রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১৮

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১৮
লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)

___” কি বলতে চাইছিস তুই?”(ভ্রু কুঁচকে)
অয়ন কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,
___” মিশমির টাকা আর রূপ দেখে পাগল হয়ে গেছিলাম আমি। মিশমি আমাকে আমার এত বছরের ভালোবাসা অনুকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। মিশমিও আমাকে পছন্দ করতো। ওর সাথে দেখা হয় ওর কলেজের সামনে। যখন আমি আমার বোনের সাথে দেখা করতে ওর কলেজে যাচ্ছিলাম। তখন ওকে আমার ভালো লেগে যায়। তাও তোর কথা মাথায় রেখে আমি ওকে ভোলার চেষ্টা করি। কিন্তু ও আমাকে পছন্দ করে ফেলে।তাই ওর বাবার টাকার লোভ দেখিয়ে ও আমার সাথে রিলেশনশিপ করার প্রস্তাব দেয়। আমি জানি না আমার কি হয় আমিও রাজি হয়ে গেছিলাম।”

এতটুকু বলে থামলো ও। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। শুধু নিম্ন স্বরে বললাম,
___” টাকার লোভে…ছিহ অয়ন। তোর থেকে এটা আশা করিনি। ভালোই হয়েছে যে তোকে আমি বিয়ে করিনি। নয়ত টাকার জন্য আমাকে বিয়ের পরেও ছেড়ে দিতি।”
অয়ন আমাকে থামিয়ে দিলো। আমার কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

___” আমাকে মাফ করে দে অনু। ওর সাথে বিয়ের পর আমি বুঝতে পেরেছি ও কেমন। ১০-১২ জন ছেলের সাথে দিনে একশ এক বার ডেটে যায় ও। ওকে কিছু বলারও সাহস নাই আমার। ওর বাবা আমাকে থ্রেট করে।নিজে একা একা থাকতাম।তোরা কেউই ছিলি না সেই মেডিকেলে। এরপর থেকে আস্তে আস্তে তোর শূন্যতা অনুভব করতে লাগি আমি। বুঝতে পারি, মিশমির মোহে ডুবে নিজের আসল ভালোবাসাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি।”
আমার কেন যেন মায়া হলো।তাও পাত্তা দিলাম না। মুখ ঘুরিয়ে বললাম,

___” আমার কোল থেকে মুখ উঠা প্লিজ। এটাকে অপবিত্র করিস না। এখানে আমার সাদি রোজ ঘুমায়। প্লিজ। আমার অনুরোধ।”
অয়ন মুখ তুললো। আমার দিকে চোখ রেখে বললো,
___” ভেবেছিলাম তুই তো অন্যকারো হয়ে গেছিস। এখন আর তোকে পাওয়ার কোনো আশংকা নেই। কিন্তু যখন তোর সাথে সাদিকে দেখতাম,আমার বুকটা পুড়ে ছাড়খার হয়ে যেত। বুঝতাম,আমার সাথে মিশমিকে দেখে তোর কি অবস্থা হয়েছিল। ”
আমি তাচ্ছিল্য হাসলাম। তারপর বললাম,

___” তাও তো বুঝেছিস। এটাই অনেক। এখন আমাকে এখানে কেন এনেছিস?”
অয়ন উঠে দাঁড়ালো। চোখ মুচতে মুছতে বললো,
___” কিন্তু পরে আমি বুঝতে পারি,যে এখনো তোর সাথে থাকা সম্ভব। ”
___” মানেহ?”( ভ্রু কুঁচকে)
অয়ন লাইটটা জ্বালিয়ে দিলো। এটা একটা বেডরুম। চারিদিকে সুন্দর করেই সজানো।শুধু পর্দাগুলো লাগানো বলে বাহির থেকে আলো আসছে না। অয়ন চারিদিকে দেখাতে দেখাতে হাসতে হাসতে বললো,

___” দেখ! আজ থেকে আমরা এখানে থাকবো। শুধু তুই আর আমি। কত মজা হবে বল? তোকে আমি গান শুনাবো। সাদির মত দুষ্টু মিষ্টি আবদার করবো। আর তুই তো আমাকে ভালোবাসিস তাই না? তুই আর আমি একসাথে এখানে থাকবো।”
ওর কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।এ কি পাগল হয়ে গেছে নাকি? আমি হালকা চেঁচিয়ে বললাম,

___” কিহ? মাথা ঠিক আছে তোর?”
___” হ্যা। আমার আবার কি হবে। নিজের ভালোবাসাকে আগে মর্যাদা দিতে পারিনি। আজ দিবো।”(মুচকি হেসেে)
আমি রেগে গেলাম। ধস্তাধস্তি করতে করতে বললাম,
___” হোয়াট দা হেল অয়ন। জাস্ট লিভ মি। বাঁধন টা খোল বলছি।”
___” অনু..”
___” একদম চুপ। তুই একজন বিবাহিত পুরুষ আর আমি একজন বিবাহিত নারী। তোর বউ আছে আর আমার বর। একসময় তোকে আমি ভালোবাসতাম,তুই আমাকে কখনো ভালোই বাসিসনি অয়ন।কিন্তু তুই আমাকে ঠকালি। আর এতদিন পর এসে তুই আমাকে ভালোবাসার মর্যাদা শিখাচ্ছিস?”
অয়ন ছল ছল চোখে বললো,

___” এরজন্য তোর থেকে সরি চেয়েছি তো অনুপাখি। আবারো আমায় আপন করে নে না।আর আমি তোকে ভালোবাসি।”
___” তুই আমাকে ভালোবাসতি না অয়ন। তুই টাকাকে ভালোবাসিস। আর আমি এখন বিবাহিত। আমি সাদিকে ভালোবাসি। তোর সাথে থাকা তো জাস্ট ইম্পসিবল। খোল আমায়।”
বলেই নিজের বাঁধন খোলার চেষ্টায় লেগে গেলাম আমি। অয়ন রেগে গেলো। আমার হাত চেপে ধরে বললো,
___” একদম আমার থেকে পালানোর চেষ্টা করবি না। তুই শুধু আমার। ”
___” ছাড় আমায়।”
আমি ধস্তাধস্তি করতে করতে কাত হয়ে পড়ে গেলাম। কাঁধে ব্যাথা পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম,
___” আহ!”

অয়ন কিছু না বলে আমাকে খুলে দিলো। এত ভালো হয়ে গেল? যাকগে। আমি পালাতে পারলেই হলো। ও আমাকে খুলে দিতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। শাড়িটা ঠিক করে নিয়ে বললাম,
___” তোর সাথে যেন আর কোনোদিন দেখা না হয়।”
বলেই চলে যেতে নিচ্ছিলাম। ওমনি অয়ন পিছন থেকে আমার হাতটা চেপে ধরলো। আমি পিছনে ফিরে ভ্রু কুঁচকে বললাম,
___” হাত ধরলি কেন তুই আমার? ছাড়।”
অয়ন মলিন হেসে বললো,

___” এভাবে চলে যাবি?”
আমি কিছু না বলে হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। ও আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কাঁধ চেপে বললো,
___” অনু তুই বুঝতে পারছিস না। তুই আমাকে ভালোবাসিস। আমার অনুপাখি তুই।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
___” কি দেখে মনে হলো যে আপনাকে আমি ভালোবাসি?”
___” মনে নেই তোর? তোকে আমি বউ বানাতে চাইতাম। তুই কেমন লজ্জা পেয়ে আমার বুকে মুখ লুকাতি?”
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,
___” এগুলো তো মজা ছিল অয়ন। আমার মজাটাকে তুই সত্যি ভেবে নিলি? ইশ!কি হাসির বিষয়।”
অয়ন কাঁদো কাঁদো অবস্থায় বললো,

___” প্রতিশোধ নিচ্ছিস?”
___” নাহ। আমি প্রতিশোধ নিতে জানি না। আমি শুধু সত্যিটাই বললাম। যা তুই সেদিন আমায় বলেছিলি।”
___” আমি তখন অন্ধ ছিলাম অনু। আমি টাকার লোভে…”
___” ব্যস। আর বলতে হবে না। তখন যেমন ছিলি এখনও তেমন হয়ে যা। আমাকে শান্তিতে থাকতে দপ তো!”
___” অনু প্লিজ… “(কান্না করে)
___” আমি সাদিকে ভালোবাসি। আমার মনে শুধু সাদি।”
অয়ন আমাকে ছেড়ে দিলো।দুহাত দিয়ে কান চেপে বললো,

___” না প্লিজ। এটা বলিস না। আমার খুব কষ্ট হয়। বুকটা ফেটে যায়।”
আমি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে চিল্লিয়ে বললাম,
___” আমি শুধু সাদিকেই ভালোবাসি। ওনার অধিকার আছে আমার উপর। আমার মনে শুধুই ওনার রাজত্ব। পাগলের মত ভালোবাসি আমরা একে অপরকে।”
___” অনু প্লিজ বলিস না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। খারাপ লাগছে। আমি তোর মুখে অন্যকারোর নাম নিতে পারছি না অনু।”

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন সাদি। আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে বললেন,
___” তুই ঠিক আছিস অনু?”
আমিও ওনাকে পেয়ে যেন নিজের আত্মা ফিরে পেলাম। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।চোখ বন্ধ করে বললাম,
___” আমি ঠিক আছি। আপনি ঠিক সময় এসেছেন। ”
উনি আমাকে সরিয়ে আচমকা একটা চড় মারলেন। আমি গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকালাম। উনি রাগী গলায় বললেন,

___” আমায় না বলে করা এই পাকনামোর সাজা তোকে ভুগতে হবে।”
আমি মাথা নিচু করে নিলাম। আসলেই অন্যায় করে ফেলেছি।ওনাকে জানানো উচিত ছিলো।
সাদি এবার অয়নের দিকে তাকালো। অয়ন তখন অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। সাদি আমাকে ছেড়ে অয়নের দিকে এগিয়ে গেলো। রাগী গলায় বললো,

___” তোর সাহস কীভাবে হলো আমার অনুকে এভাবে কিডন্যাপ করবার? ভাগ্যিস তুই আমার সন্দেহের লিস্টে ছিলি। তাই তো তোর ফোন ট্র্যাক করে তুই অবধি পৌঁছে গেছি। পুলিশকে কল করেছি। আসছে।”
অয়ন কিছু না বলে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ও ছলছল চোখে বললো,
___” আমি এতটাই অন্যায় করে ফেলেছি অনু? যে আমার দিকে তাকানোও যায় না? মানছি আমি ভুল করেছি। ভুলটা বুঝে তো মাফও চাইছি।”

___” মাফ চাইলে এটা হত না অয়ন। তুই আমাকে তুলে এনে আবার বিয়ে করতে চেয়েছিস। জোর করে তোর সাথে রাখতে চেয়েছিস।ভাগ্যিস আমি সাদিকে সবটা বলেছিলাম।”
অয়ন হাটু গেড়ে বসে পড়লো।আমার কাছে হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
___” ক্ষমা করে দে অনু। আমি পাগল হয়ে গেছিলাম। একবার টাকার লোভে আরেকবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে। আমায় ক্ষমা করে দে। অন্তত বন্ধু হিসেবে জায়গাটা দে অনু প্লিজ।”

অয়ন মাথা নিচু করে নিলো। সাদি পিছন থেকে এসে ওর কলার চেপে ধরে চিৎকার করে বললো,
___” এই কু*** বাচ্চা। তোর এত্ত বড় কলিজা। তুই আমার অনুকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাস।তুই আজকে শেষ।”
বলেই গাল বরাবর একটা ঘুষি দিলেন। অয়ন কিছু বলছে না। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সাদি গাল বরাবর আরেকটা দিলো। অয়ন তখনো আমার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে আর বলছে,
___” ক্ষমা করে দে না অনু। আমি অনেক দূরে থাকব তোর থেকে। অন্তত একবার দেখতে পারলেই আমার শান্তি।”
আমার খুব মায়া হলো। একসময় তো ভালোবাসতাম। আর ও তো আমার কাছে মাফও চেয়েছে। ওর চোখে অপরাধবোধ দেখেছি আমি। আমি সাদিকে থামিয়ে বললাম,

___” মাফ করে দিন না।”
সাদি আমার হাত ছাড়িয়ে রাগী গলায় বললো,
___” কিসের মাফ হ্যা? তোর ধারণা আছে ও কি করতে চাইছিল? পাগল ও?”
আমি ওনাকে টেনে সরিয়ে বললাম,
___” মাফ তো চেয়েছে। মাফ চাইলে মাফ করে দেয়াটাই উত্তম সাদি সাহেব। হইছে অনেক।আর পুলিশে দিয়ে ওর লাইফটা নষ্ট করারও মানে নেই।”

সাদি আমাকে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অয়ন আমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। ওর ঠোঁটের কোণে রক্ত লেগে আছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। হেসে হাত বাড়িয়ে বলাম,
___” হাই আমি অনু। ফ্রেন্ডস?”
অয়ন আমাকে অবাক চোখে দেখলো। হয়ত ভাবছে সেই প্রথম দিনের কথা। এভাবেই বন্ধুত্ব করেছিলাম আমরা। ও মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমরা হ্যান্ডশেক করে নিলাম। অয়ন হেসে বললো,
___” আবারো বিশ্বাস করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিস অনু। এবার নিজের কসম, তোর এই বিশ্বাস আমি ভাঙবে না।”
আমি হাতটা সরিয়ে নিলাম। সাদির হাত ধরে বললাম,

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১৭

___” যাওয়া যাক?”
উনি মুখটা ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি মুখ চেপে হাসলাম। এই লোকটা এমন কেন? আমি জোর করেই ওনার হাত চেপে ধরে হাঁটতে লাগলাম। আর মনে মনে ভাবছি, আজ মন থেকে একটা বড় পাথর নেমে গেলো। অয়নও নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে। অনেক তো হয়েছে ওর শাস্তি। এবার নাহয় ওকে মাফই করলাম! আর ওর চোখে আমি অপরাধবোধ দেখেছি। বন্ধুত্বের আরেকটা সুযোগ কি ওর প্রাপ্য নয়?

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১৯