিসর্জন দিল সে। কষ্টের নয় মুক্তির কান্না এটা। দিন-রাত এই পিশাচের মৃত্যু কামনা করে গেছে এতোদিন। আজ অবশেষে মুক্তি মিলল। সাজ্জাদের জন্যে যমদূত ওর জন্যে দেবদূত হয়ে এসেছে যেন। কিন্তু কে এই আগন্তুক? প্রচন্ড বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। সুদর্শন ঐ মুখটাও ছিল অনুভূতিহীন। লালচে চোখ আর এলোমেলোভাবে সদ্য গজানো খোঁচা দাড়ি স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল তার নির্ঘুম রাতের কথা। অনুভূতিহীন মুখটার পেছনে যেনো লুকিয়ে আছে তার বিধ্বস্ত হওয়ার গল্প। এক লোমহর্ষক গল্প।

কান থেকে টেলিফোনটা নামিয়ে রাগে গজগজ করতে লাগল ইন্সপেক্টর আজিজ রহমান। একটা কেস নিয়ে তৃতীয়বার কমিশনারের ঝাড়ি খেয়ে রাগে, অপমানে কান লাল হয়ে উঠেছে তার। তার ক্যারিয়ারে কোন কেস নিয়ে এতো নাকানি চুবানি খেতে হয়নি তাকে। তবে একজন খাইয়েছে। বেশ ভালোভাবেই খাইয়েছে। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে টেলিফোনটা তুলে নিয়ে এসআই কে ডেকে পাঠাল তার রুমে। এরমধ্যেই পিওন এসে চায়ের কাপ রেখে দিয়ে গেল টেবিলে। বিরক্তিতে অস্হির হয়ে চায়ের চাপটা তুলে নিলো আজিজ। চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিতে দিতে এসআই ফারুক চলে এলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ মে আই কাম ইন স্যার?’
আজিজ চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,
‘ আসুন।’
মাথা নিচু করে ভেতরে এলো ফারুক। ইন্সপেক্টর চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বললেন,
‘ কমিশনার সাহেবে ফোন করেছিলেন। কাল বনানীতে নাকি আরেকটা খুন হয়েছে। ওটা আমাদের এরিয়া না। কিন্তু তারই বিভাগের আলাদা আলাদা জায়গাতে দেখতে দেখতে ছয়টা খুন হয়ে গেল। অথচ কোন সমাধান নেই। এই নিয়েই বেশ চাপে আছেন। আমার এখানের তিনটা কেস এখনো ঝুলে আছে। আর তাই রিল্যাক্স হতে আমায় ঝেড়ে দিলো। তবে এখন মনে হচ্ছে আমরা শান্তি পাব।’
ফারুক একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ কীভাবে স্যার?’
ইন্সপেক্টর চায়ের কাপটা রেখে একটু হেসে বলল,
‘ বুঝলে না? খুনগুলো খুব মিস্ট্রিরিয়াস। যেটুকু তথ্য আমরা পাঠাতে পেরেছি তাতে বোঝা যাচ্ছে গভীর কোন ষড়যন্ত্র আছে এর মধ্যে। খুব গভীর!’
ফারুক কৌতূহলী চোখে বলল,
‘ তবে কী এবার গোয়েন্দা বিভাগ থেকে দেখবে কেসটা?’
ইন্সপেক্টর আজিজ চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছু ভাবতে ভাবতে বলল,
‘ দেখা যাক।’

উত্তরার এক ফ্ল্যাটের দরজায় বারবার বেল বাজিয়ে যাচ্ছে ইরা। রাগে-দুঃখে মাথা ধরে আসার জোগাড় হয়েছে তার। ধরারই কথা। ফ্লাটের ভেতরে থাকা ব্যক্তিকে কাঁচাই চিবিয়ে খাবে আজ ও। সবকিছুর একটা সীমা থাকে। লোকটা সব সীমা অতিক্রম করে ফেলছে দিনদিন।

বেশ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল তুহিন। কাল অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিল সে। আসলে অনেকদিন যাবত লেগে থাকার পরেই অবশেষে কালকে একটা ক্রিটিক্যাল কেস সলভ হয়েছে। সেই খুশিতে বন্ধুদের নিয়ে ক্লাবে চলে গিয়েছিল, হাল্কা ড্রিংক ও করেছে। অনেকদিন পর খাওয়াতে অল্পেই অবস্থা বেগতিক। ফ্ল্যাটে এসেই সাথেসাথেই লুটিয়ে পড়েছে বিছানায়। ঘুমের ঘোরে কলিং বেলের আওয়াজকে ওর কাছে জেনারেলের কড়া নির্দেশনার মতো লাগছে। একগাদা কাজের ভার চাপিয়ে দিচ্ছে ওর কাঁধে, কঠিন ভাষায় আদেশ করে যাচ্ছে পরবর্তী পদক্ষেপের। আর ও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে প্রতিটা শব্দ। বার বার ‘ইয়েস স্যার’ ‘ইয়েস স্যার’ বলে নিজের একাগ্রতা জাহির করে চলেছে। কিন্তু কলিংবেল একটানা বাজতে থাকায় ধীরে ধীরে তুহিনের মস্তিষ্ক বুঝতে পারল এটা আসলে কলিং বেলের আওয়াজ। কিছু একটা ভেবে ঝট করেই উঠে বসল ও। ঘুম যেনো দৌঁড়ে পালালো। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে এগারোটা বাজে। চোখ বন্ধ করে একটা আফসোসের শ্বাস নিল তুহিন। মনে মনে বলল,

‘ তুহিন, আজ তুই শেষ।’
তাড়াতাড়ি উঠে টিশার্ট পরে নিয়ে দ্রুত চলে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখল ইরা দাঁড়িয়ে আছে ভ্রু কুঁচকে। তুহিনকে দেখে ইরা হাত ভাঁজ করে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল। লম্বা-চওড়া, হলুদ ফর্সা, এলোমেলো চুলের ছেলেটাকে দেখে নিল ভালোভাবে। তুহিন একটা বোকা হাসি দিয়ে প্রেয়সীর মন ভোলানোর চেষ্টা করল বটে কিন্তু তাতে বিশেষ কোন লাভ হল না। ইরা নিজের হাতের ঘড়ির দিকে ইশারা করে বলল,

‘ ক’টা বাজে?’
তুহিন বুঝে গেছে অবস্থা বেগতিক। কিন্তু পরিস্থিতিতো সামাল দিতে হবে। তাই একটু হেসে বলল,
‘ সাড়ে এগারোটা। কেন? তোমার ঘড়ির ব্যাটরি শেষ? ওয়েট আজই লাগিয়ে দেব। ন-না না, নতুন ঘড়িই কিনে দেব।’
ইরা তুহিনকে দুহাতে ঠেলে ভেতরে নিয়ে নিজেও ভেতরে গিয়ে বলল,
‘ আজ আমাদের একসাথে ব্রেকফাস্ট করার কথা ছিল। সারাদিন ঘোরার কথা ছিল। আর তুমি? তুমি ঘুমিয়েই বারোটা বাজিয়ে দিলে? এরকম ছুটি তুমি রোজ পাও তুহিন?’
তুহিন অসহায় মুখ করে বলল,

‘ সরি সুইটহার্ট। কী করব বলো? কাল ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছে। তবুও আমি এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু _’
‘ কিন্তু এলার্ম তোমার কানে ঢোকেনি। তাইনা?’
তুহিন মুখ কাচুমাচু করে বলল,
‘ ভীষণ ক্লান্ত ছিলামতো তাই হয়তো এরকমটা হল। স্যারকে সব বুঝিয়ে তবেই না আসতে পেরেছি।’
ইরা টলমলে চোখে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আর আমি? আমার কথাটাও তো মাঝেমাঝে ভাবতে পারো তুহিন? অনেকদিন পর আজ ফ্রি ছিলে তুমি।’
তুহিনের এবার একটু খারাপ লাগল। মেয়েটার মলিন মুখ ওর ভালো লাগেনা। সে এগিয়ে গিয়ে ইরার দু গালে হাত রেখে বলল,
‘আমার মনে হয় কালকেও আমি ফ্রি থাকব। কাল যাব আমরা ঠিকাছে?’
ইরা হাত সরিয়ে অভিমানী গলায় বলল,

‘ কাল আবার তোমার কাজ থাকবে আমি জানি। দেখো আজই নতুন কেসের কল চলে আসবে। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে।’
তুহিন তাকালো ইরার দিকে। অভিমানী মুখটা কী মিষ্টি লাগছে! লাল থ্রিপিস পরে আছে। লালটা বেশ মানায় মেয়েটাকে। তুহিন পেছন থেকে ইরাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আচ্ছা। আজ তাহলে আমরা বাড়িতে সময় কাটাই? একসঙ্গে। বাইরে অনেক নয়েস আর পলুউশন। প্রেম প্রেম ভাব আসেনা। তার চেয়ে এখানেই ভালো না? কেউ থাকবেনা। শুধু তুমি আর আমি। ‘
ইরা এবার ঠোঁট চেপে হাসল কিন্তু তুহিনকে বুঝতে দিলোনা। তুহিনের হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
‘ আজ খালা নেই যে? কোথায় গেছে?’
তুহিন ইরাকে জড়িয়ে রেখেই হালকা দুলে বলল,

‘ দু’দিনের ছুটি নিয়েছে।’
‘ খাওয়া হয়নি নিশ্চয়ই?’
‘ উহুম।’
‘ খিদে পায়নি?’
তুহিন আল্লাদি কন্ঠে বলল,
‘ খুব পেয়েছে।’
ইরা এখনো রেগে থাকার অভিনয় করেই বলল,

‘ ছাড়ো আমি রান্না করছি। একসঙ্গে খাবো। ঢং ছেড়ে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।’
তুহিন ইরার কানের পিঠে চুমু খেয়ে ছেড়ে দিল তাকে। ইরা মুচকি হাসতে হাসতে চলে গেল রান্নাঘরে। তুহিন সেদিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এরপর ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দেখে ইরা ওড়না কোমরে বেঁধে রান্না করছে। হাতে খুন্তি। তুহিন ভাবছে যদি ইরা জানতে পারে কেন আজ উঠতে দেরী হয়েছে ওকে আস্ত রাখবে না আজ আর। ঐ খুন্তি দিয়েই পিটিয়ে ছাড়বে। সেই দৃশ্য কল্পনা করতেই শুকনো ঢোক গিলল তুহিন। গোয়েন্দা বিভাগের সবচেয়ে সাহসী ইনভেস্টিগেটর নাকি এই সাধারণ এক রমনীকে এতো ভয় পায়। ভাবা যায়!

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ২